‘গল্প-উপন্যাস’ – জীবন বিস্তৃতির এক সূত্রের নাম

আমি ল্যাটিন আমেরিকার উপন্যাস সম্পর্কে হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধের একটি লাইন দিয়ে শুরু করতে চাই, ‘ইতিহাস আর দর্শনের দুই প্রবল ঘোড়া উপন্যাসের কাছে বাগ মেনেছে।’ তিনি আগুনপাখি উপন্যাসের শেষে এসে এক নারীর জবানিতে বলছেন, ‘মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছেড়ে দেয়, আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলাম। শ্যাষে আমার একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি।’ এই যে জীবন দর্শন, দর্শনের সেই তল্পিতল্পা থেকে ইতিহাস, মানবমনের অলিগলি, প্রেম-ভালোবাসা, নিঃসঙ্গতা অথবা ব্যাপক আনন্দমুখর এক জীবনের গল্প – সবই উপন্যাস খুঁজে বেড়ায় এবং সর্বোপরি সময়ের ভেতর অসময়, অসংগতি – সবকিছুকে ধারণ করে।

গল্প মানুষের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলে, উপন্যাস আমাদের যাপিত জীবনকে কীভাবে অর্থপূর্ণ করে? গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছিলেন, ‘আমরা যে জীবন যাপন করছি তা কিন্তু আমাদের সত্যিকারের জীবন নয়। যে জীবনের কথা ভাবতে আমরা ভালোবাসি, যে জীবনের গল্প আমরা বারবার করি – সেটাই আমাদের প্রকৃত জীবন।’  নিঃসন্দেহে এই জীবন বলতে তিনি একজন অন্তর্লোকসমৃদ্ধ মানুষের জীবনের কথা বলতে চেয়েছেন। প্রশ্ন হলো, অন্তর্লোক ছাড়া কি মানবের জীবন হয়? দুই হাত-পা, নাক-কান,  চোখ-মুখের প্রাণধারণকারী মানুষটার জীবন কতটুকু প্রাণময় অথবা তার প্রাণটুকু কতটুকু জীবনময়? ততটুকুই যতটুকু তিনি গল্পকারে সাজানো তার জীবনের কল্পনা তথা স্বপ্নের কাছে বাস করেন। স্বপ্নকে রক্ত-মাংসে পরিণত করতে না পারলেও তার বিস্তৃত কল্পনা তাকে সেই স্বাদ দেয়, যার রসদ তিনি সংগ্রহ করেছেন গল্প-উপন্যাস তথা সাহিত্যের ভূমি এবং ভুবন থেকে।

আর সেই ভুবন সৃষ্টির জন্য একজন লেখক তার কল্পনাকে ভূমিষ্ট করাতে করাতে তাঁর নিজের জীবনকে কীভাবে বিস্তৃত করেন, আজ আমি সেই গল্প বলব। তার জন্য আমি বেছে নিয়েছি, আমার ত্রিমোহিনী নামের বিশাল উপন্যাসের সৃষ্টির প্রেরণার উৎস এবং কেন্দ্রকে। সত্যি বলতে কী, এটা শুনতে আশ্চর্য শোনাবে যে, এই উপন্যাস সৃষ্টির বীজ ছিল আমার শৈশব-কৈশোরে, আমার বড় হয়ে ওঠার গল্পে।

আমার মায়ের দাদা যাকে আমি ‘বড়বাবা’ বলে সম্বোধন করতাম, আশির অধিক বয়সেও যিনি অনেক ভোরে কয়েক মাইল হেঁটে এসে আমাদের সকলকে নিয়ে বসে নিজ হাতে বানানো ‘র’ বা ‘লাল’ চা দিয়ে সকাল শুরু করতেন, তিনি পৌষের শেষ বিকেলে নির্জন মাঠে নিয়ে গিয়ে সেই মাঠের গাছপালার ছায়াঢাকা এক টিলার ওপর মাদুর বিছিয়ে আমাকে শুইয়ে দিতেন। তারপর কাগজ-কলম নিয়ে তিনি নিবিড়ভাবে আকাশটাকে পর্যবেক্ষণ  করতেন। আর আমি পর্যবেক্ষণ করতাম তাকে। সাদা চুল-দাড়ির সৌম্যকান্ত সেই মানুষটার কাছে যেদিন আমি তাঁর এসব কর্মকা-ের কারণ জানতে চাইলাম সেদিন তিনি আকাশের দিকে আমাকে তাকাতে বললেন। আমি তাকে বললাম, আমি তো আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছি।

তিনি স্নেহভরে হেসে বললেন, আজ থেকে জেনো, আকাশ বলে কিছু নেই। যা আছে তা মানুষের জন্য কিছু নিদর্শনমাত্র। 

বলে তিনি নীল আকাশে তরমুজের গায়ের ফুটি ফুটি সাদা সাদা দাগের মতো এখানে-সেখানে ঘন হয়ে জমে থাকা মেঘ দেখিয়ে বললেন, আগামী বছর ১৩ চৈত্র বিকেল তিনটা ছত্রিশ মিনিটে দশ মিনিট ধরে শিলাবৃষ্টি হবে। এই আকাশ সে-কথা বলছে।

আমি তার কথা ক্লাস ডায়েরিতে টুকে রাখলাম এবং পরের বছর ১৩ চৈত্র পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। শিলাবৃষ্টি আর হয় না, কিন্তু আমাকে অবাক করে ১৫ চৈত্র বিকেল চারটা সাতচল্লিশ মিনিটে দশ মিনিট পর্যন্ত শিলাবৃষ্টি হয়। সে-কথাও আমার ডায়েরিতে লেখা আছে।

আসলে তিনি সারাবছরের আবহাওয়ার খতিয়ান তৈরি করতেন চৈত্রের আকাশ নিরীক্ষণ করে। প্রতি আড়াই ঘণ্টায় তিনি আগামী বছরের এক সপ্তাহ এবং আড়াই দিনে সমগ্র মাসের (চৈত্র মাসের আকাশ পর্যবেক্ষণ করে আগামী এক বছরের) চিত্র পেতেন। প্রকৃতি, আকাশ-বাতাসে এসব রহস্যময় ব্যাপার লুকিয়ে আছে দেখে আমার মনে হয়েছিল – এসবের যিনি স্রষ্টা তিনিও গল্প সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকেন। স্রষ্টার চেয়ে বড় গল্পকার আর কে আছে? বড় হয়ে বাইবেলে পড়েছি – ‘আসমান এবং জমিন একত্রিত ছিল। অতঃপর আমি তাদেরকে পৃথক করেছি এবং হে মানব, তোমাদের আমি সৃষ্টি করেছি ‘মা’ থেকে।’ (বাইবেলের এই একটা ভার্স পরিবর্তিত হতে দেখা যায় না। আল-কোরানের আয়াতেও এই একই বাণী আমরা পাই।) বিজ্ঞান বলছে – লাখ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে কোনো গাছপালা ছিল না। ছিল উত্তপ্ত মরুভূমি এবং সাগর। কাঁকড়াই ছিল তখন বিশ্বের প্রতিভূ এক প্রাণী। টন টন সাইজের কাঁকড়াগুলো, বিশেষত চাঁদনি মরুভূমিতে উঠে আসত। পাহাড়সম কাঁকড়ার শরীরে লেগে থাকত সাগরের শ্যাওলা। সাগর-কিনারে কাঁকড়ার শরীর থেকে জল-শ্যাওলা ঝরলেও তা ছড়াত আরো দূর পর্যন্ত। শিকারি মাছের অত্যাচারে ছোট মাছগুলোও কিনারে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে মরুভূমিকে জল-শ্যাওলার সন্ধান দিয়েছিল। সেই শ্যাওলাগুলোই কালে কালে গুল্ম থেকে তৃণ, তৃণ থেকে লাখ লাখ বছর ধরে গাছ হয়েছে। মরুভূমির কার্বন ডাই-অক্সাইড খেয়ে সেই গাছগুলোই একসময় বাতাসে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়িয়েছে। তৈরি হয়েছে আয়নোস্ফেয়ার, স্ট্রাটোস্ফেয়ারসহ সাতটি বায়ুস্তর। আল-কোরানের সুরা হুদে বলা হচ্ছে –

‘আমি মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছি সময়ের ছয় স্তরে। প্রথম স্তরে আমার অবস্থান/আসমান (আরশ) ছিল জলের উপরে।’

অর্থাৎ সাগরের/ জলের উপরিস্থলটুকু যদি আকাশ হয়, তাহলে সকল প্রাণের অস্তিত্ব ছিল পানির ভেতর।

আস্তিক-নাস্তিক সকলের জন্য সৃষ্টির চেয়ে রহস্যময় ব্যাপার তাহলে আর কিছুতেই তো নেই! যৌবনপ্রাপ্তির পর সৃষ্টিরহস্যের এই ভাবনা যতবার আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে ততবার আমার মনে হয়েছে – সৃষ্টি আসলে স্রষ্টার/ প্রকৃতির এক অনন্য গল্পের বুননমাত্র। স্রষ্টা হিসেবে যিনি যত শক্তিশালী তার গল্পের বুনন তত দূর থেকে প্রক্ষেপিত। প্রকৃতি অথবা স্রষ্টা আমাদের সামনে মেলে ধরে রেখেছেন রহস্যময় এক গল্পের বুনন। স্রষ্টা তাঁর গল্পকে সাজিয়ে রেখেছেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে আকাশের ঊর্ধ্বসীমানায়। তাঁর গল্পকে ধরার জন্য তিনি এ-মহাবিশ্বকে সাজিয়েছেন সুমহান ব্যাপকতায় এবং মানুষের মাঝেও কাউকে  কাউকে তিনি ভিন্নতর এবং শক্তিশালী সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্রের  ঐন্দ্রজালিক শক্তি দিয়ে (আসলে চক্ষুষ্মান করে) তার গল্পের কিছু রহস্য উদ্ঘাটন করান। আইনস্টাইন আলোর রশ্মির মাঝে বস্তুকণা দেখেন। আর একজন শিল্পী/ গল্পকার গল্পের ভেতর দিয়ে মানুষের জীবনকে, মানবজন্মের সার্থকতার, অর্থবহতার স্থানটুকু আবিষ্কার করতে চান। গল্পের চেয়ে সেজন্যই কোনো হিতোপদেশ অথবা  মহাবাণী মানুষের মননে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে না। জ্বালতে পারে না এমন কোনো আলো, যা দিয়ে সে-রহস্যময় এই জগৎ ও জীবনের অন্ধকার তলটুকু আমরা দেখে নিতে পারি। তাহলে কেমন হওয়া উচিত গল্প বলার ধরন এবং তার গভীরতা? এই প্রশ্ন যৌবনের প্রারম্ভ থেকে অদ্যাবধি আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।

আমার বড়বাবা সবসময় আমাকে একটা কথা বলতেন, আগামীকে গোনার জন্য বর্তমান আর অতীতকে নিবিড়ভাবে জানাটা জরুরি। অতীতকে না জানলে স্বপ্নের বুনন সঠিক হয় না। তিনি আমাকে দ্রোণ ফুল থেকে প্রতিটি বৃক্ষলতাকে চিনতে শিখিয়েছিলেন।  সেইসঙ্গে তিনি আমাকে শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন সেগুলোর ঔষধি গুণাগুণ।  তিনি আসলে গভীর মমতায় এই বৃক্ষলতাদি আর প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোর মাঝে মগ্ন হতে ভালোবাসতেন বলেই ছিলেন চিরতরুণ। তার কারণেই আমি বুঝতে শিখেছি, মগ্নতা ছাড়া ভালোবাসা হয় না। চলায়-বলায় ‘ভালোবাসা’ শব্দটিকে তার সত্তায় স্পষ্ট করে রাখা সেই চিরতরুণ মানুষটা আমার জীবনের একটা দর্শন স্পষ্ট করেছিলেন – বয়সী হওয়া মানেই ভালোবাসা অথবা মগ্নতাহীনতা নয়, বরং মগ্ন হতে না জানলেই মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজের অন্তর্লোকের দিকে তাকিয়ে নিজেকে খোঁজার প্রবণতা হারিয়ে তিনি এক পলায়নপর মানুষ হয়ে ওঠেন। বড় মানুষদের জীবনের এইসব দর্শনকে তিনি আমার কাছে স্পষ্ট করেছিলেন, তাদের লেখা গল্প বলে বলে।

তারপর তিনি আমাকে ভারতবর্ষে মানুষের গমনাগমন বা অভিপ্রয়াণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রিন্স ফিলিপ কর্তৃক ম্যাসিডোনিয়া আক্রান্তের পর কীভাবে গ্রিসের মানুষজন সাগর পেরিয়ে প্রথমে তুরস্ক এবং পরে ইরানের ভূমি হয়ে পরিশেষে এই ভারতবর্ষে আগমন করেছিলেন গল্পচ্ছলে তা বলেছিলেন বলেই হয়তো আমি আমাদের অতীত জাতিসত্তার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহান্বিত হয়েছিলাম। হাজার-হাজার বছর আগে ভারতবর্ষের ভৌগোলিক ইতিহাস কেমন ছিল? এই ভূমি দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার সঙ্গে একত্রে পাঞ্জিয়া মহাদেশ নামে টেথিস সাগরের ৬৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল – তার ইতিহাস খুঁজতে গিয়েছিলাম। আমার বড়বাবা সবসময় বলতেন, তুমি অতীতকে ভালোভাবে না জেনে ভবিষ্যৎকে সহজে দেখতে পাবে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বলো, স্বপ্ন দেখা বলো, কোনো কিছুর সঠিক মাত্রা সম্পর্কে তুমি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে উঠবে না, যদি তুমি তোমার অতীত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না রাখো।

পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শ্রেণি – এই দুই বছর নানাবাড়িতে থাকার কারণে আমি ছিলাম তাঁর নিত্যসঙ্গী এক বন্ধু। আজ মনে হয় এই দুই বছরেই তিনি তাঁর জীবন থেকে পুরো সময়টুকু আমাকে দান করেই যাননি, বরং তিনি সবকিছুর দিকে নতুন করে তাকানোর জন্য খুলে দিয়ে গিয়েছেন আমার চোখ আর অবারিতভাবে ওড়াউড়ি শেখার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে গিয়েছেন আমার দুই ডানাকে। তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায়, মৃত্যুর আগে এক শনশন হাওয়ার পূর্বাহ্নে আমাকে কাছে ডেকে বললেন –

তুমি কি জানো মৃত্যু কেমন? আমি ভীতু চোখে সবিস্ময়ে তার দিকে তাকাতেই তিনি স্নেহভরে হেসে বললেন,

মৃত্যু এক মাথা ন্যাড়া করা নারী। ওই যে ঘরের ছাদের কোণে আমাকে নিতে এসে সে চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার পেছনে যেন হাজার আয়নায় প্রতিসরিত তার বিভিন্ন বয়সের ছবি বিস্তৃত হয়ে আছে কয়েকশো মাইল ধরে। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, শিশু-শিশু চেহারার মাথা ন্যাড়া করা অনেক নারীর হাতে ধরে থাকা আয়নাগুলোতে আমার পুরো শৈশব দেখতে পাচ্ছি বলে বড় খারাপ লাগছে, বাবা। শুধু মনে হচ্ছে, আমি সেদিনের এক শিশু অথচ আমার চলে যাবার সময় হলো! তুমি সোমবার সকালে কোথাও যেয়ো না। আমি সেদিনই চলে যাবো।

সোমবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি জানতে পারি, তিনি আর নেই!

মনে হয় আমার জন্ম তারই সঙ্গে ১৯০২ সালের এক আষাঢ়ে, ঊনত্রিশ সালের ভয়াবহ বন্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতভাগ, ভাষা-আন্দোলন এবং পরিশেষে ’৭১ যেন ঘটে গিয়েছে আমার চোখের সামনে। তিনি আসলে আমার অনুভবে এসব ভাবনাময় দৃশ্যকল্প ঢুকিয়ে লম্বা করে দিয়েছেন আমার জীবন।

এর অনেক পরে আমার এক নানা, (মায়ের মামা) বলে বসলেন যে, তার আয়ু আছে আর ছয় মাস। বলে তিনি ট্রাঙ্ক থেকে তার একমাত্র প্রিয় শালটি বের করতে বললেন এই বলে যে, আগামী ভাদ্র মাসে তিনি মারা যাবেন এবং আগামী শীতে শালটির উষ্ণতা তিনি আর নিতে পারবেন না। গরমের মধ্যেই সেই শাল গায়ে জড়িয়ে তিনি যখন এমনকি বাজারও করতে লাগলেন, তখন গ্রামের মানুষ তার মাথা নষ্ট হয়েছে বলে হাসাহাসি আরম্ভ করল। তাদের হাসিঠাট্টাকে পাত্তা না দিয়ে তিনি তার কবর নিজ হাতে খুঁড়লেন, বাঁশ কেটে কবরের মাপমতো সেগুলো কেটে যখন প্রস্তুত করছেন সবাই তখন তাকে এক ঘোরতর পাগল আখ্যায় আখ্যায়িত করে হাসাহাসি বন্ধ করল। তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় ফিসফিসে গলায় ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে তাকে নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। এই ফিসফিস পাড়ায় পাড়ায় বাতাসের কানে কানে ছড়িয়ে পড়লে এক সন্ধ্যায় তিনি বললেন, এইরকম মোহনীয় সাঁঝ দেখার সৌভাগ্য তার জীবনে আর বেশিদিন হবে না। এরপর সবাইকে হতভম্ব করে তিনি মারা গেলেন তার মৃত্যু নিয়ে প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর ঠিক ছয় মাস পর!

আমি তখন নবম শ্রেণিতে। বাংলার শিক্ষক, ক্লাসে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘বই পড়া আমাদের কীভাবে উপকৃত করে?’ আমি অনেক বই পড়তাম বলে সেদিন সবার শেষে তিনি আমাকে প্রশ্নটা করেছিলেন, ‘বই আমাদের জীবনকে লম্বা করে দেয়’ – আমার এমন উত্তরে সেদিন পুরো ক্লাস হো-হো করে হাসলেও অনেক ছাত্রের অনেক উত্তরের মধ্যে তিনি আমার উত্তরকেই যখন সেরা বললেন তখন আমি নিজেই ভাবতে শুরু করেছি, বই আসলেই কি জীবন লম্বা করে দেয়? এখন স্যারের মতো আমিও বুঝি, ছোট্ট রাফির উপলব্ধি থেকে বলা উত্তরটি হয়তো ভুল ছিল না।

আমি কি ত্রিমোহিনী উপন্যাস লিখেছি এই কারণে যে, আমার পাঠকরা আমাদের সমৃদ্ধ অতীতটুকু জানার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠুক এবং অতীতের সঙ্গে, আমাদের ঐতিহ্য-কৃষ্টি, সংস্কৃতি এমনকি পু-্র সভ্যতা থেকে মহান ভাষা-আন্দোলন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত তাদের আত্মার যোগসূত্র স্থাপিত হোক যা বিস্তৃত করবে তাদের জীবনের বোধগুলোকে? আমি কি এই ভূমির সন্তান হিসেবে কোনো এক দায়বদ্ধতা থেকে  সৃষ্টি করেছি এমন এক উপন্যাসের, যেখানে ভূগোল-ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা-আন্দোলন অথবা স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে? আমি কি নিজেকে বলতে চাই, এই যে ঐতিহ্যম-িত আর সমৃদ্ধ আমার শহরে মানুষে মানুষে, বংশপরম্পরায় বয়ে চলা যে-বাস্তবতা সেটা সত্যি নয়, আমার সামনে প্রতিদিন ছুটে চলা মানুষের জীবনটাই শুধু জীবন নয়; বরং সত্য হলো, আমার উপন্যাসে মূর্ত জীবনপ্রবাহের জগৎ! কী জানি, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ অতীতের এই জগৎটাকে তলিয়ে দেখার এই প্রয়াসই ছিল হয়তো আমার ত্রিমোহিনী উপন্যাস সৃষ্টির মূল প্রেরণা। আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীত এবং আমাদের মহান পূর্বপুরুষদের জীবন এবং অনুভবের সঙ্গে বসবাসের এক অমোঘ ইচ্ছাও হয়তো অতীতের ভেতর ডুব দেওয়ার জন্য আমাকে হাতছানিতে কাছে ডেকেছিল। আর সেই ইচ্ছাটুকু তৈরি হয়েছিল গল্পের জগৎকে আকুলভাবে ভালোবাসার কারণেই।

এই যে, মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ধরে মগ্ন হয়ে একটা সৃষ্টির মাঝে ডুবে থাকা, অতঃপর একজন ঔপন্যাসিকের জীবনে প্রাপ্তি কী? ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির ব্যাপক প্রসার ছাড়াও প্রযুক্তির লাগামহীন ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মূল্যবোধে ধসনামা এক সমাজে তাঁর উপন্যাসটি কতটুকু পঠিত হবে – এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাওয়া একজন ঔপন্যাসিক অথবা গল্পকারকে পরিশেষে মানবের নন্দনতাত্ত্বিক অভিযানের আনন্দটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় এই ভাবনায় যে, কোনো একদিন তাঁর সৃষ্টির মাঝে মানুষ হয়তো আশ্রয় খুঁজে ফিরবে।  আমি মনে করি, আত্মিক উন্মেষের এসব আনন্দ একজন ঔপন্যাসিকের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

একটা কথা না বললেই নয়, ত্রিমোহিনী শব্দের সঙ্গে যত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই আসুক, ইতিহাসকে কখনো আমার গল্পের চেয়ে আমি বড় হতে দিতে চাইনি। অষ্টম শতাব্দীর জয়াপীড় এবং নর্তকী কমলাকে নিয়ে তেমন কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং তাদের নিয়ে আমি আমার কল্পনাকে বল্গাহীন করে দিয়েছি এতটাই যে, আমি দেখিয়েছি স্নাত এবং স্বল্পবসনা কমলা, কেশব-বসনার নাচের সমুদ্র থেকে উত্থানের মুদ্রাটি দেখিয়ে মুগ্ধ করছেন জয়াপীড়কে।

আমি কথা শুরু করেছিলাম জীবনকে বিস্তৃত করার গল্প/ মন্ত্র নিয়ে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুরনো পুকুরটার আশপাশের জমি কেটে আরো বড় করা হয়েছে; কিন্তু অনেককাল আগের ছোট্ট জঙ্গলটিকে রক্ষার জন্য পুকুরকে সোজা না করে কিছুটা ভেতরের দিকে এখনো কেউ কাটতে দেয়নি। এর পেছনে রয়েছে এক রহস্য। 

আমি তখন খুব ছোট্ট। একবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেই রহস্যময় ছোট্ট জঙ্গলটার কথা। তিনি গল্পচ্ছলে কথাগুলো বলেছিলেন। গ্রামের বাড়িতে সেই জঙ্গলের আগে রয়েছে কিছু তালগাছ আর বাঁশঝাড়। ছোট্ট আমাকে কোলে নিয়ে সেখানে এক সন্ধ্যায় দাঁড়াতেই মা দেখলেন, তালগাছের ঠিক মাথার ওপর থেকে বড় এক ধূমকেতু  প্রলম্বিত করে দিয়েছে আমার আর মায়ের ছায়াকে, যে-ছায়া বাঁশবাগান পেরিয়ে আরো অনেকদূর দূর হয়ে তার চোখের সীমানা ছেড়ে যখন অসীম, তখন মা আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন। মায়ের ধারণা, ঝড়–র মতো পাঁচটা লেজবিশিষ্ট ধূমকেতু আমার সঙ্গে এখনো বাস করে। সেই ধূমকেতু আর কিছু নয় – তা আসলে আমার কল্পলোকের সঙ্গে কথা বলা এক শক্তি, যার প্রভাবে আমিও গল্প লিখি! প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোতে যে-গল্প জড়িয়ে যায় তা ব্যক্তিবিশ্বাস থেকে লোকবিশ্বাস এবং পরিশেষে তা-ই মিথ হয়ে যায়।

বাবার মুখে শোনা আরো একটি গল্প। এক ভরা পূর্ণিমার সাঁঝবেলা পেরিয়ে গেছে। সেই বনের পাশ দিয়ে বাবা মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি জোছনার

আলো-আঁধারির মাঝে বনের ভেতরে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখে দ্রুত বাড়ি ফিরে এলেন এবং আমার দাদিকে হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

মা, তুমি এখানে?

দাদি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই বাবা পুনরায় আমার দাদিকে জিজ্ঞাসা করলেন,

কিন্তু আমি তো দেখলাম, তুমি আব্বাজানের সঙ্গে শরতলায় বসে গল্প করছ। তোমাদের সঙ্গে আরো রয়েছেন …

বাবা গ্রামের এমনসব লোকের নাম বললেন, যারা অনেক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। দাদি তাকে শক্ত করে এক ঝাঁকুনি দিলেন এবং হেসে বললেন, শরতলার ভূত দেখি আজ বাড়ি পর্যন্ত এলো। তোর বাবা তো আরো এগারো বছর আগে মারা গিয়েছেন!

বস্তুত গ্রামের মানুষ মৃত যেসব আত্মাকে সেখানে মাঝে মাঝেই গল্পের ঘোরে আবিষ্কার করতেন তারা জীবিতাবস্থায় গ্রামের মানুষদের গল্পের মাঝে বুঁদ করে রাখতেন। যেমন, মেছো ভূত মাছ অথবা ভাত চাইতে এলে গ্রামের মানুষ তাদের হাতে গরম শীল দেওয়া মাত্র সেই ভূতগুলো দৌড়ে পালাত ওই শরতলায়। এসব গল্পের কারণেই সেই শরতলা গ্রামের মানুষের কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিল আর সেই কল্পনা এতটাই জীবন্ত যে, তারা মৃত হলেও নিঃসঙ্গ ভাবনায় অথবা হিসাব না মেলা জীবনের ভার লাঘবে মনে মনে তারা প্রিয় সেসব গল্পবলিয়ের গল্প শুনতে চাইতেন।

জীবন এমন কোনো গল্প খুঁজে ফেরে, যেখানে জীবন ‘অনন্ত’, কল্পনা অবারিত আর আত্মা দারুণভাবে তৃপ্ত। গল্প এবং গল্পের দৃশ্যকল্প আমাদের মননে যে আলো জ্বেলে রাখে, করে চক্ষুষ্মান তা-ই আমাদের তাড়িত করে স্বপ্নের কাছে ফিরে যেতে। স্বপ্নময়তার ঘোর এতদূর বিস্তৃত হয় যে, আমরা আমাদের হারিয়ে প্রিয় মানুষদের আত্মার স্পন্দন অনুভব করি। আমাদের জীবন হয়ে যায় বিস্তৃত।

ত্রিমোহিনী উপন্যাসের প্রধান সব চরিত্র কল্পিত। আমার আত্মা থেকে উৎসারিত। গল্পবলিয়ে নামের এক চরিত্রের কথা মনে হলেই যখন মনে হয় প্রিয় করতোয়ার অস্তিত্বহীনতার কথা তখন হৃদয় শূন্য হয়ে আসে; কিন্তু আবারো মার্কেজের সুরে বলতে হয়,

‘ফুরিয়ে যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়। বুড়িয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু অথবা ভালোবাসাহীনতা নয়। সব হারিয়ে যায় এবং ফুরিয়ে যায় আত্মবিস্মৃতিতে।’

ভালোবাসতে না পারলেই মানুষ আসলে বুড়িয়ে যায় – এ এক চরম সত্য! সেজন্যই হয়তো ত্রিমোহিনী নামের উপাখ্যান সৃষ্টির এক প্রয়াস আমি নিয়েছিলাম, যার মাঝে ছিল অতীতকে খোঁজার নিখাদ ভালোবাসা। 

একজন ঔপন্যাসিক অথবা কথাশিল্পী জনমানুষের স্বপ্নগুলোকেই ফেরি করে ফিরে সময়ের অতলান্তে ছড়িয়ে রাখা তাদের হৃদয়-কথন থেকে। একজন গল্পকার/      কথাশিল্পী আসলে মানবার্তির  আত্মার সারথি।

সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বাবা-মায়েদের ভাবনালোকে ফেলেছে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব। তবু বিশেষত মায়েদের আমি বলব, তারা কি ভুলটাই না করেন যখন তারা তার শিশুকে একটা গল্পবইয়ের আনন্দ ভুবন অথবা একটা ফড়িং ধরার আনন্দ থেকে শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ে মগ্ন হওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আমাদের শিশুদের জীবন এখন একটা ঘাস অথবা গঙ্গাফড়িঙের চেয়ে বর্ণহীন। এই কালে আমাদের বাবা-মায়েদের কাছে সন্তানের শেখার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, তারা ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের পেছনে ছোটেন। যে-মাতা অথবা পিতা এই কাজটি করেন তিনি এক আত্মবিস্মৃত সন্তান উপহার দেন। পরিশেষে যে সন্তানদের অবৈধভাবে হলেও অর্থ উপার্জনের পঙ্কিল পথ চিনিয়ে দিয়ে এমন এক জাতি উপহার দেন যে, এই সন্তানরা পথের মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর মানুষের চেয়ে অর্থ উপার্জনের সংক্ষিপ্ত পথকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। জীবনের উৎসারণ ভুলে এই শিশুরাই বড় হয়ে যৌবন কাটায় এক ধরনের লিপ্সায় অথবা প্রায়শ্চিত্তের ভ্রান্ত ধারণায়। অতঃপর সেই ধনী সন্তানটি একদিন জীবনের অপরিসীম লিপ্সার ভ্রম থেকে, পাপের বোধ থেকে মুক্ত হতে দৌড় শুরু করে উলটোপথে। একদিনের ছোট্ট সেই শিশুটি জীবনের শেষপ্রান্তে পুনরায় নিষ্পাপ হওয়ার জন্য অঢেল অর্থ ঢেলে পুণ্যের পেছনে দৌড়ানোর সংক্ষিপ্ত মন্ত্র আবিষ্কার করে বস্তুত সমাজে তৈরি করে গলগ্রহ।  তার জীবন হয়ে যায় অর্থহীনভাবে সংক্ষিপ্ত। পুণ্যলাভের জন্য ধর্মান্ধ শ্রেণি তৈরি করাকে তারা বড় ধর্মীয় শুধু নয়, বরং বড় এক নৈতিকতার কাজ বলে মনে করেন। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণিকে চরমপন্থার পথ চিনিয়ে তারা স্বর্গের সিঁড়ি খুঁজতে থাকেন এইটুকু না বুঝেই যে, স্বর্গের সিঁড়িটা ছিল তার অন্তর্লোকে, যা সে হারিয়েছে বড় হয়ে-ওঠার প্রারম্ভিক ভ্রান্তির দিনগুলোতে। গল্প তার চোখ খুলে দেয়নি বলে তার পৃথিবীকে দেখাটা অন্তঃসারশূন্যতায় পর্যবসিত হয়েছে।

মায়েদের আমি বলব, তারা কী ভুলটাই না করেন, যখন তারা তাদের শিশুদের তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি না জানিয়ে ছোট্ট এক জীবনের অধিকারী করিয়ে দেন, যারা একদিন ঘুণাক্ষরেও তার পূর্বপুরুষদের কথা উত্তরসূরিদের কাছে উচ্চারণ করা দূরে থাকুক বরং তার মাতামহীর প্রসঙ্গকে অপ্রাসঙ্গিক বলে ঠিকাদারি বাবদ প্রাপ্ত অর্থকেই বড় করে দেখেন।

বাবা-মায়েদের আমি পরিশেষে বলব, আপনার শিশুর আত্মাকে সমৃদ্ধ করে দিন। তার হাতে বই দিন। তাকে ওড়াউড়ি শেখাতে যাবেন না। ওই কাজটা সে আপনার চেয়ে ভালো শিখে নেবে। গল্প-উপন্যাসের বুনন মানব স্নায়ুতন্ত্রে (যাকে আমরা বলি ‘মনন’) ফেলে রাখে জীবনকে লম্বা করে দেওয়ার এক গোপন মন্ত্র। সেই মন্ত্রটির গুরুত্ব আমরা যত দ্রুত অনুধাবন করতে শিখব, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল। জ্ঞানের পথে, জীবনের নন্দনতাত্ত্বিক অভিযাত্রার পথে আমাদের অগ্রযাত্রা তত অর্থবহ হয়ে উঠবে।  যে-জীবনের গল্প আমরা বারবার করি  সেই গল্পের সূত্র ধরেই আমাদের দর্শন সমৃদ্ধ হোক, কল্পনা অবারিত, স্বপ্ন অনিন্দ্য আর আমাদের সবার জীবন বিস্তৃত হোক।