গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মহাপ্রয়াণ : আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

আলী আহমদ 

বইয়ের দোকান বলতে ঢাকায় এখনো যেকটি অবশিষ্ট আছে আর নতুন যেকটি যোগ হয়েছে তার কোনোটিতে আন্তর্জাতিক প্রকাশনার, বিশেষ করে লন্ডন-নিউইয়র্ক প্রকাশনী সংস্থাসমূহের সাহিত্যের বইগুলো, স্বাভাবিকভাবে আসে না। এই লজ্জাজনক দীনতার কারণে বিশ্ববিখ্যাত বইগুলো পেতেও আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এই যোগাযোগ খুব বেশি মানুষের থাকার কথা নয়। অনেকে তাই ওই জাতীয় বইগুলো দেখার সুযোগ পান না। আগ্রহী পাঠকেরাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হয়তো পেয়ে যান দু-একটি; তবে সাধারণত অনেক দেরিতে। ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া গার্সিয়া মার্কেজের বই পেতে আমারও অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। কতদিন নয়, ঠিক কত মাস বা বছর পরে তাঁর প্রথম বই পেয়েছিলাম, তা এখন আর সঠিক বলতে পারব না। তবে বইটির নাম মনে আছে। বইটি ছিল ইংরেজি অনুবাদে আর তার নাম বাংলায় দাঁড়ায় কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না। এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কিংবা সবচেয়ে জনপ্রিয় বই হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু তখনি ওটি পড়ে চমকে উঠেছিলাম। তারপর অল্প সময়ের মধ্যে তখন পর্যন্ত প্রকাশিত, এবং ইংরেজিতে অনূদিত, তাঁর সব বই-ই পড়ে ফেলেছিলাম। ততদিনে আমি তো গার্সিয়া মার্কেজের বিশেষ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। এবং অন্যান্য অনেকের মতো খবর রাখতে শুরু করলাম, আর সহজে সে-খবর পেয়েও যেতাম যে, কখন তাঁর কোন বই বেরোচ্ছে। যখনই তাঁর নতুন কোনো বই ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা জোগাড় করে পড়েও ফেলতাম।   

বছর দুই-তিন আগেই সম্ভবত আমাদের কোনো একটি দৈনিকের ভেতরের পাতার ছোট্ট একটি সংবাদে চোখ আটকে গিয়েছিল, এখনো সুস্পষ্ট মনে আছে। সংবাদটি ছিল গার্সিয়া মার্কেজের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে। ততদিনে বয়স তাঁর চুরাশি-পঁচাশি হয়ে গিয়েছিল। আর সিগারেট টানতেন তিনি ভয়ানক রকমের বেশি। সুতরাং তাঁর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া দুঃখজনক হলেও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এবং তার অল্প কিছুকাল পরে খবরের কাগজের মাধ্যমেই আবার জেনেছিলাম, তিনি আর লেখালেখি করবেন না ঘোষণা দিয়েছেন। কোনো আপনজনের চিরবিদায় আসন্ন বুঝতে পারলে বুকের মধ্যে চাপা একটা ব্যথা যেমন হাজারো কাজের মধ্যে থেকে-থেকেই মোচড় দিয়ে ওঠে, সত্যি বলতে কি, তেমনি একটা ব্যথা যেন অনুভব করতাম গার্সিয়া মার্কেজের এই নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং তাঁর আসন্ন চিরবিদায়ের অবশ্যম্ভাবিতায়। সুতরাং ১৭ এপ্রিল, ২০১৪ তাঁর মারা যাওয়ায় এবং তারও দিন কয়েক আগে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আর সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা আমার কাছে এক ধরনের যান্ত্রিক নিরর্থকতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। আমরা যেন এক প্রকারের জেনেই গিয়েছিলাম তিনি চলে যাচ্ছেন চিরকালের জন্য।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের এই চলে যাওয়া সাধারণ কোনো লেখকের চলে যাওয়া নয়, এমনকি প্রচলিত অর্থে অসাধারণ কোনো লেখকেরও চলে যাওয়া নয়; এ হচ্ছে সাহিত্যের এক যুগ-প্রবর্তকের মহাপ্রয়াণ, একথা অন্তরের গভীরে অনুধাবন করবেন বিশ্বসাহিত্যের যে-কোনো মননশীল পাঠক। গার্সিয়া মার্কেজ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮২ সালে, পঞ্চান্ন বছর বয়সে। সাহিত্যের এ-পুরস্কার কোনো লেখক বা কবির সার্বিক সাহিত্যকর্মের জন্য দেওয়া হলেও, সংশ্লিষ্ট লেখক বা কবির দু-একটি বই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা বলে পাঠক-সমালোচক মহলে পরিচিতি লাভ করে। গার্সিয়া মার্কেজের ওই শ্রেণির একাধিক বই থাকলেও, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তাঁর জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাস সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ  বা শতবর্ষের নির্জনতা এমনই একটি পরিচিতি বা খ্যাতি লাভ করেছে। বইটি এমনিতে খুব যে সহজবোধ্য তা বলা যাবে না; তবুও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে এখনো পর্যন্ত বইখানির তিন কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীতে শুধু বাইবেলই এর চেয়ে কিছুটা বেশি বিক্রি হয়েছে বলা হয়ে থাকে। যে-কোনো সাহিত্যস্রষ্টার জন্য এ-সম্মান শুধু বিরল নয়, অনন্য। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেজের খ্যাতি শুধু এ-কারণেই নয়; কিংবা, বলা চলে, মোটেই এ-কারণে নয়।

সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিকে মোটেই খাটো করে না-দেখেও বলা চলে, ১৯০১ সালে এ-পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকে মহাযুদ্ধের              দু-এক বছর বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত এ-পুরস্কার একশ দশজনের বেশি লেখক-কবিকে দেওয়া হয়েছে। ওইসব লেখক-কবির অধিকাংশ তাঁদের নিজ নিজ দেশ এবং/ কিংবা ভাষিক অঞ্চলে অবশ্যই পঠিত ও সম্মানিত হন বলে ধরে নেওয়া যায়; কিন্তু বৈশ্বিক সাহিত্যমহলে তাঁদের কতজন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমীহ ও ভালোবাসা পান এবং তাঁদের সাহিত্যকর্ম পঠিত হয় কিংবা তাদের ব্যাপক চর্চা হয় তা প্রায় যে-কেউ অনুমান করতে পারেন। অথচ নোবেল পুরস্কার শুরুর পর ওই পুরস্কার পাননি এমন অনেকেই কিন্তু এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বসাহিত্যসভায় আপন গৌরবে দীপ্ত হয়ে আছেন। লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভ, হোর্হে লুইস বোর্হেস – এঁদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন। কারো নামোল্লেখ করে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত কাউকে আমরা ছোট করার চেষ্টা করব না বলেই নাম-না-করে বলছি যে, সমস্ত পৃথিবী তো দূরের কথা, নোবেল পাওয়া অনেক লেখক তাঁদের নিজ দেশে, নিজ ভাষায় শুধুই একটি রেকর্ড হয়ে আছেন; পাঠকের মনে নেই, এমনকি কাছেও হয়তো নেই। সুতরাং নোবেল পুরস্কার গার্সিয়া মার্কেজকে এমন খ্যাতিমান করে তোলেনি।

যে-কোনো মানোত্তীর্ণ শিল্পী নিঃসন্দেহে অসাধারণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখেন, এবং যে-কোনো শিল্পমাধ্যমের কথা আলোচনায় আনলে, এমনকি ইতিহাসের নিরিখে আলোচনা করলে, একগাদা না-হলেও বেশ কয়েকজনের নাম প্রায় এক নিঃশ্বাসে উঠে আসে। এ-কথা চিত্রশিল্পের বেলায় যেমন, সাহিত্যের বেলায়ও তেমনভাবেই প্রযোজ্য। কিন্তু যুগে যুগে কিছু কিছু শিল্পস্রষ্টার আবির্ভাব ঘটে যাঁরা অন্যতম নন, একেবারেই অনন্য। তাঁরা নতুন যুগের সূচনা করেন, তাঁরাই যুগপ্রবর্তক। চিত্রশিল্পে একনামে যেমন বলা যায় পাবলো পিকাসোর কথা, সাহিত্যে তেমন একইভাবে উল্লেখ করা যায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নাম। চিত্রশিল্পে পিকাসো যেমন, কথাসাহিত্যে গার্সিয়া মার্কেজ তেমন – সম্পূর্ণ নতুন একটি দুনিয়া খুলে দিয়েছেন আমাদের চোখের সামনে। এঁদের প্রত্যেকেরই শিষ্য-ভাবশিষ্য এবং মেধাবী অনুসারী তৈরি হয়েছে জগৎব্যাপী, এবং ভবিষ্যতে আরো হবে ধরে নেওয়া যায়।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে গার্সিয়া মার্কেজ যখন সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু গল্প লেখা শুরু করেন সেগুলো পড়ে স্পেনীয় সাহিত্যের পাঠকেরা বেশ খানিকটা চমকে উঠেছিলেন অনুমান করা যায়। কারণ তখনকার লাতিন আমেরিকার তো নয়ই, স্পেনেরও নয়, এমনকি সুপরিচিত ইংরেজি-ফরাসি-জর্মন কিংবা অন্য কোনো সাহিত্যে অমন ধরনের গল্প কেউ কখনো পড়েছে কিংবা দেখেছে বলে মনে করতে পারেনি