জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে

হাসান ফেরদৌস

জর্জ অরওয়েল ১৯৮৪ লিখে শেষ করেন ১৯৪৯ সালে। ততদিনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে, হিটলারের পতন হয়েছে এবং পৃথিবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হিটলারের জার্মানির মধ্যে তিনি ইতোমধ্যে একটি  স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান দেখেছেন। একই সময় দেখেছেন স্তালিন নামক এক চূড়ান্ত একনায়ক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক আরেক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বগ্রাসী জয়রথ। এদের সবাইকে ছাপিয়ে মহাসমুদ্রের ওপারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রথম উত্তর-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আজীবন সমাজতন্ত্রী আদর্শে বিশ্বাসী অরওয়েল এই ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন, রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে অতিক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর বল্গাহীন উত্থানের ফলে রাষ্ট্র হয়ে পড়বে নিষ্পেষণের হাতিয়ারে, ব্যক্তি হারাবে মতপ্রকাশের সব স্বাধীনতা। শুধু তাই নয়, একসময় স্বাধীনভাবে চিমত্মা করার ক্ষমতাই ব্যক্তি হারিয়ে ফেলবে। ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারির ক্ষমতা থাকবে সরকারের। এর পরও যদি ভিন্নমতের কোনো চেষ্টা হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে যে অফুরন্ত ক্ষমতা রয়েছে, যে-কোনো ব্যক্তি অথবা দলকে পিষে ফেলতে সে-শক্তি ব্যবহারে সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।

স্বৈরতন্ত্রের বিপদ সম্বন্ধে পৃথিবীর মানুষকে সাবধান করে দিতেই লেখা হয়েছিল সে-গ্রন্থ। লন্ডনের পটভূমিতে সে-গ্রন্থের কাহিনি-বিস্তার। রক্ষণশীল অথবা আধা-উদারনৈতিক লেবার পার্টির নেতৃত্বাধীন ব্রিটেনেও স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়, অরওয়েল এমন ধারণাও পোষণ করতেন।

অরওয়েল কেবল সাবধান করেই পার পেয়েছিলেন, ১৯৫০ সালে মৃত্যু হওয়ায় তাঁকে মাওবাদী চীন দেখতে হয়নি, কম্বোডিয়ার খেমাররুজকে দেখতে হয়নি, দেখতে হয়নি পিনোসে, সাদ্দাম ও ইয়াহিয়াকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক লক্ষণ তাঁর কাছে ধরা পড়েছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক বিপদ তাঁকে দেখতে হয়নি। যে-স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তিনি কল্পনার চোখে দেখেছিলেন, আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত হওয়ার প্রকৃত আশঙ্কার মুখোমুখি। ঠিক সে-কারণে এ-গ্রন্থ প্রকাশের অর্ধশতক অতিবাহিত হওয়ার পরও অরওয়েলের কল্পকাহিনি ১৯৮৪ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। যা ছিল কল্পকাহিনি, এখন তা মোটেই কল্পকাহিনি নয়।

বস্ত্তত, যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণটি অরওয়েলের মাথায় ঠিকই ছিল। ১৯৪৪ সালে, সে-গ্রন্থ প্রকাশের পাঁচ বছর আগে, যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে এক বন্ধুর কাছে লেখা এক চিঠিতে অরওয়েল লিখেছিলেন –

একথা ঠিক হিটলার হয়তো খুব শিগগিরই পরাস্ত হবে, কিন্তু তাঁর জায়গায় মাথাচাড়া দেবে স্তালিন, ইঙ্গ-মার্কিন পুঁজিপতিরা এবং দ্য গলের মতো আরো অসংখ্য খুদে
হিটলার। যেসব দেশে আমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখেছি, সেখানেও অগণতান্ত্রিক ব্যবহার আকছার চোখে পড়ে, সেখানেও মহাপরাক্রমশালী
নেতারা ছড়ি ঘোরায়। সর্বত্রই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের খাতিরে যে-কোনো ব্যবস্থাই জায়েজ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে জাতীয় অর্থনীতি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে আনা হচ্ছে, যার কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নেই। সর্বত্রই এই আর্থিক ব্যবস্থার লক্ষ্য এক শ্রেণিভিত্তিক বিভাজন (‘কাস্ট সিস্টেম’) গড়ে তোলা। এর সঙ্গে যোগ করুন আনুভূতিক জাতীয়তাবাদ ও বস্ত্তনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক সত্যের অসিত্মত্বে অবিশ্বাস। সব বিষয়কে নব্য হিটলারীয় নেতার কথা ও বক্তব্যের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টায় বিজ্ঞানকেও বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে। নেতা যা বলেন সে-কথাই একমাত্র সত্য, একথা প্রমাণই হবে এসব চেষ্টার লক্ষ্য।

আজকের আমেরিকার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, অরওয়েল প্রকৃতই একজন দ্রষ্টা ছিলেন। ১৯৮৪ গ্রন্থটি তাঁর সেই গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সব প্রভেদ অন্তর্হিত হয়েছে। ঠিক যে-তথ্যকে তাঁর প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়, ট্রাম্প তাকেই সত্য বলে হাজির করছেন, তার যৌক্তিক ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক। উদাহরণ হিসেবে ট্রাম্পের অভিষেকে আগত দর্শকদের সংখ্যার কথা ধরা যাক। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের ধারণা, সে-অনুষ্ঠানে বড়জোর লাখদুই মানুষের সমাগম হয়েছিল। আট বছর আগে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অভিষেকে তার দ্বিগুণ দর্শকের উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ও পত্রপত্রিকায় এই দুই অভিষেকের ছবি পাশাপাশি প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু ট্রাম্প বললেন, আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দর্শক তাঁর অভিষেকে উপস্থিত ছিল। হাতেকলমে সে-দাবি মিথ্যা প্রমাণের পরও সেই একই দাবি করা হলো। তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে বলা হলো, ট্রাম্পের অভিষেকে বেশি দর্শক এসেছে, এ নিয়ে কোনো তর্ক চলবে না। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হলো, এটি হলো বিকল্প সত্য – অলটারনেটিভ ফ্যাক্ট। এর আগে আমরা জর্জ বুশের আমলে জেনেছিলাম, যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ্য, সেটিই যে একমাত্র সত্য নয়, বৈজ্ঞানিক সত্য ছাড়াও রয়েছে ‘বিশ্বাসনির্ভর সত্য’। অর্থাৎ যদি কেউ বিশ্বাস করে, তাহলে মিথ্যাকেও সত্য বলে গ্রহণ করা যায়। এবার পেলাম সত্যের বদলে ‘বিকল্প সত্য’।

ঠিক এরকম একটি ডিস্টপিও (অর্থাৎ ইউটোপিয়া-বিরোধী) রাষ্ট্রব্যবস্থার কল্পনাই করেছিলেন অরওয়েল। ১৯৮৪ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র উইনস্টনকে বলা হয়, পার্টি (অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল) মনে করে দুই আর দুই যোগ করলে হয় পাঁচ। তুমি নিজ চোখে যা দেখো বা কানে যে-কথা শোনো, তা ভুল, এ-কথা তোমাকে মানতে হবে। ট্রাম্প অথবা তাঁর মুখপাত্রেরও ঠিক একই দাবি, যা চোখে দেখেছ, সেটাই একমাত্র সত্য নয়। বস্ত্তত, সেটা আদৌ সত্য নয়, তোমাকে আমরা যা বলছি, সেটাই সত্য।

ওপরে যে-চিঠির কথা বললাম (যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বে লিখিত), সেখানে অরওয়েল লিখছেন, হিটলার হয়তো দাবি করবে ইহুদিরাই যুদ্ধ শুরু করেছে। যদি সে টিকে যায়, তাহলে এই সত্যটাই প্রতিষ্ঠিত হবে। এমনকি ফ্যুরার যদি দাবি করেন, দুই যোগ দুই হলো পাঁচ, সেটাই মানতে হবে। ‘আমার ভয় হয় এখন আমরা ক্রমশ সেই পথেই চলেছি।’

জর্জ অরওয়েল – তাঁর আসল নাম এরিক বে­য়ার – জন্মেছিলেন ১৯০৩ সালে বিহারের মতিহারিতে। বিহার সে-সময় অবিভক্ত বাংলার অন্তর্গত ছিল, সে-কারণে অরওয়েলের অধিকাংশ জীবনীকারই তাঁর জন্মস্থান বাংলা বলে চিহ্নিত করেছেন। অরওয়েলের পিতা ব্রিটিশ রাজের অধীনে মাঝারিগোছের রাজ-কর্মচারী ছিলেন। ভারতে তাঁর শৈশবের কিছু সময় কাটলেও স্কুলে পড়ার জন্য তাঁকে লন্ডনে ফেরত পাঠানো হয়। আজীবন বৃত্তি পেয়ে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন অরওয়েল; কিন্তু ধনীর সমত্মানদের জন্য নির্ধারিত প্রাইভেট স্কুলে তিনি চিরকাল মাথা নিচু করেই কাটিয়েছেন। সামান্য ত্রুটির জন্য বেত্রাঘাত ছিল নির্ধারিত, আর তারসঙ্গে ক্রূর পরিহাস। স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষক সবাই তাঁকে ‘দয়ার পাত্র’ (চ্যারিটি) বলেই ডাকত। শ্রেণিভেদ সম্বন্ধে তাঁর তীক্ষন সচেতনতা এই স্কুলজীবন থেকেই পাওয়া। পরে কর্মজীবনে এসে তা আরো গভীর হয়। বস্ত্তত, পরে তিনি যে বামপন্থী ধ্যান-ধারণার প্রতি ঝুঁকে পড়েন, তার সূচনা এই ব্রিটিশ বোর্ডিং স্কুল থেকেই।অর্থাভাবে তাঁর অক্সফোর্ডে পাঠ গ্রহণ সম্ভব হয়নি। অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি ঔপনিবেশিক সরকারের অধীনে পুলিশের চাকরি নিয়ে বার্মা আসেন। ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে স্থানীয় মানুষদের যে নির্মম লাঞ্ছনার  মুখোমুখি হতে হতো, বার্মায় অরওয়েল তা নিজ চোখে দেখার সুযোগ পান। সে-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি পরে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

অরওয়েল শৈশব থেকেই চেয়েছিলেন লেখক হবেন। পাঁচ বছর বার্মায় কাটিয়ে লন্ডনে ফিরে এসে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন তিনি, যদিও আসল লক্ষ্য ছিল জীবনাভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও তার ভিত্তিতে সাহিত্যকর্ম। এই সময় তিনি রীতিমতো লোটাকম্বল নিয়ে, একদম ভিখারির সাজে এই শহরের প্রান্তবর্তী মানুষদের সঙ্গে দিনের পর দিন কাটান। যথারীতি সে-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত হলো আরেকটি গ্রন্থ, ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন

এরই মধ্যে অরওয়েল বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেখানে এসে আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের সদস্য হিসেবে প্রতিরোধ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু সে-সময় – এখনকার মতোই – বামপন্থী রাজনীতি ছিল নানা দল-উপদলে বিভক্ত। কিছুটা হতাশ ও ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে স্পেন থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন অরওয়েল। ততদিনে তিনি ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী নখর প্রত্যক্ষ করেছেন, বামপন্থী বিভক্তির শিকার হয়েছেন এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রবল সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। তা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা তিনি ত্যাগ করেননি। রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর পক্ষে সম্ভব না হলেও লেখক হিসেবে সে-লক্ষ্য পূরণে তিনি আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

১৯৮৪ গ্রন্থটি অধিকাংশেরই পড়া, ফলে এ-গল্পের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ওশানিয়া নামে যে-রাষ্ট্রব্যবস্থা অরওয়েল এ-গ্রন্থে কল্পনা করেছেন, কেউ কেউ বলেছেন তা অরওয়েলের নিজের দেশ যুক্তরাজ্যকে মাথায় রেখে। শ্রমিক দলের অধীনে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হয়তো যুক্তরাজ্যে আরোপিত হয়েছিল, কিন্তু যে-ধরনের কঠোর স্বৈরতান্ত্রিক নিয়মবদ্ধতা অরওয়েলের ওশানিয়ার লক্ষণ চরিত্র, তা কোনোভাবেই যুক্তরাজ্যের মতো সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রে বর্তমান ছিল না। তবে অরওয়েল সন্দেহ করেছিলেন, সজাগ না থাকলে এই হালকা সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থেকেই কঠোর  স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের জন্ম হতে পারে। স্পেনে থাকার সময় অরওয়েল দেখেছিলেন দলীয় আনুগত্যের নামে কীভাবে কমিউনিস্ট ও  এনারকিস্ট পার্টি সব ধরনের ভিন্ন মতের ব্যাপারে অসহিষ্ণু। সেখানে দলের নেতা ও দলের স্বার্থই সর্বাগ্রে। অরওয়েল লেবার পার্টির ভেতরেও সেই লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে সেই কাঠিন্য কোনোভাবেই তুলনীয় নয়।

বিষয়টি অরওয়েল কিছুটা খোলাসা করে গেছেন তাঁর মৃত্যুর সামান্য আগে, ১৯৪৯ সালে ইউনাইটেড অটোমোবাইল ওয়ার্কার্সের এক সদস্যের কাছে লেখা এক চিঠিতে। তাঁর গ্রন্থ কোনোভাবেই যুক্তরাজ্যের সমাজতান্ত্রিক মডেলের সমালোচনা নয়, সে-কথা জানিয়ে অরওয়েল সে-চিঠিতে জানান –

সমাজতন্ত্র বা ব্রিটিশ লেবার পার্টির সমালোচনা হিসেবে এই বই নয়, বরং কমিউনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রীভূত ও পরিকল্পিত অর্থনীতির নামে যে বিকৃতি
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার ব্যাপারে এক হুঁশিয়ারি মাত্র। মনে রাখা ভালো আমার বইটি একটি প্রহসন বা স্যাটায়ার। আমি যে-ধরনের সমাজের কথা এই গ্রন্থে বলেছি, তা অনিবার্য সে-কথা আমি বিশ্বাস করি না, তবে সে-ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমি বিশ্বাস করি, এক ধরনের স্বৈরাচারী মনোভাব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সর্বত্র বিদ্যমান। আমি কেবল চেষ্টা করেছি এই জাতীয় মনোভাব শেষ পর্যন্ত একটা সমাজকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, সে-ব্যাপারে সতর্ক করে দিতে। এই গ্রন্থের ঘটনাস্থল লন্ডন নির্বাচনের কারণ, আমি বলতে চেয়েছিলাম আমাদের দেশ অন্য আর কোনো দেশের চেয়ে মোটেই ভালো কিছু নয় এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে আমাদের দেশেও এই একই ঘটনা ঘটতে পারে।

১৯৮৪ উপন্যাসের গোড়াতেই আমরা জেনে যাই, যে-দর্শনের ভিত্তিতে ওশানিয়া চলছে তার মূলে রয়েছে তিনটি সোজা আইন – যুদ্ধ হলো শামিত্ম, মুক্তির অন্য নাম দাসত্ব, অজ্ঞতাই হলো শক্তি। যে-ভাষায় সেখানে সরকারি কাজকর্ম চলে, তার নাম ডাবলস্পিক, অর্থাৎ এক কথার দুই অর্থ, সাধারণ নাগরিকদের বুঝ দিতে এই দুমুখো ভাষার তুলনা নেই। রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে পার্টি যা বলবে, বিনাবাক্যে তা মেনে নেওয়াই এই ওশানিয়ার নিয়ম। লোকে সে-কথা মেনেও নেয়, কারণ বিকল্প কোনো সত্য তাঁদের জানা নেই। অন্য কারণ, তাঁদের ওপর সারাক্ষণ নজরদারি করছে গোপন পুলিশ। সারা শহরের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই ঘোষিত হচ্ছে, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং।

‘মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ’ – ওশানিয়ার সরকারি ভাষা ‘নিউস্পিক’ অনুসারে সংক্ষেপে যার নাম মিনিট্রু – সবার চেয়ে ভিন্ন এক ভবনে অবস্থিত, সে চেয়ে দেখার মতো এক জিনিস। পিরামিড আকৃতির এক বিশাল স্থাপনা, চকচকে শ্বেত কংক্রিটে নির্মিত ভবনটি আকাশের দিকে উঠে গেছে, তলার পর তলা, প্রায় ২০০ মিটার পর্যন্ত যা ঊর্ধ্বে প্রসারিত। তার গায়ে চকচকে অক্ষরে লেখা দলের তিনটি সেস্নাগান – ওয়ার ইজ পিস, ফ্রিডম ইজ সেস্নভারি, ইগনোরেন্স ইজ পাওয়ার।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ৩৯ বছরের উইনস্টন। অন্য সবার মতো সেও যথারীতি সরকারি দলের একজন সদস্য। ওশানিয়ার প্রত্যেকেই এই দলের সদস্য, প্রত্যেককেই এই দলের প্রধান ‘বিগ ব্রাদারে’র কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হয়। টুঁ-শব্দটি করার সাধ্য কারো নেই, কেউ যদি সে-চেষ্টা করে, গ্রেফতার ও নির্যাতন অবধারিত। সরকারি নীতির যে-কোনো বিরোধিতাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এই অপরাধের একটি বিশেষ নামও রয়েছে – থটক্রাইম বা চিমত্মা-অপরাধ। সেসব অপরাধীকে কব্জা করতে রয়েছে বিশেষ থটপুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অপরাধে দ–ত ব্যক্তিদের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। শহরের সর্বত্র এই বিগ ব্রাদারের ছবি, তাঁর মূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে। টেলিভিশনের পর্দায়, পত্রিকার পাতায় সর্বদা তাঁর ছবি। লোকের মনে, তাঁদের চিমত্মায় তিনি চৌপ্রহর বিদ্যমান।

ছাপোষা মানুষ উইনস্টন, অথচ এই অতিসাধারণ মানুষটির মধ্যেই জেগে ওঠে প্রতিবাদ। কিন্তু ঠিক কী করা যায়, সে-বিষয়ে খুব স্পষ্ট কোনো ধারণা তার নেই। নিজের মনের কথাগুলো গুছিয়ে লেখার জন্য সে একটি ডায়েরি কেনে। কিন্তু ব্যক্তিগত বলে কোনো কথা নেই এই রাজ্যে, উইনস্টন পার্টিবিরোধী কথা নিজ ডায়েরিতে লিখেছে, সে-কথা যে-কোনো সময় ধরা পড়ে যেতে পারে। একসময় সে ঠিক ধরাও পড়ে। পার্টি প্রথমে চেষ্টা করে উইনস্টনকে শুধরাতে তার মগজধোলাই করে। কিন্তু তাতে সফল না হলে তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় ভয়াবহ ইঁদুর বাহিনীকে।

উপন্যাসটির মূল বক্তব্য, আমার মনে হয়েছে, এই কথা বলা যে, স্বৈরতন্ত্র মহাপরাক্রমশালী হলেও ব্যক্তির পক্ষে তাকে অস্বীকার করার অমিত শক্তি আছে। এজন্য ব্যক্তিকে হয়তো কড়া মূল্য দিতে হবে, হয়তো মৃত্যুও সম্ভব, কিন্তু ব্যক্তির অন্তর্গত বিদ্রোহকে দমানো অসম্ভব। থটপুলিশের হাতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় উইনস্টন তার সে-প্রত্যয় ব্যক্ত করে এভাবে –

উইনস্টন বলে, ‘শুধু ভীতি ও ঘৃণার ভিত্তিতে কোনো সভ্যতা নির্মাণ সম্ভব নয়। তেমন সভ্যতা কখনোই স্থায়ী হবে না।’

‘কেন?’

‘কারণ তেমন সভ্যতার নিজস্ব কোনো প্রাণশক্তি থাকবে না। সে ভেঙে পড়বে, তাকে আত্মহত্যা করতে হবে।’

‘বাজে কথা। তুমি এমন এক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে আছ যে, ভালোবাসার তুলনায় ঘৃণা অনেক কম শক্তিশালী। মোটেই নয়। আর তা হলেই-বা পরিস্থিতির এমন কী হেরফের হতো? ঠিক আছে, ধরলাম যে আমরা নিজেদের নিঃশেষ করে ফেললাম। মানুষ ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলবে, আমরা এমন এক ব্যবস্থা করে ফেললাম। তার পরেও পরিস্থিতির কি এমন হেরফের হবে? তুমি এ-কথাটা কেন বুঝতে পারছ না যে, ব্যক্তির মৃত্যুই শেষ কথা নয়, কারণ দল হচ্ছে মরণহীন।’

একটানা তর্ক-বিতর্কে দুর্বল হয়ে পড়ছিল উইনস্টন, সে অসহায় বোধ করছিল। তাছাড়া সে জানত নাছোড়বান্দা হয়ে থাকলে ও’ব্রায়ান (থটপুলিশের সদস্য) তাঁর ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। তা সত্ত্বেও চুপ করে থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দুর্বলভাবে, কিছুটা বিশৃঙ্খলভাবে ও’ব্রায়ানের কথার পালটা জবাব তাকে চালিয়ে যেতেই হবে।

‘আমি জানি না, এসব ব্যাপার নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু জানি, তোমরা ব্যর্থ হবে। কোনো না কোনোভাবে তোমরা পরাস্ত হবে। তোমরা পরাজিত হবে জীবনের কাছে।’

আমার মনে হয়েছে এই উপন্যাসের মূল বার্তা এই শেষ বাক্যেই নিহিত – দল, নেতা, এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়েও অধিক শক্তিশালী ব্যক্তি। তাকে মেরে ফেলা সম্ভব, কিন্তু তার প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করা অসম্ভব।

অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাস হিসেবে অধিক খ্যাত ও জনপ্রিয় হলেও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভীতিকর সম্ভাবনা তিনিই প্রথম বলেছেন, এমন নয়। এ-গ্রন্থ প্রকাশের অনেক আগে, ১৯১৯ সালে, রুশ লেখক ইভগেনিজামিয়াতিন প্রায় একই রকম একটি ডিস্টপিয়ান উপন্যাস লিখেছিলেন। অরওয়েল সে-গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কার্যত একই বিষয়ে আরেকটি বই, অলডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড। জামিয়াতিন যে-স্বৈরতন্ত্রের কল্পনা করেছিলেন তা বাস্তবে পরিণত হবে ২৬০০ সালে, অন্যদিকে হাক্সলির স্বৈরতন্ত্র বাস্তবায়িত হবে ২৫৪০ সালে। তাঁরা দুজনেই যে কাল্পনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চিত্র এঁকেছিলেন, তাতে সরকার হবে সর্বক্ষমতাময়, মানুষ হারাবে নিজস্ব মতপ্রকাশের ক্ষমতা।

কাহিনি কাঠামোর দিক দিয়ে জামিয়াতিনের গ্রন্থটি অবশ্যই অরওয়েলের ১৯৮৪-র অনেক নিকটবর্তী। উদ্দেশ্যের দিক দিয়েও। যে ইউটপিও (আসলে ডিস্টপিও) রাষ্ট্রের ছবি জামিয়াতিন আঁকেন, তাতে কারো নিজের ইচ্ছা বলে কিছু নেই। কে কী করবে, কী খাবে, কী ভাববে সবই সরকার-নিয়ন্ত্রিত। কারো নিজস্ব নাম পর্যন্ত নেই, তার বদলে রয়েছে সরকারের দেওয়া একটা নম্বর। যৌন সঙ্গম সেখানে নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু তার জন্য বেঁধে দেওয়া আছে নির্ধারিত সময়। দেশটির সর্বত্র কাচ দিয়ে ঢাকা, ফলে সবকিছুই নজরদারি করা সম্ভব। সবার ওপর খবরদারির জন্য রয়েছে এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হলে প্রত্যেকের জন্য রয়েছে এক ভয়ংকর মেশিন, যার হাতে মৃত্যু অবধারিত।

গঠনগতভাবে মিল থাকলেও জামিয়াতিন এবং হাক্সলির গ্রন্থের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে অরওয়েলের ১৯৮৪ সর্বাংশে তুলনীয় নয়। অরওয়েল এক সম্ভাব্য রাষ্ট্রব্যবস্থার চিত্র এঁকেছিলেন, যে-রাষ্ট্রব্যবস্থা হিটলারের জার্মানিতে একসময়  প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্তালিনের সোভিয়েত  ইউনিয়নেও সেই একই রকম দল ও নেতানির্ভর স্বৈরতান্ত্রিক  রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রায়  অর্ধশতক  টিকে ছিল। আধুনিক সময়ে উত্তর কোরিয়ায় যে একনায়কতন্ত্র ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে, তাও অরওয়েলের কাল্পনিক জগৎ থেকে খুব স্বতন্ত্র কিছু নয়। অন্যদিকে জামিয়াতিন ও হাক্সলি দুজনেই মানবসভ্যতা কীভাবে ক্রমশ মেশিননির্ভর হয়ে পড়ছে, তার এক ভীতিকর কিন্তু বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরেছিলেন। একুশ শতকে এসে মানবজীবন ও চিমত্মার ওপর যন্ত্রের প্রভাব যে কতটা সর্বগ্রাসী, সে তো আমাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন  অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। জামিয়াতিন অথবা হাক্সলি কেউই স্তালিন বা হিটলারের একনায়কতন্ত্রের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাঁদের কল্পকাহিনি নির্মাণ করেননি। তাঁরা দুজনেই আমেরিকায় প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর মেশিন-সভ্যতার উলস্নম্ফনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, ফোর্ড মোটর কারখানায় মানুষ কীভাবে কনভেয়ার বেল্টের ঘূর্ণায়মান যান্ত্রিকতার দাসে পরিণত হচ্ছে, সে-বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন। তাঁরা এই ভেবে ভীত ছিলেন যে, মানুষ ক্রমশ মেশিননির্ভর হয়ে পড়ার ফলে সে একদিকে ব্যক্তিগত অনুভূতি হারিয়ে ফেলছে, অন্যদিকে ন্যায়-অন্যায় ফারাক করার ক্ষমতা তার লোপ পাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নীতিবোধ – যার ভিত্তিতে রয়েছে নীতিহীনতা।

একই বিষয়ের ওপর লেখা এই তিনটি বইয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর ১৯৮৪-এ চিত্রিত ডিস্টপিয়াকে এখন আর মোটেই কল্পকাহিনি মনে হয় না। যে-নব্যভাষার কথা অরওয়েল বলেছিলেন, তাও অবাস্তব নয়। তবে এ-কথাও যোগ করা ভালো, উপন্যাস হিসেবে এই তিনটি গ্রন্থ একই সমস্যায় ভুগছে। রাজনৈতিক চালচিত্র অথবা রাজনৈতিক ইশতেহার হিসেবে এদের জুড়ি নেই। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে তারা কেবল দুর্বলই নয়, অসম্পূর্ণও বটে। হ্যারল্ড বস্নুম ১৯৮৪-কে বলেছেন ‘এ গুড ব্যাড বুক’। অর্থাৎ তার উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে বইটি ভালো, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু উপন্যাস হিসেবে নয়। একই কথা অন্য দুটি গ্রন্থের বেলায়ও প্রযোজ্য।

বস্নুম ১৯৮৪-কে হ্যারিয়েট স্টোওর বিখ্যাত দাসব্যবস্থাবিরোধী উপন্যাস আংকল টম’স কেবিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেছেন, এটি হলো আমাদের সময়ের আংকল টম’স কেবিন। শুধু তফাৎ এই যে, টম’স কেবিনের চরিত্রগুলো যেমন বাস্তবসম্মত ও মনোগ্রাহী, ১৯৮৪-এর চরিত্রগুলো মোটেই সেরকম নয়। তার নৈতিক যৌক্তিকতার কারণে ১৯৮৪ এই মুহূর্তে অনেক প্রাসঙ্গিক, কিন্তু নান্দনিক দিক দিয়ে আংকল টম’স কেবিনের চেয়ে সে অনেক দুর্বল। বস্ত্তত, বস্নুম সরাসরি অরওয়েলের উপন্যাসকে স্টোওর উপন্যাসের চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর বিবেচনায়, স্টোও একজন প্রকৃত ঔপন্যাসিক; কিন্তু অরওয়েল একজন ‘রাজনৈতিক প্যাম্ফলেট লেখক’, যার প্রধান শক্তি রসময় বিদ্রূপ ও পরিহাস।

অনুমান করি, অরওয়েল বস্নুমের এই মন্তব্যে খুব একটা ক্রুদ্ধ হবেন না। লেখক হিসেবে নিজের উদ্দেশ্য প্রশ্নে খুব স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন অরওয়েল। ‘আমি কেন লিখি’, এই নামের একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার সকল রচনার একটাই লক্ষ্য, যেভাবে সম্ভব স্বেচ্ছাচার ও স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষাবলম্বন।’ আজকের দিনে এমন স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন ও নীতিবান লেখকের প্রয়োজন আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।  r