কার্লোস ফুয়েন্তেসের চলে-যাওয়া

আলী আহমদ
কার্লোস ফুয়েন্তেস মারা গেলেন ৮৩ বছর বয়সে, গত ১৫ মে, ২০১২ তারিখে। খবর হিসেবে এটি এখন আর নতুন নয়। কিন্তু প্রায় সমস্ত পৃথিবীরই গণমাধ্যমে এ-সংবাদটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কাগজে, সাময়িকীতে ও রেডিও-টেলিভিশনে এ-কথাটি বলা হয়েছে যে, নোবেল পুরস্কারটি তিনি আর পেলেন না। নোবেল পুরস্কার না-পেলেই কোনো লেখক বা সাহিত্যিক যে বিশ্বমাপের স্বীকৃতি পান না – এমন ধারণা নাকচ করে দিয়ে অনেকের মতো আমি নিজেও একাধিকবার লিখেছি। সুতরাং সে-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। কার্লোস ফুয়েন্তেসের এই নোবেল না-পাওয়াটা একটু বেশি পীড়াদায়ক এ-কারণে যে, দক্ষিণ আমেরিকার যে-চারজন প্রখ্যাত লেখক – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ওক্তাবিয়ো পাস, মারিয়ো বার্গাস য়োসা ও কার্লোস ফুয়েন্তেস – লাতিন আমেরিকার স্পেনীয় সাহিত্যে তথাকথিত ‘বুম’ (el boom) তৈরি করে ওই সাহিত্যকে একটি আঞ্চলিক ও প্রথাগত সাহিত্যের গন্ডি থেকে বের করে এনে বিশ্বসাহিত্যের অত্যন্ত মর্যাদাশীল একটি আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন, কার্লোস ফুয়েন্তেস তাঁদের মধ্যে কোনোক্রমেই নিকৃষ্ট নন। তাঁর গুণগ্রাহীরা আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছেন এ-কারণে যে, একমাত্র কার্লোস ফুয়েন্তেস ছাড়া বাকি তিনজনেই ইতোমধ্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এবং ওক্তাবিয়ো পাস ইতোমধ্যে মরেও গিয়েছেন।
দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় সাহিত্যে ‘বুম’ বা এই তেজিভাব তৈরিকারী চারজন লেখক তিন দেশের। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম নোবেল-বিজয়ী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলিভিয়ার লোক, যদিও এখন তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন মেক্সিকোতে – স্পেনীয় ভাষায় যাঁর পরিচিতি মেহিকো বলে। প্রয়াত নোবেলজয়ী ওক্তাবিয়ো পাসও মেক্সিকের লোক; তিনি বেশকিছু ছোটগল্প ও অনেক প্রবন্ধ লিখলেও, মূলত কবি। আর ২০১১ সালের নোবেলজয়ী মারিয়ো বার্গাস য়োসা পেরুর লোক। কার্লোস ফুয়েন্তেস মেক্সিকোরই লোক, যদিও তাঁর জন্ম হয়েছিল কূটনীতিবিদ বাবা রাফায়েল ফুয়েন্তেসের সে-সময়কার কর্মস্থল পানামা সিটিতে, ১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে। তারপর ১৯৩৪ সালে কার্লোসের বয়স যখন মাত্র ছয় বছর, তখন তাঁর বাবা ওয়াশিংটনে বদলি হয়ে গেলে তিনিও সেখানে যান এবং ১৯৪০ পর্যন্ত সেখানে থাকার সময়ে ওয়াশিংটনেই স্কুলজীবন শেষ করেন। তখনই তিনি ইংরেজি ভাষাটি উচ্চশ্রেণির আমেরিকানদের মতো করেই আয়ত্ত করেন। এবং লেখালেখিও শুরু করেন ওই স্কুলজীবন থেকেই। তবে বাবা রাফায়েল ফুয়েন্তেস ও মা বের্তা মার্সিয়াস গ্রীষ্মের ছুটিতে, যখন কার্লোসের স্কুল দীর্ঘ সময়ের জন্য বদ্ধ থাকত তখন, ছেলেকে মেক্সিকোতে পাঠিয়ে দিতেন। সেখানে তিনি কখনো দাদি ও নানির বাড়িতে ভাগাভাগি করে সময় কাটাতেন আর তাঁদের কাছে নানা গল্প-কাহিনি শুনতেন। ওইসব গল্প-কাহিনি ছিল তাঁদের পরিবার নিয়ে, মেক্সিকোতে ইয়োরোপীয়দের আগমন ও বসতি স্থাপন নিয়ে, তাঁর জন্মের পূর্বে ঘটে-যাওয়া ‘মেক্সিকো বিপ্লব’ নিয়ে। এদিক দিয়ে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে কার্লোস ফুয়েন্তেসের বেড়ে ওঠার এক অদ্ভুত মিল দেখা যায়। ওক্তাবিয়ো পাস ও মারিয়ো বার্গাস য়োসা অবশ্য অন্য দেশে, অন্য প্রতিবেশে বড় হয়ে ওঠেন। কিন্তু একই ভাষায় লেখালেখির কারণে ও একই ‘বুম’ বিপ্লব-আনয়নকারী হিসেবে তাঁরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে যান। এর মধ্যে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও ওক্তাবিয়ো পাসের দু-একটি ছোটগল্প ছাড়া আর কোনো লেখাই জাদুবাস্তবতাধর্মী নয়। মারিয়ো বার্গাস য়োসা ও কার্লোস ফুয়েন্তেস তো একেবারেই বাস্তবতাবাদী লেখক। চারজনই স্পেনীয়ভাষীদের তো বটেই, অনুবাদের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর সাহিত্যিক মহলে অত্যন্ত পরিচিত ও সমাদৃত।
গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে এই ‘বুম’ শুরু হলেও বাংলাদেশে তা টের পাওয়া যায় অনেক পরে। নববইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে আমরা দু-একজন তখন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় এঁদের নিয়ে আলোচনা করি এবং কারো কারো দু-একটি নিবন্ধ ও ছোটগল্প অনুবাদ করে প্রকাশ করি। এর ফলে তরুণ পাঠক ও লেখকসমাজ বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং বাংলায় এসব লেখকের কিছু কিছু তরজমা হতে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে, অনেকগুলো তরজমাই গুণগত মানের দিক থেকে প্রশ্নসাপেক্ষ হওয়ায় এঁদের অনেকের লেখাই তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। পরে এ-অবস্থা অবশ্য অনেকখানি পালটেছে এবং বেশ কয়েকজনের গুটিকয়েক বইও বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তার একটি কারণ হয়তো এই যে, তাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর কার্লোস ফুয়েন্তেস নোবেল পুরস্কার না-পেয়েই মারা গেলেন বলে, এখনো পর্যন্ত তাঁর ছিটেফোঁটা দু-একটি ছোটগল্প ছাড়া আর কিছু বাংলাদেশে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি, যদিও আমার মতো আরো অনেকের মতেই তিনি ‘বুমে’র অন্য তিনজনের মতো প্রত্যেকে প্রত্যেকের চেয়ে স্বতন্ত্র, কিন্তু কোনোমাপেই নিকৃষ্ট নন।
কার্লোস ফুয়েন্তেস অতিপ্রজ লেখক বলে তাঁর সমালোচকও আছেন। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানাধরনের বিষয় নিয়ে ষাটখানিরও বেশি বইয়ের লেখক। তার মধ্যে কয়েকখানি উপন্যাস তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে খ্যাত ও সমাদৃত করেছে। ১৯৬২ সালে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস A change of skin স্পেনীয়ভাষীদের মধ্যে তো বটেই, অনুবাদের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাসহ সমগ্র সাহিত্যবিশ্বে তাঁকে বলতে গেলে রাতারাতি পরিচিত ও খ্যাত করে তোলে। কিন্তু পাঠের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে ইংরজি অনুবাদে পড়া The death of Artemio Cruz পড়ে। এ নববইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার কথা। বইখানি প্রকাশিত হয়েছিল অনেক আগে – ১৯৬২ সালে; আর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তার মাত্র দুবছর পরে – ১৯৬৪ সালে। এটি কার্লোস ফুয়েন্তেসের বিশ্ববিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাসের একটি। গত শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশক মিলিয়ে ঘটে যাওয়া ‘মেক্সিকো বিপ্লব’, পৃথিবীর আধুনিক ইতিহাসে যা স্বল্পপরিচিত এবং প্রায় অনুল্লিখিত, সেই মেক্সিকো বিপ্লবই এ-উপন্যাসখানির মূল উপজীব্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের চেয়ে ওই বিপ্লবটি ছিল জটিলতর। আমাদের ক্ষেত্রে যেমন একটি বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল, এবং সেই বিদেশি শক্তির সহায়তাকারী সমাজের ঘৃণিত অল্পসংখ্যক কিছু লোক ছিল মাত্র, এবং যাদের পরাজয় প্রথম থেকেই অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়েছিল, মেক্সিকোর ক্ষেত্রে তা ছিল অনেকাংশে জটিল ও আলাদা ধরনের। ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম মেক্সিকো বিপ্লবের মূল বিষয় হলেও তাদের বিরুদ্ধপক্ষে স্বদেশি শক্তি ও নেতৃত্ব আমাদের মতো কেবল একটিই ছিল না; তা ছিল কমপক্ষে চারটি। এবং তা প্রায় সমান সমান ভাগেই বিভক্ত ছিল। সুতরাং এ-বিপ্লব একদিকে যেমন ছিল ঔপনিবেশিক স্পেনের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রাম, অন্যদিকে এবং একই সঙ্গে তা ছিল একটি প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে কে জিতবে আর কে হারবে তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা তখন প্রায় যে-কারো পক্ষেই ছিল অসম্ভব।
এমনি এক স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক নেতা – যাঁর কল্পিত নাম রাখা হয়েছে আর্তেমিয়ো ক্রুস – জীবনসায়াহ্নে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যে-স্মৃতিচারণ করেছেন, তা-ই হচ্ছে এ-উপন্যাসটির কাহিনি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ইবলিশি ষড়যন্ত্র, হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা, মানবতাবিরোধী বর্বরতা আর নারকীয় নিষ্ঠুরতা – এর সবকিছুই সংঘটিত হতে পারে এবং হয়ে থাকে এমন একটি স্বাধীনতা তথা গৃহযুদ্ধে। আর এর প্রায় সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করেছে এ-উপন্যাসের নায়ক আর্তেমিয়ো ক্রুস। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের চেয়ে নিঃসঙ্গে জটিলতর ও সমৃদ্ধতর মনে হয়েছে কার্লোস ফুয়েন্তেসের এই উপন্যাসটি। যুদ্ধজয়ের পরে যে-উপদল মেক্সিকোর রাজনৈতিক ক্ষমতা পায়, আমাদের নায়ক সে-দলেরই প্রথম শ্রেণির একজন নেতা। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে ক্ষমতা পাওয়ার পর যে-অরাজকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবাধ দুর্নীতি, এক কথায় অতিশয় নিচুমাপের প্রশাসন, তার সবই চলছে মেক্সিকোয়। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, ন্যায়পরায়ণতা, সুশাসন ও সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যে-পবিত্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয় স্বাধীনতা-সংগ্রাম তার সম্পূর্ণ উলটো যে-বাস্তবতা সে-দেশে এসেছিল আমাদের উপন্যাসের নায়ক তার অন্যতম প্রধান হোতা। মৃত্যুর আগে, প্রায় ঘোরের মধ্যে, এসবের স্মৃতিচারণ করে সে। লেখকের ভাষার চমৎকারিত্ব, প্লট-নির্মাণের অসাধারণ দক্ষতা ও ইতিহাসের গভীর জ্ঞান উপন্যাসটিকে একখানি ধ্রুপদী (classic) উপন্যাসে পরিণত করেছে। মনে রাখতে হবে, কার্লোস ফুয়েন্তেসের জন্ম ১৯২৮-এর ১১ নভেম্বর – মেক্সিকো বিপ্লবের ১০-১৫ বছর পর। তলস্তয়ের যেমন নেপোলিয়নের ব্যর্থ রুশ অভিযানের পঞ্চাশ বছর পরে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ, তার আপসকামিতা, মহান আদর্শের জলাঞ্জলি – এসব নিয়ে যে-উপন্যাস লেখা হবে তার জন্য আর কতদিন আমরা অপেক্ষা করব? আগুনঝরা ওইদিনের মধ্যে যাঁরা অতিক্রম করেছেন তাঁদের কেউ – নাকি অনাগত দিনের কোনো ঔপন্যাসিক লিখবেন সেই উপন্যাসখানি? কে জানে?
একটু অন্য কথায় চলে গিয়েছিলাম। এবারে আবার কার্লোসের কথায় ফিরে আসি। স্কুলজীবন ওয়াশিংটনে শেষ করলেও মেক্সিকো সিটির ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক অর্জনের পর তিনি বাবার পথ ধরে মেক্সিকোর কূটনৈতিক বিভাগেই যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে, প্রায় ৩০ বছর বয়সে, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস, Where the air is clear, এবং অচিরেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। এ-কথা আগেই বলেছি। আরো বেশ কবছর বিভিন্ন দেশে তাঁর দেশের হয়ে বিভিন্ন কূটনৈতিক পদে কাজ করার পর লেখালেখিতেই পুরোপুরি মন দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারি লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। বিয়ে করেন দুবার। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন তিনি। ১৯৫৯ সালে হাভানায় যখন পদস্থ তখন তিনি বিয়ে করেন মেক্সিকোর অভিনেত্রী রীতা মাসেদেসকে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী জীবনের শেষদিন পর্যন্তই তাঁর সঙ্গে থাকেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর একটি সন্তান – মেয়ে সিসিলিয়া ফুয়েন্তেস মাসেদেস (জ. ১৯৬২) বেঁচে আছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে দুটো সন্তানই অকালে এবং কার্লোস ফুয়েন্তেসের জীবদ্দশায় মারা যান।
কূটনীতিকের চাকরি ছাড়লেও সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনা করেছেন তিনি বিভিন্ন সময়ে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে বিশেষ কতকগুলো ‘চেয়ার’ অথবা অতিথি অধ্যাপক হিসেবে সসম্মানে ডেকে নিয়ে গেছে। পূর্বোল্লিখিত ‘বুম’ সময়ের ফুয়েন্তেসসহ চারজন লেখক-কবি ব্যক্তিজীবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। তরুণ বয়সে তাঁরা সবাই বামপন্থি চিন্তার লোক হওয়া তার একটি প্রধান কারণ। তবে মারিয়ো বার্গাস য়োসা ওই পথ থেকে সরে গিয়ে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেও তাঁর লেখকসত্তা সবসময়েই অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বাকি তিনজন বামপন্থীই থেকেছেন। তবে ফিদেল ক্যাস্ট্রো যখন লেখক ও সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন করেন, তখন কার্লোস ফুয়েন্তেস তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরতে দ্বিধাবোধ করেননি।
চার খ্যাতিমান লেখকের মধ্যে অক্তাবিয়ো পাস এবং কার্লোস ফুয়েন্তেস একই মেক্সিকোর বাসিন্দা ও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন। কিন্তু অক্তাবিয়ো পাসের সম্পাদিত সাময়িকপত্র ভুয়েলতায় যখন কার্লোস ফুয়েন্তেসকে আক্রমণ করে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, তখন তাঁদের বন্ধুত্বে যে-চিড় ধরে তা আর কোনোদিন জোড়া লাগেনি। আর এখন তো দুজনই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
কার্লোস ফুয়েন্তেসের এক বিশাল সৃষ্টিকর্মের আংশিক আলোচনা করতে গেলেও এক পুস্তক আকারের নিবন্ধ হয়ে ওঠার কথা। তবে তাঁর বিখ্যাত যে-কয়েকটি বই আমি পড়েছি তাতে পৃথিবীর লাখ লাখ (কিংবা তারও বেশি) পাঠকের মতো আমিও অভিভূত। The death of Artemio Cruz-এর কথা কিছুটা সবিস্তারে বলেছি। কিন্তু তাঁর The old Gringo হলিউডের সিনেমায় রূপান্তরিত হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী হয়তোবা অধিকতর পরিচিত। সাহিত্য হিসেবেও ওই উপন্যাসখানি অসাধারণ। তাঁর উপন্যাস Terra Nostra ওই নামেই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় ‘এই মাটি’ কিংবা ‘এই পৃথিবী’। বইখানি নানা কারণেই বিশেষভাবে উল্লেখ্য। স্পেনীয় ভাষায় বইখানি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে এবং ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে প্রকাশ পায় তার পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে। তার একটি প্রধান কারণ ততদিনে কার্লোস ফুয়েন্তেস বিশ্বখ্যাত লেখক। কিন্তু বইখানিও অসাধারণ। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের যুগান্তকারী জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাস শতবর্ষের নির্জনতা যেমন করে একটি জাতির, একটি নিপীড়িত জনপদের, একটি পরাধীন মহাদেশের গল্প হয়ে উঠেছে, তেমনিভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কার্লোস ফুয়েন্তেসের এ-উপন্যাস Terra Nostra। এই শেষোক্ত উপন্যাসখানি হয়তো গার্সিয়া মার্কেসের বিশ্বখ্যাত উপন্যাসটির মতো অত ব্যাপকভাবে পঠিত, আলোচিত ও বিস্ময়-উদ্রেককারী নয়; কিন্তু এটিও একটি অতিশয় মহৎ রচনা এবং শতবর্ষের নির্জনতার সঙ্গে তুলনীয় বলে অন্যান্য অনেক সমালোচকের মতো আমিও মনে করি। মার্কেসের সঙ্গে নানানভাবেই ফুয়েন্তেসের তুলনা চলে আসে। একই ১৯২৮ সালে দুজনের জন্ম, শেষ পর্যন্ত দুজনই থেকেছেন মেক্সিকোয়। ফুয়েন্তেস সেদিন মারা গেলেন আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছেন। তিনি এখন আর লিখতে পারছেন না। তবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এঁদের মধ্যে সবার আগে – ১৯৮২ সালে। আর লেখালেখির দিক দিয়ে কার্লোস ফুয়েন্তেস অতিপ্রজ, তা নিবন্ধের প্রথম দিকেই বলেছি। ফ্রান্সে ১৯৭৬-৭৭ পর্যন্ত তখনকার সরকারের বিশেষ অনুরোধে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। সে-কারণে সে-দেশের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ অনেক। La Reforma নামক একটি কাগজে নিয়মিত কলাম লিখতেন ফুয়েন্তেস। তিনি যেদিন মারা যান, অর্থাৎ গত ১৫ মে, সেইদিনই তাঁর একটি লেখা বেরোয় ওই কাগজে। ফ্রান্সের নতুন সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বাগত জানিয়ে এ-লেখাটি লেখেন তিনি। আরো জানা গেল যে, এ-বছরের মধ্যেই তাঁর একটি উপন্যাসিকা ও আরো একখানি উপন্যাস প্রকাশিত হবে।
কার্লোস ফুয়েন্তেস নোবেল পুরস্কার পেলেন না ঠিকই; তবে যে-কোনো মাপেই তিনি নোবেলজয়ী হওয়ার যোগ্য ছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তাঁর আসনটি পাকা হয়েই থাকবে – এ-বিষয়ে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর অন্তত প্রধান প্রধান কয়েকটি বই বাংলায় অনূদিত হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। না হলে প্রয়াত কার্লোস ফুয়েন্তেসের কোনোই লাভক্ষতি নেই, তবে বাংলা সাহিত্য দরিদ্রতর থেকে যাবে নিঃসন্দেহে। 