গোপাল মেকারের অন্তর্ধান

সালেহা চৌধুরী

হিলির রেললাইনের ওপারে ভারত, এপারে পাকিস্তান। আর গোপাল মেকার সাইকেল সারাই করে। পাকিস্তান হয়ে গেলে গোপাল মেকারের সব আত্মীয়পরিজন ওপারে চলে গেল। মামা, মাসি, দাদা, দাদার ছেলেমেয়ে, এমনকি ওর বউ কমলা পর্যন্ত। ও গেল না। বললো – এইডা আমার দেশ। আমি দেশ ছেড়ে কেমন করে যাই? বউ মুখ ঝামটা দিয়ে, নথ নেড়ে বলে – প্রাণটাই যদি যায় দেশ দিয়ে কী ধুয়ে খাবে? – তুই যা। আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। ছেলেপেলে নেই ওদের। বউটা বাঁজা। বউ পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে আর সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চলে যেতে যেতে ফিরে এসে চোখে আঁচল চেপে একটু কেঁদে বললো – আজ যাচ্ছো না। কাল যাবে। যখন মোসলমান তোমার জীবনটা অতিষ্ঠ করবে।

অপেক্ষা কর। দেখ কোনদিন যাই।

একঘরের শূন্যবাড়িটায় কেবল একটা টিয়েপাখি খাঁচায় দুলতে দুলতে বোধকরি তখন বেশ খুশি। যাক একজন তো থাকলো দানাপানি দেওয়ার জন্য। – খুশি তুই আর আমি। তুই আমাকে দেখবি আমি তোকে। গোপাল! গোপাল! করে পাখিটা লেজ ঝাপটালো। গোপাল উঠোনের দোপাটি গাঁদায় জল দিলো। ঘরের একটা শূন্যচকিতে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ কী ভাবলো তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলো।

বয়স বেশি নয়। তিরিশ-টিরিশ হবে। ওর আসল পদবি বারুই। তবে গোপাল মেকার নামেই পরিচিত। বসলো গিয়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকানে। কাজ করতে লাগলো যেমন সে করে। নিখুঁত কাজ। দু-একজন বললো তাকে – তুই গেলি না গোপাল?

দেশটা আমার। ও আমার মা। মাকে ফেলে কী করে যাই? দু-একজন খুশি হলো। দু-একজন হলো না। যারা ওর ব্যবসাটা পেতে চেয়েছিল তারা হতাশ হলো। পাঁচু কাটানি বললো – তোরা হিনদু। হিন্দুর দেশে চলে যা। এখানে থাকবি কেন? গোপাল মেকার কথা বললো না। কাজ করে গেল নিজের মনে। ব্যাপারটি ওখানেই থেমে থাকলো না। এরপর আরো দু-একজন জাতপাত নিয়ে   যখন-তখন কথা শোনাতে শুরু করলো। ওর ব্যবসাটা, ওর এক ঘরের ঝকঝকে বাড়িটা যারা পেতে চেয়েছিল তারা রেগে গেল ওর ওপর। গোপাল মেকার গ্রাহ্য করলো না।

কিন্তু গ্রাহ্য না করলেও বুঝতে পারলো ধর্মটা বেশ একটা সমস্যা এখন। নতুন পাকিস্তানি জোশে ওর চারপাশে কথার ঢিল পড়তে শুরু করলো। তারপর যখন একদিন সেই দোকানে আগুন লেগে গেল, গোপাল মেকার তখনো যাবে না বলে ঠিক করলো। দোকান মেরামত করে সোজা গেল মসজিদে। মাওলানা হাকিমপুরীর সঙ্গে দেখা করতে। মাওলানা ওর কথা জানে। অবাক হয়ে বললো – বেরো মসজিদ থেকে। এখানে মালাওন ঢুকতে পারে না। গোপাল মেকার হাকিমপুরীর পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে বললো – হাকিমপুরী আপনি আমাকে মোসলমান করে দেন। মাওলানা একটু অবাক হলো। একজন বিধর্মীকে মোসলমান করা মানে তার সাতপুরুষ জান্নাতুল ফেরদৌসে চলে যাবে। তাদের ভিসার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। এতবড় সুযোগ কেন তিনি হাতছাড়া করবেন? তিনি লোকজন ডেকে ওকে মোসলমান করালেন। কলেমা পড়ালেন। বাতাসা বিতরণ হলো। জমজমের পানি খাওয়ালেন ওকে।  একজন কম্পাউন্ডার/ ডাক্তার তাকে আরো বেশি মোসলমান করলো। লুঙ্গির তলায় সে তখন পুরোপুরি মোসলমান।  একটা নামও দেওয়া হলো তাকে। মোহাম্মদ গোপাল মেকার। মোহাম্মদ বলে দু-একজন ডাকতে শুরু করলো বটে, তবে গোপাল নামটা গায়ের চামড়ার মতো লেগেই থাকলো ওর শরীরে। বাড়িতে একটা জায়নামাজ এলো। একটা তসবিহ। একটা বদনা। অজু করার জন্য। একটা বাংলা কোরান শরিফ দিলেন হাকিমপুরী। মোসলমান হলেই হবে না। তোকে এই ধর্ম ভালো করে বুঝতে হবে।  যারা ওর দোকানে আগুন লাগিয়েছিল তারা বোধকরি হার মানলো। বললো – শালা মালাওনের বুদ্ধির কাছে আমরা পারি!  হাকিমপুরীর পেয়ারের পাত্র ও এখন। মাথায় সাদা টুপি পরে গোপাল মেকার নামাজ পড়তে আসে। আর যতক্ষণ হাকিমপুরী কাঠফাটা রোদে নামাজ পড়ান, গোপাল তার মাথায় ছাতা ধরে থাকে। খুতবার সময়টা নট নড়নচড়ন ভঙ্গিতে গোপাল দাঁড়ায় হাকিমপুরীর পেছনে। ঈদের দিনে বা বড় বড় সমাবেশে হাকিমপুরীর মাথায় ছাতা ধরায় ওর কোনো বিরতি নেই। হাকিমপুরী ওর এ-কাজটা খুবই পছন্দ করেন।

 

চুপ করে চৌকির নিচে থেকে একটা শিবলিঙ্গ সামনে এনে দুপুর রাতে গোপাল বলে – শিবঠাকুর তুমি বাপু রাগ করো না। আমি নামেই মোসলমান। এদেশে থাকতে মোসলমান হয়েছি গো। তুমি আমার সব। আমি আমার দেশ, ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না গো। এখানে আমার নাড়ি পোঁতা আছে। এ আমার দেশ গো শিবঠাকুর।  সে পূজা কেউ দেখতে পায় না। গোপাল দুপুররাতে কী করে সেটা কে দেখে? অন্য দেবদেবীও চুপি-চুপি ফুল-প্রসাদ পায়। চৌকির তলায় গোপালের বাপদাদার বিশ্বাস আর বাকি সময় সে মুসলমান।

গোপাল এই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ত্রিশঙ্কুর মতো টিকে রইলো। বউ নাকি কোনো এক দোকানদারকে পছন্দ করে তার সঙ্গে বালুরঘাটে চলে গেছে। লোকের মুখে খবর পেল গোপাল। কমলা বলেছে – বাপ-মায়ের ধর্ম যে বদলায়, সে আমার স্বামী হতে পারে না।  মিনসের মাথায় ভূত চেপেছে। আমি জানতাম বাড়ির পাশের তেঁতুলগাছের মাথায় একটা পেত্নি আছে। সেটাই ওকে এমন করেছে। গোপাল শুনলো। কিন্তু তাতে ওর ইতরবিশেষ হয়েছে বলে মনে হলো না। তবে খুশি নামের পাখিটার খাঁচার সামনে এসে একটু ধরা গলায় বললো – ওরা সব চলে গেছে। আমি ওদেশে যাওয়ার রাস্তা নিজের হাতে বন্ধ করেছি। তুই আমাকে ফেলে যাস না রে খুশি। খুশি লেজ দুলিয়ে বললো, ও যাবে না।

আর একটা বিয়ে কর রে গোপাল। ফাতিমার বয়স বেশি না। দুটো স্বামী খেয়েছে। ওকে বিয়ে করে ওর একটা গতি করে দে।

এমনি কাজকাম করুক এসে। বিয়ে করতে পারব না।

ফাতিমা এসে কাজ করে দেয়। উঠোন ঝাঁটপাট দেয়। ঘরের ভেতরটা সে পরিষ্কার করতে পারে না। কারণ চৌকির নিচে যেসব শিব, লক্ষ্মী, দুর্গার ছবি আছে সেগুলো গোপালের একার। বলে গোপাল ফাতিমাকে – ফাতিমা কক্ষনো আমার ঘরে ঢুকবি না।

কেন ঘরে কী এমন সাতরাজার ধন আছে আমি ঢুকতে পারব না? ঘরটা ঝাঁটপাট দিই। পয়পরিষ্কার করি। তুমি ঘরটা তো নোংরা রাখো। দড়িতে কাপড়, মেঝে লেপামোছা নেই।  মেয়েমানুষের হাত না পড়লে ঘরদোর কী ঠিক হয় গো বোকা গোপাল?

হবে না, হবে না। আমি এমনিই থাকবো। তোর অন্য কাজ যা আছে কর। আমার ঘর নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।

অন্য কাজ? বারান্দা ঝাড় দেওয়া। আর উঠোনের পাতা কুড়িয়ে চুলো ধরানো এই তো ভারী কাজ। তুমি তো আবার গোশত-টোশত খাও না। নিরামিষ আর একটু মাছ রান্না সেটাই বা কতক্ষণ লাগে। ভালো গরু কাটা হয়েছে। একটু গোশত এনে রাঁধি?

না। আমি গোশত খাই না।

ও তুমি নামেই মোসলমান। মনেপ্রাণে এখনো হিন্দু গো তুমি।

কেন গোশত না খেলে মোসলমান হওয়া যায় না নাকি?

যাবে না কেন। তবে পুরোপুরি মোসলমান হওনি সেটা ঠিক।

এত কথা বলবি না। ফুলগাছে জল দিবি। আর টিয়েপাখির খাঁচা পরিষ্কার করবি। দুটো-একটা কাপড় কাচবি। লেপাপোছা করবি।

তুলসীগাছটা কাটছো না কেন?

সর্দি ভালো হয় ওতে। কেটে ফেলব। কী বলিস তুই।

আমাকে নিকে করে ফেল। তাহলে আমাকে আর তোমার বেতন দিতে হবে না। খাবো, পরবো। তোমার বিবি হবো। বিবির একটা সম্মান থাকে। ঝিয়ের আবার কী সম্মান?

না। বিয়ে-নিকে করতে পারব না। আমি তোকে কি অসম্মান করি, এমন কথা বলিস?

ক্যান বিয়ে করবে না ক্যান? তোমার শরীরে কী মরদের রক্ত নেই গো গোপাল। এই বলে মুখটিপে হাসে ফাতিমা। একদিন আমার সঙ্গে শুয়ে দেখো, তখন বুঝবে আমি জিনিসটা খারাপ না।

ভাগ। ওসব আর বলবি না।

ক্যান বলবো না। বুঝেছি তোমার সমস্যা আছে। আমি তোমার সব সমস্যা ঠিক করে দেবো। দু-দুটো স্বামীকে সুখ দিয়েছি। একটা রেলে কাটা পড়ে মরেছে আর একটা রসের হাঁড়ি পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়েছে আর মরেছে।

সেইজন্যই তো, তোকে বিয়ে করি তারপর আমার একটা অপঘাত-মৃত্যু হোক।

বিয়ে না করে শোয়া যায় না বুঝি?

ভাগ।

ও কমলাকে ভুলতে পারো না বুঝি? ও আর কোনোদিন আসবে না গো। ভেগেছে এক দোকানদারের সঙ্গে। বালুরঘাটে ওরা দুজন এখন স্বামী-ইস্ত্রিগো।

ফাতিমা হাল ছাড়ে না।  কিন্তু কখনোই সে গোপাল মেকারের  ঘরে ঢুকতে পারে না। সে কেবল সুযোগের অপেক্ষায়।

 

কী ব্যাপার রে গোপাল, তুই সারাক্ষণ আমার মাথার ওপর ছাতা ধরে থাকিস কেন রে? আর তো কেউ এমন করে না? নামাজ শেষ করে একদিন হাকিমপুরী ওকে প্রশ্ন করেন। দুজনে চুপচাপ বসেছে একটা গাছের নিচে। আশেপাশে কেউ নেই।

গোপাল কোনো কথা বলে না। মুখ নিচু করে থাকে।

রোদ-বৃষ্টি। কোনোমতে নামাজ শেষ করে খুতবা বা বক্তৃতা করার সময় দেখি মাথায় ছাতা ধরে তুই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছিস। চাতালে নামাজ পড়তে হয়। মসজিদ বড় হবে যখন, তখন আর চাতালে নামাজ পড়তে হবে না। আর ঈদের মাঠেও একই কাবার করিস তুই। সত্যি করে বল, কেন এমন করিস তুই?

হুজুর আমি কী মন খুলে কথা বলতে পারব।

একটু হেসে হাকিমপুরী ওকে বলেন – বল। মন খুলে বল। তোর মনে যা আছে সব বল। এখানে আর কেউ নেই।

হুজুর আমি পঁয়ত্রিশ বছর হিন্দু ছিলাম। আপনারা বলেন আল্লাহ একজন। তাকে ভয়ভক্তি করতে হবে। হিন্দুরা অনেক সময় মানুষের মধ্যে আল্লাহ খুঁজে পায়। যেমন অতিথি আমাদের ভগবান। যেমন করে আপনি এত সময় ধরে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, শুনতে শুনতে মনে হয় আপনিই আমার আল্লাহ। আমার ভগবান।

তওবা তওবা। কী বলছিস রে তুই? আমি আল্লাহ? আমি তো এক নাপাক বান্দা রে গোপাল।

ওসব আমি জানি না। আপনারা বলেন – আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথানত করতে নেই। আমি বলি সারাজীবন আমি আপনার পায়ের পাতায় মাথানত করে বসে থাকতে পারব।

হিন্দুরা তো গরুকেও দেবতা বলে। তুই কী এখনো তাই বলবি? এত বছর মোসলমান থাকার পর?

ঠিক তা বলব না হুজুর। তবে বলব যে, মা দুধ দেয় সেই মাকে আমরা কাটতে পারি বলেন? তেমন যে গরুর দুধ আমরা শিশুকাল থেকে পান করি, তাকে কেমন করে কাটি হুজুর।

সুরা বাকারা পড়েছিস। বাংলায় একটা কোরান শরিফ দিয়েছিলাম পড়েছিস? মুসা পয়গম্বর যেই না দূরে চলে গেছে, অমনি লোকজন একটা গরু বানিয়ে পূজা করতে শুরু করেছে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। সেটা কি ঠিক হয়েছে বল?

তা হয়নি হুজুর। তবে যে গরু দুধ দেয় তাকে কাটি কী করে হুজুর। হাকিমপুরী একটু হাসলেন। যে লোক তাকে আল্লাহ মনে করে রোদবৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাথায় ছাতা ধরে থাকে, তাকে একটু বকলেন শুধু। বললেন – তোকে পুরো ইসলাম ব্যাপারটা বুঝতে হবে। তুই এখনো পুরো মোসলমান হোসনি। এসব কথা কাউকে বলিস না। কেউ এসব শুনলে বিপদে পড়বি। তোরা তো পাথরও পূজা করিস। গোপাল মেকার মুখ নিচু করে বললো কেবল – হুজুর পুজো করতে করতে পাথরটাও যে একসময় ঈশ্বর হয়ে ওঠে। ভক্তিতে সব হয়।

আমি কিন্তু সবসময় মাওলানা হাকিমপুরী থাকব। কখনো তোর ঈশ্বর হবো না, সেটা মনে রাখিস। যত ভক্তিই তুই করিস না কেন, আমি এক নাপাক বান্দা।

সে আপনি যা-ই বলেন আপনার প্রতি আমার ভক্তি কখনো কমে যাবে না। আপনি যখনি রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট পাবেন, আমি ছাতা ধরে থাকব। গরম লাগলে পাখার বাতাস দেবো। আপনি সুফি মানুষ। পরোপকারী মানুষ। এই বলে গোপাল মেকার জামা খুলে হাকিমপুরীকে বাতাস করতে থাকে।

থাক থাক। তোর আর ভক্তি দেখাতে হবে না। যা ভালো করে বাংলা কোরান শরিফ পড় আজ রাতে। দেখ সেখানে কী লেখা আছে।  নামাজ পড়িস ঠিকমতো?

পড়ি হুজুর।

কী প্রার্থনা করিস?

সব মানুষের ভালো হোক।

হাকিমপুরী হাসলেন। কোরান শরিফটা পড়িস। ওটা সব মানুষের ভক্তি আর বিশ্বাসের জিনিস। তাইতে ওর এত শক্তি।

পড়ব হুজুর।

মাথার পেছনে ছাতা ধরে গোপাল মেকার হাকিমপুরীকে বাড়ি পৌঁছে দিলো। যে-পথে কাদা, সেখানে একটু ইট বিছিয়ে পথও করে দিলো। এরপর নিজের কাজ করে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে আসে। একটু চমক লাগে। জোছনার আলোর ভেতর চাঁদের মতো উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে ফাতিমা। শাড়িটা লাল। কপালে লাল টিপ। গলায় মালা। হাতভর্তি চুড়ি। শাড়িটা এমন করে পড়েছে শরীরের সব বাঁক চোখে পড়ে। ঠোঁট টকটকে লাল। ঠোঁটে আলতা মেখেছে ফাতিমা। গোপাল মেকার বলে কেবল – এখানে কী করছিস তুই? বাড়ি যা।

আজ যাবো না। আজ তুমি তোমার ঘরে আমাকে যেতে দেবে। তোমার বিছানায় বসতে দেবে। তারপর –

আবার সেই কথা। বলেছি না এসব বলবি না।

ক্যানে বলব না। আমি কী দেখতে খারাপ? তোমার শরীরে কী পুরুষের রক্ত নেইগো গোপাল ঠাকুর।

গোপাল ঠাকুর ওকে তাড়িয়ে দিয়ে গেট লাগিয়ে দিলো। বললো – যা, যেখানে ওসব দেখালে কাজ হবে সেখানে যা।

আমি বেবুশ্যে নইগো। আমি তোমাকে ভালোবাসি গো গোপাল। এ-কথা কেন বোঝ না গো তুমি।

বেশ বেশ। কাল দিনের আলোতে বলিস এসব। রাতের আঁধারে নয়। যা। আর একদিন এমন কথা বললে তোকে বাড়িতে ঢুকতে দেবো না।

ফাতিমা এবার ফণা বিস্তার করে। এত গুমোর ভালো নয় গো। এবার দেখবে আমি তোমার কী করতে পারি। তুমি আমাকে অপমান করবে আর আমি রোজদিন সেটা সহ্য করব। তা হবে না।

ফাতেমা কী করবে ঠিক করেছে। সে ওর ঘরের তালা ভেঙে দেখবে ঘরের ভেতর কী আছে। আর কোনো মেয়েমানুষ লুকিয়ে রেখেছে নাকি।

হে আমার শিবঠাকুর, হে আমার মা লক্ষ্মী, হে আমার মা কালী এতক্ষণ তোমাদের ভুলেছিলাম। তোমরা সব ঠিক আছো তো। এই বলে ওদের নিয়ে বসে পূজা করবে বলে। তার আগে একটু নামাজও পড়েছে সে। আর সেই প্রার্থনা করেছে – হে মোসলমানের আল্লাহ হিন্দুর ভগবান, তুমি সব মানুষের ভালো করো।  মনে মনে ভাবছে পুরো কোরান শরিফটাও পড়ে ফেলবে। হাকিমপুরী মানুষটা ভালো। তাকে ও মিথ্যা কথা বলবে না।

টিয়াপাখিটা কেমন ঝিম মেরে আছে। বোধকরি বয়স ধরেছে। দানাপানি মুখে তুলছে না। গোপাল পাখিটাকে আদর করে।

 

পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ি এসে চমকে যায়। ওর শিবঠাকুর, মা লক্ষ্মী, মা কালী, গণেশ, কার্তিক সব উঠোনে গড়াগড়ি যাচ্ছে। আর টিয়েপখিটা মরে আছে খাঁচায়। প্রথমে ফাতিমা এলো। পেছনে আরো দু-একজন।

– শালা মালাওন। যে-ঘরে কোরান শরিফ, তসবিহ, কাবার ছবি, সেখানে এসবও রাখিস তুই। কাল হাকিমপুরীকে বলব আমরা। তারপর তোর মাথায় ঘোল ঠেলে দেবো ওপারে চালান করে। মোসলমান হয়েছিস তুই। ওইটা কাটলেই মোসলমান হওয়া যায়? তোর বড় সাহস দেখি। ফাতিমা মুখ টিপে হেসে বলে – গোপাল মেকারের আজই শেষ দিন। নাও এবার কী শাস্তি পাও সেটা দেখে তারপর আমি যাবো। ঘরে ঢুকতে দাও না। এইসব কারবার করো তুমি। কী ঘেন্না কী ঘেন্না।

শালা তুই শিবের লিঙ্গ পুজো করিস? কাল প্রথমেই আমরা তোর লিঙ্গ যদি না কাটি।

গোপাল মেকার কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে থাকে।

পরদিন সকালে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হাকিমপুরী বলেছেন – ওকে চালান করে দাও ওপারে। মেরে ফেলো না।

ওর হাড় গুঁড়ো-গুঁড়ো করে দেবো আমরা। কী বলছেন আপনি হুজুর। হাকিমপুরী আবার বলেন – যা বললাম করো। এক ধাক্কা দিয়ে তারকাঁটার ওপারে পার করে দাও। যেদিক দিয়ে কালোবাজারিরা চিনি, চাল, শাড়ি, মসলা, মাছ নিয়ে যায় আর  আসে সেদিক দিয়ে পার করে দাও। বিডিআরের সোজা পথ দিয়ে নয়।

আকাশে কালো মেঘ। বৃষ্টি নামবে যে-কোনো মুহূর্তে। একদল লাঠিয়াল এসে ওর বাড়ির চারপাশ ঘেরাও করে। চিৎকার করে ডাকে গোপাল বেরিয়ে আয়। ভালো চাস তো। কেউ বেরিয়ে আসে না। দরজা খোলা। তালাফালা লাগানো ছিল। সেসব কে খুললো? পাশের বাড়ির যারা সারারাত ঘুমায়নি তারাও কেমন করে কিছু জানতে পারলো না। একটিও জিনিস নেয়নি গোপাল মেকার। একজনের হাতে কাঁচি, মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢালবে বলে একটা ঘোলের পাত্র আরেকজনের হাতে। – এত সহজে ওকে পাঠাব ওপারে। ও শালা তো কারো জামাই নয় যে, সেজেগুজে পাঠিয়ে দেবো। সকলের একই কথা। না গোপাল কোথাও নেই। – ভয়ের চোটে শালা রাতেই পালিয়েছে। কালই ওর একটা ব্যবস্থা করতে হতো। কিন্তু কেউ বলতে পারে না, কোন পথ দিয়ে কোথায় গেল গোপাল মেকার। সারারাত যারা চিনি, চাল, শাড়ি, কাপড় কালোবাজারি করে, তারা কেউ ওকে দেখেনি। কোনো বর্ডারপুলিশ বা বর্ডারের একজনও গোপালকে দেখেনি।

শালা গেল কোনদিক দিয়ে? সবাই একসময় হাল ছেড়ে হতাশ হয়ে চলে গেল। ওর জিনিসপত্র যে যার মতো নিয়ে বকতে-বকতে ফিরেও গেল। বাড়িটা খালি হয়ে গেল।

সব গন্ডগোল মিটে গেলে হাকিমপুরী এসে দাঁড়ান ওর বাড়ির সামনে। তুলসীমঞ্চটার আছে। ফাতিমা বলেছে – ওটাতে নাকি সর্দি ভালো হয়, তাই কাটতে দেয়নি। ঝকঝকে একটা বাড়ি। পাতকুয়োতে শান্ত হিম জল। কতজন সে কুয়োর জলে শীতল করেছে প্রাণ। ওর কুয়োর জলের মতো এত শীতল জল কেউ নাকি কখনো দেখেনি। বিশেষত যারা চিনি, চাল এপার-ওপার করে, তারা প্রায় সকলেই ওর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক বালতি জলে প্রাণ শীতল করেছে কতবার। বলেছে, গোপাল – তোমরা পাপ করছো, সে বিচার করবেন একজন। যিনি মাথার ওপরে থাকেন। এখন জলতেষ্টা পেয়েছে, জলপান করে চলে যাও। সেই কুয়োতেও ঝাঁপ দেয়নি ও। পাতকুয়োও পরীক্ষা হয়েছে। এতবড় মানুষটা গেল কোথায়? হাকিমপুরী দাঁড়িয়ে আছেন। আকাশে কালো মেঘ। চোখ ঘসে কী দেখেন হাকিমপুরী? মেঘের ভেতর দিয়ে ছাতা মাথায় গোপাল চলে যাচ্ছে কার কাছে? ওখানে যিনি আছেন বলে বিশ্বাস, তিনি তো কোনোদিন নিজে এসে বলেননি ঠিক কোন পথ দিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া যায়। কেবল মানুষ রচনা করে নিজের পছন্দের পথ। আর এই পথ রচনার কারণে খুনোখুনি আর মারামারি। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় সময় সময়।

হাকিমপুরী আরেকবার তাকান। সেখানে মোহাম্মদ গোপাল মেকার নেই, গোপালের ছাতাও নেই। কেবল মেঘ।