গ্যোয়টে ও রবীন্দ্রনাথ মার্টিন কেম্পশেন

অনুবাদ ও সম্পাদনা : জয়কৃষ্ণ কয়াল

 

আমরা যারা বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিতে বড় হয়েছি, সেখানের স্কুল-পাঠশালায় পড়েছি – তারা সবাই বাধ্য ছিলাম গ্যোয়টের লেখাপত্রে ভালো রকম আত্মস্থ হতে। বিশেষ করে তাঁর কবিতা আর নাটকে। আমার বিশ্বাস, দ্বিতীয় বিশবযুদ্ধ এবং তৃতীয় রাইখে আমাদের পিতৃপ্রজন্মের আমূল বিপর্যয়ের পরে এই ক্ল্যাসিক জার্মান সাহিত্যিকে, সেইসঙ্গে শীলার (Schiller), ক্লাইস্ট (Kleist) এবং হোল্ডারলিনে (Holderlin) এই গুরুত্ব দরকার ছিল। দরকার ছিল জার্মানির বিশ্বদৃষ্টি এবং তার মূল্যবোধ পুনর্নির্মাণের জন্যে। দরকার ছিল আমাদের শিক্ষকদের এবং আমাদের মতো  ছাত্রছাত্রীদের আশ্বস্ত করতে যে, আমাদের কিছু ক্লাসিক সাহিত্য আছে, আছে কিছু মনন সম্পদ, যা তখনো কার্যকরী এবং একাধারে অনশ্বরও। আমার মনে আছে, ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক পরেই আমাদের সাহিত্যের শিক্ষক ক্লাসরুমে এসে সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন : গ্যোয়টের ফাউস্ট না পড়ে কোনো বাছাধনকে কলেজ ছাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। আমি জানি না, এখন কোনো শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের এমন ফরমান দিতে পারবেন কিনা। নিশ্চয় পারবেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান সাহিত্য পড়ার সময় ভিয়েনাতে আবার আমাকে গ্যোয়টে পড়তে হয়েছে। মঞ্চে তাঁর অনেক নাটক দেখেছি। তাঁর গীতিকবিতার (ballad) প্রেমে পড়েছি। গলাছেড়ে সেগুলো আবৃত্তি করেছি। গুস্তাভ গ্রুয়েন্ডজেন্সের (Gustav Griiendgens) ফাউস্ট প্রথম খন্ড (Faust Part One) পড়ে আলোড়িত হয়েছি। এটা আমি ডিস্কেও (disc) শুনেছি, সিনেমায় দেখেছি… এই লেখাটা যখন লিখছি, স্রোতের মতো অনেক কথাই মনে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু আমার মূল বিষয় ছিল আধুনিক জার্মান সাহিত্য। আমার গবেষণাপত্র লিখেছি বেলাইনের বিষয়ে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে।

ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস পরে ভারত এলাম। এলাম কলকাতায় জার্মান ভাষায় লেকচারারের চাকরি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথে মজতে আমার বেশ কয়েক বছর গেছে। সত্যি বলতে কী, রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আমার টান বাড়ল যখন তাঁর বাংলা লেখা বোঝার তাকত হলো। তখন থেকে আমার এক নতুন অভিযাত্রার শুরু। আজো তা চলছে। চলছে তাঁর কবিতার অনুবাদে। চলছে জার্মানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক উদ্ঘাটনের বইপত্র লেখায়। বক্তৃতায়। আমার অনূদিত তাঁর কবিতার আবৃত্তিতে। আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে, চলছে তাঁর গ্রামীণ শিক্ষার আদর্শে কয়েকটি সাঁওতাল গ্রামে কাজকর্মের মাধ্যমে।

ইদানীং, গত কয়েক বছর হলো, আমি যেন সেই অভিযাত্রার বৃত্তটা সম্পূর্ণ করার একটা চাড় টের পাচ্ছি আমার অন্তরাত্মায়। জার্মান ক্ল্যাসিকগুলো আবার পড়ার জন্যে মনটা আকুলি-বিকুলি করছে। আর যা-ই হোক, তার মানে এই নয় যে, আমি আবার জার্মানিতে ফিরে যাচ্ছি। বরং, আমি চেষ্টা করছি ভারত এবং জার্মানিতে আমার জীবন ও কাজের দুটো অংশকে জুড়ে নিতে। জীবনের এই পর্বে এসে জার্মান ক্ল্যাসিক পড়ার অনিবার্য মানে দাঁড়ায়, চল্লিশ বছর ধরে ভারতীয় সাহিত্য এবং পুরাকথা পাঠের প্রেক্ষাপটে সেগুলো নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করা। এটাই এখন আমার সুবিধের জায়গা। এখান থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথ এবং গ্যোয়টে বোঝার শুরু। বিষয়টা তাই নিছক পুঁথিগত বিদ্যানুশীলন নয়, বরং বলা যায় আমার জীবনবোধের মূল্যায়ন।

রবীন্দ্রনাথ এবং গ্যোয়টের তুলনা আগেও হয়েছে। স্বনামধন্য চিকিৎসক, সংগীতজ্ঞ এবং মানবতাবাদী আলবার্ট শুভাইৎসার (Albert Schweitzer) কবিকে বলেছিলেন ভারতবর্ষের গ্যোয়টে। একটা চিঠিতে তিনি কবিকে লিখেছিলেন :

আপনাকে যখন ভারতবর্ষের গ্যোয়টে বলি তখন বোঝাতে চাই যে, ইউরোপের ক্ষেত্রে গ্যোয়টের যে-গুরুত্ব, আমার মতে, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আপনার গুরুত্বও তাই।১

আরো সাম্প্রতিককালে অনুরূপ তুলনা টেনেছেন পূর্বতন পূর্ব জার্মানির ভারততত্ত্ববিদ ওয়াল্টার  রুবেন (Walter Ruben)২। তুলনা টেনেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত৩। এই দুই মনীষার প্রতিতুলনা তাই অন্য অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।

তা সত্ত্বেও, মনে প্রশ্ন জাগে আমার, রবীন্দ্রনাথ এবং গ্যোয়টের তুলনা কি আদৌ সম্ভব? হিমালয়ের সঙ্গে আল্পস পর্বতের কি তুলনা হতে পারে? তুলনা হতে পারে রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জার সঙ্গে আগ্রার তাজমহলের? উভয়েই দিগ্দর্শী অনন্যতার দাবিদার। সময়, ওজন, উচ্চতা বা আয়তনের প্রতিতুলনা কিছু ধূসর অর্থহীন সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব মাত্র দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দরকার ভাব। ভাব এবং আদর্শ। তার অভিমুখ বস্ত্তগত তথ্যের মানমাত্রার বাইরে।

শুরুতে সংক্ষেপে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথ এবং গ্যোয়টের সময়কাল। তাঁদের প্রতিভা বিচ্ছুরণের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। জার্মান সাহিত্যের ইতিহাসে আমরা গ্যোয়টে যুগের (Zeitalter Goethes) কথা বলে থাকি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও রবীন্দ্রযুগ কথাটা সমভাবে প্রযোজ্য। দুজনেরই সময়টা ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক ডামাডোলের। পরিবর্তনের। জার্মানির ক্ষেত্রে সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ আর উনিশ শতকের শুরু। ফরাসি বিপ্লব তথা সে-যুগের যে সার্বিক রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলন, তার অভিজ্ঞতা গ্যোয়টের হয়েছে। উত্তর আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও তিনি জীবিত ছিলেন। মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তখন ক্ষয়িষ্ণু দশায়। সাম্য এবং স্বাধীনতার গণপ্রজাতন্ত্রী বুর্জোয়া মূল্যবোধ সামনে চলে এসেছে। ১৮৩২ সালে গ্যোয়টের প্রয়াণের মাত্র ষোলো বছর পরে ১৮৪৮ সালে জার্মানি তার গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে।

এক শতাব্দী পরে, যখন উপনিবেশবাদের অবক্ষয় শুরু হলো, যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হয়ে উঠল আর সামন্ততন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন রবীন্দ্রনাথও অনুরূপ উৎক্ষেপ লক্ষ করেছেন। কবির মৃত্যুর ছ-বছর পরে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের সূচনা করেছে। উভয় দেশেই ধ্বনিত হয়েছে পুরনো রাজতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা। নতুন মূল্যবোধ মেনে নেওয়ার ব্যাপারে উভয় দেশেই প্রকট হয়েছে প্রাথমিক সংশয় লক্ষণ। যে-যার স্বকালের সংকীর্ণ সমাজবিধির ঊর্ধ্বে উঠে গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথ দুজনই লড়াই করেছেন তাঁদের সৃষ্টি ও কাজের মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থার প্রচার তথা রূপায়ণে।

ভাষা এবং সাহিত্যের ব্যাপারেও তাই। জার্মানিতে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ছিল ফরাসি ভাষার। মধ্যযুগীয় দরবারি ভাষার। বাংলা ভাষায় কাটাতে হয়েছে পার্সি এবং মোঙ্গলীয় প্রভাব। পুনরুত্থান ঘটাতে হয়েছে ভাষাজননীর। এ-কাজ, সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে আধুনিক বাংলা ভাষার ‘নির্মাণ’, তা প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের অবদান। জার্মানিতে চলিত ভাষা আগে থেকেই সাহিত্যের মাধ্যম ছিল। গ্যোয়টে সেই ভাষাকে করে তুললেন লোকভাষা। প্রায়শই গ্রাম্যগন্ধী, তাঁর নাট্যনিবেদনের মঞ্চোপযোগী ঝোড়ো, ঝাঁঝালো গণবোধ্য ভাষা।

সমধর্মী কালবিবর্তনের সাক্ষী দুটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের এই হলো প্রাথমিক মুখাভাস। এবার আসা যাক ভাবগত দিকে।

জার্মান মানসে একটা ধারণা রূপ নিয়েছে। তা হলো : বিশ্বপ্রতিভা (universal genius) সম্ভবত এটা পুরোপুরি জার্মান ধারণা। এই ধারণা মনে নিয়েই আমি গ্যোয়টে এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনকেই দেখতে চাই। জার্মান সংস্কৃতিতে গ্যোয়টে বিশ্বপ্রতিভার প্রতিমূর্তি। কেননা, তাঁর প্রতিভার চরমোৎকর্ষ পরিব্যাপ্ত বহু বিচিত্র ধারায়। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি শুরু করেছেন কবি হিসেবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে ব্যক্ত করেছেন কবিতায়। দুজনেই সিদ্ধহস্ত বহু বিচিত্রধর্মী কবিতায়। গীতি-কবিতা, কাহিনি-কবিতা, সাধন-কবিতা, বিষাদ-কবিতা, হাসির কবিতা, এমনকি কণাকবিতাও।

উভয়েই ব্যবহার করেছেন ওজস্বিনী সাধুভাষা, সেই সঙ্গে লোকপ্রবাদও।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার। দুজনেরই কবিতা দরকার হয়েছে তাঁদের অস্তিত্বের আনন্দ-বেদনা, তাঁদের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা ও হতাশার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের জন্যে। সেই সব মুহূর্তে তাঁদের আত্মপ্রকাশের আর্তি উৎসারিত হয়েছে ছড়ায়, ছন্দে, শব্দবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই আর্তির আরো দুরন্ত স্বপ্রকাশ তাঁর গানে। অনেক গান তিনি রচনা করেছেন মুহূর্তের প্রেরণায়, শুধু সেই মুহূর্তের আবেগসুধা ঢেলে। গান ও কবিতার এই মেলবন্ধন, মেলবন্ধন কবি ও গীতিকারের ভারতে এখনো সজ্ঞাকৃতির শিরোপা পেয়ে থাকে। ইউরোপে কিন্তু মধ্যযুগ থেকেই এই ঐক্যসূত্র শিথিল হয়ে গেছে। গ্যোয়টের কিন্তু গানের প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতা ছিল। তা তিনি সখেদে স্বীকার করেছেন।

কলকাতার জেসুইট ফাদার পিয়েরে ফালোঁ (Fr. Pierre Fallon) নাম আমাদের অনেকের মনে থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথ এবং গ্যোয়টের বিশ্বজনীন কবিকৃতির সাধুবাদ করেছেন তিনি।  লিখেছেন :

(রবীন্দ্রনাথের) কবিতার তুলনা করা যায় গ্যোয়টের চিরনতুন শিল্পকলার সঙ্গে, তাঁর বিশ্বজনীন সৃষ্টিবৈচিত্র্যের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এবং গ্যোয়টে, দুই কবি পরস্পরে একই সুরে বাঁধা। তাঁদের কাব্যকৃতি সমান সমৃদ্ধ। অসীম বৈচিত্রম্যয়।৪

গদ্যসাহিত্যেও একই কথা। গল্পে-উপন্যাসে-জীবনকথায়, সমালোচনা সাহিত্যে, বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে, ভ্রমণকথা ও অতিকায় পত্রসম্ভারে দুজনের সৃষ্টিই অসীম বৈচিত্র্যময়। কত জটিল এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অভিব্যক্তি ভাষা পেয়েছে তাঁদের মহৎ সৃষ্টিতে। আজো সেগুলো বাংলা এবং জার্মান সংস্কৃতির প্রাণরস জুগিয়ে চলেছে। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাচেতনার আদল কি রবীন্দ্র-উপন্যাসের নির্মাণ নয়? ধরুন তাঁর উপন্যাস ঘরে বাইরের কথা। সেই চিন্তাচেতনা কি বিকশিত হয়নি গোরার পরমতসহিষ্ণুতা আর  আন্তর্সংস্কৃতিবাদের আদর্শে?৫ একইভাবে, জার্মান ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতির কথা আমরা ভাবতে পারি না গ্যোয়টের Die Leiden desfjungen Werthers (তরুণ ওয়ের্দারের দুঃখ) বিবৃত তরুণ ওয়ের্দারের মেরুদন্ড ছাড়া। ভাবতে পারি না। Wilhelm Meisters Lehrjahre (ওয়েলহেম মায়িস্টারের কড়চা) বা তাঁর সুবিস্তৃত আত্মজীবনী Aus Meinem Leben : Dichtung und Wahrheit (আমার জীবন থেকে : কবিতা এবং সত্য) ছাড়া।

গ্যোয়টে ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই মঞ্চনাটক রচনা করেছেন। দুজনেই মঞ্চের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন প্রায় সারাজীবন। উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল লোকশিক্ষা (Volkserziehung)। উভয়েই মঞ্চকে দেখেছেন লোকশিক্ষার ভিত পোক্ত করার জায়গা হিসেবে। গ্যোয়টে নাটক লিখেছেন ভাইমারের (Weimar) মঞ্চের জন্যে। সেখানে তিনি নাটক পরিচালনা করেছেন (১৭৯২-১৮১৭)। তাঁর সমকালের সেরা জার্মান নাটকগুলো মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নাটক লিখেছেন তাঁর শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। নির্দেশনাও তাঁর। নিজে অভিনয় করেছেন। মঞ্চে উঠেছেন গায়ক এবং নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায়।

দুজনেই যত্ন নিয়েছেন মঞ্চসজ্জার ব্যাপারে। কুশীলবের সাজপোশাক ও তাদের নাট্যশিক্ষার ব্যাপারে। মঞ্চকে তাঁরা নিয়েছেন অন্যসব শিল্পের সমন্বয়ী (Gesamtkunstwerk) মাধ্যম হিসেবে। মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাঁরা তাঁদের স্বকালের জনগণের নান্দনিক বোধের পরিচর্যা করেছেন। তাঁদের স্বকালের জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন। আমরা দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ কত সচেতনভাবেই এই সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। যেমন নারী-সমস্যার কথা। জাতপাতের প্রশ্নে, সামন্ততন্ত্র বা স্বাধীনতার প্রশ্নের তাঁর আমজ্জ জড়িয়ে থাকার কথা।

একইভাবে, গ্যোয়টে তাঁর মঞ্চকে চেয়েছেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Padagogische Anstalt) হিসেবে। একটা শ্রেণিকক্ষ হিসেবে। সেখানে সাবালক জনগণ এসে বসবে। কিছু শিখবে। গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথ দুজনকেই তাঁদের স্বদেশ এবং স্বকালের বিশিষ্ট শিক্ষক হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ তাঁরা উভয়েই মঞ্চে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। জনগণেশের ভাঁড়ামি এবং ইতর বিনোদনের আশকারা দেওয়া রঙ্গমঞ্চ তাঁদের হাত ধরে আত্মিক কল্যাণ আর আবেগ ও সামাজিক চৈতন্য শোধনের পীঠস্থানে মূর্তিমতী হয়েছে।

আরো সমাভাস আছে দুজনের। গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথ দুজনেরই বিশ্বপ্রতিভা পূর্ণতা পেয়েছে কাজের মাধ্যমে। স্বাধীনতা সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ কয়েক বছর রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। পূর্ববঙ্গে এবং পরে শান্তিনিকেতনে সমাজ-সংস্কারক হিসেবে কাজ করেছেন। শিক্ষাব্রতী ছিলেন তিনি। গ্রামোন্নয়নের কাজও করেছেন। গ্যোয়টে ছিলেন উয়াইমার আদালতের প্রশাসক। বহুবিচিত্র দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে তাঁকে। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা দুজনেই ছিলেন যে-যার স্বকাল ও স্বদেশের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে।

সমস্ত দেশের দর্শনার্থী ছুটে এসেছেন গ্যোয়টের ভাইমারে। রবীন্দ্র-প্রয়াণের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত শান্তিনিকেতন তখনো ছোট্ট জনপদ। কিন্তু ১৯২১ সালে যখন বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হলো তখন প্রায় গোটা পৃথিবী থেকে লোক এসেছে তা দেখতে। ক্লাসিক্যাল জার্মান সংস্কৃতির ভ্রূণ সৃষ্টি হয়েছে, তা রূপ পেয়েছে ভাইমারের আদালতে। রঙ্গমঞ্চে। তা বেড়ে উঠেছে বিদগ্ধজনের আড্ডায়। আলাপচারিতায়। শান্তিনিকেতন ও কলকাতার উপনিবেশবাদবিরোধী বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায়ও একটা নতুন সংস্কৃতি সমন্বয় গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহযোগীদের প্রেরণায়, পাশ্চাত্যের আধুনিক কল্যাণবাদী আদর্শ এবং প্রাচীন মূল্যবোধের পুনরাবিষ্কারের মিশেলে।

আমরা জানি, শিশুশিক্ষার কাজে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে ছিলেন হাড়ে-মজ্জায়। চিন্তা এবং প্রয়োগ দুদিক দিয়েই। ১৯০১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে একটি স্কুল এবং কুড়ি বছর পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু করেন। গ্যোয়টে শিক্ষকতায় লাগতে পারেননি। কিন্তু Wilhelm Meisters Wander jahre : 1821/1829 (ভ্রমণপথিক উইলহেম মাইস্টারের দিনগুলি) উপন্যাসের সর্বজনবিদিত ‘Padagogische Provinz’ (শিক্ষাজগৎ) অধ্যায়ে তিনি তাঁর শিক্ষাদর্শের প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়েছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, তাঁর ধারণার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনার সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

উভয়ের আদর্শের ভিত্তি শিশুর স্বাধীনতা। তাদের শিক্ষার বিষয় নির্বাচনে তাদের স্বাধীনতা। অন্য শিক্ষাবিদেরা ছোটদের ব্যাপারে এতটা উদার বা আস্থাবান নন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রুডলফ স্টেইনারের (Rudolf Steiner) Waldorfschule (বিশ্বশিক্ষা) পরিকল্পনার কথা। গ্যোয়টের মতে, শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত এমন হওয়া দরকার যাতে শিশু তার নিজস্ব প্রবণতা, প্রতিভা আর অভিজ্ঞতার সুষম উন্মোচনের মাধ্যমে নিজেরাই বিকশিত হতে পারে। গৎবাঁধা হওয়ার দরকার নেই তার। দরকার নেই অনড় কোনো ছক মেনে চলার। পূর্বনির্দিষ্ট কোনো গোঁড়া ধারণায় পরিবৃত হওয়ারও দরকার নেই। বরং তার উন্মেষ ঘটুক প্রাত্যহিকের মোকাবিলায়। পর্যবেক্ষণ, পর্যটন আর নান্দনিক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে।

ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সংজ্ঞার সঙ্গে, তাঁর আমলের শান্তিনিকেতনি শিক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি এক মনে হয়। ব্রিটিশ বিদ্যালয় ব্যবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করে, পাঠ্যবিষয়ের খোপে-খোপে জ্ঞানের পুরিয়া না পাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে বিশেষভাবে দেখেছিলেন ব্যক্তিপ্রেরণার আয়নায়। দেখেছিলেন গানবাজনা আর নাটকের ভেতর দিয়ে। গ্যোয়টের শিক্ষাজগতের ধারণার সঙ্গে প্রাচীন ভারতের আশ্রমিক শিক্ষাপদ্ধতির চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের স্কুল গড়ার প্রেরণাও সেখান থেকেই।

সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রতিভার বিস্তার ঘটেছে বিজ্ঞান অভিযানেও। প্রকৃতি বিজ্ঞানে উভয়েই গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গ্যোয়টের সময়ে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার শুরু হয়েছে। দৃশ্যমান বস্ত্তজগৎ ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গে তাঁর কাব্যের কল্পলোককে মেলানোর কঠিন দায়িত্ব তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করেছেন। শারীরবিদ্যা, রূপতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, আকরতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যার পাঠ ও পরীক্ষায় প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন তিনি। Farbenlehre, 1810-কে (বর্ণতত্ত্ব) তিনি তাঁর সেরা সৃষ্টি মনে করতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে গেছেন। বিজ্ঞান পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃতি লাভের বাসনা তাঁর অবশ্য পূরণ হয়নি। তাঁর অধিকাংশ আবিষ্কার অসম্পূর্ণ বা অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দৃষ্টবস্ত্তর প্রেক্ষাপট আর দ্রষ্টা মানুষের একাত্মতায় তাঁর পর্যবেক্ষণের যে পদ্ধতি, তা পুরোপুরি নিখুঁত। একেবারে মার্কামারা গ্যোয়েটীয়।

অচিরেই বিজ্ঞান তাঁকে ছাড়িয়ে উঠেছে। যন্ত্রণাদায়ক হলেও ছেঁটে ফেলেছেন দ্রষ্টাকেও। পুরো মনোযোগ নিবন্ধ করেছেন দৃষ্ট বিষয়ে। প্রকৃতির সত্যবীক্ষণে ডুবে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল গ্যোয়টের কাছে। ধর্মনীতি ও আদর্শ নিরপেক্ষভাবে, শুদ্ধ গাণিতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছানো, বিমূর্তায়ন ও বাস্তবায়নের যে দীর্ঘ প্রগতি – তার সূত্রপাত এখান থেকে। যুক্তি, জ্ঞান আর বাস্তবতার এই নবোদয় থেকেই।

কাব্য আর বিজ্ঞানকে মেলাতে সমর্থ হয়েছেন গ্যোয়টে। কলা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গভীরে প্রবেশ তথা সমন্বয়ী দৃষ্টিতে তা মেলানোর কাজে সম্ভবত তিনিই শেষতম মনীষা। রবীন্দ্রনাথকেও এই প্রতিভার কৃতিত্ব দেওয়া যায়। স্বকালের যে-কোনো বিষয়ে তাঁর সামগ্রিক ধারণা যে কোনো ভারতবাসীর চেয়ে আজো অনেক বেশি। কলা এবং বিজ্ঞান উভয় বিষয়েই। প্রকৃতি বিজ্ঞানে কবি অসাধারণ আগ্রহের সাক্ষ্য রেখেছেন। বিশ্ব পরিচয় (১৯৩৭) নামে তিনি একটা বই লিখেছেন। বইটার লক্ষ্য ছিল তাঁর স্কুলের ছোটদের মনে বিজ্ঞানে আগ্রহ সঞ্চার। আত্মচরিতে তিনি বলেছেন, ছোটবেলায় তাঁর বাবা তাঁকে হিমালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁকে প্রাথমিক জ্যোতির্বিদ্যা শিখিয়েছিলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানী বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুর সমস্ত উদ্যোগে কবির ছিল সাগ্রহ-সমর্থন। তাঁর সাফল্যে তিনি উৎফুল্ল হয়েছেন।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ গ্যোয়টের মতো পুরোপুরি তৈরি ছিলেন না। কলা ও বিজ্ঞান, দুটো বিষয়ের মধ্যে ভারতবর্ষে এখনো দুস্তর ব্যবধান। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের অর্থ মূলত প্রকৃতির বিস্ময়কর বহিঃপ্রকাশে বিহবল হওয়া। তাতে তাঁর আত্মিক প্রশান্তি ঘটেছে। কাব্যিক উত্তরণ হয়েছে। অন্যদিকে গ্যোয়টের ক্ষেত্রে তা হয়েছে প্রকৃতিসূত্র বোঝার প্রেরণা।

জার্মান ও ভারতীয় মানসিকতার মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায় দৃশ্যশিল্পের ব্যাপারে উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করলে। গ্যোয়টে যেখানে বেড়াতে গেছেন সেখানের প্রকৃতি থেকে সাগ্রহে তাঁর ছবির রসদ খুঁজে নিয়েছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চোখের দেখার অবিকল প্রতিমূর্তি রচনা। চিত্রশিল্পে তাঁর তালিম ছিল না। তাঁর ছবিতে তাই আঙ্গিকগত দুর্বলতা নজরে আসে। কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টি এবং পারিপার্শ্বিকের ধারণা অত্যন্ত স্বচ্ছ। সংরক্ষিত তাঁর কমবেশি ২ হাজার ৬০০ ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে ভূপ্রকৃতি আর অট্টালিকা। মনুষ্যমূর্তি বিরল। ছবি তাঁর বিশ্লেষণী প্রকৃতি বর্ণনার মতোই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তাঁর Italienische Reise : 1813, 1817-র (ইতালি পর্যটন) কথা। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ কখনো প্রকৃতি থেকে বিষয়বস্ত্ত চয়ন করেননি। তাঁর ছবির উৎস কল্পনা। অবচেতন। উন্মুক্ত কল্পনা যেমন রূপ দিয়েছে সেভাবেই তিনি প্রকৃতি ও মানব শরীরকে ছবির বিষয় করে তুলেছেন।

এ পর্যন্ত গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী বিশ্বপ্রতিভার দশ দিগন্ত পরিক্রমা হলো। আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গে বিশ্বজনীনতা কিন্তু অন্য এক তাৎপর্যে মন্ডিত। তা হলো, ভাবের বিশ্বজনীনতা। আত্মিক বিশ্বজনীনতা। গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথের পাঠকদের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। এঁরা দুজনেই খোঁজ-তল্লাশ করেছেন বুদ্ধির অনধিগম্য এক অতীন্দ্রিয় লোকের। সর্বং খলিদ্বং ব্রহ্ম – ঔপনিষদের এই মন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এই মন্ত্র তাঁকে নিয়ে গেছে ব্রাহ্মসমাজে। নিয়ে গেছে তাঁদের নিরাকার একেশ্বরবাদে। বিমূর্ত চিন্তাভাবনায় কখনো খুব বেশি অনুরক্ত না হয়েও সৃষ্টিসংসারের মধ্যে এক মহাজাগতিক ঐক্যের সন্ধান করেছেন তিনি। তা প্রাপ্তির অভিজ্ঞতাও তাঁর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একান্তভাবে সংগতি-সন্ধানী। সংগতি তাঁর নিজের মধ্যে। সংগতি মানুষের মধ্যে। প্রকৃতির মধ্যে। তাঁর কাছে এই সংগতির সূচনাবিন্দু আমাদের আত্মসংহতি৬ বোধের জাগরণে। পরে তা ছড়িয়ে যেতে পারে আমাদের চারপাশের সঙ্গে ঐক্যের উপলব্ধিতে।

কবির বিশ্ববোধ সব সময়েই ইন্দ্রিয়বেদ্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ, বিশেষ করে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে। কিন্তু যখন অরূপলোকে তাঁর অবস্থান তখন তাঁর আকুতি ইন্দ্রিয়াতীতের জন্যে – অমর্ত্য, পরমধনের জন্যে। স্থির চিত্তে, শান্ত মনে প্রাপ্তির বন্দনাগানের চেয়ে অপ্রাপ্তির এই আকুতিই তাঁর কবিতায় বেশি প্রাণবন্ত। একে তিনি মজা করে বলেছেন কবির ধর্ম৭। সেই ধর্মগন্ডির মধ্যেই তিনি স্বচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন।

গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথ দুজনেই গভীরভাবে উন্মুখ ছিলেন সৃষ্টি জগতের সত্য ও সুন্দরকে দেখার আনন্দের ভেতর দিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে। জীবনকে উপলব্ধি করতে। কবির জীবনস্মৃতি (১৯১২) পড়লে আমরা দেখব, ঘর-উঠোনে আটক নিঃসঙ্গ বালক কবি রহস্যময়ী বহির্জগতের জন্যে কতখানি কাতর হয়ে উঠেছেন। দেখতে পাব, প্রকৃতির বিস্ময়ে তিনি কীভাবে বিহবল হয়ে পড়ছেন প্রথম শান্তিনিকেতন দেখে বা হিমালয় দর্শনে। দৃষ্টিসুখের চিরঅতৃপ্ত পিপাসা তাঁর প্রকাশ পেয়েছে ডাকঘর (১৯১২) নাটকের একটি বাক্যে। প্রকাশ পেয়েছে ঘরবন্দি রুগ্ণ অমলের আকুল হাহাকার : ‘আমি যা আছে সব দেখব, কেবলই দেখে বেড়াব।’৮

এই একই আকৃতির প্রতিধ্বনি গ্যোয়টের ফাউস্ট নাটকের দ্বিতীয় খন্ডের অন্তিম চরণে, নজরঘাঁটির প্রহরীর কথায়। তার অনুকূল অবস্থান থেকে জগৎকে দেখার উল্লাস সে প্রকাশ করেছে :

দেখা আমার জন্মসত্ব

দেখাই আমার কাজ,

নজরঘাঁটির চাকরি পেয়ে,

খুশি জগৎ মাঝ।

দূরে তাকাই, কাছে দেখি –

তারা গুণি, চাঁদকে দেখি,

দেখি বন, হরিণ বনের মাঝ।

চারপাশে যা আছে যত

আশিস ভরা অপর্যাপ্ত,

যখন তারা অবাক করে

বলি নিজের গলা ধরে

লক্ষ্মীসোনা চোখ দুটো রে

দেখলি যা তুই, ঘটল যা সব

কী উজ্জ্বল আলোর মহোৎসব।৯

এবার আসা যাক আলবার্ট শুভাইৎসারের কথায়। তিনিই প্রথম গ্যোয়টে এবং রবীন্দ্রনাথকে পাশাপাশি বসিয়েছেন। তাঁর Die Weltanschauung der indischen Denker : Mystik und Ethik, 1935 (ভারতীয় মনন ও তার বিবর্তন) বইতে তিনি প্রাচীন যুগ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ভারতীয় দর্শনের আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, ভারতীয় দর্শনের মুখ্য বৈশিষ্ট্য জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা। শুভাইৎসার স্বীকার করেছেন, এর একমাত্র ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুভাইৎসার দেখেছেন, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি জগৎকে পুরোপুরি বাস্তব এবং কল্যাণময় বলে মেনে নিয়েছেন। জীবনটাও বাঁচার যোগ্য, এর উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সৃষ্টিকে উপভোগ করা। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক এই দৃষ্টভঙ্গি, শুভাইৎসারের মতে, ইউরোপীয় বিশ্ববীক্ষণের (Weltanschauung) স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। তাই তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইতিবাচক মনোভঙ্গির জন্যে, পশ্চিমি আধুনিকতা অভিধেয় ভারতীয় ও ইউরোপীয় দর্শনের মধ্যে সংগতি সাধনে অদ্বিতীয় যোগ্য ব্যক্তি। তবে ভারত মানেই জীবন-নেতিবাদ আর আর ইউরোপ মানেই জীবন-ইতিহাস – এ ধরনের মেরুকরণে আপত্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের। আপত্তি ছিল এ ধারণা বস্তাপচা বলে।১০

এ-কথা ঠিক যে, তাঁর মহর্ষি পিতা দেবেন্দ্রনাথ কৃচ্ছ্রবাদী হিন্দুত্বের যে-কাঠামো খাড়া করেছিলেন তা থেকে রবীন্দ্রনাথকে সরে আসতে হয়েছে। জগৎ অস্বীকারের যে বৈরাগ্যবাদ তা তিনি অস্বীকার করেছেন প্রবলভাবে। কৃচ্ছ্রসাধন নিয়ে তিনি মজা করেছেন কিন্তু ঈশ্বর আর স্বর্গকে নস্যাৎ করেননি। রবীন্দ্রনাথের আজৈবনিক কাব্যিক এবং আত্মিক সাধনা ছিল ইন্দ্রিয়বেদ্য জাগতিক আনন্দের সঙ্গে ঈশ্বরসন্ধান এবং ঈশ্বরানন্দকে এক করে নেওয়া। এই কটি চরণে মনে হয় তাঁর মূল অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে :

বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।

অসংখ্যবন্ধনমাঝে মহানন্দময়

লভিব মুক্তির স্বাদ।১১

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য কবিতায় ও গানে ঈশ্বর ও পৃথিবী, আপাতবিরোধী এই দুই জগতের আনন্দকে একই সঙ্গে আবাহন করেছেন। আস্বাদন করেছেন। বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এই জীবনগীতির পুনরাবৃত্তি শোনা গেছে তাঁর বার্ধক্যেও :

আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে;

পাকে পাকে ফেরে ফেরে

আমার জীবন দিয়ে জড়ায়েছি এরে;১২

জগৎ ও জীবনের সদর্থক প্রশস্তি ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্য, তা আমরা আলবার্ট শুভাইৎসারের কথায় জেনেছি। এর ঘনিষ্ঠ জার্মান প্রতিশব্দ Welthaltigkeit – জনতাসক্তি। এর ইঙ্গিত জগৎ এবং ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞানের নিরাবরণ উন্মোচনের দিকে। গ্যোয়টের কবিতাকে বৈপ্লবিক এবং দুর্নিবার জগতাসক্তির শিরোপা দেওয়া হয়। তবে তাঁর ইন্দ্রিয় বিনোদনের অভিমুখ যৌন উপকরণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট। তাঁর কামিনী-আসক্তি বিবর্তিত হয়েছে বিচিত্রধর্মী যৌন সম্পর্কে। গ্যোয়টের কবিতা পড়লে আমরা এক অশান্ত সর্বগ্রাসী যৌন তাড়নার অভিজ্ঞান লাভ করি। অদম্য আবেগ আর অনির্বাণ অন্তর্দাহ মনে হয় তাঁর কল্পলোক খাক করে দিয়েছে। তাঁর কবিতার চরণে-চরণে স্বতক্ষরণ রক্ত ঝরিয়েছে। ফাউস্টের দ্বিতীয় পর্বের শেষে এই যৌন উপলব্ধিকে তিনি আদর্শমন্ডিত করেছেন, আসলে দৈবীকরণ সম্পন্ন করেছেন, এক রহস্যময়ী অনন্ত যৌবনায় (Ewig-Weibliche) তার উত্তরণ ঘটিয়ে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মানবজীবনের মহোৎসব। তাঁর পৃথিবী অন্য দিগন্তের অভিসারী। তাঁর জগৎ ও জীবনের গতি, প্রায় অনিবার্যভাবে, মূর্ত থেকে বিমূর্তের দিকে। বিশেষ লক্ষ্যবিন্দু থেকে নিখিল নির্বিশেষের আবাহনে। একটা স্থির ভাব থেকে সর্বপ্লাবী ভাবতরঙ্গে। আমার মনে হয় এটা ভারতীয় মননের বৈশিষ্ট্য। বস্ত্তজগতের সীমানা বিলুপ্ত করে আত্মিক জগতে – নৈর্ব্যক্তিক নিরাকার বিমূর্ত বিশ্বলোকে সে তার সমস্ত আকুতির চূড়ান্ত সান্ত্বনা খুঁজে নেয়। সংক্ষেপে, রবীন্দ্রনাথের জগৎস্বীকৃতি উড্ডীন অধ্যাত্মলোকে। গ্যোয়টের পথ বাঁক নিয়েছে যৌন প্রণয়ের দিকে।

রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা পুরোপুরি লীন পার্থিব অভিব্যক্তিতে। যা দেখলাম আমরা, তা কখনোই আলাদাভাবে দৃশ্যমান নয়। প্রকৃতপক্ষে, এ-বিশ্বাসের বীজ হিন্দুধর্মের গভীরে। মানুষ আর দেবতায় গলাগলি এখানে। মানুষ দেবতা হয়, দেবতা মানুষ। মানুষ ও দেবতার পরস্পরের মিলন-বিরহের এই নিত্য অদলবদল একটা শিল্প। সেই শিল্পকে রবীন্দ্রনাথ রাজকীয় খেলায় ভূষিত করেছেন : ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।’১৩

এই জায়গায়, অন্তত প্রধানত এই জায়গায়, গ্যোয়টে আলাদা। তাঁর প্রেক্ষাপট গ্রেকো-রোমান আর খ্রিষ্টিয়ান সংস্কৃতি। তাতে মানুষ এবং দেবতা আলাদা অস্তিত্ব। সেখানে মানুষ কখনোই দেবতাকে ছাপিয়ে ওঠে না বা দেবতায় বিলীন হয় না। কখনো তেমন হলে তা মানুষের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। তার অতিবাড়ের দৃষ্টান্ত। তেমন হলে তার কপালে অবশ্যই বরাদ্দ ভগবানের মার। ‘Grenzen der Menschheit’ (মানুষের সীমাবদ্ধতা) কবিতায় মানুষের এই ধৃষ্টতার বিরুদ্ধেই গ্যোয়টের পুরনো জিহাদ :

এতখানি দুঃসাহস কেউ যেন কখনো না করে

ঈশ্বরের সমকক্ষ সে, তার স্থান তাঁর সমস্তরে।

যদি সে তেমন বাড়ে, আপনাকে তত উঁচু করে

করোটি খোঁচায় শূন্যে তারাদের বিচলিত করে,

তবে তার জায়গা নেই পা রাখার ধূসর আত্মার

জায়গা নেই মেঘ আর মরুতের সঙ্গে খেলিবার।১৪

বছরের পর বছর ধরে গ্যোয়টের তত্ত্বজিজ্ঞাসার যে বিবর্তন ঘটেছে, তা আলোচনার জায়গা এখানে নেই। এটুকু বলাই যথেষ্ট যে গ্যোয়টে, যতদূর জানা যায়, যে-তত্ত্বজিজ্ঞাসার চর্চায় লেগেছিলেন, তা অনেকটা মরমিয়াবাদের কাছাকাছি। তাঁর মরমিয়া ধারণার আভাস আমরা অনন্ত যৌবনায় (Ewig-Weibliche) পেয়েছি। সাময়িকভাবে বা পরীক্ষামূলকভাবে তিনি খুব সূক্ষ্ম এক জগন্ময় বিশ্ব প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। সেই বিশ্ব তটস্থ শক্তিতে গতিময় এবং প্রাণবন্ত, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের নামকরণের জন্যে তিনি বিশ্বপ্রাণ (Weltseele) ও বিশ্বাত্মার (Weltgeist) কথা বলেছেন। তাঁর বৃদ্ধ বয়সের লেখা কয়েকটা চরণ শোনা যাক :

নিজেকে দেখার জন্যে অনন্ত অসীমে

যে-কেউ অদৃশ্য হবে আনন্দিত মনে

…          …             …

কেননা, অবশ্য সবই শূন্য পরিণাম

যদি তাতে বর্তমান থাকে মহাপ্রাণ।১৫

আট বছর পরে সৃষ্টি-লয়ের সনাতন ধারা সম্পর্কে গ্যোয়টে তাঁর এই হেঁয়ালি দর্শনের জবাব দিয়েছেন সম্পূর্ণ উলটো কথা বলে :

পারে না, পারে না হতে কখনোই কেউ শূন্যসার,

অনশ্বর স্পন্দিত নিত্য আমাদের অন্তরে সবার;

আননেদ, আনন্দে করো আপনার পুষ্টির বিধান

নন্দিত, সমৃদ্ধ করো মহাজীবনেতে পাওয়া স্থান।১৬

এখানে ‘অনশ্বর স্পন্দিত নিত্য আমাদের অন্তরে সবার’ শব্দবন্ধের সঙ্গে আগের ‘এতখানি দুঃসাহস কেউ যেন কখনও না করে’ কথাগুলো তুলনা করলে আমরা গ্যোয়টের অস্তিবাদী উপলব্ধির দিগন্তবিস্তারী বর্ণচ্ছটার ধারণা পাব। ধারণা পাব উভয়ের অন্তর্লীন স্বেচ্ছাকৃত স্ববিরোধেরও।

বিশ্বপ্রতিভা এবং বিশ্বজনীনতা শব্দ দুটির পারিভাষিক প্রিজমে চোখ রেখে এতক্ষণ আমরা গ্যোয়টে-রবীন্দ্রনাথের প্রতিতুলনা লক্ষ করলাম। তা করতে গিয়ে যথাসম্ভব আমরা দেখলাম অনড় অসংগতির চেয়ে তাঁদের মধ্যে সাদৃশ্য সমন্তরের মাত্রাটাই বেশি। বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই সেই সব সাদৃশ্য চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্যোয়টে এবং রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক যে স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক পরিস্থিতি, যার মধ্যে তাঁদের অবস্থান আর সৃষ্টিকর্ম, এখানে তা আমরা অনেকটাই অগ্রাহ্য করেছি।

তাঁদের স্বকালের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক পরিস্থিতির দিকে সমভাবে গুরুত্ব দিলে আমরা দেখব তাঁরা একে-অন্যের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা। গ্যোয়টে এবং রবীন্দ্রনাথকে যথাক্রমে জার্মান এবং ভারতীয় মননের স্বতন্ত্র প্রতীক ধরে আমরা একটা বিবরণী তৈরি করতে পারি। তাহলে দেখা যাবে, গ্যোয়টে ছিলেন যুক্তিবাদ এবং জ্ঞানোদ্দীপ্তির প্রতীক। তাঁর শিকড় গ্রিক পুরাণকথায়। রোমান বনেদিয়ানায় এবং খ্রিষ্টিয়ান সংস্কৃতিতে। তা সত্ত্বেও এই তিনের সঙ্গে নিজের দূরত্ব তৈরি করে তাঁর লড়াই বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিগ্রাহ্য এবং মনোবেদ্য এক জগতের জন্যে। ফাউস্টের জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির অন্বেষণ, সবকিছু জানার জন্যে তার শয়তানের শক্তি কাজে লাগানোর অভিপ্রায় আসলে কাফকার আধুনিক অচেনা প্রেমহীন জগৎ সম্পর্কিত হতাশার পূর্বসূরি।

এই ধরনের হতাশা রবীন্দ্রনাথ কখনো জানেননি। এমনকি, তাঁর জীবনসন্ধ্যার নিশিঘোর কবিতাতেও নয় সম্ভবত। তাঁর শেষ ক-বছরেও তিনি সান্ত্বনা বোধ করেছেন এই উপলব্ধিতে যে, তিনি আছেন পৃথিবীর আশ্রয়ে, তিনি সুরক্ষিত তাঁর অন্তস্থ ঐক্যবলে।

দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বিবর্তননির্ভর যে বিশ্লেষণ পদ্ধতি, তা কিন্তু বর্তমান আলোচনা পদ্ধতির মতোই সমানভাবে কার্যকরী। যুগপৎ সমন্বয় ও পৃথকীকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় গ্যোয়টে এবং রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধির চেষ্টা এবং তার মনন বৈভবে মানবসমাজের ঋব্ধ হওয়া – এই সম্ভবত আমাদের সেই পথরেখা, শেষ পর্যন্ত যা আমাদের বেছে নিতে হবে।

 

তথ্যসূত্র

১. রবীন্দ্রনাথকে লেখা আলবার্ট শুভাইৎসারের চিঠি, ১৫ আগস্ট ১৯৩৬ : রবীন্দ্র ভবন আর্কাইভ, শান্তিনিকেতন (মূল ফরাসি থেকে লেখকের অনুবাদ)।

২. Rabindranath Tagore’s Weltbedeutung (Berlin : Akademie-Verlag, 1962)

৩. Goethe and Tagore : A Retrospect of East-West Colloquy (New Delhi : South Asia Institute, University of Heidelberg, Delhi Branch, 1973)

৪. Tagore in the West : Pierre Fallon s.j. : in Rabindranath Tagore : A Centenary Volume 1861-1961 (New Delhi Sahitya Academi, 1961 : Reprinted 1986) p 320

৫. Rabindranath Tagore : the Poet and the People : Sukanta Chaudhuri in The Poet and His World : Critical Essays on Rabindranath Tagore by Mohammad A. Quayum (ed) (Orient BlackSwan, 2011) Pp 44-67.

৬. Rabindranath Tagore :  ‘The Poet’s Religion’ : in The English Writings of Rabindranath Tagore vol 2 : by Sisir Kumar Das (ed), (Sahitya Akademi, New Delhi 1996) P 357.

৭. প্রাগুক্ত পৃ ৪৯৫-৫০৫

৮. ‘ডাকঘর’, রবীন্দ্র রচনাবলি : ষষ্ঠ খন্ড (বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৩৯৫) পৃ ৩৫৭।

৯. ইংরেজি মূল থেকে ভাষান্তর অনুবাদকের।

১০. Rabindranath Tagore and Germany : A Documentation by Martin Kampchen (Max Mueller Bhavan/Goethe Institute, Kolkata 1991) pp 90-94.

১১.  ‘নৈবেদ্য’ : রবীন্দ্র রচনাবলি : চতুর্থ খন্ড (বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৩৯৪) পৃ ২৮১।

১২. ‘বলাকা’ : রবীন্দ্র রচনাবলি :  ষষ্ঠ খন্ড (বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৩৯৫) পৃ ২৭১।

১৩. ‘গীতাঞ্জলি’ : রবীন্দ্র রচনাবিল : ষষ্ঠ খন্ড (বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৩৯৫) পৃ ৮০।

১৪. ইংরেজি মূল থেকে ভাষান্তর অনুবাদকের।

১৫. কবিতাটি লেখা ১৮২১ সালে। ইংরেজি মূল থেকে ভাষান্তর অনুবাদকের।

১৬. কবিতাটি লেখা ১৮২৯ সালে। ইংরেজি মূল থেকে ভাষান্তর অনুবাদকের।