কৈশোর থেকে সামনের সদর দরোজার দিকে

সৌভিক রেজা

কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের মতে, ‘যে-কোনো ব্যক্তিই তো ভাবতে পারেন তিনি যে-জীবনটা কাটিয়ে এলেন সেই কথাটা একটু বলে যাবেন। মানুষের অমরতার আকাঙ্ক্ষা অনন্ত। মৃত্যুর নিশ্চয়তা মানুষকে সেই অমরতা থেকে সরিয়ে আনে। যে-কোনো ব্যক্তির আত্মজীবনীই মৃত্যুকে অস্বীকার করার চেষ্টা আর সেই ব্যক্তির অমরতার আকাঙ্ক্ষার মানবিক উচ্চারণ। বেশিরভাগ আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথাই তাই বেশি বয়সের রচনা – যতদিন বাঁচা হয়েছে, ততদিন আর বাঁচা হবে না, বয়সের সেই মোড়টাতে পৌঁছুনোর পর লেখা। তাঁর অতীতকে তাঁর বর্তমানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার তাগিদে লেখা।’ আমরা সেই নিরিখে বলতে পারি, হাসান আজিজুল হকও সেই তাগিদ থেকেই রচনা করেছেন তাঁর স্মৃতিকথার এই খ-গুলো – ফিরে যাই ফিরে আসি (২০০৯), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২০১১), এই পুরাতন আখরগুলি (২০১৪)। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর স্মৃতিকথার চতুর্থ খণ্ড দুয়ার হতে দূরে (২০১৭)।

২. সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘ব্যক্তি মানুষ স্মৃতিসম্পৃক্ত যেমন থাকতে চায়, স্মৃতিমুক্তও হতে চায়। মনস্তত্ত্ব বলে, স্মৃতি আসলে আমাদের নির্বাচনের উপরেও নির্ভরশীল। যে-ঘটনা বা কাজ কেউ ভুলে যেতে চায়, সে-বিষয়ে তার স্মৃতিও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়, লুপ্ত হয়ে যায়। নিজেদের পাপবোধ, দোষ আড়ালে রাখার জন্য সেসবের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক স্মৃতিও আড়ালে চলে যায় মানুষের। স্মৃতির সঙ্গে তাই জীবননির্মাণ সংলগ্ন।’ হাসান আজিজুল হক তাঁর স্মৃতির সঙ্গে একেবারে আবেগ-বিযুক্ত হয়ে থাকতে চাননি। আবার খুব-বেশি আবেগতাড়িত হতেও তাঁকে দেখা যায় না। তাঁর কাজ স্মৃতিসন্ধান নিয়ে। সে-কারণেই তাঁর এই স্মৃতিকথায় তাঁর নিজের স্মৃতি-অস্তিত্বের সমস্তটা যেন একাকার হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে যে-বিরসদিনের কথা বলেছিলেন, হাসানের বাড়িঘরের স্মৃতির মধ্য দিয়ে কি সেটাই মহাসমারোহে মূর্ত হয়ে উঠেছিল? আর তারই ভেতর দিয়ে হাসানের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের কাহিনি? তার ভেতরের চলাচলের স্মৃতি? এইসব স্মৃতি কখনো-সখনো যেন আস্ত একটা গল্পই হয়ে উঠেছে। হাসান নিজে গল্প বানাতে চেষ্টা করেছেন কিংবা গল্প তৈরি করতে চেয়েছেন- তেমন কোনো প্রয়াস তাঁর নিজের দিক থেকে ছিল বলে মনে হয় না। তবে স্মৃতিকথাও তো একটা নির্মাণ। কাজেই প্রয়াসের কথাটা একেবারে বাদ দিতে পারা যায় না। স্মরণের আড়ালে যেমন, তেমনি বিস্মরণের আড়ালে জীবনের কত ঘটনাই তো সরে সরে যায়। হাসান বলেছেন, ‘আজকাল একটা ঝাপটা টের পাচ্ছি। আমাদের এই খোলা প্রকৃতির ঝাপটা তো বরাবরই টের পাই। গরমকালের শুরুতে প্রকৃতি গরম নিশ্বাস ফেলে, মাঝে মাঝে ফোঁসাতে থাকে, তখন কাঁকর ধুলো বালি মেশানো ঝাপটা চোখে-মুখে এসে লাগে।’ কিন্তু এই ঝাপটা যেন একটু অন্যরকম। অন্যরকম একটা ঝাপটার কথা হাসান বলেছেন। যে-ঝাপটা শরীরের ভেতর থেকে আসে। বাইরে থেকে নয়, আসে জীবনের মধ্যে থেকে। হাসান বলেছেন, ‘অনেক ছোটবেলা থেকে, জ্ঞান হওয়ার কতদিন পরে তারও হিসেব করতে পারি, আবছা মনে পড়ে এমন ঝাপটা; শরীরের কোনো একটা অঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কেমন বিহবল অবস্থা। সেই তখন থেকেই হয়তো শরীরকে মোটামুটি চিনে নেওয়ার শুরু।’ আবার পরক্ষণেই বলছেন, এটা ঠিক ‘তাড়না নয়, জোরালো ঝাপটাও হয়তো নয়।’ তাহলে কী সেটা? খোলাসা না-করেই তিনি জানিয়ে দেন, ‘একটু বড়ো হলে, সাত-আট বছর বয়স হলে গাঁয়ের নিরক্ষর মাঝবয়েসি মেয়েরা আমাকে বলতো মেয়েঘেঁষা। কি তার মানে বুঝতাম না। তবে আমার মধ্যে একটা মানুষ-গন্ধ পছন্দের ব্যাপার আছে, সেটা বুঝতে পারতাম।’ নিজের সচেতন শৈশবের কথা বলতে গিয়ে দেবেশ রায় যেমন বলেছিলেন, ‘দাদুর গায়ে হরিতকীর গন্ধ ছিল। পকেটে খুব ছোট করে কাটা হরিতকী থাকত। আমি মাঝে-মাঝে দাদুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে খেতাম। হরিতকীর গন্ধ আর স্বাদের সঙ্গে দাদু মিশে আছেন।’ হোসান বলেছেন, ‘এখানে স্বীকার করে ফেলি, সত্যি করেই বেশি পছন্দ করতাম ভাবী-খালারা এলে। এটা মানুষ-গন্ধ না বলে মেয়ে-গন্ধ যদি কেউ বলে আমার আপত্তি নেই।’ দেবেশ রায় জানিয়েছিলেন, ‘মানুষের স্বভাবই তো গায়ে গায়ে বাঁচা। মানুষ তো লতার চাইতেও লতানো।’ অন্যদিকে হাসান এইটাও জানিয়েছেন, তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি দেখে ‘একদিন আমার বিধবা-বোন  বলল, হ্যাঁরে, এই ছোঁড়া কালো। মেয়েদের মধ্যে বসে থাকিস কেন, তোর লাজ-শরম নেই।’ উত্তর দিয়েছিলাম একটা। কী উত্তর? ‘আমার নাম কালো হলে কী হয়, আমার ভিতর শাদা।’ যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে হাসানকে চেনেন-জানেন তাঁরা বুঝবেন কতখানি সত্য এই উত্তরের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আত্মোপলব্ধির এই ব্যাপারটি হাসানের মধ্যে সেই বাল্যকাল থেকেই কি জাগরিত হয়েছিল? যা তাঁকে এতটা পথ নিয়ে এসেছে? শুধুই লেখক হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবেও। হাসান জানান, ‘কেন এই কথা বলেছিলাম জানি না। এখন বুঝি কথাটা একদম ঠিক।’ হাসান এ-ও জানান যে, তখন তাঁর সেই বয়সটা যখন কিনা দিঘির পাড়ে একা-একা বসে থাকতে ভালো লাগছে, বনকুল, শেয়াকুল, বৈঁচির আড়ালে বসে ফসলের মাঠ দেখতে ভালো লাগছে। প্রকৃতির চাপে আত্মহারা হাসান বলছেন, ‘এইরকম শত-শত ভালো-লাগার কার সঙ্গে তুলনা করব? তারা কত আলাদা-আলাদা। আমার মেয়ে-ঘেঁষা হওয়াটাও মনে হয় এইরকম। অন্য কোনো কিছু তো মনে পড়ে না।’ একে তিনি বলেছেন এক ‘নিবিড় ভালো-লাগার বোধ’। আমরা বুঝতে পারি- হাসান যেন খানিকটা সংকুচিত, দিশেহারা। তারপরেও স্বীকার করেছেন, ‘একা থাকলে কখনো কখনো মনে হয় শরীরের মধ্যে কোথায় যেন একটা বারুদের কারখানা বসেছে। সত্যিই এমন একটা সময় এলো যখন মনে হতো কারখানাটা বোমা তৈরি করতে শুরু করেছে। তখন অভ্যস্ত কাজগুলির রকমফের ঘটতে শুরু করল।’ হাসান তাঁর তখনকার অবস্থার কথা অনেকটাই বলেন, কিন্তু পুরোটা নয়। অথচ অনেকটা ঠিক এরকম অবস্থার কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়ে দেবেশ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, ‘আমি যতদূর পর্যন্ত আমার শৈশবে পৌঁছুতে পারি, তাতে আমি, প্রায়, নিশ্চয়ই প্রায়, জীবিত কোনো মুহূর্ত পাই না যখন আমি যৌনতামুক্ত ছিলাম। আমি আমার চার-পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মনে করতে পারি। আমার স্মৃতি, আমার বেড়ে-ওঠা, আমার ভাবনাচিন্তা, আমার কল্পনা-যৌনতার পাকের পর পাকে এমন জাপটে গেছে যে ঐ বয়সেই ও তারপরেও আমার নিজেকে সব সময় ধর্ষিত মনে হত। তেমন সব ঘটনাও আমার মনের এই বিপর্যয় আমাকে একাই বইতে হয়েছে। অথচ তার সঙ্গে যৌনতার বিকারের সুখের টানও তো ছিল। কোনোদিন যদি আমি ততটা সাহস ও সততা জোটাতে পারি, তাহলে এই যৌনতা-গ্রাসের কথা আমি বলতে চাই।’ এই স্মৃতিকথায় বলি বলি করেও হাসান তাঁর সেই ‘যৌনতা-গ্রাসের কথা’ ঠিকমতো বলতে পারেননি, বলতে হয়তো-বা চানওনি। আবার খানিকটা ঠারে-ঠারে যেন পাঠককে বুঝিয়েও দিয়েছেন। যখন তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বয়সের সকলের গলা ভেঙে সরু-মোটা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। নিজের গলা নিজেই চিনতে পারা যাচ্ছে না।… নিজেকে কী করে যে সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি, ভেবে পাই না।’ ঠিক তখনই বুঝতে পারা যায় যে, লেখক তাঁর বয়ঃসন্ধির সময়টা অতিক্রম করতে যাচ্ছেন। তিনি নিজেও যে বোঝেননি তা নয়। ‘বয়স্করা আমাদের একেবারে পছন্দ করে না, যুবকেরা বিরক্ত হয়-মেয়েরা কাছে গেলেই তামাশা করে। মনে হয় সবাই আমাদের ত্যাগ করেছে। মা-চাচীরাও মনে হয় বিরক্ত।’ এই বয়সের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিশেষত তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্র প্রগলভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধারূপে জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ে কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।’ রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছিলেন, ‘সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিংবা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।’ হাসানের অবস্থা ঠিক-ঠিক সেইরকম। তিনি লিখেছেন, ‘কদাকার হয়ে উঠছে শরীরটা। হাড়গিলের মতো লম্বা হচ্ছে গলা। বুকের টনটনানি, গোঁফ-দাড়ির চুয়ারে চিহ্ন তো আছেই, হাতে-পায়ে ঘন শক্ত লোমও বেরুচ্ছে। কারও সামনে যেতে লজ্জা লাগে, কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মেয়েদের চেহারা কিন্তু এমন হয় না- ছেলেদের ঠিক উল্টোটা।’ হাসানের বাবাও নিজের ছেলের সম্বন্ধে বলতেন, ‘আঁস্তাকুড়ের এঁটো কি কোনোদিন সগগে যায়?’ অন্যদিকে হাসানের চাওয়া ছিল একটু শান্তি, খানিকটা অবকাশ, আর জীবনযাপনে সংগতি।

 

৩. গাঁয়ের স্কুলে মহারাজা সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষ মানপত্র রচনার ভার পড়লো হাসান আজিজুল হকের ওপর। ‘আহা ছেলেটা হোক মোচলমানের ছেলে, বাংলাটা ভালো লেখে।’ হাসানেরও তাতে সায় ছিল। থাকবে না-ই-বা কেন? হাসান জানিয়েছেন, ‘এমনিতেই তো বহুদিন ধরে বই পড়ে পড়ে মাথাটা বিগড়ে গেছে – এখন এঁর মতো তাঁর মতো লিখতে ইচ্ছে করে-একবার শরৎচন্দ্রকে ধরি, একবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নকল করি।’ তারাশঙ্করের গল্পের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ছিল। হাসান জানান, ‘তারাশঙ্করের এই দেশ তো আমার দেশ। এবার তাঁর মতো লিখব-কি লিখব, কোথায় লিখব জানা নেই। আপাতত মহারাজার প্রশস্তি রচনাতেই লাগতে হলো। কি করব? কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে গাঁয়ের লোকেদের তাক লাগিয়ে দেব, নাকি সহজ ভাষায় ভালো ভালো কথা লিখব?’ লেখাটা একটা তৈরি হলো বটে আর সেই লেখাটা পড়ে তাঁর মাস্টারমশাইরা ঠিক করলেন এটা ছাপা হবে। লোকের হাতে দেওয়া যাবে। এইভাবেই হাসানের লেখালিখির শুরু। একে বলা যেতে পারে অন্য এক আরম্ভ।

৩.১ সহপাঠীদের কথা এই বইয়ে হাসান অনেকটা খোলামেলাভাবেই বলেছেন। আর সেই সূত্রে তাঁদের এলাকার হিন্দু-মুসলিম সমাজের কথাও টুকরো-টুকরোভাবে উঠে এসেছে। হাসান বলেছেন, ‘বিনয়কে আমি অনেকটা মেয়েমানুষের মতো ভালোবাসতাম।… নিগণে বিনয়দের বাড়িতে কয়েকবার নিমন্ত্রণ খেয়েছি।… খুবই সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ি ওদের – ধানের আড়ত আর দোকান ছাড়া প্রচুর জমিও ছিল ওদের। বাড়িতে ঢুকলেই মন ভালো হয়ে যেত। বিরাট বড়ো উঠোন গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো।’ হাসান তাদের বাড়িতে গেলে, ‘খাবার পরিবেষণ করতেন বিনয়ের মা। পাতে সবকিছুই দিতেন একটু উপর থেকে।’ হয়তো মুসলমানের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে। অন্যদিকে আবার তাঁদের এলাকার ‘মুসলমানদের মধ্যে আচার-বিচার ছিল না বললেই চলে। তার বদলে ছিল অসম্ভব অপরিচ্ছন্নতা। যেখানে সেখানে যে কোনো জিনিশ ফেলে রাখা। নোংরা দুর্গন্ধ আঁস্তাকুড়। তার ভিতর দিয়েই বাড়ির মধ্যে যাওয়া-আসা।’ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি যেমন ছিল আবার এরই ভেতরে একধরনের বিরোধও লুকিয়ে থাকতো, যা কখনো কখনো প্রকাশ্যে চলে আসত নানা ছলছুতো ধরে। হাসানের আরেক বন্ধু সমরেশদের বাড়িতেও তাঁর প্রত্যেকদিনের আসা-যাওয়া ছিল। হাসান লিখছেন, এর মধ্যে ‘একদিন একটা বিচ্ছিরি ঘটনাও ঘটে গেল।’ কী সেই ঘটনা? সমরেশদের ঘরের ছেঁড়া মাদুরে পায়ের কাদা মুছতেই, সমরেশের যতীন কাকা, যিনি ‘কংগ্রেস, হিন্দু-মহাসভা, মুসলিম লীগ এসব নিয়ে খুব কথা বলতেন’, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘ওটাতে আমরা শুই, বসি, তুমি পায়ের কাদা মুছলে।’ ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না। সমরেশের বাবাকে যতীন কাকা বলতে থাকেন, ‘আর তো সওয়া যায় না দাদা! মোচলমানের ছেলে এমনি করে আসছে, যা খুশি করছে, হতে পারে তোমার ছেলের বন্ধু তা বলে আমরা সহ্য করব কেন? এর একটা বিহিত না করলে তো একসাথে থাকা যায় না।’ হাসান বলেছেন, ‘নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারলাম না, যতীন কাকা এই কথা বলছেন!’ মানসিকভাবে আহত, লজ্জিত, ব্যথিত, অপমানিত লেখক ভাবেন, ‘কি জানি বাবা, কোথাও না কোথাও মানুষের মনে একটুখানি বিষ থাকবেই! আমার শিক্ষা হয়ে গেল।’ আবার এটাকেই সমগ্র দেশের চিত্র ভাবলে ভুল হবে। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম তাঁর এক স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘১৯৩৩-এর দিকে মিয়াভাই (বড় ভাই) বদলি হয়ে এলেন রহমতপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে… রহমতপুর ছিলো একটি হিন্দু-প্রধান এলাকা।… এই রহমতপুরের জমিদারবাড়ির… কালু বাবুর স্ত্রী আমার বড় ভাইকে নিজের ছেলে বলে ডাকতেন।… এই বাড়ির কথা মনে হলেই আমার চোখে যে ছবিটি ভেসে ওঠে সে হচ্ছে : কালু বাবুর বাড়িতে মিয়াভাই বেড়াতে গেছেন। সন্ধ্যায় পুজোর ঘণ্টা বাজছে এক ঘরে। এদিকে মাগরেবের নামাজেরও সময় হয়েছে। মিয়াভাই তাঁর ‘মাকে’ বললেন, মা একখানা ধোয়া কাপড় দিন। আমি পাশের ঘরে নামাজটা আদায় করে নিই। মা স্নেহে এবং আগ্রহে ধোয়া কাপড় বার করে দিলেন। তাঁর মুসলমান ‘পুত্র’ একঘরে নামাজ পড়ছে এবং আর একঘরে সন্ধ্যা আহ্নিকের আয়োজন হচ্ছে। এ এক অনির্বচনীয় দৃশ্য।’ ঘটনাটির কথা উল্লেখ করে সরদার ফজলুল করিম তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার কিশোর মনকে ঘটনাটির এই সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতির দিকটি সেদিনও অভিভূত করেছিলো।’

৪. স্কুল থেকেই হাসান আরেক রকম শিক্ষা পেয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে নানান ধরনের বই পড়ার অভ্যাস। স্কুলে কী কী পড়তেন হাসান – তার একটা ফিরিস্তি অবশ্য তিনি দিয়েছেন। পড়েছেন – বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হাসান লিখছেন, ‘পালামৌ-এর পুরো বইটাই ছিল পাঠ্য – সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রসালো ভাষা এমন পরিবেশ আর ছবি আনত যে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য দেশান্তরে বাসের অভিজ্ঞা হয়ে যেত। আরো পড়তে হতো – শেক্সপিয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, শেলি, টেনিসন, কোলরিজের কবিতা। অন্যদিকে একটু ফাঁকও থেকে যেত। কারণ হাসানের ভাষায়, ‘লেখক না মরলে পাঠ্য সাহিত্যে জায়গা পেতেন না। সেইজন্যে আধুনিক সাহিত্যিকেরা আমাদের পাঠ্যে জায়গা পাননি।’ হাসান বলছেন, ‘মনে হয় এসব মিলেমিশে মনের মধ্যে আর একটা জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিল – সেটা যবগ্রামের আটপৌরে একঘেয়ে হাঁপ ধরানো আবহাওয়ার ওপরে হাওয়ার মতো ভেসে বেড়ানো ভিন্ন এক যবগ্রাম। এর অনেকটাই তৈরি করে দিয়েছিল, অন্তত আমার মনে হয়, ক্লাসে পড়া বইপত্রগুলোই।’ এই যে বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বজগতের সঙ্গে পরিচয়, যার কথা হাসান বলছেন, ঠিক সেই একইরকম কথা বলেছিলেন ফরাসি দার্শনিক সার্ত্র (Jean Paul Sartre) তাঁর স্মৃতিকথায়। তিনি বলেছেন, ‘I met the universe in books : assimilated, classified, labelled and studied, but still impressive.’ শুধু তা-ই নয়, সার্ত্রে বই পড়াকেই বলেছিলেন তাঁর ধর্ম, আর গ্রন্থাগার ছিল তাঁর কাছে উপাসনালয়ের মতো পবিত্র স্থান। ‘I had found my religion : nothing seemed more important to me than a book. I saw library as a temple.’ বাংলা, ইংরেজি, গণিতের পাশাপাশি হাসান স্পেশাল সাবজেক্ট হিসেবে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ইতিহাস। হাসান বলছেন, ‘এখন মনে হয় ঠিক কাজটাই করেছিলাম।… ইউরোপের উত্তর পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ের এই ছোট্ট দেশটি সারা পৃথিবী শাসন করেছে এক সময়।… ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়লে একরকম সারা পৃথিবীরই ইতিহাস পড়া হয়ে যায়। এই বইটা থেকেই আমি ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, হল্যান্ড এইসব দেশ সম্বন্ধে কিছু কিছু জানতে পেরেছিলাম। তারপর থেকেই ইতিহাসের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে গেল।’ ইতিহাস পড়া সম্পর্কে হাসান বলছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাস পড়া শিক্ষিত মানুষের জন্যে খুব দরকারি মনে হলো আমার। প্রমথনাথ সেন নামে একজন লিখেছিলেন ইংল্যান্ডের ইতিহাস। আজও আছে আমার কাছে বইটা। তখনকার দিনের স্কুলের পাঠ্য বইগুলো বড়ো যত্ন করে রেখেছিলাম। বিখ্যাত মানুষেরা লিখতেন এইসব বই।’ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘যে-সকল দেশ ভাগ্যবান তাহারা চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়, বালককালে ইতিহাসই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয়-সাধন করাইয়া দেয়।’ অন্যদিকে আবার ই. এইচ কার (E. H. Carr) ইতিহাসের মধ্যে দেখেছেন, ‘বর্তমান ও অতীতের মধ্যে সংলাপ – তা বিমূর্ত ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির মধ্যে সংলাপ নয়, বরং আজকের সমাজ ও গতকালের সমাজের মধ্যে সংলাপ।’ সে-কারণেই তিনি মনে করতেন, ‘অতীতের সমাজ বুঝতে মানুষকে পারঙ্গম করা ও বর্তমান সমাজের ওপর তার দখল বাড়ানো – এই হলো ইতিহাসের দ্বিমুখী কার্যধারা।’ ইতালির মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি (Antoni Gramsci) ইতিহাসকে গভীর আগ্রহের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তাঁর কাছে ইতিহাসের কাজ শুধু মৃত মানুষকে নিয়ে নয়, বরং জীবন্ত মানুষকে নিয়ে। আর এই মানুষ হচ্ছে ‘সমাজে গোষ্ঠীবদ্ধ সব মানুষ, যারা কাজ করছে এবং নিজেদের জীবনের মান উন্নতি করছে।’ সার্ত্র মনে করতেন ইতিহাসের মাধ্যমে অর্জিত যে-অভিজ্ঞতা, তাকেই মানুষ নানাভাবে তাদের কাজে লাগায়। আর এইভাবে ‘the pressent is enriched by the whole of the past’। এসব বিবরণ থেকে একটি বিষয় আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, স্কুলের পড়াশোনার প্রতি হাসানের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ক্লাসের শিক্ষকেরা পড়াশোনার প্রতি এই আগ্রহটি তাঁর মধ্যে বপন করে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। অন্যদিকে, তারিক আলিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said) তাঁর স্কুলের পড়ালেখার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘My learning was not really a function of the classroom, which I found on the whole extremely boring. And I found most teachers quite limited, more limited than many of the students, as it turned out.’ হাসানকে সেদিক থেকে ভাগ্যবান বলতে পারি। তবে হাসানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নোটবই তখনকার দিনেও ছিল। সেই নোটবইয়ের সূত্র ধরেই মোহিতলাল মজুমদারের লেখা পড়েছিলেন হাসান। শুধু তাই নয়, পরীক্ষায় আজকের দিনের মতো প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারও ঘটতো। যে-কারণে ম্যাট্রিকুলেশন (স্কুল ফাইনাল একজামিনেশন) পরীক্ষা হাসানদের দুবার দিতে হয়েছিল।

৫. পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ফলের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না হাসানের। আর তখনই ঠিক সেই সময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন। হাসানের নিজের কথায়, ‘শরৎচন্দ্র আর বিভূতিভূষণ কি নাছোড়! নিষ্ঠুর ভয়ংকর নির্জন অথচ শান্তিভরা প্রকৃতি আমার প্রিয়। সেটা বিভূতিভূষণের মধ্যে পাই। কূটকচালে বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষ গাঁয়ের সমাজপতি বামুনও আমার চেনা-শরৎচন্দ্রের এক একটি উপন্যাসে (বামুনের মেয়ে) তাদের হুবহু দেখতে পাই। অপুর চোখ ধার নিয়ে নিবিড় প্রকৃতিরও বেশ আন্দাজ পাই। এইসব টনিক খেয়ে প্রচুর গদ্য লিখি।’ এভাবে লিখতে লিখতেই তাঁর ‘হঠাৎ একদিন মনে হলো এসব নকলবাজিতে কোনো কাজ হবে না। তার চেয়ে বৈঠকখানার সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়ে ধুলোভরা চৌকিতে শুয়ে সমস্ত দুপুর পার করে দিই। ঘাম ধুলো গরমে দুপুরবেলায় ঘুম আসে নেশার মতো।’ হাসান তাঁর সেইসময়ের আত্ম-উন্মোচনের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এর মধ্যে একদিন… জ্বলন্ত কাঠ-কয়লায় একবারে অনেকটা জল ঢাললে যেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে, তারপর নিভে যাবার সময় খানিকটা ফুঁসিয়ে নেয় – আমিও যেন সেইদিন নিজের ভিতরে সেই ছ্যাঁৎ শব্দ পাই, খানিকটা ফোঁসাতেও শুনি। কিন্তু মনে হলো আমি যেন একেবারে নতুন মানুষ।’  লেখক হিসেবে এভাবেই হাসানের আত্মজাগরণের শুরু। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি বৈঠকখানাতে যাই, কিন্তু ঘরে আর ঢুকি না। বাবা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তো বটে, বৈঠকখানার ঘরের বাইরে পুবখোলা বড়ো জায়গাটায় একটা কাঠের টেবিল আর চারটে চেয়ার পাতা আছে।… এইখানে, ঐ দুপুর বেলাতেই প্রত্যেকদিন একটি চেয়ারে বসে লিখতে শুরু করি জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘মাটি ও মানুষ’। তিন-চারটি লাইন লেখার পরেই মনে হলো এতদিন যা কিছু লিখেছি গদ্যে-পদ্যে, সেসবই আবর্জনা, কিছু হয়নি। পুড়িয়ে ফেলব সে-সব, তাদের কোনো চিহ্নই রাখব না। লেখক হওয়া শুধু নয়, লেখাই হবে আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ, জরুরি কাজ, একমাত্র কাজ। কোনো কিছুর জন্যে নয়, লেখার জন্যেই।’ তাঁর কৈশোরের লেখালেখির ব্যাপারটা নিয়ে সার্ত্রেও অনেকটা এরকমই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর কাছে মনে হয় যে, লেখার মধ্য দিয়েই তিনি যেন নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, এই লেখাই তাঁকে নতুন করে জন্মও দিয়েছেন। সার্ত্র বলেছেন, ‘I began to discover myself. I was virtually nothing… I was born from writing : before that, there was only a reflection in a mirror. From my first novel, I knew that a child had entered the palace of mirror. By writing, I existed, I escaped from the grown-ups; but I existed only to write and if I said : me – that meant the me who wrote. It did not matter I knew ioy.’ হাসানও সেদিনের কথা স্মরণ করে বলেছেন, ‘লেখা কিন্তু কাঁচাই থেকে গেল। তফাৎ বলতে এইটুকুই যে মনে আস্থা তৈরি হলো যে আমি নিজেই লিখছি – অন্যের লেখা নকল করছি না।… আমার লেখায় আমি অনেকটা হলেও আছি।’ অন্যদিকে সার্ত্রের কাছেও লেখা ছিল যেমন আত্ম-আবিষ্কারের ব্যাপার, তেমনি কঠিন পরিশ্রমেরও। তিনিও লিখে চলেছিলেন শুধু লেখার জন্যেই : ‘Writing, my black work, referred to nothing… I was writing for the sake of writing. I do not regret it.’ এইসব লেখা হাসানকেও একেবারে পুরোটা না হলেও, অনেকটাই বদলে দিয়েছিল; যদিও বাইরে তার তেমন-একটা আঁচ পড়েনি। হাসানের ভাষায়, ‘যা প্রতিদিন করি তাই করছি, যা বলি শুনি, তাই বলছি, শুনছি। কিন্তু হয়ে গিয়েছি আমি আনকোরা নতুন। বাইরে কোনো কিছু এতটুকু বদলালো না, কিন্তু বদলে গেল আমার সবটাই।’ কী লিখতে শুরু করেছিলেন হাসান? লিখছিলেন একটি উপন্যাস। হাসানের নিজের ভাষায়, ‘মাটি ও মানুষ উপন্যাসের অনেকটাই লিখেছিলাম। ছাপলে শ-দেড়েক পৃষ্ঠা দাঁড়াতে পারে। লেখাটাকে নষ্ট হতে দিইনি। পরে কলেজ-জীবনে হাস্যরসের বিখ্যাত লেখক ‘সম্বুদ্ধ’-স্যারকে পড়তে দিয়েছিলাম। বলেছিলেন, বেশ হচ্ছে, বিভূতিভূষণ ছাড়ো হে! কিন্তু নিজেই অবাক হয়ে দেখি, লেখাটায় আর একটি লাইনও যোগ করিনি। কোনোদিন শেষ করা যায় কি না তা একবার পরখ করে দেখার ইচ্ছেও হয়নি। অথচ লেখাটাকে নষ্ট করিনি, ফেলে দিইনি, কোনোদিন প্রকাশ করার চেষ্টাও করিনি। লেখাটা আজও আমার কাছে রয়ে গিয়েছে – কোনোদিন এটাকে শেষ করব না, ছাপতে দেব না স্থির হয়ে যাবার পরেও। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পুরনো কাগজপত্রের মধ্যে দেখেছিলাম, এখন আর দেখছি না। আঁতিপাঁতি করে খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে। ছাপতেই যখন দেবেন না, তাহলে হাসান ওটি লিখেছিলেন কেন? এর একটাই উত্তর : তিনি উপন্যাসটি লিখেছিলেন একান্তই নিজের জন্যে, নিজের মনের আনন্দের জন্য। যেরকম সার্ত্রে বলেছিলেন, ‘In short, I wrote for my own pleasure.’ যে-কোনো আত্মসচেতন লেখকের কাছে এই আনন্দের মূল্য – এককথায় অমূল্য। এটি সার্ত্র যেমন বুঝেছিলেন, তেমনি বুঝেছিলেন হাসান আজিজুল হক নিজেও।

৬. অঙ্কে অসম্ভব কাঁচা হওয়া সত্ত্বেও স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করলেন হাসান। বর্ধমানের রাজ কলেজে ভর্তির জন্যে যখন মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই একটি চিঠি বলা যায়, তাঁর গোটা জীবনটাকেই পালটে দিলো। হাসানের দুলাভাই ছিলেন খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের অধ্যাপক। চিঠিতে তিনি হাসানকে প্রস্তাব দিলেন, ‘তুমি… খুলনায় আমাদের এখানে চলে এসো। দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে ভর্তি হবে।… আমাদের একটা কোয়ার্টারও আছে। তোমার বোন ও ভাগ্নীও এখানে। ওদের সঙ্গে তোমার ভালোই লাগবে। সবদিক দিয়েই সুবিধে। বাপজানের সঙ্গে কথা বলো।’ হাসানের মা প্রথমে সন্তানকে দূরে পাঠাতে না না বললেও পরে বাবার চাপে রাজি হলেন। মায়ের কাছে খুলনা বিদেশ-বিভুঁই। আর বাবার কথা হচ্ছে – ‘খুলনা আবার বিদেশ হলো কবে?’ ১৯৪৭-এর ভারত-বিভাগ এই মানুষগুলোর মনে দেশ-বিদেশের ধারণা পালটাতে পারেনি। দূরত্বের কারণেই মায়ের কাছে খুলনা বিদেশ, আর বাবার কাছে পাকিস্তান হওয়ার পরেও খুলনা কিনা নিজের দেশ। আর হাসানের ভাষায়, ‘তখন খুব খারাপ চলছিল দিনকাল। যুদ্ধ গেল, দুর্ভিক্ষ গেল, দেশ স্বাধীন হলো – দিন তেমন বদলালো না।’

৭. পাসপোর্টের ঝক্কি-ঝামেলা সব শেষ করে খুলনার পথে রওনা দিতে বাবার সঙ্গে তিনি একদিন শিয়ালদহ স্টেশনে বরিশাল এক্সপ্রেস ধরার জন্যে দাঁড়ান। সেখানেও তিনি জীবনের এক কঠিন আর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সামনে গিয়ে যেন দাঁড়িয়ে থাকেন। হাসান লিখেছেন, ‘প্লাটফর্মের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত একবার চেয়ে দেখতেই মাথাটা ঘুরে গেল। পা ফেলার জায়গা নেই – মানুষে মানুষে ছয়লাপ। প্যাসেঞ্জারের ভিড়ে নয়। চেয়ে দেখি প্রত্যেকটি প্লাটফর্মই এইরকম। মানুষে ভরা – সব শুয়ে বসে রয়েছে – তাদের একজনও প্যাসেঞ্জার নয়। এত মানুষ কারা? প্লাটফর্মে প্যাসেঞ্জার ছাড়া কিংবা গেটপাস ছাড়া কেউ-ই ঢুকতে পারে না। কিন্তু সবকটা প্লাটফর্মেই দেখছি সংসার পেতে ছেলেপুলে নিয়ে বসবাস করছে অগুন্তি পরিবার। প্লাটফর্মের মেঝেতে তাদের খোলা সংসার। বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, মামা, জেঠি, খুড়ি, পুঁটলিপাকানো ঠাকুরমা, ঠাকুরদা – সবাই আছে সংসারে। লম্বায় চওড়ায় হাত সাতেকের বেশি জায়গা পায়নি কোনো পরিবার। সীমানা তৈরি হয়েছে পুঁটলি, হাঁড়িকুড়ি, তোরঙ্গ, কাঁথা-বালিশ দিয়ে।… ওদের দেখলে শুধু মনে হয় বেঁচে আছে কি করে? আমার মনে হলো এই প্লাটফর্ম ভয়ানক একটা কারখানা যেখানে মানুষকে স্রেফ বাঁচিয়ে রাখা হয়।… জ্যান্ত মানুষের এরকম শ্মশান সেই দেখেছিলাম বটে ১৯৫৪ সালে!’ হাসানের বাবা তাঁকে জানালেন যে, এই মানুষগুলো ‘রিফুজি – সব পুব পাকিস্তান থেকে এসেছে।’ সেই সময়কার উপলব্ধির কথা জানাতে গিয়ে হাসান বলেছেন, ‘সেই ষোলো বছর বয়সে শেয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো মায়ের কোলে থেকে ছিটকে মাটিতে পড়লাম।’ একসময় ট্রেন ছাড়ে। হাসানের ভাষায়, ‘ছিন্নভিন্ন পচা ঘুণেধরা মানুষে ভরা প্লাটফর্ম আস্তে আস্তে পিছনে সরে যাচ্ছে। বাবা আমার কামরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, পিছনে চলে যাচ্ছেন তিনি – হাত তিনি নাড়াবেন না জানি – বারবার ছায়া পড়ছে তাঁর মুখে, আবছা দেখতে পাচ্ছি তাঁকে। একবার হুইসেল বাজিয়ে ছাড়ল। বরিশাল এক্সপ্রেস। ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হলো প্লাটফর্ম।’ এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো স্মৃতিকথার এই পর্ব। কিন্তু তাকে হাসান আরেকটু টেনে নিয়ে যান। পথে যেতে-যেতে তিনি ভাবতে থাকেন, ‘আমি এখনো জানি না যশোর-খুলনার গ্রাম আমি ভালোবাসতে পারব কিনা। এত ছায়া, এত অন্ধকার, এত সব গ্রাম্য সুঁড়িপথ, দাওয়া-ঢাকা ঘর, গরিবদের গেরাপাতার বাড়ি, জলো বিল, স্যাঁতসেঁতে মাটি আমি ভালবাসতে পারব কি না।’ অবশেষে দীর্ঘপথ পরিক্রমা শেষে তিনি খুলনায় এসে পৌঁছতে পারলেন। সেই মুহূর্তের বিবরণ দিতে গিয়ে হাসান লিখেছেন, ‘আমি বাসায় ঢুকলাম। ছোট্ট উঠোন পার হয়েই দেখতে পেলাম দক্ষিণের পাকা বারান্দায় বসে গল্প করছেন আমার বড় বোন জানু – এখন লেখিকা জাহানারা নওশিন – আর একজন কালো পাড়ওয়ালা ধপধপে সাদা শাড়ি পরে আছেন – তিনি অনুদি। তাঁর পুরো নাম কখনোই জানা হয়নি, জানার দরকারও পড়েনি। তিনি আমাদের কাছে শুধুমাত্র অনুদি – তার একমাত্র কন্যা বাপি। তার বাবা বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা খোকা বসু – আত্মগোপনে আছেন।’ আর হাসানের ‘কৈশোরের সমাপ্তি এখানেই।’ একই সঙ্গে তাঁর স্মৃতিকথার এই খণ্ডের সমাপ্তিও। আমরাও একটি সুখপাঠ্য রচনার শেষে এসে দাঁড়াই। তবে একটি প্রশ্নও মনে জাগে : তাঁর স্মৃতিকথার সমাপ্তিও কি হাসান এইখানে এসে একেবারে টানতে চাইছেন? একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক লেখায় হাসান তাঁর এই স্মৃতিকথা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, ‘আমার স্মৃতিকথার শেষ ভাগ – ‘দুয়ার হতে দূরে’। আমি যে চার খণ্ডে আমার স্মৃতিকথা লিখছি, এটা তার শেষ পর্ব। এর আগে তো তিন পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। এটাকে বলা যায় মোটামুটি শেষ পর্ব।’ পাঠক হিসেবে আমাদের সেটি মানতে কষ্ট হয়।

৮. এই বইয়ের ভূমিকায় হাসান লিখেছেন, ‘গাঁয়ের নিভৃত ছোট্ট দুয়ার দিয়ে বাইরে এসে চারদিকে শত শত দুয়ারের দেখা পাই। তাদের কোনোটি খোলা, কোনোটি বন্ধ। হাট করে খোলা, আধা-খোলা, ঠেলা দিলেই খোলা যাবে কিংবা চিরকালের জন্য বন্ধ অথবা উই-ধরা, বুনো ঘাস-গজানো, পরিত্যক্ত – সামান্য চেষ্টাতেই ঢোকা যায় – কতো না দুয়ার এই মুক্ত পৃথিবীতে! সব ফেলে আমি দাঁড়িয়েছি অজানা অথচ নির্দিষ্ট একটি দুয়ারে। এই পর্যন্তই।’ আমরা কিন্তু এই পর্যন্ত এসে সন্তুষ্ট হতে পারি না। খুলনায় তো এলেন হাসান, তারপরের অংশটুকু শোনার জন্যে আমরা উদগ্রীব হয়ে থাকি। এর কারণ তিনি তো শুধু একজন ব্যক্তি নন, সেইসঙ্গে দেশের একজন প্রথম সারির লেখক। আর লেখক তো সারাক্ষণ সৃষ্টি করেই চলেন। এই সৃষ্টি করে চলাটা লেখকদের বেলায় শেষ হয় না। সার্ত্র যেমন বলেছিলেন, ‘In a word, I gave myself; I gave myself all the time and everywhere… I never stopped creating myself; I was giver and gift.’ আবার, ইন্দিরা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যার… জীবনী শক্তির প্রাবল্য নেই, যার মনের রহস্যময় বিচিত্র বিকাশ নেই; সে সুখী হতে পারে, সাধু হতে পারে এবং তার সেই সংকীর্ণতাকে লোকে মনের জোর বলতে পারে, কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয় তার বেশি নেই।’ আমরা বিশ্বাস করি : রবীন্দ্রনাথ যে পাথেয়র কথা বলেছিলেন, হাসানের মধ্যে তার অভাব নেই। দুয়ার হতে দূরে গ্রন্থটি সেই সত্য আরেকবার আমাদের সামনে তুলে ধরে।