গোপন

নাসিমা আনিস

রসুনের খোসা বাতাসে ওড়ে, উড়তে-উড়তে রান্নাঘর ছাড়িয়ে ডাইনিং পেরিয়ে বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছে গেলে গিন্নি ভাবে, এতটা পথ অতিক্রম করে খোসা এলো কী করে! আশ্চর্য, বাতাস নাই, ফ্যান নাই, পায়ে-পায়ে! বইটা বন্ধ করে রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখে, ঠিক যা ভেবেছিল তাই। দুলির মা একটা ছড়ানো থালার ওপর খোসাসহ শুকনো রসুন কুচিয়ে রাখছে। কুচানো রসুনের খোসা জানালা দিয়ে আসা হালকা হাওয়ায় দোল খেতে-খেতে এই কান্ডটা করছে। বলে, কতদিন বলছি এভাবে রসুন কুচালে সারাবাড়ি খোসায় ভরে যায়, ধুয়ে নিলে এটা হয় না, কাজ শেষ করে আবার ঘর ঝাড়ু দাও। শেষ কথাটা বলার পরই মনে হয়, যাহ্, ব্যাপারটা তো ওর জন্য কষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু বন্দুকের গুলি আর মুখের কথার তো মানে একই, যা হওয়ার তা হয়ে যায় তখনি, ফিরিয়ে নেওয়া যায় না বিলকুল।

এতক্ষণে খেয়াল করে, দুলির মা আজকে একটা লাল আর হলুদ-মেশানো উজ্জ্বল শাড়ি পরে এসেছে, নতুন নয় যদিও কিন্তু শাড়িটা বেশ ঝলমলে। খুশি করার জন্যই জানতে চায়, তোমার শাড়িটা তো সুন্দর, আগে দেখিনি, নতুন?  উত্তর নেই, যেমন রসুন কুচোচ্ছিল তাই করে যাচ্ছে। কাজের লোকের ব্যাপারে এখন সবাই বেশ সতর্ক, এদের মন ভালো রাখতে হবে যে-কোনো মূল্যে। সে-অভিপ্রায়েই আবার বলে, দুলির মা, তোমার শাড়িটা সুন্দর, নতুন? ও এবার তাকায়, চোখে চোখ পড়ে, আবার রসুন কুচোয়। এক কেজি রসুন, এক কেজি আদা। কী জানি ও কী বিরক্ত হচ্ছে কি-না। না, ওর মুখ দেখে মন খারাপ মনে হচ্ছে না। কী একটা বলবে ভাব করতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, এই শাড়িডা আমার খুব খারাপ আপা, পরতে চাই নাই, পরনের শাড়ি

দুইডাই ছিঁড়ছে একলগে। এই একমাস এইডাই পরা লাগবো, রোজার মাসে যদি কারো বাড়ি থেইক্যা শাড়ি পাই তয় আর এইডা পরুম না।

আপা বলে, ক্যান, তোমারে তো সুন্দরই দেখাচ্ছে, নতুন বউ- বউ লাগছে। কে দিলো শাড়িটা?

– কে আর, হেই বেডি!

– কে?

– ওই মোগো দ্যাশেরই একজন।

দুলির মা এই বাসায় কাজ করে এক বছর। সবই করে সারা সকালে। খুন্তি-হাতা ঘুরিয়ে রান্নাটা কেবল আপা করে। আপা মাঝে মাঝে দু-একটা কথা জানতে চায়। দুলির মা উত্তর দেয়, দুলির বাপ আরেকটা বিয়া করছে, আমি ঢাকা আইসা পড়ছি, ব্যস। এর বেশি সে বলবে না, এইটুকু সতর্কতা মেনেই চলে।

‑দুই

ওর গ্রাম থেকে লঞ্চঘাট দেখা যায়, এমনি গ্রাম, আর লঞ্চে উঠলে সদরঘাটের দেখা মেলে দেড় দিন পর। জীবনের ভাঙাগড়ায় সুদূর সদরঘাটের বেশ ভূমিকা, সদর থেকে অন্দর পর্যন্ত ছেয়ে আছে দুলির মায়েরও।

বাপের বাড়িতে ওর এত দারিদ্র্য ছিল যে, একটা কাপড় কিনে দুটুকরো করে ফেলা হতো সঙ্গে সঙ্গে, গা ঢাকলে মাথা ঢাকে না। বিয়ে হলো যার সঙ্গে সে আরো গরিব, অর্থে এবং প্রাণে। দজ্জাল শয়তান শাশুড়ি পেল আর অলস স্বামী। শাশুড়ি আর স্বামী সারাদিন ভাঙা ঘরে বসে-বসে বউর গুষ্টি নিপাত করে আর ও যায় লোকের বাড়িতে কি চাতালে ধানের কাজ করতে। চাতালে যেতে চাইতো না, লোকগুলোর দৃষ্টি ভালো না, উপরন্তু স্বামী-শাশুড়ির খোঁটা, ওখানে নাকি বারো ভাতারের সঙ্গে ঢলাঢলি করে কাজ করতে ওর ভালো লাগে। আবার লোকের বাড়ির ধান ঝেড়ে কি চিটা উড়িয়ে দুই কেজি চাল নিয়ে বাড়ি ফিরলে এই অল্প রোজগারের জন্যও তাকে গঞ্জনা সইতে হয়। দেখতে-দেখতে বিয়ের সাতটা বছর কেটে যায় এই করে। সাত বছরে একটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে হয়। হাঁ-করা ক্ষুধা আরো বাড়ে, স্বামী-শাশুড়ির নির্যাতন কমে না একটুও। দুলির মা তখন কত ভেবেছে, চাতালে কী পরের মাঠে কাজ করতে যখন অসম্মান হয়, তো লোকটা কি সদরঘাটে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারে না। এই গ্রামের কত লোক সেখানে গিয়ে কাজ করে পয়সার মুখ দেখেছে, ভাতের মুখ দেখেছে। কিন্তু মনে যত কথাই থাক, মুখে বললে যে দুজনে পিটিয়ে তাকে আধমরা করবে তা ভালোই জানে। মায়ের এই অমানুষিক কষ্ট দুলি আর ছেলে আলাওল কিন্তু দেখে এবং কষ্টে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। পৃথিবীর দু-একটা জায়গা সৃষ্টিকর্তা সান্ত্বনাস্বরূপ রেখে দেয়, এটাও তেমনি। না হলে এত ছোট শিশুরা কী করে তা বোঝে!

দিন তবু এইটুকু খারাপে সন্তুষ্ট রইল না। নিজেদের ভাঙা ঘরের পাশেই চৌচালা ঘরে বাস করে গুয়ে-লেংড়ি আর তার স্বামী, মাঝে মাঝে মাংস রান্নার ঘ্রাণ আসে যে-বাড়ি থেকে। গুয়ে-লেংড়ি নাম এজন্য যে, সে একটা হাত আর একটা পা নাড়াতে পারে না। ভালো হাতটাও খাটো, পায়খানা করে পানি নিতে গন্তব্য নাগাল পায় না। যতক্ষণ অন্য কেউ তাকে পরিষ্কার না করায়, সে ওইভাবে অপেক্ষা করে বসে থাকে পায়খানায় আর বাড়ির লোকদের গালাগাল দেয়, চিৎকার করে। ওর স্বামীটাও দুলির বাপের মতো কিছু করে না, স্ত্রীসেবা ছাড়া। বাপ জমি-ঘরবাড়ি সব দিয়ে এই গরিব লোকটার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে কি এমনি-এমনি! এই শর্তে যে, তুই আমার মেয়ের সেবা করবি, ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা আমার।  তো বর্গাচাষিরা যে-ধান দেয়, তাতে তাদের দুজনের ভালোই চলে। এমনকি গঞ্জে গিয়ে দুদান জুয়ার তাস-পিটানো কি যাত্রা দেখা কি এক বোতল ফেনসিডিল সেবন করার মতো পয়সাও থাকে উপরি, যা নিয়ে লেংড়ি অশান্তি করে, রাতবিরাতে গালাগাল করে বাড়ি মাথায় করে। ইশ্, লেংড়া মানুষের গলায় এত জোর!

তো শ্রাবণ মাসের ঢলের সময়, খালেবিলে থইথই পানি। এমনকি উঠানের ছলছল পানিতে পুঁটি মাছ বুড়বুড়ি তোলে। বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। ঠিক সেই সময় কাঁঠাল খেয়ে ভেদবমিতে একদিন একরাত ভুগে লোকটা মারা গেলে লেংড়ির কপালে জোটে দুলির বাপ। ঘটক দুলির দাদি। দুলির মায়ের উপার্জনে এতগুলো মানুষের খাবার জোটে না। লেংড়িও খুব খুশি, গুয়েমুতে তার জীবন কাটাতে হতো এই বিয়েটা না হলে। এটাই তো বেঁচে থাকতে বাপ-মা চেয়েছিল! দুঃখ একটা অবশ্য লেংড়ির হলো, দুলির বাপটা কালো, খেংড়াকাঠি-কুৎসিত।

কিন্তু বেজায় বেজার দুলির মা। আগে কাজ করতো লোকের বাড়িতে কি চাতালে, এখন পাকাবান্দি লেংড়ি সতীনের। লোকের কাজে কষ্ট থাকলেও গ্লানি ছিল না। এখন মাথার ভেতর আগুন জবলে ঘৃণা আর গ্লানিতে। এদিকে পেরেশান লেংড়িও, এতগুলো মানুষ বসে-বসে তার বাপের জমির ভাত খাবে বিনাশ্রমে, তা কী হয়! তো লেংড়ি এবার একটা গাইগরু কিনে ফেলে। দুধ বিক্রির টাকা কয়টা দিয়ে যদি হাটবাজারটা হয়ে যায়, তাহলে একটু যা রক্ষা। কিন্তু কাজের লোক তো ওই একজনই, দুলির মা। রান্নাবান্না করা, লেংড়িকে গোসল করানো, খাবার খাইয়ে দেওয়া, গরুর গোয়াল কাটা, দুধ দুইয়ে সকাল-সকাল আড়ংয়ে পাঠানো বেচার জন্য, বিচুলি কাটা, ঘর ঝাঁট, ঘর লেপা… কত যে-কাজ আর সঙ্গে তিন-তিনটা মানুষের গঞ্জনা। চুন থেকে পান খসলে লেংড়ি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। তার সঙ্গে ভাতের খোঁটা। শাশুড়িও তাল দেয় সঙ্গে, স্বামী তো দেয়ই। আবার রাতে স্বামীর ভাগও লেংড়ির দখলে। সকালে লেংড়ির সহবাসের বীর্যবিষ্ঠা তাকেই ধুতে হয়, এমনি কপাল! যদিও এই একটা জায়গায় স্বামী তার দিকেই ঝুঁকে থাকে; কিন্তু দুলির মা কাছে ঘেঁষতে দেয় না অকম্মাটাকে। আর তার ফলাফল – সারাদিন আরো বেশি খিটমিট করে লোকটা। দুঃখে-কষ্টে-ঘৃণায় রাতদিন ফরিয়াদ চায়, কিন্তু মুক্তির রাস্তা পায় কই!

অবশেষে মাস ছয়েক পর শীতের বিকেলে স্বামী যাত্রা দেখতে গেলে সে মওকা পেয়ে যায়। বিকেলেই ফন্দি আঁটে। খাল থেকে গা ধুয়ে বাড়ি ওঠার সময়ই মাথায় আসে। নামা থেকে ধুতরার ফল তোলে লুকিয়ে। ফল সেঁচে রস বের করে রাখে নারকেলের মালাইয়ে। আজ লেংড়ির শেষ দিন। লেংড়াপায়ে আরাম করে খাওয়ার দিন তোর আজই শেষ! রান্না করে সন্ধ্যার আগেই শাশুড়িকে ভাত দেয়। সন্ধ্যা হতেই ছেলেমেয়েদের খাইয়ে নিজে খেতে বসে, যদিও উত্তেজনায় গলা দিয়ে ভাত নামে না। তারপর সবার শেষে তরকারির বাটি নিয়ে ভাত এগিয়ে দেয় লেংড়িকে। কিন্তু সে তো নিজ হাতে খেতে পারে না। বেশিরভাগ দিন স্বামীই খাইয়ে দেয়। আজ তাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে, খাওয়াতে হবে। যতক্ষণ খাওয়ায়, ততক্ষণ বকাঝকা করে – বুইড়া বেডি হইছো কিন্তু রান্ধনডাও ঠিকমতো করতে পারো না, মইচ দিয়া জ্বালায় রাখছো, পারো খালি এক ড্যাগ ভাত রানতে আর খাইতে ইত্যাদি। খাওয়াতে-খাওয়াতে অন্যদিন বড় অসহ্য লাগে, ইচ্ছা করে               ভাত-তরকারিসহ থাল ওর মুখে ঘষে দেয়; কিন্তু আজ অসহ্য লাগে না, আহা আজই তো শেষ দিন, গাল দিচ্ছে দিক, কাল এই সংসার আমার। শাশুড়ি বুড়ি আর কয়দিন! যেমনে পিসাব নিয়া সারা রাইত ঘরেবাইরে দৌড়াদৌড়ি করে!

কিন্তু ধুতরামিশ্রিত খাবার খাওয়ার পরও তেমন কিছু বলে না লেংড়ি। আধঘণ্টায়ও কোনো বিকার না দেখে সে ভাবে, ইশ্ এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল, দক্ষিণবাড়ি থেকে পোকমারার ওষুধ আনলেই কত ভালা হতো!

শুরু হয় তারও ঘণ্টা দুই পর। একটা ঘরেরই অর্ধেকটার বেশিতে একটা মুলির বেড়ার আড়ালে লেংড়ির বিছানা। বিছানায় ছটফট করে আর দুলির মাকে ডাকে আর গাল পাড়ে। কিন্তু কেউ যায় না তার বিছানার কাছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘাপটি মেরে কাঁথার নিচে পড়ে থাকে, যেন কী ঘুম আজ তাকে পেয়ে বসেছে। টিনের চালে বাদুর কচি কুল চিবিয়ে-চিবিয়ে ফেলে, শব্দ শোনা যায়। শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে একবার লেংড়িকে একটা ধমক দেয়, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে শরীর থেকে লম্বা একটা বায়ুপ্রবাহ অবমুক্ত করে। তখনো যাত্রা দেখে ফেরেনি দুলির বাপ, গাল তো দেবেই। লেংড়ির গোঙানির শব্দের ভেতর একটা কথাই ঘরের ভেতর শোনা যায়, আমারডা খাইয়া যাত্রা-সিনামা দেহা ছুডামু… আ-গো কে আছোছ, গেলাম গো গেলাম! আরো কিছুক্ষণ গোঙানি শোনা যায় চাপা। গোঙানির শব্দ থেমে গেলে হঠাৎই পুলিশের কথাটা মনে আসে দুলির মায়ের। ধরে নিয়ে গিয়ে বেইজ্জত করবে, তারপর পিটাবে এবং সবশেষে ফাঁসিতে ঝুলাবে ছেলেমেয়ের সামনে। ছেলেমেয়েরা কোনোদিন মাথা তুলে কথা বলতে পারবে না। সবাই বলবে খুনির বাচ্চা। কাঁথা ছেড়ে উঠে বসে। লেংড়ির কোনো আওয়াজ নাই, সে শেষ হয়েছে। এবার পালাতে হবে। চারটা বাচ্চাকে ঘুম থেকে তোলে এবং শীতের কুয়াশাভরা রাতে হি-হি করে কাঁপতে-কাঁপতে আলুক্ষেতের আল ভেঙে মাঠ দিয়ে আড়াআড়ি ছুটতে থাকে।

রাত ১২টায় ছাড়ে লঞ্চ, পরদিন বিকেলে এসে পৌঁছায় সদরঘাট।

দুইদিন টার্মিনালে থাকার পর দুলির মায়ের মনে আসে পুলিশ যদি সদরঘাট আসে, তাহলে তো তাকে ধরে ফেলবে। তারপর তার আশ্রয় হয় পাটুয়াটুলীর এক হোটেল ব্যবসায়ীর বাড়ি। প্রথম দিনেই আলাওলের কাজ হয় দোকানে, সোজা হিসাব, একজনকে কাজ দিয়ে তো পাঁচজনকে খাওয়াতে পারে না। দুজন হলেও কোনোরকম চলে।  ছেলেটা হোটেলে চা-পান-সিগারেট এনে দেয়, মালিকের পা টেপে। না, দুলির মায়ের কোনো অসম্মান হয়নি। সে ব্যবসায়ীর বিশাল দোতলা বসতবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছনণ রাখে আর হোটেলের মসলা পেষে, বেতনের বদলে সবাই খেতে পায়।

সবাই জানে, বাচ্চাগুলোর বাপ মারা গেছে, বিপদাপন্ন একটা পরিবার। আর মেয়ে দুলি নয়, ফুলি, ফুলির মা, বেঁচে থাকতে এটুকু আড়ালের প্রয়োজন হয়। বাড়ির গিন্নিও তাকে প্রশ্রয় দেয়, ভেতরবাড়ির কোনার একটা ঘরের মেঝেতে বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। ভাতের কষ্ট নেই, বাচ্চারা খুশি, দুলির মা, ফুলির মাও খুশি।

কিন্তু এই সুখ তার সইলো না। দুলির বাপ কার কাছে শুনেছে পাটুয়াটুলীর কোনো এক  কোন হোটেলে তার আলাওলকে দেখা গেছে। দিনের পর দিন সে এই এলাকায় ঘুরে বেড়ায়; কিন্তু ছেলের দেখা পায় না। অবশেষে  দেখা পায় একটা শাড়ির। দুলির বাপকে বিয়ে করার পর খুশিতে ডগমগ হয়ে লেংড়ি যে-শাড়িটা দুলির মাকে দিয়েছিল, সেই শাড়িটা। বসন্তের এলোমেলো বাতাসের অসতর্কতায় শাড়িটা উড়ে-উড়ে দুলির মায়ের সংবাদ ছড়াচ্ছিল। আর শাড়ি তাক করে করে গেরস্থের দরজার কড়া নাড়ে কালো খেংড়াকাঠি-কুৎসিত লোকটা। না, দুলির মা এ-বাড়িতে থাকে না, বাড়ির গিন্নি পরিষ্কার বলে। কিন্তু কি কান্ড, তখনি দুলি এসে দাঁড়ায় দরজায়। দুলির মা যখন লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার কথা এলোমেলো, আপনেরে পুলিশ ধরে নাই? লেংড়ি মরার পর পলাইতে পারেন নাই?

লোকটার মাথাটা পরিষ্কার, দুলির মায়ের পালানোর হেতু বুঝতে পেরে বলে, পুলিশ বুঝেই নাই যে তুই বিষ দিয়া হেরে মারছোছ, চল বাড়ি চল। দুলির মায়ের আর কি দ্বিধা, কাঁটা নিরাপদে সরেছে, এবার ফেরা যাক। না, ছয় বছরের আলাওল তাদের সঙ্গে ফেরে নাই, তার ঢাকা পছন্দ হইছে, ইচ্ছা হইলে লঞ্চে উইঠ্যা সে নিজেই আসতে পারবে!

সারারাস্তা লোকটা আড়চোখে দুলির মাকে দেখে, ঢাকায় থাকলে মানুষ সুন্দর হয়ে যায়, এতদিনে সে প্রমাণ পেল। একবার সে বলেই ফেলে কথাটা, এই কয়মাসে কি একটা নতুন শাড়িও তোরে হেরা দেয় নাই? লেংড়ির শাড়িডাই পিনছোছ, সোন্দর লাগতাছে। না, আজ আর কোনো হিংসা-ক্রোধ নাই লেংড়ির জন্য। চলে যাওয়া মানুষ নিয়া কিয়ের হিংসা। রাতে লঞ্চে বসন্ত-বাতাসে শীতের কাঁথামুড়িতে দুলির মাকে জড়িয়ে ধরলে লোকটাকে সে ছাড়াতে পারে!

লঞ্চ থেকে নেমে এবড়ো-খেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে  হাঁটতে- হাঁটতে দুলির মায়ের মনে হয় তিন-চারটা মাসে জীবনে কত কিছু পালটে যায়! খুব গদগদ হয়ে জিজ্ঞাসা করে, শাউড়ি কেমন আছে? আরো এক সুখবর, দজ্জাল বুড়িটা এবারের শীতের প্রকোপ সইতে না পেরে মরেছে। আহা, দুফোঁটা ওষুধও তার জন্য খরচ করা গেল না!

উঠানে পা দিতেই দেখে রঙিন শাড়ি বাতাসে উড়ছে। দুলির মা জানতে চায়, বাড়িত কে আইছে? – কে আইবো? – শাড়ি কার?

সেই জীবন, লেংড়িকে খাওয়াও, গোসল করাও আর রাত-দিন গাল খাও। মাগি আমারে মাইরা ভাগছিল, নে আমার মরা ভূতরে আবার সেবা দে। কিন্তু ওর হাতে আর খায় না। আর বাধ্য হয়ে খেতে হলেও কোলের বাচ্চাটাকে আগে দুইগাল খাওয়াবে, তারপর তার মুখে!

হ্যাঁ, দুলির মা এখন সদরঘাট চেনে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে মেয়ে তিনটাকে নিয়ে পালায়। এবার সদরঘাটের আশপাশে আর আস্তানা গাড়বে না, তার আগে ছেলেকেও সে সরিয়ে নেবে। নইলে ছেলেকে দিয়ে তার খোঁজ পেয়ে যাবে।

ছেলেকে এনে কাজ দেয় আগের মালিকেরই আত্মীয়র হোটেলে রায়েরবাজার আর সেই থেকে গত এক বছর সেও আছে রায়েরবাজার, ঢাকার পেটের মধ্যে। এখান থেকে খুঁজে নিয়ে লেংড়ির কাজ করানো দুলির বাপের কম্মো নয়। তবু ভয়টা পেটের ভিতর গুড়গুড় করে, যতক্ষণ লেংড়ির দেওয়া শাড়িটা পরতে হচ্ছে, ততক্ষণ কোনো কিছুরই ভরসা পায় না সে।