চিরপ্রেমিক কবি কবি অরবিন্দ গুহের প্রয়াণলেখ

তাঁর একটি কবিতায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছিলেন : ‘তোমার মৃত্যুর দিনে মনে পড়ে অনেক মৃত্যুরে।’ ব্যঞ্জনার্থে নয়, বাচ্যার্থেই যেন সত্যি হয়ে উঠল এই কাব্যপঙ্ক্তি – যেদিন বাংলা সাহিত্য হারাল কবি অরবিন্দ গুহকে। একইসঙ্গে পঞ্চভূতে বিলীন হলো আরো অনেক সত্তা। একজন প্রধান কবি, একজন প্রখ্যাত গবেষক, একজন প্রসিদ্ধ ছোটগল্পকার তথা ঔপন্যাসিক এবং একজন প্রকৃষ্ট রম্যরচনাকার।

দিনটি ছিল ৩ জুন, ২০১৮, রবিবার। ২০১৫ থেকেই ভুগছিলেন অবশ্য বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রংশ রোগে! (হায়, মনে পড়ে তাঁরই লেখা সেই বিখ্যাত লাইন – ‘আয়ুর শেষে স্মৃতি খানিক খর্ব হবেই!’) সেদিন সকাল থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি। তড়িঘড়ি ভর্তি করে দেওয়া হয় আলিপুরের একটি নামী নার্সিং হোমে। সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অরবিন্দ গুহ। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯। রেখে গেলেন স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে। স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পূরবী গুহ (সাহিত্যিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের – ইন্দ্রজিৎ যাঁর ছদ্মনাম – কন্যা)। কন্যা – গৌরী দাশগুপ্ত।

অরবিন্দ গুহের জন্ম ১৯২৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশালে। যে-বরিশাল রাজনৈতিক হিসেবে অধুনা বিদেশ (বাংলাদেশ); তবু অরবিন্দ গুহ বিশ্বাস করতেন, ‘আমার মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত বরিশাল আমার স্বদেশ থেকে যাবে।’ পড়াশোনার সূচনাও বরিশালে। ব্রজমোহন স্কুলে ও কলেজে। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৭-এ ইন্টারমিডিয়েট। জীবনানন্দ দাশের সাক্ষাৎ ছাত্র অরবিন্দ গুহ দেশভাগের পরে চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন আশুতোষ কলেজে। সেখান থেকেই ডিস্টিংশন নম্বর নিয়ে পাশ করেন বি.এসসি। অচিরেই যোগ দেন চাকরিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর। অবসর নেন ১৯৮৬-তে।

কবিতা দিয়েই লেখালিখির হাতেখড়ি। স্কুলজীবনেই বাইরের কাগজে ছাপা হয়েছে লেখা। পরবর্তীকালে কবি হিসেবেই প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা। প্রথম কবিতা, কলেজে পড়াকালীনই, বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায়। এরপর সঞ্জয় ভট্টাচার্য-সম্পাদিত পূর্বাশায়। ক্রমে-ক্রমে দেশ, আনন্দবাজার, শতভিষা, কৃত্তিবাস – যাবতীয় পত্রিকার নিয়মিত কবিতালেখক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৫৪ সালে, দক্ষিণ নায়ক। এরপর একে-একে প্রথম পুরুষ (১৯৫৬), নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত (১৯৬৪), জানালার কাছে (১৯৮৫), সময় অসময় (১৯৯৪), দেখাসাক্ষাৎ (২০০৫), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৮) এবং প্রস্থানসময় উপস্থিত (২০১৪)।

 

দুই

কবিতার পাশাপাশি ‘ইন্দ্রমিত্র’ ছদ্মনামে অরবিন্দ গুহ লিখতে শুরু করেন গবেষণাধর্মী রচনা। বঙ্গরঙ্গমঞ্চের নেপথ্য-ইতিহাসের কাহিনি নিয়ে লেখা তাঁর সাজঘর গ্রন্থটি প্রকাশমাত্রই বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়। এ-গ্রন্থের জন্য ১৯৬২-তে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাশ পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন করুণাসাগর বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসাধারণ এক জীবনকথা। এ-বই পড়ে উচ্ছ্বসিত ভাষায় ইন্দ্রমিত্রকে অভিনন্দিত করেন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অগ্রজ সাহিত্যিক। প্রমথনাথ বিশী লক্ষ করেছেন যে, এই জীবনকাহিনি এমন সুচারুভাবে ইন্দ্রমিত্র হাজির করেছেন – ‘তথ্যের পর তথ্য সাজিয়ে, গল্পের পর গল্প বিন্যাস করে, ঘটনার পর ঘটনা খাড়া করে তুলে’ –  যে তার ফলে শেষাবধি ইন্দ্রমিত্রের এই প্রয়াস উত্তীর্ণ হয়েছে ‘শিল্পীর কাজ’-এ। এ-গ্রন্থের প্রশংসায় কোনো কার্পণ্যই করেননি তিনি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর গ্রন্থটির জন্য ইন্দ্রমিত্রকে রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় ১৯৭২ সালে। ইন্দ্রমিত্রের গবেষণাজাতীয় গ্রন্থতালিকায় পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছে নিপাতনে সিদ্ধ। সজনীকান্ত দাশ ও শনিবারের চিঠিকে কেন্দ্র করে উল্লেখযোগ্য কাজ এই বই। বাংলার কয়েকটি কিংবদন্তী, শরৎ কথামালা, বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলা – ইন্দ্রমিত্রের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলির কয়েকটি। এর বাইরে সম্পাদনা করেছেন বিদ্যাসাগরের ইংরেজি পত্রাবলি টঘচটইখওঝঐঊউ খঊঞঞঊজঝ ঙঋ ঠওউণঅঝঅএঅজ গ্রন্থ।

শুধু গবেষণাধর্মী রচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না ইন্দ্রমিত্র তথা অরবিন্দ গুহের সরস লেখনী। যেমন বড়দের, তেমনি ছোটদের জন্যও লিখেছেন বহু গল্প। সেসব গল্প নিয়ে বেরিয়েছে ছোটদের বই মামাবাড়ি, আটখানা নামের সংকলন। বড়দের জন্যও তাঁর একাধিক গল্পের বই; যেমন শুভদিন, নেড়িকুত্তা। এছাড়াও উপন্যাস মহারাজ। ইন্দ্রমিত্রের রচিত ‘আপনজন’ গল্পটি অবলম্বন করে রূপায়িত দু-দুটি চলচ্চিত্র। বাংলা ও হিন্দি ভাষায়। যথাক্রমে তপন সিংহ-পরিচালিত আপনজন এবং গুলজার-নির্দেশিত মেরে আপনে। রহস্যালাপ নামে একটি আশ্চর্য জোক-বুকও রয়েছে তাঁর। দেশবিদেশের নানান জোকস বা খোশগল্পের বিচিত্র সংগ্রহ এ-বইতে।

 

তিন

তবে সব ছাপিয়ে অরবিন্দ গুহের যাবতীয় লেখালিখির মধ্যে প্রধানতম, প্রবলতম সত্তা যে তাঁর কাব্যপ্রতিভা এতে আমি অন্তত বিন্দুমাত্র সন্দেহ করি না। তাঁর দক্ষিণ নায়ক পড়ে স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ মন্তব্য করেছিলেন, অত্যন্তই প্রতিশ্রুতিমান এই কবি। বাংলা কবিতায় স্থায়ীভাবে থাকতে এসেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লক্ষ করতে ভোলেননি যে, তরুণ এই কবির ছন্দের হাতটি ‘একেবারে পাকা’। বুদ্ধদেব বসু শুধু যে কবিতা পত্রিকাতেই প্রথম ছেপেছিলেন অরবিন্দ গুহের একগুচ্ছ কবিতা তা-ই নয়, ১৯৫৬ সালে যখন তাঁর সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলো, দেখা গেল, তরুণতম কবি হিসেবে তিনি সেখানে অরবিন্দ গুহকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ এক বিরল সম্মান। আরো এক বিরল সম্মান এলো ২০০৭ সালে, দেখাসাক্ষাৎ কাব্যগ্রন্থের জন্য যখন দ্বিতীয়বার রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হলো অরবিন্দ গুহকে।

অন্য পরে কা কথা, আমি নিজেও অরবিন্দ গুহের কবিতা পড়েই যে জড়িয়ে পড়েছি আধুনিক বাংলা কবিতার চিরস্থায়ী মোহে, সে-কথা বারবার স্বীকার করি। সেই ১৯৫০-৫১ সালে আমি যখন নিতান্ত ইস্কুলের ছাত্র, কীভাবে যেন হাতে পেয়েছিলাম প্রেমেন্দ্র মিত্র-সম্পাদিত একটি আধুনিক কবিতার সংকলনগ্রন্থ, প্রেম যুগে যুগে। সেখানে আর কে কে ছিলেন, কী কী পড়েছি – সব ভুলে গিয়েছি, শুধু মনে আছে একটি কবিতার কথা যা আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। করে তুলেছিল ভূতগ্রস্ত। এভাবেও লেখা যায়? এত সহজ ভাষায়, এত অনায়াস ছন্দে, এমন মসৃণ গতিতে! সব মিলিয়ে, সব ছাপিয়ে, সব ভাসিয়ে এমন সর্বগ্রাসী প্রভাবে আচ্ছন্ন করে? কবিতাটির নাম ‘অলস মুহূর্তের প্রার্থনা’। কবির নাম অরবিন্দ গুহ।

শুরু হচ্ছে এইভাবে –

হে ঈশ্বর, তুমি তাকে একবার ভীষণ অসুখ

দাও। বিছানায় শুয়ে যেন তার

আকাশ-পাতাল ভেবে দিন যায়। যেন জ্বরের ব্যথায় তার মুখ

আশ্চর্য করুণ হয়।

হ্যাঁ। এই কবিতার অনুসরণেই আমার প্রথম লেখার অপচেষ্টা। ‘সকালের দেওঘর’ নামের দশ-বারো লাইনের একটি পদ্যপ্রয়াস। আর কী আশ্চর্য সে লেখা কবিতা বিভাগে ছাপা হয়েও গেল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়! ১৯৫২-র নভেম্বরে। এরপর তো হাতে এসেছে দক্ষিণ নায়ক। প্রথম পুরুষ। নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত। প্রায় পরপর অরবিন্দ গুহের একেকটি কাব্যগ্রন্থ। বুঁদ হয়ে পড়েছি। লক্ষ করেছি অকল্পিতপূর্ব চকিত বিশেষণের ব্যবহারে, স্বগত সংলাপে প্রশ্নোত্তর এনে, আর ছন্দে-মিলে, উপমা-উৎপ্রেক্ষায়, এমনকি স্তবক থেকে স্তবকান্তরে ছন্দের নানান বদলেও কীভাবে ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে উঠছেন আমার দ্রোণাচার্য এই কবি। কীভাবে এই শেষ বইতেও কত অমোঘ কত সত্যবদ্ধ উচ্চারণমালা তাঁর –

দূর ভস্মস্তূপ থেকে কিছু অগ্নিকণা উড়ে আসে

অন্ধকার চৈত্রের বাতাসে।

খুনীরা কাছেই আছে, মুখে অহিংসার শান্ত বুলি,

তাদের সকালবেলা আমাদের হিসেবে গোধূলি।

(‘অহিংস’, প্রস্থানসময় উপস্থিত)

কিংবা,

আশা করে যেখানেই যাই –

শ্যামবাজার অথবা বেহালা,

সর্বত্র সমান সাজে আছে

জীবিত রক্তাক্ত মু-মালা।

(‘মু-মালা’, ওই)

অনুভব করি যখন তিনি লেখেন ‘নিজের পায়ের চিহ্ন কোনো কোনো পাখি রেখে যায়/ দূরের আকাশে কিংবা কাছের সবুজ গাছপালায়’ – তখন তিনি নিজের কথাই হয়তো অগোচরে বলেন। তাঁর অনুপস্থিতিই হয়তো বাধ্য করবে গেয়ে উঠতে : ‘বনে যদি ফুটল কুসুম, তবে নেই কেন সেই পাখি, নেই কেন?’

বাংলা কবিতার আকাশে আর সবুজ গাছপালাতেই জড়িয়ে থাকবেন নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত চিরপ্রেমিক এই কবি, যাঁর নাম অরবিন্দ গুহ।