কালো ধোঁয়া

বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করে উঠল। পস্ন্যাটফর্মে গন্তব্যের ট্রেন। হয়তো এই স্টেশনে আর কোনো দিনও ফিরে আসবে না দীপ। ফাঁকা ট্রেন, চোখ মুছতে মুছতে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। আশেপাশে বিক্ষক্ষপ্তভাবে বসে আছে যারা, তারা কেউ বাইরে তাকিয়ে আছে, কেউ রৌদ্রতপ্ত নেতিয়ে-পড়া গুল্মের মতো ঢুলছে। যেন অসহ্য একটা দুপুরে একটা ফাঁকা ট্রেনের বুকের ভেতরে কতগুলো ফাঁকা বুক ছুটে চলেছে।

পরের স্টেশনে ঢোকার আগে জানালার পাশে জায়গা পেয়ে গেল দীপ। বাইরে চোখ উড়িয়ে দিলো। সব চলে যাচ্ছে। ধা-ধা করে সব পেছনে চলে যাচ্ছে। গাছপালা, জলাশয়, ফসলের ক্ষক্ষত, ফাঁকা মাঠ, সব যেন দীপের হাসি, কান্না, ক্ষক্ষাভ-বিক্ষক্ষাভ, মন খারাপ আর খেলার দিনগুলির মতো কিছু বয়স নিয়ে পিছে হটছে। ভেতর থেকে ভেসে উঠছে বাল্যবন্ধুর সঙ্গে টুকরো টুকরো স্মৃতির ক্লিপিংস, তুলসীতলায় মায়ের ডেডবডি নামানো সকাল, বোনের কান্না, কিছুদিন পর বোনের আত্মহত্যার দুপুর। সব পেছনে ফেলে সামনে ছুটে চলেছে দীপ। ট্রেনের গতিই এখন তার গতি। মন অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। শরীরটাকে নিয়ে ট্রেনটা ক্রমশ ঢুকে পড়ছে ধোঁয়াময় চিমনির শহরে। সেদিকে স্থির তাকিয়ে থাকতে থাকতে দীপের চোখদুটোও শুষ্ক হয়ে আসছে। মন কঠোর। ট্রেনের ভেতরের আলোগুলো জ্বলে উঠতেই সে দেখতে পেল তার চারপাশে ভিড়ে ঠাসা যাত্রী। এক প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ ভাঙা গলায় একটা নজরুলগীতি কোনোক্রমে শেষ করে তোবড়ানো থালা বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছেন। দীপ পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা নিচু হয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, ‘দেবেন না, বাড়িতে কাজ করতে বললে করবে না, যত ভিক্ষা দেবেন এরা, ততই পঙ্গু হবে।’

দীপ ভাবল, ঠিক, দিন দিন প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাড়ছে, তবু কয়েনটা আর পকেটে ঢোকাতে পারল না, বৃদ্ধের থালায় ফেলে দিয়ে লোকটার উদ্দেশে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

লোকটা মুখে বিদ্ঘুটে ধরনের আওয়াজ করে ঘাড় ঘোরালেন। বুকের ভেতরে ছ্যাঁৎ করে উঠল দীপের। জানালার বাইরে অন্ধকার। রাত নামছে। কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে সে আর ভেতরে তাকাবে না। কারো সঙ্গে কথা বলবে না। কিছু শুনবেও না। জানালার বাইরে ওই কালো অন্ধকারেই তাকিয়ে থাকবে।

অবশেষে ট্রেন ঢুকছে রানীগঞ্জ। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে দীপ। পা বাড়ানোর আগে একবার পড়ে থাকা সিটটার দিকে তাকাল। এই সিটের ওপর তার পরিত্যক্ত জীবন বদহজমের উগ্রে দেওয়া বমির মতো পড়ে আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল। মুহূর্তে সামনের জন দীপকে ঠেলে দখল করে নিল সিটটা। দীপ পা বাড়াল দরজার দিকে। পস্ন্যাটফর্মে নেমে ভিড় ঠেলে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় এসে বাসের জন্য অপেক্ষা। খানিক দূরে একজোড়া চোখ স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখের দিকে চোখ রেখে তাকাতে পারছে না দীপ। মনে করতে পারছে না ওই চোখ আগে কোথাও দেখেছে কিনা। মুখের আদলে কেমন যেন চেনা চেনা ভাব। দাড়ি-গোঁফের প্রাচুর্যের জন্য ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না। এই অচেনা জায়গায় এসে উপযাচক হয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।

বাস এসে গেছে। দীপ উঠে পড়ল। পাদানিতে দাঁড়িয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ভেতরের দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। লোকটা নিশ্চয়ই পেছনের গেট দিয়ে উঠেছে। ওদিকেই দাঁড়িয়ে আছে। আর এগোনো ঠিক হবে না। লেডিস সিটের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

প্রায় পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর গন্তব্যে পৌঁছাল। বাস থেকে নেমে আর পেছন ফিরল না। দ্রম্নত হাঁটতে থাকল কাঙিক্ষত লক্ষ্যে। রাত বাড়ছে। রানীগঞ্জে এই প্রথম। সামনে একটা গলির মুখ। এটাই বোধহয় চার নম্বর লেন। এই গলিতেই ঢুকতে হবে তাকে।

গলির ভেতরে আলো কম। স্যাঁতসেঁতে ভাব। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। দীপ পথ আগলে দাঁড়ায়, ‘দাদা এখানে শুভময় চ্যাটার্জির বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’

‘স্যরি, আমি এখানে থাকি না।’ ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।

দীপ গলির ভেতরে ইতস্তত বিক্ষক্ষপ্ত ঘোরাফেরা করতে থাকে, ‘দিদি, শুভময় চ্যাটার্জির বাড়িটা কোথায় বলবেন?’

‘কত নম্বর?’

‘নম্বরটা তো ঠিক বলতে পারব না, তবে …’

‘তবে বলব কীভাবে!’ মহিলা দাঁড়ালেন না।

দীপ মাথা চুলকাতে লাগল। পরিচয় দিলে চেনা যাবে না! মানুষ মানুষকে নম্বরে চেনে! বহু আগে দেওয়া ঠিকানা। জায়গাটা এক থাকলেও ঠিকানার বিবরণ পালটেছে। সমস্ত বাড়ির গেটে হাউজ নম্বর বসেছে। ফোন নম্বর একটা দিয়েছিল শেষ চিঠিতে। সেটায় ফোন করলে বলে, অস্তিত্ব নেই। এখানে চলে আসার পর কিছুদিন চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল, ক্রমশ সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতে হতে কবে যে একেবারে ছিঁড়ে গেল মনে নেই। যদি বাড়িটা খুঁজে না পাওয়া যায়, এই রাতে উপায়! ওই একজন, ‘ও দাদা, বলছি শুভময় চ্যাটার্জি, টেঙ্মাকোতে চাকরি করে, বয়স বত্রিশ। বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?’

‘বাড়ির নম্বর কত?’

‘সেটা তো ঠিক জানি না।’

‘টেঙ্মাকোতে চাকরি করেন। টেঙ্মাকো তো ওইদিকে। অনেক দূর। ফোন করুন!’

‘ফোন নম্বর তো নেই! পিন নম্বর আছে।’

লোকটি ভুরু কুঁচকে দীপের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন, ‘তবে বাড়ি খুঁজে পাবেন না।’

‘আপনি রাগ করলেন? আমি নিরুপায় দাদা। শুভময় চ্যাটার্জিকে খুব প্রয়োজন, আমার বাল্যবন্ধু, কিন্তু বহুদিন ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। একপাড়ায় থাকতাম। ফেসবুকেও সার্চ করেছি, পাইনি।’

‘এক কাজ করুন, ওই ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মহিলা বালতি-হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, ওনাকে জিজ্ঞেস করুন। ওই লেনে কয়েকজন আছেন টেঙ্মাকোতে চাকরি করেন।’ ভদ্রলোক চলে গেলেন।

বাইরের ট্যাপ থেকে জল নিতে এসেছেন। বয়স্কা, বৃদ্ধা, তিনি হয়তো ততটা যান্ত্রিক নন, নির্দয় হবেন না। বুকে জল এলো দীপের। দ্রম্নত এগিয়ে গেল, ‘মাসিমা, শুভময় চ্যাটার্জি, ফারহা টেঙ্মাকোতে চাকরি করে, বয়স বত্রিশ, বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?’

মাসিমা দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাচ্ছেন, চোখ ছোট করছেন, বড় করছেন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। চশমা ঠিক করছেন।

চেনা চেনা ঠেকছে! দীপের মতো মুখশ্রী। মাসিমা গলা বাড়ালেন,  ‘তোমার নাম কী বাবা?’

‘দীপ। দীপাঞ্জন চৌধুরী। আপনি কি শুভময় চ্যাটার্জিকে …’

‘চল আমার সঙ্গে। আমি তোর জেঠিমা। ছোটবেলায় আমাকে জেঠিমা বলেই ডাকতিস।’

দীপের মা! ফর্সা টুকটুকে, কোঁকড়ানো ঘন চুল, লম্বা, আঁটোসাঁটো চেহারা! এতো দেখছি চোখে মোটা গস্নাস, সাদা চুল, রোগা, তামাটে, গাল ভাঙা! এই ক-বছরে …!

 

দুই

বিস্ময়ে দুজন দুজনের দিকে ফ্যালফ্যাল। জেঠিমার কপালে ভাঁজ, চশমা খুলে চোখ কচলে বলেন, ‘একেই বলে সময়ের ফের, বন্ধু বন্ধুকে দেখে অবাক হয়।’

‘দ্যাখো মা, সেই রাঙা আলুটা শুকিয়ে কেমন কিসমিস হয়ে গেছে!’

‘তুইও তো দাড়ি-গোঁফে জঙ্গি বনে গেছিস!’

‘বাসস্টপে তোকে দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু …’

‘আমিও তোকে চিনতে পেরেছিলাম, তবে সাহসে …’

‘তার মানে বাসস্টপে মুখোমুখি হয়েও কেউ কাউকে চিনতে পারিসনি? আর আমি একবার দেখেই চিনে ফেললাম।’ চশমাটা ফের পরে নেন জেঠিমা।

‘মা, আমি দীপকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না, ভাবলাম অফিসের কাজে এসেছে। কোনো বড় হোটেলে উঠেছে। বড়লোকের আদুরে রাঙামুলো, রাস্তায় ডেকে ডিসটার্ব করব না, তাই ডাকিনি; কিন্তু তুমি কোথা থেকে ধরে আনলে ওকে?’

‘শুভ, আমি তোর কাছেই এসেছি। বাড়ি চিনতে না পেরে গলির ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম।’ দীপ গম্ভীর।

‘আমার কাছে এসেছিস! মা, দীপ আমার কাছে এসেছে, তাড়াতাড়ি দু-কাপ চা করে আনো।’

‘ছেলেটা অতদূর থেকে এসেছে, ওকে ওইরকম বলছিস কেন?’ জেঠিমা দীপের মাথায় হাত রাখেন, ‘ওর কথায় রাগ করিস না বাবা। শুভ সেই আগের মতোই রয়ে গেছে, কথাবার্তা এখনো বলতে শেখেনি। শেষ দুটো চিঠির কোনো উত্তর দিসনি বলে ওর খুব অভিমান হয়েছিল। যাকগে, তোর বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? তোর বোনের বিয়ে হয়ে গেছে?’

কেঁপে ওঠে দীপ। মাথা নামিয়ে নেয়। বুকের ভেতরটা

খাঁ-খাঁ করে ওঠে। বোনের মুখটা যে কী বীভৎস হয়ে গিয়েছিল! বাবা অনুশোচনায় পাগলের মতো মাথা ঠুকছিল দেয়ালে। অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল বারবার। মা নেই, বোন নেই। ক্রমশ উদাস, মনমরা, চুপচাপ, বেশ কবছর। হঠাৎ একদিন পালটে গেল বাবা। একদিন ধূমকেতুর মতো বাড়িতে নতুন মা এলো। নতুন মা উঠোনে পা রাখতেই পেছন-দরজা দিয়ে পালিয়ে এসেছে দীপ। চোখে জল ধরে রাখতে পারছে না।

শুভ মুখ ফিরিয়েছিল, ত্বরিতবেগে ঘাড় ঘোরাল, ‘অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করো কেন? যাও, দাঁড়িয়ে না থেকে দু-কাপ চা করে আনো।’

জেঠিমা বারান্দা টপকে মিশে যান ডানদিকের অন্ধকারে। ওদিকেই ওদের বাথরুম আকারের ছোট্ট একটা রান্নাঘর। খানিক বাদে শব্দ ভেসে এলো ঠুংঠাং।

‘তাহলে সত্যিই তুই আমার কাছে এসেছিস?’

‘বললাম তো, হ্যাঁ।’

‘আয় তবে এখানে বসি।’

দু-কামরার ছোট্ট একটা বাড়ি। ছোট্ট বারান্দা। চারপাশে পাঁচিল। সামনে ছোট্ট একটা উঠোন। শুভর ওপরটা যত কর্কশ, মনটা তত ভালো, নরম। কী সুন্দর ফুলগাছ লাগিয়েছে! রাতে অস্পষ্ট দেখা গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি দীপের। উঠোনের একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে পায়খানা-বাথরুম। ঘরের দেয়ালে দীর্ঘদিন রঙের প্রলেপ পড়েনি। চারিদিক অগোছালো। একদিকে ড্রেসিং টেবিল, অপরদিকে খাট। খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল দীপ। দরজার মাথায় ছোট্ট সেলফে পাথরের তৈরি বিশ্বকর্মার মূর্তি। সদ্য পরানো বেলফুলের মালা কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল দীপ। ওই মূর্তিটি হয়তো আজ থেকে তার আশ্রয়দাতা হবেন।

দীপকে বিশ্বকর্মার মূর্তিতে প্রণাম করতে দেখে বিস্মিত হলো শুভ। ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস জন্মেছে তাহলে! ভুরু কুঁচকে তাকাল দীপের দিকে। শেস্নষসহ শব্দ ছুড়ে দিলো, ‘অ্যাঁ! প্রণাম!’

মূর্তির থেকে মুখ না ফিরিয়ে দীপ বলল, ‘আমি এসে বোধহয় এত রাতে বিপদেই ফেললাম তোকে!’

‘তা তো ফেললিই, ঘরে ডিম ছাড়া কিছুই নেই। এখন বাজার করে এনে রান্না চাপালে খিদেও হজম হয়ে যাবে। বড়লোকের ছেলে, শুধু ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে পারবি তো?’

‘খাওয়ার কথা বলিস না। আমি আর আগের মতো খাই না। খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।’

‘সে কী রে! খাওয়ার চরণে পেন্নাম দিয়েছিস! কেন?’

‘জ্বরে বেহুঁশ হয়ে মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই বোন আত্মহত্যা করল। বাবা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মদ খাওয়া শুরু করল। দিনের পর দিন মদ গিলে … পরে বলব সেসব কথা।’

শুভর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি দীপকে

থামিয়ে দিলো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ। কান্নাজড়ানো ভাঙা গলায় বলল, ‘এখন তুই কী করছিস?’

দীপ কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল, শুভ হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো। গলায় শেস্নষ এনে বলল, ‘ডাক্তারি পাশ করে কোনো হাসপাতালে? নাকি প্রাইভেট প্র্যাকটিস? নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কোনো নামি কোম্পানিতে …’

দীপ উঠে দাঁড়াল, বিড়বিড় করে বলল, ‘এতকিছু শোনার পরেও! … আমি চলে যাচ্ছি।’

‘থাকতে যে আসিসনি সে তো জানিই। বল, এদিকে কোথায় উঠেছিস?’ রুমাল বের করে চোখ মোছে দীপ। দরজার দিকে দু-পা এগোতেই সামনে জেঠিমা। হাতে দুকাপ চা ও মুড়িমাখা, ‘কোথায় যাচ্ছিস দীপ?’

‘ওকে ছেড়ে দাও মা। অত বড়লোকের ছেলে, এই ভাঙাচোরা নোংরা ঘরে থাকতে পারে? ওয়াক উঠছে, তাই চলে যাচ্ছে।’ শুভ দাড়ি চুলকায়।

দীপ কান্না চেপে রাখতে পারে না, ঢোক গিলতে থাকে। বহুদিনের ক্ষক্ষাভ, অভিমান, অনুতাপ গলা দিয়ে ওপরে ঠেলে ওঠে। জেঠিমাকে পাশ কাটিয়ে বারান্দার কোণে ঝুঁকে দাঁড়ায়। গক্গক্ করে উগ্রে দেয় ঝাঁঝাল ঘোলা জল। শুভ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে দীপকে, ‘মা, জল আনো। দীপ সত্যি সত্যিই বমি করছে।’

দীপ মুখ তুলে দ্যাখে শুভর দুচোখ ভরা জল টলটল করছে।

 

তিন

প্রায় বিকেল। ফারহা টেঙ্মাকোর গগনচুম্বী চিমনিটার মুখ উঠোন থেকে অস্পষ্ট হলেও দ্যাখা যাচ্ছে। কালো ধোঁয়ার কু-লী বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে সুনীল আকাশে। চিমনিটা সকাল দশটার সময় যে-হারে ধোঁয়া ছাড়ছিল, এখনো ঠিক সে-হারেই ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে। ওই কালো ধোঁয়ার ভেতরেই শুভ ও দীপের স্বপ্ন। আর এই ছোট্ট বাড়িটার দু-কামরার দুটো ঘরে হাসি, ঠাট্টা, অসুখ, পরিচর্যা, নানারকম সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেল প্রায় তিন বছর। তবে কালই সিদ্ধান্ত হয়েছে, বাড়িটা ভেঙে নতুন করে গড়া হবে। সংসার হবে। সুন্দর একটা ঠাকুরঘর হবে।

আজ সকালে যে কী হলো! নিছক ফালতু আড্ডা মারতে মারতে ফেলে দেওয়া কথা, স্মৃতি, তারপর ঝগড়া। পুরনো ব্যথা চাগিয়ে উঠল উভয়ের। বিতর্ক। চোখ লাল। দীপ বলেই ফেলল, ‘ঠিক আছে, আমি আর তোদের বাড়িতে থাকব না, ঘর দেখে চলে যাব।’

শুভও মাথা নোয়াল না, ‘অকৃতজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তই নেয়। যাহ্! তোকে কি ধরে রেখেছি?’

দীপ আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল, ‘অকৃতজ্ঞ! পুরো মাইনেটাই তো … আজই চলে যাব, এক্ষুনি।’

শুভ খোলা দরজার দিকে আঙুল তুলল, ‘দরজা খোলাই আছে, যা চলে যা।’

জেঠিমা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন, ‘তোরা কি সতিন! যে পান থেকে চুন খসলেই ঝগড়া? যা, স্নান করে খেয়ে কারখানায় যা।

ভোঁ পড়ে গেছে।’ শুভ কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল, ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন শুভর মা। ঘর থেকে বেরিয়ে দুজনেই উঠোনে নেমে গেল।

অলক্ষুনে কালো বিড়ালটা সেই সকাল থেকেই ঘরের কোণে বসে নাগাড়ে ডেকে চলেছে। কোথা থেকে এসে জুটেছে কে জানে! এই কলোনিতে তো এর আগে কখনো দ্যাখা যায়নি! সকালে একবার ঢিল ছুড়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন শুভর মা। ঘুরেফিরে আবার এসেছে, ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে এখন মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে আছে। ওটাকে তাড়াতে হবে।

চার

উঠোনের কোণে তুলসীতলায় বেশ কিছুটা জায়গা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। তারই এক কোণে একটা কাঁচা বাঁশের ডগা পোঁতা। বাঁশের মাথায় কলার খোলা বসানোর জায়গা। কারখানা থেকে ডেডবডি ফিরে এলে ওখানেই রাখা হবে।

উশকোখুশকো চুল, মাজায় গামছা, হাওয়াই চপ্পলে ফটাস্ ফটাস্ করতে করতে একটা ছেলে তুলসীতলায় এসে দাঁড়াল। মাটির কলস, শরা, একমুঠো খুচরো পয়সা আর এক ঠোঙা খই মাটিতে নামিয়ে রেখে বারান্দার দিকে এক পলক তাকাল। ওদিকে রাস্তার ওপর মানুষের জটলা ক্রমশ বড় হচ্ছে। প্রত্যেকের বুকে আলপিন দিয়ে সাঁটা কালো ফিতের টুকরো। কথার পিঠে কথা চলছে। নানারকম মন্তব্য। চিমনির মুখ। কালো ধোঁয়া।

ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই কান্নার বুকভাঙা আর্তস্বর দমক দিয়ে উঠে এসে আছড়ে পড়ছে উঠোনে। চারিদিকে লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কেউ-একজন রাস্তার দিক থেকে উঠোনে নেমে এলো, ‘বডি আসছে।’

বারান্দার কোণে গালে হাত দিয়ে বসে ছিল, কারখানার কালো ধোঁয়ার কু-লীর দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ পাগলের মতো ছুটে এসে ডেডবডির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুহাতে মৃত মুখের দুই গাল চেপে ধরে স্থির। হাত, পা, কোমর, সব ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত, কেবল মুখটা সেই আগের মতোই নির্বিকার। চোখের কোণে তিন বছর আগের সেই জলের রেখা। এ কি মানুষ! এ কী ধরনের অভিমান! উহ্! মৃত কপালের ওপর আছড়ে পড়ল জীবিত কপাল। কান্না।

দুজন দুহাত ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো বারান্দায়। শবযাত্রা শুরু। হৃদয়বিদারক ধ্বনি। শ্মশান ডাকছে তাকে! যাবে সে! না, ডাকছে না। ঘর থেকে গড়িয়ে আসছে কান্না। দুজন বাদে বাকি সব শ্মশানে। সেই দুজন উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কিছু বলছে। ওরা যা বলে বলুক, ঘরের কান্না থামাতে হবে। বারান্দা থেকে উঠে হেঁটে গেল ঘরে। কান্নাকে জড়িয়ে ধরল আরেক কান্না, ‘মা! ও মা, আমার দিকে তাকাও। তাকাও!’

কান্না চুপ। উঠে বসল। উঠোনের দুজন ঘরের ভেতর।

‘মা, এখানে আসার সব থেকে বড় কারণ ছিল বোনের আত্মার শান্তি। আমার বোন আপনাকে মা বলে ডাকতে চেয়েছিল, ও পারেনি তাই ওর হয়ে …’

কালো বিড়ালটা চলে গেছে। চিমনির মুখ থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে না।