খোয়াবনামার কবিতাগুচ্ছ

ইমরুল চৌধুরী

চার
দোষ তো আমার নয় খানিক দোষ কপালের
কপাল-ফেরে আমি আবার
অগস্ত্যযাত্রার সাড়ে তিন কোটি বছর পর
সৌরলোকের  দূরতম গ্রহ থেকে
ছিটকে পড়েছি লোকারণ্যের এই দুষ্টু গ্রহে
শরণার্থী উদ্বাস্তু শিবিরে আমার আশ্রয়
যেখানে বৌদ্ধ-মুসলমান ধর্মে ধর্মে যুদ্ধ বিচিত্র কিছু নয়
আমরা যে যার রঙের পেনসিলে এঁকেছি মানচিত্র
মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে কোপার্নিকাস গ্যালিলিও বিদ্যাসাগর
সভ্যতার কথা বলে বেড়াচ্ছেন ইতিহাসবিদ
ছেলেবেলায় মা আমাদের কৃষ্ণকায় ছাগলের
কাঁচা দুধ খাওয়াতেন
চিন্তাবিদ হবো ইতিহাসের নায়ক হবো, লিখবো
বানরের লেজ খসে পড়লে মানুষ হয় না
এ কথা মা জানতেন না

আমরা সভ্যতা চুরি করে যাত্রা করেছিলাম কার্থেজ থেকে
সঙ্গে গোটাকয়েক হাতি পাউরুটি শুকনো খাবার
ব্যস ওই যথেষ্ট
রোম নগরী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করেছি
একদা পিরামিডে লুকিয়ে রেখেছিলাম আগ্নেয়াস্ত্র
তার ব্যবহার কেউ জানতো না বলে
অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছে সভ্যতা
মৃত্যুর আড়াই কোটি বছর পর
সক্রেটিস স্বেচ্ছায় ‘হ্যামলক’ পান করেছেন
এখন আর বিশ্বাস হয় না
আর এই সভ্যতা নকল করে
আমাদের নারীকর্মীরা পোশাক না বানালে
নাঙ্গাই থাকতো সাদা মার্কিনিরা
হাক্সলির ‘রুটস’ উপন্যাসের এই নিহিত কাহিনি
কারো জানা ছিল না
‘টুইন-টাওয়ার’ ভেদ করে যে উড়োজাহাজ
রওনা হয়েছিল অগস্ত্যযাত্রায়
মর্ত্যলোকে তার ফেরা হয়নি

পাঁচ
ঘরকুনো মানুষের যা স্বভাব, ঘরে ফেরা
রাত্রিযাপনের ওলট-পালট আলখেল্লা জড়িয়ে
বেহদ্দ মাতাল আমি অহোরাত্র যখন ঘরে ফিরি কী আশ্চর্য
বেহুলা সুন্দরীর মতো আমার সন্তানের যিনি গর্ভধারিণী
তিনি নন, না-না তিনি নন
আমার কবিতা, হ্যাঁ আমার কবিতার পঙ্ক্তিমালা
ঝুপঝাপ করে কাঁসর বাজিয়ে
কী এক তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটিয়ে বসে
যেন পিঁপড়ের পায়ে লক্ষাধিক রিনিকিঝিনি নূপুর
অজান্তে ঘরের ভিতর পুষছি গুপ্তঘাতক না কি কবিতা
এসব তো আমার ঘরে ফেরা না-ফেরার কেচ্ছা-কাহিনি
এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য নয়
বিতর্ক তো সেখানে
যখন তোমাকে নিয়ে খুনসুটিভরা
অসাধারণ কোনো বিকেল কেটে যায় কবিতামাখা দুষ্টুমি নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াই
চমকে যাই কবিতার নগ্নতায়
প্রশ্ন জাগে
এখন আমার কী করণীয়
আমার ঘরে ফেরা রাত্রির যে অমোঘ সেতুবন্ধ
তার ‘প্রবেশ নিষেধ’
দরজায় পেরেকবিদ্ধ ক্রুশের কাষ্ঠদণ্ড
সেখানে প্লাতোর ঝুলন্ত দেহাবশেষ
না-না তিনি কবিতা নন
দায়রা জজের আদালতে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
কবিতার তিনি গুপ্তঘাতক গুপ্তঘাতক গুপ্তঘাতক

ছয়
ঈশ্বর তো ছিলেন একচিলতে জায়গাজুড়ে
ঈশ্বরকণায়
আলোবিমুখ বাতায়নে ইহকাল-পরকাল জন্ম-জন্মান্তর
এক্সক্লুসিভ কফিশপের মতো ঈশ্বরকণার
‘ঈশ্বরকণার’ এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির মতো
সার্চলাইটে ধাঁধানো চোখ হাতির শুঁড়ের অবিকল
টেলিস্কোপ আর কসমোলজি
তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে অনতিক্রম আরো
এক কোটি তিরাশি লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মাইল
তারপর থেকে
খুঁজতে বেরিয়েছি ছেলেবেলার টোনাটুনির
মধুর গল্প
খুঁজতে বেরিয়েছি কাটা ঘুড়ির পিছন পিছন
ছুটে যাওয়া স্মৃতি
খুঁজতে বেরিয়েছি আমলকী আর ঝাউবনে
লুকনো প্রজাপ্রতি
মা ছেলেবেলায় রাজ্যের যত্তসব
আজগুবি গল্প শোনাতেন
কখনো ঠাকুমার ঝুলি হাতড়ে
বের করে আনতেন মজার মজার গল্প
তখন আমার চোখে জ্যোৎস্নামাখা ঘুম
কখনো এন্ডারসনের ঘুমপাড়ানিয়া রূপকথা
আমি জেদ ধরে বলতাম
রাক্ষস-খোক্কসদের গল্প বলো
মা কেবল ধমকাতেন, না না ওসব কিছু নেই
রাক্ষস নেই খোক্কস নেই এ কী করে হয়
কী করে হয় এমন ভুবন-বিচিত্রা
রাক্ষস যদি নেই কোনো শিহরণ নেই
খোক্কস নেই তো কোনো পুলক নেই
এই যে আলোবিমুখ বাতায়ন
এই যে ইহকাল-পরকাল, এই যে জন্ম-জন্মান্তর
রাক্ষস-খোক্কস আর ঈশ্বরে একাকার