গদ্যছন্দের খেলা

নির্বাচিত কবিতা

তিতাশ চৌধুরী

গতিধারা

ঢাকা, ২০১২

৪০০ টাকা

‘জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্যশব্দ কবিতা

কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।’

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এভাবেই কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন তাঁর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতায়। কাব্যিক সত্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –

কবি তব মনোভূমি

রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

‘কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনায়’ সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘কবিতা শব্দের শিল্প।’ অলংকার ও রসবাদীরা কবিতায় অলংকার ও রসের উপস্থিতিকে অপরিহার্য বিবেচনা করতেন। আসলে কবিতা কী, তা বোধহয় বলে বোঝাবার নয়, কবিতা একান্তই ইন্দ্রিয়ানুভূতির বা হৃদয়ানুভূতির ব্যাপার –

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল প্রাণ।

‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ এ-কথাটি যেমন সত্য, তেমনিভাবে, এও হয়তো বলা যেতে পারে – সব লেখাই কবিতা নয়, কোনো কোনোটি কবিতা। কালের বিবর্তনে বাংলা কবিতারও অনেক বিবর্তন ঘটেছে। সেই চর্যাপদ থেকে আধুনিককালের কোনো তরুণ কবি পর্যন্ত বিষয়বৈচিত্র্যে, আঙ্গিক গঠনে, অলংকার-ব্যবহারে, ছন্দের বিন্যাসে এ-বিবর্তন চোখে পড়ার মতো। কখনো কখনো কবিতাকে দুর্বোধ্যতার অপবাদও নিতে হয়েছে। তবে কবিতা সহৃদয় পাঠকের জন্যই, দুর্বোধ্যতার বেড়াজালে আটকে থাকা কবিতাভীতির জন্য নয়।

তিতাশ চৌধুরী কবি। এটি তাঁর মূল পরিচয় কি-না সে-বিতর্কে না গিয়ে বলতে পারি, দীর্ঘদিন ধরেই তিতাশ চৌধুরী কবিতা লেখেন। সেই ১৯৭৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী প্রকাশিত হয়। এরপর অবিরল ঝরনাধারার মতো না হলেও কবিতা লেখায় আলসেমি ভর করেনি তাঁকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রায় পনেরো বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তুমি সুখেই আছো নন্দিনী। তৃতীয় ও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে তোমাদের জন্য ভালোবাসা ও অগ্রন্থিত কবিতা ২০০৪ এবং ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়। এ চারটি কাব্যগ্রন্থের মোট ১৩৩টি (উৎসর্গ কবিতা বাদ দিয়ে) কবিতা নিয়ে তিতাশ চৌধুরীর কবিতাসংকলন নির্বাচিত কবিতা।

মূল কবিতা ১৩৩টি হলেও প্রতিটি কবিতার রয়েছে ইংরেজি অনুবাদ। অর্থাৎ প্রতিটি কবিতাই প্রথমে কবির ভাষায়, পরে অনূদিত ভাষায়। কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন প্রফেসর লায়লা নূর। ভূমিকাতে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী যেমন বলেছেন, ‘তিতাস চৌধুরী তাঁর কবিতার পাঠক তাঁর স্বভাষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। বাংলা যাদের ভাষা নয়, সেই বৃহত্তর কবিতাগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে চান তাঁর কবি কণ্ঠস্বর।’ আবার অনুবাদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘মূল কবিতার এই পরিচয়টা প্রফেসর লায়লা নূরের নিষ্ঠ অনুবাদেও লাভবান করবেন সেই বৃহত্তর জগতের পাঠকের – যাঁরা মূল কবিতার রসে বঞ্চিত।’

আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার একটা অভিযোগ প্রায়ই উচ্চারিত হয়। তিতাশ চৌধুরীও হয়তো এ-অভিযোগ থেকে মুক্ত নন, আবার অভিযুক্ত নন। তাঁর প্রায় কবিতাই সত্য ভাষণের মতো। সহজ স্বীকারোক্তি এবং অপরিসীম সারল্য সাধারণ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ধরা যাক, দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা ‘দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী’র কথা। কী এক অপূর্ব স্বীকারোক্তি! দানবের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত রাজকুমারী। এ রাজকুমারী যে প্রিয় মাতৃভূমি। এই রাজকুমারীর সূর্যসন্তানেরা হায়েনাদের রোষে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর এ-তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বীভৎস অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে প্রিয়কুমারী। কিন্তু আমাদের প্রতি হায়েনাদের কেন এ-নিষ্ঠুর আচরণ, কবি ভেবে পান না –

অশ্রুহীন, শোকহীন আর কান্নাহীন

এ কোন পৃথিবীর মৃত্যু? নিখোঁজ?

রক্ত পসরা নিয়ে হাঁটি রাতদিন আমি

প্রশ্নের ধারাল ছুরিতে কাটি কেবলই বুকের পাঁজর।

(দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী)

একই কাব্যগ্রন্থের ‘রক্ততিলক’ কবিতায়ও তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন রক্তিম সূর্যখচিত একটি দেশের।

তিতাশ চৌধুরীর কবিতার অন্যতম বিষয়বস্ত্ত প্রেম। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তুমি সুখেই আছো নন্দিনীর প্রায় প্রতিটি কবিতায় প্রেমের চিত্র বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কবি বারবার তাঁর প্রেয়সীকে একান্তভাবে কাছে পেতে চেয়েছেন। প্রিয়ার সান্নিধ্য ছাড়া কবির জীবন যে একেবারেই দুঃসহ অনেক কবিতায়ই তার প্রমাণ মেলে –

১.   তুমি কাছে না থাকলে রাতে ঘুমুতে পারি না

বিছানা, পড়ার টেবিল, আলনা, সব অগোছালো

পড়ে থাকে। রবীন্দ্র-নজরুল, শেলী-কীট্স এবং জীবনানন্দ

সকলেই টেবিলের নিচে তুমুল গড়াগড়ি যায়।

(‘তুমি কাছে না থাকলে’)

অথবা,

২. দোয়েল পাখির নতুন বাসা নির্মাণের কথা বলেছিলাম

হঠাৎ সুতপতার মেহেদি পরার কথাও তোমাকে বলেছিলাম।

(‘তুমি কিছুই শুনলে না’)

অথবা,

৩. এই শয্যায় চলো

বিবিক্ত দহনে তোমাকে এক্ষুনি উষ্ণ করে দেবো

প্রগাঢ় আলিঙ্গনে ডেকে আনবো নক্ষত্রের রাত।

(‘আরেকটি দিন থেকে যাও’)

অথবা,

৪.   হায় আজ তুমি কোন কিছুতেই উত্তেজিত নও

ফুল পাখি এবং কবিতা নিয়েই সময় কাটাও।

(‘তুমি সুখেই আছো নন্দিনী’)

তিতাশ চৌধুরী প্রচন্ডভাবে বন্ধুবৎসল। সাহিত্যিক আড্ডায় তাঁর বিরাট একটি পরিমন্ডল তৈরি হয়েছে। তাছাড়া গুণীজনকে শ্রদ্ধা বা সংবর্ধনা জানাতে তিনি যেমন নিবেদিতপ্রাণ, ছোটদের প্রতিও তেমন অকৃত্রিম স্নেহ। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে প্রিয়জনদের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত কিছু কবিতায়। যেমন ‘প্রমীলাদের বাড়ি’ কবিতাটি উৎসর্গ করেন নজরুল ইসলামকে, ‘এবং তোমাকে পেতে চাই’ কবিতাটি নেলসন ম্যান্ডেলাকে, ‘নদী ও মানুষের গল্প’ কবিতাটি শহীদ আখন্দকে, ‘একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশায়’ কবিতাটি কবি শামসুর রাহমানকে, ‘যুক্ত ইশতেহার’ কবিতাটি শাহজাহান চৌধুরীকে। এ ধারার আরো বেশ কিছু কবিতা রয়েছে, যাতে কাছের মানুষের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার পরিচয় মেলে।

তোমাদের জন্য ভালোবাসা কাব্যগ্রন্থটিরও মূল উপজীব্য বিষয় প্রেম। তবে এ-প্রেম তুমি সুখেই আছো নন্দিনী কাব্যের প্রেমের মতো নয়।  তুমি সুখেই আছো নন্দিনী কাব্যগ্রন্থের প্রেম অনেকটাই দেহজ। জৈবিক কামনা-বাসনা চরিতার্থ করাই যেন সে-প্রেমের উদ্দেশ্য। কিন্তু তোমাদের জন্য ভালোবাসা কাব্যগ্রন্থের প্রেম মানবিকভাবাপন্ন। তাঁর প্রিয় ছাত্রদের উদ্দেশে কবি লিখেছেন –

১. প্রথমত তোমাদের আমি একটি লাল গোলাপের চারা রোপণ করতে বলেছিলাম

দ্বিতীয়ত তোমাদের আমি জীবনকে গভীরভাবে ভালোবেসে যেতে বলেছিলাম

তৃতীয়ত তোমাদের আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে বলেছিলাম।

(‘আমি তোমাদের বলেছিলাম’)

অথবা,

২.     ভালোবাসা এক ঝাঁক বিহঙ্গের উড়ে যাওয়া

ভালোবাসা ময়নাদ্বীপে কপিলার স্বপ্ন

ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথের অন্ধ বাউল।

(‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’)

অথবা,

৩.     আমি শুভ ও কল্যাণের দ্বীপ জ্বেলে যাবো

যেতেই থাকবো। (দ্বীপ জ্বেলে যাই)

অথবা,

৪.     এই দেখ পুব আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিচ্ছে

বাতাসে বেলী বকুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে

কাঁশবনও মাথা নাড়ছে অবিরাম

তুইও বেরিয়ে আয় খোকা।

(‘তুই ভালো হয়ে যা’)

এ ছাড়াও ‘কেউ মনে রাখে না’,  ‘কেউ কিছু বলে না’, ‘সুন্দরের ঠিকানা কোথায়, ‘কেবলই ঝরে যায়’, ‘বৈশাখ না তুমি’ ইত্যাদি কবিতায় মানবিক প্রেমের পরিচয় রয়েছে।

মানবিক প্রেমের জয়ধ্বজা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন বিশ্বশান্তির; কিন্তু সমগ্র বিশ্বে আজ মানবতাবিরোধী যুদ্ধের লেলিহান শিখা। যুদ্ধে উন্মত্ত বিশ্বকে দেখে কবি দারুণভাবে ব্যথিত। যুদ্ধকে তিনি ঘৃণা করেন। যুদ্ধকে পরিহার করে বিশ্বের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে অটুট রাখতে তিনি আহবান জানান –

১.    কেন মানুষের আভাসভূমি বিনষ্ট করা

কেন জেরুজালেমের বাতাসকে চাপা কান্নার জলে ভিজিয়ে দেয়া

অথচ কেউ কিছু বলবে না।’ (‘ফিলিস্তিন : আমার কষ্ট আমার যন্ত্রণা’)

অথবা,

২.    যুদ্ধে পরিবেশ বিপর্যয়, মানবিক সঙ্কট, গণহত্যা

ইত্যাকার বিষয় আশয় বুশ ব্লেয়ারের কাছে ছিল

স্রেফ  ইয়ার্কির সামিল। (‘স্বপ্ন ও যুদ্ধ’)

অথবা,

৩.   কেন সারা দুনিয়ায় যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়ানো? যুদ্ধের সমস্ত

নিয়মনীতি ভেঙেচুরে কেন এ বেহুদা গণহত্যা।

(‘যুদ্ধের নতুন সংজ্ঞা ও বাস্তবতা’)

‘তুমি যেতে পারো’ কবিতাটিও শান্তির অন্বেষণে ছোটা কবির অশান্তির এক দীর্ঘশ্বাস।

অগ্রন্থিত কবিতা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর মূল উপজীব্য বিষয়ও প্রেম। তবে এ-প্রেম বিরহের। না পাওয়ার বেদনা প্রতিনিয়ত কবিকে তিলে তিলে দগ্ধ করছে। হতাশার দীর্ঘশ্বাসে বারবারই ধ্বনিত হচ্ছে –

১. অথচ এই তোমাকে নিয়ে রাতদিন

আমার কী যে কষ্ট

কী যে না পাওয়ার বেদনা। (‘কী যে কষ্ট’)

অথবা,

২.    এরপর হঠাৎ একদিন কিছু না জানিয়েই তুই চলে গেলি

আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে। (‘তুই এমন করে ভুললি’)

অথবা,

৩.   কবিতার জন্য

তোমার স্পর্শের প্রয়োজন হয়। তোমার ঠোঁটে

ঠোঁট রাখতে চেয়েছিলাম, চোখে চোখ।

কিন্তু তুমি তা দিলে না। (‘যে মেয়ে কবিতা বুঝে না’)

তা ছাড়াও ‘কষ্টটুকু কোথায় রাখি’, ‘তুমি চলে গেলে’, ‘তোমার জন্য’,’ ‘কেউ পারেনি,’ ‘কোন যাদুযন্ত্রে তোমাকে আটকাবো’, ‘অপেক্ষা’, ‘আবেগ ও ভালোবাসা’ ইত্যাদি কবিতায় কবির না পাওয়ার বেদনা, হতাশা, প্রতীক্ষা, আক্ষেপ ও দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনি আমরা শুনতে পাই। অবশ্য কোনো কোনো কবিতায় জীবনকে চুটিয়ে উপভোগও করেছেন। যেমন –

১. তুমি আজ আসবে বলেই

বাগানে অজস্র ফুল ফুটেছে

গৃহকোলের ঐ সজনে গাছটিতে

আগমন ঘটেছে কুটুম পাখির। (‘তুমি আজ আসবে বলেই’)

অথবা,

২.     আমি কোন পুরস্কারের জন্য লিখি না

আমি লিখি কেবল তোমার জন্য

তোমাকে বেশি বেশি কাছে পাবার জন্য।

(‘এবং তোমার জন্য’)

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে কবি সজাগ ছিলেন। বিশেষ করে ১/১১-এর পূর্ববর্তী এবং ১/১১-এর সময়কার ঘটনা কবিকে নাড়া দিয়েছিল। এ নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘মেঘ কাটেনি’ ও ‘দুঃস্বপ্নের রাত’ নামক দুটি কবিতা। ‘কালের মোড়ল’ কবিতায় দুষ্টচক্রের খপ্পরে পড়ে দেশ কীভাবে অন্যায়-অত্যাচার, অনাচার, অসত্য ও অসুন্দরের অতলতলে তলিয়ে যাচ্ছে সে-চিত্র রয়েছে। এখানে কবি প্রচন্ডভাবে দেশপ্রেমিক। সমস্ত অকল্যাণ থেকে তিনি দেশকে মুক্ত করতে চান।

তিতাশ চৌধুরী মানবতাবাদী কবিও। সমাজের অসহায়-দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ দারিদ্রে্যর নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত হতে হতে কীভাবে একদিন সংসার থেকে হারিয়ে যায় তা তিনি রূপায়িত করেছেন ‘কাজলের মা’, এবং ‘কাজলের মা-২’ কবিতায় –

১.    আমাদের বাঁচার জন্য দুমুঠো ভাতই দরকার ছিল

শুধু দুমুঠো ভাত, আর শোবার একটু জায়গা

তা যেমনই হোক আর কিছু না। (‘কাজলের মা’)

অথবা,

২.   তারা গোলাপের সৌন্দর্য বোঝে না

গণতন্ত্র বোঝে না

বোঝে কেবল পান্তা কিংবা গরম একথালা ভাত।

(‘কাজলের মা-২’)

‘উপমাই কবিত্ব’ – এটাই বোধহয় কবিতার সার্থক সংজ্ঞা। কেননা, উপমা ছাড়া কবিতা নিছক বাকচাতুর্য। নিরাভরণ নারীর দেহ যেমন অন্যকে আকর্ষণ করতে পারে না, অলংকারবিহীন কবিতাও তেমনি সহৃদয় পাঠকের মনের গহিনে আশ্রয় নিতে পারে না। কবি হিসেবে এ- সত্যটি তিতাশ চৌধুরীর অজানা ছিল না। তাই তো তাঁর কবিতায় উপমা প্রয়োগের চমৎকারিত্ব লক্ষণীয়, যেমন –

১. ঈশ্বরের মতো দারুণ নিঃশব্দে হাঁটি।

(‘দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী’)

২. অথচ শুনেছি তোমার উজ্জবল শরীর থেকে আজকাল

ঝরে পড়ছে সোনালি বিকেল – মৃগনাভিসমগন্ধ।

(‘চিরায়ত তুমি’)

৩. আরে তুমি থিরথির করে

কলাপাতার মতো অমন কাঁপছো কেন?

(‘আরেকটি দিন থেকে যাও’)

৪. তোমার খেয়ালখুশিমতো

গরিবের ঘরবাড়ি ঘুড্ডির মতো উড়িয়ে নাও।

      (‘বৈশাখ না তুমি’)

৫. তোমাকে পাহাড়ি ঝরনাধারার সঙ্গে অনায়াসে

তুলনা করা যায়

… … …

কিংবা চৈত্রের আম্রমুকুলের মউ মউ গন্ধের সঙ্গে।

      (‘কী যে কষ্ট’)

নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থের সব কবিতাই গদ্য ছন্দে রচিত। অসমমাত্রার চরণ, অসমমাত্রার পর্ব, অন্ত্যানুপ্রাসহীনতা যদি গদ্য ছন্দ হয়, তাহলে এ- ছন্দ ব্যবহারে  কবি যত্নশীল ছিলেন। ছন্দের ব্যত্যয়ে কবিতা কখনো নিছক গদ্য হয়ে ওঠেনি।

সবশেষে বলা যায়, তিতাশ চৌধুরী কবিই। কবিতাই তাঁর কৌতূহল, কবিতাই তাঁর ঔৎসুক্য, কবিতাই তাঁর জীবন, কবিতাই তাঁর প্রেম, তাঁর ভালোবাসা। কবিতাই তাঁর খেলা; কবিতাই তাঁর জীবন জিজ্ঞাসা; কবিতাই তাঁর শেষ ঠিকানা –

‘কবিতাই আমার অস্তিত্বের শেষ ঠিকানা।’