কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

রবিশংকর বল

\ ২ \

এ-শহরে এখন আর কেউ আকাশ দেখে না।

হয় সবাই ছুটছে, না-হলে কানে লাগানো ইয়ারফোনে কথা বলে যাচ্ছে, দেখে মনে হয়, মঞ্চে সে স্বগতোক্তি বলে চলেছে বা গান করছে, এমনকি কেউ-কেউ হাঁটতে-হাঁটতেই মোবাইলে গেম খেলে যাচ্ছে। বাসে-ট্রামে-মেট্রোতে কেউ কারোর দিকে তাকায় না, তাকাবার অবসরই নেই, মোবাইল থেকে তার জানার বাইরে কিছু ফসকে গেলেই তো পিছিয়ে পড়তে হবে। ওই যে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইনে লেখে, পড়তে হয়, না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়। কেউ আর পিছিয়ে পড়তে চায় না। রঘুপতির মতো হাতেগোনা কিছু মানুষ আছে, যারা হেলেদুলে হাঁটে, এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে কী যেন দেখে, দূর থেকে ভেসে-আসা কোনো হারানো গন্ধ শোঁকে, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, আবার হাঁটে। আমরা রাস্তার ভিখিরি, ভবঘুরে, কাগজ কুড়োনোর দল – রঘুপতি নিজেকে এভাবেই চিহ্নিত করে।

রঘুপতির মনে পড়ে, তার দাদুর কাছেই সে প্রথম আকাশ চিনেছিল। একদিন গ্রামের মেঠোপথ পেরিয়ে আদিগন্ত ছড়ানো ধানক্ষেতের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে দাদুর সঙ্গে। তখন মাঠের ধানকাটা হয়ে গেছে। এবড়ো- খেবড়ো জমিতে ধানগাছের শুকনো গোড়া জেগে আছে আর সেখানে ধেঁড়ে ইঁদুরেরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পড়ে-থাকা ধান নিয়ে তারা মাটির নিচের গর্তে জমা করবে। জমির মাঝে-মাঝে জেগে আছে টেলিগ্রাফের রুপোলি পোস্ট। পূর্ণচন্দ্র বলতেন, ‘জানো তো দাদুভাই, এই আকাশের কোনো শেষ নেই। ওই যে দূরে দেখতে পাচ্ছ কেমন মাটির সঙ্গে বুঝি মিশে গেছে আকাশ, সেখানেও শেষ নয়, তুমি চলতেই থাকবে, কিন্তু আকাশ কখনো ফুরোবে না…।’ তারা জমির আল ধরে হাঁটছিল। ‘- ওই আকাশের পারে মহাশূন্য, সে-ও আরেক জগৎ দাদুভাই।’ নিজের মনেই বলে যেতেন পূর্ণচন্দ্র, ‘দ্যুলোকের সঙ্গে নিত্যসঙ্গতা এই পৃথিবী জুড়ে আছেন আমাদের জীবনের আদি ও অন্ত। আমাদের জন্ম-সাধনা ও মৃত্যু যেন এই আদিমিথুনের বুকে ঢেউয়ের ওঠপড়ার মতো।’ নাতির সঙ্গে কথা বলতে-বলতে পূর্ণচন্দ্র ফিরে গিয়েছিলেন নদীবিধৌত সেই গল্প-পরনকথার দেশে। দাদু বলেছিলেন, গ্রামের রেবতী একদিন আকাশের শেষ খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল, গ্রামের মানুষরা বলত, নক্ষত্র তার ওপর ভর করেছে, যেমন কালপুরুষ দেখতে ভবঘুরে হয়ে যায় কেউ-কেউ, আর তারপর রেবতী একদিন ফিরে এসেছিল, তখন সে উন্মাদ। রেবতীর কথা ভাবলেই রঘুপতির মনে পড়ে তিতাসের তীরের কিশোরের কথা। পূর্ণচন্দ্রের মনে হতো, রেবতী যেন এই পৃথিবীর মানুষ নয়, সে-ও বুঝি সেই সাতাশটি নক্ষত্রের একটি – রেবতী। দাদুর কাছেই রঘুপতি জেনেছিল, আকাশকে শুধু বাইরে দেখা যায় না, বুকের ভেতরে অনুভব করা যায়, নইলে সেদিন, সেই প্রথম, দাদুর সঙ্গে থেকেও কেন মনে হয়েছিল, সে বুঝি এই চরাচরে হারিয়ে গেছে, হাত-ধরে-থাকা বৃদ্ধকে সে চেনে না। পূর্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তার মনে হয়েছিল, সে কি তবে কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল? প্রথম আকাশকে জানার বিষয় থেকেই সে এই শহরেও বারবার আকাশ দেখেছে, আজো দেখতে পায়। যারা বলে, এ-শহরে আকাশ দেখা যায় না, তাদের দিকে সে হতাশের মতো তাকিয়ে থেকেছে,  আকাশ দেখার জন্য কখনো গ্রামে যাওয়ার কথা মনে হয়নি রঘুপতির।

কিন্তু আকাশ কি আর সত্যিই থাকবে? এই শহরে? মানুষ ধীরে-ধীরে দেখতে ভুলে গেলে আকাশও তো হারিয়ে যাবে। তার গায়ে মেঘের নানারকম নকশা তৈরি হবে না। তুমি যাকে ভুলে যেতে চাও, একসময় সেও কি তোমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় না? বাসস্টপে দাঁড়িয়ে এসব সাত-পাঁচ, এলোমেলো ভাবছিল রঘুপতি।

এ-শহরে এখন আর কেউ আকাশ দেখতে চায় না। তাই কেউই দেখতে পেল না। এমনকি রঘুপতিও নয়, তখনই আকাশে ভেসে চলেছে নানা রঙের কারুকাজ করা একটি কার্পেট, সেখানে বসে আছেন শেহ্রজাদে আর সুলতান শাহরিয়ার।

– এই কি তোমার ভারতবর্ষ বিবিজান? সুলতান সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন – তুমি তো বলেছিলে, সে এক প্রাচীন দেশ। কিন্তু এখানে বাড়িগুলো দেখছি আকাশ ছুঁয়েছে, যেন এক-একটা দৈত্য।

– আর গরিবগুর্বোদের থাকার জায়গাগুলো মাটির সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। এত উঁচু থেকে দেখতে পাবেন না। শেহ্রজাদে বললেন।

– তোমার প্রাচীন ভারতবর্ষ তাহলে কোথায়?

শেহ্রজাদে হাসলেন। – কিতাবে আর মানুষের স্বপ্নে দেখা যায়। এমনও ভাবতে পারেন, সে ছিল এক নবীন দেশ – পৃথিবী এখনো নবীনা – আর এখন যা দেখছেন, তা-ই প্রাচীন, জরাগ্রস্ত।

– তুমি বড় হেঁয়ালি জানো।

– সব গল্পই তো হেঁয়ালি জাঁহাপনা। হাজার-এক রাত ধরে হেঁয়ালি শুনিয়েই তো নিজের জীবন বাঁচিয়েছিলাম আমি।

সুলতান হেসে বললেন, ‘আরো বড় হেঁয়ালি, তোমার বলা কিস্সা শুনতে-শুনতে আমি তোমাকেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।’

– ইশ্কের চেয়ে বড় হেঁয়ালি আর কী আছে হুজুর!

দিল-এ-নাঁদা! তুমে হুয়া কেয়া হ্যায়?

আখির ইস দর্দ কি দাওয়া কেয়া হ্যায়?

এরপর ভারতবর্ষের কথা বলতে শুরু করলেন শেহ্রজাদে। ‘সুলতান, পৃথিবীর কেন্দ্রে ছিল মেরুপর্বত। ঋষিদের স্বদেশের নাম-ই মেরু, তাঁদের দেব-লোক-স্বর্গ। মেরুর চারদিকে চার দ্বীপ, তাদের আলাদা করে রেখেছিল চার সাগর। পৃথিবী তাই চতুর্দ্বীপা, চতুঃসাগরা জাঁহাপনা। মেরুর উত্তরে কুরু, পূর্বে ভদ্রাশ্ব, দক্ষিণে জম্বু, পশ্চিমে কেতুমাল। এই জম্বুদ্বীপে হিমালয় পর্বতের দক্ষিণের অংশ ভারতবর্ষ, রাজা ভরতের নামেই তার নাম। ভারতবর্ষকে একদা জম্বুদ্বীপও বলা হতো।

এই দেশের মহাকাব্য মহাভারত, মনুর ধর্মশাস্ত্র, বিষ্ণুপুরাণে সময় বৃত্তাকার। সবচেয়ে বড় বৃত্তটির নাম মহাযুগ, ৪৩ লক্ষ ২০ হাজার বছর। মহাযুগের ভেতরে চারটি ছোট বৃত্ত, ধীরে-ধীরে যাদের পরিধি ছোট হয়ে এসেছে, জাঁহাপনা। চারটি বৃত্ত – যুগের নাম : সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। আমরা এখন কলি যুগের ভেতরে বেঁচে আছি, হুজুর। প্রতিটি বৃত্তে বছরের সংখ্যা যেমন কমতে থাকে, জীবনচর্যার মানও অবনতির পথে এগোয়। একটা ছবি কল্পনা করুন। চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ প্রতিটি যুগ শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটি পা হারায়; অবশেষে কলিযুগে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এক পায়ে। জাঁহাপনা, একমাত্র সত্যযুগ ছাড়া প্রতিটি যুগই পাশার দানের মতো, কী হবে না হবে কেউ জানে না, আর কলিযুগে পাশার দান শুধু পরাজয়ই ডেকে আনে।

কলিযুগেই ভারতবর্ষ ভেঙে প্রথমে দুটুকরো হয়ে যায়, মালিক : ভারত ও পাকিস্তান। তারপর পাকিস্তান থেকে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই দেশ আরো কত টুকরো হবে, ভেঙে যাবে, আমরা জানি না।’

– তুমি এত কথা জানলে কোথা থেকে বিবিজান? শেহ্রজাদের করতলে হাত রাখেন শাহরিয়ার।

– এখন তো আমার অঢেল সময়। শুধু কিতাব পড়ি।

– অতীত-ভবিষ্যতের সব কিতাব তোমার কাছে আছে?

– জি।

– ভবিষ্যতের কিতাব কোথা থেকে পাও তুমি?

– আমার কাছে এক অন্ধ বৃদ্ধ আসেন। তিনিই ভবিষ্যতের কিতাবগুলো আমাকে এনে দেন।

– তাঁর নাম কী?

– তাইরেসিয়াস।

– তার মানে গ্রিক?

– হ্যাঁ, জাঁহাপনা। তিনি অন্ধ, কিন্তু অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ – সব দেখতে পান। তিনি দৈববাণী শুনতে পান, পাখিদের ভাষা বোঝেন।

– পাখিদের ভাষা?

– তিনি বলেন, পাখিরা নাকি অনেক আগে ভবিষ্যতের কথা জানতে পারে। তাইরেসিয়াস আমাকে রাজা অয়দিপাউসের গল্প বলেছিলেন।

– রাজা অয়দিপাউস? তিনি -। সুলতান শাহরিয়ার জিজ্ঞাসু চোখে শেহ্রজাদের দিকে তাকালেন।

– রাজা অয়দিপাউস নিজের পিতাকে হত্যা করেছিলেন, মাতার শয্যাসঙ্গী হয়েছিলেন। তাঁর সব ছেলেমেয়ে একই সঙ্গে রাজার সহোদর।

– কী ভয়ানক!

– আরো ভয়ংকর নিয়তির সাক্ষী হবেন আপনি, জাঁহাপনা। নিজেকে প্রস্ত্তত করুন।

– কী দেখাবে তুমি বিবিজান?

– মৃত্যুর জয়যাত্রা। রক্তনদীর স্রোত – অগ্নিদগ্ধ জনপদ – কাটা হাত-পা-মুণ্ডিস্তন-যোনি –

– থামো শেহ্রজাদে। এভাবে তো কখনো কথা বলতে না তুমি।

– কলিযুগে সবকিছুই অবনমনের দিকে চলেছে সুলতান, আপনাকে তো আমি বলেছি। শেহ্রজাদেকে কোনো কোঠায় দেখতে পেলে অবাক হবেন না।

– মুখে লাগাম দাও, বিবিজান।

শেহ্রজাদ হেসে ওঠেন। তাঁর দুই চোখে যেন উন্মাদনার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে, মনে হলো শাহরিয়ারের। তিনি শেহ্রজাদের হাত চেপে ধরে বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার?’

– আপনি তো শিকার করতে ভালোবাসেন, সুলতান।

– হ্যাঁ। যাবে নাকি?

– বীভৎস শিকারোৎসব দেখাবো আমি আপনাকে। মানুষ মানুষকে কীভাবে শিকার করে তা তো কখনো দেখেননি আপনি।

আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। শেহ্রজাদে বললেন, ‘বৃষ্টি আসছে। এবার আমাদের নামতে হবে। কোথাও আশ্রয় নেওয়া দরকার।’

– কোথায়?

– খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু তার আগে ছদ্মবেশ নেওয়া জরুরি, কেউ যাতে চিনে না ফেলে।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মলিন, ছেঁড়াফাটা পায়জামা- শেরওয়ানি পরা শাহরিয়ার ও কালো বোরখায় ঢাকা শেহ্রজাদে বাসস্টপে এসে রঘুপতির পাশে দাঁড়ালেন।

একের পর এক বাস চলে যাচ্ছে। রঘুপতির ইচ্ছা করছিল না, অনেকক্ষণ ধরেই সে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আজ কি তার অফিস যাওয়ার ইচ্ছে নেই? রঘুপতি নিজেও বুঝতে পারছিল না; বাসের পাদানির দিকে পা বাড়িয়ে অনেকবার সে পিছিয়েও এসেছে।

– সাব –

রঘুপতি লোকটির দিকে তাকাল। মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে, মাথার সামনের দিকের চুল উঠে গেছে, মনে হয়, অনেকদিন চুলে তেলও পড়েনি। তার সঙ্গে মিলেছে রাস্তার ধুলো। মুখময় খোঁচা-খোঁচা পাকা দাড়ি-গোঁফ। রঘুপতি উত্তর না দেওয়ায় সে আবার ডাকল, ‘সাব -’

– কী চাই?

– এখানে ঘরভাড়া মিলবে? লোকটি বোকার মতো হেসে বলে।

– ঘরভাড়া? এই শহরে ঘরভাড়া পাওয়া সোজা নাকি? আসছ কোথা থেকে?

– হুজুর মেহেরবান –

– আরে আসছ কোথা থেকে?

– বাতাও না বিবিজান।

মহিলাটি কথা বলে না। রঘুপতি অবাক হয়, কোথা থেকে আসছে লোকটি জানে না, কিন্তু তার বিবি জানে? এমন মানুষ সে আগে দেখেনি।

– কী সুলতান, বোলিয়ে আসমান সে। মহিলাটি নিচু স্বরে বলে।

আসমান সে? আকাশ থেকে? রঘুপতির হাসি পেল। এরা দুজনেই পাগল নাকি? না, ভিক্ষক্ষ চাওয়ার ফন্দি? সে তড়িঘড়ি বলে, ‘রাজাবাজার খালপাড়ে, নয়তো তিলজলা বসিত্মতে খোঁজ করে দেখতে পারো। ওখানে কোনো ঝুপড়ি-টুপড়ি পেয়ে যেতে পারো।’

– ঝোপড়ি? লোকটি অবাক হয়ে বলে।

– তাহলে কি রাজপ্রসাদে থাকতে চাও? রঘুপতি হাসে। – কোথা থেকে আসছ, তাই তো বলতে পারলে না। যতসব আবোলতাবোল – আসমান সে।

– জি হুজুর, সহি বাত। মহিলাটি বলে।

– তোমার নাম কী? রঘুপতি লোকটির দিকে তাকায়।

– শাহরিয়ার জনাব। আমার বিবির নাম শেহরজাদে।

রঘুপতি হো-হো করে হেসে ওঠে। – আরব্যরজনী থেকে এলে নাকি? ‘যতসব পাগল-ছাগল’, কথাটা মনে-মনে বলল সে।

শহরটা উন্মাদ লোকজনে ভরে গেছে। বাসস্টপ থেকে বাড়ির দিকে পা বাড়াল সে।

ওদিকে শেহ্রজাদে আর শাহরিয়ার দুজনের দিকে চোখ মটকে মিটিমিটি হাসছিলেন।

কালো গরাদের মতো বৃষ্টিধারা তাঁদের ঘিরে ধরল। (চলবে)