গল্প যখন সমকালের ইতিহাস

মনির জামান

আওরাবুনিয়ার কাঁটা
সরকার মাসুদ

জিনিয়াস পাবলিকেশন্স
ঢাকা, ২০১২

৮০ টাকা
আশির দশকের কবি ও গদ্যকার সরকার মাসুদের নতুন গল্পগ্রন্থ আওরাবুনিয়ার কাঁটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, তিনি তাঁর দেখা সময়ের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করেছেন। এই ভ্রমণ মানসভ্রমণ নয়, বাংলার উত্তরের সীমা থেকে সাগর পর্যন্ত চলে যাচ্ছেন তিনি। আর ছত্রে ছত্রে বর্ণনা করছেন এই ভূভাগের মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের অকথিত গল্প, যে-গল্প পড়ে সারাক্ষণই মনে হবে – এ যেন আমারই জীবনাভিজ্ঞতার সুনিপুণ বিবরণ, যা শিল্পকুশলতার ছোঁয়ায় একান্তই সকলের।
সরকার মাসুদ প্রথমত কবি। তথাপি বলতেই হয়, আওরাবুনিয়ার গল্পগুলোতে তিনি বেরিয়ে এসেছেন জীবনের বিস্তৃত বয়ান নিয়ে। এটি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। প্রথম গল্পের বই দুরবিনের ভেতর দিয়ে – এর চেয়ে এ-বইয়ের গল্পগুলো অন্য মেজাজের। ওই বইয়ে সরকার মাসুদ ছিলেন কিছুটা নিরীক্ষাপ্রবণ। কবির ভাবালুতা ছিল দুরবিনের গল্পগুলোর মূল সৌন্দর্য। কিন্তু আওরাবুনিয়ার গল্পগুলো পড়ে মনে হলো, এ যেন অন্য এক গদ্যকার, যাঁর কাছে কথার ডালি আছে।
কথাসাহিত্যের যে বিস্তৃতি তা আছে এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একটানা বর্ণনার ভেতর দিয়ে নগর-গ্রাম সম্মিলিত জনপদের হাসি-আনন্দ সহসাই আকৃষ্ট করবে। আওরাবুনিয়ার কাঁটা বইটির গদ্য-প্রবণতা পাঠককে সহজিয়া গদ্যের স্বাদ দেবে – যেমন গদ্যের সন্ধানে থাকেন একজন তৃষ্ণার্ত গদ্যকার এবং একজন অনায়াস পাঠক।
এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের স্বরূপ নিয়ে আলাপ এসেই যায়।
যদি ওয়ালীউল্লাহর কথা বলি – তাঁর গদ্য ছিল নিরীক্ষাপ্রবণ, যা বাংলা গদ্যের এলায়িত ধারাকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে বিষয়ের অভ্যন্তরে টেনে নিয়ে যেতে চাইত। গদ্যের এ-প্রবণতা বাংলা গল্পে পরবর্তী সময় এমনই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল যে, আশি ও নব্বইয়ের গল্প হয়ে উঠেছিল বিশেষায়িত পাঠ্যবস্তু। সরকার মাসুদ গল্পের জটিল ভুবন থেকে নিজেকে বের করে এনেছেন। এমনকি গদ্যকারের কাব্যিক প্রবণতা থাকে, যা সরকার মাসুদের আগের বইটিতে ছিল, তা থেকে আওরাবুনিয়ার গল্পগুলো মুক্ত হয়ে ঋজু বর্ণনার ধারা তৈরি করেছে। বিপুল বর্ণনাই এ-গল্পগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে আমার মনে হয়েছে। একজন পাঠক আমাকে বলেছেন, এই লোক তো জার্নালিস্টদের চেয়েও তুখোড় গদ্য লিখতে জানেন। কথাটা সাধারণ হলেও একজন গদ্যকারকে বিশিষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য যথেষ্ট। সরকার মাসুদ কবি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ শাখায়ও তাঁর সমান মাত্রায় বিচরণ। তথাপি তাঁর টানা গদ্য নিয়ে যাবে সমাজের নানান ঘটনায়। বইটিতে সাতটি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো শুধু প্রকারে নয়, রচনাভঙ্গির ধারাবাহিকতায় আকারেও বৃহৎ। সরকার মাসুদের এই গল্পসম্ভার দেখে আরেকটা কথা বলতেই হচ্ছে, ঢাকার গল্প যেন সবসময় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতার অর্ধেক জুড়ে ছাপার জন্য ছোট আকারে লেখেন গল্পকাররা। গল্প যে বেশ বড় হতে পারে, আমরা তা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। সরকার মাসুদ আমাদের মনে করিয়ে দিলেন, গল্পেরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপট আর বিস্তৃত ভুবন থাকতে পারে।
মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতি, বিদেশের তলস্তয়, দস্তয়েভস্কিসহ বহু গল্পকার বড়বড় গল্প লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথেরও বিপুল আয়তনের বেশ কিছু গল্প আছে। আওরাবুনিয়ার কাঁটা গ্রন্থের গল্পগুলো ভুলে যাওয়া বড়গল্পধারার স্বাদ দেবে। হয়তো এগুলোই বড়গল্প। কেননা, বড়গল্পের গদ্য আর উপন্যাসের গদ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। সরকারের এই গল্পগুলো তেমনই সরস ভাষায় দীর্ঘ করে লেখা। প্রথমেই বলব ‘বাঘা ছকিয়তের মোড়’ গল্পটির কথা। ষোলো পৃষ্ঠার এ-গল্প। যেন একটা ভ্রমণাভিজ্ঞতার বর্ণনা। গল্পটিতে উলিপুরের দিকে যাওয়ার পথে লেখক আবিষ্কার করেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের এক যোদ্ধা ছকিয়তকে, যিনি বাঘা ছকিয়ত নামে বিলুপ্তির ভেতরেও কিংবদন্তি হয়ে আছেন। এই আবিষ্কার সহজ কথা নয়। আজকে প্রতিক্রিয়াশীলদের আন্দোলনের মুখে বাঘা ছকিয়তকেই যে আমাদের প্রয়োজন, সরকার মাসুদ তা যথার্থই বলতে পেরেছেন। দক্ষিণ বাংলার ধান-নদী-খাল আর মানুষের কর্কট জীবন উঠে এসেছে নামগল্প ‘আওরাবুনিয়ার কাঁটা’য়। এক জায়গায় বলছেন, বৃক্ষশোভিত নির্জন পাকা রাস্তা দিয়ে চলছে ত্রিচক্রযান। দুপাশে অফুরন্ত সবুজ ক্ষেত। মাঝে মাঝে কলাগাছের ঝোপঘেরা টিনের বাড়ি। রাস্তার দুধারে গাছপালা কোথাও কোথাও খুব ঘন হয়ে মাথার ওপর ছাতার আকৃতি নিয়েছে। এই বর্ণনা পর্যবেক্ষকের পর্যটকের। হয়তো এই গল্পগুলো সরকার মাসুদ লিখেছেন চিরন্তন এক পর্যটকের চেতনা থেকে। আর ‘বঙ্গশ্রী অপেরা পার্টি’ – নামটা শুনেই যে-কোনো পাঠক ঢুকে পড়তে পারবেন বাংলার অনন্য ঐতিহ্যময় যাত্রাপালার জগতে, যা আজ বিলুপ্ত। সরকার মাসুদ হয়তো স্মৃতি থেকে ধরে এনে নট-নটীদের আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। আজকাল দেখি, মুসলমানি আর আমেরিকান কালচার বাংলাকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। তারপর মাসুদের গল্পে পাই পূজামণ্ডপের ধ্বংসযজ্ঞ, যাত্রাপালাকারদের ক্ষয়িষ্ণুতা। তবু তাঁর স্মৃতিপূর্ণ পঞ্চাশ বছরের ভ্রমণাভিজ্ঞতা, – নিজের জীবন ও সমাজের সর্বত্র জুড়ে – সেখানে দেখি, এই বাংলা ছিল হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টানের সহাবস্থানের আপন নিবাস, যা ক্রমাগত এক দুঃখের স্মৃতি হয়ে ভেঙে পড়ছে। এই দুঃখ সরকার মাসুদের একার নয়, এই দুঃখ আমাদের সবার। এই দুঃখ চিরকালের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিটি বাঙালির। আওরাবুনিয়ার কাঁটা বইটি একজন পাঠককে নিয়ে যাবে বাংলার চিরন্তনতার ভাবনায়। এ-কারণেই যেন সরকার মাসুদ তাঁর গল্পের নাম দিয়েছেন ‘ক্ষুদিরামের শেষ যুদ্ধ’। এই যুদ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর কিংবা সম্প্রদায়ের নয়, এই যুদ্ধ আমাদেরকে করতে হবে আমাদের ভেতরকার অশুভ চিন্তার সঙ্গে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, ধর্মীয় আগ্রাসনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে একজন চান মিয়াকে নিয়ে। ‘শুক্লপক্ষের গল্পে’ গল্পকার বলছেন – চান মিয়া যে-রাতে মারা যায়, সেটা ছিল বৌদ্ধপূর্ণিমার রাত। আকাশে কোথাও এক ছিটে মেঘ ছিল না। কেউ কেউ বললো, চান মিয়াকে জ্যোৎøাবান মেরেছে। জ্যোৎøাবান কি সেটা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারল না। ঈশ্বরই একমাত্র জানেন, চান মিয়া কীভাবে ওপরে উঠে গেছে। কেন সে মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে অত সুদর্শন হয়ে উঠেছিল, তাও কেবল ঈশ্বর জানেন। এই ঈশ্বর আল্লাহ, গড বা ভগবান – যে কেউ হতে পারেন। 

সরকার মাসুদের গল্পসমগ্র বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার দলিল হয়ে পাঠকের হাতে ছড়িয়ে পড়ে বাংলার মননকে সমৃদ্ধ করুক, বইটি পড়ে তেমন আশাবাদ ব্যক্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে।