খেলাধুলা

ওয়াসি আহমেদ

 

ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে টিভি টক-শোর সুবাদে অধ্যাপক হাসান জামিল দেশখ্যাত সেলিব্রিটি বনে যাবেন এ তার নিজের কাছেই তেলেসমাতি কান্ড ছাড়া কী! বছরপাঁচেক আগে একটা টিভি চ্যানেল থেকে যখন প্রথমবার ডাক পান, তার দূরতম কল্পনায়ও ছিল না ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে।

প্রথমবার বলেই হয়তো সেবার খানিকটা গড়িমসি করে রাজি হয়েছিলেন। টক-শোর বিষয় ছিল সদ্য-ঘোষিত সে-বছরের বাজেট। হাসান জামিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান, ম্যাক্রো-ইকোনমিক্সের নানা বিষয়ে তার পড়াশোনা, গবেষণা। কিন্তু টক-শোতে অল্প সময়ে কী বলবেন, কতটা বোধগম্য করে বলতে পারবেন, আবার বেশি বোধগম্য করতে গিয়ে না সিরিয়াস বিষয়টার গুরুত্ব খুইয়ে ফেলেন – এসবই ছিল তার গড়িমসির কারণ।

বাস্তবে তিনি ভালোভাবেই উতরে গিয়েছিলেন। খটোমটো তত্ত্ব কপচাতে যাননি, বরং বাজেটে প্রস্তাবিত ডেভেলপমেন্ট এক্সপেনডিচারের কিছু গলদ নিয়ে প্রাঞ্জল আলোচনা করেছিলেন। অনুষ্ঠানটা তার স্ত্রী রেকর্ড করে রেখেছিলেন যাতে তিনি পরে খুঁটিয়ে দেখে নিজের যুক্তি-টুক্তি নিজেই যাচাই করতে পারেন। ক্লাসে দীর্ঘদিন পড়ানোর অভিজ্ঞতায় হাসান জামিল জানেন তিনি বলেন ভালো, তবে সেবার স্ত্রীর রেকর্ড করা অনুষ্ঠান দেখে ভেতরে ভেতরে চমকে গিয়েছিলেন – তিনি এত গুছিয়ে কথা বলেন!

টক শো-তে অধ্যাপক হাসান জামিলের হাজিরা দেওয়ার সেই শুরু। টিভিতে অনুষ্ঠানগুলো হয় বেশ রাতের দিকে। হাসান জামিলের আবার রাত বেশি না করে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস, তবে সকালে উঠে পড়েন ছ’টার মধ্যে। রাত জেগে টিভি চ্যানেলে গিয়ে কথা বলতে তাই তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তার ওপর তার বিষয় যেহেতু অর্থনীতি, যত ভালোই বলেন, লোকজন ঘুমটুম ফেলে তার কথা শুনবে বিশ্বাস হয়নি।

তারপরও কীভাবে যেন জড়িয়ে গেলেন। নানা চ্যানেল থেকে আমন্ত্রণ আসা শুরু করল। তখন তিনি ভাবলেন, শুধু অর্থনীতি নয়, বরং আর্থসামাজিক, এমনকি প্রয়োজনবোধে রাজনীতি প্রসঙ্গেও কথা বলবেন। এর পেছনে বড় কারণ দেশের মানুষ অর্থনীতি বোঝে না। সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত সব ক্রিয়াকর্ম যে অর্থনীতির চাকায় ঘোরে, এ-সত্য জানার পরও অর্থনীতির মামুলি নিয়মকানুনেরও ধার ধারে না। শিক্ষিত লোকজনও গবেটের মতো কথা বলে। বোঝার মধ্যে বোঝে রাজনীতি –  ভালোই বোঝে।

অল্পদিনেই নিজের পরিকল্পনামতো তিনি তার বিষয়-আশয়ের পরিধি বাড়াতে লাগলেন। সেইসঙ্গে অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, তিনি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। শো-শেষে রাত দেড়টা-দুটোয় ঘরে ফিরেও তেমন ক্লান্তি-টান্তি বোধ করছেন না। তার স্ত্রী আফরোজা, যিনি নিজেও শিক্ষকতা করেন একটা সরকারি কলেজে, এত বছরের মুখস্থ ঘুমকাতুরে স্বামীর কান্ডকারখানা দেখে দিনের পর দিন, মানে, রাতের পর রাত বিস্ময়ে হতবাক হতে থাকলেন।

হাসান জামিল নিজে বিষয়টা যেভাবে দেখেন, মানুষ তার কথা শোনে – রাত জেগে শোনে বলেই চ্যানেলগুলো তাকে হন্যে হয়ে খোঁজে। তিনি নিজে তো সেধে বলতে যান না। তার কদর বুঝেই তারা তাকে ডাকে। পঁয়ত্রিশ বছর বিশববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন বলতে গেলে সারা জীবন। ভালো ছাত্র ছিলেন, আমেরিকার মোটামুটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি করেছেন। বেশকিছু গবেষণা নিবন্ধ বিদেশে উঁচুদরের জার্নালে ছাপা হয়েছে। বিদেশ থেকে সেমিনার-কনফারেন্সেও মাঝেমধ্যে ডাক পান। ছাত্রদের তিনি প্রিয় শিক্ষক। সাফল্য হিসেবে এসব কম নয়। এতকিছু সত্ত্বেও এই ছোট দেশে তাকে কজনই-বা চেনে! ক্যাম্পাসের বাইরে তার কোনো পরিচিতি নেই। তার কাজকর্মের খোঁজ রাখে এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু গভীর রাতে না ঘুমিয়ে কথা বলা যে সবকিছুকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এ-খবর তার একদম জানা ছিল না।

হাসান জামিল বলতে গেলে তার গোটা শিক্ষকতা জীবন এক ধরনের নিস্পৃহতা নিয়েই পার করে এসেছেন। নিরিবিলিতে কাজকর্ম করেছেন। কাজ তো নিজের মনের খোরাক মেটাতে, তবে কেউ যদি কাজটাকে স্বীকার করে সেটা বাড়তি পাওনা – ব্যাপারটাকে তিনি এভাবেই দেখে এসেছেন। নিজেকে জাহির করার মানসিকতা থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছেন। তিনি যে প্রায়-নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি পেয়েছেন এ-খবরও তার পরিচিত অনেকের অজানা। নামের সঙ্গে ডিগ্রি ব্যবহার করেন না। এক সময় অবশ্য করতেন, তখন বয়স অল্প ছিল। নাম থেকে ডিগ্রির বাহাদুরি ছেঁটে ফেলার পেছনে একটা ঘটনা আছে, সেটা লজ্জাকর। অনেক বছর আগে একটা কনফারেন্সে জেনেভা গিয়েছিলেন। আংটাডের এলডিসিবিষয়ক বড়সড় কনফারেন্স। সারা দুনিয়া থেকে নামজাদা অর্থনীতিবিদদের জড়ো করা হয়েছিল। কনফারেন্সের আগের রাতে লম্বা-চওড়া প্রোগ্রাম ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে চোখে খটকা লাগল। মূল পেপারগুলো যাঁরা পড়বেন বা আলোচক প্যানেলে যাঁরা থাকবেন তাঁদের কারো নামের সঙ্গে ডিগ্রি বা পদবি-টদবি নেই, আছে তার মতো তৃতীয় বিশ্ব থেকে যোগ দেওয়া দু-তিনজনের নামের সঙ্গে। প্রিন্সটন থেকে আসা একজন অত্যন্ত নামি অর্থনীতিবিদ, হাসান জামিলের প্রবল ইচ্ছা সুযোগ পেলে একসঙ্গে ছবি তুলবেন, তাঁর নামেরও আগেপিছে কিছু নেই – মাত্র দুই শব্দের উদোম একটা এলেবেলে নাম। খটকা লাগলেও হাসান জামিল খুব যে অবাক হয়েছিলেন তা নয়। তিনি ভালো করেই জানেন এমন একটা কনফারেন্সে যারা অভ্যর্থনার কাজে নিয়োজিত থাকে, গণ্যমান্যদের গলায় ব্যাজ পরিয়ে পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট আসনে এগিয়ে নিয়ে যায়, সেসব খেদমতগারের অনেকেই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ-ডিধারী।

সেই ঘটনার পর থেকে তিনি শুধুই হাসান জামিল। প্রথমদিকে নামটাকে ন্যাংটো-ন্যাংটো লাগত। পরে এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছে, নামের সঙ্গে ডিগ্রি জুড়ে বাহাদুরি ফলানো গাঁড়লদেরই সাজে। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বা বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূসের নামের সঙ্গে ডক্টর শব্দটা ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।

সে যাক, টক-শোতে জড়িয়ে যখন গেলেন, হাসান জামিল নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলেন না। স্ত্রী আফরোজা যতই অবাক হচ্ছিলেন, হাসান জামিলকে যেন ততই নেশায় পেয়ে বসছিল। কদাচিৎ কোনো রাতে শো না থাকলে বিছানায় শুয়ে থাকাটাই যেন মহাযন্ত্রণার। শুয়ে যে আছেন তাও সবসময় খেয়াল থাকে না, মনে হয় কোনো চ্যানেলের সেটে জোড়া-জোড়া ঝলসানো ক্যামেরার মুখোমুখি অনর্গল কথা বলছেন। কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না, চিন্তাভাবনারও দরকার পড়ছে না, মুখ খোলামাত্র একের পর এক অনর্গল অকাট্য যুক্তি বেরিয়ে আসছে। অবশ্য এ-কথা ঠিক, কথা তাকেই বেশি বলতে হয়, অনুষ্ঠানের সঞ্চালকরা ঘটে বুদ্ধি রাখে, তারা ঘুরেফিরে তার কাছেই আসে। আর বাড়ির দর্শক-শ্রোতারা ফোনে লাইন পেলে তো কথাই নেই, তাদের যা জিজ্ঞাস্য সবই তার কাছে। কখনো কখনো খুবই অপ্রস্ত্তত লাগে, অন্য বক্তারা চুপচাপ বসে, কেউ হয়তো কিছু করার না পেয়ে জুতার পলিশ পরখ করছেন পা নাচিয়ে, কেউ টাইয়ের নট ঠিক করছেন, বা মুখ গোমড়া করে অযথাই হাতে ধরা কাগজপত্রে চোখ চালাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে খেপলেও করার কিছু নেই, লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে।

বছর দুয়েক যেতে না যেতে হাসান জামিল সেলিব্রিটি বনে গেলেন। গোড়ায় অস্বস্তিতে পড়তেন। যেখানেই যেতেন, লোকজন তাকে আড়চোখে দেখত। যারা কিছুটা সপ্রতিভ, এগিয়ে এসে আলাপ জমাতে চাইত। টিভিতে যত সাবলীলভাবেই কথাবার্তা বলেন,              রাস্তাঘাটে অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া তার পক্ষে কঠিন কাজ। আফরোজা তাকে টিপস দিতেন, ‘আগ্রহ করে  কথা বলতে চাচ্ছে, তুমিও কিছু বলো।’

‘কী বলব, আমি ওদের চিনি?

’তোমাকে চিনতে কে বলছে? ওরা তোমাকে চেনে, ব্যস।’

‘ব্যস! চেনা নেই জানা নেই, হুট করে গা-ঘেঁষে এসে কী খবর কেমন আছেন বলে সেলফি তুলতে লেগে গেল। নিশ্চয় ফেসবুকেও দেয়।’

‘এ-খবর তো বলোনি, সেলফি তুমি শিখলে কার কাছে? শুধু ছেলেরা, মানে পুরুষরা নিশ্চয় নয়, মেয়েরা-মহিলারা তোলে না? কপালে বড় টিপ পরা কিছুটা ইলশেপড বাট আহ্লাদি অ্যান্ড প্রিটি মহিলারা? এ হচ্ছে সেলিব্রিটি হওয়ার বিড়ম্বনা।’

‘ঠাট্টা করছো?’

‘মোটেও না, তুমি অস্বীকার করো তুমি সেলিব্রিটি নও?’

‘এবার সত্যি সত্যি ঠাট্টা করছো। টক শো সেলিব্রিটি!’

‘সেলিব্রিটি সেলিব্রিটিই। টক-শো করো আর নেচেকুঁদে হেড়ে গলায় গানের নামে চেঁচাও। তুমি হিট করে গেছো, জনতার কাছে পৌঁছে গেছো। এখন তোমার কাজ নিজের ইমেজ ধরে রাখা। অচেনা কেউ – হোক সুন্দরী মহিলা, আমি মাইন্ড করবো না – তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, তুমিও কথা বলবে। কেমন আছেন, ভালো আছেন বলতে তো  অসুবিধা নাই।’

‘মনে হচ্ছে, রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে টিপস দিচ্ছো।’

‘করতে হয়। আমি একজন সেলিব্রিটির ওয়াইফ না!’

তো সেলিব্রিটি হওয়ার পয়লা ধাক্কাটা খেয়েছিলেন বাসার কাছে এক নাপিতের দোকানে। মাঝেসাজে চুল কাটতে ওখানে আগেও অনেকবার গেছেন। চুল যারা কাটে, নাপিত বা হেয়ারড্রেসার যা-ই বলা হোক, তারা ফ্রি থাকলে দেরি হয়নি, তবে কখনো কখনো বসে বসে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেদিন তিনি ঢোকামাত্র কী যেন ঘটে গেল। ছুটির দিনেই বেশিরভাগ লোক চুল কাটে। দিনটা ছিল ছুটির, দোকানে মোটামুটি ভিড়, কয়েকজন রেক্সিনের টানা সোফায় বসে আপেক্ষায় ছিল। তিনি ঢুকতেই বসা থেকে তারা সটান দাঁড়িয়ে গেল, যেন তার অপেক্ষায়ই ছিল। সালাম-টালাম চলল, সঙ্গে কেমন আছেন, ভালো আছেন এসব তো বটেই। একজন আবার আগের রাতের শো-এর বিষয় নিয়ে তড়বড় করে কথা শুরু করে দিলো। এমন সময় অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটল। স্মরণীয় হিসেবে এটাকে  হাসান জামিলের উচিত মনের মণিকোঠায় তুলে রাখা। একজন, তারই বয়সী হবে, সবে একগাল দাড়ি কামানো হয়েছে, চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে ফোম-মাখানো অন্য গাল টিস্যুপেপারে ঘষতে ঘষতে তাকে তার সদ্য-খালি চেয়ারটার দখল নিতে অনুরোধ করল। অনুরোধ বললে ভুল বলা হবে, পীড়াপীড়ি শুরু করল। হাসান জামিল কিছুতেই বসবেন না, এদিকে লোকটাও নাছোড়। কী করেন, শেষমেশ লজ্জার মাথা খেয়ে বসতে হলো।

ঘটনাটা বলি বলি করেও আফরোজাকে বলা হয়নি। সেই থেকে পারতপক্ষে তিনি জনসমাগম এড়িয়ে চলতেন। তবে সামাজিকতার কারণে কিছু কিছু জায়গায় না গিয়ে উপায় থাকত না। তখন মুশকিলেই পড়তেন। ক্যাম্পাসে অসুবিধা হতো না, ছেলেমেয়েরা আশেপাশে প্রতিদিনই টক শো-ওয়ালাদের দেখে অভ্যস্ত। যদিও এটুকু টের পেতেন, তার প্রতি তাদের সম্ভ্রমবোধ গড়পড়তা মানের ওপরে। আবার এও ঠিক, ক্লাসে যখন পড়ান, যত্ন করে কোনো বিষয় বোঝাতে যান, তিনি বুঝতে পারেন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইদানীং তার তেমন যোগাযোগ গড়ে উঠছে না। আই কনটেক্ট বলে যে-ব্যাপারটা তা প্রায় ঘটেই না। এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার মনে হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের চেয়ে তাকে টক-শোতে বেশি পছন্দ করে।

রাস্তাঘাটে হঠাৎ হঠাৎ অপ্রস্ত্তত হয়ে পড়লেও আফরোজা এক সময় লক্ষ করলেন হাসান জামিল নিজের সেলিব্রিটি পরিচিতিটাকে উপভোগ করতে শুরু করেছেন। নেশাটা এখন আর কেবল এক টিভি চ্যানেল থেকে অন্য টিভি চ্যানেলে ছোটাছুটি বা বকবকের মধ্যে আটকে নেই। শুরুতে তাই ছিল। ইদানীং তিনি খেয়াল করছেন, একসঙ্গে কোথাও বেরুলে হাসান জামিল যেন তার দিকে মানুষজনের কৌতূহলের মাত্রা জরিপ করেন। মুখে কিছু বলেন না, তবে ভেতরে ভেতরে যেন অপেক্ষায় থাকেন লোকজন এগিয়ে এসে যেচে কথা বলুক। আগে বাসায় তার কথাবার্তার বেশিরভাগই জুড়ে থাকত ক্লাস, ছাত্রছাত্রী,  বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্স। প্রাত্যহিক রুটিনও ছিল অন্যরকম। রাত জাগার অভ্যাস ছিল না বলে উঠে পড়তেন বেশ ভোরে, শীতকালে তো আলো না ফুটতেই নিজের চা নিজেই বানিয়ে ঢুকতেন পড়ার ঘরে। সকালের দিকে ক্লাস না থাকলে, এক ফাঁকে নাস্তা খাওয়া ও খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে পড়ার ঘরেই তার কাটত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা অবধি। সেই রুটিন এখন পুরোপুরি বাতিল। বেলা করে উঠেন, সকালে ক্লাস নেন না, দশটা নাগাদ বিছানা ছেড়ে খবরের কাগজ নিয়ে পড়ে থাকেন অন্তত ঘণ্টাদুয়েক। দুপুরের দিকে ক্লাস নিয়ে ফের সেই খবরের কাগজেই ডুব। আসলে তো খবর পড়া না, রাতের টক-শোর রসদ যোগাড় করা।

গোড়ার দিকে আফরোজা অবাক হয়ে ক্ষান্ত ছিলেন। তারপর বেশকিছু দিন গেছে স্বামীর সাফল্য বা পরিচিতিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। কিন্তু ইদানীং তিনি বিরক্ত  হয়ে পড়ছেন। টক-শোতে নেমে হাসান জামিল বুঝি নিজের খোলনলচে পাল্টে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এতদিনের নিস্পৃহতা থেকেও কি মুক্তি খুঁজছেন? সারা জীবনের গোপন খেদ, যার খবর তিনি নিজেই রাখেননি, হঠাৎ করে যেন তেড়েফুঁড়ে উঠেছে। তিনি কী স্বীকৃতির জন্য খুব লালায়িত ছিলেন? কই, আফরোজা এতদিন একসঙ্গে থেকেও তো টের পাননি। বরাবর তার মধ্যে এক ধরনের মগ্নতাই দেখেছেন, যাকে হয়তো দার্শনিকতাও বলা যেতে পারে। আর এখন যা শুরু হয়েছে, এ তো কাঙালপনা।

প্রসঙ্গটা তোলা দরকার ভেবে একদিন ফাঁক বুঝে আফরোজা কিছুটা হালকা চালে এগোলেন, ‘তোমার বইপত্র তো পোকায় খাচ্ছে।’

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। হাসান জামিলের না বোঝার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন না। মুখ থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে যেন সত্যি সত্যি পোকায় খাওয়া থেকে বইপত্র রক্ষার মোক্ষম উপায় হিসেবে বললেন, ‘নেড়েচেড়ে রোদ খাওয়াতে হবে।’

বলে মিষ্টি করে হাসলেন। স্ত্রীর কথার জবাবে যে ঠাট্টা করছেন এটা বোঝাতেই হাসিটা। সেলিব্রিটির মেকি হাসি। আফরোজার অসহ্য লাগল। বললেন, ‘নিজেরা কষ্ট করে রোদ খাওয়ানোর দরকার কী? দান করে দাও, বেচে দিলেও পারো। একটা গোটা ঘর দখল করে আছে।’

আঘাতটা শক্ত বুঝে আফরোজা আর কথা বাড়ালেন না। সারাজীবন তো মানুষটা বই-ই জোগাড় করেছেন, আর কী যত্ন বইয়ের! কিন্তু বই নিয়ে শেষ কবে তাকে মশগুল হতে দেখেছেন মনে পড়ছে না। কম্পিউটারে বসছেন – ই-মেইল করতে নয়তো টুইটারে কোনো বিষয়ে নিজের মতামত ছড়িয়ে দিতে, রিসার্চ পেপার লিখতে নয়। নিজে আফরোজা কেন যে এ নিয়ে ভুগছেন, এর কোনো ব্যাখ্যা তার জানা নেই। হতে কি পারে, সারা জীবন একজন মানুষকে যেভাবে দেখে আসছেন তাকে সেভাবেই দেখতে চান? কিন্তু এর পেছনে তো জোরালো কোনো যুক্তি নেই। হাসান জামিল চুরি-ডাকাতি করছেন না কিংবা সেলিব্রিটি হওয়ার বদৌলতে এ-বয়সে কোনো এডমায়ারার প্রেমিকাও জুটিয়ে নেননি। চাইলে তো কোনো ব্যাপারই না। যথেষ্ট সুদর্শন ও ডিগনিফাইড এই সেলিব্রিটির সঙ্গ পেতে মেয়েদের আগ্রহ কতদূর যেতে পারে এ-খবর তিনি নিজে মেয়ে হয়ে জানবেন না তো কে জানবে!

বেশ কিছুক্ষণ সাড়াশব্দ না করে হাসান জামিল একটা চাপা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘বইপত্র আর লেখালেখি নিয়েই তো কাটালাম। এবার একটু রিল্যাক্স করি।’

‘তুমি যা করছো একে রিল্যাক্স করা বলে না।’

‘তুমি নিজেই না এক সময় খুব ইন্সপায়ার করতে!’

‘তখন কী জানতাম তুমি অ্যাডিক্ট হয়ে পড়বে!’

আফরোজা ভাবলেন হাসান জামিল তর্ক করবেন। কিন্তু তাকে চুপ থাকতে দেখে অবাক হলেন, যেন অস্বীকার করছেন না তিনি অ্যাডিক্ট।

প্রসঙ্গটাকে হালকা করতে বা হতে পারে একজন পাড় অ্যাডিক্টকে রিহেবিলিটেশন সেন্টারে যেমন ধীরে ধীরে উইথড্রয়াল পন্থায় চিকিৎসা দেওয়া হয়, অনেকটা সে-নিয়মের অনুকরণে আফরোজা বললেন, ‘মাঝেসাজে যেও, মাসে-দুমাসে একবার।’

এ-কথায়ও হাসান জামিল সাড়া দিলেন না। মলিন একটা হাসির রেখা ঠোঁটে উঁকি দিয়ে হারিয়ে গেল। হাসিটা আফরোজার চেনা, যদিও বহুদিন এর দেখা পাননি। কিন্তু চুপ থাকার ভঙ্গিটাকে অচেনা ঠেকল, ঠিক মেলাতে পারলেন না।

পারলেন বিকেলের দিকে, যখন শুনলেন হাসান জামিল সে-রাতে দুটো চ্যানেলের শো-তে যেতে পারবেন না বলে ফোনে কথা বলছেন। আড়ি পেতে যা অাঁচ করলেন, ওপাশ থেকে অনুনয়-বিনয় চলছে। হাসান জামিল কারণ হিসেবে বলছেন স্ত্রী অসুস্থ, কিছুতেই পারবেন না। শক্তভাবেই বলছেন।

ঘরের পরিস্থিতি সন্ধ্যার পর থেকে বেশ থমথমে। নিজের ইচ্ছায় নয়, আফরোজার  কথার প্রতিক্রিয়ায় ঝাল ঝাড়তেই যে হাসান জামিল শো-তে যাচ্ছেন না এ তো পরিষ্কার। তাও আফরোজাকে অসুস্থ বানিয়ে। যেন ঝাল ঝাড়ার জন্য আফরোজার অসুস্থতাটুকু তার কাম্য। আফরোজা ঠিক করলেন, এ নিয়ে একটা মোকাবিলা প্রয়োজন।

প্রসঙ্গটা তুলতে হাসান জামিল তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলো না। আফরোজা সহজে ছাড়লেন না, ‘প্রোগ্রামটা তো তোমার সঙ্গে আগে আলাপ করেই ওরা ঠিক করেছে। নিজে শিডিউল দিয়ে দুম করে বাতিল করে ওদের ঝামেলায় ফেললে।’

হাসান জামিল শুনেও শুনছেন না এমনভাবে বললেন, ‘এটা ওদের জন্য সমস্যা না। যে কাউকে ধরে আনবে।’

‘কোত্থেকে?’

‘ওরা জানে।’

‘যে কাউকে!’

‘টিভিতে কথা বলার লোকের অভাব!’

আফরোজা দেখলেন স্বামীর গলায় বিরক্তি। নিজে সিডিউল দিয়ে বাতিল করেছেন এ নিয়ে অপরাধবোধ তো নেই-ই, বরং যাকে-তাকে দিয়ে প্রোগ্রাম সেরে ফেলা হবে, এও তার কাছে মামুলি ব্যাপার। সেলিব্রিটি হলে কী অনেক কিছুই হালকাভাবে নেওয়ার প্রবণতা চলে আসে, বিশেষ করে অন্যের অসুবিধা-সমস্যার বিষয়-আশয়ে? লোকটাকে আফরোজার অচেনা ঠেকছে। আর মিথ্যাটা?

সুযোগটা আফরোজা নিলেন, ‘তুমি শিডিউল ক্যানসেল করেছো – তোমার ব্যাপার, কিন্তু মিথ্যাটা কেন বললে? আমার অসুস্থতাটা কী শুনি?’

হাসান জামিল ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকালেন। ফোনে কথা বলার সময় স্ত্রী তার কথা শুনেছেন ধারণায় ছিল না। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নিলেন, ‘স্ত্রী অসুস্থ এটা প্রিটেকস্ট হিসেবে সবচেয়ে ইফেকটিভ, এর ওপরে কথা চলে না।’

‘কী অসুখ?’

আফরোজা বুঝতে পারছেন তিনি যেভাবে এগোচ্ছেন তা খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে দমাতে পারছেন না।

‘শুনি কী অসুখ? মরণাপন্ন তো বটেই, না হলে টক-শো ক্যানসেল করো! তোমার কথা শুনবে আশায় কত মানুষ রাত জেগে বসে থাকবে। বলো তো আমার কী অসুখ হলে তুমি সব সিডিউল ক্যানসেল করে দেবে। খুব জানতে ইচ্ছা করছে।’

‘তোমার ফাজলামো ভালো লাগছে না।’

ফাজলামো করুন আর যা-ই করুন, এক সুযোগে কথাগুলো বলতে পেরেছেন ভেবে আফরোজা এক ধরনের তৃপ্তি নিয়ে শুতে গেলেন। বিছানায় উশখুশ করলেন অনেকক্ষণ, ঘুম এলো না। চোখ বুজে নিস্তেজ শুয়ে শুয়ে মাথাকে যতটাসম্ভব হালকা করতে চেষ্টা করলেন। লাভ হলো না। পাশে হাসান জামিলও যে জেগে টের পাচ্ছেন। এক সময় আফরোজা নিজেই উদ্যোগী হলেন, পাশ ফিরে শোয়া হাসান জামিলের কাঁধে আলতো হাত রেখে বললেন, ‘খারাপ লাগছে?’

হাসান জামিল সাড়া দিলেন না, তবে ঘুমিয়ে যে নেই তার প্রমাণস্বরূপ এক হাত দিয়ে অন্য হাতের কনুই চুলকালেন। আফরোজা নিজের হাতটা তেমনি রেখে ভাবলেন এ-সময় আর খোঁচাখুঁচি করবেন না। কিন্তু তাকে অবাক করে হাসান জামিল বালিশ থেকে মাথা তুললেন, শুধু মাথাই না, ঘাড়-পিঠসহ গোটা শরীরেই মৃদু ঝাঁকুনি তুলে উঠে বসলেন। সাইড টেবিল থেকে চশমাটা হাতড়ে নাকে চড়ালেন, তারপর আস্তেধীরে অন্ধকারে সামান্যতম বিশৃঙ্খলা না ঘটিয়ে খাটের মাথার ডানপাশে সুইচ বেডের দ্বিতীয় সুইচটা টিপে বাতি জাবলালেন।

আফরোজা আন্দাজ করতে পারছেন না এত বছরের মুখস্ত হাসান জামিল কী করতে যাচ্ছেন। আন্দাজের সুযোগ না দিয়ে হাসান জামিল তার দিকে ঘুরে বসতে তাকেও উঠে বসতে হলো। মুখোমুখি তাকিয়ে খানিকটা যেন ধাক্কা খেলেন। পরনে লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি, কাঁচাপাকা উস্কোখুস্কো চুল, নিস্তেজ দৃষ্টি। গত পাঁচ বছর ধরে প্রায় রাতেই এ-সময় তিনি ধোপদুরস্ত থাকেন, আর ঝকমকে আলোয় তার উজ্জ্বল চোখ-মুখ বাড়তি আলো ছড়ায়। দেশের মানুষ দেখে। দেখে হয়তো আশ মেটে না, শুনতে গিয়ে আরো। এখনকার এ-অবস্থায় কেউ তাকে ভাবতেও পারবে না। কিন্তু উঠে যখন বসেছেন, আয়োজন করেই বসেছেন, উদ্দেশ্য নিশ্চয় কিছু একটা আছে। হয়তো কিছু বলবেন, রাতে এ-সময় তো কথাই বলেন।

আন্দাজটা এবার আফরোজার খাটল, যখন দেখলেন হাসান জামিল মুখ খুলছেন। কিন্তু কাকে বলছেন? মুখটা তো আফরোজার দিকে নেই, বরং নিজেকে নিজে শোনাচ্ছেন এমনভাবে বললেন, ‘স্ট্র্যাটিফিকেশন অফ ইমার্জিং মিডলক্লাস’ বইটা অনেক খেটেখুটে লিখেছিলাম। চার বছরের বেশি সময় লেগেছিল। সার্ভেই করেছিলাম প্রায় দুই বছর ধরে। বইপত্র তো আগেও লিখেছি, কিন্তু এটা লেখার সময় মনে হচ্ছিল আমি সম্পূর্ণ তৈরি। এতটা কনফিডেন্ট নিজেকে আগে কখনো মনে হয়নি। আশা ছিল বইটা অন্তত কিছু মানুষের নজরে পড়বে। অনেক দিনের চিন্তাভাবনা ছিল বইটায়।’

হাসান জামিল থামলেন। এইটুকু বলে তার ক্লান্ত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাকে ক্লান্ত দেখাল, চোখের দৃষ্টি নিভু-নিভু। নিভু-নিভু চোখ দুটো এবার সোজা আফরোজার মুখে ফেলে বললেন, ‘আমার পরিশ্রম কারো কাজে আসেনি। যাদের নিয়ে আশা ছিল পড়বে, তারাও খুলে দেখার গরজ করেনি। দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি, কিছু ফিডব্যাক অন্তত পাবো। আমার এক ছাত্র আবোলতাবোল প্রশংসা করে একটা রিভিউ ছেপেছিল পত্রিকায়, সেটা আমাকে খুশি করতে। বইটা না লিখলেই পারতাম, লিখে নিজেকে ধ্বংস করলাম।’

আফরোজা বুঝে উঠতে পারছেন না কী বলা উচিত। বইটা লেখার সময়, বিশেষ করে যখন এডিট করছিলেন, হাসান জামিল যে ভীষণ উজ্জীবিত থাকতেন এ তো তার নিজের চোখে দেখা। কিন্তু বইটার কারণে যে তার এত গভীর হতাশা তা তো টের পাননি। মুখ ফুটে কিছু বলেননি বা তার আচরণেও তেমন কিছু ধরা পড়েনি। না-কি পড়েছিল, আফরোজা ধরতে পারেননি?

‘একটা ফিডব্যাকও না … ’

ছোট, অসম্পূর্ণ বাক্যটা বলতে গিয়ে যেন অনেক পরিশ্রম করলেন হাসান জামিল।

কিন্তু পরমুহূর্তে বলার ভঙ্গি বদলে, ফেললেন, ‘আর এখন … ’

অসমাপ্ত কথাটা উহ্য রেখে নিভু-নিভু চোখেই কী করে যেন আলো ফোটালেন। আফরোজা প্রথমে ভাবলেন আলোই, পরপরই দেখলেন অন্য কিছু – আলো নয়, জেদ কি?

‘এখন কী বলি না বলি, মনেও থাকে না, ফিডব্যাকের জ্বালায় অস্থির হয়ে থাকি।’

আফরোজা আশ্চর্য হলেন বলার ভঙ্গিতে। তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির লেশমাত্র নেই। এমনও মনে হলো এও এক ধরনের হতাশা। ভাবলেন কিছু বলেন, কিন্তু কী বলবেন? মানুষ বই খায় না, কথা খায়                   এমন মামুলি কিছু বলে হাসান জামিলকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়ার              মানে হয় না।

মাঝরাতে পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে উঠবে আফরোজা মোটেও ভাবেননি। তিনি তো অনেক সোজাসাপটা হিসাব করেছিলেন। কিন্তু জেদ মিটিয়ে, রাতের পর রাত স্রেফ বকবকানির সুবাদে দেশখ্যাত হাসান জামিল ঘুম হারাম করে নিজের সারা জীবনের অপ্রাপ্তির শোধ তুলছেন এ কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? সেলিব্রিটি পরিচিতি উপভোগ করছেন বটে, তবে নিজেকে নিয়ে এক জটিল ঠাট্টার খেলায় মেতে থেকে। ঠাট্টা! সেজন্যই এ-থেকে বেরোতে পারছেন না? সন্ধ্যা হতে না হতেই খেলার নেশাটা ঝুলোঝুলি জুড়ে দেয়। হাসান জামিল খেলেন পাকা খেলোয়াড়ের মতো। কেউ জানে না খেলাটা তার একার?