কিছু স্মৃতি, কিছু উপলব্ধি

শাওন নন্দী

আসুন, আমরা এখন একটা অন্যরকম বইয়ের  সঙ্গে অল্প আলাপ-পরিচয় সেরে ফেলি। হ্যাঁ, অন্যরকম। ভালো বা মন্দের বিচার তো নেহাতই আপেক্ষেক; তাই আমাদের কাছে সেটা পরের কথা। গোড়ার কথা হলো, বইটা আর পাঁচটা বইয়ের থেকে চরিত্রে ও বিষয়বস্ত্ততে বেশ কিছুটা আলাদা। আলাদা তার বাচনে, আলাদা মর্জিতেও। দুটি ভাগে বিভক্ত মোট সতেরোটি নিবন্ধের সংকলন এই গ্রন্থ। প্রথম ভাগে নয়টি এবং দ্বিতীয় ভাগে আটটি নিবন্ধ এর ‘ভর’। স্থূল বিচারে প্রথম খ-টির লেখাগুলোকে প্রধানত স্মৃতিনির্ভর অনুভবের বয়ান বললে খুব ভুল হয় না; যেমন দ্বিতীয় খণ্ডর লেখাগুলোর ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, সেগুলো প্রধানত উপলব্ধিনির্ভর সমাজচিন্তার ফসল। আর সূক্ষ্ম বিচারে এ-কথা আমাদের স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, প্রায়শই স্মৃতি ছুঁয়ে গেছে সমাজচিন্তাকে আর সমাজভাবনা জারিত হয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ স্মৃতির আলোয়। এই অনিবার্য অভিক্ষেপ বস্ত্তত নিবন্ধগুলোকে আরো স্বাদু করেছে। তাই ভালো বা মন্দের আপাত বিচারকে ছাপিয়ে উঠে এই বই আমাদের কাছে ভাললাগার দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

‘পত্রলেখা’ থেকে প্রকাশিত এই নিবন্ধ-সংকলনটির নাম – মহিম রুদ্রের মৃত্যু ও অন্যান্য। নাম থেকেই বইটির স্বতন্ত্র চরিত্র লক্ষণ অনুমিত হতে পারে। আলোচ্য নিবন্ধগুলো আমাদের সেই অনুমানকে নিরাশ করে না। এক অনুপম স্বাদু-গদ্যে লেখাগুলোকে সহজগ্রাহ্য করে তুলেছে অমিয় দেবের সুধী-কলম। ১৫১ পৃষ্ঠার এই বই নিবন্ধগুলোর মর্জি অনুসারে যে-দুটি গুচ্ছে সজ্জিত হয়েছে, তার প্রথম গুচ্ছ ১১ থেকে ৮৪ পৃষ্ঠায় ধরে রেখেছে নয়টি নিবন্ধকে; দ্বিতীয় গুচ্ছ যে-আটটি লেখার আধার, তা সজ্জিত হয়েছে ৮৭ থেকে ১৫১ পৃষ্ঠার ব্যাপ্তিতে। প্রথম ভাগের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭৩ এবং দ্বিতীয় ভাগের ৬৪। বোঝা যায়, ‘ভরে’র দিক থেকে স্মৃতিসঞ্জাত দর্শন ও উপলব্ধি এই গ্রন্থের বেশিটা জুড়ে রয়েছে। ব্যক্তিগত মর্জির শাসন বইটির নিয়ন্তা। নিয়তিও বলা যায়। তাই বস্নার্বের গ্রন্থপরিচিতিতে আমরা দেখি-‘কয়েকটি মৃত্যু ও কিছু স্মৃতি যেমন এই বইয়ের এক ভর, তেমনি অন্য ভর আমাদের বর্তমান, যা ক্ষমতা, লোভ ও ত্রাসে ক্রমেই বিপন্ন হয়ে উঠছে। কিন্তু যেমন ওই প্রথম তেমনি এই দ্বিতীয় ভরও লেখক পরিমাপ করেছেন এর নিতান্ত ব্যক্তিগত, প্রায় হঠাৎ উঠে আসা, নিবন্ধ পর্যায়ে। তাদের রম্য বললে ভুল হবে না।’ …হ্যাঁ, প্রচলিত অর্থের বাইরে এক-অর্থে তো এর লেখাগুলো ‘রম্য’ বটেই। গ্রন্থ-সূচনায় নিবন্ধকার জানিয়েছেন-‘এই ছোট লেখাগুলি সবই সাময়িক। আবার কোথাও কোথাও পুনরুক্তিপ্রবণও। দুই অংশে বিভক্ত বিষয়ভেদে। কবে কোথায় প্রথম বেরিয়েছিল তার উলেস্নখ লেখাগুলির তলায় আছে।’-(প্রসঙ্গত)। স্বপক্ষের এই কথাগুলো থেকে এ-কথা বুঝে নেওয়া মোটেও অসংগত হবে না যে, এক ধরনের প্রচ্ছন্ন পরিপাট্য এই গ্রন্থ-পরিকল্পনায় থাকায় আমাদের পাঠাভিজ্ঞতাকে তা আরো তৃপ্ত করেছে। সমৃদ্ধ চিন্তা টেনে এনেছে আরো নতুনতর ভাবনাকে, সম্ভাবনাকেও। অমিয় দুটি ভাগে নিবন্ধগুলোকে সাজিয়েছেন এভাবে-

১. ‘মহিম রুদ্রের মৃত্যু, টেলিফোন ও মৃত্যু’, ‘১ জানুয়ারি ২০০৮’, ‘কবিতা লেখা ছাড়া আর কী রোগ ছিল তাঁর?’, ‘আমাদের অনেক নিভৃত বাসনার নাম দীপক’, ‘যত্নই যাঁর স্বভাব’, ‘অমস্নান দত্তের স্মৃতি’, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়’ এবং ‘সুবীর রায়চৌধুরী’। ২. ‘ডায়েরির বদলে কিছু এলোমেলো কথা’, ‘জানলা ও লাশ : দুই অসংলগ্ন ভাবনা’, ‘অণুচিন্তন’, ‘অথ কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি’, ‘কিমাশ্চর্যমতঃ পরম্’, ‘মা গৃধঃ’, ‘অতি ক্ষুদ্র হইলেও’, ‘চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী’। নামকরণ থেকে নিবন্ধের বিষয় মোটাদাগে আঁচ করে নেওয়া, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখানে খুব একটা কঠিন নয়।

প্রথম পর্বে সাজানো নিবন্ধগুলোতে আমরা পেলাম মৃত্যুময় কয়েকটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি লেখককে। প্রচ্ছন্ন বেদনার চাপ থেকে  সেখানে উঠে এল ব্যক্তিগত সম্পর্কের নানা বর্ণবিন্যাস, উঠে এল বন্ধুতায় ভরা ফেলে আসা সবুজ-প্রহরের কথা, এলো জীবনদর্শন ও সমাজচেতনার বহুকৌণিক বিকাশ-বারতা। আর দ্বিতীয় পর্বে, সমাজভাবনা সচেতন লেখকের কলমে তুলে আনল স্বদেশচেতনা, ভাষা, শিক্ষা, রাজনীতি, সন্ত্রাসবাদ, রিপুতাড়িত আধুনিক জীবন
প্রভৃতি বিষয়ে গভীর চিন্তন, মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ ও উপলব্ধ সত্যের বর্ণময় আলোকবিচ্ছুরণ। আর উভয় ক্ষেত্রেই ভাবের অনুষঙ্গে প্রযুক্ত ভাষার মুন্শিয়ানায়, লেখক তাঁর কথাকে পৌঁছে দিতে পারলেন, আমাদের হৃদয়ের বড় কাছাকাছি। হাত ধরাধরি করে আমাদের মনের আঙিনায় এসে হাজির হলো সমৃদ্ধি ও সন্তুষ্টি। বিচ্ছিন্ন রচনাগুলো তারই সামগ্রিক অভিঘাতে এক অর্থে খুঁজে পেল তার পূর্ণতা এবং পূর্ণতর কোনো সার্থকতাও।

 

দুই

মৃত্যুদীর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই গ্রন্থের প্রথম পর্বের লেখাগুলোতে, কথাসূত্রে লেখক বারবারই ফিরে গেছেন পুরনো দিনে; পুরনো সম্পর্কের সূত্রে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, চরিত্রের নানা রঙের শেড নিয়ে আমাদের জানার শরিক হয়ে উঠেছেন। আর কোথাও কোথাও তাঁদের সূত্রে সমাজজীবন নিয়ে প্রবন্ধকারের পর্যবেক্ষণ ও মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ, শরিক হয়ে উঠেছে আমাদের ভাবনার। যেমন গ্রন্থের প্রথম নিবন্ধ – ‘মহিম রুদ্রের মৃত্যু’তে। শিল্পী মহিম রুদ্র সুইডেনে মারা গেলেন। দীর্ঘকাল প্রবাসী ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে স্ত্রী গুনড্রিগ বা সন্তানেরা কেউ তাঁর কাছে ছিলেন না। মহিম ছিলেন একা। এই ব্যাষ্টি-সত্যটুকুকে আশ্রয় করে অমিয় পৌঁছতে চেয়েছেন এক গোষ্ঠী-সত্যতে। এই নিবন্ধ শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে একটি প্রয়োজনীয় সামাজিক প্রশ্ন – বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব, যা আজকের গতিময় জীবনের অবশ্যম্ভাবী উপজাত – তার বেদনাবহ পরিণামের দিকে এই লেখা ছুড়ে দিয়েছে তার মানবিকজিজ্ঞাসা। অমিয় লিখেছেন – ‘মস্তিষ্কের শিরা যখন ছিঁড়ছে, তখন যে জাগ্রত তার ‘বাঁচাও’ বলবার মতো কেউ তো থাকবে!’ লিখেছেন – ‘বার্ধক্য সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠেছে শুধু যৌথ পরিবার ভেঙে যাবার ফলে নয়, অণুপরিবারের উত্থানের ফলেও। বৃদ্ধ মা-বাবার আর্থিক দায়িত্ব নেওয়া আর তাঁদের দৈনন্দিন দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া এক নয়। …জিজীবিষার দীপ্র রূপ আমরা দেখি যৌবনে যা বস্ত্ততই মৃত্যুর প্রতিস্পর্ধী। বার্ধক্য তা আদৌ নয়, তবু জীবনের ধুকপুকুনিই তার মুখ্য অবলম্বন আর তা মৃত্যুর হাতে তুলে দিতে সে সহজে রাজি নয়। মৃত্যুকে অনেক সময়ই তাকে দুমড়ে-মুচড়ে তুলে নিয়ে যেতে হয়।’ আর সেই অসহায় মুহূর্তে, আর্থিক সংগতিই শুধু নয়, প্রয়োজন হয় একটু সাহচর্যের। আমাদের ছুটে চলা ব্যস্ত সময়, আজ আর তা ততখানি দিতে রাজি নয়!

‘টেলিফোন ও মৃত্যু’ নামক লেখাটি আমাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতার সমধর্মী। টেলিফোনে মৃত্যুসংবাদ শোনা, রাতবিরেতে ফোন বেজে উঠলে অজানা আশঙ্কায়
কাঁপা-হাতে রিসিভার তোলার সাক্ষী আমরা অনেকেই। তেমনি কয়েকটি অভিজ্ঞতা এই লেখার সারবস্ত্ত। মৃগাঙ্ক রায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হওয়ার পরের পরের দিন তাঁর বইয়ের প্রাপ্তি স্বীকার সম্পর্কে জানাতে গিয়ে লেখক জানতে পারেন মৃগাঙ্কের চলে যাবার কথা। মৃত্যু তো এমনভাবে অনেক সময়েই
বলে-কয়ে আসে না, হঠাৎ এসে ছিনিয়ে নেয় আমাদের কোনো প্রিয়জনকে। ছিনিয়ে নেয় টেলিফোনে ভেসে আসা কোনো প্রিয় কণ্ঠস্বর। এ-প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে শিশিরকুমার দাশ, দীপক মজুমদার, সুবীর রায়চৌধুরী, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিভূষণ চাকী প্রমুখের কথা। তাঁদের অসুস্থতা ও চলে যাওয়ার কথা। সুধীন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু-সংবাদ, ডেভিড ম্যাকাচ্চনের মৃত্যুর খবর, ফাদার আঁতোয়ানের মৃত্যু ও সেই কথাসূত্রে অতি অল্পকথায় তাঁর জীবনকেও ছুঁয়ে যাওয়া, সুরজিৎ ঘোষ ও শুদ্ধশীল বসুর অকালপ্রয়াণ; প্রতিভা বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত  প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মৃত্যুসংবাদ; এসব অপ্রস্ত্তত অথবা অল্পপ্রস্ত্তত মৃত্যুদীর্ণ মলিন খবরাখবর নিয়ে এই রচনা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে একেবারে অন্যরকম। আধা-ডায়েরি
আধা-নিবন্ধ এই লেখায় একের পর এক মৃত্যুপ্রসঙ্গ যেভাবে উঠে এসেছে, গ্রন্থের একমাত্র এই লেখাটিতেই তা কিছুটা ক্লান্তি এনে  দেয়। পাঠককেও তো নিতে হবে মাত্র কটি পাতার মধ্যে এতগুলো মৃত্যুসংবাদের ভার!

গ্রন্থের পরের দুটি নিবন্ধ লেখকের সুহৃদপ্রতিম প্রণবেন্দু দাশগুপ্তকে নিয়ে লেখা। তাঁর টুকরো জীবনকথা, মৃত্যু ও কবিতা নিয়ে নিবন্ধকারের আন্তরিক আলোচনা ও মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। যেমন ছুঁয়ে যায় ‘আমাদের অনেক নিভৃত বাসনার নাম দীপক’ – লেখাটি। পঞ্চাশের সেই দিক পরিবর্তনের পত্রিকা কৃত্তিবাসের অন্যতম পুরোধা দীপক মজুমদারের জীবনের নানা পর্যায়, নানা উত্থান-পতন, তাঁর সৃষ্টি, খেয়ালিপনা ও বোহেমিয়ানিজম নিয়ে যে-দীপককে আমাদের মনের আঙিনায় ধরিয়ে দেয়, মৃত্যুর কারুণ্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছুঁতে পারে না। লেখকের বন্ধুতার আলোয় আমরা জানতে পারি বাঙালি জীবনের চেনা ছকের বাইরে থাকা আরেক বাঙালিকে। পরের লেখাগুলোতে নরেশ গুহ, অমস্নান দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরীর কথা উঠে আসে, তাঁদের জীবন ও চরিত্রের নানা ঘটনা ও বিশেষত্বকে সঙ্গী করে। উঠে আসে তাঁদের বহির্ভুবনের পাশাপাশি অন্তর্ভুবনও! তাঁদের কথা বলতে গিয়ে লেখক ছুঁয়ে যান পরিপার্শ্বকে; তাঁদের ঘিরে থাকা সমাজজীবন ও তার অভিঘাতকে। গ্রন্থের দ্বিতীয় তথা শেষাংশের আটটি নিবন্ধ সেই সময় ও সমাজকে আরো গভীরভাবে ছুঁতে প্রয়াসী হয়েছে। ‘ডায়েরির বদলে কিছু এলোমেলো কথা’ নামক রচনাটিতে আদিবাসীকন্যা ভানুমতীর ভারতবর্ষকে খুঁজে পাওয়ার আকুলতাকে জিজ্ঞাসাকে স্পর্শ করে, লেখক আরেকভাবে নেমেছেন ভারতাত্মার অন্বেষণে। বহুভাষা, বহুধর্মের এই দেশ, তার যাপনের বৈচিত্র্যকে ছুঁয়ে লেখকের স্বদেশ-অন্বেষণের এই ভাবনা, আমাদেরও নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করে। এই লেখায় উঠে এসেছে আজকের ভারতবর্ষেও উজিয়ে থাকা ভাষা-শিক্ষা-জল সংক্রান্ত নানা সমস্যার কথা। উঠে এসেছে সম্প্রদায়ভিত্তিক, জাতিভিত্তিক ভেদ-বিভেদে দীর্ণ এক রাষ্ট্রচিত্র ও তার মর্মবেদনার কথা। নিবন্ধকারের ভাষায় – ‘রবি যে কেবল রবীন্দ্রের ডাকনাম নয়, রবিউলের ডাকনাম, কেয়া যে কেবল কেতকী নয়, রোকেয়াও – এ-বোধ কেন আমাদের এখনো স্বাভাবিক হয়ে এল না!’ স্বাধীনতার পঁয়ষট্টি বছর পরও এই হতভাগ্য স্বদেশ আমাদের ভাবায় বই কি!

পরবর্তী নিবন্ধগুলোর বিষয় বিচিত্র হলেও সুরে তারা কমবেশি একই তারে বাঁধা। স্বদেশ, সমাজ ও সময় লেখাগুলোর প্রাণভ্রমর। প্রতিটি নিবন্ধের অভিপ্রায়কে শাসন করেছে লেখকের সচেতন মন। তাঁর জিজ্ঞাসা, তার বেদনা, তাঁর অসহায়তা, তাঁর কৌতূহল। হিংসায় উন্মত্ত আমাদের এই বর্তমান তাই অমিয়ের উদ্বিগ্ন কলমে ফুটে উঠেছে। উঠে এসেছে এই জরুরি ও সংগত জিজ্ঞাসা – ‘মানুষই নাকি একমাত্র প্রাণী যে আপন নিধন করে; কিন্তু মানুষই তো একমাত্র প্রাণী, যে মুখ ফুটে কথা বলতে পারে। তাহলে?’ …‘জানলা ও লাশ : দুই অসংলগ্ন ভাবনা’ নামে এই লেখাটিতে এক ধরনের পরোক্ষ suggestion-ও উঠে আসে, সমস্যা কোনো জেহাদে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না; আরো আলোচনা, আরো মতবিনিময় থেকেই উঠে আসতে পারে সমাধানের কোনো আপাত সংগতিসূত্র! সেই চেষ্টা আন্তরিকভাবে কবে শুরু করবে মানুষ? বারুদের গন্ধে ভারি এই বর্তমান, পথে-ঘাটে রক্তচিহ্নের জিজ্ঞাসায় এ-প্রশ্নই কি তুলে আনে না – আজ, আমাদের সামনে?

লেখক, এসব নিবন্ধে নেহাত গল্পের ছলে লঘু চালে অনেক গভীর কথা শোনান আমাদের। শোনান সন্ত্রাসের কথা, রাজনীতির নামে ক্ষমতাসর্বস্ব এক অন্ধ প্রতিযোগিতার কথা। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে ‘ক্ষমতায়ন’ শব্দের অধুনা বহুল ব্যবহারের কথাও। লেখার মধ্যে থেকে উঠে আসে কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন, ধাপে ধাপে। অমিয় লেখেন – ‘সমাজ বড়ো না রাজনীতি বড়ো, এর উত্তরে আমরা সবাই বলব, সমাজ। কারণ সমাজ আছে বলেই রাজনীতি আছে, সমাজের দেহ থেকেই তার উৎপত্তি। কিন্তু যদি রাজনীতি সমাজকে ছাপিয়ে ওঠে, অহোরাত্র সমাজের নামাবলি গায়ে দিয়েও সমাজের তোয়াক্কা না করে, যদি তার ক্রমবর্ধমান দাপটে সমাজ দিন দিন সিঁটিয়ে আসে?… সমাজ না রাষ্ট্র কোনটা বড়ো তার নিষ্পত্তি কি আমরা করে ফেলেছি?’ – (‘অথ কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি’)। আর কেবল তো সমাজ-ই নয়, সমাজের যারা অনুকল্প, উপাদান যারা – এই আমরা, সময়ের জাদুকরী সম্মোহনে বিশ্বায়নের বাজারে যারা একই সঙ্গে পণ্য ও খরিদ্দার – তাঁরা; তাঁদের মনের মধ্যেও তো প্রবেশ করেছেন লেখক, অনুসন্ধান করেছেন রিপুতাড়িত মানুষের যাপনের গভীরে নিহিত প্রদাহ ও বেদনাকে। লিখেছেন – ‘রিপুরহিত মানুষ নিশ্চয়ই সব পেয়েছির দেশের বাসিন্দা, কিন্তু রিপু প্রবল হয়ে উঠলে হয়তো আমরা সব হারানোর দেশে পতিত হব। সেই পতনেরই কি আমরা সূচনা দেখছি?’ – (‘মা গৃধঃ’)। গ্রন্থের শেষ নিবন্ধটি আবার আমাদের অন্তর্লোক থেকে বেরিয়ে এসে বহির্লোকের দিকে দৃক্পাত করেছে। অবশ্য তার একটি প্রচ্ছন্ন অঙ্গুলি-নির্দেশ রয়ে গেছে আমাদেরই অন্তর্লোকের এক রাজ্য ‘ভয়ে’র দিকে। লেখকের কলম বলে উঠেছে – ‘দরজার পর দরজার পর দরজার যে-নিরাপত্তা, ‘ঠগ’ বাছতে গাঁ উজাড় করবার যে-নিরাপত্তা, তার মূলে আছে ভয়। সেই ভয় যেমন একদিকে ক্ষমতার চপলমতিত্বের তেমনি অন্যদিকে সন্ত্রাসের। সন্ত্রাসকে ঠেকাতে ঠেকাতে নিরাপত্তা নিজেই হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাদী।’ – (‘চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী’)। এভাবে সময় ও সমাজকে ছুঁয়ে, তারই মধ্য থেকে আমাদের স্বভাবপ্রবণতা ও রিপুকে ছুঁয়েও এই নিবন্ধগুলো হয়ে উঠেছে পাঠকের Serious চিন্তার খোরাক।

 

তিন

ত্রম্নটিমুক্ত বইও তো পাওয়া যায় সেইসব পেয়েছির দেশে। তাই কিছু ত্রম্নটি এই গ্রন্থেরও স্বীকার্য। যেমন আগেই বলা হয়েছে দ্বিতীয় নিবন্ধের অস্বস্তিকর মৃত্যু-প্রসঙ্গের পুনরাবর্তন। ‘অথ কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি’ শীর্ষক নিবন্ধের ভাষাবিন্যাস, যা ঈষৎ জটিল – গ্রন্থের অন্যান্য নিবন্ধের সহজ-সাবলীল সপ্রতিভ ভাষার পাশে যাকে কিছুটা যেন মলিন-মন্থর লাগে। ‘ডায়েরির বদলে কিছু এলোমেলো কথা’র পরিসমাপ্তিও মনে একটা অতৃপ্তির রেশ রেখে যায়; তা যতটা না অশেষের ব্যঞ্জনায়, তার চেয়ে বেশি কিছুটা আচম্বিত সমাপ্তিতে। আর ছাপাখানার ভূত তো যে-কোনো বইয়েরই অনিবার্য নিয়তি; তাকে ত্রম্নটি বলতে দ্বিধা হয়। তবু এমন পরিপাটি বইতে তেমন মুদ্রণপ্রমাদ অল্প হলেও যে চোখে পড়ে না – তা নয়। যেমন, ৬১ পৃষ্ঠায় ‘হৃদয়দৌবল্য’ (ব-এর ওপরে রেফ পড়েনি) কিংবা পৃষ্ঠা ৯৪-তে ‘অবাক চোখে ট্রেনে ছুটে যেতে দেখা ভানুমতী’ (বস্ত্তত যা হবে, ট্রেন ছুটে যেতে দেখা)। এসব নগণ্য ভুল বইটির অজস্র ঠিকের পাশে দাঁড়ায় না। বেশ পরিপাটি ও যত্নের চিহ্ন বইটিতে আগাগোড়াই বর্তমান। সেই পারিপাট্য রয়ে যায় চঞ্চল গুঁইয়ের করা প্রচ্ছদেও। আর রয়ে যায় বইটির লেখার আদলে। আঙ্গিকে।

ভাষা ও আঙ্গিকগত সারল্যের মতই স্মার্ট কথনভঙ্গিমা আদ্যন্ত বইটির রচনাগুলোর সম্পদ। কোথাওকোথাও তাতে বেজে উঠেছে সঘন বিষাদ; কোথাও-বা প্রচ্ছন্ন কৌতুক, হয়তো-বা মৃদু বিদ্রূপও! সেসব মিলিয়ে গ্রন্থের নিবন্ধগুলো এক সহজ প্রাণময়তায় ভরে উঠেছে। সবশেষে, গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতো তেমনই কতকগুলো রচনাংশ সাজিয়ে দেওয়া গেল; সমালোচনা নয়, প্রশংসায় –

ক. ‘…আয়নায় দেখেছেন নিজেকে, স্বপ্নতাড়িত আবার স্বপ্নোত্থিতও, সেসঙ্গে বাদাম বা আখরোটের মত নিজেকে ভেঙেওছেন শব্দে-শব্দবন্ধে।’ – (প্রণবেন্দু প্রসঙ্গে গ্রন্থের চতুর্থ নিবন্ধে বলতে গিয়ে)

খ. ‘ঘাবড়াবেন না, রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে ঢুকতে পারার মধ্যেই তো বীরত্ব, এমন কী মধ্য মধ্যবিত্তেরও।’  – (‘মা গৃধঃ’)

গ. ‘নথি সার্বভৌম, নথি অবিনশ্বর। আমরা আগুনে পুড়ব, মাটিতে সেঁধিয়ে গিয়ে মাটি হব, ভীষণ চঞ্চুর হব ভক্ষ্য, কিন্তু নথি থেকে যাবে।’ – (‘দুই জন্মদিন’, অণুচিন্ত)

ঘ. ‘সকালের টেলিফোন করে কি মৃত্যুই?’ –              (‘টেলিফোন ও মৃত্যু’)

ঙ. ‘অথচ জানলা তো মাত্র বিশৃঙ্খলা নয়, নয় অনিয়ম, জানলা তো পরিসরও। একটা নিরেট দেয়ালে একখানা জানলা কেটে দিলে কেমন চোখের আরাম হয়। আর চোখের আরাম যে মনের আরামও নয় তাই বা কে বলবে!’ – (‘জানলা ও লাশ : দুই অসংলগ্ন ভাবনা’)

চ. ‘বুঝতে হবে পরীক্ষা কোনো দ্যূতক্রীড়া নয়; কপট পাশার তো নয়ই, নয় অকপট পাশারও ছোঁড়াছুঁড়ি’। – (‘নম্বরের রাজত্ব’, অণুচিন্ত)।

এমনই আরো অজস্র দৃষ্টান্ত দিয়ে এই আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করা যায়; যদিও তা নিষ্প্রয়োজন। কেননা, বইটিকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের পরিচয়ের সীমানায় এনে ফেলতে পেরেছি। এনে ফেলেছি ভালোলাগার সীমানাতেও! r