কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

রবিশংকর বল

\ ৫ \

এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হল।

জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখতে-দেখতে… বৃষ্টিধারা দেখে ক্লান্ত হতে-হতে বাক্যটি মনে পড়ে গেল রঘুপতির। মনোরম মনোটোনাস শহর…  তিনটি শটে একটা শহরের ছবি ফ্রেমবন্দি হয়ে যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পের শুরু হয়েছিল ওই বাক্যটি দিয়ে। মনোরম আর মনোটোনাস, মনোরম আর মনোটোনাস…শব্দদুটি মাথার ভেতরে ঘাই মারতে-মারতে সারা শরীরে বিদ্যুৎফলার মতো ছড়িয়ে যায়।

মৃত্তিকা চা নিয়ে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে। সিগারেটের ধোঁয়ার কু-লীর ওপারে ভেসে আছে রঘুপতির মুখ, যে-মুখটা তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে দেখছে মৃত্তিকা আর এই এতগুলো বছরে বদলাতে-বদলাতে রঘুপতির মুখটা রেখাহীন, কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হয় তার। রেখাহীন মানে, মুখটা কোনো বড় ক্যানভাসে হারিয়ে যেতে চাইছে।

– আজও অফিসে গেলে না? মৃত্তিকা বলে।

– অফিস যেতে আর ইচ্ছে করে না, সুধা।

এসব অনেকদিন আগের কথা, যখন আলাপের পরেই রঘুপতি মৃত্তিকাকে বলেছিল, ‘তোমাকে যদি সুধা ডাকি – ’

– কেন?

– অমল ঘুম থেকে উঠলে সে জানাতে বলেছিল, সুধা তোমাকে ভোলেনি তুমি নেই সুধা –

– আজ নিয়ে তিনদিন হল। অফিসে খবর দিয়েছ?

– না।

– কাউকে জানিয়ে দিতে বলেছ?

– না।

সুধা হেসে বলল, ‘এবার অফিস থেকে তাড়াবে। মাঝে-মাঝেই বলে দু-তিনদিনের জন্য অফিস কামাই – ’।

– আর তো দুবছর আছে। আগেই না হয় –

সুধা আর কিছু বলতে গেল না।

রঘুপতি চা শেষ করে আবার সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘একটা কিছু ঘটবে সুধা, জানো – ’

– কী ঘটবে?

– জানি না। কিন্তু আমাদের শহরে আজ নতুন অতিথিদের দেখা পেলাম।

রঘুপতি বাসস্টপের মুসলমান দম্পতির কথা বলল, তারা এই শহরে কোথাও ঘর খুঁজছে, সে-কথাও সুধাকে জানাল। তারপর চোখ ছোট করে মৃদু হেসে বলল, ‘ওরা কারা জানো – ’

– কারা আবার? গাঁ-টা থেকে এসেছে।

– উঁহু। বেগম শেহ্রজাদে আর বাদশা শাহ্রিয়ার। দামাস্কাস থেকে এসেছে।

সুধা বড়-বড় চোখে তাকিয়ে থাকল। রঘুপতি কি পাগল হয়ে গেছে? না হলে বাসস্টপে গরিব মুসলিম দম্পতিকে দেখে কেউ তাদের শাহ্রিয়ার শেহ্রজাদে ভাবতে পারে?

– আমি অবশ্য বুঝতে দিইনি যে, চিনতে পেরেছি। রঘুপতি আপন মনে বলল। – রাজাবাজার বা তিলজলার বস্তিতে ঘর খুঁজে নিতে বললাম। কিন্তু সেখানে তো ওরা থাকতে পারবে না, সুধা।

– রঘুপতি হেসে উঠল।

সুধাও রঘুপতির খেলায় যোগ দিয়ে বলল, ‘তাহলে?’

– সেটাই তো এবার দেখার। আবার হেসে উঠল রঘুপতি।

– কী দেখবে?

– সুলতান বেগমরা বস্তির বাসিন্দা হয়ে কী করে –

সুধা হাসল, ‘তাদের আর খুঁজে পাবে কোথায়? কোন-কোন বস্তিতে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে – কোথায় ঠাঁই পাবে – ’

– খোঁজ ঠিক পেয়ে যাব। রঘুপতি উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে থাকে। – মাঝে-মাঝেই এক আশ্চর্য কার্পেটে চড়ে ওরা আকাশে উড়ে বেড়ায়। কখনো না কখনো ঠিক দেখতে পাব।

– কিন্তু ডাকবে কী করে?

– তা বটে। রঘুপতি গম্ভীর হয়ে গেল। কে জানে, আরব্য রজনীর সুলতান শাহ্রিয়ার আর তার বিবি শেহ্রজাদে এ-শহরে এসেছে, কাউকে বললে সে রঘুপতিকে নিশ্চিত পাগল মনে করবে। তা-ই চেঁচিয়ে ওদের ডাকাও যাবে না। কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, কত গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমা-চিত্রকলার চরিত্ররা মাঝেমধ্যেই তার সঙ্গে এসে বেঁচে থেকে রাতের পর রাত কেটে গেছে তাদের সঙ্গে কথা বলে।

সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে। ওদের চিনতে পারার পরেও শেহ্রজাদে আর শাহ্রিয়ারকে তাদের ফ্ল্যাটেই নিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু সে-মজাটা দেখতে চাইছিল, বস্তির সুলতান আর তার বিবির জীবন কেমন বদলে যাবে, এ তো আর আরবের বেনজির প্রাসাদ নয়! আর সুধা প্রথম দেখে চমকে উঠত, হয়তো ভয়ে চিৎকার জুড়ে দিত। এখন বেশ সইয়ে-সইয়ে ওকে বলা গেছে। সুধাও হয়তো ওদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে মনে হল রঘুপতির।

সিগারেট ধরিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে সামনের টেবিলে ধাক্কা খেল রঘুপতি। কালো বার্নিশ করা এই টেবিলের বয়স অন্তত ষাট-সত্তর বছর। রঘুপতিদের পুরনো পাড়ায় নবকুমাররা যখন সিংগিদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে চলে গেল, তখন টেবিলটি কিনে নিয়েছিল রঘুপতির বাবা। কারুকাজ করা পায়া, টেবিলের ওপরটা দেখলে মনে হয় কালো পাথরে তৈরি।

রঘুপতির ধাক্কায় টেবিলের এক কোণে রাখা কাচের দোয়াতটা মেঝেয় পড়ে খানখান। আরো একটা স্মৃতি চলে গেল, রঘুপতি মনে-মনে বলল, এন্ট্রপি বেড়েই চলেছে। যত দিন যায়, সব – সব ভাঙনের দিকে এগোয় – এন্ট্রপি বেড়েই চলে। অনেকদিন আগে দেখা একটা ছবির কথা মনে পড়ল তার। সে বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন সন্ধ্যার আগমন ও পাখিদের ঘরে ফেরার কলরব মিলেমিশে গেছে। দিগন্ত থেকে একটি দীর্ঘ, কালো হাত এগিয়ে এল তার দিকে, চুম্বকীয় টানে সে উঠে গেল করতলে, অতিকায় এক ফুলের পাপড়িরা যেন গুটিয়ে গেল, করতলের ভেতরে অন্ধকারে রঘুপতি আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। তারপর শুরু হল দোমড়ানো-মোচড়ানো আর সেই হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালির মতো ঝরে পড়তে লাগল সে। দূর থেকে রঘুপতি দেখল, আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালি ঝরছে তো ঝরছে অবলম্বনহীন… নষ্টভ্রষ্ট…।

দোয়াতটা ছিল তার দাদুর। কালি ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও দাদু ফেলে দেননি। কাচের সারা শরীরে ফুল-লতা-পাতা-পাখি আঁকা। এর আগেও বেশ কয়েকবার পড়ে গেছে, কিন্তু কখনো ভাঙেনি তো। রঘুপতির মনে হত, তার মৃত্যুর পরেও দোয়াতটা রয়ে যাবে, এতই দীর্ঘ আয়ু তার। কিন্তু আজ হঠাৎই –

– বান্দা হাজির হুজুর।

রঘুপতি ও মৃত্তিকা চমকে উঠে সারা ঘরে তাকাল, তারপর তাদের নজর চলে গেল দরজার দিকে।

– কে?

– হুজুর আপনার খিদমতগার।

– কোথায় তুমি?

– আপনার পায়ের কাছে, জাঁহাপনা।

রঘুপতি হো-হো করে হেসে উঠে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি লেগ পুলিং করছ?’

– মানে?

– নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে –

– কী পাগলের মতো কথা বলছ!

– বন্দেগি জাঁহাপনা।

টেবিলের দিকে তাকিয়ে ওরা দুজনেই অবাক হয়ে গেল। এক ফুটের মতো লম্বা একটা লোক সেলাম জানাচ্ছে। পোশাক ক্লাউনের মতো। রঘুপতির চোখ বড়-বড় হয়ে গেল, সে বলল, ‘তুমি কে?’

– সিঙ্গম।

– জিন?

– জি হুজুর।

– তুমি এলে কোথা থেকে?

– আমি দোয়াতের ভেতরে বন্দি ছিলাম। আপনিই তো আমাকে মুক্তি দিলেন।

– দোয়াতের ভেতরে ঢুকলে কী করে?

– সে লম্বা কিস্সা হুজুর।

– ছোট করে বল।

– ও আমাদের ধাতে নেই, হুজুর। টেবিলের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে সিঙ্গম হাসে। – কিস্সার আবার ছোট, বড় কী?

– মানে?

– কিস্সা যেমন চাইবে, ততটাই তার কথা বলতে হবে আপনাকে।

– হুঁ। রঘুপতি গম্ভীর হয়ে গেল।

সিঙ্গম বলে, আমি জানি, হুজুর, আপনাদের হাতে সময় এখন খুব কম। তাই গল্প বলার দিনও আর নেই। সবাই এখন খবরকেই গল্প বলে।

– তুমি জানলে কী করে?

– জিন সব জানে, জাঁহাপনা। আমরা আগুন দিয়ে তৈরি আর লুকিয়ে-লুকিয়েই সব দেখতে পাই। যাক্গে, এসব আপনিও জানেন না। খবরটাই তবে আপনাকে বলি। অনেক জন্ম পার করে আমি বামন হয়ে জন্মেছিলাম, কোনো কাজই করতে পারতাম না, একদিন এক বাঙালিবাবুর সার্কাসের দল আমাকে নিয়ে নিল। আমি খুব মার খেতাম আর হাসতাম। দর্শকরা আরও বেশি হাসত। হুজুর, মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে মানুষের খুব মজা হয় তাই না?

– হ্যাঁ, সিঙ্গম। জন্তুর খিদে পেলে একে অপরকে খায়। মানুষ সবচেয়ে নিষ্ঠুর জন্তু যে মজা পায়। তারপর কী হল?

– একদিন মরে গেলাম হুজুর।

– কী করে?

– পায়খানা আর বমি – পায়খানা আর বমি – । ভালই হল। কারোর মার খেতে হবে না। যেখানে খুশি যাও, ঘুরে বেড়াও, কেউ তোমাকে দেখতেও পাবে না। ওইভাবেই একদিন আপনার দাদুর কালির দোয়াতের কিনারে এসে বসেছিলাম। তিনি কী যেন লিখছিলেন।

– কী লিখেছিলেন?

– সে কি আর আমি বুঝি। দোয়াতের কালি কমে এসেছিল। কালি শেষ হয়ে যেতেই তিনি রেগে দোয়াতের মুখ বন্ধ করে দিলেন। অমনি আমিও উলটে পড়লাম দোয়াতের ভেতরে।

রঘুপতি হেসে উঠল। – দোয়াতের ভেতরে দাদু যে সিঙ্গমকে আটকে রেখেছিলেন আমরা বুঝতেই পারিনি।

– আপনার দাদুও জানতেন না, হুজুর। তাহলে আমাকে মুক্তি দিতেন।

– কেন?

– ভাল মানুষ ছিলেন যে। কাউকে আটকে রাখা ওনার ধাতেই ছিল না। এখন বলুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?

মৃত্তিকা কোমল স্বরে বলে, ‘কিছু খাবেন? অনেকদিন তো দোয়াতের ভেতরে বন্দি ছিলেন।’

– জিনদের খাওয়ার প্রয়োজন হয় না, বেগম সাহেবা।

– বেগম সাহেবা? মৃত্তিকা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

– হুজুর আমার জাঁহাপনা হলে, আপনি তো বেগম সাহেবাই। আমি আবার যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে পারব, এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। তবে হুজুর ‘সিঙ্গম’ বলে ডাকলেই আমি হাজির হব। যা চাইবেন করে দেব। এনে দেব। আপাতত কী করতে হবে, বলুন।

রঘুপতি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘সুলতান শাহ্রিয়ার আর বেগম শেহ্রজাদেকে খুঁজে বের করো।’

সিঙ্গম চিন্তিত মুখে জানালার বাইরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, ‘চলুন।’

– খুঁজে পেলে?

– হুঁ। আমি কিন্তু কাঁধে চেপে যাব। সিঙ্গম বলে।

– মানে?

– কেউ দেখতে পাবে না। আপনাকে পথ দেখাতে সুবিধে হবে। চলুন তবে হুজুর।

রঘুপতির কাঁধে বসে পা দোলাচ্ছে সিঙ্গম। ওরা দুজন বেরিয়ে পড়ল। দরজায় দাঁড়িয়ে মৃত্তিকা দেখল, সিঙ্গম অদৃশ্য। রঘুপতি একাই চলেছে। (চলবে)