ঘন বর্ণবুনটের চিত্রপটে

জাহিদ মুস্তাফাJahid-Mustofa

নিয়ামুল বারী একজন শিল্পী ও ভাস্কর। চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী এখন বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের ব্রুকলিনে। ‘ক্ষণিকের ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে তাঁর একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে গেল ঢাকায় বেঙ্গল শিল্পালয়ে। ১২ আগস্ট ২০১৪ শুরু হয়ে এটি চলেছে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত। প্রদর্শনীতে চিত্রকর্মের সংখ্যা ৮২টি। এর অধিকাংশ কাজ ছোট-ছোট ক্যানভাসে অাঁকা, বেশকিছু কাজ চারকোলে ড্রইংকেন্দ্রিক। বাকিগুলো মিশ্রমাধ্যমের পেইন্টিং।

চিত্রকর্মগুলো শিরোনামহীন। শিল্পীর নিজের উপলব্ধি যা-ই থাকুক, তিনি দর্শকদের  চিন্তার খোরাক জুগিয়ে তাঁদের স্বাধীনভাবে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছেন। নিজের চিত্রকর্ম সৃজনের কৌশলকে তাঁর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ করতে  সচেষ্ট শিল্পী উপকরণ নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন।

নিয়ামুল বারীর জন্ম ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ থেকে দুবছরের প্রাক-ডিগ্রি করে ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে মৃৎশিল্পে স্নাতক করে স্নাতকোত্তর করেন ভাস্কর্যে। এরপর ভারতের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে উচ্চতর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের আর্ট স্টুডেন্টস লিগেও অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। বাংলাদেশ, ভারত, জাপান, নেপাল, ভুটান ও যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রদর্শনী হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নকালে একজন অনুজ শিল্পশিক্ষার্থী হিসেবে নিয়ামুলকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। শিল্পবিদ্যা শিক্ষায় তিনি সচেষ্ট একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। মৃৎশিল্পে শিক্ষা নিয়ে তাতে তিনি যুক্ত করতে চেয়েছেন ভাস্কর্যের গুণ। এখান থেকেই ভাস্কর হিসেবে তাঁর উত্তরণ ঘটার সুযোগ আসে। চারুকলায় তিনি স্নাতকোত্তর করেন ভাস্কর্যে। সে-সময়ে দেখেছি, খুব নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি অজস্র ড্রইং করছেন, আউটডোরে যাচ্ছেন। দিনের পর দিন ড্রইং করেছেন গাবতলী গিয়ে। নিজেকে নির্মাণ করার আরেকটা বড় সুযোগ তাঁর বিশ্বভারতীতে শিল্পবিদ্যা অর্জনের বৃত্তিলাভ। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ, ভূপ্রকৃতি ও মানুষ তাঁকে আলোড়িত করেছে। অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র দেখার মুগ্ধতা অঙ্কন খাতায় তুলে ধরার ইচ্ছায় তিনি অন্ধকারে কাগজে চালিয়েছেন পেনসিল কিংবা চারকোল। শিল্পের রহস্যময়তায় একধরনের অবগাহন হয়েছে তাঁর।

শিল্পী শহিদ কবীরের ভাষ্য অনুযায়ী বারী হচ্ছেন নীরব অভিব্যক্তিবাদী। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে পা ফেলেছেন তিনি। পায়ে-হাঁটা মেঠোপথের রেখা, মানুষ ও যানবাহনের ঘরে ফেরার ছাপ তাঁর চিত্রকর্মে। শ্যাওলা সবুজ আর পুরনো হলদে রং ও রেখা, সাঁওতালদের মাটির দেয়ালে রং, চুনের দাগ, মুছে-যাওয়া সিঁদুরের রং এসব তাঁর চিত্রে ভেসে উঠেছে।

নিয়ামুল বারীর চিত্রকর্মগুলো ভারি বর্ণে রঞ্জিত, নানা বস্ত্ত, ফেলে দেওয়া টুকরো-টাকরা, শাড়ির পাড় প্রভৃতি নানাকিছু দিয়ে যুক্ত করা। সবমিলিয়ে একধরনের  ভাস্কর্যগুণ আরোপ হয়েছে চিত্রপটে। ফলে চিত্র হয়েও সেগুলো নির্মাণের মাত্রা পেয়েছে। রঙের সঙ্গে মিলিয়েছেন পাথরকুঁচি, বালি, তুষ, পিগমেন্ট ও আঠা। ভারি আস্তরণে দাগ কেটেছেন তুলির বদলে স্পেচুলা কিংবা সিরামিক্স টুলস দিয়ে। কিছু সারফেস মডেলিংও করেছেন মৃৎশিল্পীর কায়দায়। সব মিলিয়ে বারীর কাজ ভারি, কাদামাটির সোঁদাগন্ধময় বালুকাবেলার সম্পদ-শৈলীময় এবং কখনো কখনো পাথুরে কাঠিন্য আর গড়নে সুদৃঢ়। গভীর গাঢ়রঙের ভেতরে সময়ের অাঁচড়, স্মৃতিচিহ্ন বিধৃত হয়েছে কোথাও। মনে হয়, শিল্পী তাঁর ফেলে আসা জীবনের নানা অঙ্কন, দেয়ালের দাগ, বৃষ্টিপাত, শ্যাওলার সবুজ, তাঁর শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, মানব-জীবনের নানা অভিজ্ঞতার অভিযাত্রাকে তুলে এনেছেন চিত্রপটের ভেতরে-বাইরে।

সমকালে শিল্পের আধুনিকতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে শিল্পব্যাখ্যায় বিস্তৃত সব                কারণ-করণ দর্শকচোখকে বিস্মিত করে, বিমুগ্ধ করে। কিছু প্রশ্নও যে উত্থাপিত হয় না, এমন নয়। শিল্পীর ক্রাফটসম্যানশিপ দক্ষতার প্রয়োগ এখন আরো বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। সৃজন-সাধনার ধ্যানের মধ্যে কেউ মগ্ন থাকেন, কেউবা আবার সেই সৃজনের বহুবিধ মাত্রা নির্মাণ করেন। নিয়ামুল বারীর কাজ দেখে মনে হয়েছে, তিনি এ দুটির মধ্যে নিজের ভাবনা ও কর্মকে সমন্বিত করেছেন। তাঁর চিত্রপটের তল নানা উপকরণসমৃদ্ধ ও টেক্সচারে ভরপুর। কর্মের গুরুত্বও কম নয়। সব মিলিয়ে শিল্পীর মনন আর কৌশলের খেলায় সৃষ্টি করেছেন বিস্ময়কর এক জগৎ।

মূর্তকে বিমূর্ততার পথে আবিষ্কারের চেষ্টা শিল্পীর। ভারি বর্ণের বুনটের সঙ্গে তাৎক্ষণিকের মেলবন্ধন ঘটিয়ে শিল্পী এগিয়ে গেছেন – কাজ করেছেন অনেক সময় ধরে। পুরনো বনেদি ভাবধারায় দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তি আছে তাঁর চিত্রপটে। সিরামিক্স ও ভাস্কর্যের শিক্ষায় শিল্পী যে ত্রিমাত্রিকতার স্বাদ পেয়েছেন তাকে তিনি তুলে ধরেছেন ক্যানভাসে। এখানে মূর্ত-বিমূর্ততার মতো দ্বিমাত্রিকতার সঙ্গে ত্রিমাত্রিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে। মাটিলেপনের মতো ক্যানভাসে রঙের লেপনের মধ্যে নানা বস্ত্তর সংযোগ, নানা উপাদানের ইঙ্গিত যেন শিল্পীর তৃষ্ণা নিবারণের প্রচেষ্টা। চিত্রপটে উপাদান হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে নকশিকাঁথা, জামদানি শাড়ি, নকশাকরা কাপড়ের পাড়, জামার অংশ, নানারকম কাঠ কিংবা লোহার টুকরা। ভারি রঙের বুনোটের পরতে পরতে তৈরি গভীরতায় যখন জামদানি শাড়ির পাড় কিংবা চেনা-অচেনা অন্য কোনো উপাদান দর্শক আবিষ্কার করেন; তখন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মিলনে তিনি মোহিত হন। কাজের এই ধরন তৈরি হয়েছে শিল্পীর নানা মাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ও নানা জায়গা এবং সময়ের ভ্রমণে। তাঁর শিল্পচর্চার অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আবদুর রাজ্জাক, মার্ক রথকো, আন্তোনিও তাপিজ, জ্যাকসন পোলক, জিয়াকোমিতি, হেনরি মুর প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী ও ভাস্কর।

নিয়ামুলের ছবির যেমন শিরোনাম নেই, তেমনি তাঁর কাজের সামনের দিকে শিল্পীর স্বাক্ষরও দেওয়া নেই। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন বলে তাঁর চিত্রকর্মের পেছনে থাকে তাঁর কাজের তারিখ ও স্বাক্ষর। নিরীক্ষা প্রবণতায় এতটাই মগ্ন যে, শিল্পীর স্বাক্ষরটাও তিনি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। মাধ্যম তাঁর প্রচলিত। এর মধ্য থেকেই নতুন নতুন মাধ্যমে তাঁর আকর্ষণ নতুন কিছু সৃজনের সম্ভাবনা উসকে দিয়েছে।

‘ক্ষণিকের ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক এ-প্রদর্শনীতে বেশকিছু ফিগার ড্রইং করেছেন শিল্পী। এগুলো মূলত তাঁর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ও অনুশীলনধর্মী দুই ধরনের। এগুলো অনেকটাই অভিব্যক্তিবাদী। অনুশীলনের অভিজ্ঞতায় ড্রইংগুলো হৃদয়গ্রাহী ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে।

নিয়ামুল যে পরিভ্রমণে আছেন তার গভীরতার সীমা-পরিসীমা অনেক বিস্তৃত। সে-পথেই তিনি এগোচ্ছেন। তাঁর  সবলতা সফলতা বয়ে আনুক এই শুভ কামনা জানাই।