যেদিন কামিলা লুন্ড এ-বাড়িতে এসে ঢোকে তখন তাকে দেখায় উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত। তার নামের শেষাংশ বিশ্বের একটি সেরা এয়ারপোর্ট সুইডেনের লুন্ডের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এবং আমরা সংগতভাবেই জিজ্ঞেস না করেও বুঝতে পারি ওর দেশ সুইডেন। সে যখন তার প্রিয় বান্ধবী স্পেনের ফিওনা ভেলভেডিয়ারের সঙ্গে উচ্ছলতা ছড়িয়ে গল্প করে তখন অক্টোবরের শীত-শীত দিনের বিষণ্ন আবহাওয়াতেও আমরা ক্লেয়ার হলের লোকেরা অনুভব করি উষ্ণতা। সেই কামিলাকেই মাসখানেকের মধ্যে কেমন মনমরা ফ্যাকাশে দেখাতে থাকে।
আমাদের কানাডীয় বান্ধবী ফ্রান্সিন ম্যাকেঞ্জি দুপুরের খাবার খেতে-খেতে আমাকে বলে, কামিলার বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কামিলা মায়ের বাড়িতে থাকবে কিন্তু ওকে ব্যয়নির্বাহের অর্থ নিতে হবে বাবার কাছ থেকে। এমন সংকটের মুহূর্তে উচ্ছলতা ছড়ানো দুরূহই বটে। পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েনে ক্লিষ্ট কামিলা তবু তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অভিসন্দর্ভ রচনায় যারপরনাই অভিনিবিষ্ট থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সুইডেন-ডেনমার্কের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ওর পিইচ.ডি গবেষণার বিষয়বস্তু। মাঝে-মাঝে ওকে দেখি ক্যামব্রিজ লাইব্রেরিতে। সোনালি চুলের কামিলা বইপূর্ণ ডেস্কে কিংবা কফি-ব্রেকের টেবিলে ওর দীর্ঘ চুলে ঝাঁকুনি দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে যখন কথা বলে তখন তাকে মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ। কিন্তু আমরা যারা ক্লেয়ার হলের বাসিন্দা তাদের প্রায় সকলেই জানি, ওর বিষণ্নতার পর্ব শুরু হয়ে গেছে।
অক্টোবরের শেষে আমরা শীত অনুভব করি। কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভীয় লোকেদের রক্ত কিংবা শরীরের চামড়া হয়তো সেই শীতকে তুচ্ছজ্ঞান করে। উলের সোয়েটার কি চামড়ার জ্যাকেট পরে বন্ধ জানালার ধারে বসে আমি বইয়ের পাতা ওলটাই অথচ দেখতে পাই কামিলা তখন পাতলা স্বচ্ছ লিনেনের টপস পরে বাগানের মরা রোদের মধ্যে একটা এলম গাছের নিচে কফি পান করে। ওর হাতে বই যদিও তা পারিবারিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কিত কোনো বই নয়। সে পড়ে মিশেল ফুকোর দ্য বার্থ অব দ্য ক্লিনিক। ডিম্বাকৃতির জানালায় বসে আমি ওকে সরাসরি দেখতে পাই। জানালা বন্ধ থাকায় কামিলা দেখতে পায় না আমাকে। আমি দোতলায়, কামিলা নিচের বাগানে। হ্যান্স অ্যান্ডারসনের কাহিনিতে যেসব রাজকন্যাদের দেখেছি কামিলা যেন অবিকল তেমনই। স্লিভলেস টপসের সঙ্গে পরেছে ডেনিমের একটা কমলা রঙের থ্রি-কোয়ার্টার। ওপরের গোলাপি এবং নিম্নের কমলা রঙে মণ্ডিত কামিলাকে অকস্মাৎ স্থির করে দিলে সম্পূর্ণ নিসর্গের সহযোগে সে ফুটে উঠতে পারে শুরাটের ছবির মতোন। আমাদের বাড়িতে ওর চেয়ে সুন্দরী আর কেউ ছিল না। ওর বান্ধবী ফিওনা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সামান্থা অথবা চীনের ফে-ইউকে ওর কাছাকাছি রাখা যেত; কিন্তু ওদের কেউই কামিলাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নয়। দৃষ্টির সীমানায় নারীর এমন নান্দনিক উপস্থিতিকে অবহেলা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। পঠনে মনোসংযোগ আমার কঠিন হয়ে পড়ে। মনে-মনে বলি, কামিলা তুমি আড়াল হয়ে গেলে আমার সুবিধে হয়, আমি আমার অ্যাসাইনমেন্টটাতে এগোতে পারি। ডেটলাইন পেরোবার আর মাত্র তিনদিন বাকি অথচ আমি তখনো লেখাই শুরু করিনি। আমার গবেষণা-নির্দেশক রবার্ট স্টুয়ার্ট ম্যাকগ্রেগরকে যতই অনুনয়-বিনয় করি না কেন তিনি কোনো ওজর-আপত্তি শুনবেন না। লোকটা আবার সংস্কৃত এবং বাংলাও জানে। কাজেই যে-ভাষাতেই অনুরোধ করি না কেন প্রত্যাখ্যানের উপযোগী শব্দের তাঁর অভাব হবে না। আমার অন্য মন বলে, এমন রূপসী একটি কন্যে তোমার দৃষ্টির সীমানায় আর তুমি ডেটলাইন-ম্যাকগ্রেগর এসব দুর্ভাবনার কাদায় আটকে যেতে চাইছো। কেন, তুমি রাত জাগবে, জেগে পুষিয়ে নেবে দিনের ক্ষতি! আমার গবেষণার বিষয় স্টাডি অব মনসামঙ্গল ট্র্যাডিশন ইন বেঙ্গল। কী অদ্ভুত যোগাযোগ! একই ধরনের কাজ ইতঃপূর্বে করেছেন সুইডেনেরই মৈতি – চণ্ডীমঙ্গল নিয়ে। আর আমি করবো মনসাকে নিয়ে। মৈতি সুইডেনের, মনসা নারী – তাই তো কামিলার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে! জিত হয় আমার অন্য মনেরই।
কত হতে পারে কামিলার বয়স, কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে নিশ্চয়ই। টপসের নিচে কিছুই পরেনি সে। আমার দৃষ্টিসীমায় সে স্থাপিত সত্তর ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে এবং ওর সঙ্গে আমার দূরত্ব মোটামুটি পঞ্চাশ ফুট। কামিলা সামগ্রিকভাবেই থাকে আমার চৌহদ্দিতে যদিও ওর ডান দিকটাই পুরোপুরি দেখতে পাই আমি। তাতে করে অন্তর্বাসহীন ওর সুপুষ্ট উন্নত স্তনজোড়া সেই পাতলা লিনেন ভেদ করে আমার চোখের জমিনে বিদ্ধ হতে থাকে। হঠাৎ-হঠাৎ চুল কি ঘাড়ের ঝাঁকুনিতে তার শুরাটীয় কি সেজানীয় স্তনজোড়া কেঁপে উঠলে আমার মনে হতে থাকে, এরই নাম বুঝি যৌবন-তরঙ্গ। আসলেই কি কামিলা সুন্দর, যতটা সুন্দর আমার তাকে মনে হয়! নাকি আমার পৌরুষেয় বিদ্ধতায় সে সাধারণের আয়তনে থেকেও অসাধারণ হয়ে উঠেছে! কামিলার অনুপম সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি আমি, যদিও আমার মনে পড়ে ফ্রান্সিনের কথা। লাঞ্চে না হলেও ডিনারে আমাদের প্রায় সকলেরই দেখা হয়ে যায় ডাইনিং কক্ষে। প্রায়ই দেখতে পাই কামিলা একটা বিরাট গামলা নিয়ে বসেছে টেবিলে। সালাদ পাতা সবুজ কি লাল আপেল লাল মুলো সেদ্ধ মটরশুঁটি এইসবে গামলা ভর্তি করে ওপরে খানিকটা নুন আর গোলমরিচ ছিটিয়ে দিয়ে কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে থাকে কামিলা। তখন হয়তো টিভিতে সান্ধ্যকালীন সংবাদ পাঠ হচ্ছে কি কামিলা তার প্রিয় খেলা আইস-হকি দেখছে এক ধ্যানে। কামিলার খাদ্যোপকরণ দেখে আমার ধারণা হয় ওর লাবণ্য-সৌন্দর্য আর মেদহীনতার রহস্য তাহলে এই খাবার! কিন্তু ফ্রান্সিন একদিন আমার ভুল ভেঙে দেয়। উইকএন্ডের সকালে আমরা দুজনেই সিটি সেন্টারে গিয়েছি সাপ্তাহিক কেনাকাটার জন্যে। কেনাকাটা সেরে ম্যাকডোনাল্ডে চিকেন বার্গার খেয়ে ঘরে এসে বিশ্রাম কিংবা টিভিতে মুভি দেখা। ট্রিনিটি কলেজের লাগোয়া গলিটা পেরোতেই নিউটনের আপেল গাছটার পাশ ঘেঁষে যেতে-যেতে ফ্রান্সিন বলে, কামিলার দুঃসময় যাচ্ছে। চোখেমুখে প্রশ্নচিহ্ন আমার। ফ্রান্সিন বলতে থাকে, কামিলা যেটুকু বৃত্তির অর্থ পায় সেটাতে সে কুলিয়ে উঠতে পারে না। প্রতি সপ্তাহে হলে গিয়ে মুভি দেখা কি রোজ-রোজ কার্লসবার্গ-হাইনিক্যান এবং মাঝে-মাঝে শেরি কি ওয়াইন খাওয়া একনাগাড়ে চালিয়ে যাওয়া মুশকিল। তার ওপর আর্টস থিয়েটারে মস্কোর বলশয়ের সোয়ান লেক কি বুনুয়েলের রেট্রোসপেক্টিভ দেখতে গেলে বাজেট ঠিক রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু কামিলা সবই করবে। ফলে, তার খাবারদাবারের ব্যয়সংকোচন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফ্রান্সিনের কথা আমার অবিশ্বাস্য মনে হয় না।
ভোরে উঠেছিলাম সেদিন। একটা দুর্লভ বইয়ের সন্ধান পেয়েছি ক্যামব্রিজ লাইব্রেরির আর্কাইভ কক্ষে – ডাচ নাবিক মিস্টার গ্লেনিয়াসের লেখা এ নিউ ভয়েজ টু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ। ১৬৮২ সালে মুদ্রিত বইটি পেয়ে আমার সে কী আনন্দ। ফরাসি ভাষায় লেখা হলেও তাতে আমার দেশের নদী-সমুদ্র ছুঁয়ে যাওয়া ওলন্দাজ নাবিকের শব্দরাজিতে কান পাতলে শোনা যায় কতকাল আগেকার মাটিঘেঁষা লোকেদের জীবনের স্পন্দন। আমি খানিকটা ফরাসি জানি। ভাবি, আমাদের হলের ফরাসি থমাস দিদিয়েরের সহায়তা নিলে গ্লেনিয়াসের সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার তত কণ্টকাকীর্ণ হবে না। ভাবা যায়, নাবিক গ্লেনিয়াসের জাহাজ ঢুকে পড়েছে বঙ্গোপসাগরের চ্যানেলে যেখানটায় নদী এবং সমুদ্রের পারস্পরিক সখ্য উঁচু-নিচু ঢেউয়ে জানান দিয়ে যায়। হাতিয়া-সন্দ্বীপ হয়ে সেই জাহাজ ছুঁয়ে যেতে থাকে তিনশো বছরেরও অধিককাল আগেকার বাঙালি কবি আবদুল হাকিমের জীবন-জনপদ। নদীর তীরে-তীরে ছুটে আসে উৎসাহী লোকেরা। অবাক হয়ে তারা দেখতে থাকে গ্লেনিয়াস ও তদীয় বাহিনীর জাহাজ আর জাহাজের মধ্যকার ভাসমান চলমানতা। চোখে দুরবিন লাগিয়ে হাতিয়া-সন্দ্বীপের গ্রামীণ মানুষদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন গ্লেনিয়াস। সেই বিবরণ তাঁর বইয়ে স্পন্দিত এক জীবন জাগিয়ে তোলে। কত-কত যুগের আগেকার সেইসব ছবি – শব্দের পর শব্দের অনুলিপি দিয়ে ভরিয়ে তুলি আমার খাতার পৃষ্ঠাবলি। ক্যামব্রিজ লাইব্রেরির দরজা খোলে ঠিক নটায়। নটাতেই আমি ঢুকি রোজ। কেটলি থেকে চিনেমাটির কাপে চা ঢালতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কামিলা লুন্ড ডাইনিং কামরায় ঢুকতে-ঢুকতে সম্ভাষণ জানাচ্ছে আমাকে। বলতে গেলে আচমকাই তার কণ্ঠে আমার প্রশংসা শুনে নভেম্বরের সকালে আমি যারপরনাই উল্লসিত বোধ করতে থাকি ভেতরে-ভেতরে। আমার প্রশংসা মানে আমার চায়ের প্রশংসা। কামিলা এবং ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের প্রায় সকলেই স্ব-স্ব ধরনে চা বানিয়ে খায় ক্লেয়ার হলের ডাইনিংয়ে এসে। কয়েকটি দেশের লোকেরা খায় গ্রিন টি। আবার কিছু দেশের লোকেরা দুধ চা-ই খায় কিন্তু আমাদের মতো দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে চা-পাতা মিশিয়ে না – গরম দুধ এবং লিকার দুটোই থাকবে পাত্রে, প্রয়োজন ও অনুপাতমতো ঢেলে নিতে হবে। কিন্তু সেই চায়ে আমাদের, মানে ভারতীয় বা বাঙালিদের, বানানো চায়ের চমৎকার রংটা পাওয়া যাবে না। এই রংটাই হলো আসল – বলছিল কামিলা। তখন আমি তাকে পাত্র থেকে বাড়তি চাটুকু ঢেলে দিলে সে পরমানন্দে তার ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট আর গোলাপি গালের আভা ছড়িয়ে পান করতে থাকে সেই চা। এরকম এক অনবদ্য সুন্দরীর মুখে আমার প্রশংসা এবং আমার বানানো চায়ের প্রশস্তি আমাকে খানিকটা অহংকারী করে বইকি। কামিলা খুব সুন্দর করে বলতে পারে – ‘তোমার চা দেখলে বোঝা যায়, হ্যাঁ, ঘরে কেউ চা খাচ্ছে মানে চা-খাওয়ার সংবাদটা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। আর এর যে রং সেটা আমাদের বিবর্ণ চায়ের মধ্যে কখনোই মিলবে না।’ কামিলা আমার চায়ের নাম দিয়েছে ‘বাংলা টি’। অল্পদিনের মধ্যেই ক্লেয়ার হলে প্রচারিত হয়ে যায় ‘বাংলা টি’র সুনাম। আমাকে যেতে হবে লাইব্রেরিতে ঠিক নটায়। গ্লেনিয়াসের বই থেকে যত দ্রুত সম্ভব অনুলিপি করে নিতে হবে। এখনো বাকি তিন পৃষ্ঠা। হাতিয়া-সন্দ্বীপের লোকেরা উপকূলে এসে ভিড় করেছে বিদেশিদের দেখে। দূর থেকে দেখা হলেও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে সেই ডাচ নাবিককে। কিন্তু কামিলা আমাকে দেরি করিয়ে দেয়। ল্যাভেন্ডারের অথবা পিচ-গোলাপ মেশানো বিভালগারির মিষ্টি একটা ঘ্রাণ কামিলার শরীর থেকে অপূর্ব দ্যুতির মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমনকি সেই সুঘ্রাণ আমার বাংলা চায়ের ঘ্রাণের ওপরেও যেন রাজত্ব করতে শুরু করে। কিংবা হয়তো ল্যাভেন্ডার কি বিভালগিরি আর বাংলা চায়ের ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধন। কামিলা আমার মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটায় এবং লাইব্রেরিতে যেতে আমার দুর্ভাগ্যে নির্ধারিত হয় নিশ্চিত বিলম্ব। কালক্রমে ক্লেয়ার হলের বাসিন্দারা একে-একে জড়ো হতে থাকে ডাইনিংকক্ষে। এক পর্যায়ে নৈকট্য থেকে ছিটকে পড়ে কামিলা চলে যায় আমার আওতার বাইরে। স্কটিশ সাইমন দক্ষিণ আফ্রিকীয় ক্রিস অস্ট্রেলীয় রিচার্ড ফরাসি থমাস আইরিশ শ্যান সবাই কামিলার ভক্ত। ব্যস্ততার মধ্যেও কামিলাকে পেলে তাদের কেউই আর সময়াভাবে ভোগে না। আসে জার্মান মার্গারেট চৈনিক ফে-ইউ কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকীয় বেথান। মার্গারেট আমার পাশ ঘেঁষে বসলে আমি তাকে মৃদু কণ্ঠের সম্ভাষণ ছুড়ে দিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসি। মার্গারেটকে আমার পছন্দ নয়। কারণ সে হলোকস্টকে বলে অতিরঞ্জন এবং অধিকাংশ জার্মানদের মতো তারও ধারণা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিতে ভার্সাই-চুক্তিতে জার্মানির প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বেহালা আমার পছন্দ কিন্তু মার্গারেট যখন তার কোণের ঘরটাতে মাঝে-মাঝে রেয়াজ করে, তার সেই রেয়াজের ধ্বনি নিচ থেকে ঠিক মাথার ওপরকার আমার ঘরে এসে ঢুকলে আমার মনে হতে থাকে সে-ধ্বনি হের-হের শব্দ তুলছে। যদিও হিটলার ইতিহাস, আমার মনে হতে থাকে যা-ই সে বাজায়, শোপ্যাঁ কি শোস্কাকোভিচ, ব্রাহম্ কি চায়কোভস্কি সব-ই ভাগনার হয়ে যায় আর আউশভিচ-ডাচাউয়ের ক্যাম্পগুলোতে মিশে যেতে থাকে ইহুদিদের ছাইয়ের সঙ্গে। মার্গারেটকে আমি সহ্য করতে পারি না। মার্গারেটের সেই বেহালার চাইতে বরং হাজারগুণ ভালো যদি কামিলা একেবারে নিশ্চুপ হয়েও বসে থাকে এলমের নিচে কি চেরির ঝোপগুলির কাছে।
কামিলার আনন্দে প্রত্যাবর্তন আমার মধ্যে জাগিয়ে দেয় ভয় ও স্বস্তি দুটোই। স্বস্তি এজন্যে, এমন জীবনপ্রদ সৌন্দর্যের উৎস একটি আশ্চর্য ঝরনাধারা মুহূর্তে মুহূর্তে কেবলই বিষাদের ঝলকানি দিয়ে আমাকে আহত করবে, তা আর ঘটবে না। তার পরিবর্তে এমনকি রোদ-না-ওঠা দিনেও কেবল সামীপ্য দিয়েই সে কামিলা সম্পূর্ণ অচেনা দূরতম এক ভূখণ্ডের এক মানবকে তার উপস্থিতির ঐশ্বর্য দিয়ে ভুলিয়ে দেবে তার দেশ-সমাজত্যাগী বিচ্ছিন্নতার বেদনা। আরো মহার্ঘ্য থাকে। কোনো এক মেঘাচ্ছন্ন প্রহরে হয়তো মেয়েটিরও মনে পড়েছিল তার দেশকে বা মা-বাবাকে। তার বাবা-মা পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও দুজনেই তারা কামিলার সঙ্গে সংযুক্ত। সেই সংযুক্তির বাস্তবতা করুণ বলেই হয়তো তার মন খারাপ করে। রান্নাঘরে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে আমি চা বানাই। কামিলা আমাকে বলে, ‘তোমার ‘বাংলা টি’টা আমাকে একটু শিখিয়ে দাও না!’ আমি আকাশের চাঁদ পাই নাগালে। চা-বানানো আবার একটা কাজ যা কি না শিখিয়ে দিতে হয় – মনে-মনেই বলি। তবে, বাস্তবে আমি বেশ কায়দা করে বঙ্গদেশীয় কায়দায় চা-বানানো শেখাতে থাকি কামিলাকে। তখন কামিলা আমার একেবারে কাছাকাছি। এতটাই কাছাকাছি যে আমি তার মিষ্টি শ্যানেল নম্বর ফাইভের সুবাস পাই। সেই সুবাস সহসা যেন লাফ দিয়ে কামিলার আভাময় শরীর থেকে আমার শরীরে এসে ঢোকে। উতরানো দুধের ক্রুদ্ধ ভঙ্গি দেখার জন্যে গ্যাসের চুলোর ওপর রাখা পাত্রের খুব কাছে মুখ বাড়ালে কামিলার সোনালি চুলের তীরের বিদ্ধতা আমি অনুভব করি। তখন কোনো বাড়তি আবেশও তৈরি হওয়া সম্ভব। কিংবা আমার পাকোরাবান আর কামিলার শ্যানেল মিলে দুই বিপরীত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে স্থাপিত হয়ে যায় কোনো অদৃশ্য সংযোগ। আরো বিস্ময়কর, সাটিনের টপসের কামিলা অন্তর্বাসশূন্য। ওর নারীত্বস্বাতন্ত্র্যের অন্যতম বিশেষত্ব তার দুই স্তন পৃথিবীর অনুপম সম্পদের মতো উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে আর আমি উত্তপ্ত দুধের ঘ্রাণ, দুই রকম পারফিউমের এবং কামিলার শরীরের মাদকতাপূর্ণ ঘ্রাণের মহিমা একটাকে আরেকটা থেকে আলাদা করতে পারি না। মুখে মৃদু হাস্যাভাস ফুটিয়ে উত্তপ্ত দুধের মধ্যে দুই চামচ চাপাতার গুঁড়ো ঢেলে দিলে আমার সেই তৎপরতায় উৎসাহ জুগিয়ে কামিলা বলে, ‘তোমার বাংলা টি’র আসল বিষয়টা হলো দুধের তপ্ততা। দুধ ভালো করে না উতরালে কিন্তু চা-পাতার রংটা আসবে না।’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়াই। তারপর ছাঁকনিতে ছেঁকে নিয়ে কামিলাকে চা পরিবেশন করি সুন্দর পোরসিলিনের কাপে।
শংকাও হয় আমার। অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড আর কামিলা অনেকটা সময় ধরে বিশ্বরাজনীতি মধ্যপ্রাচ্য এসব বিষয়ে আলাপ করে। রিচার্ডের বিষয় রাজনীতি বিজ্ঞান। তাই কামিলার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে তার আলাপ সহজ ও সাবলীল হয়। কিন্তু আমার অন্য মন দেখার খোঁড়ল থেকে নিষ্কাষণ করে পর্যবেক্ষণ। ফলে, আমার ধারণা হয়, কামিলা আর রিচার্ড দুজনের মধ্যেই না একটা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। সেটা মনে করাটার পেছনে যুক্তি ছিল। রিচার্ডের বউ শার্লি থাকে কানাডায়। সামনের মাসে ওদের পরিকল্পনা ছিল দাদির নব্বই বছরের জন্মোৎসব পালন করবে। কিন্তু পরশু হ্যালিফ্যাক্স থেকে খবর এসেছে তার দাদির পরলোকযাত্রার। কাজেই সে উড়াল দিয়েছে কানাডায়। রিচার্ডের কোর্সওয়ার্ক পরীক্ষা ছুটি নেওয়া যেত। কিন্তু তাতে করে তিন মাস পিছিয়ে যাওয়া হবে। তিন মাস বিলেতে থাকার খরচ অনেক। দাদি যদি তার নিজের হতো তাহলে হয়তো একটা কথা ছিল। শার্লির প্রস্থান এবং সেখানে কামিলা-রিচার্ডের নবতর সংলগ্নতার সূচনা আমাকে খানিকটা উদ্বিগ্ন করে বইকি। যদিও আমার তা হওয়া উচিত নয়। পৃথিবীতে সবাই স্বাধীন, সবারই রয়েছে স্ব-স্ব অভিরুচি। এসব ভাবতে-ভাবতে আমি অনেকটা রাত করেই আমার অ্যাসাইনমেন্টের জগতে নিমগ্ন হই। হেমন্তের রাত। না গরম না ঠান্ডা – এমন একটা প্রীতিকর প্রাকৃতিক পরিবেশে আমি আমার জানালাটা আস্তে খুলে দিলে প্রতিবেশী বাড়ির আপেল গাছ থেকে একটা ফলপ্রসূ ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। বাইরেটা কেমন যেন রহস্যময় লাগে, যেন পটক্ষেপটা অন্য দুনিয়ার। দুই-তিন রকমের বেরি ফলের ঝোপ পেরোলে একটা সরু পথ আর সেই পথের লাগোয়া রবিনসন কলেজের মাঠটা। আমি ক্রমে দৃষ্টি মেলে দিতে থাকি দূরে। কয়েকটি জোনাকি এদিক-ওদিক করতে করতে উড়ে যেতে থাকে পাইনগাছগুলির দিকে। দূর থেকে আরো দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা আমার মনে হয় দূরের আকাশে জ্বলে দিনের মতো আলো অথচ আমার সামনেকার আকাশে না-আলো না-ছায়া। পৃথিবী আসলেই বর্ণিলতায় ভরা। দৃষ্টি দূর থেকে দূরতরের দিকে ধাবিত হতে থাকলে আমি কিছুটা সময়ের জন্যে নিকটের বিষয়ে সংবিৎহারা হই। ফলে আমারই জানালার নিচে আমাদের হলের বাগানে জোৎস্নার অকৃপণ আশীর্বাদ গায়ে মেখে কেউ ধনী হতে থাকলে আমি তার নাগাল পাই না। তবে একটা মৃদু শব্দে প্রথমে চমকে এবং পরে হতবাক হয়ে লক্ষ করি, চাঁদের ঝাপসা আলোয় বাগানের ঝোপের গা-ঘেঁষে রিচার্ড আর কামিলা। একটু এগিয়ে জানালায় ঝুঁকলেই ওদের দেখতে পাবো কিন্তু আমি সুকৌশলে দৃষ্টির ক্যামেরা তাক করি। ওদের পক্ষে সম্ভব হয় না আমাকে লক্ষ করা কিন্তু আমি তাদের দেখি।
ওদের দুজনেরই পরনে স্বচ্ছ চাঁদের আলোর পোশাক। কামিলার পাশের দেশের হান্সকে মনে পড়ে। ‘লিটল মারমেইড’ না, ‘কদাকার হাঁসের ছানা’ না, আমার মনে পড়তে থাকে ‘এমপেররস নিউ ক্লথে’র কথা। মনে পড়তেই কিশোরবেলায় পড়া সেই গল্প করোটির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। নিউ ক্লথ মানে নতুন পোশাক মানে জন্মদিনের পোশাক মানে পোশাক-না পোশাক – হা-হা-হা। কী যে সেই গল্প হান্সের! আমার ঘুম পায়। হলের দুয়েকটি ঘরের বাতি জ্বলে। সেইসব ঘরের পর্দার রং বাতির আলোকে ভিন্ন চরিত্র দেয়। কোনো-কোনো ঘরে জ্বলে স্বল্পালোকের বাতি। ঘুম পেলেও জানালাটা আটকানো মুশকিল হয়ে পড়ে। কপাট টানতে গেলেই যদি শব্দ হয় এবং সে-শব্দে কামিলা-রিচার্ড যদি ভাবে, আমি ইচ্ছে করেই তাদের চন্দ্রময় অভিসারের মাঝখানে বেরসিকের মতো আচরণ করেছি। ভাগ্যিস আমাকে বাঙাল বলে গাল দেওয়া সম্ভব হবে না ওদের পক্ষে তবু নিজেকেই আমার অপরাধী মনে হতে থাকে এমন নান্দনিক দৃশ্যচিত্রের বলয়ে অনুপ্রবেশ করার জন্যে। শেষমেশ জানালা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলে যায় – সকালবেলা দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘সম্রাটের নতুন পোশাক’ গল্পটা সে পড়েছে কি না।
সকালে ব্রেকফাস্টের সময়টাতে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। ইরানি নাদিয়া আমানপুর থাকে তিনতলায়। পিএইচ.ডি করছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ওর বিষয়টা খুব মজার – ইরানের পালাবদলের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বান্দ্বিকতা। সে আবার ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি ছাত্র সংসদের সভাপতি। নাদিয়া ইরানি হলেও ইংল্যান্ডে বাস করছিল রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে। ওর বাবা ছিল রেজা শাহ পহলভিদের অধীন পররাষ্ট্র দফতরের চাকুরে। থাকতো কেনসিংটন প্যালেসের কাছে। ইরানে পালাবদলের আভাস পেয়ে আর দেশে ফিরে যায়নি। একটা জিনিস নাদিয়ার কাছ থেকে শিখেছি আমি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের হলেও সে সাহিত্যের অনুরাগী। এটা নাকি প্রায় সব ইরানির বেলাতেই প্রযোজ্য। হামাসে শব্দটা ওর কাছে শেখা। এর মানে মহাকাব্য – ফেরদৌসি হলেন এক সেরা হামাসে রচয়িতা। নাদিয়া বলে, একটা জিনিস দেখো, আমাদের পূর্বসূরিরা নিজেদের জাতীয়তাকে রক্ষা করার জন্যে কত সংগ্রাম করেছিলেন। তারা আরব উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন নিজ-নিজ অবস্থান থেকে। নাদিয়া ফেরদৌসির দৃষ্টান্ত দিয়েছিল। কবি তাঁর শাহানামা-মহাকাব্যে আরবি শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছিলেন। যতটাসম্ভব ফারসি শব্দে তিনি সাজান তাঁর মহাকাব্যটিকে। আর এর পেছনে তাঁর প্রস্তুতি ছিল প্রায় ত্রিশ বছরের – ৯৭৬ থেকে ১০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। নাদিয়া আবার ইরানি মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে ক্যামব্রিজে। দুয়েকবার আমিও গিয়েছি তাদের সভায়। খুব সুরেলা করে সম্ভাষণ জানায় নাদিয়া, ‘সোব্হ্ বেখায়ের, অকাইয়ে আজিজ।’ আমি জবাব দিই, ‘মামনুন, সোব্হ্ বেখায়ের খানমে নাদিয়া। চেতোরি?’ প্রশ্নের জবাবে ও জানায়, ও ভালোই আছে। তবে নাদিয়ার একটা জিনিস আমার একটু খটকা লাগে। খোমেনির সে তীব্র সমালোচক, আবার খোমেনি নাকি একজন ভালো কবি। ও না বললে আমি কোনোদিনই সেটা জানতাম না। আমার প্রিয় কবি খৈয়াম, হাফিজ এবং রুমি জেনে নাদিয়া খুব খুশি। ওর কাছ থেকেই জানলাম, সাইয়েদ আলি খামেনি নামে একজন ব্যক্তি হাফিজ সম্পর্কে অনেক সুন্দর-সুন্দর কথা বলেছিলেন। নাদিয়া আমাকে একটা বই থেকে দেখায়, ১৯৮৮ সালের ১৯ নভেম্বর ইরানের শিরাজ নগরীতে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক হাফিজ সম্মেলন। তথ্যটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্যে, খামেনি তখন ইরানের প্রেসিডেন্ট আর তিনি যে-উদ্ধৃতিটি দেন সেখানে শরাবের গন্ধ ছিল – ‘গেরেফতে সা’গেরে ইশ্রাত ফেরেশতেয়ে রাহমাত/ যে জুরএ বার রুখে হুর ও পারি গোলাব জাদে।’ নাদিয়া আমাকে অনুবাদ করে শোনায় – ‘রহমতের ফেরেশতার হাতে আনন্দের জামবাটি/ এক অঞ্জলি পিয়ে হুরপরিদের চেহারা ঘামের গোলাপজলে জবজবে।’ সত্যি আশ্চর্য সুন্দর।
রিচার্ড আর কামিলা দুজনেই হাজির। ওরা পাশাপাশি বসে ঘনিষ্ঠ হয়ে। কামিলা নিয়েছে রুটিটোস্ট আর ডিম এবং রিচার্ড স্মোকড্ স্যামন আর ব্রাউন ব্রেড। সৌজন্যবশত আমি শার্লির কথা জানতে চাই। কানাডায় সে ঠিকঠাকমতো পৌঁছেছে কি না। বেশ চটপটে উত্তর তার – ‘হ্যাঁ, সব আনুষ্ঠানিকতা চমৎকারভাবে হয়েছে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সিবেলিয়াসের সংগীত বাজানো হয়েছিল ওর দাদির অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী। আর বলে গেছে, মৃত্যু-উত্তর আনুষ্ঠানিকতায় খরচ না করে সেই অর্থটা যেন অক্সফামের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সোমালিয়ায়।’ মনে-মনে নব্বই বছরের সেই মহিলার প্রতি মাথা নুয়ে আসে আমার। যেখানে সৌদি বাদশাহ আর যুবরাজদের মন ঘামেনি আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের আগ্রাসী শিকারে পড়া সোমালীয় মানুষদের প্রতি সেখানে সুদূর বরফে মোড়া হ্যালিফ্যাক্স থেকে এক মহিলার পাঠানো অর্থে হয়তো একটি-দুটি হোক রুটির কামড় তো দিতে পারবে অন্তত কয়েক সহস্র ক্ষুধার্ত মানব। রিচার্ডের কাছে জানা গেল, শার্লি হয়তো কাল-পরশুই এসে পড়বে। আমার মনটা তখন ভিন্ন আবেগের আতিশয্যে অন্যতর ভাবনায় উদ্রিক্ত হলে আমি আর হ্যান্স অ্যান্ডারসনের সেই সম্রাটের পোশাকের দিকে মনোযোগী হতে পারি না; কিন্তু আমার মনে হতে থাকে, কামিলা আর রিচার্ড দুজনেই কাল স্বপ্নিল চাঁদের আলোয় স্ব-স্ব নতুন পোশাকে বেশ সেজেছিল। হিসাব মেলাতে পারি না আমি, সংশয় আমাকে ভাবনায় ছুড়ে দেয়, ধরা যাক কাল বা পরশু শার্লি চলে এলো কানাডা থেকে। তখন কী ঘটবে? তখনো কী রিচার্ড আর কামিলা এমনই আবিষ্টতায় মগ্ন থাকবে। যদি তা থাকে তাহলে শার্লির কী হবে! নাকি রিচার্ড আর কামিলা উভয়েই তাদের এই পাঁচ-ছয়দিনের পর্বটিকে কোনো এক আশ্চর্য স্বপ্নের ছোট্ট অথচ স্মরণীয় পর্ব হিসেবেই বাকি জীবনের জন্যে সংরক্ষিত করে রেখে দেবে!
বিকেলে আর্টস থিয়েটারে যাই। ইচ্ছে ছিল মস্কোর বলশয় থিয়েটারের সোয়ান লেক দেখার; কিন্তু টিকেট মেলেনি। সেটা ঘটেছে আমার অসচেতনতার কারণেই। মাসখানেক আগেই টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে যায়। তখন আমি পদ্মপুরাণ তথা দেবী মনসার কাহিনিতে পড়ে আছি। ম্যাকগ্রেগরের চাপ আমাকে একটুও ফুরসত দেয় না। শেষে মন্দের ভালো হিসেবে পাই বুনুয়েল-রেট্রোসপেকটিভের টিকিট। দেখলাম বুনুয়েলের ছবি ভিরিডিয়ানা। মনে গেঁথে থাকলো ভিরিডিয়ানা চরিত্রে অভিনয়-করা সিলভিয়া পিনালের মুখ আর ডন জেইমের চরিত্রের ফার্নান্দো রে। রে বুনুয়েলের অনেক ছবির অভিনেতা এবং অসাধারণ তাঁর অভিনয়। রাতেও খাবার টেবিলে রিচার্ড আর কামিলার সঙ্গে দেখা। অথচ দিনসাতেক আগে একই টেবিলে রিচার্ড আর শার্লিকেও আমি দেখেছি। একই ঘনিষ্ঠতা এবং একই সংলগ্নতা দুজনের। পার্থক্য শুধু পাত্রের আর কালের। রিচার্ড-কামিলা স্বামী-স্ত্রী নয়; কিন্তু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সূত্রের আবদ্ধতায় একে অন্যে আশ্লিষ্ট হয়ে রয়েছে। পরক্ষণে নিজেকে প্রবোধ দিই, আসলে আমি প্রচলিত স্বামী-স্ত্রীর কানুনের অভ্যস্ততায় শার্লি আর কামিলার দ্বন্দ্বে খামোকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছি। অথচ যারা পাত্রপাত্রী তাদের মধ্যে কোনো বিকার নেই। তারা বোতল থেকে অরেঞ্জ জুস ঢেলে নেয় গ্লাসে। একজন আরেকজনকে কফি ঢেলে দেয় কফিমেকার থেকে। হেসে-হেসে কত কী তারা আলাপ করে। কত যে তাদের আলাপের বিষয়বস্তু। ভাবি, কাল বা পরশু কী হবে যখন এরকম এক সকালবেলা কামিলা নয়, শার্লি এসে বসবে রিচার্ডের পাশের চেয়ারে। রাতে আমার বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। আমার একটা কক্ষ পরেই রিচার্ডদেরটা। দেখি নিচ থেকে কামিলা এসে ঢুকছে রিচার্ডের কক্ষে। কী তারা করতে পারে এমন আসন্ন মধ্যরাতে। দুজনের লেখাপড়ার বিষয়বস্তুও অভিন্ন নয়। অনুভব করি, চাইলে পৃথিবীতে যে-কোনো ভিন্নতাই প্রয়োজনে অভিন্ন করে ফেলা যায়। নইলে কামিলা কি করে শার্লির জায়গায় আসে কিংবা ইরানি নাদিয়ার সঙ্গী হয় ইসরায়েলি ইঝাক হেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে, ইরানিরা উঠতে-বসতে ইহুদিদের শাপ-শাপান্ত করে অথচ ক্যামব্রিজে দেখছি নাদিয়া-ইঝাক কাল কাটায় এক নিদারুণ অবিচ্ছিন্নতায়। আমাকে ইঝাক বলে, ‘আরবি জানো?’ আমি বলি, ‘শুধু পড়তে। অর্থ না।’ হো-হো করে হাসে ইঝাক, ‘আমাদের দুটো মাতৃভাষা, হিব্রু আর আরবি। আমরা দুটোই ভালো জানি।’ দেখি সে নাদিয়ার ভাষাও জানে। আবার ফারসি সাহিত্যেরও অনেক কিছু তার জানা। ইঝাকের কাছ থেকে জানতে পারি, ফেরদৌসিরও আগে শাহানামা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন দাকিকি। ফেরদৌসি স্বয়ং দাকিকির হাজারখানেক শ্লোক তাঁর শাহানামায় ব্যবহার করেছেন। দাকিক শব্দের অর্থ আটা – হয়তো কবির পিতা বা পিতামহ আটা বিক্রি করতেন। রাতে শুয়ে-শুয়ে আমি রিচার্ড আর কামিলার কথা ভাবি। আচ্ছা, এ-বাড়িতে আরো তো লোকজন রয়েছে। জার্মানি, জাপান, চীন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, মরিশাস, কানাডা, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এরকম – সবাই কী আমার মতো ভাবে রিচার্ড আর কামিলার কথা। নাকি কেবল আমিই তাদের এই আকস্মিক জেগে ওঠা যুগ্মতায় অবাক হয়ে নিরর্থক ভাবিত হয়ে পড়েছি। হয়তো তারা এসব নিয়ে বিন্দুমাত্রই ভাবিত নয়। একটু-একটু করে নিজেকে বোঝাই, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো একটা অদৃশ্য রেখার মধ্যে আমি জট পাকিয়ে ফেলছি। আমি হয়তো যেখানে রেখা দেখতে পাই সেটা আসলে রেখা নয় রেখারই ছায়া, রেখাটা হয়তো খানিকটা ডানে নয় খানিকটা বামে। অথবা হয়তো রেখাই নেই কোথাও, সবই দেখার ফল, হতে পারে বিভ্রম। কিন্তু বিভ্রমের জন্যেও তো প্রয়োজন হয় দর্শনের। হয়তো আমি যা দেখি লোকে তাকে দেখার বিষয় মনে করে না, অথবা লোকে যা-যা দেখে তাদের সেই দেখার নিকটে আমার এই দেখার বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনেক-অনেক কম। খুব ভোরে উঠে পড়ি। লাইব্রেরিতে যেতে হবে দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গেই। আজ আমাকে রেয়ার বুকস কক্ষে কাজ করতে হবে। গ্লেনিয়াসের পর ধরেছি জেমস অগাস্টাস হিকিকে। হিকির বেঙ্গল গেজেটের কপিগুলো দুর্লভ সংগ্রহশালায় রয়েছে। সেগুলো পড়বো। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ হলে বাধ্য হয়ে আমাকেই খুলে দিতে হয় দরজা। তখনো সবাই ঘুমে। বিস্ময় আমার চোখেমুখে কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে শার্লিকে সম্ভাষণ জানাই। বিস্ময়, কেননা, আমি নিশ্চিত কামিলা এখন অবশ্যই শার্লির স্বামী রিচার্ডের কামরায়। মাঝরাতে আমি তাকে দেখেছি রিচার্ডের কামরায় ঢুকতে। দরজাটা বাইরে থেকে শার্লিরই নিজে থেকে খোলার কথা। হতে পারে সে মাস্টার কি’টা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। কিংবা রিচার্ড যেহেতু রয়েইছে সেখানে কোনো চাবিই তো তার নেওয়ার দরকার পড়ে না। আবার, এমনটাও হতে পারে, দাদির মৃত্যুসংবাদে শোকাহত শার্লির চাবির কথা খেয়ালই ছিল না। তবে শার্লিকে ভেতরে ঢুকতে দিতে-দিতে কেবল তখনই আমার প্রথমবারের মতো মনের মধ্যে ধাক্কা লাগাতে থাকে প্রশ্ন – রিচার্ড শার্লির সঙ্গে যায়নি তার কোর্সওয়ার্ক পরীক্ষার অজুহাতে। কিন্তু সে যে এখানে শার্লিবিহীন এই সময়টাতে কামিলার সঙ্গেই বলতে গেলে সবটা সময় পার করে দিলো তাতে কী তার কোর্সওয়ার্ক পরীক্ষায় কোনো বিঘ্ন ঘটলো না! তখন আমি ভাবি, বাস্তব আসলে যা দেখা যায় এবং যা দেখা যায় না মানে আড়াল, এই দুইয়েরই সমন্বিত প্রতিফল। হয়তো যেদিন এ-বাড়িতে দেখা হয়েছিল রিচার্ড এবং কামিলার সেদিনই রচিত হয়েছিল এক নতুন কাহিনি। অথবা, কাহিনিটি তার পরেই গড়ে উঠেছিল, আমিই তার সংবাদ পাইনি। কিন্তু শার্লি স্বয়ং – সেও কি জানতো না এই সমান্তরাল প্রবৃদ্ধির বার্তাটুকু! ততক্ষণে একটা অবোধ্য কিংবা দুর্বোধ্য উত্তেজনা আমাকে ভর করে। আমাকে পালটা সম্ভাষণ জানিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে শার্লি। আমি কান পেতে রই। প্রতিটি মুহূর্ত আমার মধ্যে জাগাতে থাকে অবর্ণনীয় অনুভূতি। সিঁড়িশেষে চাতাল পেরিয়ে ছোট্ট একটুখানি বাঁক। বাঁকের কোণটাতেই আমার দরজা। তারপর ফিনল্যান্ডের অ্যানের কক্ষ। অ্যান পেরিয়েই রিচার্ড-শার্লি। থেমে পড়ে শার্লি। দরজায় টোকা – এক দুই। নিস্তব্ধতার উত্তর। এক দুই তিন – উত্তরে কোনো জবাব নেই। তারপর আবার এক দুই এবং ঠিক এক মিনিট অপেক্ষা। আবার সিঁড়ি ভাঙার শব্দ। দৃষ্টি না দিয়েও আমি বুঝতে পারি শার্লি নামছে নিচে। ফয়ার রুমে তার বহনক্ষম সুটকেসটা যেভাবে রাখা ছিল সেভাবেই রয়েছে। আমার করোটির সাম্রাজ্যে তখন একই সমান্তরালে তুলকালাম ওঠানামা। এ কোন দুনিয়ায় এসে পড়েছি আমি। রিচার্ড কই কামিলা কই! তবে কী সকাল হওয়ার আগেই তারা চলে গেছে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে। এক অদ্ভুত চিন্তার ধাক্কা আমাতে – তবে কী রিচার্ড চলে গেছে কামিলার কক্ষে! কামিলাকে আমি হয়তো ঢুকতে দেখেছি কিন্তু আমি তো তাদের প্রতিটি মুহূর্তের পাহারাদার ছিলাম না। নিশ্চয়ই কামিলার কক্ষেই রাত কাটিয়েছে রিচার্ড এবং এখন যদি আমি বাজি ধরি রিচার্ড কামিলার কক্ষে তাহলে নির্ঘাৎ বাজিতে জিতবো আমিই।
শার্লি এসে বসে ড্রইংরুমে। এলম গাছ থেকে বা আপেল গাছ থেকে একটা পাতা পড়ার শব্দ হয়। বেরির ঝোপের দিকে কয়েকটি মৌমাছিকে উড়ে যেতে দেখা গেল। হয়তো কোথাও ফুল বা ফলের সংবাদ মিলেছে। আমি কোনো প্রশ্ন করি না। প্রশ্ন করাটা রীতিমাফিক নয় বলে আমি স্মিত হেসে শার্লিকে পুনরায় সম্ভাষণের ইশারা করি। শার্লিই আমাকে জানায়, রিচার্ড মনে হয় ঘুমাচ্ছে। কাল ওর কোর্সওয়ার্কের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। অনুমোদনের ভাব আমার ভঙ্গিতে। পরক্ষণে এটাও আমার মনে হতে থাকে, রিচার্ড ভেতরে না বাইরে তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতর থেকে দরজা আটকালে বা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করলে দেখতে একই রকম দেখায় – বোঝা মুশকিল লোক ভেতরে গেল না ভেতর থেকে বাইরে এলো। কিন্তু শার্লিকে আমার এমন একখানা নিরপরাধ ভাব দেখাতে হয় যে, আমি আসলে কোনো পাপের বা গর্হিত কাজের সাক্ষী নই। তখনো অন্য মন আমাকে শাসায়, আমি যেটিকে পাপ বলি হয়তো তা আদৌ পাপ কি না সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে জিজ্ঞাস্য একটাই, রিচার্ড কী সত্যই ঘুমে অচেতন তার কক্ষে! যেমনটি শার্লি ভাবছিল। নাকি রিচার্ড কক্ষেই নেই, যেমনটি শার্লি ভাবছিল না। তাহলে কামিলা কোথায়! শার্লিকে দেখে খানিকটা ক্লান্ত মনে হলেও যাত্রার ধকল যে তাকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে তা মনে হয় না। পাউরুটি-ডিম সেরে আমার চায়ের পর্ব। চুলোর ওপর সেদ্ধ হচ্ছে উতরানো বলক দেওয়া দুধের মধ্যে আমার প্রিয় অ্যাসদা চায়ের গুঁড়ো। গোটা ড্রইংরুমে ছড়িয়ে পড়ছে চায়ের ঘ্রাণ। চায়ের রংটাতেই আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ। রং সঠিক হলে বুঝতে হবে এর স্বাদটাও সাধসম্মত – হোয়েন কালার ইজ দ্য সাইন অব অ্যালার্টনেস। আমাকে চুলোর দিকে এগোতে দেখে স্মিত শার্লি প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি তোমার সেই ‘বাংলা টি’ বানাচ্ছো?’
‘এক কাপ দেবো কী তোমাকে?’ ধন্যবাদ জানিয়ে সৌজন্যের বশে আমি তাকে প্রস্তাব করি।
জবাবে শার্লিও আমাকে পালটা ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, একটু পরেই রিচার্ড দেখা দেবে, এখন সে দ্রুত ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেবে। শার্লির কথার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে দরজায় পদশব্দ শোনা গেল। ধীর-শান্ত পদক্ষেপ ওপর থেকে নিচে নামে। এখানকার লোকেরা দুমদাম সিঁড়ি ভাঙে না। তীক্ষ্ণ নজর রাখে যাতে পায়ের শব্দে কারো অসুবিধা না হয়। কেউ যেন বিরক্ত বোধ না করে। চায়ে চুমুক দিতে-দিতে এবং শার্লির দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে ভাবি, সিঁড়ি ভেঙে কে নামে, রিচার্ডই, নাকি এ-বাড়ির অন্য কেউ, নাকি কামিলা! হেমন্তের পাতাঝরার বার্তা দিয়ে এলম বা আপেল গাছ থেকে আবারো আরেকটা পাতা ঝরে পড়ে।