ক্ষুদ্রতাবিনাশী মানবপ্রেমের বয়ান

আলমগীর খান

মা

র্কিন-প্রবাসী বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও লেখক আশরাফ আহমেদ ২০১৪ সালে বাংলা লেখালেখিতে প্রবেশ করে অল্প সময়ের মধ্যেই মোট সাতটি গল্পধর্মী প্রবন্ধের বই লিখেছেন। সবগুলোরই প্রকাশক আগামী। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য সহজ ভাষায় প্রায় কথা বলার ঢংয়ে ভাবের প্রকাশ ও হাস্য-কৌতুক। সে-কারণে তাঁর উপস্থাপিত যে-কোনো কঠিন বিষয়ও কখনো পাঠককে ক্লান্ত করে না। আর তাঁর লেখার উপাদান প্রধানত তিনটি : বিজ্ঞানের বিষয়, প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধ। এসবের অনেক কিছুই আবার স্মৃতিচারণমূলক ঘটনার বয়ান। তাঁর বিজ্ঞানের ক্ষেত্র প্রাণরসায়ন, তাই হয়তো তাঁর সাহিত্যেও মানুষের হৃদয়ের প্রতিফলন অনেক গভীরভাবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রতিফলিত হয়। অবশ্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেখানে তাঁর অবলম্বন কঠোর যুক্তি, সাহিত্যে সেখানে প্রেমরস। অর্থাৎ মানুষ ও জীবনকে তিনি দেখে থাকেন গভীর সহানুভূতি ও ভালোবাসার চোখ দিয়ে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞায়।

২০১৭-এর বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর একাত্তরের হজমিওয়ালা কিশোর-উপন্যাসটি বিশেষভাবে উল্লে­খযোগ্য এর বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও এক ব্যতিক্রমী সহজ প্রকাশভঙ্গির জন্যে। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে লেখা এ-স্বল্পদৈর্ঘ্যরে উপন্যাসের কাহিনি পিতৃ-মাতৃহীন ষষ্ঠ শ্রেণির বালিকা ফুলবানুকে ঘিরে আবর্তিত। সে ঢাকায় একটি শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ধনীগৃহে কাজের মেয়ে হিসেবে থাকার সুযোগ পেয়েছে। এই বাসার বুয়াকে সে খালা বলে এবং এই খালা তাকে নিজের মেয়ের মতো আদর ও শাসন করে। বাসার সাহেব, বেগম ও তাদের ছেলেমেয়ে সবাই ফুলবানুর প্রতি স্নেহপরায়ণ ও তারা তাকে পড়ালেখার জন্য স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। গ্রীষ্মের ছুটির আগে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের কাজ দেওয়া হয়েছে এলাকায় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করা ও তার সাক্ষাৎকার নেওয়া। সাহেব-বেগমরা বিদেশে বেড়াতে যাওয়ায় স্কুলের ছুটিতে ফুলবানু খালার সঙ্গে তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক স্কুলের সামনে সে এক বৃদ্ধ আচারবিক্রেতা ইব্রাহিম লোদির দেখা পায়। সে তার ঘরে বানানো ‘জয় বাংলা আচার’ স্কুলের ছাত্রছাত্রীর কাছে বিক্রি করে। এই হজমি অন্য ছেলেমেয়ের মতো ফুলবানুরও প্রিয় আর হজমিওয়ালার সঙ্গে তার পিতা-কন্যার সম্পর্কের মতো এক হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তার কাছে সে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছে। কাছেই যে ভাঙা দালানের মধ্যে একটি ঘর তুলে বৃদ্ধ বাস করেন, তাও সে দেখেছে। এই বৃদ্ধ একজন পাকিস্তানি, একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনের অভিযানে সেও ছিল। একাত্তরে তার অফিসাররা তাকে শিখিয়েছিল, সে কাফের হত্যা করছে। কিন্তু একদিন এক নিহত মায়ের পাশে এক শিশুর কান্না শুনে তার নিজ দেশে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে। সে তার অফিসারকে অনুরোধ করে তাকে যেন সামরিক অভিযান ছাড়া অন্য কোনো কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন তাকে একটি মিলিটারি ক্যাম্পে দারোয়ানের চাকরি দেওয়া হয়। ক্যাম্পটি ছিল এই ভাঙা দালানে, যেখানে এখন তার ঘর।

এই ক্যাম্পে স্বাধীনতাকামী বাঙালি যুবকদের অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। সেসব অনেক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী এই হজমিওয়ালা। আত্মগ্ল­ানি ও বিবেকের দংশন থেকে বাঁচার জন্য সেদিনের সেই পাকিস্তানি সেনা এখন ‘জয় বাংলা আচার’ বানিয়ে বিক্রি করে শিশুদের আনন্দ দেয় ও এভাবে বাংলার স্বাধীনতাকামী বিজয়ী মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। ফুলবানুর ইচ্ছা ছিল, সে এই বৃদ্ধের সাহায্য নিয়ে এবার স্কুলে দেওয়া ছুটিকালীন হোমওয়ার্কটি করবে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যে, এক আদরের নাতনির অসুখের খবর শুনে ইব্রাহিম লোদি গ্রীষ্মের ছুটির আগেই পাকিস্তানে ফিরে গেছে। হতাশ হলো ফুলবানু।

তবু এক অজানা আকর্ষণ নিয়ে এক সকালে ফুলবানু ওই ভাঙা দালানে বৃদ্ধ হজমিওয়ালার ঘরটিতে গেল। গল্পের সত্য অথচ নাটকীয় ঘটনাটি ঘটতে থাকল তখন থেকেই। আলি বাবা যেভাবে তার বাহিনী নিয়ে ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রবলে গুহার মধ্যে ঢুকে গোপন সম্পদ সংগ্রহ করেছে, অনেকটা সেভাবে ফুলবানু হজমিওয়ালার দরজার ওপারে চলে যায় ও পেয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের কিছু অজানা ঐতিহাসিক ঘটনার সম্পদ। ফুলবানুর সামনে উন্মোচিত হয় একাত্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সে অনুসরণ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে আটক স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন যুবককে ও জানতে পারে ক্যাম্পে তাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের কথা। তাদের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তির জন্য কাজ করেছেন ও নির্যাতিত হয়েছেন, কিন্তু কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তির আশায় নয়। মুক্তিযুদ্ধে তেমন কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষের কথা জানা যায় এই কিশোর-উপন্যাসটি থেকে।

এখানে উল্লে­খ্য, গত ২৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান মিলনায়তনে আশরাফ আহমেদের ছয়টি বইয়ের ওপর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক এবং শিশু-কিশোর সাহিত্যিক আলী ইমাম একাত্তরের হজমিওয়ালাকে বাংলা কিশোর-সাহিত্যে একটি অভিনব গ্রন্থ বলে উল্লে­খ করেন। তাঁর মতে, লেখক ম্যাজিক-রিয়ালিজমের টেকনিক অবলম্বন করেছেন ও বইটি নতুন প্রজন্মের কাছে শুধু নয়,

বাংলা কিশোর-সাহিত্যে একটি দিক খুলে দিয়েছে।

একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই দিক, যা কম জানা, তাছাড়াও বইটিতে আছে এক দরিদ্র অনাথ কিশোরীর মনের কারুকাজ। সমাজের আরো দুঃখসহা অন্য কিশোরীদের তুলনায় ফুলবানু নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে এবং এ-জীবনকে সে ছাড়তে চায় না। একাত্তরে হানাদার বাহিনীর একজন হলেও ইব্রাহিম লোদি এক হৃদয়বান ভিন্ন মানুষ, পাকিস্তানের ঘৃণ্য ভূমিকায় সে লজ্জিত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গর্বিত। এই উপন্যাসে মানবতা ও স্বাধীনতার স্পৃহা এভাবে দেশের সীমানার ক্ষুদ্রত্ব অতিক্রম করে গেছে।

আশরাফ আহমেদের ভাষার সহজ রূপ, বর্ণনার সরলতা, কিশোর মনের গভীর কারুকাজ তুলে ধরার দক্ষতা, ইতিহাসনিষ্ঠতা ও সর্বোপরি ক্ষুদ্রতাবিনাশী গভীর মানবপ্রেম একাত্তরের হজমিওয়ালাকে সব বয়সী পাঠক-পাঠিকার কাছে একটি সুখপাঠ্য মূল্যবান উপন্যাসে পরিণত করেছে।