গন্তব্য

নীহারুল ইসলাম

হুকারহাট বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা চড়ে নাককাটিতলা। দুনিয়ার যত শান্তি নাকি সেখানেই! অথচ হুকারহাট আর কতদূর, সেটাই বুঝতে পারছে না আমিরুদ্দি। যদিও বাসে উঠেই কন্ডাক্টরকে বলে রেখেছে, গন্তব্যে পৌঁছালে তাকে যেন নামিয়ে দেয়; কিন্তু বাসে খুব ভিড়। কন্ডাক্টর যাত্রীদের ভাড়া নিতে ব্যস্ত। তাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা কন্ডাক্টরের মনে না থাকে যদি! আমিরুদ্দির সন্দেহ হয়। আরো একবার মনে করিয়ে দেবে কিনা ভাবে। শুধু ভাবেই, মনে করিয়ে দিতে পারে না। কন্ডাক্টর তখন তার থেকে অনেক দূরে। অগত্যা চাঁদফকিরের কথা মনে করে সে। চাঁদফকির বলেছিল, …শান্তি পেতে হলে নাককাটিতলা যা আমিরুদ্দি!

ঘর-সংসার, বউ-বাচ্চা নিয়ে নাকানি-চুবানি খেতে খেতে যখন মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে, বেঁচে থাকাটা যখন মানুষের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় তখন মানুষ চাঁদফকিরের আখড়ায় যায়। চাঁদফকিরের আখড়া বলতে টুঁটিকাটাডাঙা। একসময় সন্ধ্যার পর ওই ডাঙার নাম কেউ মুখে নিত না। যে নিত তারই নাকি টুঁটিকাটা লাশ পাওয়া যেত ওই ডাঙায়! সেখানে চাঁদফকির আখড়া করার পর মানুষের সেই আতঙ্ক কেটেছে। মানুষ এখন রাতবিরাতে বেঁচে থাকার আতঙ্ক কাটাতে সেখানেই যায়। যেমন আমিরুদ্দি নিজেই গেছিল গত সন্ধ্যায়। চাঁদফকিরের গাঁজা ছিলিমে দম মেরে বলেছিল, জীবনে শান্তি নাই ফকিরভাই! আর পারছি না। ওই একই ঘর! একই সংসার! বেঁচে থাকতে ঘেন্না ধরে গেল। কোনো পথ থাকলে বাতলাও।

– কে বলে জীবনে শান্তি নাই? পাপপুণ্যের হিসাব না কষে শান্তি পেতে হলে নাককাটিতলা যা আমিরুদ্দি! ঠিক শান্তি পাবি। তবে সেখানে গেলে নাক কাটা যাবে। আর সংসারে ফিরতে পারবি না কিন্তু!

চাঁদফকিরের কথামতো পাপপুণ্যের হিসাব না কষলেও সবদিক ভেবেচিন্তে আজ ভোর ভোর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে আমিরুদ্দি। বাসের জানালা-ঘেঁষা সিটে বসে আছে। দৃষ্টি জানালার বাইরে। একটার পর একটা শস্যক্ষেত, জনবসতি, আমবাগান, লিচুবাগান, পেয়ারাবাগান তার চোখের সামনে থেকে পেছনদিকে ছুটে পালাচ্ছে। হাজার চেষ্টাতেও সেই দৃশ্য সে তার মন-ক্যামেরায় কয়েদ করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাসের ঝাঁকুনিতে ঘুমিয়ে পড়ছে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে! একসময় কন্ডাক্টরের ডাকে তার ঘুম ভাঙে, এই যে দাদা – নেমে পড়ুন। আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন।

চোখ খুলে আমিরুদ্দি প্রথমে বাসের ভেতরটা দেখে। অবাক কান্ড! কিছুক্ষণ আগে যে-বাসটা ভিড়ে ঠাসাঠাসি ছিল, এখন একেবারে ফাঁকা। সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। অবাক কান্ড হলেও আমিরুদ্দি অবাক হয় না। চাঁদফকিরের বারণ আছে। অগত্যা কোলে ধরে রাখা ব্যাগটা কাঁধে ঠিকমতো ঝুলিয়ে সে নিজেও ফাঁকা বাস থেকে নেমে পড়ে। কিন্তু এ কী! হুকারহাট নামের বাসস্ট্যান্ডটাও যে একবারে জনশূন্য! পান-বিড়ির ঢপ কিংবা চায়ের দোকান কোনোকিছু নেই। একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। তাহলে এখানে রিকশা থাকবে কী করে? কিন্তু চাঁদফকির যে বলেছিল, …রিকশা চড়ে নাককাটিতলা!

আমিরুদ্দি আর একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে নেয় চারদিক। না, কেউ কোথা নেই। যে-বাসটায় চেপে এলো তার ড্রাইভার-কন্ট্রাক্টরকেও খুঁজে পায় না যে জিজ্ঞেস করে জানবে, এখান থেকে নাককাটিতলা যাবে কী করে? এমনকি বাসটাকেও দেখতে পায় না। তাহলে এখন কী করবে? কোন দিক থেকে এলো আর কোন দিকে যাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না যে! আবার এমন ভুতুড়ে জায়গায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে তার কেমন ভয় ভয় করছে। আমিরুদ্দি ভয় পেতে চায় না। চাঁদফকির বলেছিল, ভয় পেলে বিপদে পড়বি! সে বিপদে পড়তে চায় না। বিপদে পড়তে চায় না বলেই চাঁদফকিরের অমন উদ্ভট গল্প শুনে পাপ-পুণ্যির হিসাব না কষে শান্তির খোঁজে সে ঘরসংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছে।

মনে সাহস সঞ্চয় করে আমিরুদ্দি। বেরিয়ে যখন পড়েছে, শেষ দেখে ছাড়বে! এমন ভাবনায় রাস্তার দুই দিক দুবার ভালো করে দেখে এক দিক ধরে হাঁটতে শুরু করে সে। এদিকটায় শস্যক্ষেত, আমবাগান, লিচুবাগান, পেয়ারাবাগান কোনোকিছুই নেই। জনবসতি নেই। আছে বলতে একধরনের বাগান। কীসের বাগান কে জানে! ছোট ছোট সব বুনোগাছ। কী সুন্দর লাল-নীল-হলুদ ফুল ফুটে আছে! জান-পেহেচান কোনো ফুল নয়। অন্য ধরনের ফুল সব। অন্য রকম গন্ধ! কেমন নেশা! নেশা! শ্বাস টেনে টেনে সেই গন্ধ উপভোগ করছে সে।

হাঁটতে হাঁটতে সত্যিই একসময় আমিরুদ্দির নেশা ধরে। সে হাঁটছে না উড়ছে, মালুম পায় না। তখনই হঠাৎ পিছুডাক, বাবু, যাবেন নাকি নাককাটিতলা?

যেন এরকম ডাকের অপেক্ষায় ছিল আমিরুদ্দি। পেছন ফিরে চায় সে। কিন্তু কোনো মানুষকে দেখতে পায় না। বদলে সে দেখে তার পেছনে একটা সাদা ধবধবে রাজহাঁসকে দাঁড়িয়ে থাকতে।

এই রাজহাঁসটাই কি তাহলে তাকে নাককাটিতলা যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করল? হ্যাঁ, ওই তো – রাজহাঁসটার মুখটা কেমন হাঁ করা! প্রশ্ন করে উত্তরের ইন্তেজার করছে বুঝি। তাছাড়া নাককাটিতলাই তো সে যেতে চায়। কিন্তু কোন পথে যাবে? কীভাবে যাবে? সে-কথা জিজ্ঞেস করে যে জানবে এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না এতক্ষণ। চাঁদফকিরের কথা উদ্ভট মনে করে অগত্যা উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটা শুরু করেছিল। এখন কাউকে পেয়েছে যখন জিজ্ঞেস করতে দোষ কী? হাঁস হোক কিংবা আর যা-ই হোক! আমিরুদ্দি তড়িঘড়ি বলে উঠল, হ্যাঁ ভাই। আমি নাককাটিতলা যাব। কোন রাস্তায় যাব দয়া করে যদি একটু বলেন!

– আমি দয়া-টয়া বুঝি না। যেতে হলে গলা ধরে আমার পিঠে চড়ে বসতে হবে।

আমিরুদ্দি এবারে আর অবাক না হয়ে পারে না। রাজহাঁসের পিঠে চড়ে সে নাককাটিতলা যাবে! সত্যি সত্যি কি তাহলে তার            গন্তব্য এখন শান্তির রাজ্যে? চাঁদফকির এরকমই বলেছিল। চাঁদফকিরের কথা হুবহু মিলে যাচ্ছে দেখে আমিরুদ্দি আর দেরি করে না। সব রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাথা খেয়ে রাজহাঁসটার পিঠে চড়ে বসে।

আরো অবাক কান্ড! সে বসে আছে রাজহাঁসটার পিঠে। অথচ কী অদ্ভুত কৌশলে রাজহাঁসটা তার ডানা বের করে মেলে দিয়েছে আকাশে। হাঁসটা উড়ছে। সেও উড়ছে! রাজহাঁস কার বাহন যেন! মা সরস্বতীর। স্কুলে পড়ার সময় সরস্বতী পূজায় অংশগ্রহণ করত সে। অঞ্জলি দিত। আমিরুদ্দির সব মনে পড়ে। স্বভাবতই সে অবাক হয় না, তার আনন্দ হয়। সে গান গায়, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…।’

তবে বেশিক্ষণ আকাশে ওড়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারে না আমিরুদ্দি। রাজহাঁসটা তাকে নামিয়ে দেয় একটা তেমাথার মোড়ে। বলে, এখান থেকে নাককাটিতলা যাওয়ার রাস্তা আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে। আমি সেখানে যেতে পারব না। বলতেও পারব না। বারণ আছে।

বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমিরুদ্দি। অদ্ভুতভাবে এই মোড়টাও জনশূন্য। কোথাও কেউ নেই। নাককাটিতলা যাওয়ার রাস্তা কোনটা, সে তাহলে চিনবে কী করে? কে বলে দেবে? যে তিনটে রাস্তা এসে মিশেছে এই মোড়ে, সব রাস্তা একই রকমের! এর মধ্যে নাককাটিতলার রাস্তা কোনটা, সে বুঝবে কী করে?

মোড়ের মধ্যিখানে যে গোলাকার জায়গাটা! একদা যেখানে কোনো মহামানবের মূর্তি বসানো ছিল! রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! রাজহাঁসটা সেখানেই তাকে নামিয়ে দিয়ে আবার উড়ে গেছে আকাশে।

আমিরুদ্দি এক-এক করে তিনদিকের তিন রাস্তার দিকে চাইছে। যদি কোনো পথিক আসে! জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে নাককাটিতলার রাস্তা কোনটা? কিন্তু কোনো দিক থেকেই কেউ আসে না। অগত্যা সে কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে মহামানব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

তবে বেশিক্ষণ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। একটা খুনখুনে বুড়ি কোথা থেকে নিঃসাড়ে এসে তার গলায় একটা জবাফুলের মালা পরাতে যায়। আমিরুদ্দি চমকে ওঠে। প্রথমে দুপা পিছোলেও শেষপর্যন্ত এক পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, কে আপনি! আমার গলায় মালা পরাচ্ছেন কেন?

– তুই আমার কোখের ধন বেটা। আমি যে তোর মা!

মা! কোন মা? নিজের মা, না দাইমা? নিজের মাকে তো সে চোখেই দেখেনি! নিজের মায়ের কথা মনেও পড়ে না। তবে দাইমাকে মনে পড়ে। দাইমাকে সে দেখেছে। এরকমই খুনখুনে বুড়ি ছিল। মাথায় যে-কটা চুল ছিল, দেখে মনে হতো পাটের ফেস্যা। কিন্তু সেও কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে। তাহলে সাদা চুলের যে খুনখুনে বুড়ি মালা হাতে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে, কে এ?

আমিরুদ্দি ভাবতেই আছে, ‘ভালো থাকিস বেটা’ বলে বুড়ি ততক্ষণে তার গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছে। কেউ কোথাও নেই। অথচ হাজার হাজার করতালির আওয়াজ। আশ্চর্য! কারা করতালি দিচ্ছে? আমিরুদ্দি আবার চারদিকে চায়। দেখে কোথাও কেউ নেই। এমনকি সাদা চুলের খুনখুনে বুড়িটাও।

চাঁদফকিরের কথা মনে পড়ছে আমিরুদ্দির। দেখিস বাছা! পথে অনেক বাধা আসবে। পরোয়া করবি না, বিপদ আসবে। ভয় পাবি না। মনে সাহস রেখে-বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাবি। যেখানে সেখানে ফালতু সময় বরবাদ করবি না। তাহলেই দেখবি ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে গেছিস।

চাঁদফকিরের কথা হুবহু মিলে যাচ্ছে। তার মানে সে তাহলে তার গন্তব্যের খুব কাছাকাছি। চাঁদফকিরের কথামতো ফালতু এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না আমিরুদ্দি। তার মনে পড়ছে আখড়ায় বসে চাঁদফকির আরো বলছিল নাককাটিতলার মাহাত্ম্যের কথা। মানুষ যে-ইচ্ছা নিয়ে যায়, তার সে-ইচ্ছা পূরণ হয় নাকি! কোনো মানত মানতে হয় না। কোথাও ফুল বা চাদর চড়াতে হয় না। শুধু মানুষের ভিড়ে হেঁটে বেড়ালেই হয়। ক্লান্ত মনে হলে কোনো একটা দোকানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলেই হবে। সে চায়ের দোকান হোক কিংবা সেলুন! কেউ যদি কোটি টাকার মালিক হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে সেখানে যায় সে কোটিপতি হবে। অনেকে হয়েছে নাকি! প্রমাণ আছে।

আমিরুদ্দি অবশ্য কোটিপতি হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে সংসার ত্যাগ করে আসেনি। সে এসেছে একটু শান্তি পেতে। যদিও চাঁদফকিরের আরো কিছু কথা তার মনে পড়ছে। সামান্য একটু জায়গা, শয়ে, শয়ে লোক! কেউ পান চিবোচ্ছে। কেউ বিড়ি টানছে। কেউ কেউ চায়ের দোকানে বসে বকবক করছে। অনেকেই লুচি-পুরি-মিষ্টির দোকানে ভনভন করছে। একটা ভাতের হোটেল আছে, কিছু লোক সেখানে ভাত খেতে ঢুকছে। এসব করতে করতে সবাই কিন্তু কারবার করছে। কী কারবার, কে জানে! এমনিতে কোনো কারবারই নেই। থাকলেও চোখে দেখা যায় না। অবশ্য ওই ভিড়ে সুন্দরী সব মেয়ের ঘোরাফেরা দেখলে তা অনুভব করা যায়।

আরো অনেক কিছু বলেছিল চাঁদফকির। এখন সব কথা মনে নেই। আসল জায়গায় পৌঁছালে হয়তো মনে পড়বে। মনে পড়বে কী, তখন তো সে নিজের চোখেই দেখবে সব! এমন ভাবনা থেকে তিনটে রাস্তার একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে আমিরুদ্দি। কয়েক পা হাঁটতেই দেখে সামনে একটা কাঠের ফাটক। পাল্লা নেই। খালি পেল্লাই সাইজের চৌকাঠ আছে। সেই চৌকাঠে আশ্চর্য কারুকাজ করা। কত রকমের পাখির ছবি! সাপের ছবি! বাঘের ছবি! ঘন জঙ্গল! এমনকি, সমুদ্র, তিমি-হাঙরের ছবিও আছে! মরুভূমি-উট আছে পর্যন্ত! পাহাড় আছে-পর্বত আছে। গোটা পৃথিবী যেন ওই চৌকাঠে স্থান করে নিয়েছে। নেই বলতে শুধু মানুষ।

ফাটকের সামনে দাঁড়িয়ে আমিরুদ্দি চৌকাঠের সবকিছু খুঁুটিয়ে দেখছে। তার বাইরের কোনোকিছুতে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ভাই – সরে দাঁড়া! নয়তো ভেতরে যা! পথ আটকে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? আমিরুদ্দি এতক্ষণে খেয়াল করে। চৌকাঠের সাপটা তার সানে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে তাকে পথ ছাড়তে বলছে! ভয়ে পথ ছেড়ে দেয় সে। আর সাপটা হিস-হিস শব্দ করতে করতে চৌকাঠ ছেড়ে বেরিয়ে বাইরে কোথায় মিলিয়ে যায়।

এরপর আমিরুদ্দি ফাটকের বাইরে ফালতু দাঁড়িয়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে না। চাঁদফকিরের কাছে শুনেছিল, নাককাটিতলার বর্ণনা। কিন্তু ঢোকার মুখে ভয়ংকর এই ফাটকটার কথা তো চাঁদফকির তাকে বলেনি! সেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি যদিও। তবে এখন তার মনে হচ্ছে, নিশ্চয় ফাটকে আঁকা ছবির চাইতেও ভয়ংকর ওই নাককাটিতলা!

যত ভয়ংকর হোক, এসেছে যখন – ভেতরে ঢুকবে সে। ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখবে।

আমিরুদ্দি দেরি করে না, ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারপর সে যা প্রত্যক্ষ করে, তাজ্জব না হয়ে পারে না। সত্যি ছোট একটা বাজারের মতো জায়গাটা। সেখানে নানা রকম জীবজন্তু গিজগিজ করছে। যদিও তাদের মধ্যে একটাও মানুষ নেই। তবে দোকান-পাশার আছে। বেশিরভাগ পান-বিড়ির ঢপ। হাতি-ঘোড়া, গরু-মোষ, ছাগল-ভেড়া সবাই পান চিবোচ্ছে। গাধা-খচ্চর বিড়ি টানছে। দু-একটা চায়ের দোকান। সেগুলিতে যত রাজ্যের কাকপক্ষীর ভিড়। কিচিরমিচির করছে। একটা মিষ্টির দোকান। মাছি, মৌমাছি, ভ্রমরার গুঞ্জন সেখানে। একটা লুচি-পুরির দোকান। খরিদ্দার কুকুর-শেয়াল। একটা সেলুনও আছে। ভালুক-শিম্পাঞ্জির লাইন সেখানে। ফুটপাতে বসে জুতো সারাই করছে কটি বাবুইপাখি। একটা বাবুই বাচ্চা তো রীতিমতো একটা আরবি ঘোড়াকে জ্ঞান দিচ্ছে, মানুষের চামড়ার জুতা পরে পাওয়ার দেখিয়ে বেড়াবা সেই জুতা ছিঁড়বে না তো কী? তাছাড়া মানুষের চামড়া কত দামি তোমার কোনো ধারণা আছে! এই চামড়া যখন মানুষের শরীরে ছিল, কত নামিদামি কোম্পানির ক্রিম মেখেছে। আর জুতা হওয়ার পর তুমি আজ পর্যন্ত কী মাখিয়েছ? ঘোড়াটাও পাল্লা দিয়ে বলছে, মানুষের চামড়া সম্পর্কে আমার ধারণা থাকবে না তো কার থাকবে? মানুষ আমার পিঠে সওয়ার হয়ে একদা দুনিয়া জয় করেছিল!

আমিরুদ্দি ভিড়ে ঘুরতে ঘুরতে সব দেখছে। সব শুনছে। তার মধ্যে হঠাৎ একটা ভাতের হোটেল চোখে পড়ল তার। আজব নাম হোটেলটার! ‘মায়া বিবির হোটেল’। জন্তু-জানোয়ারের ভিড়ে মানুষের নাম নয়, হোটেলটা দেখে আমিরুদ্দির ভাতের কথা মনে পড়ে। সেই কোন ভোরে বাসি পেটে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে! দুপুর গড়াতে চলল! এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। আশ্চর্যরকমভাবে খাওয়ার কথা ভুলে ছিল সে। কিন্তু এখন সেটা মনে পড়তেই পেটে প্রচন্ড খিদে অনুভব করল। ভাতের খিদে। হোটেলের নাম যত আজবই হোক, নিজেকে রুখতে পারল না আমিরুদ্দি। ঢুকে পড়ল হোটেলটার ভেতরে।

ক্যাশ-কাউন্টারে মাথায় টুপি পরা, দাঁড়িওয়ালা একটা হনুমান বসে আছে। নাককাটিতলায় ঢোকার পর আমিরুদ্দি অবাক হতে ভুলে গেছে। হরেক রকমের জীবজন্তুকে হোটেলে বসে খেতে দেখেও সে অবাক হয় না, সোজা ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, ভাত হবে?

– ভাত, ভাতার দুটোই পাবেন। আগে আসন গ্রহণ করেন।

কথা শুনে চমকে ওঠে আমিরুদ্দি। এ আবার কোন ধরনের কথা? যদিও বেশিক্ষণ চমকানোর ঘোর থাকে না তার। হনুমানটা একটু থেমে জিভ কেটে আবার বলে উঠল, কিছু মনে করবেন না। আপনি যে পুরুষ সেটাই খেয়াল করিনি। আপনি আবার ভাতার কী করবেন? আপনি তো নিজেই…, যাকগে – বসুন! যা খেতে ইচ্ছে হয় খান। তারপর অন্য কথা।

কিন্তু বসবে কোথায়? যা ভিড়! বাঘ-সিংহ-হাতি সবাই চেয়ার-টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে। কুকুর-শেয়াল পর্যন্ত। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না।

– বাবু, আপনি এখানে আসুন।

সুযোগ পেয়ে আমিরুদ্দি বসে পড়ে। তার সামনের টেবিলে এঁটো পাত। কার এঁটো পাত এটা? এখানে বসে কে খাচ্ছিল? কে তাকে জায়গা ছাড়ল? চোখ তুলে তাকাতেই দেখল পাশে একটা মেয়ে এঁটো হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমিরুদ্দি আবার সবকিছু ভুলে মেয়েটিকে দেখছে। কে এই মেয়ে? এই জায়গায়? এই ভাবে?

হঠাৎ একটা বাঁদর এসে দাঁড়ায় আমিরুদ্দির সামনে। হোটেল-বয়। জিজ্ঞেস করে, কী খাবেন বাবু? বলেন!

– ভাত। তারপর জানতে চায়, তরকারি কী হবে?

– ডাল। আলু পোস্ত। সজনেডাঁটা। মাছ নেই। খাল, বিল, পুকুরের জল উধাও। তাহলে মাছ থাকবে কী করে? সমুদ্র থেকেও মাছ উঠছে না। হাঙরের দেখাদেখি তিমিরাও আজকাল মাছ খাওয়া ধরেছে নাক! তবে মাংস পাবেন। মানুষের মাংস। দাম বেশি। আজকাল নাকি মানুষেরও আকাল দুনিয়ায়!

মানুষের মাংস! আমিরুদ্দি নিরামিশাষী। তার ওপর মানুষের মাংসের কথা শুনে শরীরটা তার কেমন গুলিয়ে ওঠে।  কোনো করমে বলে, মাছ-মাংস লাগবে না ভাই। নিরামিষ যা আছে তাই দাও।

বাঁদরটি চলে যায়। মেয়েটি আমিরুদ্দিকে বলে, যা ইচ্ছে হয় আপনি খান বাবু। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।

আমিরুদ্দি মেয়েটিকে ভাবছে। এই জীবজন্তুর ভিড়ে আবার মেয়ে এলো কোথা থেকে? মেয়ে নয়, পরী যেন! যেমন চেহারা, তেমনি শরীরের গঠন। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না।

ইতোমধ্যে হোটেল-বয় বাঁদরটি টেবিল পরিষ্কার করে পদ্মপতা বিছিয়ে এক হাতা গরম ভাত আজড়ে দিয়েছে। বাটিতে বাটিতে দিয়েছে ডাল, তরকারি। সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা-লেবু। মেয়েটির দিকে লক্ষ থাকলেও পেটের খিদেকে অস্বীকার করতে পারে না আমিরুদ্দি। খেতে শুরু করে।

মেয়েটি আবার এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। সে বুঝতে পারছে। প্রচন্ড গরম লাগছে তার। শরীরে ঘাম দিচ্ছে। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়েছে ফ্যান নেই। পকেট থেকে রুমাল বের করে গাল-কপালের ঘাম মুছবে কিনা ভাবে। হঠাৎ অন্য পাশ থেকে তেড়ে হাওয়া বইতে শুরু করে! কালবৈশাখি নয় তো?

আমিরুদ্দির খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে মেয়েটির দিকে চায় সে। বাড়ির কথা মনে পড়ে। বউয়ের কথা মনে পড়ে। যদিও বউ কখনো খাওয়ার সময় তার পাশে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে কিনা ঠিক মনে করতে পারে না।

– কী দেখছেন বাবু? আপনি নিশ্চিন্তে খান। হাতি খেতে খেতে কান নাড়ছে তাই হাওয়া বইছে জোর। খিদে থাকলেও আর ভাত খেতে পারে না আমিরুদ্দি। তবে হাতির কান নড়ানো হাওয়া খায়। হাওয়া খেতে খেতে চাঁদফকিরকে মনে পড়ে তার। চাঁদফকির গাঁজার ঘোরে উদ্ভট কিছু বলেনি, সঠিক গন্তব্যের খোঁজই দিয়েছে তাকে। শান্তির খোঁজ। পাপ কি পুণ্য – সেটা পরের কথা। আপাতত আমিরুদ্দি শান্তি ভোগ করছে।