চারটি কবিতা

মহাদেব সাহা

সন্দ্বীপের চরে
কী যে সে ইচ্ছে ছিলো চলে যাই সন্দ্বীপের চরে
দুইজনে যেতে থাকি ঢেউ-লাগা সমুদ্রের ঘরে,
কথা বলি সারাদিন জলে-ওড়া পাখিদের সাথে
ঘুমাই নদীর তীরে জ্যোৎস্নার গন্ধমাখা রাতে;
মনে হয় সেইখানে নদী ছাড়া আর কেউ নেই
জলের উপরে তাই ঘুমিয়েছি শুধু দুজনেই,
হয়তো সাঁতার কাটে কিছুদূরে একজোড়া হাঁস
সন্দ্বীপে নেমেছে বৃষ্টি, সেইখানে নেমেছে আকাশ।

কী দিয়ে দুজনে যেন ভরি তুলি দুজনের হাত
ফুলে আর সৌরভে থইথই বর্ষণের রাত,
মাঝে মাঝে উড়ে আসে কোথা থেকে একঝাঁক পাখি
কোথায় মিলিয়ে যায় আমি তার গন্ধ ধরে রাখি;

সারারাত পড়ে থাকে অন্ধকারে সন্দ্বীপের চর
এইখানে আমাদের জলে-ডোবা বালির শহর,
আর তো কিছুই নাই জল আর এই বালিমাটি
তোমার দুহাত যদি হয়ে ওঠে নিঝুম দোপাটি,
তাই নিয়ে চলে যাই তুমি আমি সন্দ্বীপের চরে
দুইজনে ঘর বাঁধি এইখানে ভাঙনে বা ঝড়ে।

স্বপ্নবিজ্ঞান
একদা বাগিচামত্ত উৎসবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আমার শরীরের
গন্ধে পাখির কিচিরমিচির; কাফকার মেটামরফসিস রচনা করেছে
গ্রামীণ তাঁতের নকশার মতো রেখাচিত্র, এই জলছাপগুলি ভেসে
বেড়াচ্ছে সব সমুদ্রভূমিতে, ভ্রমণে জল স্থল অন্তরীক্ষ সর্বত্র ডানা
মেলবার সুখ, বৃষ্টিতে এই যে যৌনগন্ধ মধ্যরাতের নক্ষত্রের দিকে
তাকিয়ে যেদিন তা প্রথম অনুভব করি সেদিন পৃথিবীর দ্বিতীয় অধিবর্ষ
এখানে অর্থাৎ সেই নিদ্রাশহরে প্রাচীন উদ্ভিদ সংগ্রহ করতে করতে
বুঝতে পেরেছিলাম, এরই নাম স্বপ্নবিজ্ঞান, দেবতা ও মানুষের কল্পচ্ছবি
এই বাগান ও দেবমূর্তি উদ্ধারের জন্য কেউ স্রোতস্বিনী পুকুরে নামে
কেউ বীজ ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৈরি করে এক ঝুলন্ত বোধিবৃক্ষ।

আদি আর বর্তমান

আমরা যে যার মতো স্বপ্ন বুনন কাজ তৈরি করি অদৃশ্য
গুটিপোকার মতো

কেউ কিছুই দেখিনি;
ভুল তত্ত্বে আর ভুল বিদ্যায় সহস্র সহস্র বছর ডুবে
আছি।

আমরা যখন গান গাইতে পারি না তখন
বিজ্ঞান ও ব্যাকরণ নির্দেশ করি,
কিন্তু পাখিদের কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই
প্রেম যেমন সবসময়ই প্রথম।

এতো বছর হলো কান্নার কোনো বিকল্প হলো
না,
মানুষের দুঃখের ভাষা চিরকাল তার মাতৃভাষা
আদি আর বর্তমানে ব্যবধান অতি সামান্য,
মাত্র একসুতো।

যদি জাগ্রত না হয় ঈশ্বরী

কবিতা যেদিন তোমাকে আমি জাদুমন্ত্র ভেবে বুকে
নিয়েছিলাম
সেদিন আকাশে একসাথে সব তারা ঝলসে উঠেছিলো,
সপ্তর্ষিমণ্ডলে ফুটেছিলো একশ একটি গোলাপ
পৃথিবীতে হয়েছিলো প্রথম বর্ষণ,
সেদিন অপ্সরীদের পায়ে বেজে উঠেছিলো অপূর্ব ঘুঙুর;
কিন্তু এখন কেন আর সেই সঞ্জীবনী হয়ে ওঠে না কবিতা,
কেন সেই মন্ত্রে প্রজ্বলিত হয় না অগ্নি, সেই ছন্দে
বৃষ্টি নামে না,
তাহলে কেন এই ব্যর্থ ধ্যান, যদি তুমি সামনে
না আসো
যদি তুমি জাগ্রত না হও, ঈশ্বরী?