জগন্ময় মিত্র প্রণয়-বিরহের যুগলবন্দি

আবুল আহসান চৌধুরী

 

সুরসাগর জগন্ময় মিত্র (১৯১৮-২০০৩) সম্পর্কে তাঁর এক খ্যাতিমান অনুজ-শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন :

জগন্ময় মিত্র এক অসাধারণ সঙ্গীতপ্রতিভা। একসময় এক বিশেষ ধরনের গানে সমগ্র বাংলাকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। সর্বনিম্ন এক লাখ রেকর্ডের গান যদি বিক্রি হতো, সেটা তাঁর কাছে ছিল চিমত্মার বিষয়।

অত্যন্ত স্পষ্টবাদী আর অভিমানী জগন্ময়বাবু। আত্মসম্মানজ্ঞান এত বেশি ছিল যে, একসময় এইচএমভির কোনো একজন উঁচু-মাপের অফিসার তাঁকে একটু কটূক্তি করলে পরের দিনই তিনি পদত্যাগ করলেন এইচএমভি থেকে।

তারপরই চলে যান বম্বে। হিন্দি গানের জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড় হয়ে গিয়েছিল। কারণ, তিনি প্রচুর গীত-গজল রেকর্ড করেছিলেন এইচএমভি থেকে।

জগন্ময় বম্বে গিয়ে জগমোহন-নামেও খ্যাত হন। তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী।…১

এই মূল্যায়নধর্মী স্মৃতিচারণা থেকে কয়েকটি বিষয়ের সুলুক মেলে : ক. জগন্ময় মিত্রের অসামান্য সাংগীতিক-জনপ্রিয়তা, খ. তাঁর গায়নশৈলীর বৈশিষ্ট্য, গ. প্রবাসে হিন্দি গজল-গীতের জগতে তাঁর খ্যাতি ও পরিচিতি, ঘ. তাঁর দৃঢ় চরিত্র ও কঠিন সিদ্ধান্তের পরিচয়।

 

দুই

বাড়িতে সংগীতচর্চার আবহ ছিল। ছেলেবেলা থেকেই নামি গাইয়ে-বাজিয়ের তালিমের ব্যাপারটা তাই অপার কৌতূহলে খেয়াল করার সুযোগ পেয়েছিলেন। গুরুজনদের অনুপস্থিতিতে বা চোখ এড়িয়ে সে-বয়সেই ঢুকে পড়তেন নিজেদের ‘বার-বাড়ির ওস্তাদদের ঘরে’। আর ধূম্রশলাকা ‘গুরুদক্ষেণা’ দিয়ে ‘গোপনে রাগ-রাগিণী ও তবলাবাদকের কাছ থেকে তবলার বোল’ শেখার সুযোগ কাজে লাগান। কিন্তু এ তো নিয়মমাফিক শিক্ষা নয়, ‘উড়ো খই’য়ের নৈবেদ্যর মতো। এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো আরো ছ-সাত বছর। গান শেখার স্বাধীন সুযোগ এলো প্রবেশিকা পাশের পর। সেও গোপনে – লুকিয়ে-চুরিয়ে। কেশব মুখোপাধ্যায়কে গুরু ধরলেন, হাতেখড়ি হলো ধ্রম্নপদ-খেয়াল টপ্পা-ঠুমরির। কৈশোরেই একপর্যায়ে সাহিত্যিক-সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হন জগন্ময় – দিলীপকুমারের আগ্রহে তাঁর কাছে গান শেখার সুযোগ মেলে। কিছুকাল পরে দিলীপকুমারকে পাকাপাকি প–চেরি চলে যেতে হয়। যাওয়ার আগে তিনি শিষ্য জগন্ময়কে বন্ধু ওস্তাদ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হাওলা করে দিয়ে যান। জগন্ময় উত্তরকালে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাঁর সংগীতজীবনে দিলীপকুমারের অবদানের কথা। মরমি ও তপস্বী গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে জগন্ময়ের সংগীতজীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হয় – একে তাঁর গান শেখার শ্রেষ্ঠ পর্বও বলা চলে। ভীষ্মদেবের কল্যাণেই তাঁর চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে যোগ ঘটে।

 

তিন

দুটি ঘটনায় জগন্ময় মিত্রের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। গুরু কেশব মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখার সময়েই জানুয়ারি ১৯৩৮-এ বেঙ্গল মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশন। এই সংগীত-প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অখ্যাত জগন্ময় বিস্ময় সৃষ্টি করলেন। ধ্রম্নপদ-টপ্পা-ঠুমরি-বাউল-কীর্তন-রাগপ্রধান গানে প্রথম হলেন – তবে কিছুটা আফসোসের সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন : ‘যে গানে আমার প্রচার বা প্রতিষ্ঠা…, সেই আধুনিক বাংলা গানে হলাম তৃতীয়।’ ২  এই ফলাফলের পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন রকমের। পরিবারের গুরুজনেরা এই ঘটনাকে জগন্ময়ের ‘বরবাদ’ হওয়ার লক্ষণ হিসেবে সাব্যস্ত করেন এবং এতে ‘বংশের মুখে চুনকালি লেগে যাবে’ বলে তাঁদের মনে আশঙ্কা জাগে। কিন্তু তাঁর এই সাফল্যের ফলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এর কিছু পরে এলাহাবাদের অল ইন্ডিয়া মিউজিক কম্পিটিশনে অংশ নেওয়ার সুযোগ ঘটে। এই প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাপনায় ছিল প্রয়াগ সংগীত সম্মেলন। জগন্ময় খেয়ালে অংশ নিয়ে প্রথম হন। এই প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ। জগন্ময়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে এই প্রতিযোগিতার আসর থেকেই। সংগীত-সমঝদার মানুষের মুখে আর খবরের কাগজে তাঁর প্রশংসা প্রকাশ পায়। কিন্তু বিভ্রাট বাধে নাম নিয়ে। উচ্চারণ, বানান-বিভ্রাট কিংবা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক তাঁর নাম ছাপা হয় ‘জগমোহন মিত্র’। জগন্ময় বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনলে, তাঁরা তাঁর আপত্তি খারিজ করে দেন – শেষ পর্যন্ত ‘জগমোহন’ নামটিই পাকাপাকি বহাল থাকে, হিন্দিবলয়ে একসময় ‘মিত্র’ পদবিও ঝরে পড়ে। এরপর একে একে ফয়জাবাদ, গোরখপুর, মিরাট, লখনউ – উত্তরপ্রদেশের নানা জায়গা থেকে সংগীত-পরিবেশনের আমন্ত্রণ আসতে থাকে, এখানে ‘জগমোহন’ নামেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। উত্তরকালে যখন তিনি বাংলা মুলুক ছেড়ে বোম্বাইয়ে পাড়ি জমান, তখন সেখানে হিন্দি গজল-গীতের গায়ক হিসেবে ‘জগমোহন’ নামটিই তিনি গ্রহণ করেন। এইভাবে বাংলা গানের ‘জগন্ময় মিত্র’ হিন্দি গানের জগতে হয়ে ওঠেন ‘জগমোহন’।

এলাহাবাদে সংগীত-প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে এসে জগন্ময় মিত্র উত্তরপ্রদেশে গানের সুবাদেই থেকে যান বেশ কয়েক মাস। কলকাতায় ফিরে আসেন ১৯৩৮ সালের ‘শেষের দিকে’। যে ক-মাস এলাহাবাদ-লখনউয়ে ছিলেন, সময়টাকে তিনি বেশ কাজে লাগিয়েছিলেন। সংগীতনগরী লখনউয়ে জগন্ময় প্রথমে ডি. সি. দত্ত ও পরে তাঁরই কল্যাণে প্রখ্যাত ওস্তাদ শম্ভু মহারাজের কাছে ঠুমরি ও খেয়ালের তালিম নেন। এখানেই কুন্দনলাল সায়গলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সায়গল কিছুদিন লখনউয়ে থেকে মহারাজের কাছে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের করুণ-বিধুর-মর্মস্পর্শী ‘বাবুল মোরা নইহার ছুটো যায়’ গজলটি শিখেছিলেন। সামান্য সময়ের ব্যাপার বটে, তবু একদিক দিয়ে সায়গলকে জগন্ময়ের ‘গুরুভাই’ বলা যায়। পরে সায়গল যখন কলকাতায় আসেন, ফিল্ম ও গানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তখন দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্য-সৌহার্দ্য। লখনউ থেকে কলকাতায় ফিরে এসে জগন্ময়ের সংগীতজীবনের এক নতুন পর্ব শুরু হয় গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে।

 

চার

জগন্ময় জন্মেছিলেন ১৯১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, কলকাতার চেতলায় মাতুলালয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁর জন্মের একমাস আগে পিতা যতীন্দ্রনাথ মিত্রের মাত্র পঁচিশ বছরে অকালে মৃত্যু হয়। পিতৃহীন জগন্ময়ের শৈশবের দিনগুলো কেটেছে মাতামহ-মাতামহী এবং পিতামহ-পিতামহী আর   পিতৃব্যদের অপার স্নেহ ও যত্নে। কলকাতায় এঁদের আদি আবাস ছিল কলকাতার আপার সারকুলার রোডে, পরে বাড়ি বদল করে বালিগঞ্জে বসতি গড়েন। পৈতৃক বাড়ি ছিল ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার মহকুমার মালা গ্রামে। মিত্র-পরিবারে সংগীতের আবহ ছিল, তার প্রভাব জগন্ময়ের শিশুমনে বেশ ভালোভাবেই পড়েছিল। স্কুলের লেখাপড়া শুরু হয় বালিগঞ্জের জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে, আর প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন চেতলা বয়েজ এইচ. ই. স্কুল থেকে। এরপর সম্ভবত কলকাতার কোনো কলেজে ভর্তি হন, তবে সে-তথ্য অজ্ঞাত। মনে হয় গানের নেশায় কলেজের পড়া বেশিদূর এগোয়নি। জগন্ময় বিয়ে করেন ১৯৪৩-এর এপ্রিলে। কিন্তু কয়েক মাসের ভেতরেই স্ত্রীর মৃত্যু হয়। জগন্ময় তাঁর স্মৃতিকথায় তাঁর এই বিয়ে সম্পর্কে মাত্র তিনটি বাক্য ব্যয় করেছেন, তাতে স্ত্রীর নাম-পরিচয় বা তাঁর মৃত্যুর কারণ বিষয়ে কোনো কিছুই জানাননি। শুধু মন্তব্য করেছেন : ‘দীর্ঘশ্বাসের আঁচ এত শক্তিশালী এর আগে জানা ছিল না।’ ৩ এর দুবছর পর জগন্ময় বেশ ঘটা করে বড় ঘরে বিয়ে করেন। ২৪ মে ১৯৪৫ তাঁর সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ দের কনিষ্ঠ কন্যা গীতার বিয়ে হয়। গীতা দে শুধু সুন্দরীই ছিলেন না, সেইসঙ্গে অনেক গুণের সমাহারও ঘটেছিল তাঁর মধ্যে – সংগীতে শুধু অনুরাগ নয়, রীতিমতো ওস্তাদ ধরে কিছুকাল গান শিখেছেন, গায়িকা হিসেবেও নিজেকে তুলে ধরেছিলেন। অনাদি ঘোষ দসিত্মদারের পরিচালনায় জগন্ময়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে তাঁর রবীন্দ্রনাথের দুটি গানের (‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’ এবং ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে’) ডিস্ক রেকর্ড বেরিয়েছিল এইচএমভি থেকে। কিন্তু সাংসারিক দায়িত্ব ও জগন্ময়ের সংগীতসাধনাকে নির্বিঘ্ন করার কারণে সুকণ্ঠী এই শিল্পীকে গানের জগৎ থেকে সরে আসতে হয়, – ঠিক যেমন আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল মীরা দেববর্মনকে স্বামী শচীন দেববর্মনের জন্যে। জগন্ময়-গীতার দাম্পত্যজীবন ছিল সমঝোতার ও সুখের। তাঁদের তিন পুত্র (জিষ্ণু, অঞ্জন, অর্পণ) ও দুই কন্যা (ঝুমুর, নূপুর) – দেশে-বিদেশে বসবাসরত পুত্র-কন্যারা সবাই নিজের নিজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

জগন্ময়ের ওপর দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি শোকের ঝড় বয়ে যায় : মা আর স্ত্রীর প্রয়াণ। ১৯৮১-এর ফেব্রম্নয়ারিতে মা চলে গেলেন, জগন্ময় তখন বিলেতে। মা ছিলেন জগন্ময়ের জীবনের বাতিঘর। ষোলো বছর বয়সে অকালে বিধবা হওয়ার পর সুখে-দুঃখে স্নেহে-শাসনে এই মহীয়সী রমণী একমাত্র সমত্মানকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। মা যে জগন্ময়ের জীবনের কতখানি দখল করে রেখেছিলেন তার প্রকাশ তিনি নানাভাবে করেছেন। তাঁর স্মৃতিচর্চার বই শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে (১৯৮৫) মা-কে উৎসর্গ করতে গিয়ে তাঁকে ‘সর্বত্যাগিনী’ অভিহিত করে যে-কথাগুলো বলেছিলেন, তাতে তাঁর গভীর মাতৃপ্রীতির পরিচয় মেলে : ‘মা’র ঋণ কখনও পরিশোধ করা যায় না। আমিও চাই না। শোধ হয়ে গেলে দেনা-পাওনার হিসাবও শেষ হয়ে যাবে। মাকে তাহলে ফিরে পাব কি করে!’

স্ত্রী গীতা মিত্র জগন্ময়ের জীবনে ছিলেন : ‘গৃহিণী সচিব সখি মিত্রা : প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।’ সুখে-দুঃখে, প্রেমে-বেদনায়, শোকে-আনন্দে একসঙ্গে ৩৬ বছর তাঁরা কাটিয়েছেন। জগন্ময়-পত্নী বেশ আগে থেকেই বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই রোগ তাঁর মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছিল। কিন্তু মৃত্যু ত্বরান্বিত হলো বস্নাড ক্যান্সারে। ভরা সংসার রেখে গীতা মিত্রের মৃত্যু হয় ১৯৮১ সালের ৩ নভেম্বর। স্বাভাবিকভাবেই সাথিহারা জগন্ময় হয়ে ওঠেন
বিহবল-বিপর্যস্ত। শোককাতর জগন্ময়ের মনে একধরনের দার্শনিকতার ছাপ লাগে, তাই তিনি বলতে পারেন : ‘জন্মমৃত্যুর রহস্যের সঙ্গে কি অপূর্ব হাসি-কান্নার সম্বন্ধ।… ক্রন্দনের দ্বারাই মানুষ এই পৃথিবীতে তার আগমনবার্তা ঘোষণা করে, তখন বাকি সবাই হাসতে থাকে, কিন্তু মৃত্যুর সময়ে সেই মানুষই যায় হাসতে হাসতে – ক্রন্দন রেখে যায় তাদের জন্য যারা রইল পড়ে।’ ৪  স্ত্রীর মৃত্যুর পরও জগন্ময় বাইশ বছর বেঁচে ছিলেন, স্মৃতির আলোছায়ায়। প্রচ্ছন্ন শূন্যতা আর হাহাকারে কেটেছে এই দীর্ঘ সময়।

পঞ্চাশের শেষভাগে কলকাতার পাট চুকিয়ে জগন্ময় পাকাপাকি বোম্বাই (এখন মুম্বই) চলে যান। স্মৃতি ছাড়া পিছুটান আর রইল না, চেতলার বাড়িটাও বিক্রি করে দিলেন। বোম্বাই গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্যে একসময় জুহুতে বাড়িও কিনলেন। খ্যাতি-যশ-অর্থ সবই পেলেন এখানে এসে। কিন্তু তবু কিসের যেন অতৃপ্তি আর হাহাকার মনের গহিনে। কী এক তীব্র অভিমান ও বিতৃষ্ণায় কলকাতার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটল। পরে অবশ্য আবার কলকাতায় যাওয়া-আসা শুরু হলো গান রেকর্ডিং বা সংগীতানুষ্ঠানের সুবাদে, তবে ছেঁড়া তার আর জোড়া লাগল না। মা আর স্ত্রীর মৃত্যুতে যে গভীর শোক অন্তরকে বিক্ষত করে তোলে, আমৃত্যু তার উপশম হয়নি। এই অবস্থায় মানসিক শান্তির জন্যে একবার ভেবেছিলেন প–চেরি চলে যাবেন, নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে অন্য একটি আশ্রমে ঠাঁই নেন, কিন্তু সেখানেও মন টেকেনি – কিছুদিনের মধ্যেই আবার জুহুর বাড়িতে ফিরে আসেন। এই মানসিক টানাপড়েন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পুরোপুরি শেষ হয়নি। জগন্ময় মিত্রের মৃত্যু হয় ২০০৩-এর ৩ সেপ্টেম্বর বোম্বাই নগরীর জুহুর বাড়িতে। ৮৫ বছরের আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে বাংলা ও হিন্দি – বিশেষ করে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে কলকাতার The Statesman (6 September 2003) পত্রিকায় এই শোক-খবরটি ‘Obituary : Jaganmoy Mitra’ শিরোনামে প্রকাশ পায় – এই শোকাঞ্জলিতে হ্রস্ব-কলেবরে জগন্ময় মিত্রের জীবনবৈচিত্র্য ও
সংগীতকৃতির পরিচয় ধরা পড়েছে :

Veteran singer Jaganmoy Mitra (1918-2003), better known as Jagmohan, passed away at his Mumbai residence on Wednesday, leaving behind three sons, two daughters and admirers all over the globe.

Jaganmoy Mitra was born in a family of rich landowners. His family had no desire to see him become a professional singer, and hence, he had to face strong opposition in becoming one. His quest for a guru continued till Dilip Kumar Roy of Pondicherry chanced to hear him. Roy’s tutelage and Jaganmoy’s untiring efforts yielded fruit. In 1937, he won the All Bengal Music Competition. The following year, he was adjudged the best Kheyal singer in the All India Music Competition.

Jaganmoy’s first disc was released in 1939 and he never looked back. He was known as the father of the Hindi Geet. By the
mid-forties, Tagore songs rendered by him had made him a household name throughout Bengal. He was appointed as examiner for music by the Calcutta University.

In the early-fifties, at the peak of his popularity, Jaganmoy left for Bombay following ideological differences with the Gramophone Company. After his success as music director in the film Sardar, he was flooded with offers. But he kept his distance from the film world.

Jaganmoy was awarded the Padmashree in the late-nineties in recognition of  his contribution to Bengali modern songs. ৫

 

পাঁচ

জগন্ময় মিত্র নানা মাধ্যমে সংগীতের জগতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন : বেতার, গ্রামোফোন রেকর্ড, চলচ্চিত্র, জলসা-অনুষ্ঠান এবং শেষপর্বে কিছু পরিমাণে টেলিভিশনে। সব মাধ্যমেই গান গেয়ে শ্রোতাদের মনোযোগ ও প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। তাঁর এই যশ-খ্যাতি-পরিচিতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দূর-দেশেও পৌঁছে গেছে।

সংগীতে জগন্ময়ের আত্মপ্রকাশ রেডিয়োতেই। কথাপ্রসঙ্গে বলেছেন : ‘রেডিয়োর ওপর আমার বড়ো দুর্বলতা। সেই যে জীবনের শুরুতে রেডিয়োর সঙ্গে (১৯৩৬-৩৭) যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল তা আজও নিরবচ্ছিন্ন। তাই রেডিয়োকে ভালবেসে ফেলেছি।’৬ দিন দিন এই ‘ভালবাসা’ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কলকাতা কেন্দ্রে মাত্র উনিশ বছর বয়সে গান গাওয়ার সুযোগ পান। সংগীত পরিবেশন শুরু হয় স্কুল ব্রডকাস্ট প্রোগ্রামে। প্রথম প্রথম বিনা পারিশ্রমিকে, পরে প্রতি প্রোগ্রামে পাঁচ টাকা করে শিল্পী-সম্মানী নির্ধারিত হয়। একসময় রেডিয়োতে তাঁর গুরুত্ব ও উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। এই মাধ্যমে গান গাইতে তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। জগন্ময়ের খ্যাতি ও পরিচিতির মূলে যে রেডিয়োরও বড় ভূমিকা আছে তা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই রেডিয়ো সম্পর্কে তাঁর আকর্ষণ ও অনুরাগের কথা বলতে কখনো দ্বিধা করেননি। রেডিয়োর সঙ্গে তাঁর অনেক সুখদুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। সেকালের অনেক গুণী শিল্পী ও যন্ত্রী এবং অনুষ্ঠান-প্রযোজক বা সংগীত-পরিচালকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে, সেই পরিচয় কারো কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। পঙ্কজকুমার মলিস্নক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার এবং সংগীত ও সংস্কৃতিজগতের আরো অনেক কৃতী ও খ্যাতিমান মানুষের সঙ্গ-সান্নিধ্যলাভের সুযোগ তিনি পান। রেডিয়োর শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান ও যোগ্য সম্মানীর জন্যে জগন্ময় সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন এবং এ নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন কলকাতা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীসংঘের অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে।

শিল্পী ও সংগীত-পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রের সঙ্গেও জগন্ময় মিত্রের যোগ ছিল। বাংলা ও হিন্দি ছবিতে কলকাতা ও বোম্বে দু-জায়গাতেই জগন্ময় কাজ করেছেন। গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কল্যাণে হিন্দি ছবি গরিবিতে প্রথম পেস্ন-ব্যাকের সুযোগ মেলে। এ-প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণায় জগন্ময়  বলেছেন : ‘এই সময়ে ভীষ্মবাবু ফিল্ম করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (Film Corporation of India) নামে এক ফিল্ম কোম্পানির সংগীত-পরিচালকের পদ গ্রহণ করলেন এবং সহকারী হিসেবে নিলেন শ্রীশচীন দেববর্মনকে। আমাকে ডাক দিলেন গান গাইবার জন্য। হিন্দি ছবি। দু-তিনটি গান আমি গাইলাম। কোনোটা ডুয়েট, কোনোটা কোরাস। ফিল্মের
পেস্ন-ব্যাক বা নেপথ্য গানের হাতেখড়ি হলো আমার ওস্তাদের হাতে। যতদূর মনে পড়ে প্রথম পেস্ন-ব্যাক গান গেয়েছিলাম হিন্দি ছবি গরিবিতে, যার সুরকার ছিলেন স্বয়ং ভীষ্মবাবু। গানটি হলো – ‘চরখা চলকে কাম বানায়ে/ চরখা আয়ে গরিবি যায়ে \’৭   কাজ না থাকলেও ফি-দিনই স্টুডিয়োতে আসতে হতো। আর এই অবসর সময়েই গুরু ভীষ্মদেব শচীন দেববর্মন ও জগন্ময় মিত্রকে তালিম দিতেন। জগন্ময় স্মরণ করেছেন : ‘সত্যি কথা বলতে কি, বেশিরভাগ তালিম আমার স্টুডিয়োতেই হয়েছিল’ এবং এতে শিক্ষানবিশি-পর্বে তাঁর ও শচীন দেববর্মন দুজনেরই খুব লাভ হয়েছিল।

পাপের পথে – এই বাংলা ছায়াছবিতে জগন্ময়ের প্রথম পেস্ন-ব্যাক শিল্পী হিসেবে আবির্ভাব। বাংলা ফিল্মে তাঁর অভিষেক হয়েছিল সুরসাগর হিমাংশু দত্তের আনুকূল্যে। দ্বৈতকণ্ঠের এই গানটির মুখটা ছিল এইরকম : ‘মধুকর স্বপনে জাগি/ কি বাণী কয়, নয়, নয়, নয়।’ বাংলা ফিল্মে জগন্ময়ের পেস্ন-ব্যাকের বিশদ বিবরণ আজ আর সুলভ নয়, তিনি নিজেও এ-পর্বের কথা সেরেছেন আভাসেই, যেমন : ‘বহু পরিচালক ও সংগীত-নির্দেশকের ছবিতে পেস্ন-ব্যাক (নেপথ্য সংগীত) গান দিলাম। পরিচালকদের মধ্যে শ্রীপ্রমথেশ বড়ুয়া, শ্রীদেবকী বোস, শ্রীশৈলজানন্দ, শ্রীনীরেন লাহিড়ী, শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্র ইত্যাদি। আর যেসব সংগীত-নির্দেশকের সুরে গান গেয়েছি তাঁদের কয়েকজন হলেন শ্রীকমল দাশগুপ্ত, শ্রীসুবল দাশগুপ্ত, শ্রীগিরীন চক্রবর্তী, শ্রীহিমাংশু দত্ত সুরসাগর, শ্রীঅনিল বাগচী, শ্রীদুর্গা সেন, শ্রীঅনুপম ঘটক ও শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে (অন্ধ গায়ক)। দ্বৈত-সংগীত অবশ্য অনেকেরই সঙ্গে গেয়েছি, তার মধ্যে বিশেষ করে উলেস্নখ করব শ্রীমতী কানন দেবীর নাম।’৮ বাংলা ফিল্মে জগন্ময়ের কিছু স্মরণীয় গানের উলেস্নখ এখানে করব : ‘অয়ি ভুবন মনোমোহিনী’ (রবীন্দ্রসংগীত, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন), ‘তুমি প্রেমতীর্থে’ (অবতার), ‘জীবনতারা হারিয়ে’ (অবতার), ‘সাতমহলা স্বপনপুরী’ (ব্রাহ্মণকন্যা), ‘নয়নজলে গভীর গাঙে’ (ব্রাহ্মণকন্যা), ‘রাম নাম মুখ বোল’ (ভক্ত কবীর), ‘নদীর দুটি তীরে’ (জীবনসঙ্গিনী), ‘স্বপ্নে আমায় কে পরাল মালা’ (আলেয়া), ‘আমার গানে তোমার হৃদয়’ (আলেয়া), ‘ও পরদেশী কোকিলা’ (শহর থেকে দূরে), ‘কলঙ্কি চাঁদ সে যে’ (চাঁদের কলঙ্ক), ‘জাগো জাগো দেবতা’ (শ্রীদুর্গা), ‘জয় হবে জয় হবে’ (মানে না মানা), ‘ও তুই ডাকিস মিছে’ (মানে না মানা), ‘গাঁয়ের মাটি ডাকে’ (বঞ্চিতা), ‘দে জল দে জল’ (বিরাজ বৌ), ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’ (জয়যাত্রা), ‘যায় যায় অভাগী’ (রং বেরং), ‘কে এলো হাতে বাঁশী’ (রং বেরং), ‘গৌরব দিন অবসানে’ (জাগ্রত ভারত), ‘জীবননদীর তীরে চলে’ (মায়াজাল), ‘রেলের গাড়ি ও ভাই’ (কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে), ‘শ্যামল সুন্দর নওল কিশোর’ (দুর্গেশনন্দিনী)।

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে জগন্ময় মিত্র বোম্বে চলে যান। জল্পনা আছে, এইচএমভির কলকাতা অফিসের কোনো বড়কর্তার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়, তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় তিনি কলকাতার পাট উঠিয়ে বোম্বেতে পাড়ি জমান। কিন্তু এই ঘটনা তাঁর বোম্বে যাওয়ার প্রধান কারণ নয়, একমাত্র কারণ তো নয়ই, অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে। মূলত ফিল্মের টানেই তাঁর বোম্বে যাওয়া, গ্রামোফোন কোম্পানির ঘটনা এখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। জগন্ময়ের স্মৃতিকথার সূত্রে জানা যায় : ‘পুরোনো বন্ধু শ্রীকমল মজুমদারের মাধ্যমে শ্রীনীতিন বোসের আহবান পেলাম বোম্বে যাবার জন্য। শ্রী ডি. শামত্মারামের একটা মারাঠি ছবির ডাবিং হবে বাংলাতে। নীতিনদা এই ছবির ডাবিং করার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাকে দিয়ে কয়েকখানা গান গাওয়াতে চান। সংগীত পরিচালক ছিলেন বসন্ত দেশাই।… বোম্বে পাড়ি দিলাম ১৯৫০ সালের শেষ ভাগে।’৯

এরপর জগন্ময় বোম্বেতে জলসা ও ফিল্মের কাজে জড়িয়ে পড়েন। সংগীতচর্চার এই অনুকূল আবহে তাঁর ‘মনে ইচ্ছা হল এই পরিবেশে স্থিতি হলে মন্দ হয় না’। অল্পদিনেই তিনি ফিল্মিস্থান কোম্পানিতে সংগীত-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। আগে থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে সি. রামচন্দ্র ও হেমন্তকুমার (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) সংগীত- পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। পূর্বপরিচিত বন্ধুস্থানীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক সহায়তা ও সান্নিধ্য জগন্ময়ের প্রবাসজীবনকে সহনীয় ও আনন্দময় করে তুলেছিল। ‘বাঁধা মাইনের’ চাকরির ‘ভরসা’য় কলকাতা থেকে সংসার তুলে আনেন বোম্বেতে। বাসা বাঁধেন ফিল্মিস্থান স্টুডিওর কাছাকাছি গোরেগাঁওয়ের এক বাংলো বাড়িতে। কিন্তু ফিল্মিস্থানের চাকরির ধরন-ধারণের সঙ্গে জগন্ময়ের তাল-মেলানো কঠিন হয়ে উঠল। তাই এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে হলো। তবে বেকার বসে থাকতে হয়নি তাঁকে, অল্প সময়ের মধ্যেই যোগাযোগ হলো বোম্বের নামি বাঙালি চিত্রপরিচালক জ্ঞান মুখার্জির সঙ্গে। তিনি জগন্ময়কে তাঁর সরদার (১৯৫৫) ছবির সংগীত-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দিলেন। অশোককুমার, রীণা রায়, নিগার সুলতানার মতো সেকালের জনপ্রিয় শিল্পীরা এতে অভিনয় করলেন। পেস্ন-ব্যাক করলেন লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, গীতা দত্ত ও হেমন্তকুমার। পরিচালকের কথায় ছবিতে জগন্ময়কেও গান গাইতে হলো। সরদার ছবির সংগীত-পরিচালক হিসেবে জগন্ময় খুব ভালোভাবেই উতরে গেলেন, বোম্বের কাগজে কাগজে তাঁর কাজের প্রশংসা হলো। সরদারের সাফল্যের পর জ্ঞান মুখার্জি নতুন ছবিতে হাত দিলেন, নাম আতিশ। অভিনয়ের কথা চূড়ান্ত হলো সেকালের জনপ্রিয় জুটি দিলীপকুমার আর মীনাকুমারীর। জগন্ময় মিত্রের সংগীত- পরিচালনায় গানের বিষয়টাও খানিক এগিয়ে গেলো। কিন্তু জ্ঞান মুখার্জির আকস্মিক মৃত্যুতে আতিশের পরিকল্পনাও ভেসেত্ম গেল, সেইসঙ্গে জগন্ময়ের হিন্দি ফিল্মে সংগীত-পরিচালনারও সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু জগন্ময় বোম্বে ছাড়লেন না, বোম্বেকে কেন্দ্র করে সারা ভারতবর্ষে তিনি নানা জলসায় হিন্দি গীত-গজল গেয়ে ভক্ত-শ্রোতাদের মুগ্ধ-অভিভূত করে রাখলেন। এই বোম্বে থেকেই নানা দেশে তাঁর সংগীত-সফর হয়েছে : পূর্ব আফ্রিকা, ব্রিটেন, কানাডা। গান গেয়ে শুধু প্রবাসী বাঙালি বা ভারতীয় নয়, বিদেশিদেরও মনোরঞ্জন করেছেন। বিবিসিতে অনেক গান রেকর্ড করেছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যেখানেই গান করেছেন শ্রোতাদের শ্রদ্ধা-সমাদর পেয়েছেন, পেয়েছেন আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা। পঙ্কজকুমার মলিস্নক একবার বলেছিলেন : ‘সুধাকণ্ঠ জগন্ময় তুমি। জগজ্জনের সম্মুখে জগতের মহিমা কীর্তন করে নিরবচ্ছিন্ন সুখ ও শান্তিতে জীবন যাপন করো…’ – বিশ্বসভায় গান গেয়ে ও মধুময় সংসারজীবন যাপন করে এই আশীর্বাদ সার্থক করেছিলেন জগন্ময়।

 

ছয়

জগন্ময় সারাজীবন গান গেয়ে গেছেন। এই গানের সুবাদেই অনেক অসামান্য কৃতী পুরুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সুযোগ ঘটে। এঁদের
সঙ্গ-সান্নিধ্য তাঁকে প্রাণিত-সম্মানিত-গৌরবান্বিত করেছে, এঁদের কদরদানিতে ধন্য-কৃতার্থ হয়েছেন তিনি। কারো কারো সঙ্গে গড়ে উঠেছে গভীর অন্তরঙ্গ
সম্পর্ক। এঁদের কেউ লেখক-শিল্পী, কেউ রাজনীতিক, কেউ শিক্ষাবিদ বা অভিনয়শিল্পী, কেউ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আবার কেউবা রাজা-মহারাজা। এ-ধরনের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব যাঁদের সংস্পর্শে জগন্ময় এসেছিলেন তাঁদের সংক্ষিপ্ত তালিকা এরকম : রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, শ্রী অরবিন্দ, নজরুল, বরোদার মহারাজা, লালগোলার রাজা, জয়প্রকাশ নারায়ণ, উমাশঙ্কর যোশী, প–ত রবিশঙ্কর, অশোককুমার প্রমুখ।

গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তাব্যক্তি হেমচন্দ্র সোম জগন্ময়কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একবার তাঁর খেয়াল হলো, জগন্ময়কে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড বের করবেন। হেম সোম একদিন জগন্ময়কে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে। জগন্ময়ের স্মৃতিকথায় এর বিশদ বিবরণ আছে। সে-যাত্রায় হেম সোমের সুপারিশে কবি জগন্ময়কে দুখানা গান রেকর্ড করার অনুমতি দেন : ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী’ আর ‘একদা তুমি প্রিয়ে’। কবি প্রথম গানটির একটি শব্দ পালটে দেন, ‘শুষ্ক’র জায়গায় করেন ‘ছিন্ন’। দ্বিতীয় গানটি গাইবার ধরন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জানালেন : ‘দেখ বাপু এই গানটি একটু ভালোবেসে গেও।’ রেকর্ডিংয়ের পর গানদুটি রবীন্দ্রনাথকে শোনালে তিনি মন্তব্য করেন : ‘জগন্ময় অপূর্ব গেয়েছে।’ এই প্রসঙ্গে অনুপ্রাণিত জগন্ময় গর্ব করে বলেছেন : ‘আমার রবীন্দ্রসংগীতের হাতেখড়ি হল স্বয়ং কবিগুরুর আকাশভরা আশীর্বাদে।’১০  দুজনের মুখোমুখি দেখা বা কথাবার্তা দু-তিনবারের বেশি হয়নি, কিন্তু জগন্ময়ের প্রতি কবির স্নেহ-মনোযোগ গড়ে উঠতে দেরি লাগেনি। কিছুটা সহজ-সম্পর্ক তৈরি না হলে কবির ‘হাঁটুর ব্যথা’র কথা জিজ্ঞেস করতে জগন্ময়ের দ্বিধা হতো। আবার ‘আরো একটু বসো/ আরো একটু বল’, এই গানটির অর্থ জানার অনুরোধ পেশও সস্নেহ প্রশ্রয়ের বিষয়টির কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রচলিত ধারণা অনুসারে এটি যে ‘রোম্যান্টিক গান’ নয়, সেদিন কবি জগন্ময়কে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথম রেকর্ডের গানদুটি রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করায় হেমচন্দ্র সোমের পক্ষে জগন্ময়ের জন্যে আরো দুটি গান রেকর্ডের অনুমতি কবির কাছ থেকে নেওয়া সহজ হয়েছিল। পরের রেকর্ডটি প্রকাশের আগেই রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হন, তাই এই গানদুটি (‘মম যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি’ ও ‘সে আসে ধীরে যায় লাজে ফিরে’) সম্পর্কে কবির মন্তব্য জানার সুযোগ ছিল না। এরপর জগন্ময় একক, দ্বৈত ও সমবেত কণ্ঠে অন্তত একুশটি রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন। জগন্ময়ের জন্যে শস্নাঘার বিষয় ছিল এই যে, তাঁর গাওয়া রেকর্ডের কোনো গানই বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন পেতে কখনো সমস্যা হয়নি।

দেশভাগের কিছু আগে বাংলা ও ভারত জুড়ে যখন ভীষণ উত্তেজনা, মানবতাবোধ পথ হারিয়েছে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও অসহিষ্ণুতা তুঙ্গে, ভয়াবহ দাঙ্গায় মনুষ্যত্ব ভূলুণ্ঠিত – সেই সময়ে একদিন জগন্ময় মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। গান্ধী তখন কলকাতার বেলেঘাটায় অবস্থান করছেন, অল্প সময়ের ভেতরে গান্ধী যাবেন দাঙ্গা-উপদ্রম্নত নোয়াখালিতে। গান্ধী জগন্ময়কে জানতেন, তাঁর গাওয়া হিন্দি গীত-গজল-ভজনের সঙ্গে কিছু পরিচয়ও ছিল। সেই সাক্ষাতে তিনি জগন্ময়কে শিশুদের জন্যে সপ্তকা- রামায়ণের একটি গীত-রেকর্ডের পরামর্শ দেন। রেকর্ডে ছয়-সাত মিনিটের সময়-পরিসরে এই বিশাল কাহিনির রূপায়ণ অতি দুরূহ। তবু গান্ধীজির নির্দেশে শিশুশিক্ষার প্রয়োজনে মাত্র সাত মিনিটের পরিসরে সপ্তকা- রামায়ণ গান রেকর্ড করেন ১৯৪৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রখ্যাত সুরস্রষ্টা নিতাই ঘটকের পরিচালনায়। গান্ধী-অনুপ্রাণিত এই রামায়ণ-গান বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। জগন্ময় নানা অনুষ্ঠানে এই গান গেয়ে সমাদৃত হন।

গুরু দিলীপকুমার রায়ের সৌজন্যে প–চেরির শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে জগন্ময়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। একসময়ে আশ্রমবাসী হওয়ার বাসনাও জেগেছিল তাঁর মনে, শ্রীমায়ের যৌক্তিক পরামর্শে সেই ইচ্ছা থেকে তাঁকে সরে আসতে হয়। একবার শ্রীঅরবিন্দকে গান শোনানোর সুযোগ হয় জগন্ময়ের। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আশ্রম থেকে কিছু দূরে একটা বড় হলঘরে সে-অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। শ্রীঅরবিন্দের উদ্দেশে বিশেষ করে তিনি দুটি ভজন নিবেদন করেন : প্রথমটি শঙ্করাচার্যের সংস্কৃত সেত্মাত্র – ‘ন তাতো ন মাতা ন বন্ধুর্ণ ভ্রাত/ ন পুত্রো ন পুত্রী ন ভৃত্যো ন ভর্তা’ এবং দ্বিতীয়টি ব্রহ্মানন্দের ভজন – ‘তেরি শরণ মে আয়েকে ফির আস কিসকি কিজিয়ে/ গঙ্গা কিনারে বয়ঠকে কিম্ কূপকা জল পিজিয়ে।’ কয়েকদিন পর দিলীপকুমার রায়ের মাধ্যমে জগন্ময় জানতে পারেন গভীর গূঢ়ার্থের ভজনদুটি শ্রীঅরবিন্দকে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়।১১

রাজা-মহারাজারাও জগন্ময়ের গুণগ্রাহী ছিলেন, তাঁর গানের কদরদানি করতে তাঁরা কখনো কসুর করেননি। এঁদের মধ্যে বরোদার মহারাজা ও গুজরাট রাজ্যের মন্ত্রী ফতে সিং রাও গায়কোয়াড় ও মুর্শিদাবাদের লালগোলার রাজা ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের নাম বিশেষ করে উলেস্নখ করতে হয়। বরোদার মহারাজা ‘দাদা’ সম্বোধন করতেন জগন্ময়কে। ৮ নভেম্বর ১৯৬৭-তে জগন্ময়কে লেখা মহারাজার এক চিঠি থেকে জানা যায় : আহমেদাবাদে একটি অনুষ্ঠানে জগন্ময় আমন্ত্রিত হন গান গাওয়ার জন্যে, কর্তৃপক্ষ সেই অনুষ্ঠানে মহারাজাকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্যে অনুরোধ জানান। মহারাজার অভিপ্রায়, জগন্ময়ের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয় তবেই তিনি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন। সেইসঙ্গে মহারাজা এও কামনা করেছেন আহমেদাবাদে জগন্ময় যদি তাঁর সঙ্গে থাকেন, তবে তিনি খুশি হবেন। অন্য এক চিঠিতেও (২৩ নভেম্বর ১৯৬৭) জগন্ময়ের প্রতি মহারাজার অনুরাগ ও আকর্ষণের পরিচয় মেলে। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, শিল্পীর পাশাপাশি ব্যক্তি-মানুষ হিসেবেও জগন্ময় কত প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন।

প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে জগন্ময়ের বিশেষ পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। জীবনের শেষ পর্যায়ে তখন কারাভোগ, নানা অসুখ ও বয়সের কারণে জয়প্রকাশ প্রায় স্থবির। কারামুক্তির পর বিশ্রামের প্রয়োজনে বোম্বে এসে ছোট ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন। জগন্ময় তো তখন বোম্বেতেই থিতু। অসুস্থ জয়প্রকাশ সরকারি ব্যবস্থায় প্রায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। তিনি মুখোমুখি জগন্ময়ের গান শুনতে চান বলে খবর পাঠালেন। বার্তাবাহক জানালেন, নিঃসঙ্গ জয়প্রকাশ সন্ধ্যায় উদাস হয়ে থাকেন। জগন্ময়ের গান হয়তো তাঁকে অনেকখানি ‘স্বসিত্ম’ দেবে। ১৯৭৬-এর ২১ ফেব্রম্নয়ারি সন্ধ্যায় জয়প্রকাশকে গান শোনাতে গেলেন জগন্ময়। ‘মীরামনমানি সুরত কয়েল আসমানি’ – মীরার এই ভজনটি দিয়ে তাঁর পরিবেশনা শুরু করলেন। প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা একনাগাড়ে গান চলল। চিকিৎসকের নিষেধ অগ্রাহ্য করে অসুস্থ ও অশক্ত শরীরে একভাবে বসে নিবিষ্ট মনে গান শুনলেন। জগন্ময়ের গান যেন সেদিন ‘লোকনায়ক’ জয়প্রকাশকে অন্য এক জগতে নিয়ে গিয়েছিল।

গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বিশিষ্ট প–ত-লেখক-শিক্ষাবিদ উমাশঙ্কর যোশী একবার রবীন্দ্রসংগীত শোনানোর জন্যে জগন্ময়কে অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথকে নিবিড়ভাবে জানার জন্যে অনেক যত্নে তিনি বাংলা শিখেছিলেন। তাই হিন্দি-রূপান্তরে গাইবার প্রস্ত্ততি
থাকলেও যোশীর অনুরোধে জগন্ময় বাংলায় একের পর এক রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে গেলেন। মূল ভাষায় জগন্ময়ের দরদি কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে রবীন্দ্রানুরাগী যোশী মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়েছিলেন।

 

সাত

জগন্ময় মিত্রের সংগীতজীবনের একটি বড় অধ্যায় জড়িয়ে আছে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে। তাঁর সাংগীতিক খ্যাতি-পরিচিতির মূলে রয়েছে রেডিয়ো, জলসা ও গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি। তাঁর জীবনের নানা উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িত গ্রামোফোন কোম্পানি।

অল ইন্ডিয়া মিউজিক কম্পিটিশনেঅংশ নিয়ে বেশ কয়েক মাস পর জগন্ময় ১৯৩৮-এর শেষদিকে কলকাতায় ফিরে আসেন। হেমচন্দ্র সোমের কল্যাণে এইচএমভিতে রেকর্ডে গান দেওয়ার সুযোগ আসে। তিনি জগন্ময়কে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। নজরুল তখন হিজ মাস্টার্স ভয়েসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি – চিফ ট্রেনার, কম্পোজার ও সুরকার। রেকর্ডিংয়ের ব্যাপারে তাঁর মতামত ও সিদ্ধান্তের খুব মূল্য ছিল – কোনো কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও তাঁর কাছ থেকেই আসত। এখানে বলে রাখা দরকার, গ্রামোফোন কোম্পানির প্রসঙ্গে এবং সংগীত-জ্ঞান তৈরি ও আরো কোনো কোনো বিষয়ে নজরুলের কাছে জগন্ময়ের ঋণ কিছু কম নয়।

এইচএমভির রিহার্সেল রুমে নজরুলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটি জগন্ময়ের জন্যে ছিল শিহরিত হওয়ার মতো ঘটনা। নজরুলের মতো অমন বিরাট সংগীত-ব্যক্তিত্বের সামনে জগন্ময়ের কুঁকড়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল। কিন্তু নজরুল তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পরিবেশ হালকা করে দিয়েছিলেন প্রথম সাক্ষাতেই ‘তুই’ সম্বোধন করে। নজরুল জানতে চাইলেন কী গান গাইতে চান এই তরুণ শিল্পী। জবাবে জগন্ময় অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে জানালেন, তিনি নিজেই দু-একটা গান লিখে তাতে সুর-যোজনা করেছেন। নজরুল শোনাতে বললে জগন্ময় গাইলেন : ‘যদি বাসনা মনে/ দিবে দহন জ্বালা/ তবে মনের কোণে/ কেন বাসিলে ভালো।’ নজরুল সুরের প্রশংসা করে স্মরণ করিয়ে দিলেন কমার্শিয়াল গানের ধরন-ধারণের কথা। তারপর এই সুরের ওপরেই কথা বসিয়ে সেই আসরেই লিখে দিলেন তাঁর এই প্রাতিস্বিক গানটি : ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।’ জগন্ময় এর পরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে : ‘গানটিকে সুরে বসিয়ে নিয়ে যখন কাজীদাকে গেয়ে শোনালাম সে যে কী হাসি হাসলেন তা লিখে আপনাদের বোঝাতে পারব না। কাজীদার হা হা করে দিলখোলা হাসি দেখে মনে হলো যেন আমরা পৃথিবী জয় করেছি। কাজীদার লেখা গানটির জন্যই যে আমার সুরের মর্যাদা বাড়ল তা একবারও উলেস্নখ না করে কেবলই বলতে লাগলেন, ‘তোর সুরটা বড়ো সুন্দর – তোর সুরটা বড়ো সুন্দর।’ কাজীদা যে কত উদার, কত মহৎ তা কি লিখে বোঝানো সম্ভব?’১২  জগন্ময়ের জীবনের প্রথম গানটির রেকর্ডিং হলো ১৯৩৯-এর ১৮ মে। ওই একই দিনে দ্বিতীয় গানের রেকর্ডিং হয় অজয় ভট্টাচার্যের কথায় ও জগন্ময় মিত্রের সুরে – ‘সন্ধ্যা যখন নামে গোপন পায়।’ ‘শাওন রাতে’ প্রথমে রেকর্ডিং হলেও রয়্যালটির জটিলতায় তা যথাসময়ে প্রকাশিত হয়নি। দুমাস পরে রেকর্ডকৃত প্রণব রায়ের লেখা দুটি গান (‘প্রিয় হতে প্রিয়তর’ ও ‘তোমার মতন কত না নয়ন’), যার সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত, প্রথম রেকর্ড হিসেবে রিলিজ হয়। এর পরে ‘শাওন রাতে’ দ্বিতীয় রেকর্ড হিসেবে প্রকাশ পায় অপর পিঠে নজরুলেরই কথা ও সুরের ‘গুনগুনিয়ে ভ্রমর এল’ যুক্ত হয়ে। এই রেকর্ডটি অসাধারণ সমাদর লাভ করে কলের গানের শ্রোতাদের কাছে।

নজরুলের সুস্থাবস্থায় জগন্ময় আর কোনো নজরুলসংগীত রেকর্ড করার সুযোগ পাননি। পরে নজরুলের কয়েকটি মাত্র গান রেকর্ড হয় জগন্ময়ের কণ্ঠে, সেগুলো হলো : ‘আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে’, ‘চীন ও ভারত মিলেছি আমরা’, ‘সঙ্ঘ শরণ তীর্থ যাত্রা পথে’, ‘প্রথম প্রদীপ জ্বালো’, ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’, ‘গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙে যায়’। নজরুলের শেষ গান জগন্ময় রেকর্ড করেন : ‘খেলা শেষ হল শেষ হয় নাই বেলা।’ জগন্ময় কিছুটা আবেগভরে স্মরণ করেছেন : ‘কাজীদার লেখা ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ – গানটি গেয়ে আমার শিল্পীজীবনের যাত্রা শুরু করেছিলাম। বোধহয় যাত্রা শেষ করলাম তাঁরই লেখা ‘খেলা শেষ হল শেষ হয় নাই বেলা’ গানটি গেয়ে।’১৩

জগন্ময় মিত্র নজরুলের খুব বেশি গান রেকর্ড করেননি, নজরুলের সঙ্গ-সান্নিধ্যলাভের সময়ও নিতান্ত কম, গড়ে ওঠেনি তেমন অন্তরঙ্গ সম্পর্কও, – তবু জগন্ময়ের জীবন ও সংগীতে নজরুল একটা স্পষ্ট ছাপ ফেলে গেছেন। পিতৃহীন জগন্ময়ের যে-পিতামহ তাঁকে গভীর স্নেহ-আদরে লালন করেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে জগন্ময় গভীর শোককাতর হয়ে ওঠেন এবং রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন। বিষয়টি নজরুলের কানে এলে তিনি এইচএমভির হেমচন্দ্র সোমকে জগন্ময়ের বাড়ি পাঠিয়ে তাঁকে গ্রামোফোন কোম্পানির অফিসে ডাকিয়ে আনেন। ‘শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভয় ও ভালোবাসার তাগিদে’ জগন্ময় ‘কাজীদার ডাকের মর্যাদা রাখতে’ তাঁর সামনে হাজির হন। নজরুল তাঁকে প্রিয়জনের এই বিয়োগ-ব্যথার দুঃখ ও শোক না ভুলতে পরামর্শ দেন। বিস্মিত জগন্ময় তাঁকে জানান, সবাই যে শোক ভুলতে বলেন, নজরুল তো একেবারে উল্টো কথা বলছেন! এরপর নজরুল যে-জবাব দিলেন তাতে ছিল কিছুটা দার্শনিকতার ছোঁয়া : ‘ভুলিস না কেন বললাম, জানিস? সাধারণ লোকের পক্ষে শোকের বেদনা ভুলে যাওয়াটাই একমাত্র ওষুধ। কিন্তু তুই শিল্পী। তোর কথা আলাদা। জীবনে যত দুঃখ পাবি এক এক করে সব যত্ন করে মনের মধ্যে জমা করে রেখে দিবি। দেখবি ওই সব দুঃখ, আঘাত, শোক, বেদনা তোর কণ্ঠ দিয়ে একদিন ফুল হয়ে ফুটে বেরোবে। হয়তো তুই ব্যথা পাবি, কিন্তু জানবি শত শত বেদনাতুর মানুষ তোর গানে  তৃপ্তি, আনন্দ ও সান্তবনা খুঁজে পাবে। জানবি সেইখানেই শিল্পীজীবনের চরম সার্থকতা।’১৪ নজরুলের এই বক্তব্য মানস-সংকটে বিপন্ন জগন্ময়কে স্বসিত্ম ও সান্তবনা দিয়েছিল। আর জগন্ময় এ-বিষয়ে মন্তব্য করেছেন : ‘কি অপূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এ দর্শন কাজীদা ছাড়া আর কার দৃষ্টিগোচরে আসবে! আজও আমি শিল্পীজীবন নিয়েই আছি। মান-অপমান, ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-আনন্দ, কলঙ্ক-গৌরব সবকিছুই পেয়েছি। কাজীদা আজ নেই, বেঁচে থাকলে বলতাম আমার গানে কেউ প্রকৃত সান্তবনা পেয়েছে কি না জানি না, আমার কিন্তু সব ভোগই সারা হয়েছে।’১৫  তাঁর শিল্পীমনে নজরুল ছিলেন ভাস্বর হয়ে, তাই জগন্ময় যখন তাঁর স্মৃতিকথা লিখলেন, তার নাম দিলেন তাঁর জীবনের সূচনা-সংগীত নজরুলের গানের পঙ্ক্তি সাজিয়ে – ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’।

 

আট

প্রথম গান ‘শাওন রাতে’ জগন্ময় মিত্রকে খ্যাতি ও পরিচিতি এনে দিয়েছিল। সে ১৯৩৯-এর কথা। তারপর ধীরে ধীরে কিছু ভালো গান করে তাঁর নাম আরো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তিন বছর পর বাংলা রেকর্ডসংগীতের জগতে এক বিপস্নব ঘটে গেলো ‘সাতটি বছর আগে’ ও ‘সাতটি বছর পরে’ এই গান দিয়ে। এই জোড়া-গানের পূর্বাপর ইতিহাস জগন্ময় বর্ণনা করেছেন তাঁর স্মৃতিচর্চায়। গানটি লিখেছিলেন প্রণব রায় আর এতে সুরারোপ করেন সুরকার কমল দাশগুপ্তের অনুজ সুবল দাশগুপ্ত। কুন্দনলাল সায়গলকে দিয়ে গান রেকর্ডিংয়ের প্রস্ত্ততি চলছিল। কিন্তু জরুরি তলবে হঠাৎই ফিল্মের কাজে সায়গলকে বোম্বে চলে যেতে হয়। এইচএমভি কোম্পানি তখন বড় একটা সমস্যায় পড়ে গেল। সায়গলের মতো দরদি কণ্ঠ খুঁজে পাওয়া ভার। এইচএমভির হেমচন্দ্র সোম অনেক ভেবেচিন্তে জগন্ময় মিত্রের নাম প্রস্তাব করলেন। কিন্তু সুরকার সুবল দাশগুপ্ত ভারি খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ ছিলেন, সেইসঙ্গে প্রশংসাকুণ্ঠও। তিনি শর্ত জুড়ে দিলেন গান তাঁর পছন্দসই না হলে রেকর্ড রিলিজ করা যাবে না। ১৯৪২-এর ৩১ মার্চ এই জোড়া-গানের রেকর্ডিং হলো জগন্ময়ের কণ্ঠে। সুবল দাশগুপ্ত প্রসন্ন হলেন না, জানালেন, তিনি যা চেয়েছেন তার অর্ধেক হয়েছে। ধাক্কা খেলেন জগন্ময়, জেদের বশে আবার রেকর্ড করলেন পরের মাসের ২৩ তারিখে। শিল্পী জানাচ্ছেন, সুরকারের মুখে এবার হাসি দেখা গেল। ১৯৪২-এর শারদীয় অর্ঘ্য হিসেবে রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়। এটিই রেকর্ড-সংগীতের ‘প্রথম গল্প-গান’। ‘সাতটি বছর আগে’ ও ‘সাতটি বছর পরে’ রেকর্ডটি অভাবনীয় জনসমাদর লাভ করে। আধুনিক বাংলা রেকর্ডের গানের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া রেকর্ডের তালিকায় একে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই গান নিয়ে খ্যাতির বিড়ম্বনাতেও পড়তে হয় জগন্ময়কে। তিনি জানাচ্ছেন : ‘কালে এই জনপ্রিয়তা অভিশাপ হয়ে দেখা দিলো আমার জীবনে। কেউ বলছেন, ‘কি গানই গেয়েছে ভদ্রলোক।’ কেউ বলছেন, ‘আহা ভদ্রলোকের বউ মারা গেছে কিনা সেই দুঃখে এই গান গাওয়া, দরদ তো         থাকবেই।’ কেউ কেউ আবার মন গুণে কটূক্তি করতেও ছাড়লেন না, নষ্ট চরিত্রের দোষ দিয়ে।… চিঠিপত্রও পেতে লাগলাম প্রচুর। কেউ কেউ সমবেদনা জানিয়ে লিখলেন। কেউ বা নিজেকে উৎসর্গ করতে চাইলেন জীবনসঙ্গিনী হবার আকাঙক্ষায়। আবার কিছু কিছু নিছক প্রেমপত্র।’১৬   আসরে-বাসরে ‘বউ মরা’ গানটি গাওয়ার অনুরোধ আসতে লাগল। এভাবে অতিষ্ঠ ও বিব্রত হয়ে উঠলেন জগন্ময়। আসলে মজার কথা এই যে, ‘বউ মরা’র তো প্রশ্নই ওঠে না, এই গানের গীতিকার-সুরকার-শিল্পী প্রণব রায়-সুবল দাশগুপ্ত-জগন্ময় মিত্র তখন পর্যন্ত কেউ বিয়েই করেননি – তিনজনই ‘আইবুড়ো কার্তিক’। যাই হোক, গ্রামোফোন কোম্পানির গান নিয়ে এমন ঘটনা মনে হয় আগে-পরে আর কখনো ঘটেনি।

জগন্ময়ের আর-একটি গল্প-গানের রেকর্ড ‘চিঠি’ আগের রেকর্ডটির মতোই বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল। সংগীত-ব্যক্তিত্ব বিমান মুখোপাধ্যায় জগন্ময়ের বরাত দিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, ‘চিঠি’ রেকর্ডটি চলিস্নশের দশকের শেষভাগে (১৯৪৮) বের হওয়ার পর প্রথম ছমাসেই আশি হাজার কপি বিক্রি হয় – সবমিলিয়ে পরের হিসেবে এই সংখ্যা প্রায় বাইশ লক্ষে দাঁড়ায়। আশি হাজার কপি বিক্রির খবর অনেক চেষ্টা করে জগন্ময় সুরস্রষ্টা সুবল দাশগুপ্তকে জানানোর পর তিনি সাফ জবাব দেন : ‘আমি যেমনটা বলেছিলুম তুমি তো সেভাবে গাইতেই পারলে না, সেটা পারলে তো এক লাখ ডিঙিয়ে যেত। আশি হাজারে আমি খুশি নই – আমার তো আশা অনেক বেশি ছিল।’১৭  এ-থেকে বোঝা যায়, সেকালের সুরস্রষ্টাদের শিল্পীর কাছে কতখানি প্রত্যাশা থাকত।

জগন্ময় মিত্র কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী। ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’, ‘গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙে যায়’, ‘বেদনার মাঝে তোমারে খুঁজিয়া পাই’, ‘প্রেমের না হবে ক্ষয় জানি জানি গো’, ‘আমার দেশে ফুরিয়ে গেছে ফাগুন’, ‘সাতটি বছর আগে’, ‘সাতটি বছর পরে’, ‘স্বপ্নে আমায় কে পরাল মালা’, ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘যে ফুল আমারে দাও’, ‘আমি ভুলে গেছি তব নাম’, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই’, ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’, ‘বিরহে তোমারে পাই’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘শতেক বরষ পরে’, ‘আমি স্বপন দেখেছি কাল রাতে’, ‘স্বপ্ন সুরভি মাখা’, ‘তোমার বিরহ আমারে কাঁদায়’, ‘বাঁশরী কি বাজিবে না আর’, ‘আমি ভোরের স্বপ্নে দেখেছি তোমারে’ – জগন্ময়ের এইসব গানের আবেদন কালের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।

জগন্ময়ের সৌভাগ্য, প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান রেকর্ড করেছেন। অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, শৈলেন রায়, সুবোধ পুরকায়স্থ, মোহিনী চৌধুরী – সেকালের প্রায় সব খ্যাতিমান গীতিকবির গানই গেয়েছেন তিনি। জগন্ময় নিজেও গান রচনা ও তাতে সুরারোপ করেছেন, এমন কিছু গানের রেকর্ডও আছে তাঁর।

জগন্ময় যাঁদের সুরে গান করেছেন তাঁদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, কমল দাশগুপ্ত, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রাইচাঁদ বড়াল, দুর্গা সেন, সুবল দাশগুপ্ত, গোপেন মলিস্নক, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, অনুপম ঘটক, অনিল বাগচী এবং আরো কেউ কেউ। সুরকারদের মধ্যে নজরুল, কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত ও সুবল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। তবে কমল দাশগুপ্তের কাছে তাঁর গভীর ঋণের কথা স্বীকার করে বলেছেন : ‘মনে হয় জন্মান্তরেও সে ঋণ শোধ করতে পারব না।’ জগন্ময়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় : কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকেই তিনি ‘রেকর্ডিং লাইনের টেকনিক’ সম্পর্কে অনেককিছু শেখেন। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো – ‘সোজা ও সরলভাবে গানটিকে কীভাবে শ্রোতার সামনে প্রাণবন্ত করে তুলে ধরা যায়।’১৮

হিন্দি গানের জগতে, বিশেষ করে গজল-গীত-ভজনে, জগন্ময় মিত্র আপন প্রতিভার গুণে একটি সম্মানের আসন অধিকার করেছিলেন। তাঁর এই হিন্দি গীত-গানের সূচনা কলকাতার চেতলায়, যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম পর্বের আনন্দময় দিনগুলো কেটেছে। সারাজীবন তিনি বাংলা গানের পাশাপাশি হিন্দি
গজল-গীত-ভজন গেয়ে গেছেন, রেকর্ড করেছেন অনেক গান। অতুলনীয় জনপ্রিয়তা তিনি অর্জন করেন, ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় অনুরাগী শ্রোতার কাছ থেকে আখ্যা পেয়েছেন ‘King of Bengal’ – সম্মানিত হয়েছেন ‘Jagmohon – the father of Hindi Geet’ অভিধায়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে জগন্ময় বোম্বেতে চলে যান, হিন্দি গজল-গীতকে ছড়িয়ে দেন ভারতময়। অবশ্য কলকাতাতেই এর সূচনা হয়েছিল ১৯৪১ সাল থেকে এইচএমভির সৌজন্যে। কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, দুর্গা সেন, সুবল দাশগুপ্ত, দক্ষেণা ঠাকুর, প–ত গণপতবাও, কালীপদ সেন, অনুপম ঘটক ও নিজের সুরযোজনায় কবির, প–ত
মাথুর, আন্জুম, ভূষণ, ফৈয়াজ হাশমী, মুনির আলম, রাজেন্দ্র কিষণ, মধুরাজ, হসরত জয়পুরী, কাইফ ইরফানি ও রমেশ পান্ট-রচিত হিন্দি গীত-গজল-ভজনের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ‘আঁব ম্যায় কিঁউ ঘর ছোঁড়ু বন যায়ুঁ’, ‘রাধা মেরে নাম্ সে তেরে’, ‘ইয়ে চাঁদ ন্যহি তেরি আরশি হ্যায়’, ‘ও বর্ষাকে প্যহলে বাদল’, ‘দিল দেক্যর দ্যর্দ লিয়া’, ‘ম্যন্মে ব্যসালে ম্যনমোহন কো’, ‘পেয়ার কি মঞ্জিল্ ন্যহি হ্যায়’, ‘স্যপ্নোঁমে কিঁউ আতে হো’, ‘মুঝে খামোশ র‌্যহেনে দো’, ‘চাঁদ হ্যয় মেহমান অ্যায় দিল্’, ‘মন তেরি তরফ কিঁউ যাতা হ্যয়’, ‘নিরাস মে আস্ প্রভু মেরা’, ‘তুম্ ওহি তো হো যো মেরে’ – জগমোহনের দরদি কণ্ঠে একদিন এসব গজল-গীত-ভজন মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল, অন্তরকে করেছিল আবিষ্ট – তার রেশ আজো শেষ হয়ে যায়নি।

হিন্দি গীত-গজলে জগন্ময়ের অধিকার কেমন ছিল দু-একটি ঘটনায় তার পরিচয় মেলে। সেকালের নামি সংগীত-পরিচালক দুর্গা সেনের পরিচালনায় ‘খানে তো জারা’ এই হিন্দি গজলটি রেকর্ড করার কথা জগন্ময় মিত্রের। কিন্তু সুরকার কিছু না জানিয়ে হঠাৎই সুধীরলাল চক্রবর্তীকে দিয়ে রেকর্ড করিয়ে ফেলেন। গানটি দারুণ হিট হয়। সংগত কারণেই জগন্ময় আহত ও ক্ষুব্ধ হন। দুর্গা সেন ব্যাপারটা বুঝে নতুন করে আবার জগন্ময়ের জন্যে গান প্রস্ত্তত করলেন – ‘উলফৎকে সাজাদো’, শ্রোতার কাছে এই গীতটিও বিপুল সমাদর লাভ করে।১৯  জগন্ময়ের হিন্দি গান যে সারা ভারতে শ্রোতাদের কাছে অসামান্য সমাদর পেয়েছিল, সে-সম্পর্ক সংগীত-ব্যক্তিত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য স্মরণ করতে হয় : ‘জগন্ময় মিত্রর হিন্দি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। জগমোহন নাম নিয়ে সেসব গীত, গজল, দাদরা ভজন গোটা দেশে তখন চলছে।’২০  হিন্দি গীত-গজল-ভজন গাওয়ার ক্ষেত্রে হেমন্তের আদর্শ ও দৃষ্টান্ত ছিলেন জগন্ময়।২১

 

নয়

জগন্ময় মিত্র তাঁর প্রিয় কলকাতা ছেড়ে ছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসনে, বাংলা গানের জগৎ থেকেও অনেককাল দূরে ছিলেন। আশির দশক থেকে আবার বাংলার সঙ্গে জগন্ময় মিত্রের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কিছু অনুষ্ঠানে তিনি গান গাইতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছে, জীবনীশক্তিও ধীরে ধীরে কমে এসেছে – কিন্তু দরদভরা কণ্ঠের মধুময় সুর হারিয়ে যায়নি। বিমান মুখোপাধ্যায় কলকাতার নজরুল মঞ্চের এক অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে গান গাইবেন জগন্ময় মিত্র ও মান্না দে। জগন্ময় বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, গলাও ভালো নেই, তার ওপরে আগে গাইবেন মান্না দে। এ নিয়ে জগন্ময়ের সুহৃদেরা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিমান মুখোপাধ্যায় এর পরের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : ‘এলেন মঞ্চে তিনি [জগন্ময়]। এবং তখন থেকেই অবাক হওয়ার শুরু। হাততালি, হাততালি, হাততালি।… শুরু হল গান।… কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এত তরতাজা, এত মসৃণ কণ্ঠের জগন্ময়দাকে কতকাল পাইনি।… পরের পর গান গেয়ে মাত করে দিলেন।… টানা একঘন্টা পর যখন তিনি থামলেন, তখন কেউই ছাড়তে চায় না। বহু অবাঙালি শ্রোতাকেও দেখলাম, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন, মালা পরাচ্ছেন। টলটলে চোখে মুগ্ধ বিস্ময়ে ওঁকে আরও কাছ থেকে দেখার, একটু ছুঁতে পাওয়ার আকুতি নিয়ে আসন ছেড়ে উঠে আসছেন – লিজেন্ড একেই বলে।’২২

ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাব ১৮ নভেম্বর ১৯৮৪ আশুতোষ বার্থ সেন্টিনারি হলে জগন্ময় মিত্রকে সংবর্ধনা জানায়। এই অনুষ্ঠানের শেষপর্বে জগন্ময় মিত্র সংগীত পরিবেশন করেন। এই অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে বিশিষ্ট সংগীত-ব্যক্তিত্ব সুভাষ চৌধুরী উলেস্নখ করেন : ‘জগন্ময় মিত্র প্রথমে একটি সংস্কৃত সেত্মাত্র এবং রূপকের ছন্দে দেশ রাগে হিন্দী ভজন গেয়ে শোনালেন। তারপর একাদিক্রমে গেয়ে গেলেন ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে চলিস্নশের দশকের শেষ পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠের… গানগুলি। গান, গানের সুর ও তাঁর অপূর্ব গায়নশৈলীর জন্য গানগুলি এখনো কতখানি জনপ্রিয় তা সহজেই অনুমান করা গেল।… এই আসরে এই বর্ষীয়ান শিল্পী যে আশ্চর্য দক্ষতায় গানগুলি পরিবেশন করলেন তা শুনে কেবল মুগ্ধ হইনি, বিস্মিতও হয়েছি। কি সতেজ তাঁর কণ্ঠ কি পরিচ্ছন্ন অলঙ্করণ। একালের আধুনিক গানে ভাবের চেয়ে যে ভঙ্গির প্রাধান্য সে সত্যটি বারবার সেদিন উপলব্ধি করা গেল।… সেদিনের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতেই হয়। ‘তোমার গীতি’ এবং ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী’ গানে যে- সৌন্দর্যের সৃষ্টি করলেন তাতে বারবার মনে হয়েছে রবীন্দ্রসংগীত-জগতে এই শিল্পী ঈর্ষণীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন।… সমগ্র অনুষ্ঠানের মধ্যে লক্ষ করার বিষয় ছিল বাঙালির কাব্যগীতির প্রতি আকর্ষণ এখনো কী দুর্নিবার। চাহিদা পূর্ণ হচ্ছে না তাই ত্রিশ-চলিস্নশের দশকের গান এমনভাবে তাঁদের আকৃষ্ট করে। অবশ্যই জগন্ময় মিত্রদের মতো জাত শিল্পীদের কণ্ঠও চাই।’২৩ এই প্রতিবেদনটি একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নও বটে।

জগন্ময় মিত্র ১৬ নভেম্বর ১৯৮৪ রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন, ‘সারথি’র আয়োজনে। সেদিন তিনি পরিবেশন করেন তেইশটি গান : রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক কাব্যগীতি, উর্দু গজল ও গীত এবং টপ্পা। তাঁর এই ফিরে আসাকে অনুষ্ঠান-সমালোচক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও
সংগীত-গবেষক স্বপন সোম ‘স্বাগতম জগন্ময় মিত্র’ শিরোনামে অভিনন্দিত করেন। জগন্ময়ের ‘গায়নভঙ্গীর স্বাতন্ত্র্য’, গানে তাঁর ‘মৃদুভাষ’ যে ‘নাটকীয়তার জন্ম দেয়’ তা ‘শুধু তাঁর নিজস্বতাকেই’ চিহ্নিত করে, চলিস্নশের দশকের কাব্যগীতি শিল্পীর ‘কণ্ঠ ছুঁয়ে সুরের দোলায় গাঢ় রোমান্টিকতায় নতুন করে আবিষ্ট করে’২৪ – সমালোচকের এইসব মন্তব্যে জগন্ময়ের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য যথার্থভাবে উন্মোচিত।

জগন্ময় মিত্রের কাছের মানুষ তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পীর একটি অনুষ্ঠান ও তাঁর প্রতি সহশিল্পীর শ্রদ্ধাবোধের বিবরণ দিয়েছেন তাঁর এক লেখায় : ‘১৯৮১ সাল। বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী ফিরোজা বেগম ও সুরসাগর জগন্ময় মিত্রর দ্বৈত অনুষ্ঠান রবীন্দ্রসদনে। যথারীতি শিল্পীর সাথে গেছি। জগন্ময়বাবু বললেন, ‘ফিরোজাকে জিজ্ঞাসা করে এস উনি আগে গাইবেন না আমি?’ তখন গ্রিনরুমে গিয়ে দেখি ফিরোজা বেগম রিহার্সেল করছেন। জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘দেখো ছেলের কথা! জগন্ময়বাবুর গান শোনার পর আমার গান কেউ শুনবে? জগন্ময়বাবুকে আমার প্রণাম জানিয়ে বোলো তাঁর গান শুনে তবে আমি হল ত্যাগ
করব – বাংলার স্বর্ণযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী জগন্ময়বাবু। কতদিন বাদে তাঁকে পেলাম। আর তাঁর গান শুনব না!’ মুগ্ধ হলাম এক শিল্পী সম্বন্ধে অপর এক শিল্পীর বিনম্র শ্রদ্ধা দেখে।’২৫  এ থেকে বেশ বোঝা যায়, শিল্পী হিসেবে জগন্ময়ের স্থান ছিল কত উঁচুতে।

দীর্ঘ ব্যবধানে জগন্ময় মিত্র কলকাতার সঙ্গে সংগীতের যোগসূত্র পুনরায় স্থাপন করেন। ফিরে এসে প্রমাণ করলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি, তিনি হারিয়ে যাননি। এ যেন তাঁর রাজকীয় প্রত্যাবর্তন।

 

দশ

শিল্পী হিসেবে জগন্ময় সারাজীবন স্বীকৃতি-সম্মান-সমাদর কম পাননি। ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৩ ভট্টপলিস্ন প–তসমাজ তাঁকে ‘সুরসাগর’ উপাধি দান করেন। এই উপাধিটিই তাঁর নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায়। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। অল বেঙ্গল ও অল ইন্ডিয়া মিউজিক কম্পিটিশনে তিনি সংগীতের নানা শাখায় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার অর্জন করেন। বিদেশেও অনেক সংবর্ধনা-সম্মাননা লাভ করেন তিনি। তবে সংগীতগুণী বিশিষ্ট কলাকার ও সংগীত-সমঝদার শ্রোতাসাধারণের অনুরাগ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান-সমাদরই তাঁর সংগীতজীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। বিমান মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন : ‘হেমন্তদা [হেমন্ত মুখোপাধ্যায়] বলতেন, ‘চলিস্নশের দশক হল জগন্ময়ের দশক। তখন কে হেমন্ত, কে ধনঞ্জয়! আমরা ওর কাছে পাত্তাই পেতাম না।’ কী অসম্ভব শ্রদ্ধা থাকলে এই কথা বলা যায়। এ সম্মান সমসাময়িক বহুজনের কাছেই জগন্ময়দা পেতেন। আমি নিজে দেখেছি, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ঘরে ঢুকে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতেন ওঁকে।’২৬  তবে স্বর্ণযুগের অনেক গুণী শিল্পীকেই এইচএমভি ‘গোল্ডেন ডিস্ক’ দিয়ে সম্মান জানালেও জগন্ময় মিত্রের নাম তাঁরা বিবেচনায় আনেননি। এই বিষয়টা তাঁকে ব্যথিত করেছিল, কিছু খেদও রয়ে গিয়েছিল মনে।

 

পঙ্কজকুমার মলিস্নক জগন্ময়কে ‘সুধাকণ্ঠ’ বলে উলেস্নখ করেছিলেন। তাঁর ‘রুচিসমৃদ্ধ সংগীত’ ও ‘ভাবনিবিড় সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর’কে অভিনন্দিত করেছিলেন গুণগ্রাহী হিসেবে। গুরু দিলীপকুমার রায় বলেছিলেন : ‘হে জগন্ময়! জয় তব জয়/ গাই আজো গুণ তব।’ বিমান মুখোপাধ্যায় কিছু খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে জগন্ময় মিত্রের নাম জুড়ে দিয়ে তাঁদের মতো শিল্পী ‘এ-যুগের অলংকার’ বলে মন্তব্য করেছেন। সাহিত্যিক প্রভাবতী দেবী সরস্বতী জগন্ময়কে ব্যতিক্রমী অসাধারণ সংগীতশিল্পী বিবেচনায় তাঁকে তীর্থপথিক উপন্যাসটি উৎসর্গ করেন।

 

এগারো

জগন্ময় মিত্রের প্রথম রিলিজ হওয়া রেকর্ড সম্পর্কে এইচএমভির নভেম্বর ১৯৩৯-এর মাসিক পুসিত্মকায় লেখা হয় : ‘এ মাসে একটি নবাগত তরুণ শিল্পীর সাথে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই। ইনি… শ্রী জগন্ময় মিত্র। এর কণ্ঠস্বর শুধু মধুর নয়, অপূর্ব স্বপ্নময়। এঁর কণ্ঠস্বর শ্রোতার মনকে এমন এক জগতে নিয়ে যায় যেখানে চিরকালের প্রেমিক চিরকালের প্রিয়ার জন্য তপস্যা করছে।’ উত্তরকালে তাঁর এই ‘মধুর’ ও ‘অপূর্ব স্বপ্নময়’ কণ্ঠে মিলন-বিরহের গান গেয়ে বাঙালি সুররসিককে মুগ্ধ-অভিভূত করেছেন। নশ^র দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেও তাঁর সুরের ধারা কাল থেকে কালান্তরে বয়ে চলেছে।

আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম ঋত্বিক ও হিন্দি গীতের জনক জগন্ময় মিত্র। এই কালজয়ী কণ্ঠশিল্পীর জন্মের একশ বছর পূর্ণ হবে এই সালে (২০১৮)। বাঙালির স্মৃতিজাগানিয়া এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

 

তথ্যসূত্র

১।    দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় : কিছু প্রীতি কিছু  স্মৃতি, কলকাতা, এপ্রিল  ২০০৩, পৃ ৫৩।

২।    জগন্ময় মিত্র : শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, প্রতিভাস সংস্করণ : কলকাতা, ২০১০, পৃ ২৩।

৩।   ওই, পৃ ৪৯।

৪।    ওই, পৃ ১৬৫।

৫।              The Statesman (Calcutta 6 September 2003)-এ এই ‘obituary’টি লিখেছিলেন জগন্ময় মিত্রের অতিঘনিষ্ঠ তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

৬।   শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৩।

৭।    ওই, পৃ ২৬।

৮।   ওই, পৃ ৭৫।

৯।    ওই, পৃ ৮৩।

১০। ওই, পৃ ৪২।

১১। ওই, পৃ ৭০।

১২। ওই, পৃ ৩৩।

১৩। ওই, পৃ ১৬৫।

১৪। ওই, পৃ ৩৯।

১৫। ওই, পৃ ৩৯।

১৬। ওই, পৃ ৪৭।

১৭। সিতাংশু শেখর ঘোষ : বিমানে   বিমানে আলোকের গানে। তৃ-স : কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৫, পৃ ১৯৬।

১৮। শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৫।

১৯। বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পূর্বোক্ত, পৃ ২১০।

২০।  ওই, পৃ ১৮১।

২১।  ওই, পৃ ১৮১।

২২।  সুখী গৃহকোণ, মাসিক, কলকাতা, নভেম্বর ২০০৩।

২৩। দেশ, সাপ্তাহিক, কলকাতা, ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৪।

২৪। ওই, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৪।

২৫। তপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : অন্তরঙ্গ জগন্ময়’ (অপ্রকাশিত প্রবন্ধ) – বর্তমান প্রবন্ধের জন্যে লিখিত।

২৬। সুখী গৃহকোণ, পূর্বোক্ত।

 

ব্যক্তিঋণ

তপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা। সংগীত-গবেষক, জগন্ময় মিত্রের অতিঘনিষ্ঠজন, সুরসাগরের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সম্পৃক্ত। জগন্ময় মিত্রের শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে (১৯৮৫) বইটি প্রকাশের প্রধান উদ্যোগী। শিল্পী তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘মানসপুত্র’ হিসেবে। জগন্ময় মিত্রের ছবি, গানের পান্ড‍ুলিপি, চিঠিপত্র ও অন্যান্য তথ্যদলিল তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে পেয়েছি। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও
কৃতজ্ঞতা।

 

কুষ্টিয়া

১০.১.২০১৮ r