চ্যাপলিনের প্রথম ছবি

সুশীল সাহা

 আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, সিনেমার প্রায় জন্মলগ্ন থেকে এই মহাশক্তিশালী শিল্পমাধ্যমটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী চার্লস স্পেন্ডার চ্যাপলিন। অথচ দারিদ্রে্যর কশাঘাতে জর্জর শিশু চ্যাপলিনের সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বেপথু হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু সবার অলক্ষে রচিত বিধিলিপি বোধহয় একটু অন্যরকম ছিল। তাইতো মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উপার্জনের জন্য যে-শিশুকে মঞ্চে নামতে হয়েছিল, পরে ভ্রাম্যমাণ নাচ-গানের দলে যুক্ত হয়ে নিতে হয়েছিল অভিনয়ের পাঠ – সেই মানুষটির মধ্যে ছিল এমন একটি সহজাত প্রতিভা, যা তাঁকে নিয়ে এলো সদ্য আবিষ্কৃত সিনেমা নামক নব্য মাধ্যমটির পাদপ্রদীপের আলোয় – অচিরেই যা তাঁকে এনে দিলো এক অনন্যসাধারণের শিরোপা।

দারিদ্র্যলাঞ্ছিত বস্তিজীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা যে তাঁকে শিল্পী হতে সাহায্য করেছিল, সে-কথা চ্যাপলিন লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। নানা অভিজ্ঞতাময় সে-জীবনে মূলত ছিল একধরনের লাঞ্ছনা।

সেই লাঞ্ছনার কষ্ট ভুলে যেতে তাঁকে সাহায্য করেছে স্নেহময়ী মায়ের অপার ভালোবাসা আর দাদার প্রগাঢ় পরিচর্যা। মায়ের কাছ থেকেই মূলত অভিনয়ের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন শিশু চ্যাপলিন। সে-শিক্ষায় শিল্পের অনুভব থেকে বেশি ছিল উপার্জনের তাগিদ। একদিকে মায়ের ঐকান্তিক চেষ্টা, অন্যদিকে শিশু চ্যাপলিনের সহজাত প্রতিভা তাঁকে দর্শকসমাজে সমাদৃত করে তুলেছিল। অতি-শৈশবকাল থেকে মানব চরিত্র বুঝে নেওয়ার এক অসীম দক্ষতা এবং তাকে শিল্পে রূপান্তরিত করার অভিনয়প্রতিভার জোরে চ্যাপলিন হয়ে ওঠেন একজন সত্যিকারের জীবনশিল্পী। জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি পরিণত হলো অনপনেয় এক ভালোবাসায়। সেই দুরন্ত ভালোবাসাই তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিলো বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম এ-শিল্পমাধ্যমে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিককার সে-সময়টা ছিল দ্রুততম পরিবর্তনের, ভাঙনের আর নবতর সৃষ্টির। ঐতিহাসিক হবসনের মতে, এ-সময়টায় শেষ হয় ‘এজ অব এম্পায়ার’, শুরু হয় ‘এজ অফ এক্সট্রিমস’। শিল্প-বিপ্লবের বরপুত্ররা কোমরবেঁধে মাঠে নেমে পড়েছেন। যন্ত্রযুগের এক অভিনব সন্ধিক্ষণ তখন। নতুন পুঁজির অঢেল বিনিয়োগে বাজার তখন ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই সময়েই হেনরি ফোর্ডের গাড়ির কারখানার শ্রমিকদের মাইনে হয়ে যায় দ্বিগুণ। ওদিকে আকস্মিকভাবে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি একসঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে। শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এসবের মধ্যে পড়ে মানুষ হয়ে যায় একা, জীবন হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। মানুষের বোধে তখন এক ধরনের একাকিত্বের অসহায়তা বাসা বোনে। বোঝা যায়, অনুমেয় আর কাঙ্ক্ষিত বলে আর কিছু থাকবে না। ‘নিজের জিনিস নিজের দায়িত্বে রাখুন’ – এই আপ্তবাক্য হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় উপদেশ। কেননা, যে-কোনো মুহূর্তে আপনার সাজানো বলরুমে ঢুকে পড়তে পারে একজন ভবঘুরে। তছনছ করে দিতে পারে সব। প্রকৃত অর্থে ঢুকে পড়েও সে। ১৯১৪ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে তাঁকে প্রথমবার দেখা যায় পর্দায়। সেই ভবঘুরের নাম চার্লি চ্যাপলিন।

১৯১৪ সালে চ্যাপলিন প্রথম যে-ছবিতে অভিনয় করেন তার নাম মেকিং অ্যা লিভিং, প্রযোজক কিস্টোন স্টুডিওর মার্ক সেনেট। পরিচালনা করেন হেনরি লেহরম্যান। এক হাজার ফুটের এই ছবিতে চার্লি শুধু অভিনেতা। পরপর দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক ছবিতে তিনি শুধু অভিনয়ই করেন। এগারো নম্বর ছবি, যার নাম টোয়েন্টি মিনিটস অব লাভ  – এই ছবিতেই তিনি প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি মুক্তি পায় ওই বছরই। তারপর আর পেছন ফিরে দেখা নয়।

প্রথম ছবিতে চার্লির পোশাক ইত্যাদি ছিল ভিন্ন রকমের। চ্যাপলিনের কথা মনে এলেই যে-চেহারাটা আমাদের চোখের সামনে ভাসে, সেরকম নয়। এই ছবিতে তাঁর টুপি অনেক লম্বা, গোঁফ  মোটা, কোট অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। প্যান্ট অতটা ঢোলা নয়। সর্বজনপরিচিত ভবঘুরে চেহারায় তাঁকে দেখা যায় পরের ছবিতেই, যার নাম কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস। এই ছবির পরিচালক হেনরি লেহরম্যান। তিনিও এই ছবিতে অভিনয় করেন। ছবির গল্পে লেহরম্যান-অভিনীত চরিত্রটি একটি অটো রেস প্রতিযোগিতায় ভিডিওগ্রাফ করছেন আর চার্লি বারবার ইচ্ছা করে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। স্বভাবসিদ্ধ স্ল্যাপস্টিক মুভমেন্ট ছবির মূল হাস্যসূত্র হলেও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, এই ছবিতেই প্রথমবার দ্বিতীয় একটি ক্যামেরা দিয়ে – প্রথম ক্যামেরাটি, যা অভিনয়ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে, তাঁকে দেখানো হয়। যেন প্রথম ক্যামেরাটিও একটি চরিত্র।

চ্যাপলিন-পরিচালিত প্রথম ছবি টোয়েন্টি মিনিটস অব লাভের সময়সীমা মাত্র সাত মিনিট, যাতে তিনি হয়েছিলেন একজন পকেটমার। বলা বাহুল্য, পরিচালক হিসেবে তাঁর সমস্ত সম্ভাবনা ওই একটি ছবিতেই উঁকি মেরেছিল। এরপর ওই বছর চ্যাপলিন নিজের অভিনীত আরো কুড়িটি ছবি পরিচালনা করেন। প্রতিটি ছবিই বিষয়বৈচিত্র্যে ও প্রায়োগিক উদ্ভাবনের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তৃতীয় ছবি ম্যাবেলস স্ট্রেঞ্জ প্রিডিকামেন্ট। ভবঘুরে হিসেবে চার্লির প্রথম ছবি হলেও মুক্তি পায় পরে। এই ছবিরও পরিচালক হেনরি লেহরম্যান। গল্পটা ছিল – ম্যাবেল নামক এক নারী রাতপোশাক পরে থাকা অবস্থায় মাতাল চার্লির সামনে পড়ে যায়। টালমাটাল চার্লির হাত থেকে বাঁচতে মেয়েটি যা যা করে, তা-ই জন্ম দেয় বিপুল হাস্যরসের।

ভবঘুরে হিসেবে নিজেকে নানারকম নাকাল করে এই অপরকে আনন্দ দেবার অভিনব উদ্ভাবন, যা তাঁকে দিন দিন দর্শক সমাজে আদরণীয় করে তুলেছে। বস্ত্তত চার্লিও দিনদিন নানা ভাবনাচিন্তা তথা শারীরিক দক্ষতা প্রদর্শন করার প্রয়াস পেয়েছেন একটার পর একটা ছবিতে।

বিশ্বব্যাপী অবদমিত মানুষের প্রতীক হিসেবে চ্যাপলিনকে উপস্থাপিত করার এ-কৌশলটি জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিল; কিন্তু গোড়ার দিককার চ্যাপলিন-সৃষ্ট চরিত্ররা কোনো  গোষ্ঠীবিশেষের প্রতিনিধি নয়, বরং তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকজন মানুষ, যাঁরা সর্বদাই সন্দিগ্ধ। প্রবল হাস্য-উদ্রেককারী এই ফিজিক্যাল কমেডির আড়ালে থাকা তীব্র ক্ষোভ ও বিরক্তি তাঁদের প্রত্যেককে করে তুলেছিল স্বেচ্ছাচারী, সন্দেহপ্রবণ ও অননুমেয়।

যিনি একদা বলেছিলেন, ‘To truly laugh, you must be able to take your pain and play with it …’ সেই চ্যাপলিন নেদারল্যান্ডসে একটা পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শিল্প হলো পৃথিবীর কাছে লেখা ভালোবাসার চিঠি। তাই আজীবন তিনি তাঁর সব ছবিতে সেই ভালোবাসারই ছবি এঁকেছেন। তাঁর সম্পর্কে জা রেনোয়ার সেই উক্তিটি মনে পড়ে –  ‘The master of masters, the film-maker of film-makers, for me is still Charlie Chaplin.’ সিনেমা এবং চ্যাপলিন তাই এক এবং অবিচ্ছেদ্য একটি অস্তিত্ব – এ-কথা মনে রেখেই সত্যজিৎ রায় এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘If there is any name which can be said to symbolize Cinema – it is Charlie Chaplin.’ জা লুক গদার লিখেছিলেন, ‘He is beyond praise because he is greatest of all.’ আর অগণিত দর্শক যা যা বলেছেন, সেই অসংখ্য কথার ফুলঝুরি দিয়ে একখানি অজর অমর ভালোবাসার মালা গাঁথা যায়। কেননা, যাঁর উদ্দেশে এ-ভালোবাসার শ্রদ্ধার্ঘ্য সেই চার্লি চ্যাপলিনের আত্মদর্শন ছিল – ‘You need power only when you want to do something harmful. Otherwise love is enough to get everything done.’

বিংশ শতাব্দীর একটা বড় সময় জুড়ে প্রায় একশটি ছবিতে কাজ করার সুবাদে চ্যাপলিন হয়েছেন বিশ্ববরেণ্য একজন শিল্পী। সিনেমার ইতিহাসে কেবল নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসে চ্যাপলিন একজন প্রকৃত বরেণ্য মানুষ। তাই তাঁর ছায়াছবির জগতে আসার শতবর্ষকে কুর্নিশ জানাতে চাই। পেছন ফিরে দেখতে গিয়ে আমাদের চোখ ভরে যায় জলে, গর্বে বুক ফুলে ওঠে। মন বলে ওঠে – ‘এই পৃথিবী একবারই তাঁকে পায়।’