চতুর্থ জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী-২০১৮ ভাস্কর্যে নানামাত্রিক ভাষা

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যতটা চিত্রকলা এগিয়েছে ঠিক ততটা এগোয়নি ভাস্কর্যশিল্প। শিল্পের এ-মাধ্যমটিতে সৃষ্টির আড়ালে যে শ্রম ও সময় লগ্নি করতে হয় সে-হিসাব কষলে ভাস্কর্য মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে কমই। সময়টা ১৯৫৬। এই সময়ে ঢাকায় একজন নভেরা আহমেদ ভাস্কর্যশিল্পের চর্চা শুরু করেন; সেটি চলতে থাকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ১৯৬০ সালে নভেরার ‘ইনার গ্লেজ’ নামে প্রথম একক ভাস্কর্য-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এ-অঞ্চলে আধুনিক ভাস্কর্যের চর্চা দেখা যায়। ১৯৬৩ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উৎসাহে শিল্পী আবদুর রাজ্জাক বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে মানুষ ভাস্কর্যের ধরনের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। বাংলাদেশের শিল্পচর্চার গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাস্কর্যের ধারাবাহিক চর্চার ইতিহাস এ-প্রদর্শনীতে রাখা যেত। সে-উদ্যোগ হয়তো আগামীতে দর্শক দেখতে পাবে।

চতুর্থবারের মতো আয়োজিত জাতীয় ভাস্কর্য-প্রদর্শনীতে মোট কাজের সংখ্যা ১১৭টি। ৯৮ জন শিল্পীর নির্মাণে এ-সংখ্যাটি বেশ আশাব্যঞ্জক বলা যায়। এ ছাড়া আমন্ত্রিত ১১ শিল্পীর সঙ্গে প্রয়াত চার শিল্পীর ভাস্কর্য আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়।

প্রদর্শনীতে ভাস্কর্যের মাধ্যম উন্মুক্ত ছিল। এতে শিল্পীরা তাঁদের ইচ্ছামতো মাধ্যম বাছাই করে কাজ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ভাস্কর্যচর্চার বাইরেও কোনো কোনো শিল্পী তাঁর কাজকে অব্যাহত রেখে নিয়মিত নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন। সে-দক্ষতার ছাপ এ-প্রদর্শনীর কোনো কোনো কাজে দেখা যায়। পুরস্কারপ্রাপ্ত কাজগুলো নিয়ে বিশদ বর্ণনায় বলতে হয় এমন – জাতীয় ভাস্কর্য পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী খোকন চন্দ্র সরকারের কাজে দেখা যায়, কাটা গরুর মাথার জমিনে যুদ্ধবিমান, ফুলের কলি ও বন্দুক আঁকা হয়েছে। পাশাপাশি পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত মূর্তির গায়েও একই ফর্ম বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। চলতি বিশ্বে হানাহানি আর মানুষের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের কারণগুলো তিনি চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। খোকন তাঁর কাজের শিরোনাম দিয়েছেন ‘আমার বিশ্বাসের অন্তরালে’।

পলাশ সাহা পানির টেপ ও পাইপের মাধ্যমে জনজীবনের সংকটকে প্রধান করে দেখেছেন। তাঁর কাজের শিরোনাম ‘সংকট’।

কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তৈরি করেছেন ‘ফ্রাগমেন্ট ইউনিটি’ অর্থাৎ ভঙ্গুর একতা। মানবজীবন তথা সারাবিশ্বের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের মনস্তাত্ত্বিক অবয়ব তুলে ধরেছেন সালাউদ্দিন আহমেদ। অনেকগুলো কাঠিকে একসঙ্গে জোড়া দিয়ে তিনি তৈরি করেন কাঠের ঐক্য। প্রত্যেক কাঠে বিভিন্ন ইমেজ আটকে দিয়ে তিনি চোখে বিভ্রম তৈরি করেছেন। সম্মানসূচক পুরস্কার পাওয়া শিল্পী অলোক কুমার সরকারের সম্পর্ক কাজটিতে ফর্মের সরলীকরণ দেখা যায়। মানুষে মানুষে অথবা বস্তুতে বস্তুতে সম্পর্কের রূপ হয়তো এমনই।

পুরস্কারপ্রাপ্ত শিমুল দত্ত ‘চাপ সামলাও’ ভাস্কর্যদুটিতে প্লাস্টারে গড়া মানবদেহের মুখে গুঁজে দেন পেরেকখ-। কাজগুলোতে এক ধরনের দ্রোহের বার্তা প্রকাশ পায়। দ্রোহ অথবা স্যাটায়ার দুধরনের প্রকাশভঙ্গিকে চলতি সমাজবাস্তবতার রূপ বলা যায়।

প্রদর্শনীতে কাঠ, প্লাস্টার, লোহা, তামা, দস্তা, সিসা, সিমেন্ট, মাটি, ফাইবার গ্লাস, কাগজের ম-সহ নানা মাধ্যমে গড়া ভাস্কর্যের মধ্যে বাস্তবধর্মী ভাস্কর্যের উপস্থিতি সংখ্যায় কম নয়।

শিল্পের মাধ্যমে সুন্দরের প্রকাশ যেমন অনিবার্য, এর সঙ্গে যৌক্তিক সমাজবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তৈরি করাও শিল্পীর দায়ের মধ্যে পড়ে। চতুর্থ জাতীয় ভাস্কর্য-প্রদর্শনীতে কিছু কাজে মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায়, যেমন – সুলতানুল ইসলামের ফাইবার গ্লাসে গড়া ‘কথোপকথন’, সামিনা এম করিমের ফাইবার গ্লাসে তৈরি ‘মাতৃকা’, খন্দকার নাছির আহাম্মদের ‘অন্তর্বতী-১’, এসএম মিজানুর রহমানের ফাইবার গ্লাসে গড়া ‘অবলম্বন’।

এছাড়া নিরীক্ষাধর্মী কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আসিফ-উজ-জামানের ‘রূপান্তর’, আনিসুজ্জামান সোহেলের ‘ছদ্মবেশী’, অসীম হালদার সাগরের ‘এক্সজিসটেন্স ইন দ্য ন্যাচার-৩’, জয়শীষ আচার্য্যরে ‘সময়ের স্বপ্নভঙ্গ-৩’ এবং তেজস হালদার জসের ব্রোঞ্জ নির্মিত ভাস্কর্য ‘রান’।

১১৭টি শিল্পকর্মের কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে পরম্পরাগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তাতে হয়তো অতীত ভাস্কর্যচর্চার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এতে করে শিল্পের ধারাবাহিক অতীতকে চেনা সহজ হয়।

মাধ্যমে বৈচিত্র্য, বিষয়ে ভাবনার যোগ, সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে একাগ্রতা ও নিষ্ঠা, এ-ভাস্কর্য প্রদর্শনীর কাজের মধ্যে তা দেখা যায়।

বলে রাখা দরকার, কলেবরে বৃদ্ধি নয় বা সংখ্যায়ও অনেক বেশি না হয়ে আরো কিছু কাজের উপস্থিতি না হলেই প্রদর্শনী সমৃদ্ধ হতো।

আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ-একাগ্রতা আমরা আশা করতেই পারি।

চতুর্থবারের মতো ভাস্কর্য নিয়ে জাতীয় প্রদর্শনীর আয়োজন শিল্পের দর্শকের মনে আশা জাগায়, সঙ্গে ভাস্কর্য নিয়ে আমজনতার অমানিশা কেটে উঠবে – এ-ভাবনাই আমরা লালন করি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালায় গত ৯ মে শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ৭ জুন।