জন্মশতবর্ষে কুমার শচীন দেববর্মণ

কুমার শচীন দেববর্মণকে কখনো চাক্ষুষ করিনি। কিন্তু শৈশবকাল থেকেই তাঁর নাম কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে। তাঁর কণ্ঠ তো বটেই, তবে আরেকটি কারণ ছিল। তিনি আমার পিতার সহপাঠী ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ১৯২১-২২ সালে। পিতার মুখে তাঁর নাম, তাঁর বংশপরিচয় এবং তিনি যে রাজকুমার, তা জানা হয়ে গিয়েছিল সেই শৈশবকালেই। রাজকুমারসুলভ কোনো অভিব্যক্তি তাঁর চলনে-বলনে ছিল না। সাধারণের সঙ্গে ওঠাবসা, অন্তরঙ্গতাই ছিল তাঁর চরিত্রে স্পষ্ট। অবাক লাগত রাজপুত্র হয়েও তিনি চাষাভুসা, মাঝিমাল্লাদের গান গাইছেন। আবিষ্ট থাকতেন কীর্তন, ভাটিয়ালিতে। বাড়িতে সিঙ্গল স্প্রিং হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কালো সুটকেসসদৃশ কলের গান যখন এলো, সঙ্গে শচীন দেববর্মণেরও দুটো রেকর্ড এসেছিল রাখাল বালকের বাঁশি বাজানো হিন্দুস্তান রেকর্ডের লেবেলে। তারপর ফি-বছর একটি-দুটি করে রেকর্ড আমাদের সংগ্রহে আসতে লাগল। তাঁর কণ্ঠ কী যেন এক মাদকতামাখা, সানুনাসিক – আর কারো কণ্ঠের সঙ্গে মেলে না। আমরা প্রেমে পড়ে গেলাম। শুধু তাঁর কণ্ঠ নয়, গানের সুর, গানের কথা – সব মিলিয়ে পুরো গানের নির্মাণ এককথায় অনবদ্য। পরে জেনেছি, পুরো কুমিল্লা কম্পোজিশনে গান তৈরি হয়েছে। গানের কথা, সুর এবং কণ্ঠ তিনজনই কুমিল্লার কৃতী সন্তান। গানের কথায় অজয় ভট্টাচার্য, সুরে হিমাংশু দত্ত সুরসাগর আর কণ্ঠে তো শচীন দেববর্মণ। অবাক লাগে ভাবতে, রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ে অবস্থান করেও এই ত্রয়ী বাংলা গানের জগতে একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আজো তাঁদের রচিত সংগীতশ্রবণে মনে হয়, বাংলা গানে তাঁদের অতিক্রম করা দুঃসাধ্য।

প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার শচীন দেববর্মণের বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ আগরতলা ছেড়ে কুমিল্লায় বসবাস শুরু করেন।  সে-সময়ে স্থানটির নাম ছিল চাকলা রোশনাবাদ, বর্তমানে উত্তর চর্থা। যে-বাড়িতে শচীন দেববর্মণ থাকতেন সেটি এখন হাঁস-মুরগির খামার। এই কুমিল্লা থাকাকালীনই লোকসংগীতের সংস্পর্শে আসেন শচীন দেব। বিভিন্ন পালাপার্বণ, মেলা প্রভৃতি উৎসবে শচীন দেবের প্রবল টান তাঁকে লোকসংগীতের বিপুল ভান্ডারের মুখোমুখি করেছিল, যার প্রভাব উত্তর-জীবনে আমরা দেখতে পাই। এরই মাঝে রাগসংগীতের সঙ্গেও তাঁর পরিচিতি ঘটছিল কুমিল্লার নবাববাড়ীর কল্যাণে। যার পরিধি বিস্তৃত হলো কলকাতায়। সংগীতশিক্ষার আগ্রহে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সান্নিধ্যে এলেন। সংগীতগুরু হিসেবে পেলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, ওস্তাদ বদল খাঁ সাহেবকে। এ-সময়েই লোকসংগীতের সুরের সঙ্গে রাগসংগীতের মণিকাঞ্চন যোগ ঘটান শচীন দেব। কলকাতার বিভিন্ন সান্ধ্য অনুষ্ঠানে শচীন দেবের আবির্ভাব ঘটতে লাগল। তাঁর সানুনাসিক কণ্ঠে বাংলা গান এক নতুন চমক নিয়ে এলো শ্রোতাদের কাছে। কলকাতার সংগীতরসিক সমাজে শচীন দেব স্থান করে নিলেন নিজ প্রতিভায়। বেতারেও রেকর্ডের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছেন তখন – যদিও হিজ মাস্টার্স ভয়েস শুধু সানুনাসিক কণ্ঠের অজুহাতে রেকর্ড করতে অনীহা প্রকাশ করেছিল। সেই সানুনাসিক কণ্ঠই বাংলা গানে নতুনত্ব এনে দিলো।

আগেই বলেছি কুমিল্লার ত্রয়ী কৃতী সন্তানের কথা। গীত রচনায় এবং সুরে শচীন দেববর্মণের গাওয়া গানে অজয় ভট্টাচার্য এবং হিমাংশু দত্তের অবদান অনস্বীকার্য। শচীন দেবের প্রথম রেকর্ড ছিল হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখা ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’ লোকগীতি অবলম্বনে, সুর করেছিলেন শচীন দেব নিজেই – অন্য পিঠে শৈলেন রায়ের লেখা ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’ – এটিও শচীন দেবের সুর। লোকগীতির সঙ্গে রাগসংগীতের সংমিশ্রণে একটা নিজস্ব শৈলী তৈরির চেষ্টা প্রথম থেকেই শচীন দেবের ছিল এবং তিনি             এ-চেষ্টায় সফল হয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ‘সরগমের নিখাদ’ নামে আত্মজীবনী লিখেছিলেন শচীন দেব। নিজের গান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘লোকসংগীত ও ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের সংমিশ্রণে একটি নিজস্ব গায়কি সৃষ্টি করেছি, যা বিদ্বজ্জনের কাছে আদৃত হয়েছে।’ লোকশিল্প ও আধুনিক চিত্রভাষার সংমিশ্রণে অনেকদিন থেকে আমরা চিত্রশিল্পীরা একটি নতুন চিত্রশৈলী আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। একটি আধুনিক বাংলা চিত্রভাষার জন্য শিল্পাচার্য যে-কাজটি শুরু করেছিলেন এবং একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিতও তাতে পাওয়া গিয়েছিল – আমাদের দুর্ভাগ্য সময়াভাবে তাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি। আমার ধারণা, শিল্পাচার্যের সফলতা হয়তো চিত্রশিল্পের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত হতো। বিস্মিত হতে হয়, চল্লিশের দশকেই বাংলা গানের আধুনিকতায় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন শচীন দেব। তাঁর গীত এবং অজয় ভট্টাচার্য-রচিত ‘জাগার সাথি মম’, ‘চম্পক জাগো জাগো’, ‘জাগো মম সহেলি গো’ এবং হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখায় ‘ও কালো মেঘ বলতে পার’ তারই উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

কবি জসীম উদ্দীনের সংগ্রহ ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’ এবং দুখাই খন্দকার ও জসীম উদ্দীনের মিলিত সংগ্রহ ‘রঙ্গিলা রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে, আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই রইলা রে’ শচীন দেব তাঁর কণ্ঠে অমর করে রেখে গেছেন। লোকগীতির ইম্প্রোভাইজেশন ‘ওরে সুজন নাইয়া, কোনবা কন্যার দেশে যাওরে চাঁদের ডিঙি বাইয়া’ একটি সার্থক রচনা। আগরতলায় থাকাকালীন সাহেব আলী নামে একজন পল্লিগায়কের সংস্পর্শে আসেন শচীন দেব। তাঁর গাওয়া অনেক গান নতুনভাবে নতুন করে রেকর্ডে গেয়েছেন শচীন দেব। ‘তুমি নি আমার বন্ধু, গৌররূপ দেখিয়া হইয়াছি পাগল, ওষুধ আর মানে না – চল সজনী যাইলো নদীয়ায়’ এবং ‘মন দুঃখে মরিরে সুবল’ প্রভৃতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের অমর ঠুমরি ‘ঝন ঝন ঝন পায়ল বাজে’, অজয় ভট্টাচার্যের বাংলা রূপান্তরে ‘ঝন ঝন ঝন মঞ্জীর বাজে’ কী সার্থকতার সঙ্গে শচীন দেব গেয়েছেন। গীতিকার, সুরকারকেও শচীন দেব নিজ ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করে বের করে নিয়েছেন অনবদ্য সব গান, যা চিরদিনের, চিরকালের। ব্যক্তিগতভাবে শচীন দেবের কিছু গান আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে, কৈশোরে এবং আপ্লুত হই কথায়, সুরে, গায়কিতে। রঙে, রেখায়, প্রয়োগে, ক্যানভাসকে সমপর্যায়ে উদ্ভাসিত করার সমর্থতায় আরো ঘনিষ্ঠ হই শচীন দেবের। আবিষ্কারে সচেষ্ট হই কোথায় সে-রহস্য যেখানে দেশজ উপাদানে সমৃদ্ধ তাঁর আধুনিক গান। শচীন দেবের সব গানের মধ্যে সুরে, রচনায়, গায়কিতে ‘গোধূলীর ছায়াপথে’ গানটি আমার কাছে একটি অসাধারণ গান বলে মনে হয়।

‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’ আমাদের যৌবনে শোনা গান। রোমাঞ্চিত হতাম, মুগ্ধ হতাম, বারবার শুনতাম। একটি হিন্দি ছবিতেও প্রয়োগ করেছিলেন এ-গানের সুরটি লতা মুঙ্গেশকর ও মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে – ‘তেরে বিনা শুনি নয়না হামারে।’ এরকম অনেক বাংলা গান হিন্দিতে রূপান্তরিত করেছিলেন শচীন দেব। রবীন্দ্রনাথের ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানটির সুর প্রয়োগ করেছিলেন দেব আনন্দের আফসার ছবিতে সুরাইয়ার কণ্ঠে – ‘নয়না দিওয়ানে কোই নহি মানে’ সুরে, খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

বাবার চাকরির সুবাদে তখন সন্দ্বীপে থাকি। সেখানে আমাদের কলের গান ছিল, কিন্তু সন্দ্বীপে কোনো রেকর্ডের দোকান ছিল না। শীতের সময়ে একজন রেকর্ড-বিক্রেতা নোয়াখালী সদর থেকে আসতেন শাড়ি-কাপড়ের গাঁটরির মতো গাঁটরিতে রেকর্ড নিয়ে। এসেই আমাদের বাসায় অনেক বাসার মতো। বাবা দেখলেন, সেই বাঁশি বাজানো রাখাল বালকের লেবেলে হিন্দুস্তান রেকর্ডে শচীন দেব। এক পিঠে ‘প্রেমের সমাধি তীরে – তাজমহল’ শৈলেন রায়ের লেখায়, অন্য পিঠে অজয় ভট্টাচার্যের লেখায় ‘আমি ছিনু একা’। দুটো গানের সুর দিয়েছিলেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত। আমাদের সংগ্রহে চলে এলো রেকর্ডটি। বহুদিন পরে সাইগলের কণ্ঠে – ‘কোনো বুঝাই রামা’ গানটি ‘আমি ছিনু একা’ গানটির সুরে শুনি। সে-বারে আরো একটি রেকর্ড দেখেছিলাম শচীন দেবের। খুবসম্ভব কোনো একটি ছবির প্লেব্যাক – ‘কী মায়া লাগলো চোখে – সকালবেলা।’ রাগপ্রধান বাংলা গানের একটা সুন্দর রেকর্ড বাবা সংগ্রহ করেছিলেন – যে-গানদুটি শচীন দেবের কোনো এলপি বা সিডিতে দেখি না। ‘স্বপন না ভাঙে যদি, শিয়রে জাগিয়া রব’, অন্য পিঠে ‘আজি রাতে কে আমারে ডাকিলে প্রিয়’, সানুনাসিক কণ্ঠে অসাধারণ গায়কি শচীন দেবের, এখনো শিহরিত হই।

কলকাতায় আশানুরূপ স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না শচীন দেব। অনেকটা অভিমানবশেই চলে গেলেন মুম্বাই। মুম্বাইয়ে কোনো রকম বেগ পেতে হয়নি গুণী সুরকারের স্বীকৃতি পেতে। সারা উপমহাদেশে তাঁর প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ল গায়ক-সুরকার হিসেবে। বিমল রায়ের সুজাতা ছবিতে স্বকণ্ঠে ‘শুন মেরে বন্ধু রে, শুন মেরে মিতওয়া’ যেন কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার বেদনা। কলকাতা ফিরে আসার চেষ্টা তাঁর বরাবরই ছিল। ‘পরবাসে কেন গো রহিলে’ গানটিতে শচীন দেবের সে-বেদনা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শচীন দেব বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর প্রিয় কুমিল্লা, প্রিয় বাংলাদেশ ধর্ষিত হচ্ছে সে-বেদনাবোধ থেকে তাঁর আগের গাওয়া ‘তাকদুম তাকদুম বাজে, বাজে ভাঙা ঢোল’ গানটি ঈষৎ পরিবর্তন করে নতুন করে গাইলেন, ‘তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল, ও মন যা ভুলে যা কি হারালি বাংলা মায়ের কোল।’ স্ত্রী মীরা দেববর্মণের লেখা এ-গান গেয়েই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেন শচীন দেব। প্রিয় শহর কুমিল্লা, প্রিয় বন্ধুসান্নিধ্য, স্মৃতিতাড়িত শচীন দেব ভুলে যেতে চাইলেন, ‘ও মন যা ভুলে যা কি হারালি, ভোলরে ব্যথা ভোল’ আমাদেরও ব্যথাতুর করে তোলে।

আগরতলায় গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। তারা শীচন দেবের বসতবাটিকে টাউন হলে রূপান্তরিত করেছেন। শচীন দেবের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেছেন প্রবেশমুখে। ভাস্করের নামটি জানা হয়নি। আমরা কি কুমিল্লা শহরে তাঁর বসতবাটিটিকে হাঁস-মুরগির খামার থেকে মুক্ত করে আনতে পারি না? পারি না একটি স্মৃতিমন্দির গড়ে তুলতে? ২০০৬-এ কুমার শচীন দেববর্মণের জন্মশতবার্ষিকীতে অন্তত এটুকু গড়ে তুলে বাংলাদেশ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারে।