কিন্নরীদের দেশে

কানাই কুণ্ডু
এই পৃথিবী ভালোবাসার ঘরবাড়ি। ভালোবাসার টানে ছুটে বেড়ানো। এক জীবনে কুলোয় না। ছুটে দৌড়ে ফুরোয় না। পাহাড় দীর্ণ করা নদী। আকাশছোঁয়া বরফ শিখরের দীর্ঘ বিস্তার। ঢেউ ঢেউ সবুজ উপত্যকা। রুক্ষ পাথর ফুঁড়ে গজিয়ে-ওঠা এক পাইনের চিত্রকল্প। এবং রূপশ্রী অপ্সরাদের সান্নিধ্যের ডাকে তাই আবার বেরিয়ে পড়ি।
শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র প্রদ্যুু নাকি ছিলেন কিন্নরের রাজামশাই। এই বংশধরের শেষতম বা একশ বাইশতম রাজা ছিলেন রামপুরের বীরভদ্র সিং। তিনি আবার ভারতীয় লোকসভার প্রাক্তন সাংসদ এবং একদা হিমাচল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। পৌরাণিক বর্ণনায় কিন্নর মর্তের ইন্দ্রকানন। অর্থাৎ দেবতাদের বিলাসভূমি। কিন্নরীদের দৃঢ় বিশ্বাস, তারা দেবযোনিসম্ভূত। ভৌগোলিক অবস্থানে মঙ্গোলীয় হলেও, তারা দৈবকান্তি প্রাপ্ত। ব্যতিক্রমীভাবে খাড়া নাক, দীর্ঘ চোখ, সুস্পষ্ট ভ্রƒ এবং কালো চুল। গৌরবর্ণা, রক্তিম ওষ্ঠ কপোলে স্বর্ণালংকার ভূষিতা। নাচে-গানে পারদর্শী।
ঝোলা কম্বল ঘাড়ে নিয়ে হাওড়া থেকে কালকা মেলে আমি কালকায় হাজির। গন্তব্য হিমাচলের রাজধানী সিমলা। কালকা থেকে খেলনা রেলগাড়ি। কু-ঝিক-ঝিক নয়। ডিজেল এঞ্জিনে টানা ছোট ছোট কামরা। জানালা ঘেঁষে বসেছি। টানা ৯৬ কিলোমিটার রোমাঞ্চকর যাত্রা। এঁকেবেঁকে পাহাড় পেঁচিয়ে, অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে ফার্ন-পাইনের ঘন ছায়ার লুটোপুটি। আপেল-আঙুর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, জুমচাষের ধাপ বেয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে এগিয়ে চলি। প্রায় খানবিশেক স্টেশন, শখানেক টানেল আর প্রবহমান প্রপাত পেরিয়ে প্রায় ঘণ্টা ছয়েক পরে সিমলা। অবশ্য তাড়া থাকলে বাসে অথবা কালকা থেকে গাড়ি ভাড়া করে সময় সংক্ষেপ করা যায়। মাত্র দু-আড়াই ঘণ্টার পথ। চণ্ডিগড়ে নেমেও বাস বা গাড়ি ধরা যেতে পারে। ঘণ্টা চারেক সময় নেয়। কিন্তু খেলনাগাড়ির এমন উঠোন ক্ষেত-খামার পেরিয়ে, ঝরনাধারার স্পর্শ নিয়ে ফার-পাইনের ছায়া মেখে চলা ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ।
সিমলা পরিচিত শহর। কুলু মানালি কেলং, ডালহৌসি ধরমশালা চাম্বা খাজিয়ার ইত্যাদি ভ্রমণে এসেছি কয়েকবার। লাদাখ যেতেও সিমলা মানালি থেকে যাত্রা শুরু। লে ম্যালে ইন্ডিয়া কফি হাউসে আড্ডা মেরেছি অ্যাডভান্সড স্টাডিজের গবেষক বন্ধু ও সাহিত্যমহলে। এবারে আমার সিমলায় অবস্থান কেবল কিন্নরদেশে যাত্রাপথ বদলের কারণে। সিমলা ভারতের বৃহত্তম শৈলশহর এবং হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। ব্রিটিশ রাজত্বে ইংরেজরা নিজেদের দেশের আদলে একটুকরো ইংল্যান্ড গড়েছিলেন সিমলায়। গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। ম্যাল সিমলার সিঁদুর টিপ। ম্যাল ঘিরে সিমলার কালীবাড়ি, খ্রায়েস্ট চার্চ, বাজার হোটেল রেস্তোরাঁ। শেষ হয়েছে গাঁধিমূর্তির পাদদেশে।
ম্যালের নিচে সিমলা বাসস্ট্যান্ড। সেখানেই গাড়িমালিকদের ইউনিয়ন দফতর। নির্দিষ্ট রেটে গাড়িভাড়া পাওয়া যায়। বিকেলেই জিপ ভাড়া করলাম। পরের দিন ভোরে জিপ হোটেলে হাজির। লটবহর নিয়ে অধিষ্ঠান। গন্তব্য সারাহান। অর্থাৎ কিন্নরের সিংহদরজা। সিমলার কার্ট রোড ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধানে হিন্দুস্তান টিবেট হাইওয়ে। ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধকালে সেনাদের তত্ত্বাবধানে এবং নিয়ন্ত্রণে তৈরি হয় এই দীর্ঘ পথ। জাতীয় পথনম্বর এন এইচ ২২। হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত এবং সীমান্ত জেলা কিন্নর। মাত্র ৭৭টি গ্রাম নিয়ে জেলা। আয়তন ৬৫২০ কিমি। মহকুমা মাত্র তিন। প্রতি বর্গকিমিতে ১২ জন বাস করেন। বৃষ্টিপাত বেশি। তার চেয়ে বেশি তুষারপাত এবং শীত। তুষারপাতের গভীরতায় সাময়িক চলাচল বন্ধ থাকে। প্রায়শই বর্ষার আধিক্যে আচমকা বন্যায় ভেসে যায় সেতু। জলমগ্ন হয় গ্রাম। চলার পথে বন্যাবিধ্বস্ত গ্রামের ধ্বংসাবশেষ আতঙ্ক জাগায়।
নদীর দাঁতালো ধার পাহাড় কেটে নেমে গেছে গভীরে। ক্রমাগত খরস্রোতে কেটে চলেছে শক্ত পাথরের দেয়াল। ডাইনে পাহাড়। বাঁয়ে নদীগহ্বর। সমতলের মানুষ আমি। নদীগহ্বরের দিকে তাকালে বুক কাঁপে। কোথাও মাথার ওপরে ঝুলন্ত পাহাড়ি খাঁজ। কোনো পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে নুড়ি-পাথর। উচ্ছল ঝরনাধারা ভাসিয়ে দিচ্ছে পথ। কোথাও ধসে পড়ছে পাহাড়। তবে সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় নবনির্মাণও চলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। পাশে বয়ে চলে স্বচ্ছ নীল জলের নদী শতদ্রু অর্থাৎ শাটলেজ। চীনের মহাকৈলাসের বরফগলা জল জমছে মানস সরোবরে। বিস্তীর্ণ এই হৃদকে সরোবর আখ্যা দেওয়া হয়েছে ৩০ মাইলব্যাপী বিস্তারের কারণে। মানস সরোবর থেকে প্রবাহিত নদী চিনের পাহাড় চিরে নন্দিত করেছে ভারতে শিবঠাকুরের অন্যতম দেশ কিন্নর কৈলাস। পুরাণে শিবঠাকুরের তিন দেশের বর্ণনা। একটি তাঁর প্রধান আবাস মহাকৈলাস, মানস সরোবরের ওপারে যার অবস্থান। দ্বিতীয় কিন্নরের এই বরফাবৃত কৈলাস পাহাড়। এবং তৃতীয়টি মণিকৈলাস বা হিমাচলের চাম্বা উপত্যকায় মণিমহেশ। ইরাবতী নদীখাতের ভারমোর অঞ্চলে।
ফাগো কুফরি চেইল ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি। পথের নিশানায় শতদ্রু। তার চপল ছন্দ অনুসরণ করে প্রায় ১১৬ কিমি পাড়ি। দুপুরবেলা হাজির হলাম রামপুর। অর্থাৎ রামপুর-বুশাহার। হাটবাজার দোকানপাট রেস্তোরাঁয় জমজমাট। আগে রাস্তা ছিল এই পর্যন্ত। ১৯৬২-র পরে দীর্ঘায়িত হয় কিন্নরের ছিতকুল অঞ্চলে। অতীতকালে রাজপুত্র রাজা বুশাহারের রাজধানী ছিল এই রামপুর। উচ্চতা প্রায় ৩০০০ ফুট। কাঠের রাজপ্রাসাদ অনুপম দারুশিল্পে সুশোভন। প্রাসাদের নাম পদম প্যালেস। দেয়ালে সমৃদ্ধ ম্যুরাল পেন্টিং অতীত দিনের উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত। একসময়ে চীন তিব্বতের রমরমা বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। বৌদ্ধ গুম্ফাটিও প্রাচীন। হিন্দু মন্দিরের আধিক্য আছে। দূরের আকাশসীমায় বরফ পাহাড়ের উঁকি।
বিকেলে রওনা দিলাম সারাহান। মর্তের স্বর্গে আসতে হলে সারাহানই প্রধান ফটক। এরপরই কিন্নর জেলার শুরু। রামপুর থেকে জিওরি পেরিয়ে ৪৩ কিমি দূরে। ৬০৭০ ফুট উচ্চতায়। থাকার ব্যবস্থায় নানা হোটেল। হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল শ্রীখণ্ড এবং ভীমকালী মন্দিরের গেস্ট হাউস। আজ এখানেই যাত্রাবিরতি।
দূষণহীন হিমেল হাওয়া, বরফ-মুকুটে ঢাকা পাহাড়তলি, পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্তে ছড়ানো বরফে মোড়া পাহাড়। এবং উদ্ধত-উন্নত বরফস্তূপে ঢাকা স্বয়ং কৈলাস। পাশের বরফাবৃত চূড়াকে স্থানীয় মানুষ বলে পার্বতী পাহাড়। এখানেই কিন্নরীদের প্রথম দর্শনলাভ। প্রত্যেকেই সালংকারা। কথায় কথায় খিলখিল হাসি। ভাঙা হিন্দিতে সংলাপ। চোখে লোভাতুর মায়া। অনন্ত সবুজের মাঝে স্বচ্ছন্দ হাঁটাচলা। প্রকৃতির বিরল শোভার দৃশ্যময়তা মুগ্ধ করে।
দেখার মতো একটিই জিনিস, কিন্তু আসামান্য। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন ভীমকালী মন্দিরটি দারুশিল্পনন্দিত। অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা। সৃষ্টিশিল্পে বৌদ্ধপ্রভাব। নির্মাণশৈলীতেও বৌদ্ধ তথা তিব্বতীয় প্রভাবমণ্ডিত। সোনার পাতে মোড়া দরজায় পুরাণের বিভিন্ন আখ্যানমূর্তি। দেবীমূর্তিও সোনার। দশেরায় উৎসব পালিত হয় প্রতি বছর। পশুবলি প্রথা প্রচলিত। পূজারি বর্তমান রক্ষকেরা লামার মতো মুণ্ডিত মস্তক এবং গেরুয়াধারী। সামনে দৃষ্টি আড়াল করা অরণ্যঘন পাহাড়ে আছে হিমাচলের বর্ণিল পাখি মোনাল প্রজনন কেন্দ্র। আর প্রান্তরময় ছড়ানো আপেল অ্যাপ্রিকট চিলগোজা পেস্তার বাগান। নিবিড় শ্যামলিমার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কৈলাস পার্বতী এবং শ্রীখণ্ড পর্বতশ্রেণি। প্রজাপতির বাহার।
চলেছি নদীর সঙ্গে। পাহাড়ে-পাথরে ধাক্কা দিতে দিতে কখনো গর্জনে অথবা কুলুকুলু নিবিড় ছন্দে। প্রায় সারাটা পথ তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। এপারে পাহাড়কাটা পথ। ওপারে আকাশছোঁয়া ধ্যানগম্ভীর ন্যাড়া পাথরের গাছপালাহীন রুক্ষ পর্বত। মাঝে নদী বয়ে চলে শ্রান্তিহীন। এদিকে রুক্ষ পাহাড়ি দেয়াল। কোথাও ঝরনা ঝরে। জল ছিটিয়ে মন ভিজিয়ে দেয়। কোথাও আবার নুড়ি-পাথরের ধস। ধস কেবল পথ রোধ করে না, পথরেখা গুঁড়িয়ে নেমে যায় নদীখাতে। শীর্ণ পথের আয়তনে গাড়ি নিয়ে এগোনো দুরূহ হয়ে পড়ে। এই অস্বস্তি আতঙ্ক দূর করতে হঠাৎ ফুলে শস্যে সবুজে ঢাকা গ্রাম। পাথুরে ঘরবাড়ি। ওপরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দেবশিশু; কর্মঠ চাষি মহিলা। পুরুষ সম্প্রদায় প্রধানত অলস। মহিলারাই দোকান চালায়, কৃষিকাজে ব্যস্ত। আবার ঘর সাজায়। বাচ্চা ও পুরুষদের লালন করে।
প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ কিমি পাকদণ্ডির পর শতদ্রুর ওপরে সেতু পেরিয়ে ওয়াংটু। পথের পাশে সেনা ছাউনি, অফিস দফতর। কিন্নরের পথ চলতে চলতে বেশ কয়েক জায়গায় পাহাড়ের কোলে অথবা নদীর বিস্তৃত তীরভূমিতে সেনাদের আবাস। উচ্চতায় ৫৩৬০ ফুট। ওয়াংটুর গুরুত্ব চেকপোস্টের কারণে। কিছুদিন আগেও ভারতীয়দের কিন্নর প্রবেশে ইনার লাইন পারমিটের প্রয়োজন হতো। তবু প্রয়োজনে গাড়ি-বাস থামিয়ে তারা ভারতীয়ত্বের প্রমাণপত্র দাবি করতে পারে। গাড়ির লাইসেন্স কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখা হয়। এলাকায় সেনাদের সংখ্যাধিক্য। কিন্নর-ভ্রমণে তাই পাসপোর্ট বা ভোটার কার্ড সঙ্গে রাখা উচিত।
ওয়াংটু ছাড়িয়ে কিছুটা গেলেই মনোরম এক ছোট্ট জনপদ টাপরি। টাপরি মানে কুটির। তবে এখানে কুটিরও পাথরের। মসৃণ কাটা পাথরের চাপানে ছাউনি। উঠোনে পাথর কেটে মাটি ফেলে কয়েকটা যতেœর ফুল বা ফলের গাছ। বন বিভাগের বাংলো, পিডব্লুডির বিশ্রামগৃহ আছে। দোকানপাট বিশেষ নেই। তবে চা-ভুজিয়া-সামোসা এবং বিড়ি-সিগারেট, লম্বা ঝোলানো প্যাকেটে তামাক মশলা পানবাহারের দোকান ঘিরে বেকার পুরুষের আড্ডা আছে একাধিক। চারপাশে সুনসান নির্জনতা।
কেন জানি না, ইচ্ছে হলো, অন্তত একটা রাত্রি এখানে কাটাই। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নির্জনতা কাকে বলে জানতে হলে এখানে রাত্রিবাস এক অনবদ্য উপলব্ধি। সন্ধ্যা নামলে বিদ্যুৎ দুর্লভ। অচ্ছেদ্য অন্ধকার। এবং শব্দহীন স্তব্ধতা। চারপাশে ধ্যানগম্ভীর ঋষির মতো পাহাড়ের সারি অন্ধকারকে জমাট নিশিছদ্র করেছে। পার্থিব অস্তিত্ব কেবল নিচের রাস্তায় চলমান গাড়ি বা ট্রাকের গোঙানি। আরো নিচে শতদ্রুর কলতান। অন্ধকারে একক আমি নিজেকেই খুঁজে পাই না। তীব্র ঠান্ডায় জবুথবু। উচ্চতা ৬১৩০ ফুট।
টাপরি ছাড়িয়ে কিছুটা এগোলেই ভারতীয় বিজ্ঞানী হোমি ভাবার পরিকল্পনায় জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। বিশাল কর্মকাণ্ড। সুড়ঙ্গের মধ্যে জলস্রোত প্রবাহিত করে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ। আলোকিত করছে হিমাচলের কিছু অংশ। পাশেই সুদৃশ্য ভাবানগর। কর্মীদের আবাস দফতর বাজার স্কুল স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ব্যাংকও আছে।
কারছামে পাহাড়ি পথ বেয়ে যেতে যেতে এক মনোহরণ দৃশ্য। শতদ্রুর নীল জলে এসে মিশেছে সবুজ নাকি তুঁতে? জলের নদী বসপা। পথের ওপর থেকেই নদী-সঙ্গমের রং বিভাজন স্পষ্ট। শতদ্রুর সঙ্গ ছেড়ে এবার বসপাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলি সাংলার দিকে। দূরত্ব প্রায় ২২ কিমি। কিন্তু যত এগোই নিসর্গচিত্র বদলে যেতে থাকে। উচ্চতা প্রায় ৬২২৮ ফুট। নৈসর্গিক বিলাস লুব্ধ করবে। পাথরের বুকে নেচে চলা নদী, সবুজ বনানী হাত নেড়ে কাছে ডাকে। নানা বর্ণের নানা আকৃতির পাখি গান শোনায়। কিন্নরী গ্রামের ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা হাত নেড়ে টা-টা করে। যুবতীদের খিলখিল হাসি।
বসপা নদী আর অন্তহীন পাহাড়ি ঢেউয়ের সঙ্গী হয়ে এগিয়ে চলেছি। ক্রমশ ওপরের দিকে। জিপ গোঁ-গোঁ করে। কোথাও আবার ধসের কারণে সাময়িক থমকে থাকা। পাকা পিচ-রাস্তার বদলে পাথর-বিছানো অসমান পথ। ঝাঁকি লাগে। বাক্স-পেঁটরা তোলপাড়। প্রায় দুপুর নাগদ ৮৮০০ ফুট উচ্চতার সাংলা। প্রথম অনুসন্ধান হোটেল বা রিসর্ট। এখানে আমার তিনদিনের অবস্থান। তবে হোস্টেল-রিসর্টের সংখ্যা পর্যাপ্ত। তবু কলকাতার হিমাচল ট্যুরিজম থেকে সর্বত্র হোটেল আগাম বুক করে আসা যায়। আমার হোটেল দারু-নির্মিত। ওপরে টিন। কক্ষ প্রশস্ত। এবং অপেক্ষাকৃত ফাঁকা অঞ্চলে। নাম মাউন্ট কৈলাস গেস্ট হাউস।
হোটেলের অদূরে প্রায় পাখির নজরের মতো নিচে পরিব্যাপ্ত সাংলার ফলদায়ী উপত্যকার নিবিড় শ্যামলিমা। উপত্যকা অঞ্চল কামরু নামে পরিচিত। ব্যাপ্তি ৯৫ কিমি। কাশ্মিরের পহলগাঁও বা অন্ধ্রের উপত্যকা আরাকু এতো পরিব্যাপ্ত নয়। পাহাড়ি ফসলের এমন উদ্বৃত্ত উৎপাদনও সেখানে নেই। ভুট্টা বজরা গম যব আলু ছাড়াও বিস্তীর্ণ বনরাজিতে প্রভূত পরিমাণে উৎপন্ন হয় আঙুর আপেল পিচ প্লাম অ্যালামন্ড চেরি পেস্তা অ্যাপ্রিকট এবং চিলগোজা। তবে সর্বাধিক খ্যাতিলাভ করেছে সোনালি আপেল। বিদেশের বাজারে এই আপেলের বিশেষ কদর। এই বিস্তীর্ণ শস্যভূমিকে উর্বর রেখেছে বর্ষার বারিধারা এবং বসপার অবিরাম বরফগলা জলের স্রোত। চিরসবুজ এই প্রান্তর ঘিরে আছে হিমাচলের তুষারমুকুট-শোভিত নানা শিখর। ধৌলাধার পর্বতমালা মিশেছে এই পাহাড়শ্রেণিতে।
অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছোট ছোট এবং কাঠের। ছবির মতো। সম্প্রতি পাকাবাড়িও গড়ে উঠেছে। আছে মন্দির দেউল বৌদ্ধ মনাস্ট্রি। স্থাপত্যে বৌদ্ধপ্রভাব। ফার পাইন ফার্ন পিক ওক গাছও আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
কৃষি এবং পশুপালন এদের মূল জীবিকা। ছাগল ভেড়া গাধা ঘোড়া টাট্টু পালনই উপার্জনের প্রধান উৎস। বরফচূড়ায় পাহাড়। বিস্তীর্ণ সবুজে ঢাকা উপত্যকা এবং সারাদিন-সারারাত বসপা নদীর নূপুর বেজে চলে অবিরাম। প্রকৃতির এই অনাবিল প্রশান্তি মনকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় পেছনে ছেড়ে আসা কর্মময় টানাহেঁচড়ার যাপনচিত্র। বুঁদ হয়ে বসে থাকি তিনটে দিন।
এবার ভারতের সীমান্তগ্রাম ছিতকুল। সাংলা থেকে ২৬ কিমি ওপরে। উচ্চতা ১১৩১৬ ফুট। আবার পাহাড়ের প্যাঁচ। বুক ঢিপঢিপ সংকীর্ণ পথ। দুপাশের পাহাড়ে খাড়া গাছপালা আর অজস্র ফুলের সমারোহ। প্রিমুলা পপি ভূর্জপত্র এবং আপেল জাফরান ফুলের গন্ধে মোহিত পথিক। খুবই ছোট জনপদ। ঘরবাড়ির সংখ্যা প্রায় শখানেক। অধিবাসীরাও সংখ্যায় পাঁচ-সাতশোর বেশি নয়। ছোট বাজার, দোকানপাট এবং অবশ্যই সীমান্ত সৈনিক মোতায়েন। সব দেখে মনে হবে, কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ। হু-হু হিমেল হাওয়ার ঝাপট্ এবং বরফঢাকা পাহাড়। দূরে নী-লা পাশ। ওপারে চীন-অধিকৃত তিব্বত। মাঝের পাশ অঞ্চল নো ম্যানস ল্যান্ড। উদার প্রকৃতি। এই নী-লা পাশের বরফগলা জল থেকেই বসপার জন্ম। খরস্রোতে গড়িয়ে নেমেছে নিচের দিকে। সাংলার অদূরে শতদ্রুতে মিলিত হয়ে সোহাগী রূপে থমকে আছে মিলিত স্রোতে। বন বিভাগের বাংলো, পিডব্লুডির বিশ্রামগৃহ ছাড়াও আছে ট্রেকিং ক্যাম্পের সুদৃশ্য তাঁবু। ছিতকুল গ্রাম পর্যন্ত দেশি-বিদেশি পর্যটকের গতি অবাধ। এবং কিন্নরে প্রায়শই বিদেশি পর্যটকের দেখা মেলে।
সাংলায় ফিরে রাত্রিবাস। পরের সকালেই কল্পলোকের স্বপ্নপুরী কল্পা। শিবঠাকুরের ঘরবাড়ি কিন্নর কৈলাস। সাংলা থেকে আবার টাপরি। টাপরি থেকে পাওরির সেনাছাউনি ধরে এগিয়ে মোড় নিয়ে আরো ওপরে ওঠা। প্রায় ৫২ কিমি পাড়ি দিয়ে কিন্নরের জেলা সদর রেকং পিও। রেকং পিও থেকে খাড়া চড়াই বেয়ে আরো ১২ কিমি উপরে ওঠা। পথের দুপাশে ঘন অরণ্যের বিস্তার। পাইন ফার দেবদারু ওক পিচ। ঝরনার ঝরঝর, জুম চাষের ক্ষেত এবং চোখজুড়ানো বরফপাহাড় প্রায় হাতের নাগালে। ফসলের লোভে পাহাড়ি অরণ্য থেকে নেমে আসে হরিণের পাল। মেরুভালুকের নাকি যাতায়াত ছিল আগে।
যাদের কৈলাস দর্শনের বাসনা আছে, তাদের উচিত হবে অপেক্ষাকৃত অল্প দুর্গম এবং মিতব্যয়ে কল্পায় ইচ্ছাপূরণ। মানস সরোবর কৈলাস অতীব দুর্গম এবং ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু কল্পায় এলে চলতে-ফিরতে কৈলাসদর্শন। পথে হোটেলের বারান্দায়, আপেলবাগানে বা জানালায় তাকালেই কৈলাসের হিমস্পর্শ। ঠিকরে পড়ে সূর্যের আলো। দিনের নানা সময়ে কৈলাসের নানা রঙের বিচ্ছুরণ স্তম্ভিত করে বিস্ময়ে।
কিছুকাল আগেও কল্পা ছিল কিন্নরের জেলা সদর। অধিক উচ্চতা এবং শৈত্যের কারণে সদর স্থানান্তরিত হয় রেকং পিওতে। অর্থাৎ প্রায় ৯০৫০ ফুট উচ্চতা থেকে ৭৫০০ ফুটের নাব্যতায়। বর্তমানে রেকং পিও একটি বাণিজ্যিক শহর। অফিস আদালত স্কুল কলেজ হাসপাতাল বাজার দোকান শোরুম মন্দির গুম্ফা মনাস্ট্রি ব্যাংক পোস্ট অফিসে জমজমাট। পিও শহরের আয়তন ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
কিন্নরীরা দশ শতাংশ বৌদ্ধ। বাকি সবাই হিন্দু। বর্তমান জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ আদি-বংশোদ্ভূত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শান্তিপূর্ণ। সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। বিয়েতে দ্রৌপদী প্রথা চালু থাকলেও বর্তমানে প্রায় লুপ্ত। প্রায় প্রতি উৎসবে নাচগানের হুল্লোড়। মিহি সুরের বাঁশি এবং মাদলের তালে অরণ্য পাহাড় কেঁপে ওঠে। প্রিয় উৎসব ফুলেখ। আগস্টের শেষে পালিত হয়। বর্ণিল চটকদার পোশাক ও পারিপাট্যে প্রাণখোলা আনন্দে সকলের যোগদান। ধর্মপরায়ণ শান্ত এবং নিরুপদ্রব।
কল্পনার দেশ এই কল্পা। সৌন্দর্যসম্ভারে উৎকৃষ্ট। তুষার এবং সবুজের এমন নিবিড় সম্পর্ক মনকে বিবশ করে। সবুজের মগ্নতায় মিশে আছে ফলদায়ী গাছপালা। গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে তৈরি হয় আঙুর আপেল অ্যাপ্রিকটের জারকে বেহমি এবং চুলি নামের সুরা। শরীর থাকে তরতাজা। যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই তথ্য কতটা সত্য জানি না, তবে উত্তেজক এবং সৌরভবিশিষ্ট সন্দেহ নেই।
নিবিড় প্রকৃতিসান্নিধ্য এবং কিন্নরীদের অকৃত্রিম আত্মীয়তার উষ্ণ স্পর্শে কয়েকদিনের স্বর্গবাস এখন আর নিছক কল্পনা নয়।

Published :


Comments

Leave a Reply