একমাস পর অফিসে কাজ করতে এসে নিজাম সাহেব দেখলেন তিনি চোখে খুবই কম দেখছেন। বাসায় থাকতে এতটা খেয়াল করতে পারেননি। আজ অফিসে লেখালেখি করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন বিষয়টা। অথচ দু-মাস আগেই তিনি ডাক্তার দেখিয়ে নতুন চশমা নিয়েছেন। চশমা নেওয়ার পর খুব ভালো দেখতেন চোখে। অফিসের লোকেরা একটু আগেও টেবিল ঘিরে ছিল, সবার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন সবাইকে কেমন অচেনা লেগেছে তার কাছে। তার মানে তিনি চোখে কম দেখছেন। ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে ছিলেন, বড় সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করে কাছে এলেন। গলায় মমতা ঢেলে বললেন, নিজাম সাহেব আপনি এত তাড়াতাড়ি অফিসে না এলেও পারতেন। আরো কয়েকটা দিন বাসায় থাকলে পারতেন। নিজাম সাহেব বলতে পারলেন না বাসায় থাকা, বিশ্রামে থাকা তার জন্য কী কষ্টকর! বাসায় যাবেন আপনি? আমি পৌঁছে দেব? আবার বললেন বড় সাহেব। নিজাম সাহেব বললেন, না না, কাজের সময় আপনাকে যেতে হবে না। আসার সময় যেন কার সঙ্গে রিকশায় অফিসে এসেছিলেন এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেন না নিজাম সাহেব তবে এ-কথা ঠিক, আজ কারো সঙ্গে অফিসে এসেছেন তিনি। অনেকদিন পর অফিসে এসে সব কেমন গোলমাল লাগছে আজ নিজাম সাহেবের কাছে। আস্তে আস্তে অফিসের বাইরে এলেন তিনি। খেয়াল করে দেখলেন লিখতে সমস্যা হচ্ছে তার, তবে চলতে-ফিরতে পারছেন। অফিসের লোকজন দু-একজন এগিয়ে এসে বলল, সেই ভালো হবে, আপনি আরো কিছুদিন বাসায় থাকুন। একজন একটা রিকশা ডেকে বাসার ঠিকানা বলে দিলো রিকশাওয়ালাকে। নিজাম সাহেব বাসায় গেলেন না, বাসার কাছে একটা ছোট পার্ক আছে, রিকশাওয়ালাকে সেদিকে যেতে বললেন।
নিজাম সাহেবের মনে হলো, তিনি যদি এই মুহূর্তে পুষ্পাদের বাসার ঠিকানা জানতেন তবে পুষ্পার কাছে যেতে পারতেন। একজন আপন কোনো মানুষের কাছে যেতে মন চাইছে। এক বোন আছে নিজাম সাহেবের, সে অনেক দূরে থাকে। সেও এসেছিল কদিন আগে, দু-তিনদিন হলো চলে গেছে। আর তো আপন মানুষ কারো নাম মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। নিজাম সাহেব পার্কের একটা বেঞ্চে বসলেন। ঠিক দুপুর এখনো হয়নি, পার্কে তেমন কোনো লোকজন নেই। তার বেঞ্চের উলটোদিকের বেঞ্চে একটা লোক ঘুমিয়ে আছে। দু-একজন পথশিশু ইতস্তত চলাফেরা করছে একটু দূরে। নিজাম সাহেবের মনে পড়ল, সিফাতের বন্ধু মানিক যখন বলল, চাচা ওরা সিফাতের চোখ উঠাইয়া ফেলছে, তখন মাথা ঘুরে যে চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন তিনি, তার সেই চোখ আর ভালো হয়নি, আবছা দেখছেন এখনো।
ছোটবেলা বাবা-মাহারা দুই ভাইবোন ছিলেন তারা। নিজাম সাহেবের ছোট বোন সুফিয়া তার ননদ বকুলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন তার। বোনের বিয়ের পর ছোটবোনই হয়েছিল নিজাম সাহেবের অভিভাবক। তখন নিজাম সাহেব গাঁয়ের একটা প্রাইমারি স্কুলের মৌলভিস্যার ছিলেন। সাংসারিক কাজে নিপুণা কিশোরী বকুল অল্পদিনেই মন জয় করেছিল নিজাম সাহেবের। বকুলের ঘন পাপড়িঘেরা গভীর কালো টানাটানা চোখ নিজাম সাহেবকে তার প্রতি গভীর প্রেমে আবদ্ধ করেছিল। নিজাম সাহেবের সবসময় মনে হতো বকুলের মতো মেয়ের আরো ভালো বিয়ে হওয়া উচিত ছিল, তিনি বকুলের যোগ্য নন। এই কথা ভেবে নিজাম সাহেব নতুন করে পড়াশোনা করে আইএ পাশ করে পরবর্তীকালে ডিসি অফিসে কেরানির চাকরি করতেন। রিটায়ার করার পর বর্তমান অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্টের পদে আছেন। কেরানি পদে চাকরি পাওয়ার পর তার মনে হয়েছিল, তিনি কিছুটা হলেও বকুলের যোগ্য হয়েছেন। বিয়ের পর ছয়-সাত বছর গড়িয়ে গেলেও কোনো সন্তান হয় না বকুলের। নিজাম সাহেব তাদের দুজনেরই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেও বকুল কিছু মনে করবে ভেবে কিছু বলেন না। একদিন বকুলই কথাটা বলল, পরদিনই নিজাম সাহেব বকুলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেন। বললেন, তাদের কোনো সমস্যা নেই, তবে ওষুধগুলো নিয়মিত খেতে হবে। ওষুধ খাওয়ার দুই-তিন মাসের মাথায় বকুল সন্তানসম্ভবা হলো। যথাসময়ে বকুলের একটি ছেলে হলো, সে-ছেলে যত বড় হয় ততই মায়ের মতো দেখতে হয়। তার চোখদুটি একদম মায়ের মতো জন্মকাজল পরানো। মুখটায় মনে হয় মায়ের মুখটা কেটে বসানো হয়েছে। বকুল নিজামুদ্দিনের ছেলের নাম রাখে সিফাতউদ্দিন। সিফাতের জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় বকুলের দ্বিতীয় সন্তান পেটে আসার পর নানা জটিলতা দেখা দেয়। নির্ধারিত সময়ের একমাস আগেই সন্তান প্রসব হওয়ার সময় বকুল একলাম্পশিয়ায় মারা যায়; অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় জন্ম নেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সন্তানটিও মারা যায়। বকুলের কাছেই নিজাম সাহেব শুনেছিল তার মায়েরও সন্তান প্রসবের সময় একলাম্পশিয়া হয়ে মারা যাওয়ার কথা। বকুল এটাই আশঙ্কা করছিল, সেও তার মায়ের মতো একলাম্পশিয়ায় মারা না যায়। তার মায়ের মতো তারও রক্তশূন্যতা দূর হচ্ছে না দেখে সে ভয় পেয়েছিল। এরপর থেকে সিফাতকে নিয়েই নিজামুদ্দিনের সংসার। অনেকে বিয়ে করার জন্য বলে; কিন্তু নিজামুদ্দিন আবারো বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারেননি। ছেলেকে নিয়েই দিন কেটে যায়, কয়েকটা বছর খুব কষ্ট গেছে সিফাতকে নিয়ে। তবে সিফাত বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে-কষ্ট কেটে গেছে। খুব ভালো ছাত্র সিফাত ক্লাসে কখনো ফার্স্ট, সেকেন্ড ছাড়া থার্ড হয়নি। সেই ছেলে মাস্টার্স করছে এখন। সিফাতের আলাদা রুম, আলাদা বিছানা থাকলেও সে কখনো সেই ছোটবেলার মতো বাবাকে ছাড়া একা বিছানায় ঘুমাতে পারে না; কিন্তু আজ একমাস ধরে নিখোঁজ সিফাত। সিফাত যখন কলেজ থেকে ফিরছিল মানিকের সঙ্গে, তখন নাকি ওদের সামনে থেকে কতগুলো লোক একটা মেয়েকে জোর করে মাইক্রোবাসে ওঠাচ্ছিল, মেয়েটার চিৎকারে ওরা দুজন রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে ওদের বাধা দিতে গেলে লোকগুলো ওদেরও মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়ে শহরের শেষ মাথায় একটা নির্জন বাড়িতে ওঠায়। মাইক্রোবাসে ওদের নেওয়ার সময়ই নাকি ওরা বলে আগে দুইটারই চোখ উপড়াইয়া ফেলবি। চিনে ফেলছে বুঝেছিস তো? গাড়িতে উঠেই ওদের মুখে টেপ লাগিয়ে হাত আর চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর ওই বাড়িটায় ওঠানোর কিছুক্ষণ পরই নাকি জোরে জোরে সিফাতের চিৎকার শোনা যায়। মানিকের ধারণা তখনই সিফাতের চোখে কিছু করা হয়। হঠাৎ পুলিশের উপস্থিতির কথা শুনে মুহূর্তে ওরা মানিককে ফেলে মেয়েটি ও সিফাতকে নিয়ে মাইক্রোবাস নিয়ে উধাও হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে মানিককে হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সিফাত নাকি ওদের বলেছিল, তোদের আমি চিনতে পেরেছি, তোদের একজনকেও আমি ছাড়ব না। কিন্তু মানিক তাদের কাউকে চিনতে পারেনি বলে সে কোনো কথাও বলেনি। বিকেলে সিফাতের জন্য ম্যাগি নুডলস বানিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নিজাম সাহেব। এই নুডলস তাদের বাপ-ছেলের জীবনটা অনেক সহজ করে দিয়েছিল। রান্না সহজ বলে কতদিন যে তারা শুধু নুডলস খেয়ে দিন পার করেছেন। সিফাতের দেরি দেখে নিজাম সাহেব ফোন দিলেন। সিফাতের ফোন বন্ধ।
কিন্তু ফোন তো কখনো বন্ধ থাকে না সিফাতের। দুশ্চিন্তায় পড়ে বারবার ফোন করছেন তিনি, রাত ঘনিয়ে আসছে তবু কোনো খোঁজ নেই ছেলের। সিফাতের দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ফোনে ফোন দিলেন, ওরাও কিছু বলতে পারল না। ক্লাসশেষে মানিক আর সিফাতকে এক রিকশায় যেতে দেখেছে – এটুকুই বলতে পারল সবাই। পুষ্পার নম্বরটা থাকলে পুষ্পাকে ফোন করা যেত। পুষ্পা একসময় সিফাতের ছাত্রী ছিল। পুষ্পা আর ওর ছোট ভাইকে প্রাইভেট পড়াত সিফাত। তখন অবশ্য পুষ্পারা এ-পাড়াতেই থাকত, পরবর্তীকালে ওর বাবা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে শহরের অন্য জায়গায় বাড়ি কিনে নিজের বাড়িতে উঠে যান। এক ছুটির দিনে দুপুরে রান্না করছিলেন নিজাম সাহেব হঠাৎ কলিংবেল। দরজা খুলতেই দেখেন সিফাত, সিফাতের সঙ্গে একটি সুন্দরী মেয়ে। ঘরে ঢুকেই সিফাত বলে, বাবা দেখো তো ওকে চিনতে পারো কি না? মেয়েটি নিজাম সাহেবকে সালাম করে। নিজাম সাহেব মেয়েটিকে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। সিফাত বলে, বাবা তুমি ভুলে গেছ, আমি প্রাইভেট পড়াতাম ওকে আর ওর ছোট ভাই পুষনকে। – মনে পড়ে নিজাম সাহেবের, সিফাত দুটি ছেলেমেয়েকে বেশ কয়েক বছর প্রাইভেট পড়িয়েছিল। সিফাত আরো বলে, বাবা, ওর নাম পুষ্পা, ও এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ওরা কিছুক্ষণ নিজাম সাহেবের সঙ্গে সময় কাটিয়ে চলে গেল। নিজাম সাহেব বুঝতে পারেন ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে। সিফাত বাবাকে একটু টাচ দিলো, বাবা পছন্দ করে কি না? মায়ের মতোই বুদ্ধিমান ছেলে। নিজাম সাহেব রাতে সিফাতের সঙ্গে খেতে বসে অনেক প্রশংসা করলেন পুষ্পার। সিফাত একসময় হেসে ফেলে বলল, এবার থামো তো বাবা, আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি, তুমি আসলে কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পেরেছি।
এরও সপ্তাহখানেক পর এক ছুটির দিনে বেলা ১০টা-১১টার দিকে ফোন দিলো সিফাত। সে সকালে তার এক বন্ধুর কাছে একটা কাজে গিয়েছিল। সিফাত বলল, বাবা তুমি রান্না করো না, পুষ্পা আজ তোমাকে সারপ্রাইজ দেবে। তুমি রান্নার সব জিনিস উঠিয়ে রাখো। নিজামুদ্দিন তখন দুপুরের রান্নার আয়োজন করছেন। সব ফেলে নিজাম সাহেব ঘর গোছাতে লেগে গেলেন, চটপট দুই বিছানার চাদর বদলালেন। জানালার পর্দা টেনে ঠিক করে ঘর সুন্দর করে ঝাড়– দিয়ে পরিপাটি করে দ্রুত গোসল সারলেন। একটু পরেই ওরা এলো, সিফাতের হাতে একটা বিরাট টিফিন ক্যারিয়ার। পুষ্পা ঘরে ঢুকে টুক করে নিজাম সাহেবকে সালাম করল। আজ মেয়েটাকে যেন আরো সুন্দর লাগছে, এমন রূপবতী মেয়ে যেন জীবনে তিনি দেখেননি। খাওয়ার টেবিলে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে সব ঢাকনা একে একে খুলল সিফাত। পোলাও-কোর্মার গন্ধে ঘর ভরে গেল। সিফাত বলল, পুষ্পা আমার মনে হচ্ছে এই রান্না তুমি করোনি, অ্যান্টি করেছেন। পুষ্পা হেসে বলল, আমিই করেছি, তবে আম্মার ডিরেকশনে।
তারা তিনজনে খেতে বসল, নিজাম সাহেব খাবেন কী, চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। পুষ্পা তার প্লেটে খাবার উঠিয়ে দিচ্ছে, তিনি হাতের ইশারায় না করছেন, মুখে বলতে পারছেন না, আনন্দের কান্নায় তার গলা বুজে আসছে। পুষ্পা আর সিফাত পাশাপাশি বসেছে, নিজাম সাহেব চুপ করে মাথা নিচু করেই পালিয়ে পালিয়ে দেখছেন। হালকা ডিমের কুসুম রঙের একটা ড্রেস পরেছে পুষ্পা। ড্রেসের রং আর গায়ের রং একাকার হয়ে গেছে যেন মেয়েটার। সিফাতও একটা হালকা জাম কালারের শার্ট পরেছে, তাকেও কী দারুণ যে লাগছে। ভারি মানিয়েছে দুটিতে। ফর্সা চম্পাকলির মতো হাতের আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে অল্প অল্প পোলাও-কোর্মা মুখে দিচ্ছে পুষ্পা, মাঝেমধ্যে সিফাত ও তার প্লেট খেয়াল করে খাবার উঠিয়ে দিচ্ছে, তারা মানা করলেও শুনছে না। খাওয়াশেষে তার বাটিতে অনেকটা ফিরনি উঠিয়ে দিলো পুষ্পা, কোনো নিষেধ শুনল না, বলল – না করবেন না আংকেল আমি শুনেছি ফিরনি আপনার অনেক পছন্দ। আমি অনেক যত্ন করে রেঁধে এনেছি আপনার জন্য। ইস্, এমন আনন্দের দিন বকুল মারা যাওয়ার পর তার সংসারে আর আসেনি। চোখের পানি মুছে শেষ করতে পারছেন না নিজাম সাহেব। নিজাম সাহেব দেখেছেন কেউ আদর করে কথা বললেই তার কান্না পায়। বকুলকে নিয়ে যেদিন প্রথম তার বাসায় এলেন, কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তার বিয়ে হয়েছিল। অনেকদিন পর বোনকে দেখতে গিয়েছিলেন নিজামুদ্দিন। তার ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে বোন কেঁদেকেটে ননদকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। পরদিন নিজেকে খুব অপ্রস্তুত লাগছিল, যখন বকুলকে সঙ্গে করে তার অগোছালো বাসায় নিয়ে এসে ঢুকলেন। খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজের কাছে নিজেকে, অথচ বকুলকে ঘরে রেখে যখন টুকটাক কাজ ও বাজার করে ফিরলেন, ঘরটা আর তিনি চিনতে পারছিলেন না – এত সুন্দর করে গুছিয়েছে বকুল। নিজামুদ্দিন ফিরতেই বকুল বলল, ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে টুকটাক ডাল-ভাত রান্না করেছি, তাড়াতাড়ি গোসল করে এসে খেয়ে নিন তো, আপনার মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না। বকুলের এই কথাতেই কান্না চলে এলো তার, চোখ ভরে উঠল পানিতে। আজো বারবার চোখ ভরে উঠছে পানিতে। খাওয়া-দাওয়া শেষে সিফাতের সাহায্যে সব খাবার টিফিন ক্যারিয়ার থেকে বাটিতে বাটিতে গুছিয়ে সুন্দর করে ফ্রিজে তুলে রাখল পুষ্পা। বলল, আংকেল কাল রান্না করবেন না, শুধু গরম করে খাবেন। নিজামুদ্দিন ভাবেন, আহা শুধু রূপবতী না, কী যে মায়াবতী মেয়েটা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়তেই ওরা চলে গেল।
নিজামুদ্দিন জানেন, তার ছেলে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারবে, অনেক মেধাবী ছেলে সে। এখনো প্রাইভেট পড়িয়ে সে ভালো ইনকাম করে। মনে মনে ডিসিশন নেন নিজাম সাহেব, পাশ করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দেবেন ছেলের ইনশাআল্লাহ, দেরি করবেন না, এমন একজন মায়াবতীর সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। টুকটাক টাকা-পয়সা যা আছে তাতে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাতে পারবেন ছেলেকে। বকুলের দুটা গহনা আছে – কানের একজোড়া ঝুমকা আর একটি নেকলেস। খুব শখ করে স্যাকরার ঘরে বসে অনেক ডিজাইন দেখে গহনাগুলো নিজে পছন্দ করে বানিয়েছিল সে। নিজের জমানো টাকাও সে এসব গহনার পেছনে খরচ করছিল। তখনো বকুলের দ্বিতীয় সন্তান পেটে আসেনি। গহনাগুলো পরে আয়নায় নিজেকে দেখছিল, সিফাত মায়ের গলায় কানে এত সুন্দর গহনা দেখে মায়ের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছিল আর একটু পরপর মাকে টেনে চৌকিতে বসিয়ে হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখছিল বলে বকুল বলেছিল, আমি গয়নাদুটি কিন্তু আমার ছেলের বউরে দেবো বলে রাখলাম। আপনার মতো আপনার ছেলের যেন গহনা ছাড়া বউ ঘরে আনতে না হয় বুঝলেন। সত্যি একরতি গহনাও তিনি বিয়ের সময় বকুলকে দিতে পারেননি, এই দুঃখ তিনি জীবনে কোনোদিনও ভুলবেন না। কিন্তু কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল, এত নিরীহ একটা ছেলে আজ এক মাস ধরে নিখোঁজ। অফিসের বড় সাহেব থেকে শুরু করে সিফাতের বন্ধুবান্ধব এই একমাস যাবত কম খোঁজাখুঁজি করেনি। মেয়েটাই-বা কে? ছেলেগুলোই-বা কারা পুলিশও কোনো খোঁজ বের করতে পারল না আজ পর্যন্ত। মানিককে সঙ্গে নিয়ে নিজামুদ্দিন থানায় জানিয়েছিলেন ঘটনা, পুলিশ কেস রেডিও করেছিল; কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। নিজামুদ্দিন ভাবেন, গহনাগুলো তিনি পুষ্পাকে দিয়ে দেবেন, তারই তো প্রাপ্য ছিল এই গহনাগুলো। পুষ্পা এসেছিল পরদিন, বারবার আশ্বাস দিচ্ছিল, আংকেল চিন্তা করবেন না, দেখবেন ও ঠিক চলে আসবে। এরপর ঘনঘন কয়েকদিনই এসেছে পুষ্পা; কিন্তু এখন আর আসছে না, তার ফোন নম্বরটা একদিন দিতে চাইল পুষ্পা, কেন যে ফোন নম্বরটা নেওয়া হলো না মনে করতে পারছেন না তিনি। আচ্ছা পুষ্পা যদি আর না আসে, এই গহনাগুলো দিয়ে তিনি কী করবেন তাহলে? যে করেই হোক পুষ্পাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আজান পড়ছে মসজিদে, উঠে দাঁড়ালেন নিজামুদ্দিন। ঘরে ফিরতে হবে তাকে। আবছা দৃষ্টিতে নিজামুদ্দিন ঠাহর করতে পারছেন না এটা আসরের আজান, না মাগরিবের।

আজকাল অফিসে যান না নিজামুদ্দিন। ঘরেই থাকেন। একটা কাজের মেয়ে ঠিক করে দিয়েছে বাসার কাছের অফিসের এক কলিগ। মেয়েটা দুবেলা রান্নাবাড়া ও ঘর ঝাড়– দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে কাপড় ধুয়ে দেয়। বহু প্রতীক্ষার পর একদিন পুষ্পা এলো, দরজা খুলে আবছা দৃষ্টিতেও তিনি ঠিকই পুষ্পাকে চিনলেন। পুষ্পা সালাম করে তার পাশে বসল, কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। পুষ্পা দেখল ঘরটা আগের মতোই আছে, সিফাতের সবকিছুই আগের মতো আছে, এমনকি পানির গ্লাসটাও টেবিলে নিজামুদ্দিনের গ্লাসের পাশে আগের মতোই আছে। কথার ফাঁকে পুষ্পা একসময় বলল, আংকেল আজ আমি আপনার দোয়া নিতে এসেছি। নিজামুদ্দিনের বুকের মধ্যে যেন কেন হঠাৎ ধক্ করে উঠল। তিনি শুকনো মুখে বললেন, কেন রে মা? পুষ্পা বলল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি আপনার দোয়া নিতে এসেছি। নিজামুদ্দিন ঘোলা চোখে পুষ্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার তাকিয়ে থাকা দেখে পুষ্পা নিজামুদ্দিনের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, আংকেল জানেন তো আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান, তাদের তো কষ্ট দিতে পারি না, তাদেরও তো আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে। নিজামুদ্দিন তাড়তাড়ি বললেন, না না, তা ঠিক আছে, তা ঠিক আছে, আমি জানি সিফাত বেঁচে থাকলে সেও আমার কথা শুনত, সেও আমার স্বপ্ন পূরণ করত। কিছুক্ষণ বাইরে উদাসভাবে তাকিয়ে রইলেন নিজামুদ্দিন তারপর বললেন, পুষ্পা মা, আমার কাছে একজনের কিছু জিনিস রক্ষিত আছে, জিনিসগুলো আমি কী করি বলো তো? পুষ্পা কী জিনিস জানতে চাইলে তিনি বকুলের গহনার কথা খুলে বললেন। গহনার কথা শুনে পুষ্পা চুপ করে রইল দেখে নিজামুদ্দিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, বললেন, আসলে বয়স হয়েছে তো এজন্য আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারি না। পুষ্পা বলল, না না আংকেল এভাবে বলবেন না, বের করুন গহনা আমি নেব। নিজামুদ্দিন উঠে টলোমলো পায়ে আলমারি খুলে একটা পুরনো কাঠের কৌটা এনে পুষ্পার হাতে দিয়ে সেটা খুলতে বলেন। পুষ্পা কৌটা খুলে গহনাদুটি বের করে হাতে নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, এত আগে বানানো গহনা এত সুন্দর! অ্যান্টির পছন্দ ছিল বলতে হয়। নিজামুদ্দিন খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, তোমার অ্যান্টি অনেক শখ করে টাকা জমিয়ে বানিয়েছিল, বারবার বলত এটা আমার ছেলের বউকে দেব। আপনার মতো আমার ছেলেকে খালি হাতে বিয়ে করতে দেব না, এখন এই গহনা তুমি না নিলে আমি কী করব বলো তো? গহনাগুলি তুমি একটু পরো মা, আমি একটু দেখি। পুষ্পা শোকেসের ওপর রাখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গহনাগুলো পরে। আসলেও খুব সুন্দর আর ভারী গহনাগুলো। নিজামুদ্দিনের সামনে দাঁড়ালে চোখের উপচানো পানিতে নিজামুদ্দিন কাকে দেখছেন সে কি পুষ্পা না বকুল বুঝতে পারেন না, তার চোখে খালি গহনাগুলো ভাসতে থাকে। পুষ্পা খেয়াল করে, নিজামুদ্দিন ঠিকমতো চোখে দেখছেন না। পুষ্পা বলল, আংকেল আজ আপনাকে আমি চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। নিজামুদ্দিন বলেন, তিনি গিয়েছিলেন যে ডাক্তারের কাছ থেকে চশমা নিয়েছিলেন তার কাছে। ডাক্তার বলেছেন, চোখের চশমার পাওয়ার ঠিক আছে কিন্তু কেন তিনি দেখতে পারছেন না ডাক্তার তা বলতে পারলেন না। ডাক্তার যখন বললেন, কতদিন আগে, কীভাবে, ঠিক কখন থেকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, তখন তিনি ডাক্তারকে দৃষ্টি হারানোর ঘটনাটি খুলে বললেন, শুনে ডাক্তার চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর একটা ড্রপ লিখে দিলেন সবসময় চোখে দেওয়ার জন্য, আর বললেন, আপনার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া কোনো ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার চোখের এ-অবস্থা হলো আমাদের বর্তমান সময়ের সমাজের অবক্ষয়ের বাস্তব রূপ।
দুপুরে যা ছিল তাই দিয়ে পুষ্পা ভাত খেল তার সঙ্গে যে-চেয়ারটায় সিফাত বসত সে-চেয়ারটায় বসে। নিজাম সাহেব যদি পুষ্পা আসবে আগে জানতে পারতেন, তবে তার জন্য একটু ভালো কিছু আয়োজন করতে পারতেন। আজ কতদিন হলো একটু ভালো রান্নার আয়োজন হয় না তার বাসায়। সিফাত থাকতে হঠাৎ হঠাৎ একেক দিন একেক খাবার খেতে চাইত। যেমন দুপুরে খাওয়ার একটু আগে বলত, বাবা আজ পোলাও খাওয়া যায় না? গোশতের ব্যবস্থা না থাকলে ডিম ভাজি হলেও চলবে। এই রকম রাত্রে খেতে বসবেন তখন বলল, বাবা বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, খিচুড়ি খেলে কেমন হয়? খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ থেকে সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে পুষ্পা চলে গেল বিয়ের পর আবার তাকে দেখতে আসবে বলে। যাওয়ার আগে পুষ্পা গহনার ব্যাপারে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলল তাকে। নিজামুদ্দিন সাহেব ফোনে গহনার ব্যাপারে সব জানালেন পুষ্পার মাকে। পুষ্পার মা জানালেন, তিনিও খুব পছন্দ করতেন সিফাতকে, তারও ইচ্ছা ছিল এমন ভালো একটা ছেলেকে আপন করে নেওয়ার।
বিয়ের কিছুদিন পর পুষ্পা ওর বর তৌসিফকে নিয়ে নিজামুদ্দিনকে দেখতে এলো, সঙ্গে অনেক খাবার-দাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে। পুষ্পা বারবার কোনো জিনিসের প্রয়োজন আছে কি না জানতে চাইলে একটা হট ওয়াটার ব্যাগের কথা বলেছিলেন নিজামুদ্দিন। আজকাল তার পা ঠান্ডা হলে সহজে গরম হতে চায় না। সেটাও আজ নিয়ে এসেছে পুষ্পা। নিজামুদ্দিন দরজা খুলে দিলে ওরা ঘরে ঢুকে তাকে সালাম করে হাসিমুখে তার সামনে দাঁড়াল। নিজামুদ্দিন ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলেন, আজকাল তিনি কেবল মানুষের অবয়ব বুঝতে পারেন, মানুষটা ঠিক কে তা বুঝতে পারেন না, তবু তিনি চিনলেন পুষ্পাকে, কী যে সুন্দর লাগছে আজ মেয়েটাকে। কিন্তু পুষ্পার পাশে কে তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি চশমা খুলে বাঁ-হাতে চশমা ধরে ডান হাতের তালু দিয়ে বারবার চোখ মুছে পরিষ্কার করে ওদের দিকে তাকালেন, ওদের দিকে তাকিয়ে নিজামুদ্দিনের মনে হলো কে বলেছে তার ছেলের চোখ তুলে ফেলেছে, ওই তো জন্মকাজল পরানো চোখে পুষ্পার পাশে যেন অন্য কেউ নয়, তার ছেলে সিফাত দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে।