গ্রাম-শহরের বৃত্তান্ত

সনৎকুমার সাহা

আমরা জানি, বঙ্গভূমি পৃথিবীর বৃহত্তর ব-দ্বীপ। হাজার হাজার বছর ধরে এর গড়ে ওঠা।১ এখনো বিরাম নেই। তবে বিপরীত দিক থেকে একটা হুমকিও তৈরি হচ্ছে। গোটা বিশ্বে কল-কারখানায় কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাতে সমুদ্রতল আর স্থিতিশীল থাকছে না। একটু একটু করে উঁচু হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ব-দ্বীপের উপকূলীয় নাবাল অঞ্চল একসময় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা। তাতে যদি বঙ্গভূমির দক্ষিণভাগের বিরাট অংশ কোনো সময়ে সমুদ্র গ্রাস করে নেয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিপদটা অবশ্য শুধু এখানকার নয়; পৃথিবীর সব সমুদ্রোপকূল অঞ্চলের। বিশেষ করে ক্রমপ্রসারমান ব-দ্বীপগুলোর। একদিকে অসংখ্য নদ-নদীর প্রবাহে বয়ে আনা মাটি ক্রমাগত সমুদ্রে ঢেলে নতুন-নতুন স্থলভূমির প্রসার, অন্যদিকে মানুষের প্রকৃতিকে বশীভূত করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদগ্র আকাঙ্ক্ষার পরিণামে সমুদ্রের স্থলভূমি আত্মসাৎ। শেষ কোথায়, বলা যায় না। আগামী হাজার বছরের ঘটনা-স্রোত হয়তো তার আকারের আদল নিশ্চিত করবে। অথবা তা-ও নয়। ভাঙা-গড়া নতুন নতুন অনিশ্চয়তাও জাগিয়ে তুলতে পারে। আমরা সেদিক থেকে চোখ-সরিয়ে বর্তমানে ও তার অব্যবহিত অতীতে দৃষ্টি দিই। ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখি মানুষকেই। আমাদের বঙ্গভূমির ভূ-প্রাকৃতিক মানবচিত্রের দিকে যদি ধারাবাহিক নজর দিই তবে গত দুশো বছরে তাতে যে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন ঘটেছে তা খেয়াল না করে পারি না। তখন নদীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। অধিকাংশই সারাবছর নাব্য। অনেক বেশি প্রশস্ত।২ নদীপথে চলাচল, বিশেষ করে দূরের যাত্রা অথবা ভারী মালপত্র পরিবহন ছিল তুলনায় বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্যে নদীপথই ছিল অনুকূল। তা প্রসারিত ছিল বঙ্গভূমির বাইরেও। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি তুলনায় নরম। বাঁকপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নদীর কূল ভাঙা ও কূল গড়া চলে আসছিল বিরামহীন। নদীর এবং একই সঙ্গে খাল-বিল ইত্যাদির পাড় ধরে বন কেটে বসত গড়ার ভেতর দিয়ে মানুষের থিতু হওয়া শুরু। পাললিক জমিতে ফসল মেলে সহজে। জলাভূমিতে ছিপ ফেললেই মাছ। অকৃপণই বলা চলে প্রকৃতিকে। মানুষ গুছিয়ে বসে। চাক বাঁধে। গুচ্ছ-গুচ্ছ গ্রাম বিকশিত হয়ে চলে। তাদের সমাজ-সংস্কৃতির বিশেষ রূপে ফুটে ওঠার মূলে থাকে অনেকটা সংঘাতহীন শান্ত-শ্যামল গ্রামীণ পরিবেশে জীবনযাপনের ধারা। চাষ-বাস-পশুপালন প্রায় নিরুপদ্রবে চলে। সুরুচি ও সুকৃতি-ভাবনা মিশে যায় কুটিরশিল্পে। বাজারে কেনাবেচা চালু হয়। সেই সূত্রে তার প্রসার ঘটে দেশ থেকে দেশান্তরে। বাইরের ধ্যান-ধারণাও আসতে থাকে। বাঙালি তার অন্তর্জীবন নিজের মতো বিকশিত করে চলে।

বাংলার মানববসতি সবটাই অবশ্য গ্রামে নয়। অনুপাতে অকিঞ্চিৎকর হলেও ইতিহাস শহরের কথাও বলে। প্রাচীন রাজা-মহারাজাদের, পরে নবাব-বাদশাদের বাস নগরে। তাঁরা যে সর্বেসর্বা এটা বোঝানই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। অধিকৃত রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার নৈতিক দায়িত্ব পড়ে তাঁদের ওপর। তার জন্যে যে প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত, তা গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন ফসল ফলানো, মাছ-ধরা, কাপড় বোনা ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা যায় না। একটা নৈর্ব্যক্তিকতা চাই, কিঞ্চিৎ দূরত্ব চাই। রাজপ্রাসাদের সুরক্ষার ও বহিঃশত্রু আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও চাই। সবসময় যদি সফল না হয়, তাও। এ কারণে গড়ে তুলতে হয় সেনাবাহিনী, পাইক-পেয়াদা, লোক-লস্কর। এই সব কাজে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও। বিদ্যাশিক্ষারও বটে। কারণ সমাজে – গ্রামীণ সমাজেও –  পূজার্চনা, আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদি পরিচালনায় যথোপযুক্ত লোকবল চাই। সেই লোকবলের সর্বজনমান্য স্বীকৃতি না থাকলে গণসমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। তাদের অবলম্বন করে গ্রামের মানুষের সামাজিক সুস্থিতি দানা বাঁধে। কিন্তু তাদের যোগ্যতার ছাপ পেতে কোনো কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠানে সাধারণত শহরে অথবা ওই প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাকে ঘিরে বিশেষ লোকালয়ে আসতে হয়। জীবনের নিত্যপ্রয়োজন যেসবে মেটে, তাদের উৎপাদন এইসব এলাকায় হয় না। তারা হয় গ্রামে। এবং তাদের ঘিরে বৃহৎ জনসমাজের  বাসও ওই গ্রামে। শহরকে খাবার জুগিয়ে, পরনের বসন জুগিয়ে, নানা তৈজসপত্র জুগিয়ে গ্রাম বাঁচে। অন্যদের বাঁচিয়ে রাখে। বঙ্গভূমি ব-দ্বীপ বলেই এখানে তা আরো বেশি।

প্রশাসনের পরিসর যদি বাড়ে, কিন্তু উৎপাদনের প্রয়োগ-কুশলতা অপরিবর্তিত থাকে এবং তা বদলানোর কোনো তাগিদ ভেতর থেকে বা বাইরে থেকে তৈরি হয় না, তখন শহর গড়ে ওঠার ছকে আরো একটি খোপ তৈরি হয়। এমনটি ঘটে, যখন কোনো শক্তি, ভেতরের অথবা বাইরের, সাম্রাজ্যবিস্তারে নামে। বঙ্গভূমিও তার এখতিয়ারে চলে যায়। হতে পারে তা পুরো অথবা আংশিক। দখল বজায় রাখতে তার দীর্ঘস্থায়ী সেনাছাউনি প্রয়োজন, আরো দরকার রাজস্ব আদায়ের সুব্যবস্থা। তুলনায় শুকনো ও সুরক্ষিত জায়গায় সেনাছাউনি ও খাজাঞ্চিখানা নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। শাখা-প্রশাখা মিলে তারাও শহরের চেহারা নেয়। এবং আর আর শহরের মতো তারাও নির্ভর করে গ্রামের ওপর। শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা ছাড়া নিজেরা কিছু দেয় না। গ্রামের ওপর তারা প্রভুত্ব করে। গ্রামের মানুষ প্রজা। তবে কোনো রাজশক্তি দীর্ঘস্থায়ী হলেও চিরস্থায়ী হয় না। এভাবে যেসব শহরের উদ্ভব, রাজস্ব ভেঙে পড়লে তাদের অধিকাংশই অতীতে ভেঙে পড়ে। আবার গ্রামব্যবস্থায় ফিরে যায়। প্রাচীন কাহিনি ধরে রাখার স্মৃতি এখানে-সেখানে একটু-আধটু থাকে। বেশিরভাগই লুপ্ত হয়। বসবাসের জৌলুসও। এমন শহর উধাও হলে অনেক সময় বনজঙ্গলও তা গ্রাস করে। পলিমাটির উর্বরতা তার সহায় হয়।

সতেরো শতকে শহর গড়ে ওঠায় আর একটি নতুন ও সুদূরপ্রসারী মাত্রা যোগ হয়। এর অনুঘটক ছিল সমুদ্রপথে ইউরোপীয় বণিকদের আসা-যাওয়া। ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো-ডা-গামা প্রথম সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসার পথ খুঁজে পান। ওই সময়ের রেওয়াজমতো তাতে বাণিজ্য ও বোম্বেটেগিরি দুটোই মিশে থাকে। বোম্বেটেগিরিই প্রধান। ভাস্কো-ডা-গামা দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে জাহাজ ভেড়ান। উন্নত জাহাজি ব্যবস্থা ও গোলাগুলির সাহায্যে ওই জায়গাটার ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে লুটপাটে মন দেন। এরই অনুসরণে পরের ক-বছরের ভেতর পর্তুগিজ বোম্বেটেরা জবরদস্তি কায়েম করে ভারতের পশ্চিম উপকূলে গোয়া, দমন, দিউ, এইরকম কটি সমুদ্রবন্দরের ওপর। এসব জায়গায় তারা দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে এবং উপকূল ধরে সিংহল, চট্টগ্রাম, আরাকান, মালাক্কা, এমনকি চীন পর্যন্ত দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যায়। তবে তারা দেশের ভেতরে খুব বেশি ঢোকেনি। বাণিজ্য করলেও তাদের হাঁকা দামই বলবৎ থেকেছে। কিন্তু পথ জানা হয়ে গেলে তাদের পেছন পেছন আসে ওলন্দাজরা, ফরাসি ও ইংরেজরা। প্রাথমিক নজর থাকে তাদের এখানে গেড়ে বসে একচেটিয়া বাণিজ্য করে বড়লোক হওয়ার দিকে। তখনো ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটেনি। এদেশের, বিশেষ করে বাংলার সুতি-কাপড় তাদের কাছে মহার্ঘ্য। তার বাজার ধরার দিকে তাদের ঝোঁক। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে।৩ দুবছর পরে জন্ম ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির।৪ ১৬৬৬ সালে গড়ে ওঠে ফরাসিদের কোম্পানি।৫ শুধু ভারত উপমহাদেশে জাঁকিয়ে ব্যবসা করাই এদের লক্ষ্য ছিল না। ভারত পেরিয়ে আরো পুবে সমুদ্রপথে মালাক্কা, জাভা, চীন এই সব অঞ্চলেও তারা ঢুকে পড়ার পথ খুঁজছিল। সবাই সব জায়গায় একইরকম সফলতা পায়নি। ইংরেজরা ভারতবর্ষ কব্জা করেছে। ওলন্দাজরা এখানে পিছু হটলেও শ্যাম ও ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে বেশি সাফল্য পেয়েছে। ফরাসিদের দখল বঙ্গদেশের চন্দননগরে ও তামিলনাড়ুর পাশে পন্ডিচেরিতে উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বজায় থেকেছে। কথাগুলো এখানে বলা নতুন আর এক ধরনের শহরের যে এখানে পত্তন ঘটে, তার পটভূমিকা বোঝার জন্যে।

ব্রিটিশ রাজদূত স্যার টমাস রো ১৬১৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর সাম্রাজ্যে অবাধে বাণিজ্য করার অনুমতি-পরোয়ানা আদায় করে নিতে পারেন।৬ কিন্তু শায়েস্তা খান যখন বাংলার নবাব তখন ১৬৮৬ সালে ওই অঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ও তার ব্যবসায়ী কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর শুল্ক উৎকোচ নিয়ে দরকষাকষিতে তুমুল ঠুকুমুকু লাগে। তা শেষমেশ যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। শেষে সন্ধি করে রক্ষা হয়। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানিকে দক্ষিণবঙ্গে সমুদ্রঘেঁষে জলাজমিতেই একটা দুর্গ করার অনুমতি দেওয়া হয়। আরো তিন বছর পর সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে আগের মতো ব্যবসা করার সুযোগও মেলে। বাংলায় কোম্পানি-প্রধান জোব চার্ণক তখন সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা, পাশাপাশি এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে একত্রে কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা করেন (১৬৯০)।৭ তখনো কোম্পানি রাজশক্তি নয়। জায়গাটাও জলকাদায় মাখামাখি। তবু এইখানেই জোব চার্ণক তাঁতি, কাপড়-ব্যবসায়ী এদের ডেকে এনে স্থায়ীভাবে বসালেন। সমুদ্রের জাহাজ অনেক কাছে এসে ভেড়ে। ফলে উৎপাদন, কেনাকাটা, সামুদ্রিক বাণিজ্য, সবগুলোই এক জায়গায়-একসঙ্গে ঘটতে শুরু করে। কলকাতা এক আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। তিন বছরের ভেতর ওই বাঁশবনেই জোব চার্ণক দুর্গ গড়ে তোলেন। তিনি অবশ্য বিদেশি হয়ে থাকেননি। সদ্যবিধবা এক নারীকে সহমরণের চিতা থেকে উদ্ধার করে তাকেই বিয়ে করে তিরিশ বছর কাটিয়ে দেন। ওই স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি। সন্তান-সন্ততি রেখে এইখানেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে। এ অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। এখানে টানার প্রয়োজন নেই।

ব্রিটিশ কোম্পানির মতো ফরাসি কোম্পানিও চন্দননগরে ঘাঁটি গেড়ে সেখান থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা চালায়। সেই সুবাদে ফরাসি ছাপমারা আর-এক শহর সেখানে গজিয়ে উঠতে থাকে। তবে ফরাসিদের কেন্দ্রভূমি ছিল এখানে তামিলনাড়ুর পাশে পন্ডিচেরি। উপমহাদেশের মিশ্র-সভ্যতায় প্রান্তিক হলেও এক স্থায়ী প্রভাব সেও রেখে যায়। যেমন রেখে চলেছে দীর্ঘদিন পর্তুগিজদের দখলে থাকা গোয়া। বাংলায় কোম্পানি শাসন চালু হলে এখানে শ্রীরামপুর ক্রিশ্চান মিশনারিদের শহরের আকার পায়। জনসংযোগের চেষ্টায় তারা বাংলাভাষা শেখার দিকেও নজর দেয়। তারই পরিণামে উনিশ শতকের গোড়ায় ছাপার অক্ষরে বাংলা গদ্য আত্মপ্রকাশ করে। তার শ্রীছাঁদ কিছুই বলার মতো নয়। তবে তাকে প্রাথমিক ধরে তার ওপরেই রামমোহন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। পরে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র। চেতনে-অবচেতনে বাংলা গদ্যের এই শহর-নির্ভরতা খেয়াল করার জন্যেই কথাটুকু বলা।

আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা এখানে ঘটে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। ১৮৭১ সাল নাগাদ বাংলার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত রেললাইন পাতার একটা ধাপ সমাপ্ত হয়।৮ যেখানে পাশ্চাত্যেই রেললাইনের যুগ, বলা যায়, শুরু হয় ওই শতকের তৃতীয় দশকে,৯ সেখানে বাংলায় তাকে কার্যকরভাবে চালু করায় খুব বেশি দেরি হয়েছে মনে হয় না। এতে কিন্তু পরোক্ষে দুটো ব্যাপার ঘটে। প্রথমত, পরিবহন-কাজে জলপথের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তা ও কর্মকান্ডের কথা মনে রেখে তাদের জন্যে উপযোগী অপেক্ষাকৃত বড় শহরগুলোকে রেললাইনের সুবিধার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অবশ্য এতে অগ্রাধিকার পায় ব্রিটিশ শাসনক্ষমতার দৃষ্টিকোণই। তারপরেও সাধারণ মানুষের  – গ্রামবাসীদেরও – ধ্যান-ধারণা প্রসারিত হয় অনেকদূর। বাস্তবে চলাফেরাতে তাদের গতি আসে। ব্যবসা-বাণিজ্য বহুমুখী হওয়ার সুযোগ দেখা দেয়। যদিও অতি সীমিত পরিসরে।

তবে মনে রাখা দরকার, প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্য, দুটোতেই অগ্রাধিকার পায় ঔপনিবেশিক রাজশক্তির স্বার্থ। সতেরো বা আঠারো শতকে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে এই সময়ের অনুরূপ স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। মাঝখানে প্রথমত ইংল্যান্ডের কলকারখানাকে ঘিরেই ঘটে চলেছে শিল্পবিপ্লব। সেখানে প্রধান চালিকাশক্তি মিলের কাপড়। সেইটিই তাদের সবচেয়ে লাভজনক রফতানি পণ্য। এদেশেও তার বাজার বাড়ানোর দিকে তাদের লক্ষ্য। এবং তা অবাধ-বাণিজ্যের নতুন তত্ত্বকে হাতিয়ার করে। সতেরো শতকে কোম্পানির এদেশে বাণিজ্য করার মূল উদ্দেশ্য ছিল সস্তায় তাদের কাপড় কেনা। সেই জন্যে একচেটিয়া কারবারের দিকে ঝোঁক। পরিণামে মার্কেন্টাইল প্রেক্ষাপটে কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে এদেশ থেকে সুবিধাদরে পণ্য-সামগ্রী কিনে অন্যান্য বাজারে তা বেশি দামে বেচে রাতারাতি বড়লোক বনে যাওয়া। ‘রবার-ব্যারোন’ কথাটা চালু হয়ে যায় এইভাবেই। উনিশ শতকের পরিবর্তিত অবস্থায় গুণাগুণে, পরিমাণে ও দামের আপেক্ষিক ফারাকে আমরাই সুতি-কাপড়ের ক্রেতা, আর তারা বিক্রেতা। আমাদের তাঁত-কাপড়ের বিশ্বজোড়া চাহিদা আর থাকে না। থাকে না অন্যান্য ক্ষুদ্রশিল্পজাত  পণ্যেরও। এসবে মন্দা শুধু কৃষির ওপরে নির্ভরতা বাড়ায়। কৃষকের বিকল্প, অথবা, পরিপূরক পণ্যের ওপর ভরসা করার পথ ক্রমাগত সংকীর্ণ হয়ে আসে। বিদেশি বণিকেরা এই পরিস্থিতিতে আগাম দাদন দিয়ে প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য, বিশেষ করে তাদের শিল্পের কাঁচামাল কিনে নেওয়ার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে থাকে। ফোড়ে, দালাল, মুৎসুদ্দি, সবাই জোগাড় হয় স্থানীয় ওপর-চালাকদের ভেতর থেকে। এবং সবই আগাম-কেনাবেচার নিয়মনীতি মেনে। নিটফল কিন্তু এই দাঁড়ায়, আমাদের অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণত কৃষি-উৎপাদনমুখী হয়ে পড়ে। এবং সেখানেও কেনাবেচায় কৃষকদের উদ্বৃত্ত একরকম কিছুই থাকে না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) বিকৃত প্রয়োগে কৃষিজীবীদের দুর্দশা আরো বাড়ে। যা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে যায়, তা খুব কমই উৎপাদনে ব্যয় হয়। কৃষি ঢিমেতালে গতানুগতিকভাবে চলে। ভদ্রজনেরা অধিকাংশ শহরবাসী হতে চায়। অর্থকরী পণ্য পাটই একমাত্র কৃষকদের কিছু কাঁচা টাকার মুখ দেখায়। রাজনৈতিক পরিণামে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে তা কোনো মৌলিক উন্নতি ঘটায় না। ভাগ্যের ওপর ভরসা করে কোনোরকমে টিকে থাকা অথবা দুর্ভিক্ষ, কিংবা, মহামারীতে বিনষ্ট হওয়া, এই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। সার্বিক উন্নয়নে শহর নিজে কিছু যোগ করে না। যোগ করার কাজ ব্রিটিশ-ভূখন্ডে। কিন্তু গ্রামবাংলার কাঁধে চেপে দিব্যি থাকে। চোখের সামনে এই পরিস্থিতি দেখেই বঙ্কিম লিখেছিলেন, ‘আজিকালি বড় গোল শুনা যায় যে আমাদের দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে। এতকাল আমাদিগের দেশ উৎসন্ন যাইতেছিল, এক্ষণে ইংরেজদের শাসনকৌশলে আমরা সভ্য হইতেছি। আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে। কি মঙ্গল দেখিতে পাইতেছ না? ঐ দেখ লৌহবর্ত্নে লৌহ-তুরঙ্গ কোটি উচ্চৈঃশ্রবাকে বলে অতিক্রম করিয়া এক মাসের পথ একদিনে যাইতেছে।… আর আমি যে হতভাগা, চেয়ারে বসিয়া ফুলিস্কেপ, কাগজে বঙ্গদর্শনের জন্য সমাজতত্ত্ব লিখিতে বসিলাম, একশত বৎসর পূর্বে হইলে, আমি এতক্ষণ ধরাসনে পশুবিশেষের মত বসিয়া ছেঁড়া তুলট নাকের কাছে ধরিয়া নবমীতে লাউ খাইতে আছে কি না, সেই কচ্কচিতে মাথা ধরাইতাম। তবে কি দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে না? দেশের বড় মঙ্গল – তোমরা একবার মঙ্গলের জন্য জয়ধ্বনি কর।

‘এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞাসার আছে কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায় খালি পায়ে এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্ম্মবিশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?… বল দেখি চশমা-নাকে বাবু! ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে? তুমি লেখাপড়া শিখিয়া ইহাদিগের কি মঙ্গল সাধিয়াছ? আর তুমি ইংরাজ বাহাদুর!… তুমি বল দেখি যে, তোমা হইতে এই হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্তের কি উপহার হইয়াছে?’

‘আমি বলি, অণুমাত্র না, কণামাত্রও না। তাহা যদি না হইল, তবে আমি তোমাদের সঙ্গে মঙ্গলের ঘটায় হুলুধ্বনি দিব না। দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ – দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।…’ (‘বঙ্গদেশের কৃষক’, সাম্য, ১৮৭৯)

এবং আমরা জানি, তারা গ্রামে থাকে। ওই সময়ের গ্রামে তখন যারা উদ্বৃত্তভোগী, তাদের ঝোঁক কিন্তু এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার। শহরে স্থায়ী হলে সবার চোখে বিশিষ্ট হওয়ার সুযোগ মেলে। মাঝে-মাঝে চাল-চলনে শহুরে হয়ে গ্রামে এলে সবাই চোখ তুলে তাকায়। তারা নিজেরাও নিজেদের বিশিষ্ট মনে করতে পারে। রাজ্য-শাসনে তার কাঠামোর ভেতরে ‘বাছুর-পরামানিক’ হলে তো ধরাকে সরা জ্ঞান করা যায়। কিন্তু তারা গ্রামকে কিছু দেয় না। বরং গ্রামের উদ্বৃত্ত থেকেই অন্ন-বস্ত্র ইত্যাদি আহরণ করে। তবে তারা সংখ্যায়, অনুপাতেও নগণ্য। প্রাক-ব্রিটিশ-শাসন আমলের চেয়েও কম। আগের অনেক শহর, এমনকি রাজা-মহারাজার রাজধানীও গ্রামের চেহারা পেয়ে যায়। নতুন রাজপথ-রেলপথ-স্কুল-কলেজ-আদালত তাদের দূরে ঠেলে। তারপরেও বঙ্গভূমির উদ্যোগী সন্তানদের বহির্বাণিজ্যে মনোযোগী হওয়ায় কোনো বাধা ছিল না। এবং বাণিজ্য যে লক্ষ্মীলাভের প্রকৃষ্ট উপায়, এ-প্রবাদবচনও অতিশয় প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে কৌটিল্য বলে যান, বাণিজ্যে লক্ষ্মীবাস। অর্ধেক তার কৃষিকাজে। তার অর্ধেক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনিক কর্মে। এবং ভিক্ষায় নৈব নৈব চ। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলে মনে হয়, কৌটিল্য ব্রাহ্মণদের জীবন-জীবিকাকেই পার্থিব কান্ডে অসার মনে করছেন এখানে। মূল্য-সৃষ্টি ও মূল্য-সংযোজনেই কেবল লক্ষ্মীর আগমন ঘটে। ওই সময়ে কৃষিতে মূল্য-সৃষ্টির উদ্যোগ ছিল প্রবলভাবে প্রকৃতিনির্ভর। তার ওপর মানুষের শ্রমের অবদান আপেক্ষিকভাবে সামান্যই। তুলনায় বাণিজ্য প্রাথমিক মূল্য সৃষ্টি না করলেও মূল্য-সংযোজন করে। এবং ব্যাপক অর্থে প্রকৃতিনির্ভর উৎপাদনে কৃৎকৌশল প্রয়োগ তার রূপান্তরকেও যদি মূল্য-সংযোজন বলে ধরে নিই – ওই সময়ে কৌটিল্য সম্ভবত তাই করেছিলেন – এবং তাকে প্রধানত সওদার যোগ্য মনে করে বাণিজ্যের আওতায় আনি, তবে তাতেও মানুষের সম্পদ-আহরণের হেতু সর্বাধিক। রাজকর্মে কিছু সামাজিক মূল্য আছে। তবে কৃষিকাজের গুরুত্ব তার চেয়ে বেশি। ব্রাহ্মণরাই একমাত্র পরশ্রমজীবী। সে-অর্থে ভিক্ষাজীবী। পার্থিব জীবনযাপনে তাদের কোনো অবদান নেই। তীব্র কটাক্ষে কৌটিল্য বিদ্ধ করেছেন তাদেরই। আমাদের কারো অজানা নেই গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পর প্রায় হাজার বছর সমাজে সওদাগরদের গুরুত্ব ছিল সমধিক। একই সাংস্কৃতিক বৃত্তে বঙ্গভূমিতেও বহির্বাণিজ্যের বিশেষ মর্যাদা ছিল। পুরাণে ও লোককথায় তার ছবি অক্ষয় হয়ে আছে। প্রত্ননিদর্শনেও সিংহল থেকে বরবদুর, সুমাত্রা, জাভা পর্যন্ত বঙ্গভূমির বণিকদের যাতায়াতের চিহ্ন মেলে।

কিন্তু অষ্টম শতাব্দী থেকে নবজীবনে উদ্দীপিত আরব বণিকেরা এই সমুদ্রপথের ওপর তাদের প্রভুত্ব কায়েম করতে থাকে। বাংলার সওদাগরেরা কোণঠাসা হতে হতে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। আর বারমুখো হয় না। হওয়ার তাগিদও তেমন ভেতর থেকে তৈরি হয় না। কারণ, আগেই বলেছি, এই ব-দ্বীপ অঞ্চল সুজলা সুফলা            শস্য-শ্যামলা। অসংখ্য নদী-নালায় অঢেল মাছ। জীবনবৃত্ত সবার জন্যেই নিয়তি-নির্ধারিত। মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু যথেষ্ট কম থাকার কথা। অতি প্রজনন বা জনসংখ্যাধিক্য নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। ভাবনা ছিল না, এমনকি উনিশ শতকে, বা বিশ শতকের গোড়াতেও। মানুষ বাইরে দৃষ্টি ফেলেছে কদাচিৎ।  সাধারণভাবে জনগণের ভেতর গ্রামীণ জীবনে মাধুর্য ছিল নিবিড়। হতাশা বা অতৃপ্তি তাদের বহির্মুখী করেনি। কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ে চট্টগ্রাম-নোয়াখালির উপকূলীয় অঞ্চলে। আরব বা আরাকানি বণিকদের সংস্পর্শে তারা আসে। পরে জাহাজের নাবিক বা খালাসিও কেউ কেউ হয়। কিন্তু ঘরকুনো বাঙালির সাধারণ জীবনযাত্রায় তেমন বৈচিত্র্য আসে না। এমনকি পরে ব্রিটিশ রাজত্বে কলকাতার আশেপাশে তাদের উদ্যোগে ও প্রশ্রয়ে তাদেরই স্বার্থে যখন কলকারখানা কিছু গড়ে ওঠে, তখনো না।

মূল প্রসঙ্গ থেকে একটু সরে গিয়ে এখানে আর-একটি কথা বলি। সতেরো শতক থেকে কোম্পানির বাণিজ্য প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন বা  মূল্য-সৃষ্টি থেকে মার্কেন্টাইল ধাঁচে মূল্য-সংযোজনের ওপর জোর দিয়েছে বেশি। এদিক থেকে কৌটিল্য-নীতিরও তা অনুসারী। তারা তাদের আচরণে আক্ষরিক অর্থে ‘এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে’ – এই কথার যথাযথ প্রতিধ্বনি তোলে। সোনা-রুপোর মুদ্রাকে বিনিময় মাধ্যম করে তারা কাপড় ও সোনা কিনে ইংল্যান্ডে ও ইউরোপের অন্যান্য বাজারে বেশি দামে বেচা শুরু করে, তা প্রসারিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে। সেখান থেকে তারা মশলা কেনে। ওই মশলার সঙ্গে বাংলার বাজার থেকে কেনা কাপড়ের বিনিময়ে লাভের অঙ্ক পকেটে পোড়ে। বেশিরভাগ অবশ্য ইউরোপে বেচে। চীন থেকে কেনে চা, রেশমি কাপড় ও চীনেমাটির তৈজসপত্র। ইউরোপে অভিজাত মহলে তাদের খুব কদর। ভারতীয় কাপড় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মশলাপাতি দিয়ে বিনিময়ে ভারসাম্য ঠিক আসে না। উনিশ শতকে কোম্পানি-রাজ ভারতে মজবুত। তারা এখানে ছড়িয়ে দেয় আফিমের চাষ। চীনে মাঞ্চু-কুইং বংশের রাজত্বে প্রথমে অভিজাতদের – পরে সাধারণ জনগণের – ভেতরেও আফিম সেবন জাঁকিয়ে বসে। ব্রিটিশ কোম্পানি দেদার আফিম রপ্তানি করে তাদের ব্যবসায় বাড়-বাড়ন্ত ঘটাতে থাকে।  কুইং-শাসকদের এটা মনঃপুত হয় না। তাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো, জনজীবনে কর্মক্ষমতার অবনতি। এই নিয়ে খটাখটি। তা তুমুল আকার নেয় চীন ও ব্রিটিশদের ভেতর প্রথম আফিমের যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২)।১০ চীনা শাসকরা শোচনীয়ভাবে হার মানে। তার একটি খেসারত দেয় হংকংকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে। গোটা ব্যাপারটায় কোম্পানির ব্যবসা কোনোভাবেই ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে মূল্য-সৃষ্টি বা মূল্য-সংযোজনের ওপর নির্ভর করে না। আফিমের মতো পাটকেও ব্যবহার করা হয় – ওই উনিশ শতকেই, তার দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। তবে তা মার্কেন্টাইল মতি-গতি পুরোপুরি মেনে নয়। বাজারের নৈর্ব্যক্তক হালচালকেই এখানে গুরুত্ব পেতে দেখি। ইংল্যান্ডে পাটকল তার শিল্প-সমৃদ্ধিতে একটা বড় ভূমিকা রাখে। কাঁচাপাট কিন্তু সরবরাহ করে প্রধানত এই বাংলা অঞ্চল। তাতে কোনো জবরদস্তি ছিল না। কৃষকেরা বাজারের নিয়ম-অনুযায়ী মোটামুটি ন্যায্য দামই পেয়েছে। এবং ওই সময় পাটজাত পণ্যের বাজার ছিল বিশ্বজোড়া। ব্রিটিশ পাটকলগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। তবে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের ভারতে নীল-চাষের উদ্যোগ সফল হয়নি। অন্যতম কারণ ছিল, একই জমিতে একই মৌসুমে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা। এদেশের কৃষিতে আর্থিক লাভালাভের চেয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর দিকে নজর অনেক বেশি। এখনো। যে কোনো সময়ে গ্রামের ভূদৃশ্যতেও এটা ধরা পড়ে। তাতে উনিশ শতকে প্রকৃতিনির্ভরতা ছিল আরো চোখে পড়ার মতো। শহর যেন সার্বিক সামঞ্জস্যে উটকো উপদ্রব। যদিও সেই সামঞ্জস্য যে সবচেয়ে ভালো, অথবা সবচেয়ে কাম্য – এ কথা বলা যাবে না।

তবু ব্রিটিশ-রাজত্বে শহরগুলোর, বিশেষ করে কলকাতার, একটি বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। উনিশ শতকেই গ্যাসবাতি, বিশ শতকে বিদ্যুতের আলো তাদের উজ্জ্বল করে তোলে। এটাও খেয়াল করি, এদিক থেকে তারা ইউরোপ-আমেরিকার শহরগুলো থেকে খুব বেশি পরে শুরু করে না। পাশ্চাত্যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি রেললাইন পাতায় বিনিয়োগ জমে ওঠে। বাংলাতেও ওই শতকের সত্তরের দশকে একপ্রস্থ রেললাইন পাতার কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে তফাত একটি থাকে। ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রধান ভূমিকা নেয়। এখানে তা গড়ে ওঠে ব্রিটিশ-রাজশক্তির অর্থ-বিনিয়োগে। স্বার্থ তাদের অবশ্যই ছিল। তাদের বাণিজ্য-কান্ড অনেক দ্রুত ও অনেক নির্ঞ্ঝাট হতে পারে। কিন্তু রেললাইনের পাশে  বড় শহরগুলোর জৌলুস অনেকগুণ বেড়ে যায়। বিদ্যুৎবাহিত টেলিপ্রিন্টারও এসে যায় ওই সময়ের ভেতরে। কলকাতা আরো গুরুত্ব পায় এখানে প্রধান ব্রিটিশশাসিত বন্দরনগরী হয়ে ওঠায়। ইঞ্জিনচালিত বিশাল বিশাল জাহাজ গঙ্গা-নদীর ভেতরে পর্যন্ত চলে এসে সাধারণ মানুষদের হতবাক করে দেয়। আঠারো শতকে ওই সময়ে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যতরী একই পথে এসে নবাবি আমলের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে পাকাপোক্ত করে। তারই পরিণামে ১৭৭৩-এ ব্রিটিশরাজের পক্ষে কোম্পানির হাতে ভারত শাসনের অধিকার ন্যস্ত হওয়া এবং ১৭৭৪-এ ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্রিটিশ-ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হওয়া। কিন্তু তখনো কোম্পানির জাহাজ যথেষ্ট বিশালাকায় ও সেই সময়ের তুলনায় অতি আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হলেও ইঞ্জিনচালিত হয়নি। তবে এই দর্শনীয় অর্জন ভেতরের তাড়নায় ঘটে না।  ঔপনিবেশিক শক্তির অধিকার ও বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রসারিত করার লক্ষ্যকে প্রাথমিক বিবেচনা করেই ঘটে। এদেশে শহরের চেহারা বদলে যায় তারই অনুসরণে। গ্রাম যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকে। অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি, এসবে ফসলহানি ঘটলে তিমির আরো ঘনীভূত হয়। কারণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ফসল না হলে খাজনা হ্রাসের বা তা মাপ করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মধ্যস্বত্বভোগীরাও ইচ্ছামতো বাড়তি আদায়ে কসুর করতো না। অথচ শহরের চাকচিক্য ছিল গ্রাম থেকে উদ্বৃত্ত শোষণ করে।

তারপরেও উনিশ শতকে আমাদের শহরগুলো দেশের শ্রেষ্ঠ মেধার পরিচর্যা করেছে। তা থেকে ওই মেধা শোষণের সহযোগী হয়েছে, এ কথা বললে অতিসরলীকরণের ভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়তে হয়। সন্দেহ নেই, ব্রিটিশ শাসন এদেশে গণমানুষের শোষণক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল; একই সঙ্গে পুরনো প্রক্রিয়াও চালু ছিল, যদিও তাতে হেরফের ঘটেছিল নানারকম। এমনকি সমাজ-সংস্কারে কিছু কিছু কুপ্রথার অবসান ঘটেছিল, অথবা তারা যে নিন্দনীয়, এই বোধটা জাগ্রত হতে শুরু করেছিল। সব মিলিয়ে কোনো মৌলিক রূপান্তর অবশ্য তারা ঘটায়নি। কিন্তু ঔপনিবেশিক শহর হলেও এবং সে কারণেই আরো পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার সঙ্গে যোগসূত্র একটা তারা তৈরি করে। এটি অনিবার্যই ছিল। কারণ, তাদের শাসন যে নিকৃষ্ট নয় এবং নানা দিক থেকে উৎকৃষ্ট, এ কথা বোঝানোর নৈতিক দায় একটা তাদের ছিল। জনগণের কাছে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ওই শাসন এবং তার সঙ্গে শোষণ, আয়ত্তাধীন সহজতর প্রকল্প হয়ে দাঁড়ায়।

এও সত্য, আঠারো শতকের শেষাশেষি ফরাসি বিপ্লব এবং প্রায় একই সময় থেকে ধাবমান শিল্পবিপ্লব ইউরোপে কর্মে ও ধ্যান-ধারণার জগতে এমন এক চমক সৃষ্টি করে, যা বাইরের আগ্রহী যে কোনো মনকে অভিভূত করে ফেলার জন্য ছিল যথেষ্ট। এর পশ্চাতে প্রাচীন হেলেনিক সভ্যতা, রেনেসাঁস ও পরবর্তী সতেরো শতক থেকে শুরু জ্ঞানকান্ড কম আকর্ষণীয় ছিল না। আমাদের দেশে তখন এদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া সম্ভব ছিল সবচেয়ে বেশি কলকাতাতে, অল্প-বিস্তর ব্রিটিশ-শাসনে নতুন কায়দায় গড়ে ওঠা অন্যান্য শহরেও। আমরা দেখি নতুন যুগের মানুষ রামমোহন রায়কে, নিয়মের অচলতায় আঘাত হানা ডিরোজিও-অনুপ্রাণিত হিন্দু-কলেজের ছাত্রদেরকে, মাইকেল মধুসূদন দত্তকে, বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমকে। এমনকি ধর্মান্তরণে নয়, ধর্ম-সংস্কারে অগ্রণী হন রামকৃষ্ণ পরমহংস, কেশব সেন, বিবেকানন্দ। ইউরোপীয় ভাবনাজগতের সঙ্গে সংযোগ ও সংঘাত ছাড়া এদের কোনোটিই বাস্তব রূপ পেত কি-না সন্দেহ। জাতীয়তাবোধেও দীক্ষা হয় নব্য ইউরোপীয়  রাষ্ট্রচিন্তা থেকে। কিন্তু এসবেরই কেন্দ্রভূমি মুখ্যত কলকাতা, যা আবার সমগ্র গ্রাম-বাংলার শাসন-শোষণের মূল সিদ্ধান্তভূমিও।

বৈপরীত্যের এই মর্মস্থলে রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) আবির্ভাব। প্রশ্ন-মীমাংসায়, অথবা তার সঙ্গে সমঝোতায় তিনিও সাড়া দেন। আমরা সেদিকে একটু চোখ বুলিয়ে বর্তমানের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করি।

 

দুই

রবীন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতায় – তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ অধিকারের তা প্রধান নিদর্শন। এইটিই সর্বোচ্চ রাজপ্রতিনিধির কর্মনিবাস। এর রাজনৈতিক মর্যাদা আরো বাড়ে, কারণ ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর ১৮৫৮-য় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যবর্তী ভূমিকা আর থাকে না। ব্রিটিশ জনপ্রতিনিধিসভা কোম্পানির অবলুপ্তি ঘোষণা করে।১১ ব্রিটিশরাজ – সে-সময় মহারানী ভিক্টোরিয়া – সরাসরি এই উপনিবেশে শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তাঁর মন্ত্রিসভা যাঁদের নিযুক্ত করেন তাঁরাই এখানে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব করেন। কোম্পানির ব্যবসায়ী স্বার্থ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাকার গতি এখন উল্টোমুখী। শিল্প-বিপ্লবে সফলতার কারণে ব্রিটিশ-প্রস্ত্তত সুতি কাপড় ও অন্যান্য ভোগ্য বা মাধ্যমিক পণ্য এখানে তুলনামূলকভাবে সস্তা দরে বিকোয়। শিল্পের কাঁচামাল অথবা খাদ্য-পণ্য রফতানি করা আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে বাজারদর ক্রেতার মর্জির ওপর বেশি নির্ভর করে। কারণ, অধিকাংশ পণ্যের বেলাতেই (ব্যতিক্রম, পাট) আরো অনেক বিক্রেতার সঙ্গে সে দরাদরি করতে পারে। এবং রাজশক্তির সুবিধা থাকায় এখান থেকে আমদানি-রফতানি ব্যবসায় মাঝখানে সুবিধামতো শক্ত-পোক্ত দালাল জোগাড় করাও তুলনায় সহজ। কলকাতাই তাদের ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। এমনকি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদেরও। তাতে সফলতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে তাঁদের জমিদারি কেনার সুযোগ করে দেয়। তাঁরা এই অঞ্চলেও পাবনা, কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় কোনো কোনো এলাকার জমিদার হয়ে বসেন।

প্রথম জীবন তাঁর কাটে প্রধানত কলকাতার অতিবিশিষ্ট নাগরিক পরিমন্ডলে। সেখানেও তাঁদের পরিবারের মেধার বহুমুখী বিচ্ছুরণে ব্যতিক্রমী সুনাম। আবার ব্রাহ্ম-সমাজে নেতৃস্থানীয় বলে সাধারণত জনমানব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। বাল্যে একবার বাবার সঙ্গে হিমালয়-ভ্রমণ প্রকৃতির বিশালতা, নিস্পৃহতা ও উদারতার অপরূপ অভিঘাত তাঁর মনে স্থায়ী ছাপ এঁকে দেয়। দুবার বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও তাঁর হয়। তবে সেখানে অভাজনদের জীবন-যাপনের খুঁটিনাটির দিকে তাঁর নজর প্রত্যক্ষের তলে গভীরভাবে নিবিষ্ট হয়েছিল, এমন কোনো তথ্য আমরা পাই না। পরে যখন তাঁর বয়স প্রায় তিরিশ তখন পিতৃ-নির্দেশে জমিদারি দেখাশোনার কাজ নিয়ে তাঁর আগমন ঘটে এখানকার গ্রাম-বাংলায়। একটানা না হলেও বারো-বছরের মতো তিনি এখানে বারে বারে এসেছেন, পল্লি-প্রকৃতির অতুল ঐশ্বর্যে, বিপুল মাধুর্যে ও কখনো-কখনো নির্মম উদাসীনতায় চেতনালোকে সম্মোহিত, আলোড়িত ও উজ্জীবিত হয়েছেন। এই অভিঘাত তাঁর মনে চিরস্থায়ী ছাপ এঁকে দিয়েছে। তাঁর পরবর্তী কর্মজীবনে তা দিকনির্দেশ করেছে। নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তিতে তাঁর ভাষণে এ-কথা তিনি অশেষ শ্রদ্ধায় ও অকুণ্ঠ বিনয়ে স্বীকার করেছেন।

এখানে এসেই তিনি মানুষকে দেখলেন তার অনাবিল সত্তায়। শহুরে প্রসাধন তার খসে পড়ে। প্রকৃতি তাকে লালন করে। আবার ওই প্রকৃতিরই বিরাগে সে অসহায়। আরো যোগ হয় শহরের শোষণ, যা তাকে নিঃস্ব করে চলে। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই হলো প্রকৃত স্বদেশভূমি। তার মানব-মানবীর জীবন-যাপনে প্রতিফলিত হয় স্বদেশের প্রাণবান সত্তা। চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ আশ্রয় দেয় তাকে। তা মনোহর। যদিও প্রবলের ব্যক্তিস্বার্থ ও পরস্বাপহরণের উদগ্র লালসা তাকে বঞ্চিত করে বারবার। দুদিক থেকেই তিনি বিষয়টি দেখেন। বাইরের দর্শক হয়ে নয়, নিজেকে তার মাঝখানে বসিয়ে। এবং গ্রাম-বাংলার অপার সৌন্দর্য ও শান্ত মহিমায় মগ্ন হয়ে। তাঁর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় এই ভাব শব্দবন্ধনে ধরা দেয় –

নমো নমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!

গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।

অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি –

ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।

পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –

স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতল স্নেহ।

বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে

মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জলভরে।                                              (চিত্রা, ১৮৯৫)

এটা এক স্থিরচিত্র। কিন্তু এক শাশ্বত দৃশ্যমায়া এ রচনা করে, যা বাস্তবে যদি বিচ্যুতিও থাকে, তবে তাকে উপেক্ষা করে চেতনায় গাঁথা হয়ে যায়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বিপরীতটাও দেখান। এই কবিতাতেই। অন্তিম চরণে প্রবাদপ্রতিম শ্লেষোক্তি – ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!’

আর পরস্বাপহরণে স্ফীত ওই ‘মহারাজে’র সম্পদও গ্রামে কোনো কাজে আসে না। গ্রামীণ উৎপাদনে ব্যস্ত-বিব্রত সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিজের দুরপনেয় ব্যবধান রচনা করে উদ্বৃত্ত সব তাঁর পাচার হয় শহরে। বেশিরভাগই আরাম-আয়েশের সন্ধানে। শহরের এই লুণ্ঠিত ঐশ্বর্যের উজ্জ্বলতা যতই চোখ-ধাঁধানো হোক, আসলে তা মেকি। এই বৈষম্যের ও অপব্যয়ের নিরর্থকতার বেদনা সারা জীবন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। খোলাখুলি লেখেন, ‘বর্তমান সভ্যতায় দেখি, এক জায়গায় একদল মানুষ অন্ন-উৎপাদনের চেষ্টায় নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছে, আর-এক জায়গায় আর-এক দল মানুষ স্বতন্ত্র থেকে সেই অন্নে প্রাণ ধারণ করে। চাঁদের যেমন এক পিঠে অন্ধকার, অন্য পিঠে আলো, এ সেই রকম। একদিকে দৈন্য মানুষকে পঙ্গু করে রেখেছে – অন্যদিকে ধনের সন্ধান, ধনের অভিমান, ভোগ-বিলাস সাধনের প্রয়াসে মানুষ উন্মত্ত। অন্নের উৎপাদন হয় পল্লীতে, আর অর্থের সংগ্রহ চলে নগরে। অর্থ-উপার্জনের সুযোগ ও উপকরণ যেখানেই কেন্দ্রীভূত স্বভাবত সেখানই আরাম আরোগ্য আমোদ ও শিক্ষার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোককে ঐশ্বর্যের আশ্রয় দান করে। পল্লীতে সেই ভোগের উচ্ছিষ্ট যা-কিছু পৌঁছয় তা যৎকিঞ্চিৎ। গ্রামে অন্ন উৎপাদন করে বহু লোকে, শহরে অর্থ উৎপাদন ও ভোগ করে অল্পসংখ্যক মানুষ; অবস্থার এই কৃত্রিমতায় অন্ন এবং ধনের পথে মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে প্রকান্ত বিচ্ছেদ ঘটেছে। এই বিচ্ছেদের মধ্যে যে সভ্যতা বাসা বাঁধে তার বাসা বেশিদিন টিকতেই পারে না।’ (‘উপেক্ষিতা পল্লী’ ১৯৩৪)

অথচ গ্রামীণ জীবন চর্চায় তিনি এর বিপরীতটিই কল্পনা করেন : ‘…একত্রে মেলবার যে সামাজিক মনোবৃত্তি ভিতরে ভিতরে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, অন্নসংস্থানের সুযোগের দ্বারা সেইটে জোর পেয়ে উঠল। মানুষ ভূমি মাতার নিমন্ত্রণ পেলে, একত্র সবাই পাত পেড়ে বসল, তখন পরস্পরের ভ্রাতৃত্বের সন্ধান মিলল, বহুপ্রাণ এক অন্নের দ্বারা এক প্রাণের সম্বন্ধ স্বীকার করল।…’ (‘পল্লীপ্রকৃতি’, ১৯২৮)

রবীন্দ্রনাথের চোখ কিন্তু খুলে যায় – অন্তত তিনি যা খুলে যাওয়া মনে করেন, তাই – এই বাংলার অকৃত্রিম গ্রামজীবনের সংস্পর্শে এসে। প্রকৃতির যে বিশাল ব্যাপ্তি, শ্যামল কান্তি, তা যেমন তাঁর হৃদয়-মন দুই-ই জুড়িয়ে দেয়, তেমনি এখানে মানব-মানবীর সরল-স্বাভাবিক প্রকাশ তাঁর ‘আপনাকে জানার – সেই অর্থে সবাইকে জানার বন্ধ-দরজাগুলো খুলে খুলে দেয়। একই সঙ্গে তিনি দেখেন তাদের অপরিসীম দারিদ্র্য, নিশ্চেষ্ট নিয়তিনির্ভরতা ও অন্ধ কুসংস্করাচ্ছন্নতা। তাঁর মনে হয় তাঁরও এক মানুষী দায়িত্ব আছে। সব ‘মূঢ় ম্লান মূক মুখে’ ভাষা জোগাবার, ‘শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে’ আশা জাগাবার দায়িত্ব। আর এই আকাঙ্ক্ষায় তাদের প্রাণিত করার, ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, / চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু’ – (‘এবার ফিরাও মোরে’, চিত্রা, ১৮৯৪)

শুধু জীবনযাপনের অর্থ খুঁজেই তিনি ক্ষান্ত হন না। নিজেই তাকে বাস্তবে ফুটিয়ে তুলতে এগিয়ে আসেন। একটা জিনিস তিনি বোঝেন, – দান-ধ্যানে সমষ্টিমানুষের কোনো মুক্তি নেই। তা তাদের পরমুখাপেক্ষী থাকতেই উৎসাহ জোগায়। তাদের স্বাবলম্বী হতে হবে এবং নিজেদের অনুভূত চাহিদাগুলো নিজেদেরই মেটাতে হবে। পরস্পর আলাদা হয়ে নয়। সবাই একসঙ্গে, কিন্তু সবার সমন্বিত স্বাধীন ইচ্ছাতেও। এইখানে তিনি আস্থা রাখেন সমবায় আন্দোলনে। কিন্তু তাতেও অর্থ-লগ্নির প্রয়োজন পড়ে দরিদ্র-অবুঝ-অশিক্ষিত গ্রামবাসী তা পাবে কোথায়? তিনি আহবান করেন গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে যারা বড়লোক হয়েছে, তাদের।  দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাবার জন্য নয়। টাকার লগ্নিতে সহযোগিতা করতে। মহাজনী কারবারের প্রতিযোগী হয়ে নয়, নিজেদের ক্ষতি না করে গরিব মানুষের সাধ্যের ভেতরে যুক্তিসঙ্গত হারে সুদ নিয়ে টাকা ধার দিয়ে। নিজের জমিদারিতে তিনি এই উদ্যোগের সূত্রপাত করেন। কিন্তু তা সফল হয়েছে সামান্যই। জমিদারি ভাগাভাগিতে তাঁর অধিকারের ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়। বিশ শতকের গোড়ায় তাঁর গ্রাম-বাংলার পাট অল্পই অবশিষ্ট থাকে। তিনি আবার কলকাতামুখো হন। তবে এখানকার অভিজ্ঞতার কথা ভোলেন না। পরে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন গড়ে তোলায় তার স্মৃতি তাঁর কাজে লাগে। তিনিও বারবার তা শোনান।

রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, একটা উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি খাঁড়া করতে পারলে তার অনুসরণে অন্যান্য গ্রামেও সাড়া জাগবে। সব গ্রাম উদ্ভাসিত হবে। কোনো জবরদস্তির তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। এবং ঔপনিবেশিক রাজশক্তির কৃপাভিক্ষাতেও তাঁর অরুচি ছিল। তাই বলে সহমর্মী-সহযোগী মানব-মানবী, তারা যে-দেশেরই হোক, সাধ্য ও সেবা নিয়ে এগিয়ে এলে তাদের তিনি দূরে ঠেলেননি বরং সাদরে গ্রহণ করেছেন। এইভাবে এল্মহার্স্ট, এন্ড্রুজ, পিয়ার্সন, এঁরা তাঁর স্বপ্ন-কল্পনার বাস্তবায়নে সঙ্গী হয়েছেন। বিদেশি-বিদেশিনী কেউ কেউ স্বেচ্ছায় অর্থ জুগিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। চামড়া-শিল্পে নকশা করায় শ্রীনিকেতন দেশের সেরা চারু ও কারুশিল্পীদের আকৃষ্ট করেছে। শুধু দেশের নয়, বিশ্বের মানচিত্রেই তার অবস্থান বড় অক্ষরে সূচিত হতে শুরু করেছে। গ্রামোন্নয়নে তার ভূমিকা অবহেলার নয়।

কিন্তু এতে গোটা গ্রাম-বাংলায় আলো জ্বলেনি। তার অনুসারী কেউ হয়নি। কেন হয়নি, তা বোঝাও খুব কঠিন নয়। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যে মানবসম্পদ ছিল শ্রীনকেতন উদ্যোগে, তার তুল্য কিছু, এমনকি, গোটা বিশ্বেই খুঁজে পাওয়া ভার ছিল। এই কর্মকান্ড সফল করতে তাঁকেও বেরোতে হয়েছিল ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতরেও তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। প্রতিদানও কিছু পেয়েছেন। এই প্রেরণা শ্রীনিকেতনকে সফল করেছে। কিন্তু অনুরূপ ব্যক্তিনির্ভর কর্মকান্ড বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর আগে আমেরিকা গিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন বিবেকানন্দ। তাতে উৎসাহিত হয়ে ভাগ্যান্বেষী চালাকচতুর           বঙ্গসন্তান পাগড়ি মাথায় গেরুয়া পরে আমেরিকা ভূখন্ডে গিয়ে অধ্যাত্মবাদ ফেরি করতে শুরু করেন। তাঁদের কান্ড-কারখানায় রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর বিরক্তি চাপা রাখতে পারেননি। হয়তো কোনো ফেরেববাজ লাভবান হয়েছে। কিন্তু বাংলার উন্নয়নে, বা বাঙালির আত্মচেতনার বিকাশে নিটফল শূন্যই থেকে গেছে।

শ্রীনিকেতনের যাত্রা শুরু ১৯২২ সালে। তখনো শহরবাসী মোট জনসংখ্যার শতকরা দশভাগেরও কম। এবং টুকটাক কলকারখানা কিছু গজালেও মোট উৎপাদনে তাদের নিট অংশ শতকরা তিন থেকে পাঁচের ওপরে নয়। এবং তার পুঁজিপণ্য প্রায় সবটাই আসে বাইরে থেকে। শুধু তাই নয়, আমাদের নিত্যব্যবহার্য বিবিধ পণ্যও বাজারে চলে আসে। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও। শিল্পবিপ্লবের পর তুলনায় সস্তা ব্রিটিশ পণ্য এদেশের ক্রেতাদেরও আকর্ষণ করে। কিন্তু তাতে আমাদের গ্রামীণ উৎপাদন-ব্যবস্থা বড়রকমের চোট খায়। বিশেষ করে কারিগররা বেকারত্বের মুখে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক তখনকার গোটা ভারতবর্ষে সাড়া জাগায়। চরকা ও খদ্দর তাঁর কাছে আত্মনির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। এবং আত্মনির্ভরতা মানে গ্রামনির্ভরতা। কারণ, সেখানেই জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যসাধন। শহরে-নগরে মেকি জীবন। তা অন্তঃসারশূন্য।

আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী একই কথা বলতে চাইছেন। একই জায়গায় চোখ রাখছেন। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যের ছবি অাঁকায় দুজনের ভেতর তফাৎ বিস্তর। একটা-একটা প্রদীপ জ্বেলে সব মিলে দেওয়ালির স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথের। এবং অবশ্যই তারা প্রত্যেকে এক-একটা গ্রাম। গান্ধীর আক্রমণ সার্বিক। সব গ্রাম একসঙ্গে। লক্ষ্য বিদেশি পণ্য। তার আসা ঠেকাতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কাজের সৃষ্টি হবে। মানুষ অসহায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। উদ্বাস্ত্ত হয়ে ক্রীতদাস হতে শহরে ছুটবে না। এবং গ্রামে উৎপাদন শ্রমনির্ভর। বাহুল্য বর্জনের ও আদিম সরলতার দিকে তার যাত্রা। পরনির্ভরতাকে তা প্রত্যাখ্যান করে। বিদেশি পুঁজি-প্রযুক্তিও বাদ যায় না। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সহায়-সম্বলের খোঁজে আপন-পর বাছ-বিচার করেন না। এবং প্রযুক্তির রূপান্তরে উৎপাদিকা শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার যদি সম্ভব হয়, তা-ই তাঁর কাম্য। তার জন্যে যে-কোনো জায়গায় হাত-পাততে তাঁর আপত্তি নেই। অবশ্য সামষ্টিক উদ্যোগের কথা তিনি চিন্তা করেননি। ব্যক্তিগত পর্যায়েই তাঁর দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। বাজারের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কর্মের কল্যাণকরতার ভিত্তিতে। ‘শুভ কর্মপথে’ নির্ভয়ে গান ধরতে চান তিনি। কাজেও চান হাত লাগাতে। তবে সবার জন্যে নৈর্ব্যক্তিক নীতিমালা রচনা করে নয়। নিজের মতো করে নির্বাচিত গ্রামের পুনর্গঠন – ‘Rural Reconstruction’ – করতে।

এটা ঠিক, আমাদের নগর ও শহর-কেন্দ্রিক সমাজে উনিশ শতকের গোড়া থেকেই পাশ্চাত্যের প্রলোভন একটা তৈরি হতে শুরু করেছিল। তবে এই মোহ যতটা ইউরোপীয় চিন্তা-কল্পনার রাজ্যে, ততটা তার বাস্তব কর্মকান্ড ঘিরে নয়। প্রত্যক্ষ জীবন-যাপনের তাগিদও সেদিকে টানেনি। আগেই বলেছি, বাংলার ব-দ্বীপে          ছোট-ছোট গ্রামগুলোতে যথেষ্ট চাষযোগ্য ও পশুপালন-ভূমি এবং অসংখ্য নদীনালা থাকায় অনায়াস-নিশ্চিন্ত জীবন-যাপনের কথা। জন্ম-মৃত্যু ঈশ্বরের বিধান। তা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও মাথা-ব্যথা নেই। কলেরা-বসন্ত-মহামারিতে কত গ্রাম-জনপদ আকস্মিক আক্রমণে বিরতিহীন ছারেখারে গেছে। গরিব-বড়লোকের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় কোনো তফাৎ থাকে না। প্রত্যাশিত আয়ু সবারই একরকম। জমির ওপর জনসংখ্যার বাড়তি চাপ কিছু বোঝা যায় না। এমনটিই স্বাভাবিক ও অপরিবর্তনীয় মনে হয়। জাত-ধর্ম যাই হোক, বর্ণভিত্তিক পেশার ধারা অক্ষুণ্ণ থাকে। প্রবল কোনো প্রতিবাদ ভেতর থেকে তৈরি হয় না। অন্য কিছু ভাবার প্রশ্নও জাগে না। কারণ এতেই সমাজে সর্বজনগ্রাহ্য স্থিতি একটা বজায় থাকে। অস্থিরতা বা অনিশ্চয়তা হানা দেয় না। এমনকি বিশ শতকের গোড়ার পর্বেও আমরা দেখেছি, আমাদের এই বাংলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯৩১ পর্যন্ত বার্ষিক শতকরা এক-এর বেশ নিচেই থেকেছে। গ্রামীণ সমাজের স্থিতিশীলতায় উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো আঘাত আসেনি। কখনো কখনো মারী বা দুর্ভিক্ষে গ্রাম উচ্ছন্নে গেছে। পরে আবার সেই ছাঁচেই অনুরূপ গ্রাম একই জায়গায় বা আশেপাশে গড়ে উঠেছে। উৎপাদনে নতুন উপকরণ বা নতুন কৌশলের কথা কেউ ভাবেনি। ভাবার প্রয়োজনও পড়েনি। জীবনযাপনের চেহারা মোটামুটি অপরিবর্তিতই থেকেছে।

ইউরোপে কিন্তু জ্ঞানকান্ডে মৌলিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। সতেরো শতকে আমরা পাই গ্যালিলিও ও নিউটনকে। মানুষের ইহজাগতিক ভাবনায় যুগান্তকারী পালাবদল ঘটে তাঁদের অবদানে। তারও আগে অবশ্য পনেরো শতকের শেষে কলম্বাসের আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার ও ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে আসার জলপথের খোঁজ পাওয়া সেখানে মানুষের চেতনায় নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত জাগায়। তারই পরিণতি আঠারো শতকের শেষেশিল্প-বিপ্লবের সূচনা ও প্রায় সমসময়ে ফরাসি বিপ্লবের অবসানে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান-রচনা। এরা গণচেতনাকেও আলোড়িত করে। তাদের জীবনের দৃশ্যপট বদলে দিতে শুরু করে। এই জ্ঞানকান্ডের জীবনঘনিষ্ঠতা ও প্রযুক্তির প্রায় জাদুকরী ক্ষমতা শহরকেন্দ্রিক ও শহরমুখী কিছু নব্যশিক্ষিত ও শিক্ষাপিপাসু মানুষের মনে আলোড়ন জাগায়। কিন্তু পাশ্চাত্যে সামগ্রিকভাবে মানবজীবন যে অনেক সুখকর ছিল, অধিকাংশ মানব-মানবী বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণ করে নিশ্চিন্ত ছিল, এ-কথা কোনোক্রমেই বলা যাবে না।১২ প্রকৃতপক্ষে নতুন মহাদেশ-আবিষ্কার – উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, নিউজিল্যান্ডসহ অস্ট্রেলিয়া – দীর্ঘ-সময় ধরে ওইসব অঞ্চলে অভিবাসন-ক্রিয়া অব্যাহত রেখে ইউরোপকে তার ক্ষুধা ও দারিদ্রে্যর বিরুদ্ধে সংগ্রামে বহুলাংশে হাঁপ ছাড়ার সুযোগ দেয়। ইউরোপের মানব-মানচিত্রের চেহারাও বেশ খানিকটা বদলে যায়। তফাৎটা বোঝা যায় কতকগুলো তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে। আমরা দেখি ১৭৯২-৯৯ সময়ে, সেখানে একদল বাধ্যতামূলক সৈন্যের শতকরা ৭২ ভাগের দৈহিক উচ্চতা ছিল প্রত্যেকের পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির কম। উনিশ শতকের মধ্যভাগেও গোটা ইউরোপেই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। কৃষিশ্রমিকের অবস্থা সাধারণভাবে করুণ। এমনকি ব্রিটেনেও ১৮৫৯-এ নিরাশ্রয় গৃহহীনদের উপস্থিতি প্রবল।১৩ বিপরীত দিক থেকে এই মরিয়া অবস্থাই পাশ্চাত্যকে শিল্পায়নের দিকে ঠেলে। উন্নয়নের ঊর্ধ্বগতি বজায় রাখতে শ্রমের শোষণ অনিবার্য বিভীষিকা হয়ে দেখা দেয়। একই সঙ্গে তা নতুন-নতুন নগরায়ণের পথ উন্মুক্ত করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্রমশ সাধারণ মানুষের আয়ত্তে আসতে তাকে। অথবা বলা যায়, শিল্প-প্রবৃদ্ধির চাহিদাই তাকে বাস্তবে পরিণত করে চলে। এই বাংলাদেশের অঞ্চলে বিশ শতকের প্রথমভাগেও পরিস্থিতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। চিন্তাভাবনায় অবশ্য প্রশ্নটি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। বাস্তবের রূপ যদিও ভিন্ন। প্রত্যক্ষ বিশৃঙ্খলার ও প্রশ্ন-মীমাংসার কণ্টকাকীর্ণ পথটির দিকে এবার দৃষ্টি দিই। সেইসঙ্গে ভাবুকদের মনে সাড়া-জাগানো রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন- পন্থা ও গান্ধীর অন্তর্মুখীসম্পন্ন-স্বনির্ভর ও সার্বিক গ্রাম-সমাজ গড়ার অর্থনৈতিক ও চূড়ান্তভাবে মানবকেন্দ্রিক আন্দোলন কোন কোন পরিণামফল নির্দেশ করে তাও দেখার চেষ্টা করি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিকল্প সাহসী পদক্ষেপকেও আমরা বিবেচনায় আনি।

তিন

১৯৪৫-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান বিশ্বভূমন্ডলের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা করে। তা যেমন গভীর, তেমনি ব্যাপক। প্রাক-যুদ্ধ পর্বে ব্রিটেনকেই বলা যেত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। সব মহাদেশে তার উপনিবেশ। ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত ফ্রান্সও কৌতূহল জাগায় আর সবার মনে। ঘরের পাশে উত্তর আফ্রিকায় সেও এক উল্লেখযোগ্য উপনিবেশিক শক্তি। রাশিয়ায় ঘটে গেছে ১৯১৭-য় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিকল্প রাষ্ট্র-ও-জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে তাও আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে ওঠে বিশেষ করে প্রাক-দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা যখন মুক্তবাজার ব্যবস্থায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তার স্বয়ংক্রিয়তা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অক্ষশক্তি – জার্মানি, ইতালি, জাপানের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স, পরে রাশিয়া – এর  সঙ্গে অন্য গোলার্ধের আমেরিকা, – যোগ দিলে তা ভিন্ন মাত্রা পায়। মানবতা-বিরোধী নাৎসি-ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় কিন্তু বিজয়ী শক্তিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেয় না। মুক্ত বিশ্বে ব্রিটেনের প্রাধান্য আর থাকে না। সেই জায়গায় চলে আসে আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র। বিকল্প জীবনধারার প্রায়োগিক রূপ নিয়ে প্রতিপক্ষ শক্তি হয়ে দেখা দেয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া। একদিকে ইউরোপ-কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা-সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। একে আর সামাল দেওয়া যায় না। মোটামুটি বিশ বছরের ভেতর সব উপনিবেশ, পরাধীনতা থেকে মুক্তি পায়। এই উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে। অবশ্য তা অখন্ড স্বাধীন ভারতবর্ষ নয়, দুই স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাশাপাশি চীনের ঘটনারাশি ভিন্নদিকে বাঁক নেয়। ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর আগেই জাপান চীন আক্রমণ করে। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মহাযুদ্ধ শুরু হলে তা ভিন্ন মাত্রা পায়। অক্ষশক্তির পরাজয় চীনকেও জাপানি আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে। কিন্তু রণক্লান্ত জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রশক্তি গৃহযুদ্ধে হেরে যায় চীনা কমিউনিস্ট জনশক্তির কাছে। ১৯৪৯ সালে চীনের উদ্ভব হয়।

আমাদের আলোচনার প্রেক্ষাপট বোঝার জন্যে এই কথাগুলো বলা। রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধী যে গ্রামকেই কর্মভূমির কেন্দ্রে রেখেছিলেন – রবীন্দ্রনাথ, আলাদা-আলাদা, গান্ধী, সমন্বিত শক্তি হিসেবে, যদিও লক্ষ্য অব্যাহত আর্থিক-সমৃদ্ধি নয়, পারস্পরিক কল্যাণ – তার একটা কারণ, এখানে শাসক ছিল কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের কোনো অভিজ্ঞতা তখন পর্যন্ত ছিল না; এবং শাসন ছিল ঔপনিবেশিক রাজশক্তির স্বার্থে, জনগণের ভালো হবে, এই কথা ভেবে নয়। রাষ্ট্রকে বাইরে রাখে তাই তাঁদের চিন্তা-কাঠামো এবং কর্মকৌশলও। শহর ঔপনিবেশিক শক্তির এক-একটি সংযোগ-বিন্দু। মানব-মানবীর প্রাণবান, এবং অর্থবহ সত্তাকে তাঁরা দেখেন এই শহরকে বিবেচনায় না নিয়েই। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জীবনের সুন্দর উজ্জ্বল-কান্তির আনন্দময় উদ্ভাসন, এই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। প্রকৃতিকে পরাজিত বা শাসন করা নয়। গ্রামই সেখানে পরস্পর-সংলগ্ন মানবভূমি, যা দিতে পারে প্রাণের আরাম, জীবনের সার্থক অতিবাহন।

কিন্তু যখন ঘটে ঔপনিবেশিকতার অবসান, তখন স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বও এসে পড়ে জাতীয় নেতৃত্বের ঘাড়ে। আবশ্যিকভাবে, তার কেন্দ্রভূমি লাগে, কেন্দ্র থেকে শাখা-প্রশাখায় প্রান্ত পর্যন্ত তার কর্মসূচি-কার্যপ্রণালী পৌঁছে দেওয়ার সুচারু ব্যবস্থা লাগে, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার উপযুক্ত পরিকাঠামো লাগে, দক্ষ লোকবল লাগে। শুধু গ্রামে-গ্রামে বার্তা রটিয়ে দেওয়া যথেষ্ট নয়, তাকে কার্যকর রূপ দেওয়ার ক্ষমতাও সংরক্ষণ করতে হয়। নৈরাজ্য কোনো সমাধান দেয় না। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বিদায় নেয় ঠিকই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা, জনগণের উন্নয়নের লক্ষ্যেও, অনিবার্য হয়ে পড়ে। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার শুরু থেকেই তা চলে আসছে। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় তার বিবর্তন ঘটে একভাবে। লাভের অভিমুখ ঘোরানো থাকে বাইরে। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার সংশোধন গুরুত্ব পায় অবশ্যই। কিন্তু তাকে খারিজ করা যায় না। নিটফল দাঁড়ায় এই, শহরের প্রয়োজন অটুটই থাকে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন-চাহিদা তার পরিসর বরং আরো প্রসারিত করে চলে।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর ওই দেশগুলোর অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় কী করে, এবং কত তাড়াতাড়ি, তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে পারবে। শুধু তাই নয়, এমনভাবে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি আনতে হবে, যাতে মাথাপিছু আয় ক্রমাগত বাড়ে, যেন দারিদ্র্য পুরোপুরি ঘুচে যায়। গান্ধী এটাকে সেভাবে বিবেচনায় নিতে চান না। রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ অর্থনীতির মৌলিক চাহিদাগুলো নিজেদের উদ্যোগে প্রত্যেকে নিজের মতো করে পূরণ করবে, এর ওপর জোর দেন; আপন-আপন সৃষ্টিশীলতা তাতে উৎসাহিত হয়, কিন্তু অবিরাম প্রবৃদ্ধির কোনো ধারণা তার সঙ্গে যোগ হয় না। এতে যে পণ্যরাশির প্রলোভনে প্রকৃতির ওপর নির্যাতন অবারণ হয়ে পড়তে পারে, তাতে তাঁর বিরাগই ছিল। কিন্তু টিকে থাকাও যে প্রবৃদ্ধি হারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে, এটা তিনি খেয়াল করেন না। অথবা, তাঁর সময়ের বাস্তবতা এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।

সদ্য স্বাধীন গরিব, কিন্তু উন্নয়নকামী দেশগুলোর উৎপাদন-ব্যবস্থার দিকে চোখ রেখে পরে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, আর্থার লিউইব্র এই সামান্য লক্ষণটি সুনির্দিষ্টভাবে সামনে আনেন (১৯৫৪), এরকম সব পরিস্থিতিতে গ্রামীণ অর্থনীতি উদ্বৃত্ত শ্রমের সমস্যায় ভোগে। তাতে তাদের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা বলতে গেলে শূন্য। পাশাপাশি পুঁজিনির্ভর উৎপাদন কান্ড সমগ্রের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। গতানুগতিক গ্রামীণ অর্থনীতির তারা অংশ নয়। ছড়ানো-ছিটানো শহরে বা শহরতলিতে তাদের কারবার। এদের চাঙা করতে চাই স্বল্প-মজুরির শ্রম – যেটুকু না দিলে শ্রমিকের টিকে থাকাই দায়। যেহেতু গ্রামে শ্রমের উল্লেখযোগ্য অংশ ফালতু, তারা না থাকলেও উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়ে না, তাই তাদের পুঁজিনির্ভর ও পুঁজি-সৃষ্টিকারী শিল্পে, পরিকল্পিতভাবেই টেনে আনা যায়। বিনিয়োগে কৃষি-উদ্বৃত্তও কাজে লাগে। ফালতু শ্রমিকের ভরণ-পোষণের জন্যে এটা তারা এমনিই খরচ করত। কিন্তু এভাবে পুঁজির ক্ষেত্র যদি প্রসারিত ও বহুমুখী হতে থাকে, তবে শিল্প উৎপাদনে শ্রমের চাহিদা বেড়ে চলবে। গ্রামের শ্রমভার লাঘব করে শহরের বিস্তার ঘটতে থাকবে। তবে গ্রামীণ খাতে বাড়তি শ্রমিক শহরমুখী হওয়ার ফলে তার প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা যদি বেড়ে যায়, যার ফলে গ্রামে এবং শহরে উভয় জায়গাতেই শ্রমের মজুরি বাড়ে, তবে তার দুটো বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। একদিকে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় কল-কারখানায় শ্রমের চাহিদা আর নাও বাড়তে পারে, অথবা ওই বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে, অন্যদিকে মজুরি বাড়ার ফলে সাধারণভাবে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শিল্পপণ্যের চাহিদাতেও ঊর্ধ্বগতি আসতে পারে। সব মিলিয়ে কৃষি ও শিল্প, উভয় খাতেই প্রসার ঘটার সম্ভাবনা। তবে শিল্পখাত দ্রুততর গতিতে এগোলে কৃষিতে শ্রমস্বল্পতা দেখা দেওয়া সম্ভব। সে-কারণে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্যেও, কৃষিও তুলনায় পুঁজিঘন উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হতে পারে। সার্বিকভাবে উনণয়নশীল সমাজ-অর্থনীতির এই দৃশ্য-কল্পনা বাস্তবায়নে সরকারেরও একটা ভূমিকা থাকে। বিষয়ানুযায়ী করারোপ বা করছাড়, অর্থায়নে ব্যাংকখাতে নীতি-নির্দেশনা,& এগুলো বিবিধ কর্মকান্ডে অনুঘটকের কাজ করে।১৪

হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ রানিস (Ranis) ও ফেই (Fei) লিউইস-মডেলকে আরো কার্যকর রূপ দিতে সচেষ্ট হন (১৯৬১)। কৃষিতে শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্যের ওপরে হলেও যদি তা শিল্পশ্রমে মজুরির চেয়ে কম হয়, তবে তাদেরও তাঁরা আরো দ্রুতহারে শিল্পখাতে টেনে আনার কথা বলেন। তাতে শিল্পের অধিকতর সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে কৃষিতেও পুঁজির আপেক্ষিক ঘনীভবন। ওই সময়ের প্রযুক্তি তা ছোট-ছোট খামারকে উৎসাহ দেয় না। বৃহত্তর সম্পন্ন কৃষকদেরই তা উৎসাহ জোগায়। কিন্তু তাঁদের মতে সমৃদ্ধি এতে ত্বরান্বিত হয়। অর্থনীতি পুরোদমে এগিয়ে যেতে পারে।১৫

একটা কথা এখানে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না, পাকিস্তানের করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকনোমিকসের সঙ্গে রানিস ও ফেইয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সরকার তাঁদের সমীহ করত। তাঁদের পরামর্শের ছাপ দেশটির উৎপাদন ও বণ্টন নীতিতে কিছু যে পড়ত না, তা মনে হয় না।১৬

আর এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গানার মিরডাল, লিউইসের উদ্দেশ্য ও তত্ত্বকাঠামোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েও,  বাস্তব কর্মকান্ডে উপত্যকায় ও অধিত্যকায় – বিপুল দারিদ্রে্য ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সম্পন্নতায় যে-ব্যবধান, তার পরিণামে একমুখী পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন না হয়ে যে বৈষম্যের তীব্রতা, ও সেইসঙ্গে আপেক্ষিক দারিদ্রে্যর  বিস্তার বাড়তে পারে, সেদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, পুঁজি-বিনিয়োগের বিশেষ বিশেষ কেন্দ্রকে ঘিরে চারপাশে উন্নয়নের বিস্তার ঘটবে, এটা খুবই সম্ভব (spread effect)। কিন্তু বিপরীত সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এমনও হতে পারে, সফল পুঁজিকেন্দ্রিক ক্ষেত্রগুলো অনুন্নত এলাকার বিশেষ করে শ্রমনির্ভর কৃষি এলাকার, উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ও টেনে নিতে পারে, এবং তা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রশ্রয়েই। পরিণাম তার, ওইসব জনবহুল অনুন্নত অঞ্চল সঞ্চয়-বিনিয়োগের অভাবে আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। একে তিনি বলেছেন একই মিলিত কারণের (cumulative causation) সম্পূর্ণ বিপরীত ফল – পশ্চাদবলোপন (backwash effect)১৭ পাকিস্তানে ঠিক এই কান্ডটিই ঘটে। এবং সেখানে প্রধান ভূমিকা নেয় পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থপুষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। অন্যান্য বৈষম্যমূলক নীতিমালার সঙ্গে টাকার উচ্চমূল্য হার বজায় রেখে এ-বাংলার পাটচাষিদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পপতিদের অপেক্ষাকৃত কম খরচে বিদেশ থেকে পুঁজিপণ্য আমদানির সুযোগ করে দেওয়া, ও পাশাপাশি একই রাষ্ট্র হওয়ায় এখান থেকে সঞ্চয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানায় ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে ওখানে পাচার করা, এ দুটো কাজই সম্পূর্ণ বৈধপথে ধারাবাহিক ঘটে চলে। এই বাংলা উন্নয়নের কোন অংশীদার হয় না।

আসলে পুঁজি-কেন্দ্রিক কার্যত শহর-কেন্দ্রিক উন্নয়ন-উদ্যোগের সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখা দরকার, তার ফল কোনো না কোনোভাবে সর্বস্তরে সাধারণ মানুষের ভেতর প্রেরণা সঞ্চার করছে কি না, উন্নয়নের চলকরাশি তাদেরও ইতিবাচকভাবে স্পর্শ করছে কি না। তেমন না হলে উন্নয়নের অঙ্গীকার বিফলে যেতে বাধ্য। তবে শিল্পায়ন ছাড়া, শহর-নগরের বিস্তার ছাড়া যে কোনো ধরনের উন্নয়ন, – সূচক মানব-কেন্দ্রিক হোক বা মাথাপিছু আয়নির্ভর হোক – বহু মানুষ-অধ্যুষিত কোনো দেশে ঘটেছে, এমনটি চোখে পড়ে না। সাম্প্রতিককালে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী ভারতীয় চেতনায় সবচেয়ে গৌরবের দুই ব্যক্তিপ্রতিভা। তাঁদের আদর্শ এখনো মানুষের মনে প্রেরণা জোগায়। কিন্তু তাঁদের গ্রাম-নির্ভর সমাজ-ভাবনা উন্নয়নের অনুশীলনে সেভাবে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে না; যদিও ধারাবাহিক কর্মকান্ডে তালমিল বজায় রাখায় তাদেরও বিবেচনায় রাখতে হয়।

নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতেই (১৯৩৬) মন্তব্য করেছিলেন, গান্ধীর কৃষি ও কুটির শিল্প-কেন্দ্রিক গ্রাম-ভারতের ধারণা এবং সেই সূত্রে স্বরাজ-ভাবনা, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকারক; বাস্তবে তেমন কল্পরাজ্য কায়েম করাও সম্ভব নয়;১৮ যদিও তিনি স্বীকার করেছিলেন, কৃষক সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের জীবনবোধ এসব দেখার ও বোঝার চোখ তাঁর খুলে দিয়েছিলেন গান্ধীই।১৯ পরে মহলানবিশের তত্ত্ব-কাঠামোর ওপর ভর করে তিনি যে উন্নয়নের পথ ধরেন, তা প্রাধিকার দেয় ভারী শিল্পকে, যা উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর এবং যা গড়ে উঠলে অন্যান্য শিল্প, এমনকি কৃষি, তাকে কাজে লাগাতে পারবে। দেশ প্রকৃত স্বনির্ভর হবে। বাস্তব, পরিকল্পনামাফিক সবটা এগোয়নি। অনেক বাধা-বিপত্তি এসেছে, প্রকৃতি সবসময়ে সহযোগিতা করেনি, আয় সৃষ্টি ও বণ্টন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তবু অর্থনীতি সমন্বয়ের পথে এবং উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়েছে। শহরাঞ্চলও নতুন মাত্রা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শহরকে আলোকিত করে গ্রামকে অন্ধকারে রাখায় এক সময় ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, শরীরের সব রক্ত মুখে এসে জমা হলে তাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে না। কিন্তু সর্বাধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি শহর থেকে অসংখ্য শিরায়-উপশিরায় গ্রামে পেঁŠছে দিতে পারলে তাতে অন্ত্যোদয়ে বাধা পড়ার কথা নয়। শহর বহির্বিশ্বের কায়েমি-স্বার্থের প্রয়োজনে বিলাসিনী নটী হয়ে আর থাকে না।

তবে উন্নয়নের দ্বান্দ্বিক রূপ সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে ফুটে ওঠে চীনে। কমিউনিস্ট চীনের উত্থানের প্রাক-পর্বে সেখানকার সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি অনেকেই আমরা এড়িয়ে যাই। কিন্তু সেখানেও দেখার বিষয় কিছু আছে, যা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। জাপান ১৯৩৭-এ চীন আক্রমণ করে।২০ ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় দুবছর পরে। আমেরিকা তাতে জড়িয়ে পড়ে আরো দুবছর পরে – পার্ল হারবারে জাপানের বোমাবর্ষণের পর। রাশিয়াও যুদ্ধে অংশ নেয় হিটলারের সরাসরি আক্রমণের পরে – ওই ১৯৪১-এ। এভাবে দেখতে গেলে চীনে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ইউরোপে তা দাঁত বসাবার আগেই। অন্তত দুটো কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগ আমরা ফুটে উঠতে দেখি : ১. নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস (প্রান্তিক, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৭), ও ২. বুদ্ধভক্তি (নবজাতক, ৭ জানুয়ারি, ১৯৩৮)। আট বছর ধরে চীন জাপানের হামলা যুঝেছে। তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্য যে কোনো মিত্রশক্তির তুলনায় কম নয়। সমর্থনযোগ্য হিসাব যা পাই, তাতে দেখি অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে আমেরিকা ও ব্রিটেন, প্রত্যেকে হারিয়েছে কমপক্ষে চার লাখ করে জনশক্তি, রাশিয়ার ক্ষতি দুই কোটি মৃত্যু ছাড়িয়ে যায়; আর চীন হারায় এক কোটি ৪০ লাখের ওপর তার স্বদেশের মানুষ।২১ আট বছর ধরে যুদ্ধটা চলেছে চীন ভূখন্ডেই। তাই তার প্রধান-অপ্রধান সবরকম প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ধ্বংসের মুখে পড়ে। বসবাসের বৃহৎ অট্টালিকাও বাদ যায় না। যুদ্ধের মোকাবেলায় চীনের নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী সরকারপ্রধান চিয়াং-কাই-শেক। ক্ষমতালিপ্সু, নির্মম, দুর্নীতিগ্রস্ত – এমন অনেক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে। কিন্তু দেশরক্ষার যুদ্ধে কখনো তিনি দুর্বলতার পরিচয় দেননি। ১৯৪১-এ আমেরিকা যুদ্ধে নেমে পড়লে তারা পাশে এসে দাঁড়ায়। তাতে নতুন সমস্যারও সৃষ্টি হয়। আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিয়াং-কাই-শেকের জাতীয় লক্ষ্য ও সেইসঙ্গে রণনীতি, সবসময় এক জায়গায় মেলে না। সোভিয়েত রাশিয়াও প্রায় একই সময়ে জার্মানিকে প্রতিহত করায় এগিয়ে আসে। বিজয়ের পথে তার একটা বাহিনী জাপানিদের সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া হয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। মহাযুদ্ধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভেতর থেকে সহযোগী ও সহযোদ্ধা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে যান চিয়াং-কাই-শেক। কিন্তু তখনো চীনের সংহত রূপ অধরা। মাঞ্চু-সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে ১৯১২ সালে। তার আগেই ১৯১১-য় সান-ইয়াত-সেনকে প্রধান করে চীনকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু উথাল-পাথাল অবস্থায় সান-ইয়াত-সেন তখন এক বছরের বেশি টিকতে পারেন না। যুদ্ধবাজদের বিভিন্ন এলাকায় নিজ নিজ দখল বজায় রাখা প্রধান হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতেই তিনি আবার ক্যান্টনে এক বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। অধিকাংশ বিদেশি-শক্তি তাঁকে গুরুত্ব না দিলেও রাশিয়ায় বিপ্লবোত্তর কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে তাঁর এক যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা হয়। যদিও বলশেভিক নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, চীন খুবই পশ্চাৎপদ, তার সঙ্গে সমমর্যাদায় যৌক্তিক সহযোগিতা তখনো বাস্তবসম্মত নয়। তার পরেও এই যোগাযোগ চীনের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের পথ খুলে দেয়। সমাজবাদী আদর্শ যাঁদের আকৃষ্ট করে, তাঁরা সংঘবদ্ধ হতে থাকেন। এবং অনেকটা খোলামেলাই। সান-ইয়াত-সেন কিন্তু পরিস্থিতি সুসংহত করার অবকাশ পান না। ১৯২৫-এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ক্ষমতার ও জায়গা দখলের পালা নতুন করে শুরু হয়। এতে জয়ী হয়ে নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করেন জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং-কাই-শেক। ১৯২৭-এ সাংহাই দখলের সময়, তিনি সেখানে, বিদেশিদের নয়, হাজার-হাজার কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যদের নির্বিচারে হত্যাকান্ড সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করেন। মাও তাঁর অনুসারীদের নিয়ে উত্তর-মধ্যাঞ্চলে পাহাড়ে ঘেরা ইয়েনান (Yau’an)-এ আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে কৃষক-বিপ্লবের রূপরেখা রচনা করতে শুরু করেন। চিয়াং-কাই-শেকের প্রভুত্ব তিনি স্বীকার করেন না। তবে ১৯৩৭-এ জাপানি হামলা শুরু হলে তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়বেন না, এ-বিষয়ে সমঝোতায় আসেন। এবং যুদ্ধ চলাকালে তা মোটামুটি কার্যকরই থাকে। কিন্তু জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে কমিউনিস্টরা তেমন অংশগ্রহণ করেনি। তারা তাদের শক্তি সংহত রেখেছে যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্যে। আরো একজনের কথা এখানে বলা প্রয়োজন। তিনি ওয়াং-জিং উয়ে। সান-ইয়াত-সেনের সময় তিনি ছিলেন যেন সমাজ-বিপ্লবের এক রোমান্টিক নায়ক। অতীব সুদর্শন ও অসাধারণ বক্তা। দুঃসাহসী কান্ডেও সরাসরি নেমে পড়েন সবার আগে। অনেকে তাকেই মনে করতেন সান-ইয়াত-সেনের উত্তরাধিকারী। ক্ষমতার লড়াইয়ে চিয়াং-কাই-শেকের কাছে হেরে গিয়ে তিনি দূরে সরে থাকেন। পরে ১৯৪০-এ এমন এক হঠকারী কান্ড ঘটান, যাতে জাতীয় ইতিহাসে তিনি একরকম বিস্মৃত হয়ে পড়েন। যেটুকু মনে থাকেন, তা শুধু এক খলনায়ক হিসেবে। ১৯৪০-এ জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী যখন জাপানিদের হাতে মার খেয়ে বিধ্বস্তপ্রায়, তখন তিনি ওই আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে চুক্তি করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি এক কিংবদন্তিকে কী মনে করিয়ে দেন? চীনের এক অস্থায়ী সরকারের প্রধান হয়ে বসেন। নান্কিং-কে করেন রাজধানী।  চিয়াং-কাই-শেকেরও রাজধানী ছিল নানকিং। ১৯৩৭-এ জাপানি আক্রমণে তা বিধ্বস্ত হয়। পূর্বোপকূল থেকে আরো দূরে সরে মফস্বল শহর চোং কিং-এ তিনি তা সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। তবে তা-ও ১৯৩৯-এ পৌনঃপুনিক জাপানি বোমা-হামলার শিকার হয়। হাজার-হাজার অধিবাসী প্রাণ হারান।

১৯৪৫-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়। মিত্রশক্তির কাছে জাপান আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ী শক্তিবলয়ে চীনকেও গণ্য করতে হয়। চিয়াং-কাই-শেক আশা করেন, তাঁর প্রতিরোধ সংগ্রাম-ও-চীনের পুনর্গঠন – এই দুটো বিষয় মনে রেখে পশ্চিমা-বিশ্ব যথাযোগ্য সহযোগিতা দেবে; কিন্তু তা হয় না। পাশ্চাত্যের প্রাচ্যনীতিতে জাপানই গুরুত্ব পেয়ে চলে। এদিকে চীন নিজেই আর এক গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে। আকস্মিক নয়।  সান-ইয়াত-সেন-পরবর্তী চীনে বোধহয় তা অনিবার্যই ছিল।

মহাযুদ্ধ চীনের বড়-বড় শহর ও সেইসঙ্গে তার শিল্পায়নের অবকাঠামো ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়। একরকম জীবন্মৃত অবস্থায় ধুঁকতে থাকে। ইদানীং যেসব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তা থেকে জানা যায়, বিশ শতকের প্রথম থেকে আধুনিকায়নের ও শহরাঞ্চল গড়ে তোলার যা কিছু উদ্যোগ অর্থনীতিতে সঞ্চারিত হয়, তার সৃষ্টিশীল অংশ বেশিরভাগ ধ্বংসের মুখে পড়ে। রেললাইন প্রায় সবটাই বিধ্বস্ত, রাজপথ-কালভার্ট খান-খান, সাংহাই নগরীর শতকরা প্রায় ৫২ ভাগের এবং রাজধানী নানকিংয়ের প্রায় ৮০ ভাগের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। উৎপাদন-ব্যবস্থা একরকম আদিম কৃষিতে ফিরে যায়। মিত্রশক্তি সোভিয়েত রাশিয়াও লুণ্ঠনে কার্পণ্য করে না। জাপানকে তাড়া করে ভেতরে ঢুকে ভারী শিল্পে অগ্রগতি যেটুকু হয়েছিল তার বেশিরভাগ মাঞ্চুরিয়ায় ছিল তা খুলে নিয়ে যায়। যুদ্ধের প্রায় গোটা সময় কমিউনিস্টরা ইয়েনানে ঘাঁটি গেড়ে সাধারণ কৃষিজীবীদের ভেতর নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে চলে। মাও-জে-দংয়ের কাছে শ্রেণিসংগ্রাম চীনের বাস্তবতায় কৃষিজীবীদের মুক্তির সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। উত্তরে ও পশ্চিমে সোভিয়েত কমিউনিস্টদের সঙ্গেও তৃণমূল পর্যায়ে যোগসূত্র গড়ে ওঠে। খোলাখুলি যুদ্ধের পরিমন্ডলে অস্ত্রের অভাব হয় না। গণবাহিনী তৈরি করে কৃষকদের হাতে দেদার অস্ত্র বিলানো যায়। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন সম্পর্কে প্রকৃত চাষিদের জমির মালিক করে ভূমি-সংস্কারের কাজ বৈপ্লবিক আকার নেয়। বিপুল গরিব মানুষের সাড়াও মেলে তাৎক্ষণিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মাওয়ের আহবানে এই কৃষক ব্রিগেড চতুর্দিক থেকে শহর ঘিরে ফেলে তাকে কব্জায় এনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব পরিকাঠামো দখল করতে শুরু করে। আগেই বিধ্বস্ত শহরগুলোর প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা ছিল না। যত শহরের পতন ঘটে, তত কমিউনিস্টরা সংখ্যায় বাড়ে। শক্তিতেও। ১৯৪৯-এ বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়। মাও-জে-দং-এর নেতৃত্বে এক অবিভক্ত কমিউনিস্ট গণচীন আত্মপ্রকাশ করে। বিধ্বস্ত-পরাস্ত চিয়াং-কাই-শেক তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে গিয়ে সেখানে মার্কিনিদের সহায়তায় একনায়ক হয়ে বসেন। মূল চীন-ভূখন্ডের দিকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি মেলে থাকলেও সেখানে আর তাঁর ফেরা হয় না। ১৯৭৫-এ তাইওয়ানেই তাঁর জীবনাবসান। ১৯৭৬-এ মৃত্যু মাও-জে-দং-এর। তবে তা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বাধিনায়ক হিসেবে গণচীনের রাজধানী বেইজিং (পিকিং)-এ।

আমাদের আলোচনার মূল বিষয়টির দিকে এখান থেকে ফিরে তাকাই। মাও-জে-দং এমন এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ায় নেতৃত্ব দিলেন, যা নানা দিক থেকে বিশিষ্ট। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পূর্ণাবস্থায় তার ভেতর থেকে শ্রমজীবী মানুষের বিপ্লব সমাজতন্ত্রে উত্তরণ অনিবার্য করবে – অন্য কথায় শহরে-নগরে উৎপাদনের মূল কেন্দ্রগুলো প্রযুক্তির প্রয়োগসিদ্ধ কর্মীদের দখলে আসবে – এই অনিবার্যতা বা এই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত, যা মার্কসের দ্বান্দ্বিক যুক্তিবাদ অনুসরণ করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, তা এখানে আদৌ প্রাসঙ্গিক মনে হয় না। মার্কসের praxis, বা প্রয়োগকলা অবশ্য শিং-উঁচিয়ে তাড়া করে। তার তাগিদে কার্য-কারণ-সম্পর্কের ধারাবাহিকতা উলটে-পালটে যায়। এমনকি মার্কসের বাস্তবের প্রেক্ষাপটে বিচার-বিশ্লেষণেও।২২ চীনেও ব্যাপারটা সেরকম ঘটে। পরিস্থিতি এমন, যেখানে মূলত পুঁজিভিত্তিক উৎপাদন-ব্যবস্থার ভৌত কাঠামো যা গড়ে উঠেছিল, তার কিছুই প্রায় কার্যকর নেই। অনেকটাই বিধ্বস্ত এমনকি নিশ্চিহ্ন। এখানে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে তারপরে করণীয় কী? শ্রমের উৎপাদিকাশক্তি বাড়ানোর কথা বলা যায়। সেটা কোথায়? কেমন করে? এই উৎপাদিকাশক্তি বাড়াবার পূর্বশর্ত হলো, পুঁজির রূপান্তর ঘটিয়ে তারও প্রায়োগিক ক্ষমতা বাড়ানো। তার বিরুদ্ধে লড়াই করা নয়।

মাও-জে-দং উৎপাদন সম্পর্কে কৃষকদের বিপ্লবী ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দেন। এবং তারই অনুসরণে কলকারখানায় হাতে-কলমে কাজ করে যারা, সেই শ্রমজীবীদের। কমিউনের কল্পনাকে তিনি বাস্তবায়িত করতে চান। শহর ও গ্রামের তফাৎ তাঁর কাছে অবান্তর হয়ে পড়ে। তাঁর বিখ্যাত ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ বা  ‘বিশাল-উল্লম্ফন কান্ড’ (১৯৫৭-৬১) ব্যক্তিগত উৎপাদনকে প্রান্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনে। যৌথ উদ্যোগ থেকে বাধ্যতামূলক উদ্বৃত্ত বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত হয়। আর ‘ওয়াকিং অন টু লেগস’ (দুপায়ে হাঁটা) – এই ধুয়ো তুলে গ্রামে-গ্রামে ও ঘরের পেছনে ফার্নেস বসিয়ে স্টিল বানানোর কুটিরশিল্প গড়ে তোলার উৎসাহ পায়। ফল কিন্তু হয় মারাত্মক। ১৯৫৮-৬১-র টানা দুর্ভিক্ষে শুধু এই কারণেই মারা যান ১৬.৫ মিলিয়ন থেকে ২৯.৫ মিলিয়ন মানব-সন্তান।২৩ আন্দাজের ব্যবধান বিরাট। তবে সর্বনিম্ন সংখ্যাটিও যথেষ্ট আতঙ্ক জাগায়। চীনের কোথাও কোথাও ওই সময়ে আবহাওয়ার বিরূপতাও ছিল। তবে তা-ই দিয়ে এমন ভয়াবহতার অতি আংশিক ব্যাখ্যা হয়তো মেলে। বাংলায় ১৭৭০-এর মন্বন্তরেও বিপর্যয় এই আকারের হয়। দেশের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ-উৎসন্নে যায়। তার পেছনেও বড় কারণ ছিল প্রশাসনের উদাসীনতা, একই সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খাজনা আদায়ে নির্মমতা। যাই হোক, ১৯৬১-তে চীনে বৃহৎ উল্লম্ফন নীতি পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু গ্রামে-শহরে ক্ষমতায় ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সমতা আনার – এক কথায় উৎপাদন-সম্পর্কে পৃথকতা দূর করার – পরিকল্পনা মাও-জে-দংয়ের মাথা থেকে যায় না। তারই পরিণাম ১৯৬৬-৭৬, এই পর্বের সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তারও পরিণতি সুখকর হয়নি।

মাওয়ের মৃত্যুর পর দুবছরের ভেতর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি একেবারে উলটোদিকে মুখ ঘোরায়। নেতৃত্বে আসেন দেং-শিয়াও-পিং। দেশটির ওপর একদলীয় কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু মৌলিক সংস্কারে ব্যক্তিমালিকানার পরিসর বেড়ে চলে – যদিও সরকারের নিয়ন্ত্রিত ও সর্বতোভাবে উদ্যোক্তা-অনুকূল বাজার-ব্যবস্থায়। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও পুঁজির উৎপাদনশীলতা সর্বাধিক জোর পায়। বহির্মুখী দৃষ্টি আরো তৎপর হয়ে ওঠে। আগ্রাসী রফতানিনীতি রাষ্ট্রই পরিচালনা করে। কনফুসীয় ঐতিহ্য, কিছুটা বা বৌদ্ধ ধ্যান-ধারণার রেশ দক্ষতার ও ইহজাগতিকতার দিকে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিচালিত করে। ‘কম্যান্ড-ইকোনমি’ তার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। কোথাও কোনো বিরোধ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। প্রবৃদ্ধি হার বিস্ময়করভাবে বাড়ে। এবং তা ধারাবাহিক অব্যাহত থাকে।২৪

একই সঙ্গে যা লক্ষণীয়, তা শহরের বিস্তার। ১৯৬৫-তে যেখানে শতকরা ১৮ ভাগ লোক শহরবাসী ছিল, ১৯৮৮-তে তা দাঁড়ায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ।২৫

অনুমান করা যায়, এখন তা শতকরা ৬০-৬৫-র কোঠায় চলে এসেছে। শহর গ্রামকে শোষণ করে এই ধারণা নিয়ে আর কেউ বসে নেই। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও আধুনিক মূলধনী সামগ্রীর ব্যবহার ক্রমবর্ধমান। তা বেশিরভাগই সরবরাহ করে শহরের উৎপাদন কর্মকান্ড। গ্রামেই বাড়ির পেছনে চুলো বসিয়ে ইস্পাত বানাবার হুজুগ আর নেই।

 

এবার আমরা আমাদের দিকে ফিরে তাকাই। রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধী যে বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে গ্রামোদ্যোগ ও জাতীয় উদ্যোগ সমার্থক মনে করেছিলেন, তা আর নেই। এর ভেতরে যে প্রযুক্তি-বিপ্লব ঘটে গেছে, বিশেষ করে গত শতকের দ্বিতীয় ভাগে, তার চৌম্বক টানে আমরাও তার অন্তর্জালে ঢুকে পড়েছি। গ্রাম-শহরের বিভাজন তাতে ঘুচে যায়। শুধু তাই নয়, উপগ্রহ সংযোগে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ঘটনা, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও, চোখে দেখা সম্ভব। উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকলে মুখোমুখি কথা বলাও। এছাড়া ভেষজ বিজ্ঞান অনেক মহামারী নির্মূল করেছে। জীবন অনিত্য হলেও তাকে প্রশস্ত করার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। প্রজনন আর সবটুকু নিয়তি-নির্দিষ্ট নয়। নরনারীর ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ তাতে সম্ভব। কৃষিতেও ঘটেছে প্রযুক্তি-বিপ্লব। তাতে গ্রাম-শহরের ঘনিষ্ঠতা ক্রমবর্ধমান। শহরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের। শ্রম যে পণ্য, তা অনেক আগে থেকেই। এখন তা আরো সচল। নর-নারী নির্বিশেষে। পূর্ব-নির্ধারিত গ্রামীণ পরিবেশই তার আর আমৃত্যু-আজীবন অপরিবর্তনীয় নিয়তি নয়। এসবের ফলে গ্রাম বাঁচলে শহর বাঁচবে, বা শহর গ্রামের কাঁধে চাপা সিন্দাবাদের বুড়ো, এসব কথা অনেকখানি তাদের বাস্তব সঙ্গতি হারাতে বসেছে। গ্রাম থাকা প্রয়োজন। তা মৌলিক।২৬ কিন্তু শহরও গ্রামে প্রাণসঞ্চার করছে। তা উপেক্ষা করার নয়। ফলে শহর-গ্রামের ভূ-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। সবটাই যে সুখকর, তা নয়। অচেনার রহস্যময়তা থাকছে না। জীবনের রসানুভূতি বেশ কিছুটা শুকিয়ে যেতে বসেছে। অস্থিরতা বাড়ছে। আবার উলটো দিক থেকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাড়ছে পরাণুকরণের গতানুগতিকতা বাড়ছে, সব মানব-মানবীরই, অন্তর্জাত নিঃসঙ্গতা এবং তা যা দিয়ে শুরু করেছি, আমাদের এই অতিপ্রজ ব-দ্বীপ অঞ্চলেও। যদিও তার মাটিরও ব্যবহারে-ব্যবহারে শুকনো-খটখটে হওয়ার অনুপাত ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সাগর থেকে আরো নতুন মাটি জাগবে, এই ভরসা নিয়ে বসে থাকা অর্থহীন। বিপরীত সম্ভাবনার কথা যে বলেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূল থেকে বিরাট অঞ্চল সাগরগর্ভে তলিয়ে যাওয়া, তার আশঙ্কাও আপাতত মাথায় রাখছি না। তেমন কিছু ঘটলে গোটা পৃথিবীর চেহারাই বদলে যাবে। আমাদের চিন্তার প্রেক্ষাপট আর একইরকম থাকবে না।

আমাদের এই বাংলাদেশ-ভূখন্ডে ১৯০১ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি ৯০ লক্ষ।২৭ জন্মহার-মৃত্যুহার, দুটোই ছিল যেন নিয়তির বিধান। গরিবে-বড়লোকে তাতে তফাৎ তেমন ছিল না। জনসংখ্যা যে একটু একটু বাড়েনি, তা নয়। তবে তা খুবই ধীরে। কৃষিভূমি ও জলাভূমির ওপর নির্ভরতা প্রায় একইরকম অবিচল থেকেছে। ভিন্ন কিছু করার বা হওয়ার তাগিদ ভেতর থেকে তৈরি হয়নি। এরই কিছু আগে থেকে রবীন্দ্রনাথ নিবিড়ভাবে দেখতে থাকেন আমাদের গ্রাম-বাংলাকে। তার বাস্তবতার স্থায়ী রূপ তাঁর চোখে চিরকালের মায়া এঁকে দেয়। তাই তিনি যখন লেখেন, অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি-/ ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি’ – তখন তা এমন এক সত্যের প্রকাশ ঘটায়, যা আমাদের চেতনাতেও অক্ষুণ্ণ থেকে যায়। অথচ বাস্তব সেই ঘাটে বাঁধা থাকে না। সরে এসেছে সেখান থেকে কবে। এভাবেই তৈরি হয়, রবীন্দ্রনাথের শেষ মন্ত্রের মতো উচ্চারণে – ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ’, সার্ত্র যাকে বলেছেন ‘bad faith’.

আমরা দেখি ১৯৬১ সালেও এদেশে খামারের গড় আয়তন ছিল ৩.৫ একরের মতো।২৮ এখন তা ১.২৫ একরের কাছাকাছি। তবু খাদ্যচাহিদা মোটামুটি যে মেটাতে পারছি, এ-কথা উপেক্ষা করার নয়। এটা যে সম্ভব হচ্ছে, তার একটা বড় কারণ, কৃষি-প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জনসংখ্যা বাড়ার পরিণামে নিট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। তবু এখন দো-ফসলা, তিন-ফসলা জমি চাষের আওতায় আনায় মোট চাষের জমির পরিমাণ আগের প্রায় দ্বিগুণ, এবং ফসলের পরিমাণ প্রায় চারগুণ। ১৯৬১-তে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ কোটির আশেপাশে। এখন তা ষোলো কোটির কাছাকাছি। তবু সামলাতে পারা যাচ্ছে। উচ্চফলনশীল বীজ, কীটনাশক, প্রধানত ভূগর্ভের জলে সেচ, এগুলোই প্রধান নিয়ামক। এবং দ্বিতীয় আর-একটা বিষয় – এরা জমির আয়তন-নিরপেক্ষ। ফলে জমির আয়তন কমলেও উৎপাদনশীলতায় কোনো প্রভাব পড়ে না। যৌথ খামারের বা সমবায় খামারের ধারণা তাই আগের মতো গুরুত্ব পায় না। এই পরিবর্তন গ্রাম-শহরের ব্যবধান ভেঙে দেয়। কিন্তু গ্রামের স্বপ্নময় ছবিও বিলীন হয়। অবশ্য এ-ও মনে রাখা দরকার, গ্রামের সব ছবিই আগে স্বপ্নময় ছিল না। ‘দুই বিঘা জমি’তেও নয়।

আরো দেখি, শিক্ষার দ্রুততর বিস্তার। তা গ্রামকে এড়িয়ে যায় না। একশ বছর আগে এই বাংলায় সাক্ষরতার হার ছিল শতকরা ১৭-এর মতো। এখন তা শতকরা ৬০-এর কাছাকাছি। প্রাথমিক স্তরে স্কুলে ভর্তির হার শতকরা ১০০-ই। এবং যা আরো দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা হলো, নিচের দিকে মেয়েদের পড়াশোনার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। অথচ ১৯৮১-তেও মোট সাক্ষরতার হার ছিল শতকরা প্রায় চবিবশ।২৯ ‘গরজ বড় বালাই’ – এ-কথাটাই মনে পড়ে। শত চেষ্টাতেও আগে শিক্ষার হার বাড়ানো যায়নি। তার কারণ, পারিবারিক পেশার ওপর নির্ভরতা তখনো মানুষকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিত। এখন আর দেয় না। খোলাবাজারে পেশার প্রতিযোগিতায় নামতে হলে – তা যে বৃত্তিরই হোক – শিক্ষার স্বীকৃত মান ন্যূনতম এক চাহিদা। বেকার ও ছদ্ম-বেকারের সংখ্যা যেখানে ক্রমবর্ধমান – গ্রামেও সেখানে সব পরিবারেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া যতদূর সম্ভব শেখার দিকে ঝোঁক। ব্যক্তির প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭১-এর মত।৩০ কাজেই গোটা জীবন কীভাবে কাটবে, সেটাও শুরুতে ভাবা আবশ্যিক হয়ে পড়ে।

আজ বাংলাদেশে শহরবাসীর সংখ্যা শতকরা ৩৫ থেকে চল্লিশের ভেতরে।৩১ আরো নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, কারণ গ্রামও বহু জায়গায় শহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছে। বিশ্ব-উন্নয়ন-সূচকরাশি থেকে এটাও চোখে পড়ে, শহরবাসীর অনুপাতের সঙ্গে সমৃদ্ধির একটা ইতিবাচক সম্পর্ক অধিকাংশ দেশেই বর্তমান। জনসংখ্যার শতকরা ৭৫-এর কাছাকাছি বা তার বেশি শহরবাসী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও এরকম আরো কটি রাষ্ট্রে।৩২ তাদের কৃষি যে অবহেলিত তা নয়। জনসংখ্যার কৃষিনির্ভরতা ক্রমহ্রাসমান এবং আয়ের উৎস যে শহরের দিকে তাদের ক্রমবর্ধমান হারে টানে, এটিই দেখবার। এমনকি যেসব দেশ কৃষিতে বাড়বাড়ন্ত, সেসব দেশেও – যেমন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ডেনমার্কে। ঐতিহ্য ও সভ্যতার ধরন বাদ দিয়ে এ-কথা বলা অর্থহীন, তা মানি। তবু একটা ছাঁচ যে ফুটে ওঠে, তা অস্বীকার করা যায় না।

এরই সঙ্গে যোগ হয় মুদ্রার সচলতা, সকর্মকতা, কাজ ও শ্রমিকের নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক, শাখা-প্রশাখায় জালের মতো তার এ বহুমুখী বিস্তার, আলাদা-আলাদা গ্রাম-সমাজ বা মন্ডলের আপন-আপন স্বাতন্ত্র্য ভেঙে-পড়া, শুধু প্রত্যক্ষ মুদ্রায় নয়, চেক, ড্রাফট, ইত্যাদিতে স্থাবর-অস্থাবর সবরকম পণ্যের কেনা-বেচা প্রত্যন্ত গ্রামেও অতি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে ওঠা এবং পরিণামে শুধু টাকার বা বিকল্প টাকার সম্পর্কেই অসংখ্য মানবিক সম্পর্কহীনতা একসঙ্গে যুক্ত করে তাদের আপন আপন লক্ষ্যে নির্বিকার পরিচালিত করা। গ্রাম-শহরের ব্যবধান সেখানে নিরর্থক। যদিও মুদ্রার হিসাবই মাধ্যম হওয়ায় তার ওপর নির্ভরতা যত বাড়ে, মানুষে-মানুষে ব্যক্তিগত পরিচয়ের নৈকট্য তত কমে। তবে কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়। জটিলও হয়। তা এড়ানো যায় না। এড়াতে চাইও না। আরো বিষয়-আশয় আয়ত্তে আনার স্বার্থেই তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

আগেই বলেছি, ১৯৬১-র তুলনায় এখন, ২০১৪-য় এসে কৃষি-উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। কিন্তু কৃষির অনুপাত মোট জাতীয় উৎপাদনে শতকরা প্রায় ষাট ভাগ থেকে কমে এখন দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০ ভাগের মত।৩৩ এটা কিন্তু শ্রীবৃদ্ধিরই লক্ষণ। শিল্প উৎপাদন থেকে ১৯৭১-এর আগে পেতাম আমরা শতকরা আট ভাগের মতো। সে-অনুপাত শতকরা ৩০-এ দাঁড়িয়েছি। বাকি শতকরা পঞ্চাশ ভাগের মতো আসছে সেবা খাত থেকে। শিল্প ও সেবা, দুটোরই প্রসার প্রধানত শহরে। অবকাঠামো ও যোগাযোগ, দুটোর জন্যেই তা তুলনার অনুকূল। কুটিরশিল্পের বিস্তার ঘটবে, এ-আশা নতুন করে জাগানো যায় না। তাই সব মিলিয়ে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে আসার ঢলও কমানো যাবে না। এটা দুশ্চিন্তাও বাড়ায়। অতিরিক্ত শহরমুখী জনস্রোত এটা-ওটা ছুটকো কাজে ভিড়ে যায়, আর বস্তিতে, রাস্তার পাশে পড়ে থেকে রাত কাটায়। জীবন বহু মানব-মানবীর জন্য আক্ষরিক অর্থেই ফালতু হয়ে যায়। হতাশা আর বিতৃষ্ণা বেশি বেশি মনকে গ্রাস করতে থাকে।

এখানে একশ বছর আগে জনসংখ্যা ছিল প্রায় তিন কোটির মতো। এখন তা সম্ভবত ষোলো কোটি ছুঁয়েছে। জনগণের জীবনযাত্রার মান আগের চেয়ে নিচে নেমেছে বলা যাবে না। মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতা অনেকগুণ বেড়েছে। বেড়েছে বহুবিচিত্র পণ্যসম্ভার। তাই দিয়ে এই সময়ে বেশ দ্রুতই সামনে এগোচ্ছি। পাঁচ-সাত বছর ধরে টানা উৎপাদন-প্রবৃদ্ধি হার যদি থাকে শতকরা ৬.৫-এর আশেপাশে, আর জনসংখ্যা-বৃদ্ধির হার নেমে আসে শতকরা ১.২-এ, তবে তাকে সফলতার উদাহরণই বলা যায়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয় ক্রমবর্ধমান ষোলো কোটি মানুষের কথা। এখনই তা প্রতি বর্গমাইলে ২৮০০-র ওপর। আরো বাড়লে পরিবেশগত ভারসাম্য যাবে কোথায়? শহরে বহুতল ভবনে গিজগিজ করছে মানুষ। কিন্তু পাশাপাশি বাস করেও কেউ কাউকে চেনে না। চিনতে চায়ও না। অথবা প্রসারমান বস্তি গ্রাস করছে শহরের সুকুমার দৃশ্যপটকে। একটা হিংস্র তাড়া খাওয়া প্রাণীর মতো যেন। সব মিলিয়ে এ সুস্থ মানসিকতার সৃষ্টি করে না। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে দম-দেওয়া কলের পুতুলের মতো। পারস্পরিক সহজ বন্ধুতা হারিয়ে যেতে বসেছে। তার চেয়ে পছন্দের ছবির পর্দায় চোখ রাখা। সংখ্যায় অনেক, কিন্তু সবাই একলা-একলা। কৃষিতে যে উন্নতি হয়েছে, তার কল্পনা রবীন্দ্রনাথও করতে পারতেন না। কিন্তু আর কত? জমির আয়তন তো চাইলেই বাড়ানো যাবে না। অথচ মৌলিক চাহিদা পূরনের প্রধান উৎস সেইটিই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দিয়ে মুশকিল আসানের কথা ভাবা যায়। কিন্তু ফসল ফলাবার ক্ষমতা তো সব জায়গাতেই সম্ভাবনার শেষ সীমার দিকে এগোচ্ছে। আর মোট জনসংখ্যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যেখানে ছিল পৃথিবীতে ২০০ কোটির মতো, এখন তা ৭০০ কোটি ছাড়িয়ে আরো বেড়েই চলেছে। আত্মসন্তুষ্টির কি কোনো জায়গা থাকছে? ম্যালথুসীয় না হয়েও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। শুরু করেছিলাম এই ব-দ্বীপের  ধাত্রী-পালয়িত্রী বৈশিষ্ট্য নিয়ে। ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ – এই কথা অসংশয়ে বলবার অধিকার প্রশ্নাতীত, ধরে নিয়ে। কিন্তু মাটির তলা থেকে বেঁচে থাকার নির্মম তাগিদে জল তুলে-তুলে তার সরসতাকে আমরা শুকিয়ে ফেলছি। যদি একদিন সে কাঠের মতো শুকনো হয়ে যায়, তখন কী হবে? ভবিতব্যের হাতে সব কিছু ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কি আমাদের আর কোনো গতি নেই?

সেবা-খাতের আকর্ষণীয় অগ্রগতি নিয়ে আরো একটু ভাবি। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাবার জিনিস এ নয়। ঘর-সংসারের অসংখ্য প্রয়োজনীয় বা শখের সামগ্রীর ভেতরেও এ নয়। অথচ তাদের কেনাকাটায় এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংযোগ গড়ে ওঠে। তাতে পণ্যরাশির অন্তর্জাত মূল্যে কোনো পরিবর্তন না এলেও তাদের পরিচিতি বাড়ে, কেনাবেচার পরিসর বাড়ে, দূরান্বয়ী সংযোগ বাড়ে। এভাবে মূল্য সংযোজনে জিনিসপত্রের বাজারদামও বাড়ে। সত্যিকারের অর্জন তবে কতটুকু? আমরা আজকাল গ্রামে-গঞ্জেও দেখি এনজিও নামে ময়দানব সোনার হরিণের বেশে গ্রামেগঞ্জেও অবিরাম হাতছানি দিয়ে যায়। শহরে নানা ছুটকো কাজ। গ্রামের বাড়তি মানব-মানবীরা তাদের পেছনে ছোটে। কিছু জুটলে পয়সা মেলে। বেঁচে থাকার সংস্থান একটু-আধটু হয়। আবার তাদের ভেতর থেকেই মাতববর-মাস্তান গজায়। গোটা প্রক্রিয়া কোনো সুনির্দিষ্ট আকার না পেলেও তা চালু থাকে। পাশাপাশি সুসংগঠিত, সুস্বীকৃত কর্মধারাও অবশ্য আছে। যেমন, শিক্ষা, ব্যাংক-ব্যবস্থা – ইত্যাদি। এদের ভালো-মন্দর দিকটা নিয়ে এখানে কিছু বলছি না। শুধু বোঝাতে চাইছি, এসব ক্রিয়াকর্মের ফলে বহু মানুষের কাজ জোটে। কাজ জোটা মানে হাতে টাকা পাওয়া। সেই টাকা আবার ফিরে যায় বাজারেই। কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের পেছনে। অথবা কেনো-না-কোনো ইন্দ্রিয়-সুখের আকর্ষণে। এই চাহিদাসৃষ্টিতে বাজার তেজি হয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। আপেক্ষিকভাবে অনেকে ক্ষতিগ্রস্তও হয়। প্রকৃত দ্রব্য (real goods) উৎপাদনের ভিত, কতটা মজবুত হয় এতে বলা মুশকিল। তবে কর্মক্ষেত্র যে সরগরম হয়, তা অস্বীকার করা যায় না। সেবা-খাতের বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়া তাই একদিকে যেমন আমাদের  দুশ্চিন্তা কমায়, অন্যদিকে তেমনি তা দুশ্চিন্তা বাড়ায়। এটা খেয়াল করবার, বড়-বড় শহরে বস্তির অপ্রতিরোধ্য বিস্তার, ফুটপাত সব হকারদের দখলে চলে যাওয়া এসব সেবা-খাতের ফুলে-ফেঁপে ওঠারই পরিণাম। এবং গ্রামের অসহায়তারও তা পরিচয়।

সব মিলিয়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে শহর-গ্রামের কল্পিত চেহারার সঙ্গে বাস্তবের দূরত্ব কিন্তু ক্রমপ্রসারমাণ। পরিসংখ্যানে কালিক ধারায় (time series) পর্যায়ক্রমিক সামঞ্জস্য আনার (hagadjustment) প্রশ্ন নিয়ে অনেক বিজ্ঞজন মাথা ঘামান। আমাদের গ্রাম-শহরের বৃত্তান্তও বুঝি তার আওতায় চলে আসে।

 

টীকা ও নির্দেশিকা

১. Haroun Er Rashid, An Economic Geography of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1981, p 10-16.

২. বাংলাদেশের নদীপথ স্বাধীনতার আগেও ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। এখন দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার কিলোমিটার। প্রতিবেদন, দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা, ১০ নভেম্বর, ২০১৪।

৩. তীর্থংকর রায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৩, পৃ ৩০।

৪. ওই, পৃ ৩৬।

৫. ওই, পৃ ১১৩।

৬. ওই, পৃ ৪৩।

৭. ওই, পৃ ৬৩।

৮. N. K. Sinha (ed), The History of Bengal (1757-1905), University of Calcutta, 1967,                 p 338.

৯. আমরা পড়ি, ‘…No innovation of the Industrial Revolution has fired the imagination as much as the railway, as witness the fact that it is the only product of nineteenth century industrialization which has been fully absorbed into the imagery of popular and literate poetry. Hardly had they been proved technically feasible and profitable in England (1825-30), before plans to build them were made over most of the western world, though their execution was generally delayed. The first short lines were opened in the USA in 1827, in France in 1828 and 1835, in Germany and Belgium in 1835 and even in Russia by 1837…’ দেখুন,  E. J. Hobsbawm, The Age of Revolution, 1789-1848, ABACUS, London, 1977, p 60। তবে শিল্পবিপ্লব আমাদের এখানে হয় না। উপনিবেশিক শক্তির আগ্রহ তাতে ছিল না, এটা বলাই যথেষ্ট নয়, আমাদের কৃষি সমাজের, একই অর্থে গ্রামীণ, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার কোনো তাগিদ ভেতর থেকে প্রায় কিছুই তৈরি হয় না। অবশ্য বাইরের প্রভাব শহরে ভাবনা-চিন্তার জগতে কিছু আলোড়ন যে তোলে না, তা নয়, তবে তা বর্ণভিত্তিক কর্ম-কাঠামোয় দাগ তেমন কাটে না। পণ্যতালিকায় কিছু পরিবর্তন ঘটে অবশ্য। বিশেষ করে শহরের বাজারে।

১০. Rana Mitter, China’s War with Japan, 1937-1945, the Struggle for Survival, Penguin Books, 2014, p19-20.

১১. কো. আন্তোনোভা, গ্রি. বোনগার্দ-লেভিন, গ্রি. কতোভ্স্কি, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮২, পৃ ৪৫২ (অনুবাদ, দ্বিজেন শর্মা)।

১২. ফরাসি বিপ্লবের কালে গোটা ইউরোপ ছিল প্রবলভাবে গ্রামীণ, যদিও জ্ঞানকান্ডে জাগতিক ধ্যান-ধারণা বদলে যেতে শুরু করেছে প্রায় দুশো বছর আগে থেকে। কোপার্নিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) বৈপ্লবিক আবির্ভাব তো আরো আগে। আমরা দেখি ফরাসি বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের শুরুর সময়ে রাশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও বলকান অঞ্চলে গ্রামবাসীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ থেকে ৯৭ ভাগ, অধিকাংশ ইউরোপীয় রাষ্ট্রেই প্রতি পাঁচজনে অন্তত চারজন ছিল গ্রামবাসী। দেখুন Hobsbawm, পূর্বোক্ত, পৃ ২৩।

১৩. পূর্বোক্ত, পৃ ১৯-৪২।

১৪. W. A. Lewis, ‘Economic Development with Unlimited Supplies of Labour’, in Manchester School, May, 1954. আরো দেখুন, Diana Hunt, Economic Theories of Development, An Analysis of, Competing Paradigms, Hamester Wheatsheaf, UK, 1987, p 86-95.

এখানে উল্লেখ করা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক অমিয়কুমার দাশগুপ্ত ১৯৪৯ সালে বোম্বাই থেকে প্রকাশিত সমীক্ষা ট্রাস্টের Economic Weeklyতে (পরে Economic and Political Weekly নামে পরিবর্তিত) অনুরূপ ব্যাখ্যা খাড়া করেন। তবে ওই Economic Weekly তখনো অর্থনীতি-বিদ্যার স্বীকৃত প্রকাশমাধ্যম না হওয়ায় তা অনেকটাই অগোচরে থেকে যায়।

১৫. Diana Hunt, পূর্বোক্ত, পৃ ১০১-১০২।

১৬. এর পরিণাম পাকিস্তানের জন্যে শুভ হয়নি। রানিস ও ফেই ১৯৬১ সালে যে তত্ত্বাকাঠামো খাড়া করেন, তার পেছনে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও বিপরীতধর্মী উপকরণবিন্যাসের বাস্তবতার বিষয় আদৌ বিবেচিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। তার পরপরই বোলসের কৃষি-বিপ্লবের কলাকৌশল উৎপাদনশীলতাকে অনেকটাই আয়তন-নিরপেক্ষ করে তোলে। বৃহত্তর খামারের পক্ষে রানিস ও ফেইয়ের ওকালতি বহুলাংশে অসার হয়ে পড়ে। এদিকে পাকিস্তানে আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। হাম্পটি-ডাম্পটি আর এক থাকে না।

রানিস ও ফেইয়ের প্রবন্ধ : G. Ranis and G. Fei, ‘A Theory of Economic Development’, American Economic Review, September, 1961.

১৭. G. Myrdal, Economic Theory and the Underdeveloped Countries, Methuen, 1963.

১৮. Jawaharlal Nehru, An Autobiography, London, 1936, p 510.

১৯. ওই, পৃ ৫২।

২০. বিস্তারিত দেখুন, Rana Mitter, পূর্বোক্ত।

২১. ওই, p 5-6.

২২. মার্কসের তাত্ত্বিক আকর গ্রন্থ ক্যাপিটাল ও অ্যাঙ্গেলসের সঙ্গে একত্রে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণিকে বিপ্লবের আহবান, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পাশাপাশি রেখে পড়লেই তফাৎটা ধরা পড়ে।

২৩. Jean Druze and Amartya Sen, Hunger and Public Action, Clarendon Press, Oxford, 1989, p 210-211. তাঁরা জানান, ‘…these figures are extra-ordinarily large. For example, the excess mortality in the last Indian famine, viz. the so-called great Bengal Famine of 1943 (occuring four years before independence), is estimated to be about 3 million. In the scale of ‘extra deaths’ the Chinese famine was, thus, about five to ten times as large as the largest famine in India in this century. (p 210)

২৪. দেখুন, অধ্যাপক দিলীপ কুমার নাথ, ‘চীন সমাজতন্ত্র থেকে পিছু হটেনি’? (প্রশ্নবোধক চিহ্ন বর্তমান লেখকের), দৈনিক সমকাল, ঢাকা, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪। আমাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে ১৯৮৯-তে ছাত্র-প্রতিবাদ ও টিয়েন-আন্-মেন স্কোয়ারকান্ডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এটি কিন্তু আমাদের বক্তব্যকেই আরো জোরালভাবে সমর্থন করে। প্রতিবাদীদের মুক্ত-ভাবনা ও কর্মকান্ডের দাবিকে রাষ্ট্রই আত্মস্থ করে নেয়। শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। কোনো দ্বান্দ্বিক অনিবার্যতার সৃষ্টি হচ্ছে কি না বাইরে থেকে সে-বিষয়ে কিছু জানি না। তবে অধ্যাপক দিলীপ নাথের প্রবন্ধের কিছু তথ্য এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ‘২০১৩ সালে চীনের ২০১৪ জন শীর্ষ ধনীর ১৬০ জন, যাদের সম্মিলিত পারিবারিক নিট সম্পদ ২২১ বিলিয়ন ডলার, তাঁরা ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস/ CPPCC-এর সদস্য ছিলেন।… চীনের ২০১৩ সালের মোট রপ্তানির ১১% রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছে, ৪৭% বৈদেশিক মালিকানা খাত থেকে ও ৩৯% দেশীয় ব্যক্তিগত খাত থেকে হয়েছে।’

২৫. The World Bank, World Development Report, 1990, World Bank, Table 31, p 238.

২৬. গ্রামেই আমাদের ক্ষেত-খামার। শহরে তাদের সম্প্রসারণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। শহরে বহুতল বাড়িতে সবজি চাষেরও কোনো সুযোগ থাকছে না। ফুলবাগানও হারিয়ে যেতে বসেছে।

২৭. Bangladesh Bureau of Statistics, Statistical Pocket Book, 2000, Dhaka p145.

২৮. Statistical Year Book, 1962, Dhaka.

২৯. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যাবলি।

৩০. ওই।

৩১. বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০১২-১৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ অর্থবছরে বাংলাদেশে শহরবাসীর অনুপাত মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩৯ শতাংশ।

৩২. The World Bank, World Development Indicators, 2008, World Bank.

৩৩. বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০১২-১৩ প্রতিবেদন থেকে জানি, জাতীয় উৎপাদনে ২০১১-তে কৃষির অবদান ছিল শতকরা ২০ ভাগ। ২০১৩-এ তা প্রত্যাশিত ছিল শতকরা ১৮.৭ ভাগ। অন্যদিকে শিল্পখাতের অনুরূপ অনুপাত ২০১১-এ ছিল শতকরা ৩০.৪ ভাগ, যার ২০১৩-এ প্রত্যাশিত মান শতকরা ৩২ ভাগ। সেবাখাত  ২০১১-এ জাতীয় উৎপাদনের ৪৯.৬ শতাংশ, ২০১৩-তেও তা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল বলে অনুমান।