‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক/
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ – ’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(কবিগুরু, তোমার হঠাৎ দেখা হরিণ
চোখের কালো মেয়েটি যুগান্তরের
সূর্যরথে পাড়ি দিয়েছে ভিন্ গোলার্ধে।
ময়নাপাড়ার কলেজ পড়া শেষ না হতেই
ডি. ভি. ভিসার সিকে ছিঁড়ল। তারপর
মহানগরী নিউইয়র্ক। বদলে গেল জীবন,
বদলে যাচ্ছে মনন, বদলে যাবে জীবনের
ইতিবৃত্ত। সেই গল্পই শোনাব তোমায়।)
———— প্রথম পর্ব ————
এ-শহরে বৃষ্টি নামে
শিহর জাগে দমকা হাওয়ায়
এ-শহরে কৃষ্ণকলি
আঙুল তুলে ট্যাক্সি থামায়।
কখনো ঝলমলে দিন
পাতাল রেলের আঁধার ঠেলে
ছুটে চলে কৃষ্ণকলি
ঘড়ির কাঁটা পেছন ফেলে।
কফির কাপে ছলকে ওঠে
দিনের শুরু ব্যস্তসকাল
চোখ-ধাঁধানো এই শহরে
হৃদয়ছোঁয়া কথার আকাল।
বন্ধু-স্বজন নেই তো কোথাও
মানুষগুলো দ্বীপের মতো
মুখে সুখের পলেস্তারা
হৃদয়টাতে গোপন ক্ষত।
সন্ধ্যা পরায় সোনার মুকুট
ম্যানহাটানের দালান চূড়ায়
রাত্রি তখন নিয়ন জ্বেলে
নেশা ধরায় রঙিন সুরায়।
ঘরে ফেরার পালা যখন
দিনের শেষে কাজ ফুরালে
স্বপ্ন দেখার তন্দ্রা নামে
কাল হরিণ চোখের কোলে।
ময়নাপাড়ার মাঠে বুঝি
এখন সকাল রোদের ঝলক
শ্যামলীটার সাদা বাছুর
কাজল চোখে ফেলছে পলক।
তালগাছটার বাবুইপাড়ায়
ভোরের হাওয়া দিচ্ছে দোলা
বেগুন ক্ষেতের কঞ্চি বেড়ায়
ফিঙে পাখি লেজটি ঝোলা।
মন্দিরাতে প্রভাতি গান
বৈরাগীটি ফিরছে ঘরে
রমিজ কাকার চায়ের দোকান
তুলছে ধোঁয়া নদীর ধারে।
ভোরের ট্রেনের দমকা হাওয়ায়
কাশফুলেদের মাতামাতি
আঙিনাতে রক্তজবার
পরাগ মাখে প্রজাপতি।
বাবার হাতে দুধের ভা-
মা এখনো পুজোর ঘরে
ময়নাপাড়ার কালো মেয়ের
মন চলে যায় তেপান্তরে।
ইস্ট রিভারের কাজলজলে
সন্ধ্যা যখন আবির ছড়ায়
কুইন্সবরোতে সেভেন ট্রেনটা
জিরোয় খানিক লোহার খাঁচায়।
আকাশ ভেঙে চলছে গাড়ি
লোহার পাঁজর গুরুগুরু
নিচের শহর সন্ধ্যা থেকেই
অন্যরকম জীবন শুরু।
সেই জীবনেও দুঃখ আছে
সুখেরও নেই কমতি কিছু
রাতের নারী, রাতের পুরুষ
ছুটছে তেমন সুখের পিছু।
হঠাৎ করেই রহস্যময়
শহর যেন কোথায় মিলায়
আকাশ রেলের দুধার জুড়ে
কাশফুলেরা দুলছে হাওয়ায়।
ময়নাপাড়ার মেঠোপথে
ওই তো কারা ইস্কুলে যায়
সকালবেলার রোদ লেগেছে
মসজিদের ওই শুভ্র চূড়ায়।
জেলেপাড়ার ছিপ নৌকা
মাঝনদীতে জাল ফেলেছে
মাঠের ধারে ডোবার জলে
শাপলা শালুক দল মেলেছে।
ওই তো দূরে জারুল-ছায়ায়
শ্যামলবরণ গাভি দুটি
সহযাত্রী বৃদ্ধা শুধায়
‘আর ইউ অলরাইট সুইটি?’
সম্বিত পায় কান্না লুকায়
হরিণচোখের কৃষ্ণকলি
সন্ধেবেলার জনস্রোতে
স্বপ্নকে দেয় জলাঞ্জলি।
—- দ্বিতীয় পর্ব —-
দিনগুলি যায় ঘড়ির কাঁটায়
মাস ঘুরে যায় ক্যালেন্ডারে
বছরগুলো গড়িয়ে গিয়ে
বিসত্মৃতি পায় যুগান্তরে।
তুষারচাপা ঘাসের মতো
প্রহর গোনে সব স্মৃতিরা
সুখের দিনের আশার আলোয়
জাগবে আবার প্রাণের সাড়া।
বাবার চিঠি ক্বচিত কখন
মায়ের সাড়া মোবাইল ফোনে
নেটওয়ার্কের খেয়ার মাঝি
মিনিট বুঝে পয়সা গোনে।
ঘরের ভাড়া, গ্রোসারি বিল
কিনতে হবে রেলের টোকেন
ফোনের বিলের ঋণ বকেয়া
মাসের শেষে টানাপড়েন।
ময়নাপাড়ার যোগেনবাবুর
প্রতীক্ষা আজ সুখের তরে
মা বলেছে সুদিন যেন
আটকে আছে শনির ঘরে।
নির্বাচনের পরে পরেই
জেলেপাড়ায় লাগল আগুন
ভোট হারানো দলের নেতার
আক্রোশটাও বাড়ছে দ্বিগুণ।
ভিটেছাড়া কত মানুষ
হারিয়ে গেল দেশান্তরে
দুশ্চিমত্মার বলিরেখা
যোগেনবাবুর কপাল জুড়ে।
সবুজ নীলের ময়নাপাড়া
হেমমেত্মর হয় সোনার ফসল
মুসলমান বা হিন্দু সে হোক
সব কৃষকের সমান ধকল।
ফসল কাটার আনন্দগান
মেঠো সুরে সুর মেলাতে
ঈদের সেমাই, পুজোর প্রসাদ
পড়ত সমান সবার পাতে।
শান্তি-সুখের সেসব সুদিন
কেন এমন হারিয়ে গেল?
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নিয়ে
কারা এমন বিষ ছড়াল?
কেড়ে নিতে চাইছে ফসল
দখল নিতে চাইছে জমি
গরিব লোকের সস্তা মরণ
বেঁচে থাকাই সবচে’ দামি।
রাতবিরেতে আঙিনাতে
কাদের যেন ফিসফিসানি
যোগেনবাবু পালিয়ে বাঁচো
নইলে দেবে জীবনখানি।
এসব কথা মেঘের মতন
জমছে মনের ঈশান কোণে
ঝড়ের কালো আভাস দিয়ে
দূরের আকাশ বিজলি হানে।
—— তৃতীয় পর্ব ——
মহানগর নিউইয়র্কে
দাপিয়ে বেড়ায় মেরুর হাওয়া
গভীর শীতে ঘুমায় শহর
পথঘাট সব তুষারছাওয়া।
ঝাপসা হলো পথের আলো
ধোঁয়াশা আর তুষারঝড়ে
শীত পালিয়ে জুটেছে মানুষ
রেসেত্মারাঁতে এবং বারে।
আকাশ জুড়ে ছাই-মাখানো
চিমনি থেকে নীলচে ধোঁয়া
লিখছে সেথা ব্যথার কাব্য
রাখছে বিষণ্ণতার ছোঁয়া।
দিনগুলো সব ছোট্ট এখন
হুড়মুড়িয়ে সন্ধ্যা নামে
কৃষ্ণকলি ফিরছে ঘরে
রাত্রি তখন মধ্যযামে।
কুইন্স বুলোভার্ড নিঝুম পাথার
বাসের দেখা ক্বচিত কখন
তুষার ঠেলার ড্রেজারগুলোর
আসা-যাওয়া যখন-তখন।
হাড়ের ভেতর সুই ফোটানো
উত্তরে হিম জাঁকিয়ে নামে
মৃত্যুশীতল হিমেল হাওয়া
খবর পাঠায় রাতের খামে।
ঘরে ফেরার ব্যাকুল তৃষা
একটুখানি উষ্ণতা চাই
কৃষ্ণকলি, কোথায় যাবি?
এই শহরে দরদি নাই।
জীবন থেকে উষ্ণতাকে
নিচ্ছে শুষে শীতের প্রহর
অসাড় হয়ে আসছে ক্রমে
দেহ এবং বোধের শেকড়।
ওই তো মায়ের রান্নাঘরে
জ্বলছে উনুন গনগনে আঁচ
স্নেহমাখা মুখটি মায়ের
সিঁথির সিঁদুর এয়োতি সাজ।
দাওয়ায় বসে মাদুর পেতে
বাবার গায়ে খাদির চাদর
কৃষ্ণকলি দাঁড়িয়ে থাকে
পা দুটি তার নিরেট পাথর।
কণ্ঠ চিরে স্বর ফোটে না
‘বাবা আমার হাতটি ধরো’
দৃশ্যপট মিলিয়ে গেল
কাঁপছে দেহ থরোথরো।
সংজ্ঞাহীনা কৃষ্ণকলি
পথের ধারে লুটিয়ে পড়ে
তুষারঝড়ের শুভ্র চাদর
শরীরটাকে দিচ্ছে মুড়ে।
ধেয়ে আসছে বরফ-ড্রেজার
পথের দুধার উপচে পড়ে
ময়নাপাড়ার সেই মেয়েটির
তুষারকবর এই শহরে?
—— চতুর্থ পর্ব ——-
কুইন্সবরোর হাসপাতালে
জ্ঞান ফিরেছে দুদিন পরে
কৃষ্ণকলির প্রাণের সাড়া
কম্পিউটার মনিটরে।
কাজলকালো হরিণ-চোখে
অশ্রুবিন্দু টলোমলো
জানালাতে শীতের আকাশ
সূর্যরাগে ঝলোমলো।
ডাক্তার, নার্স সবাই এলেন
সবার মুখেই জয়ের হাসি
‘এই তো মেয়ে তেজোদীপ্ত,
এমন সাহস ভালোবাসি।’
‘জিততে হবে বাঁচার লড়াই,
যোদ্ধা যারা হার মানে না
পাওনা জীবন বুঝে নেবেই
আর কিছুরই ধার ধারে না।’
এমন কথা কেউ বলেনি
ময়নাপাড়ার মেয়েটিকে
কে যেন আজ বাড়িয়ে দিল
বেঁচে থাকার মূল্যটিকে।
সন্ধেবেলা আলোর খেলা
মেঘের মিছিল আকাশজোড়া
এমন সময় আগন্তুক এক
হাতে সতেজ ফুলের তোড়া।
ধীরপায়ে সে এগিয়ে আসে
‘কেমন আছো এখন প্রিয়?
তোমার সাথে পরিচয় হোক
নামটি আমার এন্টোনিও
ভাগ্য ভালো সেদিন রাতে
তোমায় আমি দেখেছিলাম
তুষারঢাকা নিথর দেহ
পথের ধারে কুড়িয়ে পেলাম।’
একটি যুবক বলছে কথা
যুবতীটি তাকিয়ে থাকে
সাঁঝের আলো কাজলচোখে
অনুরাগের স্বপ্ন আঁকে।
কালো যুবক মগ্ন বিভোর
দেখছে মেয়ের নয়নজোড়া
ময়নাপাড়ার কালো মেয়ে
প্রথম পেল ফুলের তোড়া।
পাপড়ি মেলে ক্রিসান্থিমাম
ফুটল প্রথম গোলাপকলি
প্রথম প্রেমের প্রথম পরশ
পরাগ মাখে প্রথম অলি।
সুঠাম যুবক ভরাট কণ্ঠে
শুধায় ‘বলো কৃষ্ণকলি
কোন সুদূরে জন্ম তোমার
স্নিগ্ধ সজল ওয়াটার লিলি?
তোমার দেশের নদীও কি
তোমার চোখের মতোই কালো?
এমন সবুজ স্নেহের মায়া
তোমার মুখে কে ছড়ালো?’
কৃষ্ণকলির মৃণাল বাহু
অ্যান্টোনিওর সবল হাতে
শিহর জাগায় স্বপ্নে রাঙায়
নতুন দিনের নতুন প্রাতে।
দিনগুলো সব সুরভিময়
বাতাসে কে বাজায় বাঁশি
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে গেল
কৃষ্ণকলির স্বপ্নরাশি।
রুদ্র, ভয়াল এই নগরী
অন্তরে তার স্নেহের ধারা
যে খুঁজে পায় তৃষ্ণা মেটায়,
আশায় থাকে পায়নি যারা।
আশিস রেখো কবিগুরু
জীবন চলুক জয়রথে,
অ্যান্টোনিও, কৃষ্ণকলি
এগিয়ে যাক আলোর পথে।
আশিস করো জগৎজোড়া
বৈষম্যের দহনজ্বালা
মিলিয়ে যাক ধর্মঘৃণা
আসুক মানবতার পালা।