কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৫ সম্মান আনন্দ ও প্রাপ্তির সম্মিলন

আবসার জামিল

 

‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ একদিকে যেমন তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য আনন্দের ও সম্মানের, তেমনি প্রাপ্তিরও। শুধু আর্থিক প্রাপ্তি নয়, এ-পুরস্কার নিঃসন্দেহে তাঁদের আগামীদিনের সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস জোগায়। নবীনদের পরিচর্যার এ-ধারাবাহিক আয়োজনে অষ্টমবারের মতো প্রদান করা হয়েছে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৫’। গত ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে এ-পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এবার চারটি বিভাগে কালি ও কলম এ-পুরস্কার প্রদান করেছে। বিভাগগুলো হলো – ১। কবিতা, ২। ছোটগল্প ও উপন্যাস, ৩। প্রবন্ধ, গবেষণা ও নাটক এবং ৪। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা/ প্রবন্ধ। কবিতা বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেছেন ধানের ধাত্রী গ্রন্থের জন্য শামীম হোসেন; ছোটগল্প ও উপন্যাসে ধাতব সময় গ্রন্থের জন্য ইমরান খান; প্রবন্ধ, গবেষণা ও নাটক বিভাগে বাংলাদেশের পালকি ও পালকিবাহক : নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ধারা গ্রন্থের জন্য রঞ্জনা বিশ্বাস এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা/ প্রবন্ধে যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য গ্রন্থের জন্য সালেক খোকন। চারটি পুরস্কার প্রদান করা হলেও কালি ও কলম বই আহবান করেছিল পাঁচটি বিভাগে। কিন্তু শিশু ও কিশোর সাহিত্য বিভাগে মানসম্মত বই পাওয়া যায়নি বলে বিচারকরা সর্বসম্মতিক্রমে পুরস্কার ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান বিচারকম-লীর সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ।

মাঘের হিম সন্ধ্যায় এ-আয়োজনে বিশেষ অতিথি ছিলেন ওপার বাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও সংগীতবোদ্ধা শঙ্করলাল ভট্টাচার্য এবং কথাসাহিত্যিক ও কালি ও কলমের সুহৃদ সেলিনা হোসেন। কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী। এছাড়া অনুষ্ঠানমঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের এবং সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল হাসনাত।

২০০৮ সাল থেকে তরুণ কবি ও লেখকদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে এ-পুরস্কার প্রদান করে আসছে কালি ও কলম। সে-বছর দুটি বিভাগে এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০৯ সালে বিভাগ বেড়ে দাঁড়ায় তিনটি। ২০১০ সালে যোগ করা হয় আরো দুটি বিভাগ। ফলে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি বিভাগেই বই চাওয়া হয়। মাঝে ২০১৪ সালে তিনটি বিভাগে বই চাওয়া হলেও ২০১৫ সালে ফের পাঁচটি বিভাগেই পুরস্কার প্রবর্তন করে কালি ও কলম।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, আগেরবারের তুলনায় ২০১৫ সালে আমরা তরুণ লেখকদের কাছ থেকে অধিক সাড়া পেয়েছি। পাঁচ সদস্যের বিচারকম-লী চূড়ান্তভাবে পুরস্কারের বই নির্ধারণ করে। এই বিচারকম-লীতে ছিলেন – অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, লেখক সুব্রত বড়ুয়া, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন এবং কবি ও অধ্যাপক মাহবুব সাদিক। তিনি আরো জানান, কালি ও কলম শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও ২০১৫ সালের জুলাই থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। লুভা নাহিদ চৌধুরীর বক্তব্য শেষে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেওয়া এ-পুরস্কার নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে এ-বছর পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। শংসাবচন পাঠ করেন যথাক্রমে কবি ও অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। শংসাবচন পাঠশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, প্রত্যেক বিজয়ীর হাতে একটি ক্রেস্ট ও এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা।

পুরস্কারগ্রহণের পর প্রত্যেক বিজয়ী সংক্ষিপে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন। কবি শামীম হোসেন তাঁর পুরস্কারটি মাকে উৎসর্গ করে বলেন, আপনারা আমাকে আশীর্বাদ করবেন, আমি লিখতে এসেছি এবং লিখব।

নবীন কথাসাহিত্যিক ইমরান খান তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি শর্ত থাকে এটি বিক্রি হওয়ার। আমার ছাত্রছাত্রীরা বইটি কিনে আমাকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। এছাড়া সাহিত্যকর্মে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি

তাঁর পরিবার, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন ও বইটির প্রকাশককে ধন্যবাদ জানান।

গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস বলেন, জীবনে প্রথম স্কুলে যাওয়া, প্রথম সাহিত্য রচনা, প্রথম মা হওয়া, প্রথম প্রেমে পড়লে যে-অনুভূতি হয়, পুরস্কার পেয়ে আমার তেমনই অনুভূতি হচ্ছে। এ সময় প্রায় ১৭ বছর আগে প্রয়াত বাবা-মাকে স্মরণ করে রঞ্জনা তাঁর পুরস্কারটি তাঁদের উৎসর্গ করেন। সাহিত্যক্ষেত্রে এ-অর্জনের জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান তাঁকে নেপথ্যে থেকে সর্বদা সহযোগিতা করে যাওয়া সবার প্রতি।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করে যাওয়া সালেক খোকন বলেন, আমি পুরস্কার তখনই পেয়ে গেছি যখন যুদ্ধাহত ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা এই বইটি প্রকাশের পর আনন্দে কেঁদেছিলেন। কালি ও কলম এ-পুরস্কার দিয়ে শুধু আমাকে নয়, সেই ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকেই সম্মানিত করেছে। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে-সংগ্রাম সেটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলবে বলেই আমার বিশ্বাস।

পুরস্কারপ্রাপ্তদের অনুভূতি প্রকাশের পর বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের। তিনি বলেন, দীর্ঘ বারো বছর ধরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কালি ও কলম প্রকাশ করে আসায় আমি গৌরবান্বিত বোধ করছি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন অঙ্গনের মধ্যে কালি ও কলম হচ্ছে সবচেয়ে বড় ট্র্যাকশিট। কালি ও কলমের মতো এমন উচ্চমানের সাহিত্যপত্রিকা বাংলাদেশ তো বটেই, ওপার বাংলায়ও নেই। তিনি আরো বলেন, কালি ও কলম যে সত্যি একটি উচ্চমানে স্থান পেয়েছে তার প্রমাণ পেয়েছি কলকাতা থেকে পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে। কারণ কালি ও কলম কলকাতা থেকে প্রকাশ উপলক্ষে আমরা আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিলেও তারা তা ছাপেনি এবং এর কোনো কারণও আমাদের জানায়নি। এ থেকেই আমার কাছে কালি ও কলমের উচ্চমান ও অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায়।

বিশেষ অতিথি শঙ্করলাল ভট্টাচার্য বলেন, একটা শব্দ এখন খুব চালু হয়েছে চতুর্দিকে, সারাবিশ্বে – infrastructure অর্থাৎ পরিকাঠামো। যে-কোনো উন্নয়নের জন্য এখন পরিকাঠামো দরকার। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠান কালি ও কলম সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণ করছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেসব লেখার জন্য আপনারা আজ পুরস্কার পেলেন সেসব পুরস্কার লেখাগুলো সম্পন্ন হওয়ার পরই পেয়ে গেছেন। সুতরাং আপনাদের আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, নতুন করে সাহিত্যাঙ্গনে কর্মে ব্যাপৃত হতে হবে। এ-সময় টিএস এলিয়টের একটি উদ্ধৃতি তিনি তুলে ধরেন, ‘হে প্রভু আমাকে এমনভাবে লিখতে শেখাও যেন আমি আর কোনো দিন লিখতে চাইব না।’ নোবেল-বিজয়ী অমর্ত্য সেনের দি আইডিয়া অব জাস্টিজের প্রসঙ্গ টেনে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য বলেন, পুরস্কারপ্রাপ্ত নবীন চার লেখকের সাহিত্যের মূল বিষয়বস্ত্তও দি আইডিয়া অব জাস্টিস। তিনি আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দে আমরা আর পূর্ববঙ্গীয় পশ্চিমবঙ্গীয় থাকি না, একাকার হয়ে যাই। সবশেষে বাংলাদেশের সাহিত্য ও কালি ও কলমের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন প্রথমেই দীর্ঘ বারো বছর ধরে কালি ও কলমের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা এবং নবীন কবি ও লেখকদের গত সাত বছর ধরে নিয়মিত পুরস্কৃত করে যাওয়ায় পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ’৪৭ সালে দেশভাগের ফলে বিভক্ত দুই বাংলার সাহিত্যের ধারা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কারণ বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন হয়ে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, মাঝে পুরো ষাটের দশকের সামাজিক, রাজনৈতিকসহ নানা প্রেক্ষাপটই এ ভিন্নতা এনে দিয়েছে।

’৪৭-এর পর আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান,  আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত ওসমান প্রমুখ এদেশে বাংলা সাহিত্যের যে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তা আজো বহন করে চলেছেন ইমরান খান, শামীম হোসেন, রঞ্জনা বিশ্বাস ও সালেক খোকনরা।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রদত্ত কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার একটি মর্যাদার স্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। এর কারণ দুটি। প্রথমত, এই পুরস্কার প্রদানের স্বচ্ছতা। সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন, বিচারকদের বিচার অনুযায়ীই এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। এখানে কালি ও কলমের কেউ হস্তক্ষিপ করেন না বা আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়েন না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যাঁদের কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা কেউ এ পুরস্কার পাওয়ার পর আমাদের সাহিত্য থেকে হারিয়ে যান না। অতএব পুরস্কারটি যে যথার্থই সৎপাত্রে পড়ছে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, কালি ও কলম যেমন বাংলাদেশসহ দেশের বাইরে বাংলা সাহিত্যের যে-চর্চা আছে তার প্রতিনিধিত্বস্থানীয় হয়ে উঠছে, তেমনি এ-পুরস্কারটিও মর্যাদা, গৌরব ও আনন্দের হয়ে উঠবে।

সবশেষে সবাইকে ধন্যবাদ ও পুরস্কৃতদের অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। এবার একটি বিভাগে একজন নারীর পুরস্কার অর্জন করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ও সৃজনে এই অর্জন নিশ্চিতভাবে প্রভাবসঞ্চারী হয়ে উঠবে, এ-ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তিনি আরো বলেন, বারো বছর ধরে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট দিনে কালি ও কলম বিরতিহীন প্রকাশিত হয়ে আসছে। কালি ও কলম বাংলাদেশের নবীন ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের মেলবন্ধনে প্রয়াসী। বিশেষত নবীনদের মানসম্পন্ন রচনা পত্রস্থ করতে কালি ও কলম সর্বদা ব্যাপৃত। তাঁর বিশ্বাস, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নবীনরা যে-স্বাক্ষর রাখছেন সাহিত্যের ভুবনে, তা গভীরতাসঞ্চারী হয়ে উঠছে।

পুরস্কার প্রদান ও সম্মানিত অতিথিদের বক্তব্যের পালা শেষে কবিতা ও গানের সুরে উপস্থিত সবাইকে বিমোহিত করেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী শামা রহমান এবং আবৃত্তিকার হাসান আরিফ। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত আটের ঘর পেরিয়ে গেছে।

ধীরে-ধীরে অনেকে তখন ফিরতে শুরু করেন নিজ-নিজ গন্তব্য-অভিমুখে। সবার মনেই হয়তো তখন আগামী বছরও এমন একটি সুন্দর ও আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান উপভোগের প্রত্যাশা জন্ম নেয়।