মণীশ রায়

এরকম হয়।
হঠাৎ কোনো একটা পূর্বপরিচিত জায়গা খুব আপন হয়ে ওঠে। রোগশয্যায় শুয়ে কারো কারো যেমন প্রিয় একটা খাবার খাওয়ার জন্যে মন অহেতুক আইঢাই করতে থাকে, আলতাফের বেলাতেও তাই ঘটল। নইলে সব ফেলে সে এখানে কেন এসে দাঁড়াবে?
অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে থিতু হওয়া সফল ডাক্তার সে। কালেভদ্রে অতিথিপাখি হয়ে এদেশে আসে। গুরুত্বপূর্ণ
এক-দুটো ডাক্তারি সংক্রান্ত বক্তৃতা ঝেড়েই আবার ব্রিসবেনে নিজের পুত্রকন্যাদের কাছে ফিরে যায়। মোটে এক-দুদিনের সফর; নিরিবিলি আসে; শেরাটনে এক-দুই রাত কাটিয়ে নিরিবিলিতেই আবার কেটে পড়ে। নিজের জন্মভিটে কুমিল্লার দিকেও পা বাড়ায় না। অবশ্য, এখন কেউ আর নেই সেখানে; তবু তো জন্মশহর। ঘনিষ্ঠ সব আত্মীয়-পরিজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শহরজুড়ে। তবু মন চায় না। আর এ তো ফুপির শ্বশুরবাড়ি। কবে ফেলে গেছে স্মৃতির সব পরগাছা এখানে। মনেও পড়ে না। তবু জবরদস্তি চলছে মনের ওপর, ঘুরেফিরে কেবলি মনে হচ্ছে, এখানে না এলে বুঝি সব বৃথা। সুখের অসুখ ছাড়া এ আর কী!
আলতাফের কাছে সুখ জিনিসটাই অদ্ভুত ঠেকে; অশান্ত বায়ুর মতন চারপাশে কেবল নিশ্বাস ফেলে চলেছে। এ মুঠো থেকে অন্য মুঠোয়, এক আকাশ ছেড়ে অন্য আকাশে কেবল ছোটাছুটি করে বেড়ানো। যখন নিজের ঘাড়ে এসে পাখনা নাড়ে, তখন সব মধুময়; উড়ে গেলেই দীর্ঘশ্বাস; ফের মন আঁকুপাঁকু করে। কখন আসবে, কখন বসে পাখনায় ফরফর শব্দ তুলবে – তা ভাবতে ভাবতেই প্রৌঢ় হয়ে পড়ল বেচারা আলতাফ। তবু বাসনাকাতর মানুষটা ক্ষণে ক্ষণে বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে, কোথায় পাবো তারে, কোথায় পাবো তারে?
এরকম করে খুঁজতে গিয়েই মনে পড়ল এখানকার কথা, ফসিল হয়ে পড়েছিল অন্তরমহলে। হয়তো প্রাত্যহিক নানা ব্যসত্মতা আর উচাটন এসব সুখময় অতীতের চোখ বন্ধ করে রেখেছে দীর্ঘদিন, খেয়ালই করেনি সে। এখন হঠাৎ কোত্থেকে এসে ওর সবটুকু গ্রাস করে নিয়ে বলছে, এ-জায়গাটাই নাকি ওর সব। এখানে একবার না এলে নাকি সব বিস্বাদ, সব তেতো।
ব্রিসবেন নদীর ধার ধরে হেঁটে-বেড়ানো কিংবা কোনো রেইন ফরেস্টের ভেতর বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘোরাঘুরি করা তো ওর নিত্য অভ্যাস। হঠাৎ একদিন টের পেল, মাটি ফুঁড়ে প্রস্ফুটিত বীজের মতন কিছু একটা উঁকি মেরে আকাশ দেখতে চাইছে এই প্রৌঢ়ের ভেতরে। তখনই আচমকা মনে পড়ে গেল, গভীর জলা-জঙ্গলে ভরা উস্কোখুস্কো অপরিচ্ছন্ন হতদরিদ্র পাগলের মতন দেখতে একটা খাল পড়ে রয়েছে ওর কৈশোরে, যাকে এখনো চাইলে ধরা যায়, একটুখানি ছোঁয়া যায় কিংবা খানিকটা বুঁদ হওয়া যায় কোনো এক আবেশে।
ব্রিসবেন ওর নয়; চোখ ধাঁধায় এর সুসজ্জিত রূপে ঠিকই; মোহগ্রসত্ম হওয়া যায় যখন-তখন। কিন্তু মন কিছুতেই মগ্ন হতে চায় না। বরং কৈশোরের পেলব ছোঁয়া-মাখানো ওই হাজামজা খালটাকেই ওর নিজের বলে মনে হচ্ছে, এখনো।
খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে শহরটার বুক চিরে বয়ে যাওয়া সেই খালটাকে একবার স্পর্শ করে আসার। এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, সে এখন খালটার পাড়েই দাঁড়ানো। বেমানান বেওয়াকুফের মতো আলতাফ তাকিয়ে রয়েছে মায়াবী কিশোরবেলার দিকে। চোখের ভুরুপলস্নবে সূর্যাসেত্মর ছায়া। মন অস্থির, উন্মনা, তৃষ্ণার্ত; মগজে কৈশোরের ঘোরলাগা চুনি-পান্নাময় আকাশ।
আগের মতো ওর তেমন চেনাজানা কেউ নেই আর এ-শহরে। ফুপি মারা যাওয়ার পর বাড়িঘর বিক্রি করে ফুপা ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে থাকতে শুরু করেন। ক-বছর হলো তিনিও গত। বছরচারেক আগে নিঃসন্তান মানুষটি মরে পড়ে ছিলেন নিজ ঘরে। উৎকট গন্ধে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন থাকতে না পেরে দরজা ভেঙে সেই লাশ বের করে দাফনের ব্যবস্থা করে। আপন বলতে কেউ ছিল না পাশে। পরে এক ভাতিজা এ-শহর থেকে ঢাকায় গিয়ে ঘটা করে কুলখানির আয়োজন করে এবং বিনাযুদ্ধে ফ্ল্যাটটি দখল করে নেয়। এখন কী অবস্থা – তা ওর জানা নেই।
এ-শহরটাও আলতাফের নয়; ওর একমাত্র নিঃসন্তান ফুপুর শ্বশুরবাড়ি মাত্র; ছুটিছাটায় বেড়াতে আসত এখানে। এই
আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়েই যত আলাপ-পরিচয়। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর সে আবার পা রাখল এখানে। ঢাকার শেরাটন হোটেলে
চেক-ইন করে দেরি করেনি, ছুটে এসেছে খালপাড়ে। কারণ, এখানেই নমিতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওর। শুধু একদিনের পরিচয় মানুষকে অত টাটায়? আশ্চর্য! বুঝতে পারেনি এতদিন।
শহরটার হৃদয় ফুঁড়ে সুতোর মতন একচিলতে যে বহতা খাল, সেটা আসলে নমিতারই মন। সারাবছর এ-খালটা জলহীন শূন্য উদ্যানের মতন কংকালসার-হাড্ডিসার উদোম হয়ে পড়ে থাকে। শুধু বোরোধানের ফলনের সময় শুকনো খটখটে খালটা অন্যরকম এক সাজে ধরা দেয়। সে আরেক রূপ – প্রথমে কচি ধানের গাঢ় সবুজ কিশোরী রোয়া এবং পরে লাজুক নববধূর মতো আনত পাকা সোনালি ধানের শীর্ষে সূর্যোদয় ও সূর্যাসেত্মর আলোর নাচন – সব ভুলিয়ে দেয় এক নিমিষে। আলতাফ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেদিকে তাকিয়ে সময় কাটিয়েছে, এখনো স্পষ্ট সব মনে পড়ে।
বর্ষার সময় খালটার আবার অন্যরূপ। এর ঘোলাজলে আশেপাশের ছেলে-ছোকরাদের ডুবুরি খেলোয়াড়ের মতো অবিরাম লাফালাফি-দাপাদাপি চলে। পাড়ঘেঁষা আম আর নারকেল গাছে চড়ে ভাসমান কচুরিপানায় ঢাকা গেরুয়া জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আকছার দৃশ্য। সাঁতরে এপার-ওপার করা, ভেলায় চড়ে উজানে ভেসে যাওয়া আর গামছা দিয়ে মাছ ধরার নিত্যনতুন কৌশল তো এখানকার বন্ধুদের কাছেই সে শিখে নিয়েছিল। মা-বাবার কাছে বসে থাকলে ওর কি এসব অভিজ্ঞতা হতো কোনোদিন? কুমিল্লা বললেই ওর কাছে জেলখানা। একটা প্যারাসিটামলে হাত দিতে গেলেও দারোগা বাবার অনুমোদন লাগে। কোনো হুলস্থূল উলটাপালটা নেই জীবনে। পড়ো, খাও আর ঘরে বসে থাকো। বলতে গেলে ওর পুরো কৈশোরটাই পোড়োবাড়ির মতন বৃথা হয়ে যেত, যদি না একমাত্র ফুফুর বাড়িটা মরুভূমির ওয়েসিসের মতন মাঝে মাঝে ধরা দিত।
এতোদিন জায়গাটার কথা ভুলেই বসেছিল আলতাফ। সহসা ক-বছর ধরে গুম হওয়া আত্মীয়ের মতন চোখের সামনে এসে উপস্থিত; কদিন থেকেই অন্তরে খুব টান পড়ছিল জায়গাটার জন্যে। ব্রিসবেন নদীর তীরে কিংবা গোল্ড-কোস্টের রুপালি বালুকাবেলায় হাজারবার চক্কর কেটেও শামিত্ম মিলছে না তখন। বারবার করে সেই বাঁকানো নারকেলগাছটার কথা মনে পড়ছে, যেখান থেকে সে জীবনে প্রথম লাফ দিয়েছিল খালটার ঘোলা মৌসুমি জলে। ওই গাছটা সে কোথাও আর খুঁজে পাচ্ছে না। জীবনের প্রথম রক্ত হিম করা অ্যাডভেঞ্চার আর সেই মেয়েটা, কী যেন নাম, হ্যাঁ, নমিতা, আলতাফ ভোলেনি। ভুলতেই পারছে না।
আলতাফের ধারণা, নমিতারও ওর মতোই আশির গোড়ায় জন্ম। নববইয়ের দশকে এসে বেশ হৃষ্টপুষ্ট। লম্বা-ঢ্যাঙা গড়ন। সকাল নেই, দুপুর নেই – একটা ময়লা রংচটা কামিজ আর সাদা পাজামা পরে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো – এই তো কাজ। একটা দুমড়ানো-মোচড়ানো ওড়না আছে বটে, সেটি গলাতেই প্যাঁচানো থাকে সারাক্ষণ, সাপের মতন।
পঞ্চানন্দ ছিল উত্তরপাড়ার মাতববর কিসিমের এক পুরুষ, ইস্টিশনে চায়ের দোকানে চা বানাত। সে এখন ইলিয়াস, নও-মুসলিম। সারাক্ষণ ওকে মসজিদের আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায়। কদিন যেতে না যেতেই চায়ের দোকানে নয়, নিজেই একখানা টি-স্টল দিয়েছে ইস্টিশনের কাছে।
নমিতাদের পাড়ার লোক ইলিয়াস ওরফে পঞ্চানন্দ গুরুগম্ভীর এক পুরুষ। চোখের দৃষ্টি তীব্র; কামেল পুরুষের দৃষ্টি নাকি এরকমই হয় – বয়স্ক নারীর দল মুখে মুখে তাই বলে বেড়ায় ওর সম্পর্কে।
সে-ই ওকে ডেকে একদিন বলেছিল, ‘ওড়না গলায় বানছিস কে রে ? তুই নডি নাহি?’
নমিতা ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়েছিল সেখান থেকে। তারপর যখনই ওকে দূর থেকে দেখেছে, সে লুকিয়ে ফেলেছে নিজেকে। ভয়ে থরথর করে কেঁপেছে ওর নাজুক শরীর।
এসব কথা আলতাফ ঠোঁটপাতলা ছিদামের কাছ থেকে জেনেছে। এতো বছর পর এখানে দাঁড়িয়ে বাল্যশিক্ষা-ধারাপাতের মতন সেসব কথা ঠিকই মনে পড়ছে।
সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে খুব একটা বনিবনা ছিল না নমিতার, প্রায়ই তুমুল ঝগড়া বাধে। সে বরং যাদের নিয়ে সচরাচর কুতকুত-বউচি খেলে আর সারাদিন হইচই করে বেড়ায় – এরা সবাই পোলাপান। সাও আটির ছিদাম, বাইন্যাপাড়ার হিরণ, মালি আটির আক্কাস আর ফকির আটির নিরঞ্জন – সবাই ওর খেলাবন্ধু।
এই দুই-চার আটির যত চুরিচামারি সব ওরই নেতৃত্বে হয়। জাম্বুরা, লেবু, করমচা, আম, জাম, ডাব – সব সাফাইয়ের সঙ্গে জড়িত নমিতার দল। মাঝে মাঝে খালপাড়ে চলে এদের এলাহি রান্নাবাড়া খেলা। খালের মাছ, জমির লাউ, মুলা, ধনেপাতা আর নিজেদের বাড়িঘর থেকে চুরি করে আনা তেল-মশলা-চাল। এগুলো জোগাড় করে ছেলেরা। শুধু হাঁড়ি-পাতিল আর রান্না করার দায়িত্ব নমিতার ঘাড়ে।
নমিতা দেখতে এমনিতেই ঢ্যাঙা। তার ওপর সেদিন মায়ের ফেলে দেয়া একটা শতচ্ছিন্ন শাড়ি গায়ে জড়ায় – তাতে ওকে মুলিবাঁশের মতন লাগে। কিন্তু ওর কিছু যায়-আসে না তাতে। সে নিজেকে সংসারের চিরায়ত মায়ের সাজে সাজিয়ে নিবিষ্টমনে সবার ওপর মাতববরি করতেই ব্যসত্ম। হাতমুখ নাড়িয়ে মুখঝামটা দিয়ে ছেলেদের খাটিয়ে মারে শুরু থেকে শেষ অবধি। যেন একটা বিয়েবাড়ির সবকিছু সামাল দিচ্ছে এই পুঁচকে মেয়েটা। একটা রইরই কা- নির্জন খালপাড়জুড়ে। ছেলেগুলোও অভিভাবকত্বের অভিনব স্বাদ পেয়ে অস্থির আনন্দে মাতোয়ারা সেদিন।
মাঝে মাঝে খাল দিয়ে নৌকায় করে সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে চলে যায় নতুন জামাই। ছইয়ের মাথায় বাঁধা আছে চোঙ মাইক; সেখান থেকে চারপাশ কাঁপিয়ে গানের কলি খালপাড়ের নির্জনতাকে খানখান করে দেয়। ‘যদি বউ সাজো গো, আরো সুন্দর লাগবে গো’র কলি কানে ভেসে আসতেই নমিতার নেতৃত্বে সবাই আনন্দে চিল্লাতে শুরু করে দেয়। যেন বিয়েটা ওদের খালপাড়ের আঙিনাতেই জমে উঠেছে।
কমবয়সী মাকুন্দা জামাই নৌকার ছইয়ে হেলান দিয়ে ওদের দেখে; এমনভাবে তাকায় যেন সে এই প্রথম শিশুদের লাফাতে দেখল খালপাড়ে। ছইয়ের ভেতরে বসে লাল ঘোমটার আড়াল থেকে বউর দৃষ্টি এদের অনুসরণ করে। জামাইয়ের মতন নবপরিণীতার দৃষ্টিতেও বিস্ময়, অন্তরে বোকা প্রশ্ন, এরা এত নাচানাচি করছে কেন? মাইকে তখনো বাজছে, ‘যদি বউ সাজো গো, আরো সুন্দর লাগবে গো।’
নমিতার বয়স এগারো-বারো হলেও ছইয়ের ফাঁকে লতানো বুনো ফুলের মতন ঝুলে থাকা নতুন বউয়ের মুখখানা সবার আগে ওরই চোখে ধরা দেয়। এক নিমিষে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ভুল করে না সে। কখনো ভালো লাগে, কখনো মন্দ – নিজের চেয়ে কিছুতেই বেশি সুন্দরী মনে হয় না কাউকে।
মালি আটির একপাশে বরইগাছওলা বাড়িটা ওদের। একফালি উঠোনের বুনো ঝোপের মতন ওর বেড়ে ওঠা। মা-বাবা দুজনই মুনিষ খাটে পরের বাড়ি; ফেরে রাতের বেলায়। সে একা একটা মেয়ে লেখাপড়াহীন অদ্ভুত এক স্বাধীনতা নিয়ে ঝোপঝাড়ের মতন বেড়ে উঠছে এই তরজার ঘরে। কীভাবে বাড়ছে নমিতা – তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই যেন। পোষা হাঁসের মতন সকালে বের হয়ে ফেরত আসে সন্ধ্যায়। হাঁসকে তবু আদর করে ‘আয় আয় তই তই’ বলে ডাকতে হয় সাঁঝবেলায়, নমিতাকে তাও বলা লাগে না। সে নিজে নিজেই ডেরায় ফিরে এসে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ে। মা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেও বাবার ফিরতে রাত হয়ে যায়। গভীর রাতে কলাগাছের বাকল থেকে তৈরি করা মাদুরের ওপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ক্লান্ত-শ্রান্ত নমিতাকে মা-ই প্রথম ডেকে ওঠে, ‘তর বাপ ফিরছে। খাইয়া নে কডা ভাত।’
সকালে পান্তা আর আগের রাতের তরকারি কিছু থাকলে তা দিয়ে নমিতার ক্ষুধা মেটে। তারপর মা-বাবা দুজনই উধাও। তখন নমিতার হাতে কোনো কাজ থাকে না। সে স্কুলে যায় না, বছর-দুই চেষ্টা করেও গোবরে কোনো পদ্ম ফোটেনি। হাতে অফুরন্ত সময়। কী আর করবে, পাখির মতন, বেহাল বেহায়া বারোয়ারি বেড়াল ছানার মতন এখান থেকে ওখানে, পাড়া থেকে বেপাড়ায় কেবল ঘুরে বেড়ানো; একা নয়, সঙ্গে থাকে দুষ্টু ছেলেগুলো।
আলতাফ এদের ভেতর কখন যে ঢুকে পড়ল, আজ আর
মনে নেই। হ্যাঁ, মনে পড়ছে; সাও পাড়ার বিশাল ছাতিওলা বেঁটে-খাটো কাতলা মাছের মতন দেখতে ছিদাম ওকে নিয়ে এসেছিল খালপাড়ে। সে ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নমিতার গ্যাং নিয়ে যা কিছু সে শুনেছে, সব ওর মুখ থেকে। শুনে শুনে এক মজাদার কৌতূহল তৈরি হয় এদের ঘিরে।
প্রায়ই ইচ্ছে হয় ছিদামের সঙ্গে এখানে আসার; কিন্তু
ফুপা-ফুপির কড়া অনুশাসন আসতে দেয় না ওকে। প্রতিবারই ভেসেত্ম যায় আলতাফ আর ছিদামের পরিকল্পনা। এবার সে নানা ফন্দি করে সবার চোখে ধুলো দিয়ে ছিদামের সঙ্গে এখানে পৌঁছে গেছে। আর ঠিক সেদিনই বসেছিল ওদের জমজমাট রান্নাবাড়া খেলার মজাদার আসর। কে পোলাপানের বাপ হয়ে নমিতার সঙ্গে শুতে যাবে, এই নিয়ে কামড়াকামড়ি, মান-অভিমান চলছে সবার মাঝে।
নমিতার ইচ্ছে নয় পুরনো কাউকে ফের বাপ বানানোর। এই নিয়ে ঝগড়া। যাকে পছন্দ নয়, তার দিকে পেছন ফিরে দপদপ করে পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অভ্যাস ওর। পা তুলে যতবার পেছনের বন্ধুকে দেখায় ততবার মুখে বলে, ‘ব্যাঙ্গাইলে ব্যাঙ্গা, মড়া ছাগলের রক্ত খা।’ নমিতা ধরেই নেয় পেছনের মানুষটি ওকে ভেংচি কাটছে।
এসময় নমিতাকে একটা ডাসা পেয়ারা কিংবা একটা আতাফল দিলেই ওর সব রাগ-ক্ষক্ষাভ-অভিমান একেবারে জল। সঙ্গে সঙ্গে ভোল পালটে মিষ্টি হেসে মুখে বলবে, ‘তুই আসলে খুব ভালা পুলা। তরে আমি ভালোবাসি।’ বলে নমিতা সারামুখে থুথু ছড়িয়ে বিকট এক চুমু খাবে ওকে।
ক্লাস ফোর-ফাইভের পড়ুয়া পাড়া-বালকদের এসব বোঝার কথা নয়। বেপরোয়া আগ্রাসী এরকম চুমুর দাপটে দমবন্ধ হয়ে আসত ওদের। থুথু-মেশানো চুমুয় বিরক্ত হতো অনেকেই। তবু সবার ভেতর নমিতার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা যেন কাজ করত। একটা নীরব প্রতিযোগিতার ঘূর্ণিতে পড়ে সবাই হয়ে যায় প্রজা আর নমিতা কীভাবে যেন ওদের রানি বনে যায়। কী ক্ষমতায়, কী মমতায়, কী অপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্যে!
ওর খেলাবন্ধুদের ভেতর মালি আটির আক্কাস এসব বিষয়ে ইঁচড়েপাকা। সে স্কুলে যায় সত্যি; কিন্তু পড়ে না। নিত্যদিন
বাপ-মায়ের মার খেতে অভ্যসত্ম। নমিতার কাছে এলেই বড় ইচ্ছে হয়, ওকে জড়িয়ে ধরতে। সে ছুকছুক করতে থাকে ওর চারপাশে। কিন্তু নমিতা ওকে কাছে টানে না। প্রায়ই সে ঝুঁকে পড়ে সাঁও আটির ছিদামের দিকে। বেঁটেখাটো ছাতিওলা রূপবান কিশোর সে।
চোখদুটো ঢলঢল; চেহারায় মায়া ও বুনোভাব দুটোই রয়েছে মিলেমিশে । বাপের টাকা-পয়সা আছে। কিছু হলেই সবার সামনে সে ছিদামকে জড়িয়ে ধরবে। থুথু ভরা চুমু খাবে সবাইকে দেখিয়ে। তাতেই তাতিয়ে ওঠে আক্কাসের মন। একদিন খালপাড়ে নমিতাকে একলা পেয়ে আক্কাস বলে ওঠে, ‘ল, আমরা বিয়া কইরা ফেলাই।’
‘ল। কিন্তুক তুই করবে কিতা?’ বিয়ের ব্যাপারে নমিতার অসম্মতি নেই। পারলে প্রতিদিনই সে একটা করে বিয়ে করে। তবে সবাইকে নয়। যখন যার প্রতি ওর অনুরাগ উসকে ওঠে, যে ওকে বেশি করে এটা-ওটা খেতে দিতে পারে, নমিতা তাকেই এক লহমায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। কোনোরূপ ছুকছুকানি নেই। মুখে বলবে, ‘বিয়া করবি, কর? কিন্তুক করবি কিতা?’
‘কেরে, তর বাফের লাহান মাইনষের বাড়িত মুনিষ খাটুম। অইত না?’
‘ধুর। আমার বাফের চেত জানছ? লাডিদা বাইড়াইয়া তর হাড্ডি-গুড্ডি চুর-মুচুর কইরা ফেলাইব।’
‘তাইলে উপায়?’
‘আমারে কদিন খাওয়া। হেরফর কমুনে, তরে বিয়া করুম নাকি করতাম না।’
আক্কাসের বাপ রাজ-ওস্তাগর। বাড়ি তিতাসপাড়ে নয়, রংপুরে। সাত-আটখানা বাচ্চাকাচ্চা। এর ভেতর আক্কাস চার নম্বর। বাপের প্রতি ডর বেশি। মাইর শুরু হলে হাতে-পায়ের ব্যথা শরীরে আটকে থাকে মোট চারদিন। তখন চোখের সামনে থেকে নমিতা-ফমিতা সব উধাও। তবু সে-ও সুযোগ পেলে চিটা রুটি আর মুরগির মাংস এনে ওকে খেতে দেয়। নমিতার চোখ তখন চকচক করে। মুখে বলে, ‘গরু না তো?’
‘পালা মুরগির গোসত। তুই খা।’ বলে আক্কাস মুগ্ধ চোখে নমিতার হাপুস-হুপুস খাওয়া দেখে।
একইরকম কথা বলে অন্যদেরও সান্তবনা জানায় নমিতা। এরকম করতে গিয়ে দিন দিন রান্নাবাড়া খেলাপর্বটা চালানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। সবাই নমিতার বর হতে চায়, ছেলেপুলে হওয়ার কথা বললেই সবার মন খারাপ। তাইলে খেলা চলবে কেমন করে?
ছিদাম তো একদিন বলেই উঠল, ‘আমার কি তর পোলা অওনের বয়স আছে?’ দেখাদেখি হিরণ-নিরঞ্জনরাও নমিতার সন্তান হতে চায় না। ওরা সবাই বড় হয়ে বাঁচতে চায়। বাবার মতো মাতববরি করার বাসনা সবার মনে।
এ নিয়েই উথাল-পাতাল ওদের রান্নাবাড়া খেলার আয়োজন। কাকে রেখে কে বাবা বনবে, এ নিয়ে মাথা গরম সবার, সঙ্গে নমিতারও। এরই ভেতর ছিদামের হাত ধরে আলতাফ এলো খালপাড়ে।
নমিতার গায়ে মায়ের দেয়া শতচ্ছিন্ন গোলাপি শাড়ি। মুখে হাসির ছটা। ওকে দেখেই প্রথম কথা, ‘তুই তো এই শওরের কেউ না। বেড়াইতে আইছস, বাপ অইবি?’
সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে উঠল তুমুল শব্দে। বোকার মতো আলতাফও হাসে। বুঝতে পারে না, সবাই ওকে নিয়ে এতো হাসছে কেন। পরে সব বুঝতে পারলেও তখন ওর মুখ দিয়ে কথা সরছে না। রীতিমতো নার্ভাস সে। এখনো সে-কথা মনে হলে হো-হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছা করে আলতাফের; ব্রিসবেন নদীর ধারে সবার অগোচরে এরকম দিলখোলা হাসি বহুবার হেসে নিয়েছে সে।
ছিদাম ফিসফিস করে ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আরে, তুই তো দেহি মহা ভাগ্যবান। আইতে না আইতেই নমিতার জামাই অইয়া গেলি? আর তাইরে আমরা ভালা-মন্দ খাওয়াইতে খাওয়াইতে জান কয়লা করতাছি, তবু চান্স পাই না। যা যা, ব্যাটা। তুই বিদেশি পোলা। তরে কেউ কিছু করত না। যা।’
নমিতা ওর কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলল, ‘মিছামিছি সংসার। হিহিহি।’
ওর কথার ভেতর একটা অন্যরকম নেশা ছিল। কিছু না বুঝেও ভূতের গল্প শোনার মতন ওর শরীর শিউরে উঠল। জিহবা শুকিয়ে কাঠ। তলপেটে আমাশয়ের রোগীর মতন কামড়।
নমিতা বুঝতে পারল। এক চোট হেসে বলল, ‘তুই ত ঘাবড়াইয়া গেছিস। এইডা খেলা। তুই খালি বইয়া থাকবি। আর সব আমি করুম।’
এবার ছিদাম বলে উঠল, ‘নমিতা এইডা ঠিক না। হে তো তর জামাই। হেরে তুই কছ কেরে?’
‘ইচ্ছা। একশদবার তুই কমু। তর কিতা? তুই যাঃ।’ ছিদাম হাসতে হাসতে চলে গেল অন্যদের কাছে। আজ ওরা সবাই ছেলেপুলে। তাই, ইট দিয়ে উনুন তৈরি করছে ওরা। কেউ শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করে আনছে জ্বালানির জন্যে। কেউ মাছ কোটায় ব্যসত্ম। আবার কেউ অবিরাম তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে, আনন্দে।
হলুদ-মরিচ মাখানো খালের গুঁড়া মাছ নমিতার একপাশে একটা কলাইকরা বাটিতে রাখা। এর পাশেই একখানা তেলভরা কাচের শিশি; একটু পর কড়াইয়ের তেলে ছাড়া হবে সেগুলো। সেই প্রস্ত্ততি নিচ্ছে নমিতা। চুলা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে; কিছুতেই জুতসই আগুন জ্বলছে না।
অথচ ধোঁয়ায় নমিতার চোখজোড়া প্রায় আচ্ছন্ন; চোখ বুঁজেও সেই জ্বালা থেকে নিস্তার মিলছে না; অবিরাম জল ঝরছে।
ঠিক এ-সময় গান শোনাতে শোনাতে ছইওলা এক নৌকা চলে এলো সবার দৃষ্টিসীমানায়। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেপুলের লাফালাফি শুরু হয়ে যায়। সবাই যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। জিকিরে-জিকিরে পুরো খালপাড় জমে ওঠে। কেউ গাছে চড়ে। কেউ হাততালি দেয় লাফাতে লাফাতে।
আক্কাস হাঁটুজলে নেমে নাচতে শুরু করে দেয়। ছিদাম আনন্দে কী করবে, কিছু ভেবে পায় না। সহসা সে ঢিল ছুড়তে শুরু করে নৌকা তাক করে। এটাই ওর আনন্দের চরম প্রকাশ। নমিতা এসে ছিদামকে থামায়।
দেখাদেখি আলতাফেরও ইচ্ছে করে কিছু একটা করার। কী করলে ভালো হয়, বুঝতে পারে না। সহসা কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করে সে। অমনি নমিতা এসে ওকে চোখ রাঙায়। মুখে বলে, ‘তুই আবার নাচোস কেরে? তুই কি পোলাপান?’
কথা শুনে আলতাফের হাসি পেয়ে গেল। সে পালটা প্রশ্ন করল, ‘তাইলে আমি কী?’
‘দূর বেক্কল, তুই পোলাপান অবি কেরে? তুই তো হেরার বাপ। আমার সোয়ামি।’ বলতে বলতে বাঁধভাঙা হাসিতে নমিতা ভেঙে পড়ে। গায়ে দেওয়া ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করে। যেন সে এরকম বেহায়া কথা বলে বড় বোকামি করে ফেলেছে। এখন লজ্জা পাচ্ছে।
অগত্যা, একটা গাছের নিচে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলতাফ বসে রইল। সে বুঝতে পারে না, ওর দোষটা কোথায়। সে কেন অন্যদের মতন খালের ঘোলা জলে নেমে ঢিল ছুড়তে পারবে না। গামছা দিয়ে খালে মাছ ধরা কেন বারণ হবে ওর জন্যে – তাও ওর বোধগম্য নয়। সে ওদের কাছাকাছি গেলেই ছেলেরা সিঁটিয়ে যায়, লজ্জাবতী পাতার মতন।
নমিতা এবার ওর দিকে এগিয়ে এলো। আঁচল দিয়ে বড়দের মতো মুখের ঘাম মুছে প্রশ্ন করল, ‘তর খারাপ লাগতাছে, নারে?’
আলতাফ এখানে নতুন। যদিও ছিদামের সঙ্গে বেশ কবার এখানে এসেছে। নারকেল গাছ থেকে লাফিয়ে পড়েছে খালের জলে। গামছা দিয়ে মাছও ধরেছে বেশ কবার। তবু রান্নাবাড়া খেলার আয়োজনে এই প্রথম।
সে কোনো উত্তর না দিয়ে মাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। একসারি পিঁপড়ে কাছের বাঁশঝাড়ের গোড়া থেকে বেরিয়ে ওর পায়ের নিচ দিয়ে অজানার উদ্দেশে এগিয়ে চলছে। আলতাফের দৃষ্টি সেদিকে।
নমিতা ফের বলে, ‘তরে একটা কাম দিই। তুই খালি হম্বিতম্বি কর।’
‘মানে?’ মাথা তুলে নমিতার মুখের দিকে তাকায় সে।
‘ডাকখোঁজ। তুই হেগো মিছামিছা বাপ না? গলা ছাইড়া ডাক হেরারে। খাইতে আওনের লাইগা ক।’
এ-কথায় আলতাফ চুপ হয়ে যায়। কেমন বাধো-বাধো ঠেকছে নিজের কাছে। এখানে সবাই ওর সমবয়সী, বয়সে ও মাতববরিতে বেশ পাকা। তাদের কীভাবে গলা ছেড়ে তুই-তুকারি করে ডাকে? কিন্তু নমিতা জানাল, এটাই খেলার মজা। ঠিকঠাক না করলে ওকে বাদ দেয়া হবে খেলা থেকে।
বাধ্য হয়ে সে ডেকে উঠল হেঁড়ে গলায়, ‘কি রে, তরা কী করছ? খাওনের সময় অয় নাই? আইয়া ল। জুতাইয়া মাথার চাড়া নামামু। দেহিস।’ শেষের কথা কয়টি ছিদামের শেখানো। এখনো মনে হলে রীতিমতো হাসি পায় আলতাফের।
খালপাড়ে দাঁড়িয়ে ঝাপসা হলেও সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিজেকে। হাফ প্যান্ট পরা একটি ছেলে। গোলগাল শ্যামলা মুখ। মাথাভরা চুল। কেবলি চেঁচাচ্ছে দারোগা বাপের কণ্ঠ নকল করে। প্রথমে অনুচ্চ গলায়, তারপর কণ্ঠের জোর কেবল বেড়েই চলে। একসময় মনে হলো, ওর সমসত্ম জড়তা কেটে গেছে। সে এখন এ-দলের বাবা। বাবারা যা করেন, সে তাই করছে। এটাই ওকে চালিয়ে যেতে হবে।
একটু বাদে খাওয়া-দাওয়ার পালা। কিন্তু সবাই বসে গেলেও ওকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। নমিতার বারণ। কারণ, ছেলেপুলেদের খাওয়া শেষ হলে তবেই নমিতার সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেতে হবে। তারপর ঘুমানোর পালা। খালের ঢালে একটা বুনো দেবদারু গাছের তলায় কার যেন একটা ছেঁড়া চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানেই ওরা খাওয়া শেষ হলে শুয়ে পড়বে।
খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলেপুলেরা আগেভাগেই গাছের তলার বিছানা দখল করে নিয়েছে। কেবলি বিনা কারণে হি-হি করছে। এ ওকে খামচাচ্ছে। পরস্পরের চুল ধরে, কান টেনে অবিরাম চেঁচামেচি করছে শুধু।
আলতাফ মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে, ‘না ঘুমাইলে চোখ গাইল্লা ফেলামু। ঘুমা। কুন কতা না। চোখ বুইজা ফ্যাল।’ এ-কথাগুলোও নমিতা ওকে শিখিয়ে দিয়েছে। কেননা, এগুলো না বললে বাবা হওয়া যায় না।
ছিদাম হঠাৎ ভেংচি কাটে, ‘ওই ভাদাইম্মা কুমিল্লার বাইচ্চা। আসেত্ম ক না। হাটকাল বানাইয়া লাইবি?’
অমনি নমিতা ওকে ধমকে ওঠে, ‘ছিদাইম্মা, তুই খেলার নিয়ম ভাঙতাছস। তরে কইলাম এক ঘইরা ফ্যালামু। ’
আর কথা নয়। ওরা সবাই ইচ্ছে করে নাক ডাকতে শুরু করে। এমন বিকট নাকডাকা সে কোনোদিন শোনেনি। কার চেয়ে কার নকল নাকডাকা বেশি শব্দময় হয়, তাই নিয়ে ওদের নীরব-নিশ্চুপ প্রতিযোগিতা চলছে।
এ-সময় নমিতা আচমকা একটি কাজ করে বসে। প্যান্টের ভেতর আলতাফের কচি মরিচের মতন শিশ্নটিকে সে চেপে ধরে চকাস করে ছ্যাপ-থুতুয় ভিজানো একটা চুমু খেয়ে ফেলে ওকে। তারপর ফিসফিস করে জানায়, ‘এইডার লাইগা হগ্গলে পাগল। তুই ফাউ-ফাউ পাইয়া গেলি। কাইল তুই খাওয়াইবি।’
ঘটনার আকস্মিকতায় আলতাফ একেবারে হতভম্ব। শরীরের অভ্যন্তরে কেমন এক অপরিচিত ঝাঁকুনি অনুভব করে সে। হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। মনে হলো, সে কোনো গর্হিত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
আলতাফ এক ছুটে পালিয়ে আসে সেখান থেকে। পেছনে ছেলেপুলেরা একসঙ্গে হেসে ওঠে, ‘বাপটা পালাইয়া যায় খেলা ফালাইয়া। ধর, ধর।’
আলতাফ আর কখনো ওদিকে যায়নি। যে কদিন ছিল, সে ফুফুর পাঁচিল ঘেরা বাড়িতেই সময় কাটিয়েছে। নমিতার সঙ্গেও আর দেখা হয়নি। পরের ক-বছর ছিদামের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ওর। অন্যদের সঙ্গেও কথা হতো। কিন্তু কখনো খালপাড়ে পা দেয়নি। এ নমিতার কারণে কিনা – এখন আর তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না আলতাফ।
তবু হঠাৎ করেই এতদিন পর ব্রিসবেন শহরে গুম হওয়া আত্মীয়ের মতন নমিতা এসে উপস্থিত। অদ্ভুত রকমের এক কৌতূহল ওকে পেয়ে বসল। জীবনে প্রথমবার যে-মেয়েটি ওকে স্বেচ্ছায় চুমু খেল, প্রশ্নটা ঘুরেফিরে কেবলি কামড় বসাচ্ছে, সে কেমন আছে?
শহরটির আনাচে-কানাচে এখন প্রচুর বাড়িঘর। যে-খালপাড়ে একসময় গাছগাছালির ছড়াছড়ি ছিল, এখন ওখানে পাকা দালান উঠছে তরতর করে। স্মার্টফোন-জাঙ্কফুড সব মেলে এ-শহরে। যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতির সঙ্গে মানুষের জীবনে বৈচিত্র্য এসে গেছে। সেই রং প্রতিটি মার্কেট আর দোকানে রাংতার মতন ঝলমল করছে ।
খালটাও ঠিক আগের মতন নেই। বুড়িগঙ্গার মতন একেও সবাই মিলে বলাৎকার করে করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পাড় দখল তো হচ্ছেই, বাড়িঘর আর কারখানার নোংরা ও বিষাক্ত জলের দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায় না।
স্মৃতির খাল আর এখন নেই। শানবাধানো বড়সড় একটা ড্রেনের মতন দেখাচ্ছে – কোথাও জলের তোড় নেই। মুখ থুবড়েপড়া এক বুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সামনের দিকে। এর প্রতি করুণা হয়, মাঝে মাঝে তীব্র ক্ষক্ষাভ; কিন্তু ভালোবাসা-বাসি চলে না।
যে-খালপাড় সে দেখতে এসেছে এত কাঠখড় পুড়িয়ে, সেটি এখন ওর স্মৃতির অন্দরমহলে খলবল করছে। চোখের সামনে আপাতত কিছু নেই, স্মৃতির ফসিল ছাড়া। ডাক্তার স্ত্রী সোহেলী ও মেধাবী দুই ছেলে নিয়ে ওদের ব্রিসবেন শহরের স্ট্রিটন রোডের যে সুখী সংসার, তা ফেলে কেন যে সে হুজুগের মাথায় এ ভরা বর্ষার সময় এই গু-মুত আর নোংরায় ভরা ড্রেনটার কাছে ছুটে এলো, ভেবে নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত এখন।
তারপরও মনের কোথায় যেন খচখচ করছে একটা কাঁটা। এ-শহরে বেশ কবার সে এসেছে; ওর ফুপি যে-পাড়ায় থাকত সেখানকার ছেলেদের সঙ্গে ওর একদা সখ্য গড়ে উঠেছিল। সেই পাড়ার কিনার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খালটার পাড় থেকে এইমাত্র সে ঘুরে এলো। কই, কেউ তো ওকে চিনল না? কৈশোরের সেই চেনা বন্ধুগুলো কি সবাই হারিয়ে গেল? আঁতে কেমন যেন লাগছে। সে এতোই অচেনা অপাঙ্ক্তেয় এ-শহরে? একতরফা প্রেমের মতন?
পথ চলার সময় ওর চোখজোড়া চারপাশে অবিরাম ঘুরতে থাকে। একটা অজানা আশা – যদি কাউকে মিলে যায় রাস্তায়।
সহসা মনে হলো কেউ একজন ওকে অনুসরণ করছে। কিছু বোঝার আগেই হনহন করে এগিয়ে এলো এক মাঝবয়সী লোক। ওর দিকে তীক্ষন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখভরা হাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘তুমি কি আলতাফ? আমি ছিদাম।’
হো-হো করে হেসে উঠল আলতাফ। পাশের একটা টি-স্টলে বসে দুজন মিলে চা-শিঙাড়া খেল। ফেরার পথে আলতাফ নিজে থেকেই বলে উঠল, ‘তোমাদের নমিতার খবর কী?’
সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিল ছিদাম। গাট্টাগোট্টা টাইপের শরীর-স্বাস্থ্য ওর। নিউমার্কেটে রয়েছে ওর এক মনিহারি দোকান। আয়-রোজগার মন্দ নয়। একটাই ছেলে, পাকা গিন্নি ওর বউ। সব মিলিয়ে সে সুখী – এই তার উপলব্ধি। তবে জ্বালাও আছে – ছেলে রতনের পড়ালেখায় মন নেই। বিএ পাশ না করতে পারলে যে সমাজে মান-সম্মান থাকে না, তা রতনের মাথায় ঢোকে না। এই দুশ্চিন্তাই ওকে এখন কুরে খাচ্ছে।
আলতাফ ফের প্রশ্ন করল, ‘নমিতার খবর কী?’
‘ওইডা মরছে। জাতকুল ছাইড়া ইমাম সাবের বউ অইছে। তুমি তো চিনবা না। পঞ্চানন্দ আছিল না এই পাড়ায়? হে তো নও মুসলিম অইছে। ইমামতি করে মসজিদে। হের বউ অইছে। বয়সের তফাৎ জানোনি? বিশ বছর। নডি, তাই একটা নডি।’
আলতাফ মুখে কিছুই বলল না। সে বেরিয়ে এলো টি-স্টল থেকে।
ছিদাম পিছু পিছু এসে স্টেশন পর্যন্ত ওকে একটা চেনা রিকশা ঠিক করে দিলো। রিকশা যখন ছাড়তে যাবে, তখনই ছিদাম হাউমাউ করে আর্তনাদ করে উঠল, ‘ভাই, তুমি আমার একটা উপকার করবা?’
‘কী?’ অবাক হয়ে পালটা প্রশণ করে আলতাফ। মুখে স্মিত তৃপ্তিমাখা হাসি।
‘আমার একমাত্র পোলাডারে অস্ট্রেলিয়া লইয়া যাইতে পারবা না তুমার লগে? হের মতিগতি ভালা ঠেকে না। যদি পঞ্চানন্দের মতন অইয়া যায়? ’ ছিদামের চোখদুটো অজানা শঙ্কা ও ভয়ে ছলোছলো।
আলতাফের হাসি পেল। রিকশায় বসে ওর নিচু মাথায় হাত বুলিয়ে উত্তর দিলো, ‘জন্মভিটের চেয়ে আরাম আর কোত্থাও নাই। ওইখানকার নদীতে মাছ নাই। দাবানলে ছারখার হয় সব। এইখানেই থাকো, দোসত্ম। সব ঠিক অয়া যাবে।’ এ সময় ব্রিসবেনে ফেলে আসা ওর ডাক্তার বউ সোহেলী ও দুই পুত্রের আদুরে মুখকটি ভেসে উঠল। অনেকক্ষণ কথা হয় না ওদের সঙ্গে। ঢাকায় ফিরে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে বসে আয়েস করে কথা বলতে বলতে হবে।
ছিদামের চোখে চশমা। অবাক চোখে সে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। পালটা কোনো কথা বলার আগেই রিকশাটি অনেকদূর এগিয়ে যায়।