খালেদ চৌধুরী

আবুল হাসনাত

 

বাংলা নাট্যমঞ্চকে খালেদ চৌধুরী আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং দেশীয় নাটকের ঐতিহ্যিক ভাবনা নিয়ে যে-উচ্চতায় স্থাপন করেছিলেন তা ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে আছে। কী অসাধারণ ছিল ভারসাম্যজ্ঞান ও প্রতীকায়নের পরিপ্রেক্ষিত, তাঁর মঞ্চস্থাপত্যের দিকে দৃকপাত করলে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। আজ থেকে ষাট বছর আগে তিনি যখন রক্তকরবীর মঞ্চটির ড্রইং করেন বন্ধু ও সতীর্থ শম্ভু মিত্রের অনুজ্ঞায়, তখনো তিনি ভাবেননি পরবর্তীকালে তাঁরই প্রবর্তনায় ও প্রযত্নে বাংলা নাট্যমঞ্চ পরিশীলিত বোধে এবং অভিনবত্বে নবীন মাত্রা নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। অথচ মঞ্চপরিকল্পনা বা মঞ্চস্থাপত্য নিয়ে তিনি তখনো কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। আইপিটিএর কর্মী ও সদস্য হিসেবে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ থেকে যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তা তাঁর বোধ ও মননে মিশে ছিল। রক্তকরবী মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের আসনকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। মঞ্চ পরিকল্পনায় তাঁর উদ্ভাবনী কৌশল, পরিমিতি ও পরিশীলিতবোধ এবং বুদ্ধির প্রাখর্য তাঁকে অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করে। তিনি যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই চিত্রকলা, রেখাচিত্র ও লোকসংগীতের গভীরে প্রবেশ করে তার চর্চা শুরু করেন। এসব অভিজ্ঞতা মঞ্চসজ্জায় তাঁকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত এবং নতুন ভাবনায় উদ্দীপ্ত করে তোলে। বহুরূপীর রক্তকরবী প্রযোজনায় মঞ্চ, সংগীত, পোশাক এবং বিশেষ বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। শম্ভু মিত্র ও কুমার রায়ের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, নাটকে সংগীতের প্রয়োগ ও আবহসৃষ্টির জন্য তিনি প্রাণান্ত পরিশ্রম করতেন। সংগীত ও দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। এছাড়া যৌবনে তিনি লোকশিল্প সম্পর্কে যে-জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, নাটকের প্রয়োগ-কৌশলে তা ব্যবহার করেছেন।

পরবর্তীকালে তিনি হয়ে ওঠেন মঞ্চস্থাপত্যে অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনি যেসব মঞ্চনাটক পরিকল্পনা করেন সেগুলো হলো : পুতুলখেলা, গুড়িয়া ঘর, শুতুরমুর্গ, এবং ইন্দ্রজিৎ, আধে আধুরে, ডাকঘর, কালের যাত্রা, পাগলা ঘোড়া, আকরিক, তখন বিকেল, জন্মদিন, দুই তরঙ্গ, সুন্দর, কর্ণাবতী, চিলেকোঠার সেপাই, অন্তর যাত্রা প্রভৃতি। তিনি একই সঙ্গে মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনা করেন অমর ভারত, দ্বন্দ্বসমাস, দেবতার গ্রাস, আন্না থেকে মিনা এবং অতি সম্প্রতিকালের গুপী গায়েন বাঘা বায়েন।

খালেদ চৌধুরী ৯৪ বছর বয়সে ৩০ এপ্রিল কলকাতায় পরলোকগমন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে মঞ্চপরিকল্পক, প্রচ্ছদশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, লোকশিল্প সংগ্রাহক ও লেখক। বহু গুণের অধিকারী এই মানুষটির তিনটি অসামান্য গ্রন্থও রয়েছে। প্রথম গ্রন্থ, থিয়েটারে শিল্প ভাবনা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন থেকে। গ্রন্থটিতে থিয়েটার-সম্পর্কিত ভাবনার সঙ্গে উঠে এসেছে তাঁর শৈশবের স্মৃতি। অজানা তথ্য ও নব্য ভাবনায় সমৃদ্ধ এ-গ্রন্থ। কৈশোরোত্তীর্ণকালে প্রকৃতি, মানুষের জীবনাচরণ ও লোকসংগীত তাঁকে জীবন ও সমাজ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছিল এবং এই আগ্রহ থেকেই তিনি জীবন ও শিল্প সম্পর্কে এক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলেন। এই গ্রন্থের প্রবন্ধের শিরোনাম থেকে নাটক বিষয়ে খালেদ চৌধুরীর ভাবনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা যায়। এ গ্রন্থের সতেরোটি প্রবন্ধ হলো : শিল্পের সন্ধানে, মঞ্চবেদির বিবর্তন ও প্রতিষ্ঠা, মঞ্চচিত্রণ, মঞ্চসজ্জা : প্রাথমিক দায়িত্ব, শিল্পের শর্ত, নাটক-নেপথ্য-সময়, থিয়েটারে মঞ্চচিত্রণ, নাটকে সংগীত প্রয়োগের সমস্যা, থিয়েটারে আবহ, থিয়েটারে সার্বিকতা, রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যে দৃশ্যপট, রবীন্দ্রনাটকে দৃশ্যকল্প ও আবহভাবনা, অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র, কিছু ধাঁধা কিছু প্রশ্ন, গঙ্গাদা, তৃপ্তি মিত্র : দেখেছি একটি প্রতিভার স্ফুরণ এবং নির্দেশক ও অভিনেতা শম্ভু মিত্র। এসব শিরোনাম থেকে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় মূলত নাটক ও নাটকের মঞ্চের স্থাপত্য ও আবহসংগীত নিয়ে সে-সময়ে তাঁর যে-ভাবনা গুঞ্জরিত হয়েছিল হৃদয় ও মনে তা বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আলোচিত হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মঞ্চে উপস্থাপনা সম্পর্কে খালেদ চৌধুরীর কিছু প্রসঙ্গিক চিন্তার কথা। এছাড়া নাট্য-আন্দোলন এবং বহুরূপীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার ফলে শক্তিমান শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র ও গঙ্গাপদ বসু সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন। অভিনয়কুশলতায় এই তিনজন কীভাবে নাট্য-আন্দোলনকে নানা মাত্রা দান করেছিলেন, তা তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থ লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে। এতে লোকসংগীত ও তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মোট নয়টি প্রবন্ধ আছে : শিকড়ের সংগীত, লোকসংগীত গণসংগীত প্রসঙ্গ, লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা, লোকসংগীত : গ্রহণ-বর্জনের আলোকে, লোকসংগীতের ভাষা, সংস্কৃতির লোকজ উপাদান, গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, গুরুসদয় স্মৃতি এবং লোকসংগীত : পরিধি ও প্রাসঙ্গিকতা। সংগীত, বিশেষত লোকসংগীত, নিয়ে তাঁর বহু ভাবনার বিচ্ছুরণে উজ্জ্বল এই গ্রন্থ। লোকসংগীতে যে মানবিক চেতনার বিচ্ছুরণ আছে এবং এই সংগীতচর্চার ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষ কেমন করে হয়ে ওঠেন জীবনচর্চায় সমৃদ্ধ সে-কথা এতে বলা হয়েছে। নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি ২০১১ সালে তৃতীয় গ্রন্থ প্রকাশ করে, নাম স্মৃতির সরণি। আইপিটিএতে কর্মসূত্রে এবং নাটক মঞ্চায়নকালে যেসব গুণীজনের সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন এবং পরস্পরের বন্ধু ও সখায় পরিণত হয়েছিলেন, তাঁদের কথা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন    এ-গ্রন্থে। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, কামরুল হাসান, কলিম শরাফী, গঙ্গাপদ বসু, শেখর চট্টোপাধ্যায়, তাপস সেন, কুমার রায়, শ্যামানন্দ জালান, সলিল চৌধুরী, অরুণ মিত্র, শান্তি মিত্র, রণজিৎ সিংহ, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, গুরুসদয় দত্ত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন ও রবিশঙ্করসহ মোট ২৩ জন খ্যাতনামা ও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যক্তির কথা এতে আছে। সৃজনধর্মে এঁরা সকলে হয়তো একই মেরুর ছিলেন না, তবে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মাধুর্য নিয়ে এবং সৃজনের বহুকৌণিক গুণাবলি নিয়ে এইসব মানুষ ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও প্রয়াসকে করেছিলেন প্রাণের আবেগে দীপ্ত। মৃণাল সেন ছাড়া তাঁদের কেউ আজ আর বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁদের সৃজন ও কর্ম ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে যে-রস সিঞ্চন করছে তার গভীর আবেদন রয়েছে। এঁদের ব্যক্তিত্ব, সৃজনকুশলতা এবং লেখকের সঙ্গে সখ্যের নিবিড় বন্ধনের কথা বইটিতে আছে।

খালেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর আসামের করিমগঞ্জের দাসগ্রামে, মামার বাড়িতে। আত্মীয় গুরুসদয় দত্তের দেওয়া নাম চিরকুমার থেকে ভাইদের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পিতার দেওয়া পরিবর্তিত নামে তিনি হয়ে যান চিররঞ্জন দত্তচৌধুরী। যৌবনেই বাড়িতে হিন্দুধর্মের গোঁড়ামিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং নিজের নাম পালটে পরিচিত হন খালেদ চৌধুরী নামে। ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে আইপিটিএর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। এরই মধ্যে চলতে থাকে তাঁর অন্যতম সৃষ্টিশীল কাজ বিভিন্ন গ্রন্থের প্রচ্ছদপট অঙ্কন ও অলংকরণ।

আইপিটিএতে সংগীত, নৃত্য ও অভিনয়জগতের যেসব নক্ষত্রপ্রতিম মানুষের সমাবেশ হয়েছিল এবং এর উদ্যোগে ভারতবর্ষের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কর্মপ্রয়াসকে নববিন্যাসে সজ্জিত এবং লোকসাধারণের জীবনকে মনোময়, মনোজ ও প্রেরণাময় করবার উদ্দেশ্য নিয়ে সর্বভারতে যে-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ছিল। নবীন স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও বোধ নিয়ে নাটক, চলচ্চিত্র ও সংগীতের ক্ষেত্রে কত ধরনের কাজ যে এখানে হয়েছে তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। এই কর্মে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ ও শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে বিরোধ না হলে যেসব সৃজনশীল শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তির সমাবেশ এখানে হয়েছিল, তাঁরাই ভারতবর্ষের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে এমন একটি পথরেখায় পৌঁছে দিতে সমর্থ হতেন, যা হতো আলোকাভিসারী, দীপিত ও নবীন বিন্যাসে বিন্যস্ত এবং রেনেসাঁসধর্মী। আইপিটিএর অভ্যন্তরীণ বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে অনেক সদস্য এই গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। দারিদ্র্য এবং বিপরীত স্রে্র্রাতে যাত্রা সত্ত্বেও এঁদের অনেকেই জীবনের মোহের কাছে পরাজিত না হয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সৃজনশীল হয়ে উঠেছিলেন। মঞ্চনাটক, অভিনয়, সংগীত, চলচ্চিত্র ও চিত্রশিল্পের ভুবনে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সেকালেও খুব সহজ ছিল না। কিন্তু এঁদের অধিকাংশই ছিলেন উদ্ভাবনী কৌশলে দক্ষ, নব নিরীক্ষার আকুতিতে উজ্জ্বল ও সৃজনে তৎপর। সৃজন ব্যতিরেকে অন্য কোনো পথ উন্মুক্ত নেই – এই ভাবনাই হয়ে উঠেছিল এঁদের জীবনাদর্শ। সেই যে অঙ্গীকার ও জনমানুষের কল্যাণ ও শ্রেয়োবোধে তাঁরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন আইপিটিএর ভাবাদর্শের সঙ্গে যুক্ত থেকে, তা অমোচনীয় হয়ে ছিল সকলের সৃজনধর্মে। গোষ্ঠী ত্যাগ করে এলেও তা আমৃত্যু লালন করেছেন। সেজন্য নাট্যগোষ্ঠীর উদ্ভব, সংগীতে নবনিরীক্ষা, চলচ্চিত্রে জীবনের রূপায়ণে ভিন্ন রুচির প্রতিফলন এবং চিত্রকলায় নবীন গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল। বৃত্তাবদ্ধ অনুষঙ্গকে অস্বীকার করে নব্যধারার সৃজন-প্রয়াসী হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গোষ্ঠীচেতনার মধ্য দিয়ে তাঁরা বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা ও সাধনায় নবীন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন।

খালেদ চৌধুরী এই কর্মযজ্ঞে শুধু সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন কিংবদন্তিতুল্য সংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে গানের স্কোয়াডে। ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের অব্যবহিত পরে মানুষকে প্রাণিত ও জীবনকে উজ্জীবিত করার জন্য গান গেয়েছেন এই স্কোয়াডে। বাংলাদেশ প্রদক্ষিণ করেছেন, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরেছেন।

তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। এই কর্মে যুক্ত থাকায়, চিত্রাঙ্কনে সহজাত পারদর্শিতা অর্জন করায় এবং পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়ায় তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকে নবীন আলোকে দীপ্তিময় করেছিলেন।

ছবি আঁকায় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পর তাঁর ইচ্ছা ছিল কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হবেন। সেই ইচ্ছা নিয়ে জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ-বিষয়ে তাঁর স্মৃতির সরণি গ্রন্থে বর্ণনা আছে। তাঁর জবানিতে, ‘কামরুল হাসানকে প্রথম দেখি উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের শেষার্ধে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের বাসায় ১৪ নং সার্কাস  রো-তে। একতলার ঘরটির জানালার কাছে মেঝেতে বসে তিনি ছবি আঁকতেন। যাঁরা তাঁর কাছে আসতেন তাঁরাও ওইভাবে বসতেন। আমি সরকারি চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির অভিপ্রায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। আবেদিনের পাশে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ছিল একটি সুঠামদেহী যুবক, কোলে একটি স্কেচ বুক। আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা পরিমাপের উদ্দেশ্যে আমি যখন আমার ঝুলি থেকে একটি একটি করে স্কেচ অথবা ছবি নামক পদার্থ আবেদিন সাহেবকে দেখাচ্ছিলাম, তখন আবেদিন সাহেবের মুখে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করিনি, তবে পাশে উপবিষ্ট যুবকটির মুখে ছিল মিটিমিটি হাসি। কেন জানি না হাসিটি আমার কাছে খুব সরল মনে হয়েছিল। এক ফাঁকে আবেদিন সাহেব আলাপ করিয়ে দিলেন কামরুল হাসানের সঙ্গে। তারপর আমার ছবি সম্পর্কে মন্তব্য করে বললেন – ‘কী দরকার আর্ট স্কুলে ঢুকে। যা করছ তাই করে যাও।’ আমি আবেদিন সাহেবকে আমার আর্থিক অসংগতির কথা পূর্বাহ্ণে জানিয়ে রেখেছিলাম। জানি না তিনি ওই কারণে, অথবা আমার নিচু মানের অাঁকার জন্য আমাকে নিরুৎসাহ করলেন কি না সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হলো না।’

জীবিকার প্রয়োজনে এই সময়ে তিনি কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন করেন। গতানুগতিকতামুক্ত বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি পাঁচ সহস্র বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন। এ সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে বলেন, এ সংখ্যা আরো অধিক। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রচ্ছদ অঙ্কন অব্যাহত ছিল। তাঁর প্রচ্ছদশিল্পে যে ভাবনা-চিন্তা প্রতিফলিত হতো তা তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল। নতুন সাহিত্য প্রকাশনালয়ের বেশকিছু বইয়ের দৃষ্টিনন্দন অলংকরণ ও প্রচ্ছদ অঙ্কন করেন তিনি।

তাঁর কালে প্রচ্ছদশিল্পকে তিনি উচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এ নিয়েও তাঁকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মাধ্যমে প্রতিষ্ঠালাভ এবং নবীন বোধ ও বুদ্ধি সঞ্চারের জন্য তিনি প্রয়াসী হয়েছিলেন। এ নিয়ে খালেদ চৌধুরী বলছেন : ‘তারপর আমি আস্তে আস্তে ওই জায়গাটায় এলাম। আমি শুরু করলাম ১৯৪৫-এ। আমি প্রথম যে কভারটা করলাম সেটা চিন্মোহন সেহানবিশের অনুবাদে ডাইসন কার্টারের সোভিয়েত বিজ্ঞান। বইটা আছে এখনো। অনিল সিংহদের ছাপা। আমার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ। বই যখন বেরোল তখন দশ টাকা পেয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, দারুণ। যেন বিশ্বজয় করে ফেললাম। আমি এঁকেছিলাম, একটা স্টার, মানে শুটিং স্টার-এর মতন একটা, ওপর দিকে উঠছে, প্রচন্ড  বেগে উঠছে, যেমন করে রকেট ওঠে, ঐভাবে একটা স্টারকে আমি তুলি। অর্থাৎ সোভিয়েতকে আমি স্টার হিসেবে সিম্বলাইজ করি। সোভিয়েত বিজ্ঞানও যেন ওইভাবেই ‘রাইজ’ করছে। আমাকে অনিল সিংহ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এটা এরকম করলেন, কেন করলেন? তখন আমাকে এক্সপ্লেন করতে হলো। এই হলো আমার ফার্স্ট এক্সপেরিয়েন্স বইয়ের কভারের। তারপর থেকে এটায় উন্নতি কীভাবে করা যায় এবং নিজেকে কতভাবে তৈরি করা যায়, সেইটা নিয়ে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন পর্যন্ত আমি ভীষণভাবে লেপটেছিলাম। মানে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন – এই দশ বছর আমার প্রচন্ড  রকমের প্রায়-অবসেশনের মতো হয়ে গিয়েছিল। অথচ টাকা বিশেষ পেতাম না। কিন্তু মনে হয়েছিল যেন, কোথাও একটা প্রতিষ্ঠা দরকার। প্রচ্ছদ হচ্ছে না, রাত্রে উঠে হাঁটতে শুরু করেছি। ছটফট করছি, কিছুতেই মাথার থেকে আসছে না। অনেক সময় একটা বইয়ের জন্যে আমি আটটা দশটা করে প্রচ্ছদ করছি, মানে লে-আউট করছি, একটাও অ্যাকসেপটেড হয়নি। এই ক্রাইসিস।

এই ক্রাইসিসের পরে কামরুলের সঙ্গে দেখা হয়। কামরুল আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে গেল, ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এর পোস্টার অাঁকবার কাজ জুটিয়ে দিল। সেই পোস্টার করে কিছু টাকা পেলাম। সেই টাকা পেয়ে একটু স্থিতু হলাম। সেই সময়েই আবার আইপিটিএরও সঙ্গে আমার বিরোধ হতে লাগল। আমার নিজেরও যেমন ক্রাইসিস ছিল, আইপিটিএরও একটা ক্রাইসিস চলছে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান্ড, বেআইনি।’

খালেদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সাপ্তাহিক বর্তমানে (১৪ মে ২০১৪) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে প্রচ্ছদশিল্পে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মেঘনাদ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘জীবিকার স্বার্থে তিনি প্রচ্ছদ অলংকরণের কাজ করতেন। ১৯৯৮ সাল অবধি কাজ করেছেন। পনেরো হাজারের মতো বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। প্রচ্ছদশিল্পে তাঁকে একটি ‘যুগ’ আখ্যা দেওয়া যায়। যে ভাবনা-চিন্তা নিয়ে কাজ করেছেন তাঁর সমসাময়িক সময়ে সেটি অত্যন্ত আধুনিক বলে ধরা যায়।’

আইপিটিএ থেকে বেরিয়ে এসে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে শম্ভু মিত্ররা গোষ্ঠী চেতনা ও নব নাট্য-আন্দোলনকে সঞ্জীবিত করার জন্য নাটক শুরু করলেন ১৯৪৮ সালে। তখনো দলের কোনো নামকরণ হয়নি। এ প্রসঙ্গে শম্ভু কন্যা শাঁওলী মিত্র বলছেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির সংসর্গচ্যুত এই যুবকেরা যখন বুঝে উঠতে পারছেন না কী তাঁদের করণীয়, তখন মহর্ষি সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘why are we eating our hearts out? আমরা কিছু করি! আমাদের সঙ্গে তো ঝগড়া নেই কারও-র। আমরা যেমন করে পারি, যেটা ভালো মনে করি, করতে শুরু করে দিই!’ এই অনুপ্রেরণা থেকেই ১৯৪৮ সালে বহুরূপীর জন্ম হয়। কাজ শুরু হয়ে যায়। যদিও নামকরণ হয়েছিল বছর দুই পরে, ১৯৫০ সালে। দেশের এবং ব্যক্তিগত জীবনের চরম বিপর্যয়ের মধ্যেই বহুরূপীর জন্ম। বলা যেতে পারে বহুরূপী তাঁদের প্রথম সন্তান। যে সন্তানটির প্রতি তাঁদের একাগ্র মনোযোগ, সমস্ত যৌবন দিয়ে তাকে গড়ে তোলবার সাধনা। আর তা এতই স্বাভাবিক ছিল, সে যেন নিঃশ্বাসের মতোই।’

খালেদ চৌধুরী বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৫৩ সালে; শম্ভু মিত্রের আগ্রহে রঙ্গমঞ্চের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। শম্ভু মিত্র যখন পরিকল্পনা করছেন রক্তকরবী মঞ্চায়নের, তখন চোখের সামনে এ-নাটকটির কোনো প্রতিমান বা আদল ছিল না। রক্তকরবী মঞ্চায়নের কথা দীর্ঘদিন থেকে ভাবছিলেন শম্ভু মিত্র। কিন্তু দ্বিধা ছিল মনে এই নাটকের সামগ্রিক প্রয়োগ-কৌশল নিয়ে। এই সময়ে খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করে বারংবার নাটকটি পাঠ করে, মহলা দিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রক্তকরবী মঞ্চস্থ করবেন।

শম্ভু মিত্র এ-প্রসঙ্গে বলছেন, ‘আমাদের রক্তকরবী ভালো লাগে। যেমন অনেকেরই লাগে। অনেকবারই আমাদের মনে হয়েছে যে ওটা অভিনয় করি। আবার প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে যে আমরা পারবো না। আমাদের পক্ষে এ কাজ অত্যন্ত কঠিন। তারপর একদিন খালেদ চৌধুরী বহুরূপীতে এলেন। এবং রয়ে গেলেন। লোকটির অস্বাভাবিক ক্ষমতা। অাঁকতে পারেন, যে কোনও বাজনা বাজাতে পারেন, গান শেখাতে পারেন, আর যতো নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে পারেন। তাঁকে পেয়ে আবার আমাদের মাথায় রক্তকরবী চিন্তা পেয়ে বসল।’

বাংলার কিংবদন্তিতুল্য নাট্য-দম্পতির একমাত্র কন্যা শাঁওলী মিত্র – যিনি অভিনয়ে ও নাট্য-নির্দেশনায় এবং কথকতার ঢঙে পুরাণকে মঞ্চে উপস্থাপন করে সর্বভারতে খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং নিজেও এক প্রভাবশালী নাট্য ব্যক্তিত্ব – তাঁর একটি গ্রন্থে রক্তকরবী প্রযোজনা সম্পর্কে বলছেন, ‘শম্ভু মিত্র, তাপস সেন এবং খালেদ চৌধুরীর এই সৃষ্টির কাজে সংযুক্ত হওয়াও শম্ভু মিত্র-র জীবন তো বটেই এবং বহুরূপী-র শুধু নয়, সমগ্র বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রেই এক অভূতপূর্ব ঘটনা।’ খালেদ চৌধুরী বলেছেন, ‘শম্ভু মিত্রের সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো আমি কোনো দিন নাটকের সঙ্গে যুক্তই হতাম না। … শম্ভু মিত্রই একমাত্র লোক যাঁর মধ্যে আমি নাটকে সর্বকলার একত্রীকরণ, সমন্বয় সাধন, সুষ্ঠু শৈল্পিক রূপায়ণ এবং নাটকের প্রথম থেকে শেষ অভিনয় পর্যন্ত সম মান বজায় রাখার নীতি এবং অভ্যাস প্রত্যক্ষ করেছি।…’ আর শম্ভু মিত্র খালেদ চৌধুরী সম্পর্কে বলেছেন, ‘…ওর মতো আমি আর কাউকে দেখিনি। মানে অত অদ্ভুত বুদ্ধি না!… কোনও জিনিস এত দ্রুত এত সামান্য ব্যাপারে করে দিতে পারে। ঝট করে – মানে, জিনিয়াস বলে মনে হয়। রিমা-র্কেবল – রিমা-র্কেবল-…।’

সত্যিকার অর্থেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন শক্তিমান মঞ্চস্থপতি। বহুরূপীর প্রযোজনায় এবং বাদল সরকার-লিখিত নাটক পাগলা ঘোড়ার পনেরো দিনের ব্যবধানে দুটি মঞ্চপরিকল্পনা তাঁর নাটকে জ্ঞান ও গভীরতা সম্পর্কেই অভিহিত করে। দুধরনের দুটি মঞ্চপরিকল্পনাতেই তাঁর মেধা ও মননের ছাপ ছিল। বাংলাদেশের নাট্যামোদীদের সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৫৬ সালে ঢাকার আরমানিটোলায় নিউ পিকচার্স সিনেমা হলে রক্তকরবীর মঞ্চায়ন ও খালেদকৃত মঞ্চ ও সংগীতের মূর্ছনা উপভোগ করার। ১৯৭৪ সালে পাগলা ঘোড়া (৯ থেকে ১১ মার্চ) বহুরূপীর প্রযোজনায় ওয়াপদা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সেই সময়ে এ-নাটক মঞ্চস্থ করবার মতো কোনো মঞ্চ ছিল না। উদ্যোক্তরা সেজন্যে ওয়াপদা মিলনায়তনকেই বেছে নিয়েছিলেন। খালেদ-কৃত দ্বিতল এ-মঞ্চটি নির্মাণে দীর্ঘদিন কলকাতায় যে-আদলের মঞ্চে পাগলা ঘোড়া মঞ্চস্থ হয়েছে তাকেই অনুসরণ করা হয়েছিল। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে অপরিসর মঞ্চটিও তাঁর গুণে হয়ে উঠেছিল পরিশীলিত।

রক্তকরবীর মঞ্চ, আলো, আবহ, পোশাকভাবনা, অভিনয় এবং সর্বোপরি নাট্য-উপস্থাপনার অনন্যতা মানুষকে নিয়ে যেত শিল্প-অভিজ্ঞতার সেই স্তরে, যেখানে সচরাচর কেউ পৌঁছতে পারে না।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে রক্তকরবী কেন অনন্যতার মর্যাদা পেয়েছিল, সে-সম্পর্কেও একটু বলবার প্রয়োজন আছে। যদিও তার আগে রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় অভিনীত হয়েছে, তবু তাতে স্বল্পসংখ্যক অভিনেতা কাজ করেছিলেন। রক্তকরবী নাটকে চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং প্রায় সব চরিত্রই উচ্চমানের অভিনয় দাবি করে। আর চার অধ্যায় নাটকের কাহিনির চেয়ে রক্তকরবী নাটকের কাহিনি যথেষ্ট আলাদা, তার সংলাপের ধরনও পৃথক।

তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের এই নাটকটি ‘অভিনেয় নয়’ বলেই পন্ডিতদের মতামত ছিল। এই নাটকের সংলাপগঠন এবং এর কাহিনির বাস্তবতা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক একে ‘রূপক’ শব্দটির আড়ালে আচ্ছাদিত রেখেছিল। সেই ‘রূপকে’র জাল ছিঁড়ে তাকে প্রাসঙ্গিক প্রমাণ করা খুব শক্ত কাজ ছিল। চার অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা অবশ্যই অভিনেতাদের উপলব্ধিতে শান দেওয়ার কাজ করেছিল। কিন্তু অতগুলি চরিত্রের প্রত্যেকের বাচনভঙ্গিতে কথোপকথনের সঠিক সুরটির প্রকাশ অবশ্যই নির্দেশকের এবং অভিনেতৃবর্গের সাধনাসঞ্জাত। (শম্ভু মিত্র : বিচিত্র জীবন পরিক্রমা, শাঁওলী মিত্র,  পৃ ৮১-৮২)

দেবব্রত বিশ্বাস ও রামকিঙ্কর বেইজ এবং বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি সংস্থার উদ্যোগে রক্তকরবী মঞ্চায়ন হলেও এসব ছিল প্রাণহীন স্ফূর্তহীন প্রযোজনা। যদিও ঐতিহাসিক দিক থেকে নিশ্চিতই এসব প্রযোজনা ভাবনার বৃত্তকে সম্প্রসারিত করেছিল। এ যে অভিনীত হতে পারে এবং এ-প্রযোজনাটি প্রতীক থেকে প্রাণময় রক্তমাংসের হয়ে উঠতে পারে – এ-কথা বোধকরি রবীন্দ্রনাথও ভাবেননি। এ-প্রসঙ্গে রামকিঙ্কর সম্পর্কে খালেদ চৌধুরীর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘গুরুদেব খবর পেলেন যে আমি রক্তকরবী করার চেষ্টা করছি। তিনি এলেন, এসে বললেন, কিঙ্কর তুমি নাকি রক্তকরবী করার চেষ্টা করছ? ওটা তো আমি পড়ার জন্য লিখেছিলাম; ওটা কি অভিনয় হবে? কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিনয়ের কথা ভাবেননি।’ তখন বিশু এবং নন্দিনীর অংশটা rehearsal হচ্ছিল। ‘দেখি কী করছ’, গুরুদেব বললেন। বিশু করছিল শান্তি (শান্তিদেব ঘোষ) আর নন্দিনী করছিল রাণু।’

আমরা ধরে নিয়েছিলাম রাণু মানে রাণু মুখার্জি। তাই ওনাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। বহুদিন পরে লেডি রাণু মুখার্জিকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আপনি করেছিলেন? উনি বললেন যে ওটা রাণু ঘোষ। যাই হোক কিঙ্করদা বলছেন যে, ‘গুরুদেব rehearsal দেখলেন। বিশু সম্বন্ধে একটাও কথা বললেন না। নন্দিনী সম্বন্ধে বললেন যে, ‘আমার নন্দিনী কিন্তু একদিকে যেমন উচ্ছল তেমনি কিন্তু গভীর। এর মধ্যে উচ্ছলতাটা আছে কিন্তু গভীরতাটা নেই।’

রামকিঙ্কর বেইজের এক জীবনীকারের সূত্র থেকে আমরা জানি, ১৯৫৭ সালেও একবার শান্তিনিকেতনে রক্তকরবী মঞ্চায়নের প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। তখন থেকে রক্তকরবীর বিশু পাগলার গান বেইজের কণ্ঠে পরম ভালোবাসায় দরাজ কণ্ঠে গীত হতো। বিশেষত রাত্রিবেলা বেইজ যখন এ-গান গাইতেন খোলা প্রান্তরে প্রাণের মমতা দিয়ে তখন তা এক মিশ্র আবেগ ছড়িয়ে দিত।

স্বয়ং শম্ভু মিত্র খালেদ চৌধুরীর উদ্ভাবনী শক্তির কথা সশ্রদ্ধ থেকেই উল্লেখ করেছেন তাঁর প্রসঙ্গ নাট্য গ্রন্থে (পৃ ১৫৬) লিখেছেন, ‘নাট্যের শুরু হয় একা নন্দিনীকে নিয়ে। সে মঞ্চের ওপর একটা চবুতরায় বসে ফুলের মালা গাঁথছে। এইখানে এমন একটা কিছুর দরকার হলো যাতে নাটকের একটা মানে প্রকাশ পায়। কল্পনা হলো যে এই যক্ষপুরীতে সুরকে খন্ডিত করে বেসুরের প্রতাপ। খালেদ চৌধুরী টিউনিং ফর্ক নিয়ে বেরুলেন পুরনো লোহালক্কড়ের দোকানে খোঁজ করতে। যোগাড় করলেন গোটাকতক ভাঙ্গা লোহার পাত। যেগুলো আলাদা পর্দায় বাজবে। সেই বাজানোর ছন্দে মাঝে মাঝে নাকাড়ার উপর ঝাঁটা মেরে, – কাঠের ওপর ঘা-মেরে একসঙ্গে একটা যন্ত্রের আওয়াজ তৈরি হলো। তারপর সেই বাজনাটা মেলানো হলো বাঁশির সঙ্গে। বাঁশির আওয়াজগুলো যেন ব্যবহৃত জীবনের উৎসারিত সুরের মতো, আর অপর আওয়াজগুলো যেন যান্ত্রিক জীবনের বেসুরত্ব। সে কেবলি বাঁশির আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠতে চায়।… এই রকম উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় শ্রীখালেদ চৌধুরী রক্তকরবীর পরতে পরতে দিয়েছেন।’ সত্যিই তাই। সর্দারণীরা ধ্বজা পুজোয় যাচ্ছে, রাজার এঁটোদের দৃশ্য, যথাক্রমে ‘কাট্ট-কুটুম’ আর ঘড়ঘড়ি যন্ত্র (এগুলো সবই তাপসের অনেক আলোর সরঞ্জামের মতোই – খালেদ সাহেবের উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল) আর মোটা লোহার শিকলের ঝনঝনি, আবার ‘বিশু পাগল, পাগল ভাই’ বলে নন্দিনীর সেই উচ্চগ্রামে ডাকের সঙ্গে চড়া পর্দায় বাঁশির ট্রিল (বাঁশি বাজাতো অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়) আর খালেদ সাহেবের হাতে বেহালার সুর নানা সময়ে নানান ব্যাপ্তি এনে দিত।

প্রাগুক্ত প্রবন্ধে শম্ভু মিত্র লিখেছেন, ‘নাট্যে শব্দের ব্যবহার কোথায় সাঙ্গীতিক হয়, সে সম্বন্ধে আমাদের অনুভবের ভিত্তি এক বলে শ্রীখালেদ চৌধুরীর এই অচলিত পদ্ধতি আমার কাছে সবচেয়ে উচিৎ পদ্ধতি বলে মনে হয়।’ আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে এই সম্পূর্ণ প্রযোজনাটির অনন্যতা ধরা থাকল না কোনো মাধ্যমেই।

রক্তকরবীর মঞ্চায়ন নিয়ে এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন খালেদ চৌধুরী। মহলা এবং শম্ভু মিত্রের সঙ্গে নাটকটির খুঁটিনাটি দেখে তিনি এই নাটকটির মঞ্চ ও আবহসংগীত সৃষ্টির জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করেন। এ-প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য – ‘রাজার ঘরের সামনে যে জাল ছিল – প্রথমে সেটা গগন ঠাকুরের অাঁকা রক্তকরবী বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে হুবহু অনুকরণ করে তৈরি করা হয়। পরে সেটা সম্পূর্ণ বদলে দিলাম। পরে দরজাটা উপর-নীচে হাঁ হয়ে খুলে যেত আর মকর মুখের চেহারাটা স্পষ্ট বেরিয়ে আসতো। রক্তকরবীতে যে সমস্ত এলিমেন্ট আছে – রাজা বা নন্দিনী যে সমস্ত কথাবার্তা বলে এই সমস্ত কিছু ওই দরজার কমপোজিশনে ধরা আছে। সুপার-ইমপোজ করা হয়েছে। চট করে দেখলে মনে হবে গগন ঠাকুরের ছবি, আসলে কিন্তু তা নয়।’ কীভাবে গগনেন্দ্রনাথের ছবি থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে বেসিক কোরিওগ্রাফি অপরিবর্তিত রেখে সিম্বলের চেহারা, তার রূপ বদলে গেছে সে-কথাও বলেছেন খালেদ। আগে খাড়া মতন দরজার ওপরটা তিনদিকে ঢালু করে দিয়ে বাংলাদেশের একটা কুঁড়েঘরের চেহারা দিয়েছিলেন। তার মাঝখানে ওপরে একটা উড়ন্ত বাজপাখির রিলিফ। সেই অনুপাতে ডানদিকের চত্বর এবং তার থামগুলোর উচ্চতায় হেরফের করে দিলেন। মনে করা যায়, এই বাজপাখি জর্মান প্রতীক হয়ে যাচ্ছে কিনা এই প্রশ্নের সংকোচ ভেঙে নন্দলাল বসু সোচ্চার কণ্ঠে জানিয়ে বলেছিলেন : ‘হোক না। শক্তির প্রতীক তো। আসলে লড়াই তো রাজার বিরুদ্ধে নন্দিনীর, মানে সায়েন্স ভার্সেস আর্ট – সায়েন্সের সঙ্গে আর্টের লড়াই। সত্যিকার বলতে গেলে তো ওই। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে শিল্পের লড়াই।’

প্রভাতকুমার দাসের একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, পোশাক ও আবহসংগীত পরিকল্পনা নিয়ে খালেদ চৌধুরীর ভাবনার কথা : ‘মঞ্চসজ্জা ও পোষাক পরিকল্পনার মতো, সংগীত ও আবহের ব্যবহারে নিজের অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন খালেদ চৌধুরী। অবশ্য প্রধানত শম্ভু মিত্রের প্ররোচনা ছিল। যাতে নতুন করে চিন্তা করা যায়। অর্থাৎ বাঁধাধরা ছকে না করে, অন্যভাবে করা যায়।’ বলেছিলেন : ‘ধরো, এই কারখানার শব্দ হচ্ছে। কিন্তু কারখানার মতো না করে যদি অন্যভাবে করা যায়।’ প্রচলিত যন্ত্র বলতে একটা ঢোল, বাঁশি, একটা উত্তরবঙ্গীয় দোতারা, আর অবশ্যই একটা বেহালা। খালেদ বলেছেন : ‘বেহালাটা ঠিক বেহালার মতো করে সবসময় আমি বাজাতাম না। কোনো কোনো জায়গায় বাজাতাম। আর বেশিরভাগ সময় যা বাজাতাম, তা হচ্ছে ইফেক্ট-মিউজিক। সেটা কক্ষনো রচিত ছিল না। এবং সবশেষে, যখন সবাই আসছে, লড়াই শুরু হয়ে গেছে, তখন একটিমাত্র ড্রাম বাজত। তাতে একটি সোজা চার মাত্রার তাল।’

রক্তকরবী নাটকটি গগনেন্দ্রনাথের সেই আলো-অন্ধকারের খেলায় সমৃদ্ধ ও অলংকৃত হয়ে বই হয়ে বের হয়েছিল ১৯২৬ সালে। প্রচ্ছদচিত্রটি ছিল মনোগ্রাহী। প্রথম সংস্করণে আরো ছিল গগনেন্দ্রনাথ-অঙ্কিত বেশ কিছু ছবি। তাঁর অলংকরণের গুণে এ হয়ে উঠেছিল অসাধারণ একটি গ্রন্থ। নানাজনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, দীর্ঘদিন রক্তকরবী মঞ্চায়নের জন্য কেউ ভাবেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও না। তাঁর সম্মুখে পাঠ করা হয়েছে রক্তকরবী। বিশু পাগলার গানে নন্দিনীর প্রতি ভালোবাসার টান অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

রক্তকরবীর মঞ্চায়ন শুধু রবীন্দ্রনাটকেই নয়, বাংলা নাটকেও নবীন মাত্রা সঞ্চার করেছিল। বহুরূপীর প্রযোজনাটি কতটুকু বিন্যাসে রাবীন্দ্রিক আর অর্থযোজনার দিক থেকে কতটুকু রবীন্দ্রানুসারী, এ নিয়ে এক সাংস্কৃতিক ঝড়ই বয়ে গিয়েছিল, কত রকমের সমালোচনাই না হয়েছে পক্ষে আর বিপক্ষে যদিও আজ ষাট বছর বাদে এই তর্কে আমরা এক সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের অনুষঙ্গকে প্রত্যক্ষ করি।

বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, গোপাল হালদার, উৎপল দত্ত আর অন্নদাশঙ্কর রায় এই তর্কে অংশ নিয়েছিলেন এবং এঁদের মধ্যে কয়েকজন শম্ভুর প্রযোজনার পক্ষে না দাঁড়ালে রক্তকরবীর মঞ্চায়ন সম্ভবই হতো না।

বিরোধিতা এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তার সরকারের সমালোচনা করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই প্রযোজনা – এ-কথা দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল। এতে বহুরূপী গোষ্ঠী বিমূঢ় বোধ করলেও এর মঞ্চায়ন থেকে সরে আসেনি। বরং দিল্লিতে মঞ্চায়নকালে জওহরলাল নেহরু সংসদ অধিবেশন থেকে ছুটে এসেছিলেন বহুরূপীর রক্তকরবী দেখতে। তিনি শুধু পছন্দই করেননি, রীতিমতো প্রীতিবোধ করেছেন। বহুরূপীর এই দিল্লি বিজয়ের পর অব্যাহত ধারায় ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত এর অভিনয় হয়েছে। কলকাতা তো বটেই, দিল্লি, মুম্বাই, এলাহাবাদ এবং বিদেশ থেকে সুনাম কুড়িয়েছিল।

আজ ষাট বছর বাদে ভাবতে ভালো লাগে যে, রক্তকরবীতে যে গুণীজনের সমাবেশ হয়েছিল তাঁরাই পরবর্তীকালে বাংলা নাট্যমঞ্চকে কতভাবেই না সমৃদ্ধ করেছেন, যা নিয়ে আজ গবেষণা চলছে।

রক্তকরবী গ্রন্থ হয়ে প্রকাশিত হওয়ার ২৮ বছর পরে ১৯৫৪ সালের ১০ মে বহুরূপীর প্রযোজনায় এবং শম্ভু মিত্রের পরিচালনায়, খালেদ চৌধুরীর মঞ্চ, সংগীত ও পোশাকে সমৃদ্ধ হয়ে ও তাপস সেনের আলোকসম্পাতে সমৃদ্ধ হয়ে মঞ্চস্থ হলো ইবিআর ম্যানসন ইনস্টিটিউট প্রেক্ষাগৃহে। তখন স্বাভাবিকভাবেই এর মঞ্চায়নের বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।

দেবব্রত বিশ্বাস ও রামকিঙ্কর বেইজের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে রক্তকরবী আগে মঞ্চস্থ হয়েছিল। কিন্তু তাতে প্রাণের আবেগ ছিল না স্ফূর্ত। বহুরূপীর প্রযোজনায় রক্তকরবী মঞ্চস্থ হওয়ায় রবীন্দ্রনাটক যে বহুমাত্রায় ঋদ্ধ তা উন্মোচিত হয়েছিল। দশকের পর দশক বাংলা মঞ্চনাটকে প্রাণ সঞ্চার করেছে রক্তকরবী।

যদিও রক্তকরবী নাটকের মর্ম ও চেতনার ব্যাখ্যা নিয়ে, নন্দিনী চরিত্রের মধ্যে যে উচ্ছলতা, প্রাণময়তা তা নিয়ে হাস্যকর কথা প্রচারিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি, শম্ভু মিত্র নাট্য-মঞ্চায়নকালে যা ভাবেননি – তা প্রচারিত হয়েছিল। বহুরূপীর অব্যাহত প্রযোজনা এই সরল ও একরৈখিক অপব্যাখ্যার উত্তর দিয়েছিল প্রযোজনায় জীবনঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ যুক্ত করে। শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, প্রতীক থেকে রক্তে-মাংসে।

এ-প্রসঙ্গে কুমার রায়ের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে এই মঞ্চায়ন নিয়ে কতটা বিরূপতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তিনি বলছেন, ‘রক্তকরবী প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ এক নতুন ঘটনার কথাটা এইবেলা বলে নেওয়া যাক। সেটি আমাদের প্রযোজনা সম্পর্কে নয়, বরং বলা ভালো, প্রযোজনা বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ। সে উদ্যোক্তা ছিলেন সে সময়ে রবীন্দ্র ঘটনার তত্ত্বাবধায়কদের পক্ষ থেকে। মনে আছে, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৪, নিউ এম্পায়ার মঞ্চে সকাল ১০টার অভিনয়ের আসর ১২টায় শেষ হওয়ার পর দর্শক অভিবাদন পর্বে আমাদের সভাপতি গঙ্গাপদ বসু (তিনি অধ্যাপক করতেন) বললেন পূর্ণ প্রেক্ষাঘর দর্শকদের উদ্দেশ্যে যে, সম্ভবত আজকের এই অভিনয়ই রক্তকরবীর শেষ অভিনয় – কেননা বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির অছি পরিষদ আমাদের এ অভিনয়ের আর অনুমতি দেবেন না। সে চিঠি তখন আমরা পেয়ে গেছি। দর্শক প্রচন্ড  ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন মনে আছে। এর আগে তাঁরা মাত্র তিনটি অভিনয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর সেই অনুমোদিত তিনদিনের শেষদিন ছিল। ইতিমধ্যে তাঁরা দ্বিতীয় অভিনয়ের পর চিঠি দিয়ে ‘মূলের থেকে বিচ্যুতির অভিযোগ’ এনে তা জানিয়ে দিয়েছেন। তাই ঘোষণা। পরের একটি চিঠিতে তাঁরা শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দিলেন, তাও দিল্লি বিজয়ের পর।’

খালেদ চৌধুরীর স্মৃতি ও কয়েকটি প্রবন্ধ ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতীক্ষণ থেকে বই হয়ে বেরুল। অজানা অনেক তথ্যে ভরপুর এই বই। মঞ্চনাটকে কেমন করে তিনি সংশ্লিষ্ট হলেন, কেমন করে মঞ্চায়নের সূত্রে হয়ে উঠলেন বহুরূপী ও শম্ভু-তৃপ্তি মিত্রদের আপনজন ও আত্মজন সে-কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন তিনি থিয়েটারে শিল্পভাবনা গ্রন্থে। আগ্রহী পাঠকের জন্য এ হয়ে উঠল তৃপ্তিকর এক অভিজ্ঞতা। বাল্য ও কৈশোরের উন্মাতাল দিনগুলোর কথার সঙ্গে আছে তাঁর প্রিয় গ্রাম সুপ্রাকান্দার নানা স্মৃতি। নৌকাপূজা, ধামাইল নাচ আর নৌকাবাইচের স্রোত তরঙ্গ তাঁর শৈশব-কৈশোরের প্রত্যক্ষণকে কত গহনতাসন্ধানী করে যে তুলেছিল তার বর্ণনা আছে। এ-বর্ণনায় স্মৃতিকাতরতা বোধ উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও তাঁর জীবন ও মননে এর তাৎপর্য যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। যে-কোনো স্মৃতিচিত্রণে আমরা ব্যক্তিমানুষকে ও স্বরূপকে যেভাবে পাই খালেদ চৌধুরীর বর্ণনায় তা হয়ে উঠেছে আরো প্রাণময়, বৈচিত্র্যসন্ধানী এবং সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। আসামের গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে উঠে এসেছে এক মনোগ্রাহী সাংস্কৃতিক আবহ। সেইসঙ্গে প্রকৃতির উদার ঐশ্বর্য ও লোকসংগীত তাঁকে কীভাবে কখনো উন্মনা ও একাত্ম করেছিল তার বর্ণনা। এ-অঞ্চলের একটি গ্রামে – যেখানে নৌকাপূজা এক সমারোহ নিয়ে উঠেছে – নৌকা কেবল চলমান যান নয়, বিশালাকৃতির চারতলা সব নৌকা তৈরি হতো পুরাণকল্পের প্রতীক নিয়ে।

খালেদ চৌধুরী এই স্মৃতিকথায় তাঁর পার্শ্ববর্তী গ্রামে দেখা এই নৌকাপূজার কথা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীকালে এই নৌকাপূজার লোকায়তিক অনুষঙ্গ তাঁর শিল্পিত সত্তায় যে-প্রভাব ফেলেছিল স্মৃতিকথায় তার উল্লেখ আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। খালেদ চৌধুরীর বর্ণনায় – ‘আমার ছাত্রজীবনে আমি হঠাৎ জানতে পারলাম যে, আমাদের স্কুলের পাশে একটা গ্রাম, সেই গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু চাষী নৌকোপুজো করছে। ‘নৌকোপুজো’ কথাটা সেই প্রথম শুনলাম; কারণ সেই বয়সে নৌকোপুজো ব্যাপারটা কী আমি জানতাম না, আমার আশপাশের লোকেরাও জানত না। কাজেই লোকেরা ভিড় করত সেখানে গিয়ে। যথারীতি আমরাও স্কুল থেকে, অনেক সময় স্কুল পালিয়ে, অনেক সময় স্কুল ছুটি হলে, সোজা ওইখানে চলে যেতাম; বাড়িতে এসে মিথ্যা কথা বলতাম যে, স্কুলে আটকে রেখেছিল, দেরি হয়ে গেছে। উদ্দেশ্য ছিল, ওই গ্রামে গিয়ে একটা নতুন জিনিসের মুখোমুখি হওয়া। এমনি আমরা ঠাকুরের মূর্তি দেখেছি, দুর্গাপ্রতিমা দেখেছি, লক্ষ্মীপ্রতিমা দেখেছি (কালীপুজোটা আমাদের দেশে হতো না কখনো)। ফলে এই প্রতিমাগুলো খুব ‘কমন’ আমাদের কাছে। কিন্তু নৌকোপুজোর ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। গিয়ে দেখলাম, প্রায় চারতলা উঁচু একটা বিশাল বাড়ির মতো তৈরি করা হয়েছে – দুদিকে দুটো গলুইয়ের মতো বার করে দিয়েছে – এই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। টোটাল জিনিসটাকে যদি দাঁড় করানো যায় তাহলে একটা ছইওয়ালা নৌকোর মতো মনে হয়। জিনিসটা বিশাল। কমপক্ষে দেড়শো থেকে দুশো ফুট হবে। তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। সেই যে চারতলা উঁচু ‘বাড়ি’ সেটা তাক তাক করা। তার ওপর থেকে, একেবারে শুরুতে প্রেতের সারি। উলঙ্গ সমস্ত প্রেত, নানা ভঙ্গিতে; অর্থাৎ খাজুরাহোতে যেরকম উলঙ্গ মূর্তি থাকে, এইখানেও সেইরকম সব উলঙ্গ মূর্তি – এটা আমাদের কাছে দারুণ একটা কৌতূহলের বিষয়। তার নীচের ধাপেই বিভিন্ন অবতার। যেসব অবতারের নাম কোনোদিন জানতাম না – সেই সমস্ত অবতার – কূর্ম অবতার, বামন অবতার, বরুণ অবতার, অগ্নি ইত্যাদি, আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।’

শিল্পের সন্ধানে শিরোনামে শৈশবের আর একটি স্মৃতি অমোচনীয় হয়ে থাকে। তাঁর বর্ণনায় – ‘রণজিৎ সিংহের একটা বই বেরিয়েছে মাটির সুরের খোঁজে, তাতে আমার একটা অাঁকা ছবি আছে। ধামাইল নাচের। দেখবে, তাতে গোল হয়ে মেয়েরা নাচে; একজনের হাতে একটা বড় করতাল থাকে, সে-ই লিড করে। গানটা মূলত ত্রিমাত্রিক। যে-কোনো উৎসবে মেয়েরা এই নাচটা নাচে। সর্ব বর্ণের। অনেকের ধারণা, গুরুসদয় দত্তের বইতেও আছে, কায়স্থ-ব্রাহ্মণরা এগুলো করে না, কিন্তু গুরুসদয় দত্তের দিদি এই ধামাইল নাচের প্রবক্তা ছিলেন। ওইখানে কোথাও একটা ‘কনট্র্যাডিকশন’ রয়ে গেছে। সেটা তো আমার নিজের অভিজ্ঞতা, আমি নিজে দেখেছি। যাই হোক, সব ধর্মের সবাই ধামাইল নাচত তা আমি জানি, খালি মুসলমানদের নাচতে দেখিনি। মুসলমানরা আমাদের ঠিক পাশাপাশিই, কাছেই থাকত। খুব কাছে নয়, একটা আলাদা গ্রাম, যাতায়াত মোটেই ছিল না; কিন্তু তাদের কোনোদিন আমি নাচতে দেখিনি। নমঃশূদ্রদের মধ্যে এবং অন্যান্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ধামাইলের চল ছিল। আমাদের মামীমার বাড়িতে গেছি, তখন আমরা বেশ বড় হয়ে গেছি, আমাদের বলল, ‘যাও ওই প্রতিমা ভাসানে যাচ্ছে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।’ তখন একটা অনুমান করলাম যে একটা কিছু হচ্ছে, যার জন্যে আমাদের বার করে দিল। তখন আমি বড় হয়ে গেছি। এই পরিবেশে আমার বড় হওয়া।’

এই স্মৃতিচারণে ধামাইল নাচ সম্পর্কে তিনি অন্যত্র বলছেন, ‘কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি যে আমার দিদিমা এই নাচের একজন প্রবক্তা ছিলেন। আমার দিদিমা ছিলেন গুরুসদয় দত্তের বড়দি। ওই বয়সে তাঁকে আমি নাচতে দেখেছি, আমার ছোটবেলায় – তখন তো তাঁর যথেষ্ট বয়স, প্রায় তখন ষাটের কাছাকাছি বয়স হবে – তখন তাঁকে দেখে আমার এক মামীমা বলতেন যে, তিনি যখন নাচতেন তখন তাঁকে দেখে মনে হত ষোল বছরের মেয়ে। আমি নিজে তাঁর নাচ দেখেছি। সেই পরিবেশে শুধু তিনিই নন; আমাদের সমস্ত গ্রাম নমঃশূদ্র পরিবেষ্টিত; তাঁদের বাড়ির মেয়েরাও একই সঙ্গে নাচতেন। যে-কোনো উৎসবে অনুষ্ঠানে, যে-কোনো পার্বণে মেয়েরা আগে নাচত; বিয়ের সময়, বিজয়ার সময়, বাড়িতে পুরুষদের তো থাকতেই দিত না। সবাই ভাগো, বাচ্চাদের পর্যন্ত তাড়িয়ে দিত। উদ্দাম নাচ হত। সেই সময় আমরা বাচ্চা, কাজেই আমরা থাকতে পারতাম। ধামাইল নাচের সময় পুরুষদের বার করে দেওয়ার কারণ বোধ হয়, এরা নাচতে নাচতে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আমার মনে হয় যে, বিশেষ করে এই সময়টায়, অর্থাৎ বিজয়া দশমীতে রং-টং খেলে, কাদা মাখে – এই সমস্ত কিছু করে, তখন বোধ হয় ওরা অবিন্যস্ত হয়ে যায়, বিস্রস্ত হয়ে যায়। বোধ হয় সেই কারণেই ওরা বাড়ি থেকে পুরুষদের তাড়িয়ে দেয়। সেটা আমি আজকে বড় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম।’

আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে খালেদ চৌধুরীর সখ্য গড়ে উঠেছিল চল্লিশের দশকের মধ্য পর্যায়ে। কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়ন ও চিত্রশিল্পে উচ্চতর জ্ঞান আহরণ করবার বাসনা তাঁর ছিল। যদিও তাঁর এ-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম দিন পরিচয়ের পর থেকেই কামরুল হাসানের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন খালেদ চৌধুরী। এই বন্ধুত্ব কামরুল হাসানের মৃত্যুকাল অবধি অটুট ছিল। ১৯৪৮ সালে খালেদ চৌধুরী এই বন্ধুর সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার জন্য ঢাকায় আসেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কামরুল হাসান তাঁর পরম নির্ভরবন্ধু খালেদ চৌধুরীর কলকাতার পার্ক সার্কাস সংলগ্ন বেনিয়াপুকুর লেনের বাড়িতে ওঠেন।

উল্লিখিত এই বাড়িতেই আমি কামরুল হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।  সে-সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু ড্রইং ও তেলরঙে কাজ করেন। কলকাতায় বিড়লা অ্যাকাডেমিতে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের যে-প্রদর্শনী হয় তাতে কামরুল হাসান-অঙ্কিত পাঁচটি চিত্র ছিল। ১৭ জন প্রবাসী শিল্পীর মোট ৬৬টি কাজ প্রত্যক্ষণ করে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পানুরাগীরা মোহিত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। এই প্রদর্শনীটি ছিল নানা দিক থেকে খুবই তাৎপর্যময়।

এই সময়ে করা কামরুল হাসানের বেশ কয়েকটি চিত্র অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কলকাতায় আশ্রিত বাংলাদেশের যেসব শিল্পী ও শিল্পানুরাগী এই প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর কাজ। কামরুল হাসানের এইসব চিত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে খালেদ চৌধুরীর এই বাসভবন।

খালেদ চৌধুরী বাংলা নাটকের মঞ্চস্থাপত্যে ও প্রচ্ছদশিল্পে যে-অবদান রেখে গেছেন তা দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। লোকসংগীত নিয়ে গবেষণায় ব্যাপৃত হয়ে এর বিস্তৃত ও সুবিশাল ভান্ডার সম্পর্কে তিনি অবহিত হন। শুরু করেন লোকসংগীত সংগ্রহ। সেই সংগ্রহ খুবই ব্যাপক ও সমৃদ্ধ। গড়ে তোলেন ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ছিল লোকসংগীত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিকৃতি রোধ করা। এই শতাব্দীর প্রারম্ভে তিনি তাঁর লোকসংস্কৃতি ও সংগীতবিষয়ক যাবতীয় সংগ্রহ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রে দান করেন। এই সংগ্রহ ভবিষ্যতে সংস্কৃতিমনস্ক একটি বাঙালি সমাজ নির্মাণে বিরাট ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই। লোকসংগীত তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল জীবনাচরণ-জীবনচর্যার নানা দিক সমন্বয়ের প্রতিফলনে সমৃদ্ধ জীবন-অনুষঙ্গী এক ভুবন। লোকসংগীতের অন্তঃপ্রবাহে তিনি একটি জাতীয় সত্তার স্বরূপ অনুধাবন করতেন, যা ছিল তাঁর কাছে অনুধাবনযোগ্য। জীবিতকালে রাষ্ট্রপক্ষ এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মানিত করেছিল। কোনো সম্মান বা সংবর্ধনার প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি তা এড়িয়ে যেতেন। দুঃখ এবং কষ্ট পেয়েছিলেন বহুরূপীর বিভাজনে। শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের বিচ্ছেদে তাঁর মনঃকষ্টের অবধি ছিল না।