গ্রহণে অগ্রহণে রবীন্দ্রনাথ

দেবেশ রায়

 

তাঁর সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের বাঙালিত্ব সম্পূর্ণের চাইতে কিছু অধিক – তাঁর সৃষ্টির বিপুলতা সভ্যতার ইতিহাসেও বিস্ময়কর। তাঁর অন্যান্য কাজের কথা তুলছি না। শুধু কল্পনা থেকে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন – সেই কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-ছবির বিপুলতার কোনো শরিক নেই – সভ্যতাতেই নেই। এই উল্লেখে আমি তাঁর প্রবন্ধ-জাতীয় লেখার কথা মনে রাখিনি। কারণ – প্রবন্ধ-নিবন্ধ জাতীয় রচনা মনন-অধ্যয়ন থেকে তৈরি হয়। সেগুলো সৃষ্টিকর্ম হিসেবে বিবেচনা যেন না-করাই নিরাপদ।রবীন্দ্রনাথের এই নিবন্ধ-জাতীয় রচনার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য এখনো আলোচিত হতে শুরু হয়নি। তিনি এইসব রচনায় একটা পদ্ধতি, যাকে মেথড বলে, প্রতিষ্ঠা করেন। সেই প্রসঙ্গে তিনি যত কথা বলেন তা ওই মেথড বা পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের ভাষা ঠিকভাবে পড়া হয় বলে মনে হয় না। সেই কারণে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে তাঁর এই লেখাগুলি নিয়ে খুব একটা কথা ওঠে না। উদাহরণ হিসেবে তাঁর চারিত্রপূজা বইটির কথাই বলা যায়। রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগরের জীবন ও কৃতির আলোচনায় তিনি প্রায় সব সময়ই তাঁদের এক দ্বান্দ্বিকতায় স্থাপন করেন। তাঁদের সময়ের দেশ ও সমাজের সঙ্গে এঁরা স্বনির্বাচিত কোনো দ্বন্দ্বকে তাঁদের জীবনের প্রধানতম ব্রত করে তুলেছিলেন – সেটাই রবীন্দ্রনাথ খুঁজে বের করতে চেয়েছেন। ১৩২৯-এ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একটি লেখায় তিনি এমনকি এ-কথাও বলেছিলেন যে, বিদ্যাসাগরকে তাঁর দানধ্যান ও করুণার জন্যই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন যাঁরা, ‘বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্যের খ্যাতির দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড়ো পরিচয় সেইটিই তাঁর দেশবাসীরা তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।’ এটা একটা মন্তব্য মাত্র নয়, বা বিদ্যাসাগরকে তিনি কীভাবে দেখতে চান তার কোনো উপস্থাপন মাত্র নয়। বাক্যগুলির পাঠ কীভাবে তৈরি করে তোলা হচ্ছে ও বাক্যগুলিকে কোন সম্বন্ধে গেঁথে-গেঁথে বাচ্যটিকে অবধারিত করে তোলা হচ্ছে – তা খুঁটিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, রবীন্দ্রনাথ একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির কথা বলছেন। আমাদের দেশে দয়ালু ও করুণাবান মানুষের সঙ্গে বিদ্যাসাগরকে এক করে ফেললে তাঁর শ্রেষ্ঠ গুণকে আড়াল করে ফেলা হবে। এমন আড়ালের পেছনে অভিসন্ধিও কাজ করতে পারে সন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ‘তিরস্করণী’র মতো কঠিন একটি শব্দও ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে অকৃপণ, বদান্য ও পরোপকারী মানুষ হিসেবে দেখতেই চাইছেন না, দেখতে চাইছেন এক ‘নির্ভয়’ ‘আক্রমণ’কারী হিসেবে। এই পদ্ধতির ভেতরই গ্রহণ ও অগ্রহণের একটা সক্রিয়তা আছে। রবীন্দ্রনাথের এই গ্রহণ-অগ্রহণের সক্রিয়তা তাকে বোঝার বেলায় বড় একটা প্রয়োগ করা হয় না। বরং তাঁর এক ঐক্যবোধই প্রধান হয়ে ওঠে তাঁর সম্পর্কে আলোচনায়। তাঁর আত্মার ভেতরের দ্বন্দ্বের কথা, বিশেষ করে, শঙ্খ ঘোষের লেখাতে আমরা পড়ে আসছি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় জুড়ে। সেই আত্মার বাইরে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসেও আছে এমন গ্রহণ-অগ্রহণের বাস্তব।

দুই

রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দেশবাসী, শান্তিনিকেতনের সহকর্মী-প্রতিবেশী ও তাঁর স্বভাষী মানুষদের কাছ থেকে তাঁর কী বিচ্ছিন্নতা কোথায় ছিল ও আছে? এক রকম করে তো রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণের চেষ্টা হয়েছে ও হচ্ছে। সেটা কি যথেষ্ট? বা, যথেষ্ট নয়? এই ইষ্টের কি কোনো হদিস মেলে?

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেসব আলোচনা, ছোট ও বড়, হয়েছে তাতে তো দেখা যায়, অনুগত এক পাঠকসমাজ সেই প্রথম বয়স থেকেই তাঁর ছিল। সে-সমাজ প্রথমে পারিবারিকই ছিল, তারপর হয়ে যায় আত্মীয়জন ও তারও পর তাঁদের চেনাজানা মানুষ। সেইসব পাঠক প্রায় সকলেই ছিলেন বয়সে তাঁর চাইতে বড় ও শিক্ষিত। তাঁদের নিজেদের শিল্পচর্চা ও সমাজকর্মের আলাদা ক্ষেত্র ছিল। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রথম কৈশোর থেকেই তাঁরা শুধুই প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের সাহিত্যসংক্রান্ত কাজকর্মে তাঁর সঙ্গী হওয়ার চেষ্টায় তাঁরা কখনো কোনো বাধা হননি, বরং তাঁর সম্পর্কে একটু মুগ্ধতাই ছিল বড়দের। তিরিশ বছর বয়সে পৌঁছুবার আগেই বাংলার কাব্যপাঠকদের একটি গোষ্ঠীর কাছে তিনি প্রধান এক বাংলা কবির মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাস পড়ে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন ও সন্ধ্যাসঙ্গীত পড়ে এক বিবাহ-অনুষ্ঠানে বরমাল্য নিজের কণ্ঠ থেকে খুলে তাঁর কণ্ঠে পরিয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর তিরিশ থেকে চলিস্নশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কারো কোনো দ্বিধা ছিল না যেন। যাঁরা তাঁর কবিতা পছন্দ করতেন না বা তাঁর গানও অপছন্দ করতেন, তাঁরাও কিন্তু তাঁর কাব্যক্ষমতা নিয়ে কোনো সন্দেহ জানাননি। বরং বলা যায়, তাঁরা ক্ষমতার অপপ্রয়োগের কথাই বেশি তুলতেন। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার অর্থ-অস্পষ্টতাই ছিল তাঁদের প্রধান অভিযোগ। আবার, এই বাক্প্রতিমাই ছিল তাঁর অনুরাগীদের মুগ্ধতার প্রধানতম কারণ। চলিস্নশের দশক যখন তিনি বয়সে পার হচ্ছেন, তখনই ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁকে ‘বিশ্বকবি’ বলে অভিহিত করেন। ব্রহ্মবান্ধব যে সচেতনভাবেই শব্দটি ব্যবহার করছিলেন, তা এই বাক্যটির অপরাংশে আরো স্পষ্ট – রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিশ্বমুখী একমাত্র বাতায়ন আর বিশ্বের পক্ষে রবীন্দ্রনাথই একমাত্র গবাক্ষ, যে-পথে বাংলাকে জানা যায়। অজিত কুমার চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি তত্ত্বভিত্তি রচনা করেন রবীন্দ্রনাথের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে। এই তত্ত্বভিত্তি রবীন্দ্রনাথ-বিরোধিতার কাব্যতত্ত্বের সমান্তরাল হয়ে উঠেছিল।

রবীন্দ্রনাথের আগে আর কোনো বাঙালি কবিকে নিয়ে কাব্যতত্ত্ব ও রচনার ঔচিত্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। রঙ্গলাল-হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্র-মধুসূদন – এঁরাই তো প্রাক-রবীন্দ্র প্রধান বাংলা কবি। এঁরা নিজেরা কাব্য সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন, প্রধানত কাব্য নিয়ে নতুন ধারণা প্রকাশ করতে। এঁদের লেখাপত্র নিয়ে তখনকার কাগজপত্রে আলোচনা হতো বেশ ছড়িয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র এমন সাহিত্যপরিচয়সূচক লেখা অনেক লিখেছেন! সেইসব আলোচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তার কোনো দ্বিধা ছিল না, বরং তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল কবির বিষয়কল্পনা ও তাঁর আঙ্গিক-সামর্থ্য স্পষ্ট করা। এর নিদর্শন পাওয়া যাবে নবীনচন্দ্রের ‘রৈবতক’-ত্রয়ী ও ‘পলাশির যুদ্ধ’, হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’, দীনবন্ধুর সাহিত্যবৈশিষ্ট্য ও ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের কবিতা নিয়ে তাঁর আলোচনায়। মধুসূদন যে কৃতি অর্জন করেছিলেন, সে-বিষয়ে খুব কিছু মতান্তর ছিল না। এইসব কবিতা ও কাব্য-আখ্যান থেকে শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রসমাজের মনে ‘নতুন সাহিত্য’ নিয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই ধারণার দুটি প্রধান উপাদান ছিল : কাহিনির সম্পূর্ণতা ও কাব্যরচনা। রবীন্দ্রনাথের কবিতাচর্চা অনেক দিন পর্যন্ত তো কাহিনিনির্ভরই ছিল। ‘কবি-কাহিনী’, ‘বনফুল’, ‘ভগ্ন হৃদয়’, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘ভগ্নহৃদয়’, রুদ্রচ-’, ‘নলিনী’। সেই কবিতায় যখন রবীন্দ্রনাথ সুরের বৈচিত্র্য ও নাটকীয়তা সঞ্চার করলেন তখন এই গানগুলির বোধ্যতা সহজ থাকল না। প্রতিষ্ঠিত রুচি এই কবিতার খুব অনুকূল ছিল না। তা থেকেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নিন্দা রটেছিল ও রবীন্দ্রনাথকে তাঁর কাব্যের যুক্তি নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে হচ্ছিল। সেই প্রক্রিয়াতেই রবীন্দ্রকাব্যজিজ্ঞাসা একটি স্বতন্ত্র বিষয় হয়ে ওঠে।

সেই স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে আরো একটি জিজ্ঞাসা যুক্ত হয়েছিল। বাংলাকে দুটো ভাগে ভাগ করার কথা উঠেছিল। একটি ভাগ হবে পুব-বাংলা ও আসাম, আর একটি ভাগ ছিল পশ্চিমবঙ্গ। এর বিরুদ্ধে সারাবাংলায় আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনে নানা কারণে খুব বেশি থাকতে পারছিলেন না। প্রধানত তাঁর মেয়ের অসুস্থতার কারণে। তিনি তখন থাকেন গিরিডিতে। বাংলা বিভাজনের মিছিলে হেঁটেছেন, আন্দোলনের জন্য গান লিখে দিয়েছেন ও এই স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর কথা তিনি বিভিন্ন সময়ে বড়-বড় প্রবন্ধে লিখে সে-প্রবন্ধ পাঠ করেছেন।

১৯১০-এর ৪ জুলাই, রবীন্দ্রনাথ কাদম্বিনী দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘একথা তুমি নিশ্চয় জেনো ব্রাহ্ম পরিবারে যদিও আমার জন্ম তবু ঈশ্বর উপাসনা সম্বন্ধে আমার মন কোনো সংস্কারে আবদ্ধ হয় নি। তার একটা কারণ, অতি শিশুকালেই আমার মধ্যে
কবিপ্রকৃতি অত্যন্ত প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল – আমি আমার কল্পনা নিয়েই সর্বদা ভোর হয়ে ছিলুম – ধর্ম প্রভৃতি সম্বন্ধে কে কী বলে বাল্যকালে তা আমার কানেও যায় নি। তার পরে আমার বয়স যখন ১৩/১৪, তখন থেকে আমি অত্যন্ত আনন্দ ও আগ্রহের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করেছি – তার ছন্দ রস ভাষা ভাব সমস্তই আমাকে মুগ্ধ করত। যদিও আমার বয়স অল্প ছিল তবু অস্ফুট রকমেও বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের মধ্যে আমি প্রবেশ লাভ করেছিলুম। এই বৈষ্ণবকাব্য এবং চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি কাব্য অবলম্বন করে চৈতন্যের জীবনী অনেক বয়স পর্যন্ত বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এমন কি আমাদের সমাজের ধর্মালোচনার সঙ্গে আমি বিশেষ যুক্ত ছিলুম না। তার পরে আমার স্বদেশ অভিমানও বাল্যকাল থেকে অত্যন্ত প্রবল। সেজন্যও যা কিছু আমাদের দেশের তাকে ভালভাবে গ্রহণ করতে আমি সর্বদাই প্রস্ত্তত ছিলাম – বরঞ্চ প্রতিকূল কিছু শুনলে জোর করে নিজের বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও তার প্রতিবাদ করা আমার স্বভাব ছিল। যখন থেকে আমি আমার অন্তরতম প্রকৃতির স্বাভাবিক ব্যাকুলতার প্রেরণায় সাধনার পথে প্রবৃত্ত হলুম তখন থেকে

আমার পক্ষে যা বাধা তা বর্জন করতেই হয়েছে এবং যা অনুকূল তাই গ্রহণ করেছি। অর্থাৎ যখন মানুষের সত্যকে না হলে নিতান্ত চলে না তখন সে দেশের খাতিরে বা সংস্কারের টানে কল্পনার ইন্দ্রজাল দিয়ে নিজেকে আর ভুলিয়ে বেড়াতে কোনোমতে পারে না – এমন কি সে-রকম ফাঁকিতে তার অত্যন্ত একটা ধিক্কার বোধ হয়। যখন আমরা সত্যই ঈশ্বরকে চাই তখন আমরা নিজের বা অন্যের সঙ্গে লেশমাত্র চালাকি করতে পারিনে।’ (চিঠিপত্র, সপ্তম খ-, বিশ্বভারতী, ১৩১১, পৃ ২৭-২৮)

এই চিঠিটি যখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তখন তাঁর বয়স ৪৯। খুব বাইরের সন-তারিখের হিসাবেও তিনি নৈবেদ্যচৈতালি
কাব্য-কল্পনায় ঢুকে পড়েছেন ও খেয়া থেকে গীতাঞ্জলির কল্পনা, শব্দে ছন্দে প্রতিমায়, মূর্ত হয়ে উঠছে। ১৯১২-এর মার্চে আকস্মিক পীড়ায় শেষমুহূর্তে তাঁর বিদেশযাত্রা স্থগিত রাখতে হলো। ডাক্তারের পরামর্শ পালনের জন্য তাঁকে পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে শিলাইদহে যেতে হলো। বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটাতে নিজের খেয়াগীতাঞ্জলিগীতিমাল্য থেকে ইংরেজি অনুবাদ শুরু করলেন। ইন্দিরা দেবীকে জানালেন চিঠিতে, একসময় যে-কবিতা লিখেছিলেন বুঁদ হয়ে, সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ, কতটাই বিশ্রাম দিচ্ছে তাঁকে।

এই সবগুলো ঘটনা নিশ্চয়ই এই চিঠিটি লেখার আগেই ঘটে যায়নি। কিন্তু এর আগে বা পরে কখনো কি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যের ধর্মাচার থেকে মুক্তি, তার বাল্যের কবিতামগ্নতা, বৈষ্ণব কবিতা ও ধর্মব্যাখ্যায় তাঁর আগ্রহ, তাঁর স্বদেশ-বাৎসল্য – এই বিষয়গুলিকে তাঁর জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে বলেছেন?

সম্ভবত এই সময়ই শান্তিনিকেতন নামে একটি ধর্মসংক্রান্ত কাগজ শান্তিনিকেতন থেকে বেরোতে শুরু করে। ১৯১০-এর ১৫ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দেবালয় সমিতি’র এক সভায় ‘রবীন্দ্রসাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব কিসে’ নামের একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ আগেই পড়েছিলেন ও প্রবাসীতে প্রকাশ সম্পর্কে তাঁর সংকোচ জানিয়েছিলেন। প্রবন্ধটিতে চারুচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলে লেখেন, ‘যাহা সামান্যতা পরিহার করিয়া ভুমানন্দের অন্তরঙ্গ আত্মীয় রূপে প্রকাশিত হইয়া উঠে, … যাহা বিশ্বের ভিতর দিয়া মানবমনকে বিশ্বেশ্বরের চরণপদ্মের অভিমুখিন করে। ইহা ভারতবর্ষের একান্ত নিজস্ব সাধনা। এবং এই লক্ষণটি আমরা কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের কাব্যেই পরিস্ফুট দেখিতে পাই।’

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো-কোনো বাংলা পত্র রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে তীব্র সন্দেহ জানায়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৮৩৩ শতাব্দ অর্থাৎ ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ বেরোয়, ‘রোমীয় বহুদেববাদের পরিণতি’। লেখাটির শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘তিন শতাব্দীর প্রাচ্যপ্রভাবে রোমীয় বহুদেববাদের যে পরিণতি ঘটিয়াছিল, জার্মান প–ত ফ্রানজ কুমন্ট তাহার আলোচনা করিয়াছেন। …আমরা …ভারতের আধুনিক ধর্মান্দোলনের সহিত রোমের তাৎকালিক অবস্থার সাদৃশ্যের প্রতি পাঠকের চিত্ত আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি।’ প্রবন্ধটির শেষে আবার বলেছেন, ‘বর্তমান ভারতে ব্রাহ্মধর্মের সহিত নবজাগ্রত হিন্দুধর্মেরও প্রায় এইরূপ সম্বন্ধ দেখা যায়। সেই জন্যই কেশবচন্দ্রের সহিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের যোগ, অথবা বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর শেষ বয়সের মতের সহিত হিন্দুসমাজের মতের মিলন সম্ভবপর হইয়াছে। বিবেকানন্দ যে এক সময় উৎসাহী ব্রাহ্ম ছিলেন তাহাতে তাঁহার পরবর্তী মত পরিবর্তনের কোনো গুরুতর বিঘ্ন ঘটায় নাই।’ (চিঠিপত্র, ১৪শ খ-, পৃ ৪১১)

ময়মনসিংহে রবীন্দ্রজয়মত্মী উপলক্ষে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ‘বক্তৃতা’ দেন। তার ‘সারমর্ম’ চিঠিপত্রের এই খ– আছে। চারুচন্দ্র সে-লেখাটিতে একটি জায়গায় শিলাইদহে কবির সঙ্গে তাঁর বোটে থাকার ঘটনা বলেছেন। নির্দিষ্ট করে বলা নেই এটা কোন বছরের ঘটনা। প্রসঙ্গ থেকে মনে হয়, হতে পারে আমরা যে-সময়ের কথা বলছি, ১৯১২ বিদেশযাত্রা স্থগিত রেখে বিশ্রামের জন্য শিলাইদহে গিয়ে নিজের কবিতা অনুবাদ করার সময়ই, চারুচন্দ্র গিয়েছিলেন শিলাইদহে। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিদিনের অভ্যাস ও জীবনযাপনের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখছেন, ‘শিলাইদহে থাকবার সময় আমি কবির খুব ঘনিষ্ঠ সংসর্গ লাভ করবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। সেই সময় তাঁর উপাসনায় তন্ময়তা আর গভীর ধ্যান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভোর রাত্রে একখানি চেয়ার বোটের সামনে পেতে পূর্বদিকে মুখ করে তিনি ধ্যানে বসতেন, আর বেলা হলে সূর্যের আলোক প্রতপ্ত হয়ে তাঁর মুখের উপর না-পড়া পর্যন্ত তাঁর ধ্যানভঙ্গ হত না।’

এই ঘটনা থেকে এমন একটি ধারণার যুক্তি পাওয়া যায় যে, রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিনে এই ‘ধ্যানে’র একটি নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। তিনি পদ্মার চরের একাকিত্বেও সেই অভ্যাস থেকে সরতেন না।

কাদম্বিনী দেবীকে যে-চিঠিটিতে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশে বাল্য থেকেই ধর্মবোধ অপেক্ষা কবিত্বের তাৎপর্য বেশি, সেই চিঠিতেই তিনি বলছেন, ‘যখন থেকে আমি আমার অন্তরতম প্রকৃতির স্বাভাবিক ব্যাকুলতার প্রেরণায় সাধনার পথে প্রবৃত্ত হলুম…’। এই ‘সাধনা’ বলতে কোন সময়টি বোঝানো হচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ ধর্ম-আচারকে ‘সাধনা’ বলেননি কখনোই। ‘সাধনা’ বলতে তিনি বোঝাতেন নিজের নির্ধারিত কর্মের জন্য প্রস্ত্ততি। এমন প্রস্ত্ততি তাঁর স্বভাবেই ছিল, তবুও, এই প্রস্ত্ততিকে ‘সাধনা’ বলেছেন কি নৈবেদ্যর আগে? এই প্রস্ত্ততিকেই নৈবেদ্য থেকে গীতিমাল্য পর্যন্ত তিনি প্রসারিত করেছেন?

এখানে একটা কথা বিশেষ করে লক্ষ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখাতেও এই ‘ধ্যান’ ও ‘সাধনা’র কথা এসেছে। গোরা উপন্যাসে পরেশবাবুর চরিত্রে একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মের ধ্যানের অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। সেইসব মিলে ও শান্তিনিকেতনের ‘মন্দিরে’র ব্রাহ্ম-উপাসনা থেকে এমন ‘ধ্যান’ রাবীন্দ্রিক ধর্মাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।

শান্তিনিকেতনের মন্দিরের উপাসনা ব্রাহ্ম সমাজের রীতি অনুযায়ী ও মহর্ষির ইচ্ছা-অনুযায়ী পালিত হয়। দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে-তিনটি লেখা বা ভাষণ লিখেছিলেন ও বলেছিলেন, তাতে তিনি বিশেষ করে বলেছেন বোলপুরে ও হিমালয়ে দেবেন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক ধ্যানের কথা। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স দশও নয়। সেই বালক পিতার সঙ্গে দিন যাপনের বিরল অভিজ্ঞতা থেকে পিতার ভঙ্গি ও অভ্যাসে প্রভাবিত হয়েছেন – এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে তাঁর লেখার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি স্থির করার অভ্যাসও হয়তো জুড়ে গেছে। এই ‘ধ্যান’ নিশ্চিতভাবে কোনো ধর্মাচার নয়।

 

তিন

প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী গ্রন্থক্রমের পঞ্চম খণ্ড বিরল গবেষণায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের রাজনীতিতে খুব একটা গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন না। নানা স্মৃতিকথায় এই সম্পর্কটি একটু অতিমাত্রায় রঙিন হয়ে আছে। প্রশান্ত কুমার পালের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ের দিন-তারিখ পঞ্জিভুক্ত করেছেন।

২৩ নভেম্বর ১৯০২ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু।

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ মধ্যম মেয়ে রেণুকার মৃত্যু।

১৯০৪ ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মৃত্যু।

১৯০৭ ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু।

২৫ জানুয়ারি ১৯০৩ আদি ব্রাহ্মসমাজ গৃহে রবীন্দ্রনাথ মাঘোৎসবে প্রথম বেদিগ্রহণ করেন।

৯ জুন, ১৯০৬ মোহিতচন্দ্র সেনের মৃত্যু।

১৯০৮ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের মৃত্যু।

৮ অক্টোবর মধ্যম জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যু।

১৯০৩-এ বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রথম উঠেছিল। তার পরে সরকার এ নিয়ে সাড়াশব্দ না করায় বাঙালি জনসাধারণ বিষয়টি প্রায় ভুলেই যান। লর্ড কার্জন ১৯০৪-এর ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বার ভাইসরয় হয়ে এসে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব আবার কার্যকর করতে থাকেন। ১৯০৫-এর ১৯ জুলাই ভারত সরকার বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবটি প্রকাশ করেন ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ গেজেটে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রায় সমস্ত পত্রিকার পাঠক। কিন্তু এই নোটিশটি যে তিনি পড়েছিলেন তার কোনো চিহ্ন কোথাও নেই।

এরও পরে রবীন্দ্রনাথের এই সময় প্রকাশিত গান-কবিতা-প্রবন্ধের কোথাও বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ২৯ জুলাই ১৯০৫ খেয়ার প্রথম কবিতাটি লেখেন ও লিখেই যান। শ্রাবণ সংখ্যা ভা-ারেও তাঁর কোনো লেখা নেই। ২৮ জুলাই ডন সোসাইটির পুরস্কার বিতরণ সভায় তিনি উপস্থিত থাকবেন, এমন বিজ্ঞাপিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি হাজির ছিলেন না। ৩ আগস্ট বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্টার থিয়েটারে একটি সভার জন্য রবীন্দ্রনাথের নাম বিজ্ঞাপিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি আসেননি।

৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আহূত যে-সভায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী বিখ্যাত সমাবেশ হয়, সেখানেও রবীন্দ্রনাথ হাজির ছিলেন – প্রশান্ত কুমার পাল এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি।

রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেন ১২ আগস্ট, শনিবার, ‘বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম ঢেউটি চলে যাবার পর’। ‘ব্রতধারণ’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন ছদ্মনামে। ২৫ আগস্ট ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধ পড়েন টাউন হলে। এই দুটি লেখাতেই বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক দাবি ও বয়কট-কর্মপদ্ধতি নিয়ে তাঁর মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে ঘোষিত হয় যে, ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে।

রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে চলে গিয়েছিলেন ১১ সেপ্টেম্বর। ‘এবারের গিরিডি বাস রবীন্দ্রনাথের জীবনে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে স্বদেশী গান লেখার কারণে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম চারণ-কবির ভূমিকা নিলেন তিনি। মাসখানেকের মধ্যে তিনি ২২/২৩টি গান রচনা করেন, যেগুলি তখনকার লোকের মুখে মুখে ফিরেছে।’

এই পঞ্জির সঙ্গে আর একটি পঞ্জিও নিহিত আছে।

যদি ধরে নেওয়া যায়, এই পঞ্জিটি উনিশ শতকের শেষ চার বছর ও বিশ শতকের প্রথম ১০ বা ১২ বছর, এই ১৫-১৬ বছরের, তাহলে আমরা হয়তো আভাস পাব, রবীন্দ্রনাথ তখন আত্মবিরোধী এক সত্তা হয়ে উঠছেন।

১৮৯৬-এর ২ মার্চ ‘সিন্ধুপারে’ কবিতা রচনা করেন ও চিত্রা কাব্যগ্রন্থ রচনা শেষ হয়। সে-কাব্যে তাঁর ‘জীবনদেবতা’র ধারণা বিমূর্ততা থেকে স্পষ্টতা পায়। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ওই মার্চ-এপ্রিলে যে কবিতা রচনা শুরু করেন, সেগুলি পরে চৈতালি নামে সংকলিত হবে। জুলাইয়ের মধ্যে চৈতালি রচনা শেষ হয়। পরের বছরের এপ্রিল-শেষ  থেকে কল্পনা, ক্ষণিকা, কাহিনীকথা, কাব্যগ্রন্থ চারটির কবিতাগুলি লেখা চলতে থাকে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে এই চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলা সন ১৩০৭-এর শেষদিকে ও ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ সেই কবিতাগুলি লিখতে শুরু করেন। এ-বছরেই সে-কবিতাগুলি মিলে নৈবেদ্য কাব্য হয়ে উঠবে।

লক্ষ করতে চাই, এ-ঘটনাটি যে চৈতালি বই হয়েছে অনেক পরে, প্রথমে বেরিয়েছে কাব্যগ্রন্থাবলীতে (১৩০৩ বঙ্গাব্দ), এরও বছর পনেরো পরে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২১ বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ চৈতালি নিয়ে একটি ঘনিষ্ঠ বৈঠকে অনেক কথা বলেছিলেন। শ্রোতা ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, অজিতকুমার চক্রবর্তী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নেপালচন্দ্র রায়, কালীমোহন ঘোষ, জগদানন্দ রায়। ক্ষিতিমোহন সেন এই কথাগুলির অনুলিখন করে রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে নেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্ররচনাবলীর ষোড়শ খ– শঙ্খ ঘোষ-প্রণীত গ্রন্থপরিচয়ে এই অনুলেখটি আছে। এই আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ চৈতালি কাব্যটিকে চিত্রার পারম্পর্যে স্থাপন করেছেন। চৈতালির অনেকগুলি কবিতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সে-ব্যাখ্যাগুলি তাঁর কাব্য রচনার একটি ধারাবাহিকতায় তিনি স্থাপন করেছিলেন, সেই ধারাবাহিকতার সংগতি রেখেই। আমাদের মনে এখন হয়তো দুটো প্রশ্ন তৈরি হতে পারে।

১. যে-সংগতিপূর্ণ ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ চৈতালিকে চিহ্নিত করছেন, সেই সংগতি ও ধারাবাহিকতা কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরই নিজের তৈরি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের এই ধারাবাহিকতা কল্পনা করছেন।

এতদূর পর্যন্তই কল্পনা করছেন যে বলছেন, চিত্রার জীবনদেবতা যেন চৈতালিতে বিশ্বদেবতা হয়ে উঠেছে। আবার, ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২১ বৈশাখের সেই নিভৃত কাব্য-আলোচনা, বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশ শুরু হলে তার বিশেষ ভূমিকায় চৈতালি সম্পর্কে তাঁর ধারণার বদল ঘটল। লিখলেন – ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখা বলে যেটুকু দেখা সেটুকু খুব নিবিড় করে দেখা হয়েছে।

২. রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যসৃষ্টির ধারাবাহিকতা যখন নিজে পরীক্ষা করেছেন তখনো, বেশ অনেকদিন পরও, তিনি সেই পরীক্ষার স্ববিরোধিতা লক্ষ কি করেননি? অথচ অন্তত এই সময়টিতে স্ববিরোধিতা মেঘে-বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠার মতোই স্পষ্ট।

৩. নিজের ধারাবাহিকতার এই ধারণা কিন্তু তিনি এর পরের, গায়ে গায়ে পরের, কাব্যগুলির বেলায় ব্যবহার করেননি – কল্পনা, কাহিনী, কথা, গান্ধারীর আবেদন, কর্ণকুমত্মী সংবাদ, কণিকা, ক্ষণিকা। অথচ, আজ হয়তো আমরা, জীবনদেবতা-নিরুদ্দেশ যাত্রা-সিন্ধুপারের আখ্যানের স্পষ্ট, খোদিত ও মূর্ত অপরিচিত যে-রহস্যময়ীকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রধান ও একমাত্র সত্তাপরিচয় করে তুলেছিলেন, তার সেই পরিচয় ও রহস্যের সমান্তরালে নতুন করে পড়তেও পারি চৈতালি থেকে ক্ষণিকা পর্যন্ত কবিতাগুলিকে। সেই নতুন পাঠে আমরা সকৌতুকে দেখতেও পারি কবিস্বভাবের এই রূপান্তর। একটু বানিয়ে বললে বা ধাপ দেখিয়ে বললে স্পষ্ট হয় এই রূপান্তর। চিত্রা পর্যন্ত নিজের কবিতার অদৃশ্য রহস্যময়ী রচয়িত্রীর চিরগোধূলিতে ধূসর মুখটুকু না দেখা থেকে কবিতার উৎসার। আর কল্পনা থেকে উৎসারিত হতে থাকে পুরাণ-ইতিহাস-রটনায় প্রাণবন্ত সব সম্পর্ক থেকে। এগুলি কবির আত্মা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। কৌরব-পা-ব, কুমারী মা-শত্রু পুত্র, কচ-দেবযানী, কুমারসম্ভব – এই কাব্য-আখ্যানগুলি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবিত ধারাবাহিকতার বাইরের রচনা। এগুলির কাব্য প্রমাণাতীত কোনো অদৃশ্য থেকে রচিত হচ্ছে না। রচিত হচ্ছে অতি স্পষ্ট, প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত নতুন প্রমাণ থেকে। অথবা, রবীন্দ্রনাথের আত্মানিরপেক্ষ কোনো বাস্তবকে আত্মায় মাখামাখি হয়ে যেতে আমরা। ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে’; বা, ‘ঈশানকোণ থেকে বাধাবন্ধহারা ঝড়’, বা, ‘মহান মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি করে দাও মোরে’।

কল্পনা থেকে ক্ষণিকা পর্যন্ত কবির আত্মার এমনই অভিযান। আবার এই সময়ের লেখা ক্ষণিকার কবিতাগুলিতে এসে গেছে সেই ছন্দ, যে-ছন্দে দৈনন্দিন জীবন লীলায়িত হয় নতুন ধরনের আত্মসচেতনতায়

ওরে মাতাল, দুয়ার ভেঙে দিয়ে

পথেই যদি করিস মাতামাতি

থলিঝুলি যা আছে তা ফুরাস রাতারাতি –

বা, এই সময়ের সামান্য পরেই যখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই আবাল্য রচিত ‘সত্য ধারণা’টিকে ঠাট্টাও করে ফেলেন,

ওগো সত্য বেঁটে খাটো

বীণার যন্ত্র যতই ছাঁটা,

কণ্ঠ আমার মতই আঁটো

তুলব তবু উচ্চস্বর।

কিন্তু কবিতায় রূপান্তরণ ঘটে গেল আরো। এই কৈশোরক শোভন চাতুর্যের জায়গায় এসে যায় কণিকার নীতিনির্দেশ, ছোট-ছোট সব নীতিনির্দেশ। তেমন নীতি মনে রাখার দরকার হয় একজন গৃহস্থের, একজন প্রতিদিনের মানুষের ও একজন রসিক মানুষেরও,

দয়া বলে, কে গো তুমি, মুখে নাহি কথা,

অশ্রম্নভরা আঁখি বলে, ‘আমি কৃতজ্ঞতা।’

(কণিকা)

‘জন্মমৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা

যেমন চলার অঙ্গ পা তোলা পা ফেলা।’

(কণিকা)

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সত্তাকে ছন্দ ও সমগ্রতায় এই সময় তিনি নিজে ভেবেছিলেন, নদীর মতো নিয়ত ও ছেদহীন সমগ্রতার প্রবাহ বলে। প্রধানত তাঁর সেই ভাবনা অনুসরণ করে বারবারই চেষ্টা হয়ে যাচ্ছে তাঁর সত্তার অখ-তা বা সমগ্রতা বা আস্থার স্বরূপ নির্ধারণের, যেন সেটাই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ও সৃষ্টিশীল সত্তার (being) এক ও অদ্বিতীয় ছাঁচ। অথচ এই একটি ছাঁচের খোঁজাখুঁজিতে রবীন্দ্রনাথের সত্তার অজস্র দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, পশ্চাদপসরণের চিহ্নগুলি যাচ্ছে মুছে। ফলে, রবীন্দ্রনাথের সত্তার মূল স্রোত, উপস্রোত, শাখাস্রোত, প্রাচীন প্রবাহভূমি – এগুলো থেকে আমরা দূরে সরে আসছি। রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলির অন্তর্গত রূপান্তরগুলি আমাদের দৃষ্টিক্ষেত্রের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এই আত্মবিরোধিতার একটি স্থূল উদাহরণ দেখা যাক। রবীন্দ্রনাথ একটি বালক বিদ্যালয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আরো দুজন চেয়েছিলেন – ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তিনজনের চেষ্টা শুরুতে একত্রিত হয়েছিল বটে কিন্তু সেসবই ঘটেছে শুধু এই কারণে যে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাকি দুজনের একজন মারা গিয়েছিলেন, আর একজন কর্মের কারণে শান্তিনিকেতন ছেড়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে ১৯১০ সালের আগে-পরে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও কর্মীদের যে-চিঠিপত্র লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ সেগুলিতে, ও কুঞ্জবিহারী ঘোষের জন্য একুশ পৃষ্ঠার যে-নির্দেশাবলি পাঠিয়েছিলেন সেইটিতে, জানা যায়, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের জন্য যে-বিধিবিধান তৈরি করেছিলেন, তার সঙ্গে সাধারণ স্কুলের বিধিবিধানের খুব কিছু তফাৎ নেই। জেসুইটদের শিক্ষাবস্থায় যেমন আনুগত্য ও শৃঙ্খলাবোধ সবচেয়ে বড় মূল্য পায় – রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সংগঠনেও ছিল তা-ই। এমনকি ছাত্রদের পরীক্ষার ব্যাপারে তাঁর যে-উদ্বেগ আর শান্তিনিকেতনের ছেলেদের এন্ট্রান্স ও এফএ পরীক্ষা কোন কলেজের মাধ্যমে হতে পারে সে-নিয়ে তাঁর উদ্ব্যস্ততা – একজন সাধারণ শিক্ষা-সংগঠকের মতোই। তার চাইতে আলাদা কিছু নয়।

ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই নিরুপায় অবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায় চিঠিপত্রের চতুর্দশ খ– মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুঞ্জবিহারী ঘোষের কাছে, আর তাছাড়াও আরো কয়েকজনের কাছে লেখা চিঠিপত্রে। এই খ-টি ছাড়াও অন্য অনেককে লেখা চিঠিপত্রেও এই সময়কার অসহায়তার সাক্ষ্য আছে।

এই সময়টিতেই কেন এমন অবস্থা। কারণ, আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ থাকতে পারছেন না। ১৯০২-এর নভেম্বরে কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা যান। তার আগে অনেকদিন ভুগে বলেন্দ্রনাথ মারা গেছেন ১৩০৬ বঙ্গাব্দ, ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগস্ট। বলেন্দ্রনাথ বস্ত্তত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সহকারী। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম পরিকল্পনা তাঁর। সাহিত্যরচনায় তাঁর মৌলিকতা যথেষ্ট ছিল। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের হাত-পা ভেঙে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা। ১৮৯৯-এর এপ্রিল থেকে কলকাতায় পেস্নগ মহামারি। এপ্রিল থেকেই রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে সপরিবার বাস শুরু করেন। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু, পেস্নগ, স্ত্রীর অসুস্থতার শুরু – এর মধ্যেই তাঁর অতিবিশ্বাসী ম্যানেজার বহু হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। আর্থিক ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বিপন্ন। কুষ্টিয়ার ব্যবসার জন্য ঋণ নিতে হচ্ছে বড়-বড় অঙ্কের। ১৩০৭-এর শেষদিকে বা ১৯০১-এর প্রথমদিকে নৈবেদ্যর কবিতা শুরু হয়। ওই বছরের জুন মাসে তাঁর বড় মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ে। এই বিয়ের ব্যবস্থা করতে রবীন্দ্রনাথকে নানা রকম অপমান সইতে হয়। বড় মেয়ের বিয়ের একবছরের মধ্যেই প্রায়, আগস্টে, শান্তিনিকেতন থেকে অসুস্থ মৃণালিনীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিন মাস কাটতে না-কাটাতই তাঁর মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করতে না-করতে তাঁর মেজমেয়ের যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ মেয়েকে নিয়ে গেলেন হাজারিবাগ। মার্চে গেলেন আর সেখান থেকেই সে মাসের মাঝামাঝি মেয়েকে নিয়ে একাই গেলেন আলমোরা। অসুখ কিছু কমল না, মাস ছ-সাতের মধ্যে কলকাতায় ফিরে এলেন। ১৯০৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর রেণুকা মারা গেলেন। চার মাসও কাটেনি। ১৯০৪-এর ১ ফেব্রম্নয়ারি শান্তিনিকেতনে গুটিবসন্তে সতীশ মারা গেলেন। শান্তিনিকেতনের এই শিক্ষকের ওপর তিনি খুবই ভরসা রাখতেন।

ব্যক্তিগত বিপর্যয় এখানেই শেষ নয়। তাকেই তো আমরা বিপর্যয় বলি, যা পূর্বস্থির সমস্ত পরিকল্পনা ধ্বংস করে দেয়। ১৯০৫-এর ১৯ জানুয়ারি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে বার্ধক্যব্যাধিতেই মারা গেলেন। সে-মৃত্যুতে কোনো আকস্মিকতা ছিল না। অনেকদিনই তিনি অসুস্থ ছিলেন। সকলে প্রস্ত্ততই ছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য ছিল এইখানে যে, এমন মহাপ্রতিভাশীল কবিও পিতৃসঙ্গের প্রয়োজন বোধ করতেন।

এমন সংকট রবীন্দ্রনাথের জীবনেও খুব বেশি আসেনি।