চারুকলার ৭০ : শিক্ষকদের প্রদর্শনী

এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার সূত্রপাত ১৯৪৮ সালে। সে হিসাবে চারুকলা প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পার হয়েছে সদ্য বিদায়ী বছরের শেষদিকে। প্রতিষ্ঠার এই মাইলফলক বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের জন্য নিঃসন্দেহে বড় এক অর্জন। এটি সাড়ম্বরে উদ্যাপন করেছে এখনকার চারুকলা অনুষদ। তাদের  আয়োজনে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে  সাবেক ও বর্তমান শিল্পশিক্ষার্থীরা তাঁদের পরিজন নিয়ে আনন্দ-আয়োজনে পুনর্মিলনী  উদ্যাপন করেছেন।

এর আগে ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার থেকে চারুকলার প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক-শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে জয়নুল গ্যালারিতে বড় এক প্রদর্শনী শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষকসহ তরুণ শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করায় এটি হয়ে উঠেছে সাত দশকের চারুশিল্পের প্রতিনিধিত্বশীল একটি বিশেষ প্রদর্শনী।

চারুকলার প্রতিষ্ঠাতা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও তাঁর সতীর্থ গুরুশিল্পীদের পাশাপাশি আমাদের প্রধান শিল্পীদের অনেকেই এখানে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন; অন্যরা শিক্ষকতা থেকে অবসরে গেছেন। এখন যাঁরা শিক্ষকতা করছেন, তাঁরা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালের শিল্পী আর তরুণ শিক্ষকদের জন্ম স্বাধীনতার পরে। এই সত্তর বছরে চারুশিল্পীদের অন্তত চার প্রজন্মের দেখা পাচ্ছি আমরা। কলকাতা থেকে আসা গুরুশিল্পী জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ, শফিকুল আমীন, কামরুল হাসান প্রমুখ, গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটে তাঁদের শিক্ষার্থী-শিল্পী প্রজন্ম, স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে আশি ও নববইয়ের দশকের শিল্পী প্রজন্ম এবং শূন্য দশক থেকে এ-সময় পর্যন্ত শিল্পীপ্রজন্ম।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন গুরুপ্রজন্মের প্রধান চিত্রকর। চারুকলার প্রথম অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন ১৯৫৮ সালে এক চশুইভাতিতে গিয়ে ছবিটি এঁকেছিলেন। জলরঙে নদীবক্ষে মালবাহী বড় এক নৌকার ছবি এঁকে তাতে ছাত্র-শিক্ষক-সতীর্থদের স্বাক্ষর নিয়ে বাঁধাই করে ছবিটি অধ্যক্ষের অফিসকক্ষে ঝুলিয়েছিলেন। সেটি এখন চারুকলার অমূল্য এক সম্পদ। প্রদর্শনীতে এ-কাজটি অনেকের কথা মনে করিয়ে দিলো – যাঁদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। এখানে স্বাক্ষর আছে আবদুল গণি হাজারী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশীদ চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, আবদুল বাসেত, আবদুস সাত্তার, শওকাতুজ্জামান, আবদুল হাই, জিয়াউল হক, রওশন আরা, ফরিদা খানসহ সে-সময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের। হালকা রঙের প্রলেপ, বলিষ্ঠ রেখা ও তুলির আঁচড় জানান দেয় শিল্পাচার্যের দক্ষ হাতের অঙ্কনবৈশিষ্ট্য। চারুকলার
প্রথমদিকের শিক্ষক আনোয়ারুল হকের পাখির দৃষ্টিতে দেখা ‘মাছধরা’ চিত্রটিতে – তেলরঙের দ্বিমাত্রিক লেপনে নীল পানিতে হালকা নীলে পানির ঢেউয়ের রেখাময় ছবিটি সরলীকরণের অসামান্য এক দৃষ্টান্ত। ‘মেলার পথে’, ১৯৪৭ সালে আঁকা সফিউদ্দীন আহমেদের উড এনগ্রেভিংয়ে করা চিত্রকর্ম। এই কাজটিতে পাশ্চাত্য পরিপ্রেক্ষিতের জোরালো প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ বিষয় ও এর সামাজিক দিক উঠে এসেছে। লোকবাংলার সরাচিত্রের শৈল্পিক উপাদান পাওয়া গেল কামরুল হাসানের চিত্রে।

পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষকদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবী, মরণচাঁদ পাল, আবদুস শাকুর শাহ নিজেদের কাজে স্বকীয়তা ও দেশজ উপাদানে শিল্পভাষা তৈরি করেছেন – তাঁদের কাজে মাটি, মানুষ, দেশ ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও বয়ান বিদ্যমান। আবার পাশ্চাত্য করণকৌশলের মাধ্যমে প্রাচ্য নন্দনতত্ত্বের সংশ্লেষও দেখতে পাই। সমকালীন শিল্পীদের অনেকের কাজে প্রাচ্যের ইজম বা শিল্প-আন্দোলনভিত্তিক অনুশাসন দেখা যায়; আবার কারো কারো কাজে দেশকালের আধুনিক ভাষা নির্মাণের নিরিখে প্রাচ্যের শিল্পভাষার নানা উপাদানের অনুষঙ্গের উপস্থিতি পাওয়া গেল।

অ্যাক্রিলিকে বিমূর্ত ধরনের স্বস্তিদায়ক বর্ণের খেলায় নন্দিত ছবি এঁকেছেন খ্যাতিমান শিল্পী মনিরুল ইসলাম। শহিদ কবীরের চিত্রকর্মটিতে নিরাভরণার দেহকাঠামোর ছন্দময়তা, বাংলা বর্ণমালাসহ বাঁশিওয়ালার অভিব্যক্তিতে প্রাচ্য নন্দনবোধের স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে। মতলুব আলী সবুজ বর্ণে বাংলার নিসর্গ রূপায়িত করেছেন।

প্রদর্শনীতে এ-দেশের আধুনিক চারুশিল্পের অন্যতম নির্মাতা শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার এচিং ছাপচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁর ছাত্রছাত্রী, পরে সহকর্মীদের মধ্যে অধ্যাপক মাহমুদুল হক, আবুল বারক আলভী, রোকেয়া সুলতানা, আনিসুজ্জামান, জয়া শাহবিন হক, নাজির হোসেন খোকনের ছাপচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে।

বাস্তবধর্মিতায় যাঁরা আঁকেন, সে-দলের অন্যতম শিল্পী জামাল আহমেদ। তিনি এঁকেছেন নদীর দিকে জড়াজড়ি করে আগুয়ান চার বালকের চিত্র। শিল্পী ফরিদা জামান এঁকেছেন সোনালি রোদমাখা মাছধরার জাল। মুস্তাফিজুল হক মোরগের গরিমাময় অবয়ব এঁকেছেন। শেখ আফজাল এঁকেছেন হাঁটুগেড়ে বসা এক বালকের ছবি। মোহাম্মদ ইকবাল আলী এঁকেছেন অনিশ্চিত চাউনির তিনটি শিশু-অবয়ব। আনিসুজ্জামান এঁকেছেন নগর-জটিলতার ছাপচিত্র। দুলাল গাইন এঁকেছেন বাইসনের ছবি। গাছের শেকড়ের সঙ্গে শকুন্তলা কিংবা অন্য কোনো নারীর শরীরভঙ্গিমাকে মিলিয়ে মলয় বালা প্রাচ্য-জলরঙে ছবি আঁকেন। তাঁর এই সিরিজের একটি চিত্রকর্ম এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। একগুচ্ছ ফুল হাতে এক কিশোরীর অবয়ব এঁকেছেন তরুণ শিল্পী কামালউদ্দিন।

নিসার হোসেন আর শিশির ভট্টাচার্য্যের চিত্রকর্মে সৌন্দর্যের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটাই প্রধান হয়ে ওঠে। সমাজকাঠামোর ভেতরে দুর্বৃত্তপরায়ণতার বিপদের দিকে আমাদের দৃকপাত করতে ইঙ্গিত করেন তাঁরা। এঁদের শিল্পচিন্তায় প্রাণিত হয়ে তুলনামূলক তরুণ প্রজন্মের শিক্ষক সহিদ কাজী, আবদুস সাত্তার তৌফিক, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, দীপ্তি রানী দত্ত, সঞ্চয় চক্রবর্তী, অমিত নন্দী, সুমন ওয়াহিদের কাজেও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের উপস্থিতি দেখা যায়।

প্রদর্শনীতে ভাস্কর্য দিয়ে অংশ নিয়েছেন প্রয়াত ভাস্কর ও শিল্পী আবদুর রাজ্জাক, হামিদুজ্জামান খান, এনামুল হক এনাম, লালারুখ সেলিম, কাওসার হাসান, মিতু হক, মুকুলকুমার বাড়ৈ, নাসিমুল খবির ডিউক প্রমুখ। মৃৎশিল্প নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন – দেবাশীষ পাল, মীর মোস্তফা আলী, শামসুল ইসলাম নিজামী, স্বপন সিকদার, রবিউল ইসলাম, আজহারুল ইসলাম প্রমুখ। গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক খাজা কাইয়ুমসহ অতীত ও বর্তমানের শিক্ষকরা এ-প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তাঁদের কাজ নিয়ে। মোহাম্মদ ইউনুস, মামুন কায়সার, মাকসুদুর রহমান, অনুপম হুদা, রতন প্রামাণিক, হারুনুর রশিদ টুটুল প্রমুখ শিল্পী নিজের অঙ্কনবৈশিষ্ট্যে দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন। কারুকলার মোহাম্মদ নজিব, ফারুক আহমেদ, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক বুলবন ওসমান, শেখ মনিরউদ্দিনসহ অন্য শিক্ষকশিল্পীরা অংশ নিয়েছেন।

চারুকলার সাতটি বিভাগে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিল্পশিক্ষা দেওয়া হয়। বিভাগগুলো হলো – অঙ্কন ও চিত্রায়ণ, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, গ্রাফিক ডিজাইন, প্রাচ্যকলা, মৃৎশিল্প ও কারুকলা। তবে       এ-প্রদর্শনীতে বিভাগভিত্তিক কাজের বৈচিত্র্য ছাপিয়ে উঠেছে মূলধারার শিল্পমাধ্যম পেইন্টিংয়ের প্রাবল্যে। ফলে শিল্পভাষায় মাধ্যমগত যে-বৈচিত্র্যের জন্য বিভাগগুলো সৃষ্টি হয়েছিল তার অগ্রগতি, প্রচার-প্রসার নিয়ে প্রশ্ন ওঠা বিচিত্র নয়।

তবু সব মিলিয়ে বলতে হবে, প্রয়াত শিক্ষকদের স্মরণ, প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষকদের পরিচয় এবং চারুকলার সত্তর বছরের            শিল্প-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি – এসব হিসাব করার সুযোগ রেখে গেল এ-প্রদর্শনী।

১০ ডিসেম্বর জয়নুল গ্যালারিতে শুরু হয়ে প্রদর্শনীটি চলেছে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।