ছুঁচোর কেত্তন

নীহারুল ইসলাম

স্বাভাবিক নিয়মেই আমার মৃত্যু হয়েছিল। তবে আমার ইচ্ছানুসারে আমাকে দাহ করা হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিসাধনে মেডিক্যাল কলেজে আমার দেহটা উৎসর্গ করা হয়েছিল। তারপর কত দিন! কত রাত! কত অন্ধকার পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ছুঁচো জন্ম পেয়েছি। নিজেকে ধন্য মনে করেছি। যদিও নিজেকে ধন্য মনে করার পেছনে আরেকটা কারণ আছে, ছুঁচো জন্ম পেলেও আমার অবস্থান হয়েছে জ্ঞানরাজ্যে। মনের সুখে সেখানেই আমি জ্ঞানচর্চা করছিলাম। একদিন আচমকা কোথা থেকে কী একটা এসে আমার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জ্ঞানরাজ্যে আছি তাই চমকালাম না। নিজের পায়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম একটা মানুষ!

এবার আর না চমকে পারলাম না। জ্ঞানরাজ্যে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না! এতদিন আছি, একা আছি। একটা পিঁপড়েও চোখে পড়েনি কোনোদিন! তাহলে জলজ্যান্ত মানুষটা এলো কোত্থেকে? আমার মতোই কি কেউ মরে গিয়ে মানবজন্ম পেয়ে ঠাঁই পেলো এখানে? আমার সঙ্গী হলো? নাকি এর পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে! আমার কিছুই বোধগম্য হয় না। মানবজন্মে যেমন মূর্খ ছিলাম, এতদিন জ্ঞানরাজ্যে থেকেও যে তেমন আকাট মূর্খই রয়ে গেছি, বেশ বুঝতে পারছি।

এর মধ্যে মানুষটা আমার পা ছেড়ে নিজের দুহাত জোড় করে উঠে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। নতমস্তকে আমার উদ্দেশে বলছে, অপরাধ নেবেন না হুজুর! চরম বিপদে পড়ে আপনার পায়ে সিজদা ঠুকেছিলাম। যাতে আমার প্রতি আপনার নেকনজর পড়ে! যাতে আপনি আমাকে আমার সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করেন!

অত ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা কথা শোনার অভ্যাস আমার কোনোকালেই ছিল না। গ্রামের মোড়ল ছিলাম যখন, তখনই শুনিনি! আর এখন তো শোনার কোনো কথাই নেই! এখন কারো কথা শোনার মতো অত সময়ও নেই আমার কাছে। তবু কী জানি কেন – মানুষটাকে দেখে আমার খুব মায়া লাগে। তা ছাড়া প্রাণের প্রতি প্রাণের সহানুভূতি দেখানোই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানের নিদর্শন। জ্ঞানরাজ্যে থেকে, এতদিন জ্ঞানচর্চা করে অন্তত এটুকু না বুঝলে আর কী বুঝলাম? তাই মানুষটাকে অবজ্ঞা করতে পারলাম না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, কী রকম বিপদ? তাড়াতাড়ি বলে ফেলো!

– আর বলবেন না হুজুর! আপনার মৃত্যুর পর আমিও আপনার মতো গ্রামের মোড়লের পদে অধিষ্ঠিত হই। গ্রামের মানুষ আমাকে সর্বসম্মতিতে মোড়ল নির্বাচিত করে। আমি তাদের মতামতকে সম্মান জানিয়ে মোড়লের দায়িত্ব গ্রহণ করি। বেশ চলছিল। লোকে বলতে শুরু করেছিল পর্যন্ত যে, আমি নাকি আপনার চেয়ে ভালো মোড়ল! আমার মোড়লিতে গ্রামের ছিরি পাল্টে যাচ্ছে। গ্রামের প্রভূত উন্নতি হচ্ছে। আমি নাকি গ্রামের সবচেয়ে আধুনিকমনস্ক মোড়ল! বলতে পারেন, এরকম কথাবার্তা শুনে মাটিতে আমার পা পড়ছিল না। দেমাগে আমি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। বেশ কাটছিল। গ্রাম গ্রামের মতো ছিল। আর, আমি ছিলাম আমার মতো, উড্ডীয়মান! তার মধ্যেই হঠাৎ করে সেদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল গ্রামে।

– কী সেই ঘটনা? আমি জানতে আগ্রহ বোধ করি।

– বাশিরের দ্বিতীয় মেয়েটিও হঠাৎ করে লিপাত্তা হয়ে গেল হুজুর।

– কোন বাশির? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

– ওই যে হুজুর, এককালে যে-বাশির আপনার খুব ন্যাওটা ছিল। যার বড় মেয়েটি লিপাত্তা হওয়ার পর যে আপনাদের ছেড়ে আমাদের সমর্থন করে গ্রামে শাসনক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল! আমার চেয়ে আপনি বেশি জানেন তাকে। চেনেনও। যদি তার দ্বিতীয় মেয়েটির লিপাত্তা হওয়ার  কথা ছিল না। আপনি জানেন, এমনিতে সে খুব বিচক্ষণ! তবু গ্রামের মোড়ল হওয়ার পর আমি তাকে পইপই করে সাবধান করেছিলাম, বিটিকে আর লেখাপড়া করতে বাহিরে পাঠাস না বাশির। গাঁয়ে যেটুকু পড়ার পড়লে। ঘরের বিটি এখুন ঘরেই থাক। সুমায়মতো বিহা দিয়ে দিবি। ঝামেলা চুকে যাবে। তা, আমার কথা সে শুনলে না। বললে, লেখাপড়া না করলে নাকি জাতে ওঠা যায় না! আমি আর কী বলব? এটা জাতে ওঠার যুগ! সবাই জাতে উঠতে চায়। আমার মোড়লিতে কেউ যদি জাতে ওঠে, উঠুক! আমার সুনাম হবে। কিন্তু বাশিরের মেয়েটি জাতে ওঠা দূর, লিপাত্তা হয়ে আমার জাতে ওঠার বারোটা বাজিয়ে ছাড়লে দেখছি!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কীরকম?

– তাহলে প্রথম থেকে শোনেন হুজুর, বাশিরের দ্বিতীয় মেয়েটির সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ! ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত! বাস বা ট্রেন কোনোকিছুই চলছিল না। হাইরোডের ওপর গাছ ভেঙে পড়েছিল। রেলের  ওভার- হেডের তার ছিঁড়ে সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা! তবু সব বাধা অতিক্রম করে মেয়েটি রোজকার মতো একেবারে গ্রামের সীমায় এসে পৌঁছেছিল। আরেকটু হলে বাড়ির দাওয়ায় পা পড়ত তার। কিন্তু তার আগেই, গ্রামের ঢোকার মুখে চৌরাস্তার মোড়ে আপনার আমলের কারখানা গড়ার নামে পাঁচিলঘেরা জায়গাটা থেকে পাঁচটা ভূত বেরিয়ে এসেছিল।

– পাঁচটা ভূত! সেখানে ভূত এলো কোথা থেকে? কেন – সেখানে কারখানা হয়নি?

– কী করে হবে হুজুর? আমার সেই আন্দোলনটা যে আজো বেঁচে আছে! শুধু আমার গ্রামেই নয়, আশপাশের গ্রামেও আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়েছে।

– কোন আন্দোলনটা?

– ওই যে হুজুর, ‘লাঙ্গল যার/ জমি তার’! যে-আন্দোলনের ওপর ভর করে আপনি মোড়ল হয়েছিলেন। তারপর সেই আন্দোলনটাকেই ভুলে গেছিলেন!

আমার একটু একটু করে মনে পড়ছে। আমার শেষ সময়ে কারখানার জন্য জমি ঘেরাকে কেন্দ্র করে একটা আন্দোলন হয়েছিল বটে! এতক্ষণে আমার সামনে মানুষটাকে চিনতে পারি আমি। আমার এককালের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। বাশিরকেও মনে পড়ে আমার।  বাশিরের বড় মেয়েটি ওই আন্দোলনের সময় বলি হয়েছিল। কথাটা মনে পড়তেই আমি মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তা পাঁচটা ভূতে মেয়েটির কী করলে?

– কী করবে আবার? ভূতের যা কাজ, সেটাই করেছে! মেয়েটিকে লাশ বানিয়ে ফেলে রেখে চম্পট দিয়েছে।

– কোথায় লাশ বানিয়ে ফেলে রেখেছে?

– ওই যে বললাম, গ্রামে ঢোকার মুখে চৌরাস্তার মোড়ে কারখানার নামে পাঁচিলঘেরা জমিটায়!

– তুমি জানলে কী করে?

– আপনি যেভাবে জেনেছিলেন হুজুর!

আমার থমতম খাওয়ার অবস্থা! তবু কোনোরকমে জানতে চাই, কী জেনেছিলাম আমি?

– বাশিরের বড় মেয়েটি লাশ হওয়ার কথা!

মনে মনে আমি মানুষটার প্রশংসা না করে পারি না। মানুষটাকে নিজের সমকক্ষ মনে হয়। জ্ঞানরাজ্যে আছি বলেই হয়ত! আর কিছু জিজ্ঞেস করি না তাকে। সরাসরি পরামর্শক দিই, লাশটাকে পুড়িয়ে দাও। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।

– ল্যাঠা চুকে যাবে বললেই কি ল্যাঠা চুকে যায় হুজুর? আপনার কি ল্যাঠা চুকে গেছিল?

না, আমার ল্যাঠা চুকে যায়নি। ওই ঘটনার পর আমি আমার মোড়লি খুইয়েছিলাম। এক এক করে আমার মনে পড়ছে সব। এই মানুষটার চক্রান্তেই হয়েছিল সবকিছু। স্বভাবতই এই মানুষটার ওপর আমার রাগ হওয়ার কথা! কিন্তু আমার রাগ হয় না। মানুষটাই আমার কথায় রেগে যায়। বলে, আপনি কি আমার ওপর বদলা নিতে চাইছেন হুজুর?

– কী রকম বদলা? আমি জানতে চাই।

– এর মধ্যে সবকিছু ভুলে গেলেন হুজুর? যে-কাজ করে আপনি রাজপাট খোয়ালেন! এই জ্ঞানরাজ্যে নির্বাসিত হলেন! আমাকে আপনি সেই কাজ করতে বলছেন! কিন্তু আমি এত তাড়াতাড়ি রাজপাট খোয়াতে চাই না। আপনার মতো জ্ঞানরাজ্যে নির্বাসিত হতে চাই না।

– তাহলে কী করতে চাও?

– আমি আমার গ্রামের মোড়ল হয়েই থাকতে চাই। আপনি যতদিন মোড়ল ছিলেন তার চেয়েও বেশি সময় ধরে। আমি আপনার রেকর্ড ভাঙতে চাই। কী করে সেটা পারি, তার পথটা যদি বাতলে দেন হুজুর!

কী করে পথ বাতলাব? পথ বাতলাতে পারলে আমি তো নিজেই মোড়ল হয়ে থাকতাম এতদিন! ছুঁচো হয়ে জ্ঞানরাজ্যে ঠাঁই নিতাম কেন? না, এ-কথা আমি আমার এককালের প্রতিদ্বন্দ্বীকে বলতে পারি না। কেমন সঙ্কোচবোধ হয়! এককালের প্রতিদ্বন্দ্বী যেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে!

হ্যাঁ, ঠিক তাই। মানুষটা ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। আবার বলে ওঠে, বলেন হুজুর! বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন তাই দেবো।

– পথ বাতলে দিলে যা চাইব তাই দেবে?

– দেবো হুজুর। শুধু মোড়লিটা বাদ দিয়ে আপনি যা চাইবেন তাই দেবো।

– ঠিক বলছো?

– একশভাগ ঠিক বলছি হুজুর!

মানুষটার মরিয়া ভাব দেখে আমি তার কাছে কী চাইব, সেটাই ভুলে যাই। মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মানুষটাকে দেখি। যখন ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, কোনোদিন ভালো করে তাকাইনি। দেখিনি মানুষটা কেমন? বুঝতে চেষ্টা করিনি মানুষটা ভালো না মন্দ? সৎ না অসৎ? বুদ্ধিমান না বোকা? কিন্তু আজ বুঝতে চেষ্টা করি।

মানুষটা সেটা বুঝতে পারে না। আবার বলে, একশভাগ ঠিক বলছি হুজুর। যা চাইবেন তাই দেবো আপনাকে। আপনি শুধু বিপদে থেকে উদ্ধার হওয়ার পথটা আমাকে বাতলে দেন!

– তাহলে এককাজ করো। আগে তোমার আত্মাটাকে  আমার কাছে বন্ধক রাখো। আচমকা আমি বলে বসি।

– আত্মা বন্ধক রাখব! ‘আত্মা’ আবার কী জিনিস হুজুর?

‘আত্মা’ কী জিনিস, আমি মানুষটাকে বোঝাই কী করে? জ্ঞানরাজ্যে আসার আগে এই জিনিসটা সম্পর্কে আমার নিজেরও তেমন কোনো ধারণা ছিল না। এখনো ঠিকঠাক ধারণা হয়নি। তাহলে আমি তাকে ধারণা দিই কী করে?

চুপ করে আছি। ভাবছি, কী বলব? কিন্তু মানুষটা আমাকে চুপ থাকতে দেয় না। ভাবতে দেয় না। আবার আমাকে প্রশ্ন করে, ‘আত্মা’ জিনিসটা কী হুজুর? একটু বুঝিয়ে বলেন যদি!

– ‘আত্মা’ হলো সেই জিনিস যা আমাদের নেই। অথচ আছে বলে বিশ্বাস করে বেঁচে থাকি।

– তাহলে যে-জিনিস নেই, তা আমি আপনাকে দেবো কী করে?

– বিশ্বাসটা তো আছে তোমার?

– কীসের বিশ্বাস?

– এই যে, তুমি ভালো! তুমি সবার মঙ্গল চাও! তুমি কোনো অন্যায় করো না! অন্যায়কে প্রশ্রয় দাও না!

– তা আছে বইকি।

– ওই অনুভূতিটাই তোমার ‘আত্মা’। ওটাই তুমি আমাকে দাও।

– ওটা আপনাকে দিলে আর কী থাকবে আমার? আমি কী নিয়ে ফিরে যাব আমার গ্রামে? কী নিয়ে মোড়লি করব?

– কেন? তোমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে। বাশিরের মেয়েকে নিয়ে।

আমার কথায় মানুষটা কথা বলতে ভুলে যায়। আর, আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি। দেখি, একটা মানুষ কী অদ্ভুতভাবে একটা ছুঁচোতে রূপান্তরিত হয়! আমার নিজের ছুঁচোয় রূপান্তরিত হওয়া আমি দেখিনি। কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে রূপান্তরিত হতে দেখছি। কে জানে, আমার জ্ঞানের বৃত্ত সম্পন্ন হচ্ছে কি-না! হয়ত হচ্ছে। তাই আমি শেষবারের মতো তাকে জিজ্ঞেস করি, বাশিরের আর কোনো মেয়ে আছে নাকি হে?

– আছে হুজুর। আরো তিনটি মেয়ে আছে।

অদ্ভুত ব্যাপার – উত্তরটা শোনামাত্র আমি নিজেকে ছুঁচো থেকে আবার মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখি! না, আমি ভয় পাই না। বুঝতে পারি, জ্ঞানরাজ্যে এতদিনে সত্যিই আমার জ্ঞানলাভ সম্পন্ন হয়েছে। এতদিনে সত্যিই আমি দেবতায় উন্নীত হয়েছি। এখন শুধু আমার স্বর্গে আসনলাভের অপেক্ষা…