জিরোভাই

আবুল মনসুর
ধানমণ্ডি ২৮ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি পান্থপথের মুখের দিকে। ওখানে সার-সার এসি বাসের টিকিট-বিক্রিঘর। পরীক্ষার কাজে চাটগাঁ যেতে হবে, বাসের টিকিট কিনব। শীতের সকাল, ধুলোময়লায় ঝাপসা হলেও মৃদু রোদটা মিষ্টিই বলা চলে। বেলাটা সকাল সাড়ে নটা, তাতে কী, ঢাকা শহরে সকালই বা কী, বিকেল অথবা রাত বারোটাই বা কী। গাড়ির জ্যাম, ফুটপাতে মানুষের জ্যাম ঠেলে ধাক্কাধুক্কা খেতে খেতে আর জান হাতে রাস্তা পেরিয়ে চলছি। চাটগাঁ যাওয়ার সুবিধামতো টিকিট কিনে ২৮ নম্বরের মুখের বিহারি সেলুনে চুল কাটিয়ে বাড়ি ফিরব। টিকিট কিনে আবারো জান-হাতে রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকের ফুটপাত ধরে
হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল – সার-সার পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের পসরা নিয়ে বসা হকারদের। নিত্যদিনের পত্রিকার বাইরে অন্য কটা পত্রিকা কিনব বলে দাঁড়ালাম। একটা জার্নালও নিলাম – ইন্ডিয়া টুডে। খদ্দেরের ভিড় আছে মোটামুটি। আমি বড় নোট দিয়ে ভাংতির জন্য দাঁড়িয়ে আছি, অন্য খদ্দেরদের আর রাস্তার কোলাহলে হকার আমার ক্ষীণকণ্ঠ শুনতেই পাচ্ছে না। হঠাৎ আমার ঠিক পাশ থেকে একটি ভরাট গলা হকারকে ধমক দিয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই, ওনার টাকাটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দে না। ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ, ওনাদের সময়ের দাম বুঝিস?’ পরিচিত কারো মশকরা ভেবে মুখ তুলে পাশের মানুষটির দিকে তাকাই। না, পরিচিত কেউ তো নয়! আমার চেয়ে একহাত লম্বা দশাসই চেহারার এক ভদ্রলোক, মাঝবয়েসি হবেন, মুখে পুরো কাঁচাপাকা গোঁফ। পরনে জিন্সের ট্রাউজার আর সাদা টি-শার্ট, পায়ে স্পোর্টস-শু। দেখে মনে হয় অবসরে যাওয়া কোনো সামরিক কর্মকর্তা, মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছেন। একটু কৌতূহল ও কৌতুকের মিশেলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে বুঝলেন আমি ইন্টেলেকচুয়াল?’ ভদ্রলোক আমার কথাকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘আরে ওসব দেখলেই বোঝা যায়।’ এবার বিস্মিত হয়েই শুধোই, ‘তা আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?’ ‘আমার কোনো পরিচয় নেই।’ ‘আপনি কি এ-এলাকায় থাকেন?’ ভদ্রলোক পালটা প্রশ্ন করেন। ‘জি।’ ‘কী করেন?’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তথ্যটি জানালাম।
এর প্রতিক্রিয়া হলো নাটকীয়। বিশাল মানুষটি ফুটপাতে বহু মানুষের চোখের সামনে আমার পায়ে হুমড়ি খেয়ে কদমবুচি করতে লাগল আর বারবার বলতে লাগল, ‘আরে বাপ রে, বিরাট মানুষ আপনি। আপনাকে তো আমার দরকার।’ আমি হতভম্ব ভাব কাটিয়ে দুপা পেছনে ছিটকে যাই, ‘আরে, করেন কী, করেন কী!’ আমাদের চারপাশে ছোটখাটো ভিড় জমে উঠল, সবাই একটা কিছু মজা দেখার প্রত্যাশায় উন্মুখ। ভদ্রলোক বলতে থাকেন, ‘স্যার, আপনার সঙ্গে তো আমার বসতে হবে। অনেক আলোচনা করার আছে। দেখেছেন দেশের অবস্থা, জিনিসপত্রের দাম, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুতের অবস্থা।’ বলি, ‘দ্যাখেন ভাই, এসব জিনিস আমার বিষয় নয়, এসবের সমাধান দেওয়া আমার কম্ম নয়’। ‘আরে বাপ রে, এসব সমাধান আপনারা না করবেন তো স্যার কি সখিনার বাপরা করবে?’ – উত্তর এলো। সখিনার বাপ সম্পর্কে আমার বিশেষ ধারণা না থাকলেও এটুকু বুঝতে পারি যে, তাঁর পক্ষেও এসবের সমাধান সম্ভব নয়। ‘স্যার, আজকে আমরা তাহলে বিদ্যুৎ নিয়ে বসি। এটাই এখন সবচেয়ে প্রকট সমস্যা। আপনার বাসার ঠিকানাটা একটু বলবেন স্যার?’ আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, এর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় কী উপায়ে। ‘দ্যাখেন ভাই, আমি তো যাচ্ছি চুল কাটাতে, বাসায় ফেরার আগে একটু বাজার করব, ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হবে।’  বাস্তবের সঙ্গে গুলতানি মিশিয়ে পরিত্রাণের চেষ্টা চালাই। ‘তাহলে আপনার একটা কার্ড দ্যান, আমি পরে ফোন করে আসব।’ ফতুয়ার বুক-পকেটে রাখা কার্ড নিশ্চয় ব্যাটার নজরে পড়ে গেছে, মিথ্যা বলার সাহস হলো না। কার্ড দিয়ে ভদ্রতার খাতিরে আমিও একটা কার্ড চাইলাম। ‘আমি কার্ড-ফার্ড রাখি না। তবে এই এলাকায় আমাকে সবাই চেনে, জিরোভাই নামেই আমি পরিচিত।’ ‘কী ভাই?’ ‘জিরোভাই।’ ‘এই ব্যাটা, এক টুকরা কাগজ দে তো।’ পরের অংশ হকার ছোকরাটার উদ্দেশে।
পকেট থেকে কলম বের করে ছোকরার দেওয়া কাগজের ওপর কষ্ট করে ঘষটে-মসটে একটা বড় গোল্লা এঁকে পাশে লিখলেন – ভাই, নিচে মোবাইল নম্বর। ‘স্যার, আমার নম্বরটাও দিলাম। আপনি ফ্রি হওয়া মাত্র আমাকে ফোন দেবেন, আমি চলে আসব। আলোচনাটা খুব দরকারি।’ ‘জি, আচ্ছা।’ ‘কী কাগজ কিনলেন স্যার? ও, আচ্ছা। এসব কাগজ পড়ে কোনো লাভ হবে না স্যার, আমি আপনাকে একটা কাগজ কিনে দিতে চাই।’ নিষ্কৃতির আশায় ‘কী দরকার ছিল’ জাতীয় মৃদু প্রতিবাদ করে রাজি হয়ে যাই। ‘অ্যাই ব্যাটা, একটা ইনকিলাব দে।’ সর্বনাশ, আল-কায়দা-টায়দার পাল্লায় পড়লাম না তো? ‘ইনকিলাব? আমি ও-পত্রিকা পড়ি না।’ ‘শোনেন স্যার, আমি হলাম আল-কায়দার যম। এজন্য আমি আওয়ামী লীগের আমলে জেলে ছিলাম, বিএনপির আমলে জেলে ছিলাম, এরশাদের আমলে জেলে ছিলাম, তত্ত্বাবধায়কের আমলে জেলে ছিলাম, এখনো জেলের হুমকি মাথায় নিয়ে চলছি। ওরা কী বলছে, কী ভাবছে জানাটা দরকার, তা না হলে ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন কেমন করে?’ হঠাৎই ‘চলি স্যার, ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে গেছে’ বলে হাঁটা দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ‘দেখা হচ্ছে, আলোচনাটা ভীষণ জরুরি, আজকেই বসছি স্যার।’ ‘জি, জি, অবশ্যই’ – হাঁপ ছাড়তে ছাড়তে বলি।
পরিত্রাণ পেয়ে আশপাশের জমায়েত লোকেদের দিকে তাকাই। কে এ-লোক? সন্ত্রাসী-টন্ত্রাসী নয় তো? কেউ সরাসরি উত্তর দেয় না, এ ওর চোখের দিকে তাকায়, একটু মুচকি হাসে। ‘অ্যাই ছোড়া, কে রে এই লোক? তোকে যে বলল পাঁচশো টাকা দিয়ে রেখেছিল আট টাকার কাগজের জন্য, বাকি চারশো বিরানব্বই টাকা ফেরত চাইল, এটা সত্য? নাকি চাঁদাবাজ? এভাবে টাকা-পয়সা আদায় করে? কোথায় থাকে?’ একটু ধমকের সুরে বলি। ‘জিরোভাই, শুক্রাবাদের ওই গলিতে থাকে। না না, টাকা দিছিল ঠিকই।’ – শেষমেশ হকার ছোড়াটা উত্তর দেয়। ‘জিরোভাই, এটা কোনো নাম হলো? লোকটার আসল কোনো নাম নেই?’ অন্যদের দিকে সপ্রশ্ন তাকাই। ‘জানি না তো। পুরা শুক্রাবাদে ওনারে সবাই জিরোভাই বইল্যা চেনে। অন্য নাম জানি না।’ মাঝবয়েসি একজন জানান দেয়। হকার ছোড়াটা মিটিমিটি হাসে। ‘কী রে, হাসিস কেন? কথা লুকাচ্ছিস?’ ‘একটু টাল আছিল আর কী, বুঝবার পারেন নাই?’ এবার একটু রহস্যের উন্মোচন হয়। আমি এই সক্কালবেলা এতক্ষণ এক মাতালের প্রলাপ শুনছিলাম, আর তাতেই ভড়কে যাচ্ছিলাম। ‘সক্কাল থাইকাই টানা শুরু করে’ – হকার ছোড়া এবার জোরে হাসে। তাড়াতাড়ি সরে পড়ি, নিজের বোকামিতে লজ্জা পেয়ে যাই।
চুল কাটাতে কাটাতে মোবাইলটা বেজে ওঠে। বুকের রক্ত লাফ দিয়ে ওঠে। জিরোভাই? চুল কাটার সময় ফোন ধরার অসুবিধা তার বুঝতে পারা উচিত। অতএব ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়, ধরি না। বিহারি-নাপিত ছুরি-কাঁচি বন্ধ করে অপেক্ষা করে, কোনো কথা না-বলে কাজ আবার শুরু করে। বাসায় এসে গোসল সেরে খেতে বসেছি, ফোন বেজে উঠল। বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। ফোন বাজতে থাকে, আমি ধরি না। ‘কী হলো, ফোন বাজে, ধরো না কেন’, বাসার কেউ বলে। ‘খেতে খেতে ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না, খেয়ে উঠে ওই নম্বরে ফোন করলেই চলবে।’ আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। খাওয়া শেষ করে তড়িঘড়ি জিরোভাইয়ের চিরকুটটা             বের করি, নম্বর মিলিয়ে দেখি। হ্যাঁ, তারই নম্বর। মাতাল তার প্রলাপ-আলাপ এতক্ষণ মনে রেখেছে? আমার কার্ড দেখে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লেখা মোবাইল নম্বর মিলিয়ে ফোন করেছে? এ কি সম্ভব? আমার কেমন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তাড়াতাড়ি ফোনটা  সুইচ-অফ করে দিলাম।
আজকের দিনে কতক্ষণ আর মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখা চলে। আমারও তো কাজকর্ম রয়েছে, দরকারি ফোন আসতে পারে, করতেও হতে পারে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে সন্তর্পণে মোবাইলটা খুলি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে ওঠে। নম্বর মিলিয়ে দেখি, হ্যাঁ জিরোভাইয়েরই নম্বর। শীতের সন্ধ্যায় আমি ঘামতে শুরু করি, এবার না ধরাটা অভদ্রতা হবে, বেয়াদবির পর্যায়েও পড়তে পারে। নিজের ওপরও রাগ হতে লাগল, এতো ভয় পাওয়ারই বা কী আছে, ফোনটা ধরা উচিত। ‘হ্যাঁ-হ্যালো’। ওপাশ থেকে উৎফুল্ল কণ্ঠ, ‘স্যার বলছেন? খুব ব্যস্ত ছিলেন মনে হয়, অনেকবার ফোন করেছি। আপনারা ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ, ব্যস্ত তো থাকবেনই। তবু স্যার, আমাদের মতো খড়কুটোদেরও একটু সময় তো দিতে হবে।’ ‘জি, একটু ব্যস্ত … তো ছিলাম, তাই ফোন …।’ ‘না, না, সে কি আমি বুঝি না? তা, এখন কি আসব স্যার?’ ‘হ্যাঁ, না-না, আমি তো এখন একটু বাইরে আছি, একটু কাজে …, রাতে আবার একটা দাওয়াতে যেতে হবে। ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।’ ‘তাহলে কাল বসি স্যার? বিষয়টা খুবই ইম্পরট্যান্ট।’ ‘কাল তো সকালেই আমাকে চিটাগং যেতে হচ্ছে। ফিরে এসেই আমি আপনাকে ফোন করব, তখন আপনার সঙ্গে বসি?’ ‘ওকে স্যার, অনেক মেহেরবানি আপনার। ফোনের অপেক্ষায় থাকব স্যার।’ একগাদা মিথ্যা কথা বলে লোকটার হাত থেকে আপাতত অব্যাহতি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কোথাকার এক মদ্যপ পাগলের পাল্লায় পড়ে খামোকা ভয়ে জড়সড় হচ্ছিলাম। ভাগ্যিস, ভিজিটিং কার্ডে বাসার ঠিকানাটা দিইনি, তাহলে যে কী উৎপাত হতো।
চাঁটগা থেকে ফিরে ভয়ে ভয়ে থাকি কখন জিরোভাইয়ের ফোন আসে। এবার তাকে এড়ানোর আর রাস্তা নেই। কাগজের হকারদের ওই এলাকার দিকে ভুলেও হাঁটি না। আমাকে অবাক করে দিয়ে জিরোভাইয়ের ফোন আর আসে না। দিন যায়, মাস যায়, মাসছয়েক হয়ে এলো, জিরোভাই ফোন করে না। মদ টেনে টেনে ব্যাটা নিশ্চয় মরেছে, লিভারটা পচিয়ে ফেলেছে। হাঁপ ছেড়ে স্বস্তি বোধ করার চেষ্টা করি; কিন্তু জিরোভাই আমাকে ছেড়ে যায় না। হয়তো লোকটা বহাল তবিয়তেই আছে। হয়তো আমার জারিজুরি সে ঠিকই ধরে ফেলেছে, আমার মধ্যবিত্ত মিথ্যাচার আর গা বাঁচিয়ে চলার ফন্দি তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাই সে নীরবে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। এক হীনমন্যতার বোধ আমাকে ভেতরে ভেতরে কামড়াতে থাকে।
হঠাৎ মনে পড়ল। আচ্ছা, আমার এক ভাগ্নে তো শুক্রাবাদ এলাকায় থাকে। যদিও সে ওখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে অল্পদিন, তবু জিরোভাইয়ের কিছু খবর সে জানতেও পারে। তাকে এত্তেলা পাঠাই। ‘শুক্রবার সকালে আমার বাসায় একটু আসিস, তোর সঙ্গে দরকারি কথা আছে, দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাস।’ ভাগ্নে একটু অবাক হয়, একা একা থাকে বেচারা, কখনো তো তাকে খেতে বলি না। তবে ঠিকই আসে। ‘আচ্ছা, তুই শুক্রাবাদে বাসা ভাড়া নিয়েছিস কদিন হলো রে?’ ‘এই তো এ-মাস শেষে পাঁচ মাস হবে। কেন বলো তো মামা?’ ‘তুই তো ওই এলাকার লোকজনকে এর মধ্যে মোটামুটি চিনবি। ‘জিরোভাই নামের লোকটাকে চিনিস নাকি? বা শুনেছিস?’ ‘জিরোভাই? তুমি তার নাম জানলে কী করে?’ ‘নাম জানি না শুধু, তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয়ও আছে। তুই কিছু জানিস এর সম্বন্ধে?’ ভাগ্নের বিস্ময় কাটে না। ‘শুনেছি যৌবনে তোমার ডিটেকটিভ হওয়ার সাধ ছিল। এখনো কি ডিটেকটিভগিরি করছ নাকি?’ ‘শোন, ওসব রাখ। জিরোভাই সম্পর্কে কী জানিস বল তো?’ ‘আমি তো মামা তেমন বেশি কিছু জানি না। খোঁজ নিয়ে তোমাকে জানাতে পারি।’ তা-ই সই।
সপ্তাহখানেক পরে ভাগ্নে যে-তথ্য জানাল তা সংক্ষেপে এরকম – জিরোভাই ওই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন বছর দশ-এগারো হবে। একাত্তরে নাকি দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু দেশে ফিরে কোনো সনদ বা সম্মান নিতে অস্বীকার করেন। বোধহয় বিষয়-সম্পত্তি ভালোই ছিল। চাকরি-বাকরি কিছু করতেন না, এটা-ওটা পাগলামি কাজ করতেন দেখে বাড়ির লোকের সঙ্গে বনিবনা হতো না। তখন বউকে নিয়ে এখানে চলে আসেন। নিজের পরিচয় বলতেন জিরোভাই, অন্য কোনো পরিচয় জানাবেন না, ভীষণ গোঁ। প্রথম প্রথম পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নানা কিছু করার চেষ্টা করতেন। নিজেদের অলিগলির সব ময়লা নিজেরা পরিষ্কার করবেন। গোটা পঞ্চাশেক বালতি, ঝাড়ু – এসব কিনলেন। ছেলেপেলেরা কদিন তার সঙ্গে হইহই করে জুটল, কিছু কাজ হলো, তার চেয়েও বেশি তার পয়সায় ভূরিভোজ। পরে বালতি-ঝাড়– সব এর-ওর বাসার সম্পত্তি হয়ে গেল। ছেলেপেলেরা সটকে পড়ল। আগের মতো ময়লা জমতে লাগল। এরপর চেষ্টা হলো ক্রিকেট ক্লাব করার, তিনি নিজেই কোচ। ব্যাট-বল-প্যাড-গ্লাভস-উইকেট কিনলেন নিজের পয়সায়। এবারো প্রথমে ছেলেপেলেরা জুটল, হইহই হলো, তারপর জিনিসপত্র কমতে শুরু করল। সবশেষে ছেলেপেলেরা ফিরে গেল যার যার ঘরে। মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলার চেয়ে ঘরে বসে কম্পিউটারে গেম খেলাই তাদের বেশি পছন্দ। এভাবে কখনো সস্তামূল্যের দোকান দিয়ে কেনা দামের চেয়েও কমদামে বিক্রি করে, কখনো  কন্যাদায়গ্রস্তকে ঋণ দেওয়ার কাজ করে অনেক টাকা-পয়সা খুইয়ে এখন হতাশ ও দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এসব পাগলামির কারণে বউটাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন একটা কাজের ছেলে নিয়ে একা থাকেন। খাদ্যের চেয়ে পানীয়ের আসক্তি বেশি। তবে দেশের জন্য একটা কিছু করার চিন্তা মাথা থেকে যায়নি, মাঝে মাঝেই নানান আজগুবি পরিকল্পনা নিয়ে বকবক করেন। লোকে তাকে পাগল বলেই বিবেচনা করে। আমি স্তব্ধ হয়ে থাকি। ওই নম্বরে ফোন করে খবর নেবো তার? সাহস পাই না, আবার কোন উৎপাত ডেকে আনি। লোকটা ভালো না মন্দ, দেশপ্রেমী না মতলববাজ, স্বাভাবিক না অপ্রকৃতিস্থ – ভেবে পাই না।
আবার দিন-মাস পেরিয়ে যায়। জিরোভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখার দিনের মতোই অবিকল এক শীতের সকালে চলেছি চাটগাঁ যাওয়ার বাসের টিকিট কিনতে। ফিরতে ফিরতে মনে হতে লাগল, আজ আবার যদি জিরোভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়? কী প্রতিক্রিয়া হবে আমার, ঠিক জানি না। তবু মনটা মনে হয় ভেতরে ভেতরে চাইছিল দেখা হোক আবার। একটু যেন আরো বুঝে নিতে চাই লোকটাকে। হকার ছোকরাটা যেখানে বসে তার দিকে চলতে চলতে হঠাৎ মনে হলো, ঠিক ওই জায়গাটিতে যেন একটা ভিড় জমে আছে। লোকজন গোল হয়ে কিছু একটা দেখছে।
ত্রস্তপায়ে হেঁটে গেলাম জায়গাটার দিকে। ভিড় ঠেলে উঁকি দিলাম ভেতরে। হকারদের কাগজ রাখার একটি টুলের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে একজন মানুষকে, সমস্ত বুক-পেট রক্তে ভেজা, বেঁচে আছে বলে মনে হচ্ছে না। এ-পাশ থেকে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। অন্যপাশে গিয়ে পাশ-ফেরানো মুখটার দিকে তাকালাম। জিরোভাই! ভিড়ের মধ্যে হকার ছোকরাটাকেও দেখতে পেলাম। তাকে পাশে টেনে আনলাম, ‘কী হয়েছে রে? তুই কিছু দেখছস?’ ‘আমার চোখের সামনেই তো সব ঘটনা। আধা ঘণ্টাও হয় নাই।’ ‘কী ঘটনা?’ ‘রাস্তায় অনেক লোক হাঁটতাছিল। হঠাৎ দেহি এক মহিলার সামনে এক বেবি আইস্যা কষা ব্রেক দিলো। চাইরটা লোক নামলো, সব্বার হাতে লম্বা লম্বা ছুরি। নাইমাই মহিলারে ধইরা পাঁজাকোলে কইরা বেবিতে তুলতে চায়। মহিলা চিক্কর দিয়া উঠছে। বেবিতে পরায় তুইলা ফেলছে, হঠাৎ কোত্থন বাঘের মতন গর্জন দিয়া ছুইটা আইল জিরোভাই। চাইট্টা জোয়ানের লগে শুরু করল একলার লড়াই। দুইটারে পাইরা ফেইলা এমন মাইর দিলো। এর মধ্যে অন্য দুইটা শুরু করল ছুরি চালান। জিরোভাই রক্তে ভাসতাছে, কিন্তুক ছাড়তাছে না ওই দুইটারেও। তয় শেষতক পারল না, বয়স হইছে না। ওই দুইটা পালাইল, জিরোভাই মাটিত পড়ল ধড়াস কইরা। কম বয়স অইলে জিরোভাই চাইরটা ক্যান ওইরহম দশটারেও ঠ্যাঙে ধইরা আছাড় দিয়া মারত। অন্য দুইটারে মাইনসে পিষ্যা গোস্তের দলা বানাইয়া ফালাইছে। দ্যাখবেন, আহেন।’ ‘না রে, থাক। তা অন্য কেউ সাহায্য করতে আসলো না?’ ‘একটা লোকও না। জিরোভাই কাউরে ডাকেও নাই। একাই লড়াই কইরা মরছে।’ ছেলেটার কি চোখ ছলছল করল? কী জানি।
আমার সমস্ত সুবিধাবাদিতাকে নীরবে উপহাস করে জিরোভাই চলে গেলেন।