চে : এক কিংবদন্তি-পুরুষ

মতিউর রহমান

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বনজঙ্গলে ঘেরা বলিভিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম লা হিগুয়েরাতে চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয়েছিল। বলিভিয়ার সামরিক সরকার চে-কে বন্দি অবস্থায় বিচার না করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। চে-র বিরুদ্ধে পুরো অভিযান চলেছিল সিআইএর নেতৃত্বে। এ-হত্যাকা–র প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে একজন কিংবদমিত্ম গেরিলা হিসেবে চে শক্তিশালী একটি বৈশ্বিক রূপ পেয়ে যান। সারাবিশ্বে সংবাদপত্র ও টিভিতে তাঁর মৃতদেহের ছবি প্রচারিত হয়ে যায়। তারপর থেকে যিশুখ্রিষ্টের মতো প্রতিকৃতিতে চে হাজির হয়ে যান লাল পোস্টার, গান, কবিতা, বই আর সিনেমার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় সব শহরে, রাসত্মায়-রাসত্মায়, মিছিলে আর স্লোগানে।

দেশে-দেশে চে-র ঘর আছে

কিউবার সফল বিপ্ল­বের কমান্ড্যান্ট হিসেবে মৃত্যুর আগেই চে হয়ে উঠেছিলেন সারাবিশ্বের বিপ্ল­বীদের অনুপ্রেরণার উৎস। মৃত্যুর পর তাঁর জীবন, তাঁর লেখা ও বক্তৃতাগুলো নতুন শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়। দেশে-দেশে মানুষের মধ্যে নতুন প্রণোদনা তৈরি করে। চে গুয়েভারার মহান আত্মত্যাগ আর মৃত্যু লাতিন আমেরিকার দেশে-দেশে এবং একই সঙ্গে লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ, রোম, প্রাগ, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা মতাদর্শের দল ও গোষ্ঠীর কাছে মহত্ত্বের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৮ সালে প্যারিসের ছাত্র ও যুব বিদ্রোহে লাল পতাকা হয়ে সামনে ছিলেন চে গুয়েভারা।

মনে পড়ে, সেই ১৯৬৮ সালের শেষে আমরা পেয়ে যাই জলপাই রঙের প্রচ্ছদে চে-র বলিভিয়ান ডায়েরি। তখন ঢাকায়, বাংলাদেশে পাকিসত্মানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ের প্রস্ত্ততি চলছে। তারপর ১৯৬৯-এর জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারির গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারে সারা বাংলাদেশ উত্তাল। নতুন-নতুন বিপ্লবী-উদ্যোগের সূচনা হচ্ছে। সেই সময় আমাদের প্রিয় রণেশ দাশগুপ্ত দৈনিক সংবাদে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন লাতিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম। সেগুলো আমরা তখন পড়ছি গোগ্রাসে। এমনকি চে-র আত্মত্যাগে শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতো অন্তর্মুখী ও বিমূর্ত শিল্পীও আমাদের কাছ থেকে তাঁর বলিভিয়ান ডায়েরি নিয়ে পড়ে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। ঊনসত্তর থেকে একাত্তরের সেই দুঃসাহসিক দিনগুলোয় চে গুয়েভারা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে উজ্জ্বল পতাকার মতো। সেই দিনগুলোয় চে-র লেখা গেরিলাযুদ্ধ বইটি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে-হাতে ঘুরেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তা থেকে গেরিলাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, যুদ্ধের কৌশল শিখেছেন। তাই শুধু পাকিসত্মান নয়, তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে ‘জয় বাংলা’র জয় হয়েছে।

শুধু ষাটের দশকের ছাত্র-যুববিদ্রোহ নয়, ‘চে বেঁচে আছেন’ সেস্নাগানটি এখনো দেশে-দেশে সংগ্রামী আর বিপ্ল­বীদের সাহসী আহবান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বাতিসত্মা শাসন উৎখাতে চে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। শুরুতে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিলেও তাঁর সাহস, যুদ্ধ-কৌশল, নেতৃত্ব তাঁকে দ্রম্নত গেরিলা বাহিনীর প্রথম কমান্ড্যান্ট পদের মর্যাদা এনে দেয়। কিউবার বিপ্ল­বের পর শিল্পমন্ত্রী আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কিউবার বিপ্ল­বের নেতা হিসেবে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ান। দেশে-বিদেশে সেই দিনগুলোয় বহু বিষয়ে চে শত-শত নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তৃতা করেছেন এবং সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

তারপর লাতিন আমেরিকার চেয়ে আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের রণক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন চে গুয়েভারা। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে কিউবার যোদ্ধাদল নিয়ে কঙ্গোয় যান গেরিলাযুদ্ধ শুরু করতে। সেখানে অগ্রসর হতে পারেননি, পরাজিত হন। কাস্ত্রোর অনুরোধে ডিসেম্বরে  যান তানজানিয়া ও প্রাগ হয়ে হাভানায়। তিনি ফিরতে চাননি। কঙ্গো যাওয়ার আগেই চে কিউবার নাগরিকত্ব, দল ও রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব পরিত্যাগ করেছিলেন।

সে-বছরে কিউবায় ফিরে বলিভিয়ায় গেরিলাযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি ও গেরিলা দল গঠনে ব্যসত্ম হয়ে পড়েন। লক্ষ্য ছিল বলিভিয়ায় গেরিলাযুদ্ধ শুরু করে স্বদেশভূমি আর্জেন্টিনা এবং পরে পেরুতে তা প্রসারিত করবেন। চে ১৯৬৪ সাল থেকেই বলিভিয়ায় গেরিলাযুদ্ধের প্রস্ত্ততি শুরু করেছিলেন। চে-র বিশ্বসত্ম বেশ কয়েকজন যোদ্ধা বলিভিয়ায় যান। বলিভিয়াকে বিপ্লবের ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করার শুরুতে চে-র সিদ্ধামেত্মর সঙ্গে কাস্ত্রোর কিছুটা মতভিন্নতা হয়েছিল। কাস্ত্রোর মত ছিল, বলিভিয়া গেরিলা লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি হয়নি। গেরিলাযুদ্ধে ক্যাম্প, যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং মানুষের সমর্থনের ভিত্তি গড়ে তোলা ছিল জরুরি। কিন্তু কাস্ত্রোর ভাষায়, চে ‘অস্থির’ হয়ে পড়েছিলেন। আবারো চে-র নিজস্ব দল গঠন এবং গেরিলা তৈরির কাজে সব সহযোগিতা দিয়েছিলেন কাস্ত্রো ও তাঁর সরকার। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরেই চে ‘দুই, তিন, অনেক ভিয়েতনাম সৃষ্টি’র বিপ্ললবী প্রত্যয় নিয়ে বলিভিয়ায় চলে যান। কিউবা বিপ্ললবে যিনি অসম সাহসী সংগঠক ও যোদ্ধা এবং তাত্ত্বিক নেতার ভূমিকা পালন করলেন, তিনিই আবার বলিভিয়ায় পরাজিত হয়ে প্রাণ দিলেন। চে-র গেরিলা দল স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন পায়নি, গ্রামের কৃষক পাশে দাঁড়ায়নি এবং শহরের জনগণের কাছ থেকে সাহায্যও পায়নি।

চে গুয়েভারা ছিলেন একজন চিকিৎসক, যিনি তাঁর পেশা ছেড়ে দিয়ে জন্মভূমি আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জন্ম আর্জেন্টিনায়, গুয়েতেমালায় বিপ্ল­বী হয়েছি, কিউবায় লড়েছি, কিউবান হয়েছি। আমি একজন লাতিন আমেরিকান। আমি লাতিন আমেরিকার যে-কোনো দেশের জন্য প্রাণ ত্যাগে প্রস্ত্তত। বিনিময়ে আমার কিছুই চাওয়ার নেই।’ মেক্সিকোয় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে চে-র পরিচয় হয়। তারপরই চে কিউবার বিপ্ল­বে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

 

শেষ যাত্রা

লাতিন আমেরিকা আর পৃথিবীর নিপীড়িত-নিঃস্ব মানুষের জন্য চে-র জীবনসংগ্রাম শুরু হয়েছিল। বলিভিয়ায় তাঁর যুদ্ধের যাত্রা শেষ হয় যখন তিনি হাঁটুতে গুলির আঘাতে আহত হন। শত্রম্নর গুলি লেগে চে-র হাতের রাইফেলটি পড়ে যায়। শেষ এই যুদ্ধের সময় যেন অমোঘ নিয়তির দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গিয়েছিলেন চে। এমন এক সময়েই কিংবদমিত্ম হিসেবে চে-র প্রতিমূর্তি আরো বড় হয়ে উঠল লা হিগুয়েরা আর ভ্যালেগ্রান্দেতে। ৮ অক্টোবরে আহত হয়ে শত্রম্নর হাতে ধরা পড়েন জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুর পর সেই যিশুখ্রিষ্টসদৃশ বীর, তাঁর দুটি অপরূপ চোখ দিয়ে যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর শেষ সময়ের অপরিসীম সাহসী উক্তিগুলোর মধ্যে একটি ছিল, ‘কাপুরুষ, মারো, গুলি মারো, তোমাদের গুলিতে মরবে শুধু মানুষটি।’ বলিভিয়ার সরকার মিথ্যা প্রচার করে চলছিল, চে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সে-মিথ্যা দ্রম্নতই প্রকাশ পেয়ে যায়।

আসলে সেই ৯ অক্টোবর দুপুরের কিছুটা সময় আগে চে এবং তাঁর সঙ্গীদের আটক করার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বলিভিয়ার সেই গ্রাম লা হিগুয়েরার ছোট স্কুলঘরে সার্জেন্ট মারিও টেরেন ঢোকেন সরকারের নির্দেশ পালন করতে। ঘরে ঢুকে তিনি দেখতে পান, চে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন; অপেক্ষা করছেন। সৈনিকের ঘরে ঢোকার উদ্দেশ্য চে বুঝতে পারেন। তিনি শান্তভাবে তাঁকে উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। সার্জেন্ট টেরেন ভীত হয়ে কাঁপতে থাকেন, দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু টেরেনকে ঘরে ফিরে গিয়ে আর বিলম্ব না করে চে-কে গুলি করে হত্যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সৈনিকটি তখনো কাঁপছেন। স্কুলঘরে ফিরে গিয়ে চে-র দিকে না তাকিয়ে তাঁর রাইফেল থেকে পরপর নয়টি গুলি করেন চে-র বুকে এবং বুকের পাশে, যা তাঁর দেহ ভেদ করে দেয়ালে বড়-বড় গর্ত তৈরি করে ফেলে। তারপর তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ ভ্যালেগ্রান্দেতে নিয়ে যাওয়া হয় হেলিকপ্টারে। সেখান থেকে শেভ্রোলে ট্রাকে করে দ্রম্নত নেওয়া হয় সেন্ব ডি মাল্টা হাসপাতালে। এখানেই ধুয়েমুছে তাঁর দেহ থেকে রক্ত পরিষ্কার করা হয়। তারপর বলিভিয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আলফ্রেদো ওভান্দোসহ অন্য সামরিক কর্মকর্তারা নিহত চে-কে দেখতে আসেন। ডাক্তার ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের শেষে সাংবাদিক, আরো অনেক       কৃষক আর সাধারণ মানুষ এবং সৈন্য সারারাত লাইন করে চে-কে দেখে, তাঁর জ্যাকেটবিহীন খোলা দেহ, কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত গেরিলা প্যান্ট। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায়, চে তখন আশ্চর্যজনকভাবে জীবন্ত ছিলেন। চোখ দুটি শুধু খোলাই ছিল না, অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছিল। দুটি ঠোঁটে লেগে ছিল মর্মস্পর্শী হাসি। চে-র এই যিশুখ্রিষ্টসদৃশ ছবিই ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের সর্বত্র। এভাবেই চে-র দেহ ২৪ ঘণ্টা ধরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। বিস্ময়ে-বেদনায় তাঁকে দেখে যাচ্ছিল মানুষ আর মানুষ।

এরপর বলিভীয় কর্তৃপক্ষ চে-র মৃত্যুর প্রমাণ রাখার জন্য তাঁর দুই হাত কেটে ও প­vস্টারে মুখের ছাপ নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে চে-কে কবর দেয়। কোথায় তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে, তা গোপন রাখা হয়। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে, ১৯৬৮ সালের মধ্য-মার্চে প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট, পরে সিআইএ এজেন্ট ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তনিও আরগুয়েডেস গোপনে এক সাংবাদিক বন্ধুর মাধ্যমে চে-র ডায়েরির ফটোকপি কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। জুলাইয়ের প্রথম দিনে কিউবা সরকার এটি প্রকাশ করে। দ্রম্নত এই বই কিউবা থেকে লাতিন আমেরিকা, ইউরোপসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আরগুয়েডেস আরেক ইতিহাস রচনা করেছিলেন রাসায়নিক উপাদানে সংরক্ষিত চে-র দুই হাত লেখকবন্ধু জর্জ সুয়ারেজের হাতে তুলে দিয়ে। চে-র মৃত্যুর আটদিন পর তিনি এটি তাঁর হাতে তুলে দেন। কিন্তু নানা ঘটনায় এগুলো কিউবায় পৌঁছাতে দুই বছরের বেশি সময় লাগে। ১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি তা কিউবায় পৌঁছায়। আর বিস্ময়কর ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে কিউবা ও আর্জেন্টিনার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ভ্যালেগ্রান্দেতে হাতবিহীন চে এবং তাঁর সঙ্গীদের দেহাবশেষ খুঁজে পান। সেসব দেহাবশেষ কিউবায় পাঠানো হলে কিউবার সামত্মা ক্লারায় (যে-শহর চে মুক্ত করেছিলেন) নতুন স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে তা সমাহিত করা হয়।

 

নেরুদার স্মৃতিকথায় চে

প্রত্যন্ত গ্রাম লা হিগুয়েরাতে শত্রম্নর গুলিতে নিহত হওয়ার পর এর্নেসেত্মা চে গুয়েভারার ব্যাগ থেকে সবুজ, দুমড়ানো একটি নোটবুক পাওয়া গিয়েছিল। নোটবুকটি চে সব সময় নিজের কাছে রাখতেন। কোনো রাজনৈতিক লেখা বা কোনো সামরিক পরিকল্পনা নয়, এটি ছিল চে-র প্রিয় কবিতার একটি সংকলন। আর নোটবুকের কবিতাগুলো ছিল চে-র নিজের হাতে লেখা। সংকলনের ৬৯টি কবিতার মধ্যে কিছু কবিতা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ স্পেনীয় কবি চিলির পাবলো নেরুদার। কিউবার জাতীয় কবি নিকোলাস গিয়েন এবং গত শতাব্দীর অন্যতম কাব্যপ্রতিভা পেরুর সেজার ভায়েহোর কবিতাও ছিল সংকলনটিতে।

২০০৭ সালে চে-র ৪০তম মৃত্যু দিবসের এক মাস আগে মেক্সিকোর প্রকাশনা সংস্থা প­vনেটা তাঁর হাতে-লেখা কবিতার সংকলনটি বই আকারে বের করে। মেক্সিকান লেখক ও চে-র জীবনীকার প্যাকো ইগনাসিও বইটির ভূমিকা লিখেছেন। তিনি বলেছেন, চে-কে বন্দি করার পর সেনারা তাঁর ব্যাগ খুঁজে দুটি নোটবুক পায়। একটিতে ছিল হাভানার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় গোপন সংকেত; দ্বিতীয়টি এই সবুজ নোটবুক। চে-র সহযোদ্ধাদের কথা থেকে জানা যায়, এই সবুজ নোটবুকটি তিনি ১৯৬৩ সালে তানজানিয়া যাওয়ার পথে কিনেছিলেন। এই নোটবুকে কিছু লেখার জন্য অবসরে প্রায়ই তিনি গাছে উঠে বসতেন। প্রকাশনা সংস্থা প­vনেটা নোটবুকটি কীভাবে পেয়েছে, তা জানাতে চায়নি। তবে বলেছে, বইটি আসলেই চে-র কি না, এটা নিশ্চিত হতে তাদের দুই বছর সময় লেগেছে। লেখক প্যাকো ইগনাসিও বলেন, ‘রাজনীতি ও আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে জড়িত কবিতার এক অন্তরঙ্গ সংকলন এটি। চে-র কিংবদমিত্মতে এটি আরেকটি উপাদান যোগ করল।’ এসব খবর আমরা পেয়েছি লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা দি অবজারভার (৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭) থেকে।

তবে বলিভিয়ায় লড়াইয়ের ক্ষেত্রে চে-র ব্যাগে কী ছিল, সে-ব্যাপারে ভিন্ন একটি তথ্যও পাওয়া যায়। সেটি আমরা পাই চিলির কবি পাবলো নেরুদার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ মেমোয়ার্স (পৃ ৩২৩) থেকে। নেরুদা সেখানে চে গুয়েভারার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনা লিখেছেন। ফরাসি লেখক রেজেস দেব্রের মাধ্যমে তিনি জেনেছিলেন, বলিভিয়ার পাহাড়ে একেবারে শেষ পর্যন্ত তাঁর ডুফেল ব্যাগে (দড়ি দিয়ে বন্ধ করা যায় এমন ব্যাগ) শুধু দুটি বই রাখতেন চে; একটি অঙ্কের, অন্যটি তাঁর (নেরুদার) কবিতার বই কামেত্মা জেনারেল। রেজেস দেব্রে, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত জনপ্রিয় বই রেভ্যুলেশন ইন রেভ্যুলেশনের লেখক কিউবা বিপ্ললবের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি বলিভিয়ায় চে-র সঙ্গে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং একসময় গেরিলাযুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য কাজ নিয়ে চলে আসার সময় ধরা পড়ে যান। বিচারে তাঁর ৩০ বছর জেল হয়েছিল। পরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গল ও প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে দেব্রে মুক্তি পান।

প্রকাশনা সংস্থা প­vনেটা আর রেজেস দেব্রের তথ্যের মধ্যে যে পার্থক্য বা বিভ্রামিত্ম রয়েছে, তাতে কোনটি আসল সত্য বলে ধরে নেব, তা নিয়ে চে-সম্পর্কিত বহু বই ঘাঁটাঘাঁটি করেও অন্য কোনো তথ্য আমরা পাইনি। তবে সব ভেবে আমাদের মনে হয়, প­vনেটা বা প্যাকো ইগনাসিওর কথাকে আমরা সত্য বলে মেনে নিতে পারি। কারণ, ৪০ বছর পর বহু খোঁজাখুঁজি করে নিশ্চিত হয়েই তারা চে-র কবিতার স্বহসেত্ম লিখিত নোটবুকের সংকলনটি প্রকাশ করেছে। আর রেজেস দেব্রের সঙ্গে পাবলো নেরুদা যখন কথা বলছিলেন, তখনো বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার সশস্ত্র গেরিলা অভিযান এবং তাঁর শেষ সময়ের সব তথ্য প্রকাশ পায়নি। তবে এ-তথ্য নিশ্চিত যে, কিউবার মুক্তির জন্য গেরিলাযুদ্ধের সময় সর্বক্ষণ চে গুয়েভারার সঙ্গে ছিল পাবলো নেরুদার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ কামেত্মা জেনারেল

 

বন্দুকের পাশে কবিতা

চে-র সঙ্গে পাবলো নেরুদার প্রথম এবং একমাত্র সাক্ষাৎকারটি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। দেখা হয়েছিল হাভানায়। চে সাক্ষাতের সময় দিয়েছিলেন মধ্যরাতে। তাঁর অর্থ-দপ্তরে নেরুদা গিয়ে পৌঁছেছিলেন রাত একটায়।

নেরুদার আত্মজীবনী মেমোয়ার্সের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, ‘…সে রাতে চে-র পরনে ছিল বুট আর সামরিক পোশাক, কোমরে পিসত্মল। অফিসের ব্যাংকিং আবহে তাঁর পোশাকটাকে লাগছিল পুরোদস্ত্তর বেমানান। শ্যামলা, ধীরভাষী চে-র কথায় আর্জেন্টাইন টান স্পষ্ট। তিনি হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে আপনি পামপায় (আর্জেন্টিনার তৃণভূমি) ধীরে-সুস্থে একটার পর একটা ‘মাতে’ (একধরনের পানীয়) খেতে-খেতে কথা বলতে পারেন।’ তাঁর বাক্য ছোট-ছোট আর হাসি দিয়ে শেষ হয়, যেন আলোচনাটাকে অমীমাংসিত রাখতে চান।

‘ওই রাতে চে আমাকে এমন একটা কথা বলেন, শুনে চমকে উঠেছিলাম। তবে এ-কথাটার মধ্যেই হয়তো নিহিত ছিল তাঁর নিয়তি। আমার চোখ থেকে অফিসের অন্ধকার জানালায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁর দৃষ্টি। কিউবায় সম্ভাব্য দক্ষিণ আমেরিকান আগ্রাসন নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। হাভানার রাসত্মায় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানে আমি বালুর বসত্মা ছড়ানো-ছিটানো দেখেছি। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘যুদ্ধ… যুদ্ধ… আমরা সব সময় যুদ্ধবিরোধী, কিন্তু একবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পরে যুদ্ধ ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। তারপর সর্বদা খালি যুদ্ধের কাছেই ফিরে যেতে চাই আমরা।’

‘আমার বই কামেত্মা জেনারেল সম্পর্কে তিনি যা বললেন, শুনে আমি কৃতার্থ। সিয়েরা মায়েস্ত্রায় রাতে গেরিলাদের এটা পড়ে শোনাতেন তিনি। এত বছর পর এখনো ভাবলে আমার শরীর কেঁপে ওঠে, যখন মনে পড়ে, মৃত্যুতেও তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিল আমার কবিতা।

‘আমার সুবিধার্থে তিনি যেন সশব্দে চিমত্মা করছিলেন। তাঁর কথা শুনতে-শুনতে চমকে উঠেছিলাম। যুদ্ধ আমার কাছে গন্তব্য নয়, সমূহ বিপদ।

‘আমরা বিদায় বললাম, কখনো আর তাঁকে দেখিনি। তারপর বলিভিয়ার জঙ্গলে তাঁর লড়াই, তাঁর করুণ মৃত্যু। কিন্তু এখনো চে গুয়েভারা আমার কাছে এমন এক ভাবুক, সাহসিক লড়াইয়ে যিনি অস্ত্রের পাশে সব সময় কবিতাও রাখতেন।’ (পৃ ৩২৩)

চে গুয়েভারার সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক বছর পর তাঁর হত্যার খবর জেনে নেরুদা তাঁর মেমোয়ার্সে লিখেছিলেন মর্মস্পর্শী কিছু কথা। সেগুলো এরকম : ‘দরিদ্র বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার সরকারি হত্যাকা- ডেকে এনেছিল চরম ঝঞ্ঝা। টেলিগ্রামে তাঁর মৃত্যুর বার্তা সমগ্র বিশ্বকে আলোড়িত করে, সেটা ছিল যেন এক সর্বব্যাপী হিমশীতল শ্রদ্ধার-ভূকম্পন। তাঁর বীরোচিত ও বিয়োগান্ত জীবনের প্রতি শেষশ্রদ্ধা জানাতে রচিত হয় লাখ-লাখ শোকগাথা। সারা পৃথিবী থেকে ভক্তকুল নিবেদন করে শ্রদ্ধাঞ্জলি, কবিতায় – দীর্ঘ হয় কবিতার মিছিল। কিউবা থেকে একজন সাহিত্যামোদী কর্নেলের টেলিগ্রাম আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তিনি আমার কাছ থেকে একটি কবিতা চেয়েছিলেন, যা আজো লেখা হয়ে ওঠেনি।

‘আমি বিশ্বাস করি, তাঁকে নিয়ে লেখা একটি উপযুক্ত শোকগাথায় অবশ্যই তাঁর হত্যার বিরুদ্ধে কেবল উচ্চকিত, শাণিত প্রতিবাদই নয়, একই সঙ্গে তাঁর জীবনের বেদনাদায়ক উপাখ্যান প্রতিধ্বনিত হতে হবে পরম মমতায়। আমি সেই পঙ্ক্তিমালার প্রতি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকব, যতক্ষণ না তা আমার হূদয় ও আমার রক্তের শিরায় সঞ্চারিত হয়।

‘আমি এটা ভেবে গভীরভাবে স্পন্দিত যে আমিই একমাত্র কবি, যাকে এই মহান গেরিলা নেতা তাঁর দিনপঞ্জিতে উদ্ধৃত করেন। আমি স্মরণ করতে পারি একদিনের কথা। সেদিনটিতে সার্জেন্ট রেতামার উপস্থিত ছিলেন। তার সামনে চে আমাকে বলেছিলেন, তিনি প্রায়শই সিয়েরা মায়েস্ত্রার টগবগে বিনয়ী, শ্মশ্রম্নম–ত বীরোচিত গেরিলাদের সামনে আমার লেখা কামেত্মা জেনারেল থেকে পড়ে শোনান। তাঁর দিনপঞ্জির যেখানে সতর্কীকরণের সুর উদ্দীপ্ত, সেখানে তিনি আমার ‘কামেত্মা পারা বলিভার’ (‘বলিভিয়ার জন্য গান’) থেকে বেছে নিয়েছেন একটি বাক্য : ‘এক সাহসী ক্যাপ্টেনের মতোই তোমার ছোট মৃতদেহখানি…’।’ (পৃ ২৯৯) নেরুদার কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে চে যে ক্যাপ্টেনের কথা লিখেছিলেন, এই তরুণের প্রকৃত নাম ছিল এলিসিও রেইস; বলিভিয়ায় চে-র সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন সান লুইস নামে। চে তাঁকে খুব ভালোবাসতেন।

চে গুয়েভারা কবিতা ভালোবাসতেন। তিনি কবিতা লিখেছেন। চে-র প্রিয় কবি ছিলেন স্পেনীয় রিপাবলিকান ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, আমেত্মানিও মাচাদো, রাফায়েল আলবের্তি প্রমুখ। স্পেনীয়, কিন্তু মেক্সিকোতে নির্বাসিত কবি লেওন ফিলিপের কবিতার বই থাকত তাঁর বালিশের নিচে। পরে চে তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি একজন ব্যর্থ কবি।’ তিনি পড়তেন ওয়াল্ট হুইটম্যান ও রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার স্পেনীয় অনুবাদ। বোঁদলেয়ার পড়তেন গভীর আগ্রহ নিয়ে। তবে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, চিলির কবি পাবলো নেরুদা ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। এ-তথ্য আমরা পাই চে যখন কিশোর বা যৌবনের দ্বারপ্রামেত্ম, বয়স যখন তাঁর ১৭ কি ১৮, তখনই আবিষ্কার করেছিলেন নেরুদার সেই জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান। এই কবিতার বই থেকে কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন কারমেন কর্ডোভাকে। সম্পর্কে জ্ঞাতি বোন, কিন্তু বন্ধুর চেয়ে বেশি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে। শুধু কারমেন কর্ডোভা নয়, বুয়েনস এইরেসের অনেক তরুণীই তখন চে-র সৌন্দর্যে ভীষণ আকৃষ্ট হতো। আসলেই চে ছিলেন এক অসাধারণ সুদর্শন পুরুষ।

 

কবিতার চে

চে গুয়েভারা কিশোর বয়সেই কবিতা পাঠ করতেন। সে-সময়েই সতেরো শতাব্দীর স্পেনীয় কবি ফ্রান্সিসকো দে কুয়েভেদোরের কবিতা মুখস্থ করে আবৃত্তি করতেন। স্কুলজীবন থেকেই তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল অঙ্ক, প্রাকৃতিক ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ও ইতিহাস। স্পেনীয় ভাষার সঙ্গে ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন মায়ের কাছ থেকে। লেখালেখি আর গানেও আগ্রহ ছিল। তাঁর দুই বন্ধু বোযো আগুইলার আর আলবার্তো গ্রানাদোর কাছ থেকে জানা যায়, তখন ফ্রয়েড থেকে জ্যাক লন্ডন, আনাতোল ফ্রাঁস, এমিলি জোলা, লিও টলস্টয়সহ অনেক লেখকের বই তিনি পড়তেন। বিশ্ব ইতিহাস নিয়ে ২৫ খ–র বই পড়েছিলেন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে। তাঁর ১৬৫ পৃষ্ঠার প্রথম হাতে-লেখা নোটবুকে প্রেম, বিশ্বাস, বিচার, মৃত্যু, ঈশ্বর, নৈতিকতাসহ বহু বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা ছিল। পরের ১০ বছরে এ-রকম সাতটি নোটবুক লিখেছিলেন। এগুলোতে জওহরলাল নেহ্রম্ন থেকে নিৎসে, ফ্রয়েড, মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিন থেকেও উদ্ধৃতি ছিল। গ্যেটের দর্শন ছিল তাঁর প্রিয়। নেহ্রম্নর ভারতের সন্ধানে গ্রন্থটি গভীরভাবে পাঠ করেছিলেন চে। তাঁর বন্ধু ওসভাল্ডো বিডিনস্ট পেযারের মতে, ‘সাহিত্য থেকেই সবকিছু শুরু’ ছিল চে গুয়েভারার। তাঁরা দুজনে পড়েছেন উইলিয়াম ফকনার, ফ্রাঞ্জ কাফকা, আলবেয়ার কাম্যু এবং জ্যঁ পল সার্ত্রের উপন্যাস। অনেক পরে, জ্যঁ পল সার্ত্রে এবং সিমন দ্য বোভার হাভানায় গেলে চে-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁদের। সার্ত্রে চে-কে বলেছিলেন, একজন সম্পূর্ণ মানুষ।

বই চে গুয়েভারাকে সারাজীবন সঙ্গ দিয়েছে। জ্ঞানের উৎস আর বুদ্ধিবৃত্তিক তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তিনি সবসময় বইয়ের আশ্রয়ে ছিলেন। একই সঙ্গে ছিল তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও বিশেস্নষণী ক্ষমতা। তাঁর প্রথম জীবনে সংগ্রহ করা বইয়ের তালিকাও ছিল দীর্ঘ। এই সংগ্রহ থেকে চে-র সাংস্কৃতিক আগ্রহের ব্যাপ্তিও স্পষ্ট হয়।

বেশ কয়েক বছর আগে আত্মতিকৃতি : চে গুয়েভারা বইয়ের সম্পাদক ভিক্টর ক্যাসাস লিখেছেন, চে যে-বিষয়টিকে পাঠ করতেন, তা হলো ভালোবাসা। পাঠের বিষয় আর পাঠকের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কটি তিনি বোধ করতেন। এ-বইটিতে এমন অনেক ছবি স্থান পেয়েছে যেখানে চে পড়ছেন। এ-বইটিতে চে-র লেখা চারটি পুসত্মক সমালোচনা সংকলিত হয়েছে। বইগুলো হলো – ১. মার্তি : এক কিউবান মুক্তিযোদ্ধার শেকড় ও পাখনা, ২. এক শ্রমিক কার্লোস ফালার উপন্যাস মামিতা ইউনাই, ৩. পেরুর কবি সেজার ভায়েহোর ১৯৩১ সালে রাশিয়া এবং ৪. পাবলো নেরুদার কামেত্মা জেনারেল

পাবলো নেরুদার কামেত্মা জেনারেল সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় চে লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর দিয়ে সময় যখন নিসত্মরঙ্গভাবে বয়ে যাবে, মানুষ যখন সমানভাবে তার অপ্রতিরোধ্য স্বাধীনতার দেখা পাবে, তখন নেরুদার এই রচনা বিবেচিত হবে আমেরিকার দেশগুলোর ঐকতানের কবিতা হিসেবে।

এই কবিতা একটি সূচনাফলক এবং সম্ভাব্য এক সম্মিলন। এর মধ্যকার সবকিছু, এমনকি এর শেষ দিকের লাইনগুলো এক অনাস্বাদিত প্রশ্বাসের আনন্দ বয়ে আনে। এই কবিতা স্ফটিকের মতো সে-দৃশ্যকে চিত্রায়িত করেছে যখন কবি নিজের সঙ্গে কথোপকথন স্থগিত করে আমাদের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে, জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন।’

কামেত্মা জেনারেল বইয়ের এ-আলোচনাটিতে নেরুদাকে নিয়ে অভিভূত চে একের পর এক সত্মবক উদ্ধৃত করে তাঁর চমৎকার সব মন্তব্য যোগ করেছেন। বিসত্মারিতভাবে বিশেস্নষণ করেছেন এবং তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আলোচনার শেষে ফ্রাঁসোয়া ভিলোঁর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘এটি লাতিন আমেরিকার মহত্তম কবিতার বই, আমাদের সময়ের মহাকাব্য, যেখানে আমাদের জন্মভূমির সকল ভালো এবং মন্দ তাদের ডালপালাসহ চিত্রায়িত হয়েছে।’

আমরা দেখি, সারাজীবন কবিতার সঙ্গে চে-র ছিল এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দ্বিতীয় স্ত্রী আলিয়েদা মার্তের সঙ্গে নানা বিষয়ে চে-র মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু তাঁরা পরস্পরের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল ও বিশ্বসত্ম ছিলেন। উভয়ের হূদয়ে পরস্পরের জন্য ছিল গভীর ভালোবাসা। শোয়ার ঘরে একামেত্ম আলিয়েদার জন্য চে কবিতা পাঠ করতেন, যা তাঁকে গভীর আনন্দ দিত। তখন প্রায়ই আবৃত্তি করতেন তাঁর প্রিয় কবি পাবলো নেরুদার কবিতা।

হাভানা থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগে চে আলিয়েদার জন্য তাঁর প্রিয় ভালোবাসার কবিতাগুলো টেপ রেকর্ডারে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করে রেখে গিয়েছিলেন। তার মধ্যেও ছিল পাবলো নেরুদার বেশ কয়েকটি কবিতা।

চে-র বয়স যখন ২০ বছর, তখন অর্থের জন্য কাজ করেছেন বুয়েনস এইরেসে। প্রচ- পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। আবার পড়াশোনা করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে। প্রায়ই ভুগতেন হাঁপানিতে। সেই শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুগেছেন এ-রোগে। ২০ বছর বয়সে জীবনের কঠিন সংকটপূর্ণ সময়ে চে-র প্রিয় দাদির মৃত্যু এবং মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে। অন্য ভাইবোনেরাও অর্থ রোজগারের জন্য কাজ করেছেন, তখন অস্থির আবেগে চার পৃষ্ঠার এক কবিতা লেখেন চে। মুক্তছন্দে লেখা সেই কবিতার বিষয় ‘মৃত্যু’। দিনটি ছিল ১৭ জানুয়ারি ১৯৪৭। ওই কবিতার কয়েকটি লাইন, ‘মৃত্যু, হ্যাঁ, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে/ বেয়নটের ফলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে…/ তা যদি না হয়, তো ডুবে মরা নয়।/ আমার নামকে ছাড়িয়ে যাবে/ আমার স্মৃতি, তা হলো লড়াই করা ও/ যুদ্ধ করে মরা।’

মাত্র কুড়ি বছরের এক তরুণের আশ্চর্য নাটকীয় ভাবনা দুই দশক পরে কীভাবে বাসত্মবে মিলে গিয়েছিল, ভাবতে গিয়ে আজো অবাক হতে হয়!

 

মৃত্যুহীন প্রাণ

দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারের অধীনে শাসিত হওয়ার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বলিভিয়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে শুরু করে। তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিবদের সমর্থনে ২০০৫ সালের শরৎকালীন নির্বাচনে বামপন্থী হুয়ান ইভো মোরালেস ক্ষমতায় আসেন। তিনি মুভিমিয়েমেত্মা আল সোশ্যালিজমোর নেতা। তিনি ও তাঁর দল চে-র প্রশংসায় সরব। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি জাতীয় সংসদ ভবনে চে-র ছবি স্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রপতির অফিসে টাঙিয়েছেন কোকো পাতা দিয়ে তৈরি চে-র প্রতিকৃতি। মোরালেসের ভাষায়, ‘চে যে সংগ্রাম অসমাপ্ত রেখে গেছেন, সেটি আমাদের সমাপ্ত করতে হবে।’ ২০০৬ সালের ১৪ জুন ইভো মোরালেস গিয়েছিলেন লা হিগুয়েরায়, চে-র ৭৮তম জন্মদিন পালন করতে। বলিভীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনিই প্রথম চে-র মৃত্যুর স্মৃতিবিজড়িত ওই গ্রামটি সফর করেন। ভ্যালেগ্রান্দে হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা-সরঞ্জাম দিয়ে প্রস্ত্তত একটি স্থাপনা (ইনস্টলেশন) প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন মোরালেস। ভ্যালেগ্রান্দে বিমানবন্দরে গোপনে কবর দেওয়ার আগে চে-র মৃতদেহ এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। যে-লন্ড্রি বিল্ডিংয়ে চে-র মৃতদেহ পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং যেখানে তাঁর শেষ ছবিগুলো তোলা হয়েছিল, তা এখন ‘চে-তীর্থ’ হিসেবে পরিচিত।

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজও দারুণ এক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁদের চিমত্মাধারায় চে-র দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ২০০৬ সালে কারাকাসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামে শাভেজ বলেন, ‘লাতিন আমেরিকায় আমাদের ‘দুই, তিন, অনেক… বলিভিয়া’ তৈরি করতে হবে।’ যেমন বলেছিলেন চে, ‘লাতিন আমেরিকায় আমাদের দুই, তিন, অনেক ভিয়েতনাম তৈরি করতে হবে।’ ভেনেজুয়েলার রাসত্মায় এখন পাশাপাশি শোভা পায় সাইমন দ্য বলিভার, হুগো শাভেজ ও চে গুয়েভারার ছবি।

ইকুয়েডরেও চে-র উপস্থিতি খুব জোরালো। শাভেজ ও মোরালেসের পথ অনুসরণ করে ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারিতে অভিষেক অনুষ্ঠানের ভাষণে বামপন্থী রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরেআ দেলগাদো শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করেন সাইমন দ্য বলিভার ও চে-র কথা।

২০০৬ সালের ২২ জুলাই চে-র মৃত্যুর চার দশক পর তাঁর কিশোর বয়সের স্মৃতিবিজড়িত আলতা গ্রাসিয়ায় যান লাতিন আমেরিকার প্রভাবশালী দুই রাষ্ট্রনেতা হুগো শাভেজ ও ফিদেল কাস্ত্রো। এখন কিউবা, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলায় নয়; ব্রাজিল, নিকারাগুয়া, উরুগুয়ের সরকারি অফিসগুলোতেও চে-র ছবি স্থাপন করা হয়েছে। কিউবার ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে প্রতিদিন তাদের স্কুল শুরু করে ‘আমরা চে-র মতো হব’ – এই শপথবাক্য পাঠ করে। এসব দেশে এমন নেতা আবির্ভূত হচ্ছেন, যাঁরা চে-কে অনুভব করেন, যাঁদের হূদয় ও মননে আর্নেসেত্মা চে গুয়েভারা আজো জাগ্রত।

অতীতের মতো এখনো লাতিন আমেরিকায় চে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশি জাগ্রত। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে চে রক্তধারার মতো মিশে আছেন। মানুষের জাগরণে অনুপ্রেরণা হয়ে, প্রণোদনা হয়ে প্রতিদিনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। শুধু লাতিন আমেরিকা কেন, সারাবিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ ও উত্থানে সহযাত্রী হয়ে আছেন চে গুয়েভারা।

 

চে গুয়েভারার কবিতা

 

ফিদেলের জন্য গান

 

তুমি বলেছিলে সূর্যোদয় হবে।

চলো যাই,

সেই অচিহ্নিত পথে

তোমার ভালোবাসার সবুজ কুমিরকে মুক্ত করতে।

 

এবং চলো আমরা

সকল উপেক্ষাকে তুচ্ছ করি

বিদ্রোহী প্রগাঢ় নক্ষত্রপ্ল­vবিত ভ্রূকুটিতে।

হয় বিজয়ী হব না হয়

মৃত্যুকে যাব পেরিয়ে।

 

প্রথম গুলিতেই সারাটা জঙ্গল

উঠবে জেগে সতেজ বিস্ময়ে।

এবং তখনই সেখানে

তোমার পাশে

আমরাও থাকব

প্রশান্ত সাহচর্যে।

 

যখন তোমার কণ্ঠস্বর বাতাসকে করবে চার ফালি –

ভূমি সংস্কার, সুবিচার, রুটি, স্বাধীনতা

তখন সেখানে আমরাও

তোমার পাশে থাকব,

আমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে –

একই উচ্চারণ।

দিনের শেষে

অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযান

সাঙ্গ হলে,

তখন দেখবে সেখানে

শেষ যুদ্ধে

আমরাও রয়েছি

তোমার পাশে।

 

যখন বন্য পশু চাটে তার ক্ষত

যেখানে বিদ্ধ কিউবার বর্শা,

তখন গর্বিত হূদয়ে আমরা

তোমার পাশে থাকব।

 

ভেবো না ওই সব উপহারসমেত

ব্যাঙের মতো লাফিয়ে বেড়ানো

তমঘা-আঁটা মাছিরা

আমাদের সংহতি করতে পারবে বিনষ্ট,

আমরা চাই তাদের রাইফেল, বুলেট

আর এক টুকরো পাথর

অন্য কিছুই নয়।

 

আমেরিকার ইতিহাস রচনায়

আমাদের সামনে যদি

ইস্পাত-বাধা আসে

তাহলে আমাদের গেরিলা অস্থি

ঢাকার জন্য চাই শুধু কিউবার অশ্রম্নধারা –

আর কিছু নয়।

অনুবাদ : মতিউর রহমান

চে-কে নিয়ে

কিউবার জাতীয় কবি নিকোলাস গিয়েন। কিউবা আর লাতিন আমেরিকা ছড়িয়ে রয়েছে গিয়েনের কবিতায়। কিউবার বিপ্ল­বের অন্যতম নেতা চে গুয়েভারাও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। লাতিন আমেরিকায় সশস্ত্র সংগ্রাম ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে বলিভিয়ায় চে-র নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলাযুদ্ধের করুণ সমাপ্তি ঘটে। আহত গুয়েভারাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ-হত্যাকা– বিমূঢ় গিয়েন বিলাপের সুরে এই কবিতা রচনা করেন :

 

নি কো লা স  গি য়ে ন

 

গিটারে বিলাপের সুর

 

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

সশস্ত্র তুমি রাইফেল নিয়ে

যে রাইফেল প্রস্ত্তত আমেরিকায়,

আমেরিকায় প্রস্ত্তত যে রাইফেল,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

যে রাইফেল প্রস্ত্তত আমেরিকায়।

 

২.

বারিয়েন্টোস এটা দিয়েছে তোমায়

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

মি. জনসনের উপহার

খুন করতে তোমার ভাইকে,

তোমার ভাইকে খুন করতে,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

খুন করতে তোমার ভাইকে।

 

৩.

তুমি কি জানো এই মৃতদেহ কার,

খুদে সেনা বলিভিয়ার?

এই মৃতদেহ চে গুয়েভারার,

তিনি ছিলেন আর্জেন্টাইন এবং কিউবান,

আর্জেন্টাইন এবং কিউবান ছিলেন তিনি,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

তিনি ছিলেন আর্জেন্টাইন এবং কিউবান।

 

৪.

তিনি ছিলেন সেরা বন্ধু তোমার

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

দারিদ্র্য-পীড়নে বন্ধু তোমার,

অরিয়েন্টি থেকে মালভূমি,

মালভূমি থেকে অরিয়েন্টি,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

অরিয়েন্টি থেকে মালভূমি।

 

৫.

সম্পূর্ণ সজ্জিত আমার গিটার,

খুদে সেনা বলিভিয়ার

শোক প্রকাশে, কিন্তু ক্রন্দনরত নয়,

যদিও ক্রন্দন মানবিক বড়,

মানবিক বড় ক্রন্দন যদিও,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

যদিও ক্রন্দন মানবিক বড়।

 

৬.

ক্রন্দন নয় এ প্রহরের জন্য

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

এ-সময় অশ্রম্ন আর বেদনার নয়,

এ ক্রন্দন *মাচেতির জন্য,

মাশেতির জন্য এ-ক্রন্দন

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

এ-ক্রন্দন মাচেতির জন্য।

 

৭.

তামায় মূল্য দিয়েছে সে তোমায়

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

বিকিয়েছ তুমি তাই আর খদ্দের সে,

অত্যাচারীর শুধু এই এক চিমত্মা,

এই এক চিমত্মা অত্যাচারীর শুধু,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

অত্যাচারীর শুধু এই এক চিমত্মা।

 

৮.

জাগো, এখন সম্পূর্ণ দিবালোক

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

সারাবিশ্ব দাঁড়িয়ে নিজ পায়ে,

সূর্যোদয় হবে শিগগিরই,

শিগগিরই সূর্যোদয় হবে,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

সূর্যোদয় হবে শিগগিরই।

 

৯.

পথ নাও সোজা সম্মুখপানে

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

এ-পথ সুগম নয় সকল সময়,

নয় সুগম অথবা মসৃণ,

সুগম অথবা মসৃণ নয়

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

নয় সুগম অথবা মসৃণ।

 

১০.

কিন্তু, নিশ্চয়ই তুমি শিখবে তখন

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

হত্যা করতে পারে না ভাইকে কেউ,

হত্যা করতে পারে না ভাইকে কেউ,

ভাইকে কেউ হত্যা করতে পারে না,

খুদে সেনা বলিভিয়ার,

হত্যা করতে পারে না ভাইকে কেউ।

 

*মাচেতি – দা-জাতীয় ধাতব অস্ত্র

অনুবাদ: মতিউর রহমান