জানালা অথবা বিবিধ মৃত্যুপ্রতীক্ষা

আবু হেনা মোস্তফা এনাম

একাকী, নিঃসঙ্গ কথার নক্ষত্রবীথি মনের অতল আঁধারে লুব্ধক, চাঞ্চল্য আর অন্তহীন। অন্তহীন এ-কথা সে-কথার আশ্চর্য বুদ্বুুদ। কথা – কথা – কথা! কথা কী যে সব অদ্ভুত ম্যাজিক! কথার জন্যই পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতা, কথার ভেতর সভ্যতার নিস্তব্ধ ইতিহাসের নিগূঢ় প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের মর্মার্থ, কথার ভেতর পৌরাণিকের ঐশ্বর্য, কথার ধ্বনিপুঞ্জে সাম্প্রতিকের সৃজন-অভ্যুদয়, কথার জন্য প্রতীক্ষা; কথার বাইরে আর সব ফানুস, সমস্তই শূন্য, সীমাহীন আলস্যে নিষ্কর্মা-অভিনীত দিনরাত্রি। কথা আছে তো তুমি আছ, কথা আছে তো আমাদের অস্তিত্ব আছে, আমাদের বর্তমান আছে, আমাদের জানালা আছে, রৌদ্র আছে, আকাশ আছে; রৌদ্রাকাশের উন্মীলন, উন্মীলনের অন্তর্গত স্পর্শ ও শ্র“তির প্রজ্ঞা, শ্র“তির প্রজ্ঞার ভেতর কণ্ঠস্বরের স্বভাব – এই জ্ঞান, এখন, যখন, কণ্ঠস্বর
নেই, কণ্ঠস্বরে ধ্বনির উন্মেষ নেই তো আমাদের স্বপ্ন নেই, আমাদের প্রাচীনতা নেই, ভবিষ্যৎ নেই, সাম্প্রতিক নেই, সময়ের উল্লম্ফন নেই, সৃজন-অভ্যুদয় নেই, অনুরণন নেই; স্বপ্নবৃত্তায়িত বিদ্যালয়ে আমরা জড়পিণ্ড, তার চলন নেই, ঠাট নেই, রূপ নেই, ঘ্রাণ নেই, কোমলতা নেই – কেবল রুক্ষ, আদিম জন্তুর ভয়ংকর ছায়া, ঈর্ষার নিঃসঙ্কোচ রক্তহ্রেষা। এখন কথার জন্য অধীরতা, কথার জন্য বেদনার কালো রক্তকণ্ঠক্লেশ, কথার জন্য জানালার সাধনা। অথচ কথার উন্মীলন, কথার আকাক্সক্ষা কণ্ঠ এবং হৃৎপিণ্ডের ভেতর নিদ্রার কুশীলব হলে, তখন রক্তাক্ত নৈসর্গিক, তখন মৃত বৃক্ষকাণ্ড, তখন পাহাড়ের পরিত্যক্ত প্রাচীন গুহা; সেখানে পাতা নেই, ফুল নেই, ঘ্রাণ নেই, সবুজ নেই, আলো নেই, ছায়া নেই, রং নেই, রঙের প্রকৃতি নেই, রঙের আশ্চর্য নেই। আমরা, যখন, কথার রঙের সন্ধান করি, এখন কথার ছায়ান্ধকার বিমূঢ়; আমরা কথার ফুলের উন্মীলনে প্রবেশ করি, কথার রক্তাক্ত নৈসর্গে মোহিত, এখন সেই স্মৃতি-অভ্যুদয় বেদনার কোরাস, এখন এই প্রজ্ঞা অস্তিত্বের নিঃশব্দ প্রাকৃতিক!
অথচ, নক্ষত্রবীথি যে-কথা, সে-কথাই বন্ধ হয়ে গেলে আশফাকের নিজের ভেতর এক নিদারুণ শূন্যতার হাহাকার, তখন নিঃসঙ্গ বেওয়ারিশ কুকুরের হাপিত্যেশ স্বভাবের তরঙ্গসঞ্চার; কেননা, কখনো কি সে ভেবেছিল – এরূপ নির্বাক নিস্তব্ধ প্রাকৃতিক স্ফুটনে তাকে শূন্য ছাদের সাদা দেয়ালের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত পরাজিত হতে হবে? যদিও, বলা হলো, যুদ্ধ এবং পরাজয়ের গ্লানিবিষাদিত শব্দবন্ধ; যখন যুদ্ধের ইতিহাস, যা অনির্বচনীয় এক রক্তপ্রলম্বন, যা মৃত্যুবিষাদের দীর্ঘশ্বাস, শব্দবন্ধের কী স্পর্ধা যে, এই মৃত্যুবিষাদের দীর্ঘশ্বাস আমাদের জ্ঞানের অন্তর্গত করে! তবু আমরা, দৈনন্দিন অজস্র যুদ্ধের ভেতর মরণাপন্ন, কীভাবে যে, এখন, এই দুস্তর বীভৎস এবং আঁধার বর্তমান অতিক্রান্ত; এখানে, এখন, ছায়ার সঙ্গে হিমশীতল যুদ্ধ, দেয়ালের সাদার সঙ্গে অগ্নিরক্তোন্মত্ত যুদ্ধ; এখন, স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে, স্বপ্ন এবং সাম্প্রতিকের সঙ্গে যুদ্ধের নিঃসঙ্কোচ নিরুদ্ধ চিৎকারের নখর সঞ্চারিত। কেবল বাঁদিকের জানালাটা আশফাকের; স্বপ্নের আশ্চর্য যেমন কখনো আত্মপ্রসাদিত, যেমন পুলকদায়িনী, যেমন কখনো জ্যোতির্ময় নক্ষত্রের সৌন্দর্য; এরূপ চতুষ্কোণ একটা সম্ভাবনার অভিপ্রায় বয়ে আনে। সে দেখে জানালায় সবুজ সূর্যালোকের নৈসর্গিক, দেখে গাছগাছালির পাতা ডাল লতাপুষ্পের হাতছানি, দেখে ছায়ার অভ্রবিস্তারিত, দেখে বিহঙ্গগান, সেখানে পৃথিবীর বিবিধ শব্দের ইতিহাস সামগ্রিক দূরত্বকে নিকটস্তে সমাহিত, পৃথিবীর বিবিধ স্পর্শ ও স্বরের অভিজ্ঞতা, শ্র“তি ও ঘ্রাণের জ্ঞান, দৃশ্য ও উপলব্ধির প্রজ্ঞা, সেখানে নীলাব্ধি দিন আর বিকেলের মর্মার্থ, সন্ধ্যা-নক্ষত্রের স্খলিত বেদনাঘূর্ণির নিগূঢ়তার ভেতর তার কল্পনা ও আকাক্সক্ষা সীমাহীন নিরর্থকতার বিকারে অশ্র“পাত করে। যখন জানালায় আশফাকের অশ্র“পতন; জানালা গ্রীষ্মের জানালা, বর্ষার জানালা, শরতের জানালা, হেমন্তের জানালা, শীতের জানালা, বসন্তের জানালা। জানালার ভেতর বৈশাখী, জানালার ভেতর বর্ষা অথবা হিমের ঝড়। ছাদের দেয়ালে মাকড়সার জাল মুখস্থ করতে করতে যখন ক্লান্ত, জীবনের স্বপ্নকর্মা ও সম্ভাবনার সবুজ সূর্যালোকিত জানালাটি এখন দুর্দমনীয় শ্মশ্র“র অশ্বক্ষুর। পাশ ফেরার ক্ষমতা নেই, এমনকি অতি সন্তর্পণে ঘাড় ঘোরাতে চায় আশফাক, কিন্তু প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওর দুরভিসন্ধি আঁচ করে তীব্র বিদ্রোহে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয়। তখন, কেবল আঁখিতারা আর চঞ্চল কালো মণির বিক্ষোভ, বিক্ষোভ-বিস্ফারিত চক্ষুকোটর ছিঁড়ে হৃৎপিণ্ডটা দড়াম করে আছড়ে পড়ে। ওইটুকুই। ওইটুকুতেই আশফাক মৃত্যুলোকের শূন্যতায় বড্ড একাকী, ক্লান্ত বোধ হয়; দেয়ালের সাদার সঙ্গে যুদ্ধের ভেতর কল্পনা আর ভবিষ্যতের বিবিধ সংকেতের মধ্যে মনে হয় – তাহলে বেঁচে আছি! বেঁচে আছি! বেঁচে থাকাটাই বড়ো তীব্র অনুভব, বিষাদিত দীর্ঘশ্বাসের ঝিমের ভেতর এই অনুভব আশ্চর্য সুখের – ওই যে সবুজ সূর্যালোকের নৈসর্গিক জানালা, ওর তন্দ্রার ভেতর নিমীলিত আঁখিপল্লবে ছায়াস্পর্শের অনুরণন তোলে, মুখরিত ঝিল্লিরব প্রাচীন সুরের উন্মত্তে জেগে, প্রাচীন পতঙ্গের পাখায়, পাখার ছায়ায়, পাখার রং ও রেখার প্রৌঢ় ইতিহাস ডাকে – আশফাক ওঠো, চোখ খোলো! আশফাক ওঠো, ওঠো, চোখ খোলো!
চোখ খুললেই সহস্র বিদ্রƒপ, চোখ বুজলেও কম্পমান চিৎকারের রক্তোচ্ছ্বাসিত ছুরি, অথবা চোখ খোলা ও বন্ধের ইতিহাসের ভেতর, এখন, দুর্দমনীয় ছাদের সাদা দেয়াল – কোথাও নিবিড় আঁধার, জন্তুর পদবিক্ষেপে ধাবমান দুর্দম কৃষ্ণবর্ণ প্রাগৈতিহাসিক ভবিষ্যৎ; অথবা ঝুঁকে আসা কাজলের অধৈর্য মুখ। কাজলের মুখ ভেঙেচুরে সহস্র তরঙ্গের ভেতর দিয়ে বিকলাঙ্গ পতঙ্গ উড়ে আসে, অচেনা, দুষ্পাঠ্য, ফ্যাকাশে; মনের মধ্যে হাত-পা গলিত কুষ্ঠে বিস্তারিত। হাতড়ে হাতড়ে ওই চোখমুখের আদল স্পষ্ট হলেও অস্পষ্ট গোঙানি স্বরের বিকৃতি হয় – কে? কে? কে? – আমি কাজল – ও কাজল! কে? কাজল কে? – ও কাজল! তখন, এই সম্বোধন ও জিজ্ঞাসা কাজলের বিস্ময় নয়; অবহেলা না উদাস – এসব মুহূর্তের অভিব্যক্তি প্রাগৈতিহাসিক ছায়ায় বিস্তৃত হলে কাজল, যে তখন, অপেক্ষা এবং বেদনার ধৈবত সঞ্চারে আঁধারিত তার রক্তমাংসের ভেতর দুঃখ ও ক্ষোভের যুগপৎ অনুরাগের উত্তেজনা। পুনরায় শান্তশ্রী মোহিনী, কখনো অসহায় – তখন ছায়া নেই, প্রান্তরহীন, দিকচক্রবালশূন্য ঝাঁ-ঝাঁ রৌদ্রঋতুর দিন; বৃক্ষ নেই, ফুলপাতা নেই, নক্ষত্র নেই, পানির শীতার্ত নেই; তখন কেবল গনগনে চুলায় পোড়া ভাতের চিমসে গন্ধ, গনগনে চুলার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, লাল ধূম্রঅগ্নিঘূর্ণির নিগূঢ়তা। অগ্নিঘূর্ণির নিগূঢ়ে আশফাকের মাথার ভেতর, তখন, নিস্পৃহ আঁধার; এখন সন্ধ্যা; নাকি, এখন রাত? এখন দুপুর; নাকি এখন দুপুর! দুপুরের এত শূন্যতা, দুপুরের এত উদাস সঞ্চয়, দুপুরের এত সংসার, দুপুর এত প্রাচীন; দুপুর এত জানালা, দুপুরের সংসারে কত কাজ; তোমার, কাজলের, আমাদের – সংসারের ইতিবৃত্ত, সংসারের খুঁটিনাটি, সংসারের রৌদ্রছায়া, সংসারে ধ্বনির ইন্দ্রজাল, শব্দের কুহেলিকা, বৃক্ষের সংসার, সংসারে প্রাণীর সংসার, সংসারে গৃহিণীর সংসার, সংসারে জলজ সংসার, সংসারের ইতিহাস, ইতিহাসের ভেতর প্রাচীন প্রজ্ঞা ও জ্ঞান, সংসারের ভেতর জন্ম-মৃত্যু, সংসারের ভেতর জীবনের উন্মীলনের ইতিহাস, জানালার ইতিহাস, জানালার বেদনা, বেদনার ইতিহাস, আনন্দের ইতিহাস, প্রেমের ইতিহাস, অপেক্ষার ইতিহাস, ভবিষ্যতের ইতিহাস, সাম্প্রতিকের দুর্বিনীত যন্ত্রণা, অতীতে প্রলম্বিত আঁধার – তোমার হাত না পড়লে সমস্ত ধূলিময় হবে, কাজল, তোমার সংসার, সংসারের ইতিহাস, সংসারের গৌরব, সংসারের সব বাঁধন আলগা হয়ে যাবে, কাজল! কাজল, রান্না ফেলে সংসারের প্রাচীন ছায়া ফেলে প্রতীক্ষিত সময় ফেলে আবার এলে, চুলোয় কি নিমবেগুন, চুলোয় কি তোমার সংসার, আমাদের সংসার, চুলোয় কি তোমার ভবিষ্যৎ, আমাদের ইতিহাস – পুড়ছে, পুড়ছে সবুজ সবুজ গ্রাম-নগর, পুড়ছে সংসার, বৃক্ষ পুড়ছে, নদী পুড়ছে, আকাশ পুড়ছে; কাজল; আমাদের বাতাস পুড়ছে, আমাদের জানালা পুড়ছে, বিদ্যালয় পুড়ছে, কৃষি পুড়ছে, আমাদের ছায়া পুড়ছে – পোড়া গন্ধের ভেতর কাজলের শান্তশ্রী স্বস্তিদায়িনী মুখ ঝুঁকে এলে আশফাক আনন্দের নিবিড় বেদনায় চোখ খোলে।
চোখের ভেতর স্খলিত ছায়ার কণ্ঠস্বর জলজ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে এলে, এখন, শুয়ে শুয়ে এরূপ অভ্যুদয় অবিরাম প্রতিবিম্বিত, আশফাক নিষ্কলুষ দীর্ঘশ্বাস করে। ধম্মদার দোকানের দুধচায়ের তেষ্টা পায়, কাজলের ঝুঁকে থাকা মুখ সন্ধান করে; আর তন্দ্রার ভেতর ভিন্ন এক নিদ্রাভ্রমণে রফিকের মুখ ভেসে আসে, ছায়া-ছায়া আম্রকাননের বিবিধ নৈসর্গিক ভেসে আসে, আম্রকাননকুঞ্জের জ্ঞান, জ্ঞানের ইতিহাস, ইতিহাসের দিনরাত্রির ব্যঞ্জনা, ইতিহাসের জানালা; অথবা আম্রকাননকুঞ্জনিবাসীদের মুখের মিছিল। এসবই বিস্মৃতির আঁধারে ডুবিয়ে দিতে চাইলেও বরং ক্রমাগত উসকে ওঠে অথবা কেবলই কালো পোশাকের দৌড়, কালো পোশাকের কুচকাওয়াজ প্রতিযোগিতার চলচ্চিত্র শুরু হলে এসব দৃশের এক-একটি সূত্র, এক-একটি জ্ঞান জানালার ভেতর বকুলগাছের রাশি রাশি পাতার আড়ালে ভীরু পাখি; পাতার ছায়ায়, পাতার আঁধারে মৃত্যুগন্ধে বিবশিত। আর, এখন, যারা জানালার ভেতর সবুজ রৌদ্রের ভেতর ডাংগুলি খেলায় মত্ত; কিশোরদের তুমুল হইচই, খেলার উল্লাসের ভেতর আচমকা ভেসে এলে আশফাকের তন্দ্রা লুপ্ত হয়। তখন, নিষ্করুণ রৌদ্রের বেয়নেট তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। স্মৃতির পুঞ্জীভূত আঁধার লুপ্তবিধি – এরূপ রৌদ্রে, এরূপ রৌদ্রঋতুর উচ্চ-দিনে তাকে; যে-আশফাক, এখন, আতঙ্কিত বিস্ফারিত গলার রগ ফুলিয়ে ত্যাড়া অশ্র“ সংবরণ করে; চলে যেতে হয়েছিল, সে চলে গিয়েছিল। এখন যাদের ডাংগুলির তীব্র কৈশোর, তখন, তার এবম্বিধ চণ্ড বয়সে, খেলার কৈশোরের ঐশ্বর্যরাশি ফেলে আটজনের একটি দলের সঙ্গে চলে যেতে হয়েছিল। এখন স্মৃতির বেদনা, তখন মৃত্যুর উন্মীলন, তখন স্বপ্নের রক্তদণ্ড লাশ হয়ে যাওয়া, পরিব্যাপ্ত ইন্দ্রিয়ের অবলুপ্তি ভাবের মধ্যে নিঃশব্দে এগিয়ে চলা, ছায়ার ভেতর রাতের ভেতর জ্যোতিষ্কের প্রতীক্ষিতের ভেতর মৃত্যুর সুকৃতি আর কেবল মা মা দৃশ্যের সঙ্গে জীবনের স্পন্দন নির্বিকার করা।
কিন্তু আশফাক মরেনি। বাঁয়ের জানালার প্রতীক্ষিত ছায়ায়, জানালার জ্যোৎøার ভেতর সে বেঁচে আছে; এখন জানালা তার তুলট তন্দ্রার ভেতর উঠে আসে, বিছানায় নিদ্রা যায়, চুলের ছায়ায় জানালার আঙুল, স্বপ্নের ভেতর প্রহরী জানালা, ক্ষুধার ভেতর, নিঃস্বতার একায় জানালার অপঠিত গ্রন্থ – এটুকুই বড়ো তীব্র অনুভব। আমঝুপিতে শেলের আঘাতে মৃত্যু উড়েছিল ননী গোপাল আর মাদারবক্সের ছায়ায়। ওদের ছিন্নভিন্ন মৃত্যু কাঁধে করে পুনরায় ফিরে আসতে হয়েছিল মেহেরপুরে। ততদিনে শহরের অধিকাংশ মানুষ বেরিয়ে পড়েছে গ্রামের দিকে, গ্রাম ছেড়ে রাতের ছায়ার দিকে, ছায়ার আঁধার ছেড়ে নদীর কাছে, জ্যোৎøার ভেতর, বৃক্ষের সহিষ্ণুতার ভেতর, ভবিষ্যতের অন্তহীন নিকটবর্তী অপেক্ষায়। যেদিকে দৃষ্টি প্রক্ষেপিত হয়েছিল, তখন, কেবল জনশূন্য বাড়িঘর, তখন শূন্যতা প্রতিধ্বনিত – আমাদের অতিক্রান্ত আকাশ, পৌরাণিক নক্ষত্রমণ্ডলী, প্রাচীন দিনরাত্রিকৃত অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, ইতিহাসের অন্তর্বেদ, প্রাচীন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম, প্রযুক্তি, পাখি, বৃষ্টি, নদী, পাহাড় এবং ফুলের মোহিনী সমস্তই ধুমধূলিকুণ্ডলিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ছাই। অগ্নিরক্তময় ছাইয়ের ভেতর কেবল একটানা কুকুরের আর্তনাদ, ঝিঁঝির ঝিল্লিরব ছাড়া সীমাহীন নিস্তব্ধতা, সীমাহীন আঁধার; তখন, যেমন প্রজাপতির পাখার শব্দেও ওইসব আঁধার নিস্তব্ধতা চমকেছিল।
চেতনার নির্বাক আঁধার চমকিত করে পোড়া গন্ধের বিবমিষা; কী পুড়ছে, চুলার ভেতর, নাকি পৃথিবীর চুলার ভেতর সংসার? নাকি চুলার অগ্নিবিক্ষোভে পৃথিবীর সংসার যাবতীয়? নাকি মনের বিভ্রম! মাথার আঁধারের ভেতর বিভ্রম, করোটির ভেতর বিভ্রম! এখন, তবে এরূপ যে, করোটির কোমল অস্থির ভেতর মনের অন্ধিসন্ধি কালিঝুলিময় স্মৃতিবিভ্রমে জানালার রৌদ্রের সহিষ্ণুতায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন থেকে ভেসে আসে মুকুলিত ঋতুঘ্রাণ, আমপাতার ছায়া, ছায়াচন্দ্রালোকে পাতার মৃত্যুবিষাদ। সারি সারি আম্রকুঞ্জের ভেতর রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি, আর বৃক্ষের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা – যেখানেই দাঁড়াও, প্রাচীন আমগাছগুলো কুচকাওয়াজে স্থির সৈনিকের শৃঙ্খলা নিয়ে নিরুপম। আশফাক সেই নিরুপম ইতিহাসের পোড়া গন্ধের ভেতর প্রবেশ করে, আমরা ওই ইতিহাসের ছায়ার হিমেলে, ইতিহাসের সবুজে, ইতিহাসের লালে, ইতিহাসের ডালপালায়, ইতিহাসের নিষ্করুণ জানালায়, পাতার ফাঁকে ফাঁকে ক্যাথলিক মিশনবাড়ির সাদা দেয়াল দেখি; নাকি দেখি পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্য ও উপলব্ধির প্রজ্ঞার ভেতর দিয়ে সাদা দেয়ালের মর্মার্থ, নাকি নিষ্কলুষ আকাশের নিঃসীম পারাবার!
বিভ্রম আর তন্দ্রার ভেতর, পৃথিবীর বিবিধ শব্দের ইতিহাস সামগ্রিক দূরকে নিকটস্তে সমাহিত জানালায় সিস্টার ক্যাথরিন গনজালভেসের মুখ ভেসে উঠলে আশফাকের ধমনির ভেতর হিঙ্গুল রক্তোচ্ছ্বাস। কাচের স্ফটিক মার্বেল বসানো চোখ সিস্টার প্রতিদিন ডেটলজলে ঘষেমেজে ধুয়ে রাখে, এরূপ উজ্জ্বলতা প্রকৃতিস্থ। রাত জেগে সিস্টার পতাকা সেলাই করে টাঙিয়ে দেয় মিশনবাড়ির ছাদে। উড়ন্ত পতাকার সবুজ, এখন, জানালায় দৃশ্যাবৃত; পতাকার লাল, পতাকার সবুজ, পতাকার ছায়ার স্বস্তি সহস্র বিস্তারিত। আমরা সেই ছায়া সন্ধান করি, সবুজের সন্ধানে বৈদ্যনাথতলার আকাশ দেখি, জানালা দেখি, লালের সাধনা করি; আর সিস্টার তেরেজিনা তুলা দিয়ে সেলাই করা ডঊখঈঙগঊ দেখে ক্ষুধার্ত শিশুদের সাদা করোটি রৌদ্রে ভেসে ভেসে জানালায় দৃশ্য হলে মাথার মধ্যে হেঁটে বেড়ায় সহস্র ছুরি। মাথার ভেতর রাশি রাশি পিঁপড়া, সারি সারি মানুষ, সহস্র জানালা; জানালার ভেতর মগজের কোষে কোষে জমাট রক্তের চাঁই, শুকনো রক্তের ধুলো আর প্রাচীন প্রাচীন গ্রাম উজাড় করে ছুটে আসে মানুষ; শত শত মানুষ, সহস্র মানুষ, মানুষ মানুষ মানুষ… মানুষ মানুষ, মাথার ভেতর আকাশ নিয়ে মানুষ, দুর্যোগময়ী আঁধার নিয়ে মানুষ, লাল ছায়ার ভেতর, হিঙ্গুল ইতিহাসের ধূলিঘূর্ণাবর্তের ভেতর মানুষ… মানুষ মানুষ মানুষ, নিদ্রাশিকারি মানুষ, নিঃসঙ্কোচ মানুষ, ভবিষ্যৎ মানুষ, স্মরণাতীত মানুষ, প্রাগৈতিহাসিক মানুষ, অতিক্রান্ত মানুষ, অপেক্ষিত মানুষ, গৃহমানুষ, বেদনা মানুষ, প্রসূতি মানুষ, বৃক্ষ মানুষ, শস্য মানুষ, পাখি মানুষ, মৎস্য মানুষ, জানালায় মানুষ, বিদ্যার্থী মানুষ, ছায়া মানুষ, আঁধার মানুষ, নক্ষত্র মানুষ, কৃষি মানুষ, ভেষজ মানুষ, মাটি মানুষ, জল মানুষ, নদী মানুষ,… মানুষের ভেতর মানুষ মানুষ… মানুষ মানুষ মানুষ। এত সহস্র মানুষের ভেতর মানুষ, যারা হয় সাদা মানুষ, যারা প্রীতিপূর্বকে আমাদের কুশল মঙ্গল বাঞ্ছা করেছিল, তারা মার্ক টালি এবং পিটার হেস, ক্যামেরার ভেতর আহ্বান করেছিল দুঃখী মানুষ বেদনা মানুষ ভাঙা মানুষ ক্ষুধা মানুষ সাদা পাঞ্জাবির ভেতর উস্কোখুস্কো চুল এলিয়ে দিবসের নক্ষত্রে উজ্জ্বল মানুষের আত্মা। তখন, এখন যেমন দেয়ালের সঙ্গে যুদ্ধ, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ, শূন্যের সঙ্গে যুদ্ধ; যুদ্ধের রক্তবিক্ষোভের ভেতর ওইসব উজ্জ্বল মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাদের কণ্ঠে বাষ্পের কণা জমে ওঠে। তখন, আমরা দেখি, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীত প্লাবিত, আমরা দেখি সুরের অগ্নিবেদনার অশ্র“ প্লাবিত করছে আসাদুল হক, শাহাবউদ্দীন; আমরা দেখি পিন্টু বিশ্বাস, মনসুর আলী – সুরগুলো স্তব্ধতার ঐকতানে আম্রকুঞ্জের পাতায় পাতায় পতঙ্গের নীরব ভঙ্গিমায় ফুলের উন্মীলনে অশ্র“নির্ঝর; খঞ্জ কাননের কুঞ্জে কুঞ্জে কান্না প্লাবিত; নিঃসঙ্গ কুকুরের চোখে নদী, অন্ধের হৃদয়ে নদী, ছায়ার গভীরে নদী, আকাশে নদীর নিঃশ্বাস। আমের পাতায় পাতায় এপ্রিলের মঞ্জুরিত রোদ সাদা পাঞ্জাবি এবং মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কাচে নক্ষত্রের ঝিকিমিকি। ‘আমার রাজা গো, বাদশা গো’ বলে পাটের আঁশের ধূসর চুল উড়িয়ে এক বৃদ্ধা হৃদয়ের লবণাক্ত নদী সাঁতরে এলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ মণ্ডপ থেকে নেমে ঘোর স্নেহে আহ্লাদিত। তখন, বাহু এবং বুকের মধ্যে বৃদ্ধা শিশু-সারল্যে পাঞ্জাবিতে অশ্র“র দাগ অঙ্কিত করলে ‘শালার বুড়ি কইল্ল কী দেকদিনি’ – এসব বাক্যের কানাকানি উপেক্ষা করে প্রতিবিম্বিত ছিল গোপন রোদনের জর্জরিত ইন্দ্রিয়সমূহ। গোপন রোদনের কী গভীর বেদনা? গোপন রোদনের কী মর্মার্থ? এই রোদনের অর্থ কেউ কি বুঝেছিল? এখনো কি কেউ বোঝে? রোদনের মর্মার্থের প্রকাশ কোন শব্দব্যঞ্জনার অন্তর্গত? সেসব রোদনদিনের জন্য বুকের ভেতর ত্যাগের সাধনা নিয়ে মৃত্যুর আলিঙ্গনে গিয়েছিল সে, আশফাক, মৃত্যুর সুকৃতি আর কেবল মা মা রোদনদৃশ্যের সঙ্গে জীবনের স্পন্দন নির্বিকার করেছিল। এখন, কৈশোরের সেই পিঙ্গল ছবির ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে বেদনা। এখন জানালায় রোদনের জন্য অনুধ্যান, কথার জন্য বেদনা; তথাপি চিন্তা-প্রক্ষেপে রোদনের বেদনা নেই, রোদনের অশ্র“ নেই। বরং জানালার ভেতর আমগাছের পাতায় অশ্র“বৈদুর্য শূন্যতার নিদারুণ স্ফটিক হয়ে ওঠে, অশ্র“বৈদুর্যে প্রহেলিকাময় রৌদ্রালোক দেখে ছাদের দেয়ালে, জানালার চতুর্ভুজে।
জানালায় পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের শোকার্ত ছায়ার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি দেখে। প্রতিধ্বনির ভেতর বৃক্ষকণ্ঠ, আমাদের মাকড়সার চিরকালীন শুঁড়ের বিস্তার; প্রতিধ্বনির ভেতর মুক্তির নদী, মুক্তির জানালা, আমাদের মুক্তির ছায়া; প্রতিধ্বনির ভেতর হলোকাস্ট অভিজ্ঞতার ইস্পাত প্রতিফলিত করে দিচ্ছে নক্ষত্র আর দিকচক্রবাল, ভবিষ্যৎ আর আতঙ্ক-বিস্ফারিত চক্ষুকোটর ছিঁড়ে বিক্ষত হৃৎপিণ্ড; প্রতিধ্বনির ভেতর ক্ষুধার্ত শিশুদের ছায়া; প্রতিধ্বনির ভেতর ফ্রাঙ্কোর বীভৎস ছায়া, ইয়াহিয়ার নিষ্ঠুর ছায়াদন্ত, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ছায়াপ্রেত, ক্ষুধার্ত শিশুদের বেঁকেচুরে দুঃসহ দগ্ধ মেরুদণ্ড নিংড়ে মুঠোর ভেতর এক ফোঁটা সাহস বের করে নেয় আশফাকের জীবন, আশফাকের বর্তমান। আর আশফাক প্রবেশ করে রফিকের ইতিহাসে, রফিকের জীবনে, রফিকের ছায়ায়, রক্তে, আকাশে, ক্ষুধায়, প্রতীক্ষায়। প্রবেশ করে সহস্র জীবনের মিছিলে, সহস্র মুখের স্রোতে, – রফিকের রক্ত, রফিকের ছায়া, রফিকের প্রতীক্ষায় বুকের ভেতর গুমরে ওঠে পুঞ্জমেঘ। ক্ষুধায় পেট মেরুদণ্ডের ভেতর বেঁকেচুরে ঢুকে যাওয়া রফিক; সৎমায়ের সংসারে, একমুঠো খাবারের জন্য রফিক উঠোনের ভেতর মাইলের পর মাইল হাঁটছে, সকলের খাওয়া শেষে সৎমায়ের ঘর তালাবদ্ধ, নতুন মায়ের সুমতি হলে খেতে দিলে খেল, না দিলে না। নতুন মা তখন দীর্ঘ ঘুমের অনুশীলনে। এখন, আশফাক ঘুমের অনুশীলনে নিদ্রাকুশীলব, তখন জানালায় জ্যোৎøাকৃত ছায়ার সৃজন; জানালা তখন রৌদ্রের ভেতর ছায়ামেঘের নৈসর্গিক আবিষ্কারের সাধনা করে। ঘুমের অনুশীলনের ভেতর দেখে রফিক বিদ্যুতের তারের সন্ধানে হাঁটছে আম্রকাননের ছায়া-ছায়া আঁধারে, ওয়াপদা রোডের আম্রকাননে তখন সন্ধ্যা ককিয়ে ককিয়ে নামছে, সন্ধ্যাবিহঙ্গের ছায়া আঁধার খড়কুটোর ভেতর সাদা কাপড়ে ঢেকে যাওয়া মায়ের অস্পষ্ট মুখ; আমপাতার ফাঁকে ফাঁকে তখনো মৃদু আলোর রেশ ছায়াচন্দ্রালোকের জ্যোৎøা প্লাবিত করে। এমন ছায়া-ছায়া জ্যোৎøালোকে মার পুঁথি পাঠের হিল্লোলিত সুর পুষ্পের মোহিনী – পূর্বেতে গর্জিল দেওয়া, ছুটিল বিষম বাও। কই বা গেল সুন্দর কইন্যা মন পবনের নাও ॥ ডুবিল আসমানের তারা চান্দে না যায় দেখা। সুনালি চান্নির রাইত আবে পড়ল ঢাকা ॥ ভাবিয়া চিন্তিয়া কইন্যা কী কাম করিল। বাপের হাতের ছুরি লইয়া ঠাকুরের কাছে গেল ॥ – মাথার ভেতর জ্যোৎøায় মায়ের পুথিকণ্ঠী মুখ নিয়ে টুকরো টুকরো আলোর অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে রফিক ওয়াপদার বিদ্যুতের তার বিচ্ছিন্ন করতে গিয়েছিল, আশফাক দেখে, জানালার ভেতর সন্ধ্যাবিদ্যুতের রক্তচিহ্নিত তার আম্রকাননের ছায়ায় নিরুদ্দেশ হলে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রফিক। আশফাক দেখে জানালার ভেতর ছায়ার রং বদলে যাচ্ছে, সূর্যের ছায়া বদলে যাচ্ছে, নৈসর্গিক ইতিহাস বদলে যাচ্ছে, অতিক্রান্ত আকাশ, পৌরাণিক পথঘাট, শহরের সন্ধ্যা, প্রত্যুষের ছায়া-ছায়া আলো বদলে যাচ্ছে। মারের চোটে রফিকের চোখমুখ ভাঙা মৌমাছির চাক হয়ে উঠেছিল, হাত-পায়ের প্রত্যেকটা গিঁট ভেঙে দিয়েছিল, অণ্ডকোষে দুটো আস্ত থান ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিল। লাশ পাওয়া যায়নি; মেহেরপুর সরকারি কলেজের পেছনে গণকবর আবিষ্কৃত হলে; তখন লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে মাতৃভূমিতে, বৃক্ষে, ছাদে, আকাশে, ছায়ায়, জ্যোৎøায়, রৌদ্রে, জানালায়; ছেলের সন্ধানে, ছেলের লাশের সন্ধানে, ছেলের ছায়ার সন্ধানে মনসুর মামার অপেক্ষা কলেজের মাঠে আঁধার বিছিয়ে রাখে। আর ঘুমের মধ্যে কেবলই ফুলেফেঁপে কালো রক্ততরঙ্গে হাসি হাসি ক্ষুধার্ত ছেলের মুখচ্ছবি উঠোনের ভেতর মাইলের পর মাইল হেঁটে বেড়ায়।
শহীদ রফিকের স্মরণে কোনো সড়কের নামকরণের স্বপ্ন আমরা মাথায় নিয়ে ঘুরি দীর্ঘদিন। শহরে নতুন নতুন দৃশ্যাবলির ভেতর ইতিহাস বদলে যায়, ইতিহাসের করুণ কুশ্রী বিকলাঙ্গ ছায়া দৌড়ে বেড়ায়; যেন সার্কাসের ক্লাউনের নৃত্য চলছে শহরের আকাশে, শহরের বৃক্ষে, শহরের সড়কবাতির ভেতর। আর সব ঋতুই যেন দৌড় অনুশীলনের, দৌড়ই শরীরচর্চার একমাত্র জ্ঞান। নতুন জ্ঞান, নতুন খেলা, নতুন শরীরচর্চার ইতিহাসে আমরা দর্শকের ঐশ্বর্য – কেননা, এরূপ নতুন খেলা আলোর অস্তিত্ব, আলোর প্রজ্ঞা নিশ্চিহ্ন করেছিল; যেহেতু আঁধার, সড়কের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করলেই আঁধার; ফলে আমাদের দৈনন্দিনে, আমাদের শরীরচর্চার নতুন জ্ঞানে, আমাদের ছায়ায় ছায়ায় রফিকের অস্তিত্ব মাথার ভেতর ঢুকে পড়ে, স্বপ্নের ভেতর ঢুকে পড়ে, ক্ষুধার ভেতর ঢুকে পড়ে, আঁধারের ভেতর, আলোর ভেতর, প্রাচীন অপেক্ষার ভেতর, আকাশের ভেতর, পাখির ভেতর, ফুলের ভেতর, নদীর ভেতর, সময়ের ভেতর, ঘুমের ভেতর ঢুকে পড়ে; ফলে রফিক হয়ে ওঠে আমাদের অস্তিত্ব ও নৈসর্গিকের অভ্যুদয়, আমাদের ইতিহাস-বর্তমান ও ভবিষ্যতে রফিকের অনিঃশেষ অপেক্ষিত যাপন। রফিকের অস্তিত্ব ও উপস্থিতির ভেতর আমরা প্রত্যুষে মধ্যাহ্নে কৃত্রিম আঁধার রচনা করি; আঁধারে শহরের রাস্তায় অনুশীলন দেখি – আমরা চাপাতি দৌড়, আমরা হকিস্টিক দৌড়, আমরা হাতুড়ি দৌড়। সন্ধ্যায় চাপাতি দৌড়ে পৌরসভার মেয়রকে কুপিয়ে শান্ত শহরে ভীতিকর আঁধারের অলৌকিক নীরবতা, অথবা চাপাতির কোপে কেউ কারো হাত কেটে নিয়ে গেলে সারারাত শহরে বিদ্যুৎহীন সর্পিল নক্ষত্রের রক্তোচ্ছ্বাস। আম্রকাননের ছায়া-ছায়া হিম আঁধারে সেলাই করা চটের বস্তার ভেতর কেউ ফুলে মৃত ভেঁটকি মাছ হয়ে ছায়ার ভেতর বৃক্ষের ভেতর ফুলের পরাগে গন্ধের বিবমিষা ছড়ায়। এরূপ মৃতের ক্রন্দন ক্রমাগত আম্রকাননকুঞ্জে জমতে থাকলে আমরা পুনরায় অন্তহীন যুদ্ধের ভেতর আটকে পড়ি। যদিও, বলা হলো, যুদ্ধ এবং আটকেপড়ার ক্লান্তিবিষাদিত শব্দবন্ধ; যখন যুদ্ধের ইতিহাস, যা অনির্বচনীয় এক রক্তপ্রলম্বন, যা মৃত্যুবিষাদের দীর্ঘশ্বাস, – শব্দবন্ধের কী স্পর্ধা যে এই মৃত্যুবিষাদের দীর্ঘশ্বাস আমাদের জ্ঞানের অন্তর্গত করে? তবু আমরা, দৈনন্দিন অজস্র যুদ্ধের দুস্তর বীভৎস এবং আঁধার বর্তমানের পরিত্রাণহীনের ভেতর আম্রকাননকুঞ্জে শহিদ রফিকের রক্তচিহ্নিত স্থান নির্ণয়ে সমর্থ হলেও, স্মৃতি কেবল রক্তপরাগের শীত হয়ে ওঠে। রক্তপরাগের শীত নিয়ে আশফাক চায়ের অপেক্ষায় টোস্ট মুড়িয়ে দেওয়া অথবা কখনো চুলা জ্বালবার কাজে ব্যবহৃত কাগজ দেখে, দেখে শহরের লোকেরা বিষাদক্লিষ্ট ঘুরছে উদ্দেশ্যহীন, অথবা ঘুরছে পরচর্চার আনন্দে উদ্দেশ্যলুপ্ত, অথবা প্লাবিত আঁধারে সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে ফেলে যাওয়া ঝাঁঝরা ট্রাকে সরকারি গুদামের চালের বস্তা ফুটো করে চুরির অপরাধে একজনকে আমরা পেটাচ্ছি, খেলছি, ফেলছি। মধ্যবয়সী লোকটি মুখ আড়াল করে রাস্তার ধুলোর øেহে রক্তের বুদ্বুদ মিশিয়ে দিলে তার ক্ষুধা পায়; রক্তের নেশা আমাদের ফেনসিডিলের বোতলবন্দি হলে দেখি ক্ষুরধার সুদীর্ঘ ব্যঞ্জনার ভেতর ধুলোর ভেতর ছায়ার ভেতর আঁধারের ভেতর ভবিষ্যতের ভেতর অপেক্ষার বেদনায় রক্তধুলোয় স্তব্ধ রফিকের ছোটভাই রহমত। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের আবেগ এই মানবলোককে মহিমান্বিত করে চলেছে, এরূপ কল্যাণ ও দেশমাতৃকাপ্রেমের কুশল বাঞ্ছিত আমরা চোরকে পুলিশে সোপর্দ না করে মুক্তি দিই। আশফাক দেখে, এই বিনীত মুক্তি এখন সমস্ত আঁধার প্লাবিত করে; এমনও যে, পৌরাণিক আকাশের অপেক্ষিত নক্ষত্রমণ্ডলীকে এই মুক্তি এই রক্তধূলিচিহ্নিত অপমানিত ও লাঞ্ছিত স্বাধীনতার স্বাদ আনে। ফলে এ তার মোক্ষ নয়, আকাশ নয়, খেলা নয়, বৃক্ষ নয়, নদী নয়; এ তার ধুলার বিভূতি। লোকটি ধুলার হিমে বসে থাকে – একাকী, নির্মম, গ্লানিহীন, আত্মগ্রাসিত, নির্বোধ আশ্চর্যে।
আত্মগ্রাসিত নির্বোধ আশ্চর্যের ভেতর চায়ের অপেক্ষায় আশফাক প্রৌঢ় হয়ে যায়; এখন, এরূপ বৃদ্ধ হাড়ের অন্তর্গত সুপ্ত প্রাণ, সকলে নিশ্চুপ, ইদানীং ভয়ানক ক্লান্তি, ওপরে কুণ্ডলিত আঁধার, এখন আঁধারের দিন। নিজের প্রতি করুণা হয়, ধিক্কার হয়; রফিক বাঁচেনি, সে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকা এত কুশ্রী, এত জঘন্য, বেঁচে থাকা এত নির্মম, এত গ্লানিময় – এরূপ মরিয়া ত্রস্ত বিকার বাতাসের ছায়ামর্মরে সংঘর্ষিত। এরূপ বিকারের মধ্যস্থ নিশ্চুপে ধম্মদা চা এগিয়ে দেয়, পুনরায় চুলোর ভেতর আগুন উস্কে দিতে দিতে আশফাক কেতলির বাষ্প দেখে, বাষ্পের ভেতর কতিপয় ক্ষুধার্ত শিশু দেখে, দেখে এক গ্রীষ্মরাতের আঁধার প্রত্যুষে আগুনে ঝলসে যাওয়া বড়োবাজারের টিন উড়ছে বাষ্পের ভেতর, কাঁচাবাজার আর মুদিদোকানের বিবিধ দ্রব্যের পোড়া ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, বাষ্পে। চুলোর আগুন আর কেতলির বাষ্পে এসব মৃত্যুব্যাধি উড়ে এলে মৃত শাকসবজি, মৃত তেল-লবণ, মৃত সাবান-সোডা, মৃত বিবিধ প্লাস্টিকের আঁধার ছাইয়ের ভেতর নতুন মার্কেটের আর্কিটেকচার আমাদের নতুন স্বপ্ন, নতুন ইতিহাস, শহরের নতুন আধুনিক হয়ে-ওঠা আর নতুন জানালা নির্মাণের অহঙ্কার প্লাবিত করে। এই অহঙ্কারের ভেতর মাথার মধ্যে ভবিষ্যৎ মাথার মধ্যে ক্ষুধায় বিমূঢ় হাত-পা মাথার মধ্যে মৃত ভাইয়ের ছায়া-ছায়া আঁধার নিয়ে রফিকের ছোটভাই, যে হয় এখন মধ্যবয়সী রহমত, আগুনে ঝলসানো মৃত শাকসবজির ভেতর বেকারত্বের নতুন ইতিহাস রচনা করে চলেছে। আমরা দেখি, শহরে তখন নতুন মার্কেটে টেন্ডারবাহিনীর দোকানঘর দখলের কুচকাওয়াজ। পৌরসভা অথবা মেয়রের বাড়ির সামনের লনে মোটরবাইকের মিছিল। এসব মিছিলে কতিপয় মানুষ প্রতিদিন প্রত্যুষে সবজির দোকানদার, তারা দেখে এসব আলোছায়ার মিছিলে তাদের নামে দোকানঘর বরাদ্দ নেই। আমাদের বন্ধু অথবা ভাই, শহরের মফস্বল সাংবাদিক, তখন এসব মুমূর্ষু সংবাদ ই-মেইল করে। আমরা বৈকালিক গোধূলিতে এসে উপস্থিত বাসি খবরের কাগজ দেখি। আমরা বিবিধ ই-মেইল দেখি, হঠাৎ ভেসে আসা পর্নো ছবি দেখি, ফেনসিডিল দেখি, আম্রকাননের গোপন ছায়া দেখি, কালো পোশাক, কালো চশমা, টহলরত কালো গাড়ি দেখি, রাস্তার ধূলি দেখি; কিন্তু দোকান হারানো নিঃস্ব কিছু মানুষ দেখি না, নিঃস্ব মানুষের কান্না দেখি না। খবরের কাগজ জুড়ে কালো বর্ণমালার অনন্ত আঁধার দেখি, কালো অক্ষরমালার ভেতর চাপাতির কোপে আহত মেয়রকে অনুভব হয়, কেউ তার সুখ্যাতি করে। অথবা আমরা কেবলই অন্যমনস্কতার সাধনা করি। কেউ চাপাতি-দৌড়ে বিজয়ী অ্যাথলেটদের সঙ্গে পৌরসভার লনে বসে মেয়রের সান্ধ্য-আড্ডার গল্প পরিবেশন করে। এসব গল্পছবির ছায়ায় আমরা টালির চালে নিশিপতঙ্গের সংগীত শুনি আর শূন্যতার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে আপনমনে শব্দব্যঞ্জনাময় একটি গল্পছবি সৃষ্টি করি… একজন কুত্তার লেজ লোহার পাইপের ভেতর ঢুকানোর চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হলে এক বন্ধু বলে, তুমি জানো না, কুত্তার লেজ একশ মণ ঘি দিয়ে টানলেও সোজা হবে না। তখন লোকটি বলে, সে কুত্তার লেজ দিয়ে পাইপটা বাঁকানোর চেষ্টা করছে… হে হে হে… বুঝলেন… কুত্তার লেজ…
এসব গল্পছবি নীরবে শুনতে শুনতে আশফাক, তখন, ধম্মদা চায়ের দোকানের বাঁকা লোহার টানেলের আঁধারে; জানালা নেই, আলো নেই, বাতাস নেই, ছায়া নেই, আনন্দ নেই, আকাশ নেই, পাখি নেই, কণ্ঠস্বর নেই, স্বপ্ন নেই, খাদ্য নেই, কোমলতা নেই – কেবল রুক্ষ, আদিম জন্তুর ভয়ংকর অগ্নিচক্ষু জ্বলছে আর বাষ্পের অগ্নিব্যঞ্জনা। সে দেখে, তার সহচাখোররা, ধম্মদা এবং সে নিজেও, তাদের হলোকাস্ট হাড়ে আঁধার চামড়া জড়িয়ে যাচ্ছে; কাপড় নেই, খাবার নেই। সমস্ত চিন্তা, কাজের অনুপ্রেরণা, ইন্দ্রিয়ের যাবতীয় আবেগ, উপলব্ধি, চক্ষুলজ্জাহীন যৌন ইচ্ছা – সবই অন্ধ নির্লজ্জ হলোকাস্ট ক্ষুধার কাছে নতজানু। সব বাক্যই এখানে অর্থহীন। আশফাক এরূপ অর্থহীন সাম্প্রতিক থেকে পরিত্রাণের জন্য ধম্মদার ত্রাসিত টানেল থেকে বের হতে চাইল, কিন্তু এমন চাপা ক্রন্দন এবং ভয়ার্ত জ্ঞান হয়, টানেলের কোথাও প্রবেশ নেই, বাহির নেই; চোখের ভেতর রক্তোচ্ছ্বাস, মাথার ভেতর রক্তবাষ্পবিন্দু। চারদিক ফাঁকা, ছায়া-ছায়া আলো অগ্নিশিখার তির্যকে আমাদের মফস্বল সংবাদকর্মী আসে; এই আঁধার টানেলের কোনো প্রবেশ নেই, বাহির নেই, তবু ছায়া আসে, ধূলির ঘূর্ণাবর্তে সরকারের গোপন নথিপত্র উড়ে আসে; সংবাদকর্মী গল্পের ছলে কথা বলে – প্রতিদিন যেভাবে খুন অপহরণ বাড়ছে, সাবধানে থাকবেন, শুনেছেন তো ঝিনাইদহে মোফাখ্খর হোসেন চৌধুরীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে!
শহরজুড়ে ল্যাম্পপোস্টগুলো আচমকা অন্ধ হয়ে গেল; এখন ছায়া নেই, ছায়ার প্রতীক্ষা নেই, ছায়ার কম্পন নেই, ছায়ার জানালা নেই, ছায়ার বেদনা নেই। এখন আমাদের আলোর জন্য প্রতীক্ষা, ছায়ার জন্য অধীরতা। এখন আমাদের জানালার জন্য আকাক্সক্ষা। আলোর অস্তিত্ব জ্ঞানে। এখন আমাদের জ্ঞানের জন্য উন্মুখতা। ল্যাম্পপোস্টগুলো অন্ধ হয়ে যাওয়া মানে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন; কী যে হয় – বিদ্যুতের তার বিচ্ছিন্ন? নাকি তারের ভেতর বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন! – এই জ্ঞান অধীত হলে আশফাক আম্রকাননের ছায়া-ছায়া আঁধার চন্দ্রালোকের ভেতর অস্ফুটে ডাকে – রফিক… রফিক… – এই আহ্বান বিস্ফারিত অপেক্ষার বেদনা প্রতিবিম্বিত করলে ঘুঘরো পোকা ওড়ে, আম্রকাননের ছায়া-ছায়া আঁধারে ফেনসিডিল ওড়ে, আমাদের কৈশোরোত্তীর্ণ সন্তানদের স্বপ্ন ওড়ে, স্বপ্নের ছায়া, স্বপ্নের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের আকাশ-বৃক্ষ-নদী-পাখির ছায়ার ধূলিঘূর্ণাবর্তে ক্ষুদ্র ক্ষুুদ্র মৃত্যু ওড়ে। এরূপ মৃত্যুর ছায়ায়, দেশমাতৃকার আবেগের লাঞ্ছনা আর অপমানে মৃত ভাইয়ের অস্পষ্ট স্মৃতির রক্তগোধূলির ভেতর বিদ্যুতের ছিন্ন তারের মালা গলায় পরে রহমত ভূত দেখে জ্যোৎস্নায়, অথবা নিজেই সে ভূত হয়ে মৃত্যুর ছায়া ওড়ায় আম্রকুঞ্জের নিকুঞ্জে।
এসব মৃত্যু, মৃত্যুর ছায়ায়, মৃত্যুর জানালায়, মৃত্যুর নৈসর্গিকে আমাদের মৃত্যু, আমাদের সন্তানদের মৃত্যু, আমাদের ছায়ার মৃত্যু, বেদনার মৃত্যু, আনন্দের মৃত্যু, জানালার মৃত্যু, প্রজ্ঞার মৃত্যু মগজে অশ্র“র নীরব উদগ্রীব প্লাবিত করে – কী করেছিল রহমত? কী করেছিল মোফাখ্খর? কী করেছিল… কী করেছিল… একটা বিষণœ ছায়া কেঁপে ওঠে আর আচমকা বাতাসের ঝঞ্ঝাঘূর্ণি, ধূলিতরঙ্গে সম্প্রতি মৃত তারিখের সরকারি নথিপত্র উড়ে আসে, ধূলির ঘূর্ণাবর্তে একটা প্রৌঢ় বিড়াল রাস্তা পারাপারের সময় অন্ধ হয়ে গেল অথবা আশফাক দেখে – মৃদু জ্যোৎস্নায় পলাতক ক্ষুধার্ত একজন আম্রকাননের আঁধার থেকে বেরিয়ে আসছে। মৃত ভাইয়ের অস্পষ্ট স্মৃতির ভেতর তাকে প্রতিবিম্বিত দেখে। দেখে স্মৃতির অস্তিত্বগ্রাসিত গ্লানির ভেতর মাথা গুঁজে রহমতের ঝিম; যেহেতু সরকারি খাদ্যগুদাম, ফলে থানার দুজন ডিউটি কনস্টেবল পোড়া রুটির চিমসে গন্ধে ভরা দুপুরের জানালায় উপস্থিত হলে, তখন, রহমত নিরুদ্দেশ। কনস্টেবল দুজন রহমত অথবা রহমতের ছায়ার সন্ধান না পেয়ে ফিরে গেলে আমরা দেখি, রহমত গ্লানি এবং লজ্জার রোদ থেকে বেরিয়ে জানালার বিষণœতা ছুঁয়ে আম্রনিকুঞ্জে ছায়াজ্যোৎস্নার আঁধারে অন্তর্লীন।
ছায়াজ্যোৎস্নার আঁধারে শহরের জানালায় ল্যাম্পপোস্টগুলো অন্ধ হয়ে গেলে ধূলির ঘূর্ণাবর্ত। ভয়ার্ত নিশিপতঙ্গ আর মানুষ ছোটে দিগি¦দিক, অপ্রসন্ন বিদ্যুৎ, হাওয়ার বর্ণালি চিৎকার। ধম্মদা ঝাঁপ ফেলে দেয়, জানালা বন্ধ করে; অতঃপর মড়কে উজাড় শহরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাস্তা লাখ লাখ ঝিঁঝিপতঙ্গের একটানা ঝিঁঝিট ঝিঁঝিঝিট। চুলোর কয়লা তেমনি গনগনে প্রাণ পায়, কেতলির নলে ফুটন্ত বাষ্পের দুর্দম, ঘোলা কাচের ভেতর হারিকেন জ্বলে উঠলে চা-খোরদের ছায়াগুলো এক একটা কালো প্রেতের নৃত্য। কালো প্রেতের ছায়া খোলা বইয়ের ভেতর, জানালায় প্রেতের ছায়ার ভেতর একজন বুকে রক্তের প্রসৃতি নিয়ে দেয়ালের মাটির সবুজের সংঘর্ষে মুখ থুবড়ে পড়লে আমরা জানি জলের বাষ্প, আমরা জানি নক্ষত্রের ছায়ার সুদীর্ঘ স্বাধীনতা; কেননা, মৃত্যুর পর আমরা নক্ষত্রে প্রস্ফুটিত; তবু আমরা জানি, এ-জীবন অজস্র ক্রন্দনের ছায়াসম্পাত। উদ্ধত বাষ্প এবং বাইরে ঝঞ্ঝাবিদ্যুতের স্খলিত চিৎকার আমাদের আহ্বান করে, আশফাক ঝাঁপ ঠেলে আচমকা এই আহ্বানে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে, তখন, চণ্ড মেঘের ছায়া ফুঁসে উঠছে, পথের ধুলো আশফাকের চুলে চোখে দাঁতে নাকে, পথের ধুলো আকাশে, মেঘে; মেঘের বিদ্যুতে ধুলোর ছায়াকূপ, কূপের ছায়ার ভেতর অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়হাড্ডি। বজ্রবিদ্যুতের শত-সহস্র ছুরির ঝিলিকে সে দেখে টেবিলে বইখাতা খুলে বসে আছে মোফাখ্খর, হারিকেনের ঘোলা কাচের ভেতর মোফাখ্খর পড়ছে, লিখছে। জানালার ভেতর মোফাখ্খর পড়ছে, লিখছে। বিষণœ জানালা, দুপুরের উজ্জ্বল জানালা এখন প্রাচীন তুলট কাগজের ভঙ্গুর ধূসরতা। পুনরায়, আশফাক দেখে, কালো প্রেতের র‌্যাপিড ছায়াকর্ম, ক্ষিপ্র আঁধারের ব্যাটালিয়ন বেয়নেট উঁচিয়ে উন্মুক্ত বইখাতা গেঁথে দেয়, জানালা বন্ধ করে দেয়; ছায়াক্রিয়ার লকলকে বেয়নেট কড়াৎ শব্দে রক্তবিস্ফারিত; বিগলিত রক্তমোফাখ্খর ছায়াকূপ থেকে উঠে এলে আশফাক সহস্র ছায়াকূপের গোলকধাঁধায়; কূপ থেকে উঠে আসে সহস্র রক্তকঙ্কাল, রক্তজানালা, রক্তজানালায় প্রাচীন জ্ঞান রক্তাক্ত, প্রাচীন আলো রক্তাক্ত, প্রাচীন আকাশ রক্তাক্ত, পাখি রক্তাক্ত, ছায়া রক্তাক্ত; কূপ থেকে উঠে আসে সহস্র জানালা, কূপ থেকে উঠে আসে সহস্র অতিক্রান্ত আকাশ, কূপ থেকে উঠে আসে আমাদের প্রাচীন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শিল্প, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পাখি, নদী, ফুলের মোহিনী; কূপ থেকে উঠে আসে পৌরাণিক দিনরাত্রিকৃত নক্ষত্রমণ্ডলী, ইতিহাসের অন্তর্বেদ, ইতিহাসের সত্য, ইতিহাসের মৃত্যু, ইতিহাসের মিথ্যা; কূপ থেকে উঠে আসে সহস্র বজ্রবিদ্যুতের তীক্ষè ছুরি, বজ্রবিদ্যুতের ছিন্ন তার, তারের ভেতর রক্তরফিক, তারের ভেতর রক্তরহমত; কী যে হয় – আশফাক দেখে; সে বড়োই একা, চিরদিন একাকী; মাথার ওপর ভয়ংকর আকাশ, সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর আঁধার হয়ে নেমে আসা বজ্রবৃষ্টিবায়ুর তীক্ষè ছুরি; তার এক সময় মনে হলো – তার পেছন পেছন পিঠের ওপর ঘাড়ের নিকটস্তে পায়ের ছায়ার ভেতর কণ্ঠের ভবিষ্যতের ভেতর কালো প্রেতের র‌্যাপিড আঁধারক্রিয়ার ব্যাটালিয়ন নিঃশ্বাস ফেলছে; আশফাক বজ্রবৃষ্টিবায়ুর ছুরির ভেতর দ্রুত হাঁটে, কিন্তু শতসহস্র ছায়াকূপের গোলকধাঁধায় সে দিকভ্রান্ত, তার চারপাশে ক্ষীপ্র আঁধারের প্রেতার্ত রক্তবেয়নেট; চিৎকার করে সে ডাকে কাজলকে, রফিককে, মোফাখ্খরকে, রহমতকে; কিন্তু কণ্ঠ চিরে শব্দের লেশমাত্র নিশ্বাস বের হয় না, কণ্ঠ এবং ডান হাত-পায়ের রগ ছিঁড়ে সে পথের আঁধারের ভেতর, পথের ছায়ার ভেতর, পথের ইতিহাসের ভেতর, পথের প্রতীক্ষার ভেতর, পথের জানালার ভেতর, পথের সূর্যের ভেতর পড়ে থাকে নিঃসাড়, নিস্তব্ধ, বিস্ফারিত।