কালিদাস কর্মকার : মরমি ডানায় অনন্তযাত্রা

সৃজনকাতর ও উদ্যমী ছিলেন তিনি একই সঙ্গে। বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পী নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে এত দেশ ভ্রমণ করেননি। উত্তর থেকে দক্ষক্ষণ গোলার্ধের যে-অক্ষাংশেই পৌঁছেছেন সেখানেই আয়োজন করেছেন নিজের কাজের প্রদর্শনী। যে জল-হাওয়া-মাটি তাঁকে ঘিরে রেখেছে তার মধ্যেই তিনি শিল্পের সংকেত তালাশ করেছেন। মেঘে মেঘে অনেক ঘুরে, অনেক মাটি ও জলকে শিল্পাঞ্জলি দিয়ে তিনি আজ মহাশূন্যে বিরাজ করছেন। তাঁর নামের দুই অংশই তাঁর সত্তার বিশেষ নির্দেশক। কালিদাস ও কর্মকার।
শিক্ষালাভ করেছেন অনেক শিল্পায়তনে। ভিতটা ঢাকায়। ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে, বর্তমানে এ-প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। তারপর স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজ থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসে না, আসে গুরুর কাছ থেকে। তাই তিনি দীর্ঘদিন গুরুর সন্ধানে থেকেছেন যেন। ষাটের দশকের শেষে কলকাতার পাঠ শেষ করে কালিদাস সত্তরের দশকে পোল্যান্ড যান। এই দেশই শিল্পীর অন্তরে হেমবর্ণ জাগরণ আনে। দৃশ্যশিল্প আসলে বস্ত্ততে দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যের অনুকরণ শিল্প নয়।
বস্ত্ত-পৃথিবীর অভিজ্ঞতা মনের গভীরে জারিত হতে হতে কোনো
রেখা-রূপের আশ্রয়ে হৃদয়লীন কোনো অনুভবকে যে কীভাবে জাগ্রত করবে তার রহস্য উদ্ধার আজো নন্দনতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়। এদেশে কালিদাস গ্রাফিক্স আর্টে শিক্ষালাভ করেন। তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন অধ্যাপক শিল্পী আন্দ্রে রুদজিনস্কি। এই গুরুই কালির সাধনার পথ চিহ্নিত করে দেন। রেখা বহুতৌলিক উন্মেষ আর বর্ণের স্নিগ্ধ প্রকাশ – এ দুয়ের সমন্বয়ে রচিত হয় যে-শিল্প তা চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাজাত নয় শুধু, তাতে থাকে আত্মার অনুরণন। বিশেষ আবেগের অভিঘাতে আত্মায় সৃষ্টি হয় সেই শব্দমন্দ্রময়তা। বিষয়টি এভাবে স্বরাট করে বলার পেছনের কারণ এই যে, কালিদাস মূলত পোল্যান্ডের
শিক্ষা-দীক্ষায় নবজন্ম লাভ করেছেন। তাঁর কাজে কিন্তু ঢাকা বা কলকাতার চারুবিদ্যার্জনের কোনো ছাপ আমরা খুঁজে পাই না। আবার তিনি যে পশ্চিমের শিল্পের অনুগামী, তাও বলা যাবে না। তবে গ্রাফিক্স আর্টে পূর্ব ইউরোপের ওই দেশটির খ্যাতি শিল্পমহলে সুবিদিত। কালিদাস কতখানি গুরুর অনুদান নিয়েছেন তা আমি তদন্ত করে দেখেছি; গুরু রুদজিনস্কির প্রভাব সেখানে ক্ষীণ, বরং সার্বিকভাবে পোল্যান্ডের স্নিগ্ধতা-অন্বেষী বিশেষ মনের সঙ্গে কালিরও শিল্পচেতনার সম্পর্ক রয়েছে। তবে বিষয় তাঁর একান্ত নিজস্ব। পরিমার্জনা আর দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে বাংলাদেশের এ-শিল্পীকে পোলিশ-হৃদয়ের ঋণ স্বীকার করতে হবে। কালিদাসের শিল্পযাত্রা স্নিগ্ধতার নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে জাপানে গিয়ে। এখানে তিনি এখানকার ওয়াসি পেপারের টেক্সচারের মাহাত্ম্য অনুভব করে প্রসারিত করেছেন নিজের শিল্পাবেগ। কেউ মানুক আর না-ই মানুক, শিল্পী কালিদাস কর্মকারের ছবি দেখে আমার এই বিশ্বাস স্থির হয়েছে যে, তিনি পূর্ব ইউরোপ ও দূরপ্রাচ্য জাপানের সমন্বয়ে শিল্পের কারিগরি দক্ষতা অর্জন করে এক অভূতপূর্ব উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন। তবে স্বদেশ বাংলাদেশ তাঁর প্রধান গবেষণাগার। তা সত্ত্বেও যেখানেই যে-অবস্থানে থেকেছেন, মরুময় বা জলময়, উষ্ণ বা শীতার্ত, সব দ্রাঘিমাতেই কালিদাস
পৃথিবীর মানুষের কষ্ট ও অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচন করার তাগিদ থেকে গ্রাফিক্সপ্রধান মিশ্রমাধ্যম, স্থাপনাশিল্প ও হ্যাপেনিং ও পারফরম্যান্স করেছেন। দুমড়ে-মুচড়ে, ভেঙেচুরে অথবা নিজেকে সমাধিস্থ করে নৈঃশব্দ্যের কেন্দ্র অন্বেষণ করেছেন। এজন্য শিল্পী আর সর্বার্থে এই মাটি-পৃথিবীর মানুষের পরিচয়ে নিজেকে সীমায়িত করে রাখেননি। তিনি বুঝতে পেরেছেন, আমি এক বিন্দু রং, মানে এক তিল আলো, এক কণা বাতাস মাত্র। আমার অস্তিত্বের ঠিকানা এই পৃথিবীর এরিয়েলে নেই শুধু, তা মহাজাগতিক। কালিদাস নাক্ষত্রিক ধ্যানের বলয় তৈরি করেছেন তাঁর শিল্পে। সেই বলয়ে বলয়িত হয়েছে তাঁর চেতনা। তিনি বিচিত্র ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোজিত করেছেন তাঁর চিত্রপটে। প্যারিসে কালিদাস বিখ্যাত ছাপচিত্রের শিল্পী হেইটারের কাছে
তালিম নিয়েছেন। খুঁটিয়ে দেখেছি, কালির চিত্রজমিনে হেইটার নেই। এটা কিন্তু খুব সহজ বিষয় নয় যে, গুরুর প্রভাব থাকবে না শিষ্যের কাজে। অবশ্যই হেইটার কালিদাসকে গভীরতর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তবু কালিদাস ফিরে ফিরে এসেছেন
কালীর চরণে, আউল-বাউল-দরবেশদের ভুবনের প্রতীকারণ্যে, উচ্চৈঃশ্রবা আর দুলদুলের দ্বৈরথে চেপে অন্বেষণে বেরিয়েছেন ঔষধির, যা এই হিংসার পৃথিবীকে নিরাময় করবে, শুশ্রূষা পাবে মানুষের রক্তাক্ত হৃদয়। সাধু-সন্ন্যাসী, পির-আউলিয়া,
হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, এসবের বাইরে যত গৌণ ধর্মাচার আছে সবার কাছে আনত হয়ে কল্যাণ প্রার্থনা করেছেন কালিদাস। মানুষের কষ্টে লেলিহান শিখায় দগ্ধ তাঁর অন্তর কেবলই প্রার্থনায় বসেছে। তাঁর সেই ধ্যানস্থ অস্তিত্বের মন্ত্রপূত অবস্থাই তাঁর শিল্প। যদি আমরা সেই স্বতঃসিদ্ধতাকে মেনে নিই যে, সব মহৎশিল্পই শিল্পীর মানসিক অবস্থার উপস্থাপন।
তাঁর জীবনে দুর্বহ কষ্টের দুই বড় আঘাত এসেছে দুটি ঘটনায়। ’৭১-এর যুদ্ধে পৈতৃক ভিটায় হানাদারদের তা-ব আর পরিজনের মৃত্যু। দ্বিতীয়টি ব্যক্তিক, স্ত্রীর অকালমৃত্যু। সহধর্মিণীর চিতার আগুনে দগ্ধ হয়েছে তাবৎ অন্তর। প্রথম জীবনে কালিদাস অনেক লোহালক্কড়ের সংযোজনে এবং ছেঁড়াফাঁড়া ধাতব পাতের কর্কশ অভিব্যক্তি মুক্ত স্পেসে তুলে ধরে যুদ্ধের ভয়াবহতা জানান দিতে চেয়েছিলেন। এ-কাজে তিনি কতটুকু সার্থক, তা একদিন কাল আমাদের জানাবে; তবে তিনি ধাতব টুকরো-টাকরা আর দগ্ধীভূত টিন, ইস্পাতের নির্ভরতায় প্রথাগত ভাস্কর্যশিল্প থেকে বেরিয়ে এসে যে-শিল্পের খবর দিলেন তা-ই আমাদের স্থাপনাশিল্পের আদি নিদর্শন। যুদ্ধোত্তরকালে কালিদাসের একটা আত্মপ্রতিকৃতি দর্শক হৃদয়ে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিল্পের বিষয় আত্মপ্রতিকৃতি। নিজের এই প্রতিকৃতি তিনি মিশ্রমাধ্যমে দ্বিতল পটে এঁকেছেন, আবার তা দিয়ে ভাস্কর্যপ্রতিম শিল্পও গড়েছেন। এখানেও তিনি কুড়িয়ে পাওয়া বা ফাউন্ডিং অবজেক্টকে শিল্পে উন্নীত করেছেন। এটি ছিল মূলত একটি বাঁশের গোড়া। শিল্পের হাতের স্পর্শে অর্থাৎ চেঁছে-ছেনে শিল্পী তাকেই বানালেন আত্মপ্রতিকৃতি। শীর্ষদেশে চাপালেন কাঁটার মুকুট। মুখমণ্ডল ও কপালে গাঁথলেন পেরেক। যিশুর কষ্টটা কতটা দুঃসহ ছিল তা তিনি বুঝতে চেয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর এরকম একটি শিল্প রচনার মধ্য দিয়ে কালিদাস এদেশে প্রথম কনসেপচুয়াল আর্টের সূচনা করেছেন, এ দাবি গ্রাহ্য করে আমাদের শিল্পের ইতিহাস রচনা করার নৈতিক দায় আছে। কালিদাস আশির দশকের শুরু থেকে এক ধরনের রূপকাশ্রয়ী ইমেজ এঁকে চলেছেন। ছাপাই ছবির সঙ্গে আরো উপাদান জুড়ে দিয়েছেন : তাই তা মিশ্রমাধ্যমের শিল্প হিসেবে গণ্য হয়েছে। কখনো রঙিন ছাপচিত্রে শুধু ছাপাইশৈলীর আদর্শই এককভাবে অনুসরণ করেছেন। এ-পর্বের একটি ছবির ব্যবচ্ছেদে আমরা শিল্পীর অন্বিষ্টের স্বরূপ অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছতায় অনুভব করতে পারি। ছবিটির শিরোনাম নেই। শিরোনাম থাকা সংগতও নয়; কারণ এখানে যেসব অনুষঙ্গের আন্তর-সম্পর্ক রয়েছে, তাতে তা আর একটি নামে শনাক্ত হওয়ার নয়। কথিত ছবিটিতে প্রধান ইমেজ একটি মানুষের হাতের পাঞ্জা। পাঁচ আঙুল একটা অর্ধগোলক ভেদ করে আলোময় আকাশি
স্পেসে নির্দেশিত। আঙুলের চারপাশে অনেক ধরনের রেখার
জাল-জালিকা। শীর্ষে উড়ছে প্রজাপতি। তন্তুর মতো রেখাকে প্রসারিত করে চলে কীটপতঙ্গ। হাতের তালুতে মানুষী ইমেজ, সনির্বন্ধে মানুষের চোখ আর ওই বৃত্ত বলয়ে নৃমু-ু। আলোকিত প্রথম তলের ওপর এতসব বিচিত্র অনুষঙ্গের সংগঠনের মধ্য দিয়ে কোন বক্তব্য উপচিয়ে আসে? কী বলতে চান শিল্পী? এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে একটি সত্যই আমাদের পথ দেখায় যে, মানুষের মন যখন বিশেষ ধর্মের অনুশাসনের বিধানে নিজেকে আর আবদ্ধ রাখে না তখন যেসব আচার-অনুষ্ঠানের এবং বিশ্বাসের প্রতীক হৃদয়ে আবর্তন আনে তা-ই অাঁকে বা উচ্চারণ করে থাকে আরাধনশীল শিল্পীমন। এখানে মানবপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম; ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ভাবনা জড়াজড়ি করে আছে। মানুষের ভাবনালোক একপক্ষীয় নয়, বহুমাত্রিক। অনেক বিশ্বাস, ধর্ম-সংস্কারের বহুস্তরী রূপের শৈল্পিক ভাষ্য কালিদাসের সৃষ্টি।
তিনি মায়াবাদে বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেছেন। পশ্চিম যাকে ট্রানসেন্ড বলছে, আমরা তাকে মায়া বলতে চাই, আমরা সহজেই বুঝি এই বস্ত্ত-পৃথিবী যতই জাজ্বল্যমান স্পষ্ট হোক না কেন তা থেকে নিরন্তর উৎসারিত হয়ে চলেছে লীলা : এই লীলাতেই ঈশ্বর বা
প্রকৃতি-মাতা। একটা আদিম বোধিতে লীন হয়ে কালিদাস বিরামহীন অধরা বা অরূপের মুদ্রা বা লীলারহস্য অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন এবং ইমেজের জটিল বিন্যাসে সেই প্রকৃতিপূজারি মনটা অাঁকতে চেয়েছেন। তিনি ধ্যানের বলে মহাজাগতিক শক্তির সঙ্গে নিজের মানুষী সত্তার সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন তাঁর শিল্পে। এজন্য তাঁর কাজে বিদ্যুৎরেখার মতো আলো, তারকার মতো দ্যুতিময় অনুষঙ্গ বিচরণশীল।
প্রকৃতি আমার মা। তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই সরল বিশ্বাস সরল উপস্থাপনায় কালিদাস আমাদের জানিয়ে গেছেন শিল্পের ভাষ্যে। এই তো বছর-কুড়ি বা তারচেয়ে কিছু বেশি হবে হয়তো। প্রদর্শনী চলছে তাঁর শিল্পকলা একাডেমীর অধুনালুপ্ত গোল গ্যালারিতে। দেয়ালে সেসব ইমেজ আছে; কিন্তু মেঝেতে শস্যদানা। যেমন বসত্মার মাথা গুটিয়ে মুদির দোকানে রাখা হয় বিভিন্ন রকমের চাল, ডাল, মশলা। এই যে গোলাকার নানা রঙের বৃত্ত ফসল থেকে উৎসারিত – এটাই তো শস্যশ্যামলা বাংলার ইনস্টলেশন বা স্থাপনাশিল্প। প্রদর্শনীতে যুক্ত করা হয়েছিল অনেকগুলো টেলিভিশন সেট। একেকটা স্ক্রিনে একেক রকম ইমেজ। নানা অনুষ্ঠানে নানা জাতির মানুষের অঙ্গভঙ্গি, একটি স্ক্রিনে কালিদাস নিজেও জপতপ করছেন : এভাবে লীলাময় ভুবনে নিজেকে তুলে ধরেছেন তিনি। কীর্তিনাশা বা গঙ্গা, মিসিসিপি বা আটলান্টিক, যে সাগরতীরে বা নদীপাড়ে তিনি উপস্থিত হতেন কাদা-বালি গায়ে মেখে রোদন করতেন। দেহ মুচড়িয়ে কষ্টের কোরিওগ্রাফি রচনা করতেন। জননী বসুন্ধরার সুধা পান করেছেন আর ধরিত্রীপুত্রদের কষ্টকে অনুভব করবেন না, এ তো হতে পারে না। তাই এই তিন ভাগ জলের পৃথিবীর প্রান্তে কাদা মেখে মাটি-মার প্রতি ঘনিষ্ঠ থেকে সাত সাগরের নোনাজলের সঙ্গে নিজের নোনা অশ্রম্ন মিশিয়ে সশরীর শিল্প রচনা করে তর্পণ করেছেন – বুঝি বা মানবমুক্তির জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন অটল বিশ্বাসে। যতই নরপশুদের মারণাস্ত্রে সভ্যতার হৃদয় বিদীর্ণ হোক তবুও অমল হৃদয় খুঁজে পাবে শামিত্মর নীলাকাশ, এমন আশ্বাসই কালিদাসকে মরমি ডানায় ভর দিয়ে এক আকাশ থেকে উজ্জ্বলতর আরেক আকাশের দিকে ধাবমান রেখেছে।