গতি, জীবন, শিল্প –  মিথস্ক্রিয়া

শিল্প সৃষ্টির সংগ্রাম শিল্পীর চরিত্রের অন্তর্গত চাহিদা। এটি একটি সিদ্ধান্ত, যা অধিবিদ্যা এবং বস্তুগত জগতের মধ্যকার একটি ক্রিয়াশীল সম্পর্ক। এই সম্পর্ক একটি প্রতিনিধিত্বশীল ভাষা আকারে সমাজ-সংস্কৃতির বিনির্মাণকে গতিশীল করে। অর্থাৎ শিল্প একটি ‘মাধ্যম’ এবং একই সঙ্গে ‘প্রভাবক’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ আচরণ ধারণ করে। আধুনিক তত্ত্বালোচনা শিল্পকে শুধু সুন্দর/ মনোগ্রাহী নয়, একই সঙ্গে কুৎসিৎ/ বিরক্তি উদ্রেককারী উপাদান হিসেবেও সাদর সম্ভাষণ জানায়। সচেতনে বা অবচেতনে কিংবা শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন যা-ই হোক না কেন, তা সমাজের ক্রিয়াশীল ঘটমান বর্তমান এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ – তা অনস্বীকার্য।

শিল্পী তেজস হালদারের ‘মুভিং স্পিরিট’ (গড়ারহম ঝঢ়রৎরঃ) শিরোনামের একক প্রদর্শনীটিও শিল্পের উপরোক্ত গুণের ধারাবাহিকতা। তেজস হালদার এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভাস্কর্য মাধ্যমে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজ করেন। তাঁর মেধা, শ্রম, ভক্তির সমন্বয়ে চারটি ভিন্ন সিরিজকর্মের প্রায় আশির অধিক কাজ নিয়ে এ-প্রদর্শনী।

পুরান ঢাকায় স্টুডিও পরিচালনা, সে- এলাকার ঐতিহাসিক ইতিহাস, সময়ের সঙ্গে মিশ্রিত হওয়া নতুন সংস্কৃতি, বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শব্দ, গন্ধ, সরু গলির ভেতর দিয়ে নিত্যদিন জীবনের তাগিদ ও বেঁচে থাকার প্রেরণায় তেজসের নিত্যদিনের যে-অভিজ্ঞতা তার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে এসব কাজ।

মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে রূঢ় বস্তুজগৎ আর আধ্যাত্মিকতার আলাপচারিতা।

লস্ট ওয়াক্স এবং স্যান্ডকাস্টিং প্রসেসে করা ব্রোঞ্জে তেজস দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। ২০০৭ সালে বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে ‘ষড়ভঙ্গ’ (উঁধষ ঈড়হংঃৎঁপঃরড়হ) শিরোনামের প্রদর্শনীতে এ-মাধ্যমে বাস্তববাদী ফিগারেটিভ কাজ করে প্রশংসা পেয়েছিলেন বোদ্ধামহলের কাছ থেকে। ‘রান সিরিজে’র (জঁহ ঝবৎরবং) কাজগুলো এরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু বদলেছে অন্তর্গত ন্যারেটিভ বা বর্ণনা। এ-পর্যায়ে শিল্পী স্পষ্টভাবে বাস্তবধর্মিতার সঙ্গে আধ্যাত্মিক মরমিকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন ক্রমাগত। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা যেভাবে সদা ঘূর্ণনশীল বা গতিশীল, সেই গতিশীলতা রান সিরিজের মূল ভাবনা। যেখানে পদার্থবিদ্যা ও মহাকাশবিদ্যা যুক্তি খ-ন করে চলেছে সব কৌতূহলের এবং একই সঙ্গে অদৃশ্য শক্তির রহস্য সর্বদা বিস্ময়কর। আমাদের লোকসংস্কৃতিতেও।

তেজস হালদারের কাজে ফর্ম বা আঙ্গিক, রেখা, উপরিতলের বুনট বা টেক্সচার বেশ চমকপ্রদ। পাতিনা করে ব্রোঞ্জে তৈরি করা রং একধরনের পুরনো আস্বাদের জোগান দেয়।