খুব ভোরে ঘুম ভাঙে অর্পিতার। যৌবনের পুরনো আলস্য একেবারে ঝেড়েমুছে বিদায় করেছে গত এক দশক আগে। গৃহকর্মী এক মগ ঈষদুষ্ণ জলে লেবুর রস মিশিয়ে টেবিলে রেখেছে, এইটুকু পান করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বড় মনোরম হেমন্তের সকাল। ভোরের কোমল মিঠে রোদ চারদিকে ঝলমল করছে। মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতায় মৃদু কাঁপন। দোতলার বারান্দা ছেড়ে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায় অর্পিতা। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একখণ্ড সাদা মেঘ উড়ে যেতে দেখে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে, বাগানে ঢুকে আলতো হাতে নানা প্রজাতির গোলাপের পেলব পাপড়িতে হাত বোলায়। বাগানের কোণে একটি নিড়ানি ছিল সেটি নিয়ে কয়েকটি গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দেয়।
বাগানের কাজ সেরে বাসায় ঢোকে। ততক্ষণে গৃহকর্মী নাশতা তৈরি করে টেবিলে দিয়েছে। অর্পিতা আর স্বামী নাজিম একসঙ্গে নাশতা খায়।
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। নাশতা খেয়ে সোফায় আলস্যে গা এলিয়ে একটি সাপ্তাহিক সাহিত্যপত্রিকা নিয়ে অনুবাদসাহিত্য পড়ে। অর্পিতার সকল ছুটির দিন বরাদ্দ থাকে সাহিত্যপাঠের জন্য – এর কোনো ব্যত্যয় নেই। ছুটির দিন ছাড়াও কোথাও বেড়াতে গেলেও গল্প-উপন্যাস-কবিতা কিংবা প্রবন্ধ পড়া চাই। সে মনে করে, সাহিত্য মন ও মননের বিস্তৃতি বাড়িয়ে সংকীর্ণতা দূর করে জীবনকে বিভিন্ন ডায়মেনশন থেকে উপলব্ধি করতে শেখায়।
নাজিম বাজারে গেছে। আজকের দুপুরের রান্না ওরা দুজনে মিলে করবে বলে আগেই গৃহকর্মীকে জানিয়ে দিয়েছে। আসলে আজ গৃহকর্মীর সাপ্তাহিক ছুটি। এই দিন তাকে কিছু টাকাও দেওয়া হয় বাইরে ঘোরাঘুরি করার জন্য। এই বাসার এই নিয়ম ঠিক করেছে অর্পিতাই।
অর্পিতার ছেলেটা এখনো ছোট। ছুটির দিনে দশটার আগে ঘুম ভাঙে না। অর্পিতা ওর নাম দিয়েছে ‘ঘুমরাজ’।
এই সময় অর্পিতার মুঠোফোনে একটি কল আসে। অপরিচিত নাম্বার।
হ্যালো, কে বলছেন?
ম্যাডাম, আমার নাম রায়হান। আমি দৈনিক দিন খবরের কাগজের নারীবার্তার ফিচার সম্পাদক। আপনি যদি অনুগ্রহ করে একটু সময় দিতেন …
কেন বলুন তো।
আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই … অ্যা … অম … অ্যা … মানে আমাদের নারীবার্তা পাতার জন্য।
রায়হানের কণ্ঠ ভরাট। ওর কণ্ঠ শুনেই অর্পিতা মুগ্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে অর্পিতার ফার্ম নিয়ে দুটি সংক্ষিপ্ত ফিচার হয়েছে দুটি সাপ্তাহিক কাগজে। যদিও সাক্ষাৎকার ওর ভালো লাগে না, সে কাজে বিশ্বাসী, প্রচারে নয়; কিন্তু রায়হানের কথা শুনে রাজি হয়ে যায়। বলল, কখন আসতে চান?
রায়হান বলল, আপনি যখন বলবেন, ম্যাডাম।
অর্পিতা চিন্তা করে দেখল আজকেই ভালো সময়। কাল দিন পর যাবে নেদারল্যান্ডসে। পরে কখন দেখা হয় কে জানে। অর্পিতা বলল, আজকে সময় করতে পারলে চলে আসুন। আমি দুপুরের আগে কিছু সময় দিতে পারব।
তরুণ রায়হান খুশিতে আত্মহারা। অনেক দিনের একটি স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। অর্পিতার সাক্ষাৎকার ফেসবুকে শেয়ার দিলে মিনিটেই হাজার লাইক-কমেন্ট। রায়হান বলল, ম্যাডাম আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।
অর্পিতা রাতের বাসি কাপড় বদলে নেয়।
বিশ মিনিটের মধ্যে রায়হান এসে হাজির।

দুই
রায়হান জানতে চায়, আপনার সাফল্য নিয়ে এখন পর্যন্ত দুটি ফিচার সাপ্তাহিকে দেখলাম। সে-দুটো লেখায় মনে হচ্ছে অসম্পূর্ণ তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে।
হ্যাঁ, ওরা খুব ছোট করে লিখেছে। সামান্যই।
আমি একটি সম্পূর্ণ ফিচার প্রকাশ করতে চাই। অ্যা … মানে … অবশ্যই যদি আপনি রাজি থাকেন।
অর্পিতা হেসে বলল, হ্যাঁ। আমি আসলে খুব বেশি প্রচার করতে চাই না। যাহোক, এখন বলুন আপনি কী জানতে চান?
ম্যাডাম, আপনার সাফল্যের সম্পূর্ণ গল্পটা শুনতে চাই। আপনি অনুমতি দিলে আমি রেকর্ড করে নেব … যাতে কোনো কিছু বাদ না পড়ে।
অর্পিতা মৃদু হাসে। তারপর হঠাৎ তার মুখে একটি বিষাদের ছায়া দেখা যায়। অর্পিতা বলতে শুরু করে … ঠিক আছে আপনি রেকর্ড করতে পারেন।
আমার সাফল্যের গল্পটার পেছনে রয়েছেন এক হতভাগা বাবা, আবার বলতে পারেন এক হতভাগা স্বামীর হাত। তিনিই আমার জীবনের সাফল্যের বীজ আমার মগজে, চিন্তায়, স্বপ্নে বুনে দিয়েছিলেন প্রায় এক যুগ আগে … কোনো এক বসন্তের বিকেলে। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমি সিঙ্গেল মায়ের একমাত্র মেয়ে।
সিঙ্গেল মা! রায়হান বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চায়।
অর্পিতা আবার শুরু করে, হ্যাঁ। গল্পটা পুরনো হলেও প্রাসঙ্গিক। আমার বাবা নেশা করত। প্রায় রাতেই নেশা করে বাসায় ফিরত, মাকে নির্যাতন করত। মদ খেত। একবার মা অতিষ্ঠ হয়ে আলাদা থাকতে শুরু করল। পরে জানলাম বাবা তার অফিসের এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছে এবং একদিন মাকে ডিভোর্স লেটারও পাঠিয়ে দিলো। মা অবশ্য বাবাকে সহজেই ছেড়ে দিলো, কোনো আইনি ঝামেলায় যায়নি। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ডিভোর্সের পর মা-মেয়ে একসঙ্গে থাকি। মা একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করে। মায়ের সামান্য বেতনে খুব সাদামাটা জীবন আমাদের।
অর্পিতা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাসার ডোরবেল বাজে। অর্পিতা বলল, নাজমা দেখ তো তোর খালু এসেছে। দরজা খুলে দে। আর এখানে নাশতা দে।
নাজিম অন্য দরজা দিয়ে বাসায় ঢোকে। ড্রয়িংরুমে নাশতা দিয়ে যায় নাজমা।
তারপর ম্যাডাম? রায়হান প্রশ্ন করল।
আসলে অনার্স পড়ার সময় আমার এক ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সে ছিল অনেক বড়লোকের ছেলে। বন্ধুত্ব থেকে আমরা ভালোবাসার দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু বড়লোকের ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে বুঝতে পারলাম ওর সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওই সময় আমি দারুণভাবে হতাশা, মানসিক অস্থিরতা, বিষণ্নতা ইত্যাদি নানা মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকি এবং মাঝে মাঝে আমি নেশাও করি। গাঁজা-মদ খাওয়া শুরু করি।
এদিকে মায়ের সামান্য বেতনে আমার লেখাপড়ার খরচ, আমার সাধ-আহ্লাদ ইত্যাদি নানা কারণে আমার কাছে স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিক হয়ে যায়। খুব এলোমেলো জীবনযাপন করতে শুরু করি তখন। ভার্সিটির ক্লাসেও খুব বেশি অ্যাটেন্ড করি না।
ভাবলাম আমিও কিছু করে রোজগার করি। এই ভেবে এটা-সেটা শুরু করি। কিন্তু কোনো কাজেই সাফল্য পাইনি। এদিকে টার্ম রেজাল্টও খুব খারাপ হয়েছে। আমার বন্ধুটিও আমাকে অ্যাভয়েড করতে লাগল। এ-রকম বিভিন্ন সমস্যার কারণে আমি চরম হতাশায় ডুবে যাই। হতাশা থেকে মুক্তির জন্য বেছে নিলাম মাদককে।
রায়হান প্রশ্ন করে, কী মাদক নিতেন?
অর্পিতা শান্তভাবে বলে, তখন গাঁজা আর হেরোইনই নিতাম। তবে হেরোইন টাকার অভাবে সবসময় নিতে পারতাম না। সামান্যই। খুব যে আসক্ত হয়ে পড়েছি তা নয়। নেশার জগতে ঢোকার প্রাক্কালে …
তারপর? রায়হান প্রশ্ন করল।
অর্পিতা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, তারপর … একদিন রমনা পার্কে গেলাম এক বসন্তের বিকেলে। আমি এদিক-ওদিক ঘুরছি মাদক বিক্রেতার খোঁজে। হঠাৎ প্রৌঢ় বয়সের একটা লোক আমার পেছন দিক থেকে বললেন, কী মাল?
বড় অদ্ভুত গলার স্বর। খুব ভরাট।
তখন শীত নেই, বসন্তের বাতাস, গাছে গাছে কোকিলের ডাকাডাকি, ফুলে ফুলে সাজানো গাছ অথচ লোকটির গায়ে একটি পুরনো ময়লা কোট। চোখের নিচে কালো দাগ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নাওয়া-খাওয়াহীন লোকটির কথাবার্তা বেশ চোস্ত। অন্য মাদক ব্যবসায়ীর মতো মনে হয়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কয় নম্বর?
আমি জানতে চাইলাম, এগুলোর আবার নম্বর আছে নাকি?
লোকটি হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি। নতুন। তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ। তবে দু-একদিন বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছি। তারপর আমি বললাম, এক নম্বর দেন। আমি কিন্তু নিজেও জানি না এক নম্বর কী? লোকটি একটি কাগজের পোঁটলা দেওয়ার সময় আমার সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন। মাত্র একশ টাকায় মাল দিয়ে বললেন, নতুনদের কাছ থেকে আমি কমই নিই।
আমি জানতে চাইলাম, নতুনদের কাছ থেকে কম নেন কেন?
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, টু হুক দ্য ফিশ। মানে বড়শিতে আটকানোর জন্য।
আসলে জানেন রায়হান, ভদ্রলোকের কথা আমি বিশ্বাস করেছি। কারণ মাদকসেবীদের প্রথম বিনে টাকায় খাওয়ালেও ক্ষতি নেই। একবার যদি কেউ টেস্টও করে তাহলে ধরে নিতে হবে সে কোনো না কোনো সময় মাদকাসক্ত হবে। তখন তাদের কাছ থেকেই কিনতে হবে আর দাম বেশি দিতেও আপত্তি করবে না। ব্রিটিশদের চা খাওয়ানোর ফরমুলার মতো। আমি একশ টাকায় একটি পোঁটলা হাতে নেওয়ার পর তিনি বললেন, তুমি কেন নেশা করছ, একটু বলবে?
আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম, আমার পার্সোনাল কথা কেন বলব?
তিনি হাসলেন। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। তখন বিকেলের রোদ মরে গেছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধার চারপাশ থেকে নামছে। হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে লোকটি আমার সামনে এসে বললেন, আমি যে মাল দিয়েছি সেটি কিন্তু আসল মাল নয়। আটার গুলি।
আমার মেজাজ তখন চরমে। আমি রাগে রি-রি করতে করতে বললাম, আপনি আমাকে আটার গুলি দিলেন কেন? ভণ্ড, ঠগ্, বাটপাড়, বদমাশ, প্রতারক …
আমি এমনভাবে গালি দেওয়ার পরও লোকটি কিন্তু মন খারাপ করেননি। বরং হাসতে হাসতে বললেন, এবার বলো কেন তুমি নেশার জগতে এলে? এখন বলতে পারবে। কারণ, মানুষ যখন রেগে যায় তখন সত্য কথা বলে ফেলে। তুমিও পারবে। বলো।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হলো, আবার কৌতূহলও হলো।
তিনি আমাকে পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসালেন পিতৃস্নেহে। আমিও খোলাখুলি সব বললাম। বললাম, হতাশা। ব্যর্থতা। আমি কোনো কাজেই সাকসেস হতে পারি না। যে-কাজই করছি শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা।
ভদ্রলোক বললেন, ধরো তুমি আজকে বাসায় যাওয়ার সময় পথে যদি ট্রাফিক জ্যাম থাকে তাহলে কি বাসায় যাবে না? যদি পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে কি বাসায় যাবে না?
আমি বললাম, কেন যাব না? অবশ্যই যাব।
ভদ্রলোক বললেন, তার মানে বাধা থাকলেও তোমাকে বাসায় পৌঁছাতে হবে, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক বললেন, তোমার বাসায় যাওয়ার জন্য তুমি কয়টি গেট দিয়ে ঢুকবে?
আমি বললাম, একটি।
ভদ্রলোক বললেন, তার মানে দশটি পথ বা গেট দিয়ে নয়, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ দশটি গেট দিয়ে নয়।
ভদ্রলোক বললেন, তার মানে নির্দিষ্ট পথেই তোমাকে যেতে হবে। দশটি পথ দিয়ে গেলে তোমার বাসায় যেতে পারবে না। তোমার জীবনের পথও একটি হওয়া উচিত। দশটি পথে জীবনে সাফল্য আসে না। মানুষ এই সহজ সত্যটিই বুঝতে পারে না। শুধু চাই আর চাই, খাই আর খাই করে জীবন কাটিয়ে দেয়, বুঝলে? কোথায় যেতে চাই, কোন পথ দিয়ে যাওয়া দরকার সেটিই খুঁজে নিতে পারি না। আসলে জীবনের কী চাওয়া হতে পারে? ভেবেছো কখনো?
ওনার কথায় যেন এক প্রকার সম্মোহনী জাদু ছিল। তাঁকে ভালো লাগতে শুরু হলো। শ্রদ্ধাও জাগতে শুরু করল মনে। তিনি বললেন, আমার দিকে তাকাও। আমাকে দেখো। এই বুকে যে পাথরের মতো কঠিন কষ্ট আছে, যে-কষ্টকে কখনোই দূর করা যায় না, তা কি বুঝতে পারো?
আমি বললাম, না। কী করে বুঝব?
তিনি বললেন, আমি কোথায় যেতে চেয়েছিলাম আমি জানতাম না। শুধু টাকার পিছনে ছুটছিলাম তো ছুটছিলাম। শুধু টাকা আর টাকা। আমার একটা সোনার মতো ফুটফুটে ছেলে ছিল, কী যে দুরন্ত, কী যে অশান্ত, ব্রিলিয়ান্ট ছিল সে … কিন্তু তার দিকে আমি কখনো নজর দিইনি। আমার স্ত্রীও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল সারাক্ষণ। শুধু টাকা ওড়াত আর ঘুরে বেড়াত। কেনাকাটা, শপিং ইত্যাদি।
আমি জানতে চাইলাম, তারপর?
আমরা দুজন আমাদের মতো চলছি। আমার সোনার ছেলেটাও তার মতো চলছে। সে কীভাবে যে নেশার ফাঁদে পা দিলো টেরই পেলাম না। তারপর চিকিৎসা। কিছুদিন ভালো, আবার সেই পথের মাতাল।
তিনি চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
আমি জানতে চাইলাম, তারপর?
তারপর আমরা তাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। একদিন টাকা না পেয়ে সে তার মাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। আমার বুকের ধন, ছেলেটারও ফাঁসি হয়।
একটু চা খেয়ে নিই কী বলেন, অর্পিতা বলল।
রায়হান জড়ানো গলায় বলল, জি ম্যাডাম। চা খেয়ে নিলে ভালো হয়।
চা খাওয়ার পর অর্পিতা আবার শুরু করে, ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে আরেকটি বেঞ্চে বসেন। তখন সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পার্ক। শহরের পথবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। ভদ্রলোক বললেন, জীবনকে ধ্বংস করার পথ খুব সহজ, কিন্তু গড়ে তোলা খুব কঠিন। প্রতিটি দিনে জীবনকে তিলে তিলে তৈরি করতে হয়। প্রতিটি দিনকে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতে হয়। তুমি যদি সুস্থ থাকো প্রতিটি মুহূর্তই বসন্তকাল। আর এই বসন্তকালকে উপভোগ করার জন্য চাই সুস্থ জীবন। প্রতিটি সকালকে মনে করো জীবনের শ্রেষ্ঠ সকাল। প্রতিটি দুপুরকে মনে করো জীবনের শ্রেষ্ঠ দুপুর। প্রতিটি রাতকে মনে করো জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। ধ্বংস করে নিষ্ঠুর, কুৎসিত মানুষেরা। সৃষ্টি করে সুন্দর মানুষেরা। তুমি সুন্দর। তুমি কেন ধ্বংস করবে? তুমি সৃষ্টি করবে। পৃথিবীকে সুন্দর করে তোমরা যদি না সাজাও তবে কে সাজাবে বলো?
আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে সৃষ্টি করব?
তিনি বললেন, তোমার ডেসটিনেশন কোথায়? তোমার গন্তব্য কোথায়? আগে সেটি ঠিক করো। তারপর … উড়ে যাবে? না। ধাপে ধাপে যাও। মাটিতে পা রেখে নক্ষত্রালোকে দু-বাহু বাড়াও। তোমার পা-দুটি তোমার নির্ভরতা। নক্ষত্রালোক তোমার স্বপ্ন। তোমার বুকের গহিনে সেই স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলো। জাগিয়ে তোলো। এই স্বপ্নই তোমাকে নিয়ে যাবে তোমার গন্তব্যে। তুমি কি চাও? বলো, আই বিলিভ ইন মাইসেলফ। আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম অ্যান্ড অ্যা রোডম্যাপ। আই হ্যাভ অ্যাবিলিটিজ টু রিচ দেয়ার।
কথা শেষ করে তিনি হাঁটতে লাগলেন। তাঁকে মনে হলো এক অলৌকিক লোক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন এখন?
তিনি বললেন, তোমার মতো তরুণ-তরুণীদের গন্তব্য ঠিক করে দিতে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, যাওয়ার আগে আপনার পরিচয়টা কী বলবেন?
তিনি বললেন, আমার পরিচয়! দু-বছর আগেও ছিলাম শিল্পপতি খন্দকার আবসার। এখন আমি হতভাগা বাবা। ব্যর্থ স্বামী। আর … অন্ধকার নেমেছে ধীরে ধীরে আর সেই অন্ধকারে তিনি মিশে গেলেন।
রায়হান জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হলো?
অর্পিতা বলল, সেখান থেকে এসে আমি আমার গন্তব্য ঠিক করলাম। লেখাপড়া ছেড়ে আমি মার্কেট অ্যানালাইসিস করলাম, নিজের চিন্তা ও দক্ষতা যাচাই করে ফ্যাশন ডিজাইনের কাজ করতে শুরু করলাম। আর এখন আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমার ফার্মে কাজ করে একশ ত্রিশজন কর্মী। তাদের মাসিক বেতনই দিই দুই কোটি টাকা। আমার ফার্মের ইয়ারলি টার্নওভার একশ কোটি টাকার ওপরে। নিজের দেশ ছাপিয়ে আমি বিশ্বের বাজারেও বাংলাদেশকে পরিচয় করাতে পেরেছি। এসবই এখন স্বপ্ন।
রায়হান জিজ্ঞেস করল, আপনি কি সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা করেছিলেন?
অর্পিতা বলল, আমি কয়েকবার ওনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম পার্কে … কিন্তু পাইনি।
অর্পিতা চোখ মোছে।
ভেজা কণ্ঠে বলল, তিন বছর আগে আমরা … মানে আমি ও আমার স্বামী একদিন পার্কে হাঁটতে গেলাম সকালে। দেখি একটি বেঞ্চিকে ঘিরে অনেক মানুষের জটলা। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। স্তব্ধ হয়ে গেলাম … সেটি ছিল শিল্পপতি খন্দকার আবসার সাহেবের লাশ। গায়ের কাপড় ভীষণ নোংরা। শরীরটা কংকালসার।
অর্পিতা ড্রয়িংরুমের দরজা দিয়ে বাইরের বেশ বড় ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীল ঝকঝকে আকাশে উজ্জ্বল রোদ।
রেকর্ডার বন্ধ করে রায়হান স্তব্ধ হয়ে বসে রইল চেয়ারে।