ছোটগল্পের ইংরেজি সংস্করণ

শরীফ আতিক-উজ-জামানের এগারোটি গল্পের ইংরেজি সংস্করণ বের করেছে ব্রিটেনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্পাইডারওয়াইজ। এটা এক ব্যতিক্রমী সম্মানের ঘটনা যে, বাংলাদেশের কোনো

লেখকের বই বিলেতের কোনো প্রকাশক প্রকাশ করেছেন। আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যে সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই।

কী আছে এ-গল্পগুলোতে? শরীফ আতিক-উজ-জামানের গল্পগুলো বিষয় ও চরিত্রচিত্রণে বৈচিত্র্যময়। আছে দেশভাগের যন্ত্রণা এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আমাদের সমাজবাস্তবতা ও প্রান্তিক মানুষের জীবনযন্ত্রণা। তিনটি গল্পে সরাসরি রয়েছে সাতচলিস্নশের দেশভাগ ও দেশভাগসঞ্জাত যন্ত্রণার আর্তি। মূল নামগল্পটিই ‘River Madhumati and The Broken Fiddle’ দেশভাগের নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণার এক গভীর আলেখ্য। সরাসরি দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে আরো দুটি গল্পে – ‘Shishubala, the Midwife’ ও ‘The Partitioned’-এ। ‘The Move’ ও ‘Faces on a Sketchebook’ গল্পে আছে বস্তিবাসী ফুটপাতবাসী প্রান্তিক মানুষের নিষ্করুণ জীবনের বিমানবিক চিত্র। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তনতা যে কত চরম ‘The Feminist’ ও ‘Housemaid’ গল্পদুটোতে তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের উচ্চাকাঙক্ষা গুঁড়িয়ে দেয় কোনো কোনো তরুণের স্বপ্ন এবং কীভাবে তাদের ব্যবহার করা হয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের উঁচুতে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে, তা তুলে ধরা হয়েছে সকরুণ বিশদতায় ‘Rider of a Dream Horse’ গল্পটিতে।

গল্পগুলি পাঠে মনে হয়, সাতচলিস্নশের দেশভাগ লেখক শরীফ আতিক-উজ-জামানকে যেন বিশেষভাবে তাড়িত করে। কারণ নামগল্পসহ বইটির একাধিক গল্পই হচ্ছে দেশভাগ নিয়ে। দেশভাগের ফলে স্বদেশ ছেড়ে গেলেও কি আসে কাঙিক্ষত মুক্তি? আসে যে না, গ্রন্থটির প্রথম গল্প ‘River Madhumati and The Broken Fiddle’ তার প্রমাণ, যেখানে অনুসূয়া চরিত্রটি বলছে – ‘বাংলাদেশে আমরা ছিলাম সংখ্যালঘু, আর ইন্ডিয়ায় আমরা হলাম রিফিউজি। কোন্টা ভাল বাবা?’ এ-প্রশ্নের উত্তর অবশ্য অনুসূয়ার বাবা হতভাগ্য অনির্বাণের জানা নেই!

সমাজের বঞ্চিত, প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে রয়েছে একাধিক গল্প – ‘The Move’ ও ‘Faces on a Sketchebook’। দারিদ্র্য এসব বস্তিবাসী মানুষের জীবনকে কীভাবে বিমানবিক করে তুলেছে তার এক প্রাণস্পর্শী চিত্র এঁকেছেন লেখক। সমাজের প্রান্তস্থ এসব মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে লেখকের সংলাপদক্ষতা প্রশংসনীয়। আর ফুটপাতবাসী এসব সর্বহারা মানুষের চরিত্রগুলোকে যে সংবেদের সঙ্গে শরীফ আতিক-উজ-জামান তুলে ধরেছেন তা লেখকের গভীর মানবতাবোধের পরিচয়ই বহন করে। এদের জীবনকে দেখার লেখকের চোখ গভীর সহমর্মিতার চোখ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিকে, তাদের সকল অনৈতিকভাবে সম্পদ সংগ্রহ ও জীবনাচরণকে দেখার চোখ আবার তীক্ষ্ম শেস্নষাত্মক। সমাজের উচ্চবিত্তদের অনৈতিক বিত্ত ও জীবনাচরণ, বা আমাদের সমাজের বর্তমান অসংলগ্নতা ও অমানবিক ব্যাপারগুলির ক্ষেত্রে, শরীফ
আতিক-উজ-জামানের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই হচ্ছে, ইংরেজিতে যাকে বলে – ডার্ক হিউমার, তীক্ষ্ম শেস্নষাত্মক এক দৃষ্টিভঙ্গি যা একই সঙ্গে কৌতুকময়ও এবং তা আঘাত হানে খুব মোক্ষমভাবেই।

বাংলা ছোটগল্প একটা সুদীর্ঘ ও গৌরবময় যুগ পার করে এসেছে। এটা ঠিক যে, বাংলা সাহিত্য একজন মপাসাঁ বা একজন চেখভ সৃষ্টি করতে পারেনি, তবে রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু ছোটগল্প, মানিক ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, এবং আরো কারো কিছু গল্প, নিঃসন্দেহে বিশ্বমানকে ছুঁয়েছে। বাংলাদেশেও অসামান্য কিছু ছোটগল্প লেখা হয়েছে – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহিরসহ আরো অনেকেই লিখেছেন সেসব গল্প। বিষয়ের গভীরতা এবং সমাজ ও চরিত্রদের চিত্রায়ণের দক্ষতা নিয়ে শরীফ আতিক-উজ-জামানের গল্পগুলিও বাংলাদেশের গল্প-ঐতিহ্যের এই উন্নত ধারাটিতে সংযুক্ত হবে বলে আশা করি।

নিজ গল্পগুলির অনুবাদ শরীফ আতিক-উজ-জামান নিজেই করেছেন। ঝরঝরে সুখপাঠ্য অনুবাদ এবং কখনো তা বাঙালির ইংরেজি হয়নি, যথার্থ ইংরেজিই হয়েছে। আর কিছু বাক্যাংশ ও শব্দচয়ন তো খুবই অব্যর্থ এবং তা অনুবাদে সঠিক ভাষা ব্যবহারের চমৎকার উদাহরণ হয়ে রইল। অনুবাদের গ্রহণযোগ্য মানও এ-বইটির একটি বড় ইতিবাচক উপাদান বলে আমার মনে হয়েছে।

গল্পগুলি পাঠে একজন সংবেদনশীল পাঠককে যা সবচেয়ে মুগ্ধ করবে, তা হচ্ছে, লেখকের বর্ণনার সূক্ষতা। লেখক স্থূলভাবে কিছু বলেন না। না ঘটনার বর্ণনায়, না চরিত্রদের মনোজগতের চিত্রায়ণে। যা বলেন তা বলেন খুব সূক্ষ্মস্তরেই। এবং সে-সূক্ষতার মধ্যে এমন একটা গভীরতা আছে যা পাঠককে মুগ্ধ করবেই। ইংরেজ প্রকাশকরা খুবই পেশাদার। কিছুটা উন্নাসিকও বটে। সহজে তাঁরা তৃতীয় বিশ্বের কারো বই ছাপেন না। শরীফ আতিক-উজ-জামানের বই যে তাঁরা ছেপেছেন তা এসব গল্পের সূক্ষ্ম বয়ান ও একই সঙ্গে গভীরতর যে-স্তর এবং এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গল্পগুলির যে উন্নত সাহিত্যমূল্য সৃষ্টি হয়েছে, সে-কারণেই।

সাহিত্যের একাধিক অঙ্গনে শরীফ আতিক-উজ-জামানের পদচারণা রয়েছে – উপন্যাসে, প্রবন্ধে, অনুবাদকর্মে; ছোটগল্পে তো বটেই। খুলনাবাসী এই লেখক নীরবে, কিছুটা নেপথ্যে থেকেই, যেন আমাদের সমাজ ও রাজনীতির এক জীবনালেখ্য লিখে চলেছেন। একজন লেখক হিসেবে শরীফ আতিক-উজ-জামানের এই সাহিত্য-সাধনা অনেকটাই যেন একলব্যের সাধনা। মহাভারতের একলব্যের মতোই যেন রাজধানী ঢাকার মূলকেন্দ্র থেকে দূরে খুলনায় বসে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন এবং তার এ-সাধনা আজ দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে বৈশ্বিক স্তরেও পৌঁছেছে। ইউরোপে শরীফ আতিক-উজ-জামানের এ-বইটির প্রকাশনা আমাদের সাহিত্যের জন্যে একটা খুবই ইতিবাচক ঘটনা বলে আমি মনে করি।