জীবনানন্দ দাশের কবিতালোক

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী

তাঁর জনপ্রিয়তা যেন তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল : তিনি যে আমাদের, বিশেষভাবে আমাদেরই, এ-সত্যটি তিনি লোকান্তরিত হওয়ার পরই যেন অনবগুণ্ঠিত হতে শুরু করল। জীবৎকালে যিনি ছিলেন প্রায় অজ্ঞাত, আজ তিনি সর্বহৃদয়সম্বাদী। বস্ত্তত তিনি আজ কেবল জনপ্রিয় নন, ১৯৫৪-এ মৃত্যুর অর্ধশতাধিক কালের মধ্যে জীবনানন্দ আজ বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষে পরিণত হয়েছেন। বাংলা কবিতা বিংশ শতকে প্রবেশ করেছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে, – আজ প্রায় অবিসংবাদিত যে – একুশ শতকের প্রবেশমুখে জীবনানন্দই আমাদের পুরোধা। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সবচেয়ে পরিপূর্ণ, সবচেয়ে সার্থক সংজ্ঞার্থটি তাঁরই কবিতার মধ্যে রূপায়িত হয়েছে।

এ-কথা বলার অর্থ এই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। জগৎ-সংসারের দাসত্বশেষে যখনই আমরা নিজের কাছে ফিরে আসি – তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের খুব আপন হয়ে কাছে আসেন; আমাদের নিসর্গপ্রণত পূজাপ্রবণ অতল সত্তার ভেতর থেকে আমাদের উথাল-পাথাল করে দিয়ে অনুরণিত হয়ে ওঠে : ‘তোমায় আমায় মিলন হবে বলে আলোয় আকাশ ভরা’, কিংবা ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে, আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে’। ধ্যানমগ্ন রবীন্দ্রনাথ যেন আমাদেরই মনের গভীর থেকে পৃথিবীর উদ্দেশে উচ্চারণ করেন :

বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর গুপ্ত সঞ্চার

তোমার যে মাটির তলায়

তাকে আজ স্পর্শ করি, উপলব্ধি করি সর্ব দেহে মনে।

অগণিত যুগযুগান্তরের

অসংখ্য মানুষের লুপ্ত দেহ পুঞ্জিত তার ধুলায়

আমিও রেখে যাব কয় মুষ্টি ধূলি

আমার সমস্ত সুখ-দুঃখের শেষ পরিণাম-

রেখে যাব এই নামগ্রাসী, আকারগ্রাসী, সকল পরিচয়গ্রাসী

নিঃশব্দ মহাধূলিরাশির মধ্যে।

এরই প্রতিপৃষ্ঠে আলোছায়ার জীবনানন্দীয় ভুবন; সান্ধ্যভাষ্যে ছায়াবৃত, কখনো দূরাবগাহ, অবোধ্য নয় যদিও। মানুষের অস্তিত্ব-বিন্দুর দুই দিকে ছড়িয়ে আছে দুই কালো সাগরের ঢেউ, অন্ধকার নেমে আসে আকাশের কালো জল থেকে;  জীবনানন্দের মনে হয়, ‘সমাবৃত হয়ে আছি কোনো এক অন্ধকার ঘরে’, সঠিক পথের অন্বেষণে একবার দৃষ্টি ফেরে নক্ষত্রের দিকে, একবার প্রান্তরের দিকে, কিন্তু গন্তব্য অনির্দিষ্ট থেকে যায় – সিদ্ধান্তহীন জীবন অস্থিরতা ও যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ওঠে। ঢের দিন বেঁচেছে মানুষ এই পৃথিবীতে  আজ অগণন মানুষের শব ছাড়া আর কোনো শস্য আহরণের নেই; মানুষের জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মতো নয়; – মহিনের ঘোড়ার মতো অনর্থক, যান্ত্রিক জীবনের আর কোনো মানে হয় না; আর তাই ধানসিড়ি নদীর কিনারে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জীবনানন্দ পউষের রাতে এই জেনে যে আর কোনোদিন জেগে উঠবেন না; – কিন্তু মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায় – এই উপলব্ধি থেকে নিদ্রার পর্ব শেষ হয়ে আবার শুরু হয় জীবনের স্পন্দন :

কোথাও তরণী আজ চ’লে গেছে আকাশরেখায় – তবে

এই কথা ভেবে

নিদ্রায় আসক্ত হ’তে গিয়ে তবু জেগে ওঠে পরাস্ত নাবিক …

(‘নাবিক’)

প্রাত্যহিক মৃত্যুচিন্তা যার জন্য অনিবার্য ছিল সেই জীবনানন্দ জীবনের আহবান জানিয়েছেন এই বলে :

মৃত্যু নয়… তুমি এক কুঁড়ে বাঁধো কোনও দূর দিগন্তের কাছে

তার পর… দেখিবে সোনালি রৌদ্র খেলা করে জনার’এর খেতে

দেখিবে আকাশ দূরে আকাশে আকাশে আরও নীল হয়ে আছে

দেখিবে সন্ধ্যার মেঘ বহু ক্ষণ থেমে আছে কুহকের সমুদ্রের দিকে যেতে-যেতে

(‘মৃত্যু নয়’, সূর্য-অসূর্যলোক)

বস্ত্তত যে কাল-পরিধিতে বাঙালি কবিতা-পাঠক জীবনানন্দকে আবিষ্কার করেছে, বিংশ শতাব্দীর প্রায় সে একই সময়ে রবীন্দ্রসংগীত বাঙালির মর্মমূলে ব্যাপ্ততম পরিসর করে নিয়েছে। এক বিবেচনায়, বিংশ শতাব্দীর নাগরিক মানুষের কাছে জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথেরই পরিপূরক। তাঁরা দুজনই আমাদের শূন্যতাদীর্ণ নগর-যান্ত্রিক মানসের শরণবেদী। আপাতঃ অসবর্ণ দুই কবি বিংশ শতাব্দীর বিভক্ত মানবসত্তার দুই খণ্ডর কাছে ভিন্ন আঙ্গিকে পূর্ণমাত্রায় আবেদন নিয়ে উপস্থিত-সক্ষম। একজনের আবেদন ঈশ্বরে সমর্পিত রূপকাতর চেতনার কাছে, অন্যজনের কড়াঘাত আধুনিক নাগরিক মানুষের নিরাবলম্ব ও সন্ত্রস্ত অথচ ইন্দ্রিয়লিপ্ত অবচেতনার কাছে। জীবনানন্দের কবিতার অস্পষ্ট নায়কেরা তাই অভূতপূর্ব প্রতিবিম্ব নিয়ে উপস্থিত হয় পাঠকের কাছে :

আরও গাঢ় বিতর্কের পাতা নেড়ে-চেড়ে

জানি না সে পেল কোন প্রীত সমাধান

বহু দিন আমাদের চক্ষু থেকে অন্তর্হিত হয়ে

সে যেন প্রবাদ হয়েছিল কোনও অন্ধকার নিমজ্জিত ভিড়ে

মাঝে-মাঝে যেন কোনও মধ্যযুগ থেকে এক অর্ধমৃত সমুদ্রের বাতাসের মত

আমাদের নিশীথ’কে মুহূর্তের কোলাহলে ব্যস্ত ক’রে চ’লে যেত

তবু আমরাই মৃত্যুর ভিতরে পড়ে আছি।

সে ঢের জীবিত : …

দুই

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পত্তন হয়েছিল তিরিশের দশকে। তিরিশের কবিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীজোড়া এলিয়টবর্ণিত ‘পোড়োজমি’কে আধুনিকতার দিব্য ভিত হিসেবে পরম অভ্যর্থনায় গ্রহণ করেছিলেন। জীবনানন্দ ‘পোড়োজমি’র সুপ্রসার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু একে অবিনাশী বা চিরন্তন জীবনপট হিসেবেও মেনে নেননি। জীবনের মৃত্যুকেন্দ্রিকতা হৃদয়ঙ্গম করে জীবনানন্দেরও কাছে সব কাজ তুচ্ছ, সব চিন্তা প-শ্রম মনে হয়েছিল বটে কিন্তু তাঁর অনাবদ্ধ দৃষ্টিতে লক্ষ্মীপেঁচার লাজুকতাও দৃশ্যমান হয়েছিল; – তিনি দেখেছিলেন, ‘মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’, মনে হয়েছিল সেই নারী ‘কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মত যেন হায়’, দেখেছিলেন, ‘অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভ’রে গেছে’। তাঁর গভীর দৃষ্টিলব্ধ চিত্র তাঁর গভীরতর বোধকে দিয়েছিল পরম আশ্রয় : উটের গ্রীবা ধারণ করেছে নিস্তব্ধতা, সন্ধ্যার আঁধার ভিজিয়ে দিয়েছে বিমর্ষ পাখির ডানা, মিনার হ’য়ে মেঘ তার জানালায় ডেকেছে সোনালি ডানার চিলকে।

ত্রিশের কবিরা আধুনিকতার ঘরবাড়ি নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধের পর উত্তর-সামরিকী কালে : ভারত তখন ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনে প্রমত্ত; ১৯৩০-এর গভীর অর্থনৈতিক মন্দা ক্রমপ্রলম্বিত; সংস্কৃতির নৌকো দোদুল্যমান। সব মিলিয়ে মানুষ এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, নৈরাজ্য এবং অবক্ষয়ের মুখোমুখি। এই অন্ধকারে জীবনানন্দের আবির্ভাব যেন প্রতিফলিত হলো নিচের পঙ্ক্তি কটিতে :

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর ছলছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;

তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া

গুটিয়ে নিয়েছে যেন

কীর্তিনাশার দিকে। (‘অন্ধকার’)

 

মানুষের হৃদয় ও চেতনার যে গভীর অনুভব তার এমন নিসর্গলগ্ন প্রকাশ বাংলা কবিতায় এর আগে পরিদৃষ্ট হয়নি। হতে পারে মানবজন্ম উদ্দেশ্যহীন – তবু বেঁচে থাকা তাৎপর্যময় কেননা জগৎ সুন্দর; অপরূপ নিসর্গের রূপ আস্বাদনেই একটি জীবন কেটে যেতে পারে। তাই নদীর ছলছল শব্দে অন্ধকারের ঘুম ভেঙে যায়। এখানেই শেষ নয়; – জেগে উঠলে চোখে পড়ে পাণ্ডুর চাঁদ তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে বৈতরণী থেকে। আত্মস্থহ অনুভবকে এভাবে নিসর্গের সঙ্গে সংলিপ্ত করেছেন জীবনানন্দ; জীবনানন্দের ইতিহাস ও পুরাণ আশ্রিত নিসর্গলিপ্তি জীবনানন্দের কবিতাকে এক মোহময় শব্দচিত্রে পরিণত করেছে।

কেবল উত্তর-সামরিকী কাল নয়, পৃথিবীতে তখন মানুষের সংগঠন ও সমবায়ে বড় এক পরিবর্তন ঘটে গেছে; সোভিয়েত রাশিয়ায় বলশেভিকরা লেনিনের নেতৃত্বে মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রচলন করেছে; শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা বিবেচিত হচ্ছে পরমার্থিক। সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নিঃশর্তভাবে আধুনিক বাংলা কবিতায় সেই মাত্রা যোগ করছেন। মানুষের জীবন সংগ্রামের সম্প্রচার তাঁদের কবিতার অন্যতম উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। জীবনানন্দ কেবল এটুকু লিখে তাঁর উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন :

রক্তে যেন চিনি জ’মে গেছে ঢের – মনে হয়

মিঠাই’এর দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে-হেঁটে তিন যুগ – হয়ে গেছে ঢের বর্ণমালা পরিচয়

মিঠাইটা তোমাদের – অথবা তাদের – আমাদের তরে শুধু ফুটপাথে হেঁটে-হেঁটে শিস!

[‘পুরোনো বই’এর দোকানে আমি’, জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতা]

জীবনানন্দ স্বীকার করেছেন যে, ‘শোষিত মানবজীবনের, সেই জীবনোৎসারিত বিপ্লবের ও সেই বিপ্লবের শেষ আশা-ভরসার সমাজ সৃষ্টির’ বাণী নিয়ে কবিতা লেখা যেতে পারে; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেছেন মানুষের ‘জীবন পদ্ধতি যে কোনো সমাজ ও সমবায় পদ্ধতির চেয়ে বড়’ – তাই মানবজীবনকে কেন্দ্র করেই তার কবিতাকল্পনা আবর্তিত হয়েছে। তাঁর কবিতা ‘স্বর্গ ও আঘাত’ এবং এ দুয়ের ‘স্বাভাবিকতা ও স্বাভাবিক ভীষণতা’ সর্বমানবীয়ভাবে পরিস্ফুট করে তোলার প্রয়াস পেয়েছে। ‘জীবনের নিভৃত কুহকে’র সন্ধান কবিদেরই জানা, সন্ধ্যায় কাকের মতো আকাঙক্ষা নিয়ে কবিরাই ঘরে ফেরেন, পৃথিবীর সকল আবিলতা, লোভ আর যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে কবিরাই বুঝতে সমর্থ :

…পথ ঘাট মাঠের ভিতর

আরো এক আলো আছে; দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;

চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো

হয়ে আছে স্থির;

পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায়

মস্নান ধূপের শরীর;

(‘মৃত্যুর আগে’, ধূসর পাণ্ডুলিপি)

সমাজ, রাষ্ট্র, প্রচারণার তাবৎ ঝঞ্ঝাটের গোলকধাঁধা ভেদ করে মানুষের নীরব অথচ মূল আবেগানুভব আবিষ্কার করা একমাত্র কবিদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। সমাজবাস্তবতার সঠিক পাঠকৃতির মাধ্যমে আবেগ, বুদ্ধি ও যুক্তিশীলতার উপযুক্ত সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব ছিল তাদেরই পক্ষে। ঠিক; – কিন্তু জীবনানন্দ দেখেছেন একটু যেন বেশি, বুঝেছেন একটু যেন বেশি এবং তাঁর এই উপলব্ধি পাঠকের সঙ্গে নিছক ভাগ করে নিতে চেয়েছেন, খানিকটা উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই। অতএব জীবনানন্দ লিখতে পেরেছেন অশ্রম্নতপূর্ব কথকতা :

বিচারক উচ্চাসন থেকে নেমে – পরচুলা                        খুলে ফেলে – তার পর যায়

হয়তো নিজের ঘরে – কিংবা কোনও                                গণিকার ঊর্ধ্ব আখড়ায়

মাথার চাঁদিতে তার একটাও চুল নাই –  

                                                                    তাই

চুমো দিতে গেলে তবু ঋজু গণিকার

গলায় কেমন কফ আটকায়ে যায় বার-বার

ক্লান্ত হয়ে কথা ভেবে দেখে নেকটাই

(‘রুটি-বিক্রেতার ঘরে জন্মেছে যে’,  সূর্য-অসূর্যলোক)

 

তিন

বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনা হয় ‘কলেস্নাল যুগে’। কলেস্নাল সাহিত্য-পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এর কিছু আগে, ১৯২২-এ, বরিশালের মানুষ জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে টিউটরের চাকরি নিয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রস্থলে চলে এসেছেন। ১৯২৫-২৬-এ জীবনানন্দ নানা পত্র-পত্রিকায় কবিতা ছাপতে শুরু করেছেন। প্রথম থেকেই তাঁর কবিতার স্বাতন্ত্র্য বিদগ্ধ পাঠকের মনোযোগ টেনে নিয়েছিল। কলেস্নাল পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩২ সংখ্যায় জীবনানন্দের ‘নীলিমা’ পাঠের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে অচিমত্ম্যকুমার সেন লিখেছেন, ‘হঠাৎ কলেস্নাল-এ একটি কবিতা এসে পড়ল – ‘নীলিমা’। ঠিক একটুকরো নীল আকাশের সারল্যের মতো…।’ বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘কিছুকাল পূর্বে জীবনানন্দ দাশগুপ্ত স্বাক্ষরিত ‘নীলিমা’ নামে একটি কবিতা কলেস্নালে আমরা লক্ষ্য করেছিলাম; কবিতাটিতে এমন একটি সুর ছিল যার জন্য লেখকের নাম ভুলতে পারিনি।’

আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক জীবনানন্দ দাশ অরাবীন্দ্রিক চরাচরের জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। কলেস্নালীয়দের মধ্যেই সতীর্থদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন জীবনানন্দ। কলেস্নালের ছত্রছায়ায় না-হলেও তরুণ জীবনানন্দের পরিচর্যা হয়েছিল কলেস্নালেরই আবহে; তবে অনতিবিলম্বে তিনি সতীর্থদের থেকে পৃথক হতে শুরু করলেন। ক্রমান্বয়ে এই পার্থক্যের দূরত্ব বেড়েছে। বস্ত্তত সতীর্থদের ছেড়ে জীবনানন্দ ক্রমশ তাঁর নিজস্ব পথে দূরে সরে গেছেন। প্রকরণ, কৌশল, বিষয়বস্ত্ত আর আবেদন সবদিকেই তিনি হয়েছেন পৃথকান্ন। বুদ্ধদেব বসু যে-বছর লিখেছেন :

… রূপালি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে, সমস্ত আকাশ

নীলের স্রোতে ঝরে’ পড়ছে তার বুকের উপর

সূর্য্যের চুম্বনে। – এখানে জ্বলে’ উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু

তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে

কখনো কি ভেবেছিলে?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম

দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে

জলের উপর দিয়ে। – কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে, আর আমার

কী ভালো লেগেছিল।

[‘চিল্কায় সকাল’, কবিতা, ১ম বর্ষ, আশ্বিন,

১৩৪২]

তারুণ্যসুলভ এ হেন সরল আবেগের সরলতর প্রকাশের প্রতিপৃষ্ঠে একই সময়ে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন :

… সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে

চিল;

পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে

আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকীর রঙে ঝিলমিল;

সব পাখী ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

(‘বনলতা সেন’, কবিতা, ১ম বর্ষ, পৌষ, ১৩৪২)

জীবনানন্দের অনেকগুলো প্রকরণগত কবিবৈশিষ্ট্য এ-কবিতাতে ফুটে উঠেছে – শব্দচয়নের বৈচিত্র্য, উপমার ঔজ্জ্বল্য আর ছন্দোত্থিত সংগীতময়তা অভিনব ও তুলনারহিত। উভয়ই প্রেমের কবিতা কিন্তু স্পষ্টত জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ যাকে বলে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের শাসন থেকে মুক্ত; আবেগের জ্বলজ্বলে পাড় খুলে নিয়ে জীবনানন্দ কেবল সুন্দরের ছবি এঁকেছেন যার মধ্য দিয়ে তাঁর অভীষ্ট উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে, কেননা সৌন্দর্যই প্রেমের সবচেয়ে প্রধান উদ্দীপক, শিল্পের প্রধান আরাধ্য। আরো লক্ষণীয়, জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় এক মায়াবীলোক তৈরি করেছেন ইতিহাস আর নিসর্গের নানা স্তর ছুঁয়ে। অন্যদিকে বুদ্ধদেবের রচনা কার্যত আবেগবাহী শব্দের যুক্তিশীল বিন্যাস মাত্র। তাঁর শব্দাবলি কল্পনার জাদুস্পর্শে প্রভাময় হয়ে উঠেছে এ-কথা বলা চলে না।  এমত মন্তব্য সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যখন লিখছেন :

উন্মুক্ত আকাশে শুনি চমৎকৃত চিলের চীৎকার;

দিগন্ত বিসত্মৃত মাঠে ডেকে ওঠে শিকারী নকুল,

গুপ্ত ছত্রাকের ফুলে সমাচ্ছন্ন শোষিত বকুল;

উদগ্রীব ডাহুক জাগে থেকে থেকে সতর্ক চীৎকার।

অপমৃত ভগবান; অস্তাচলে রক্তাক্ত অঙ্গার;

অরাজক চরাচরে প্রত্ন প্রতিহিংসার প্রতুল;

অতিদৈব বিবর্ত্তনে মনুষ্যই যেহেতু অতুল,

তাই সে আত্মহা আজ, তার ধর্ম্ম আত্মীয়সংহার। …

কষ্টকল্পনা ও জোরপ্রবিষ্ট ছন্দানুপ্রাসের কৃত্রিমতার পাশাপাশি, প্রায় একই সময়, জীবনানন্দ দাশ আমাদের দৈনন্দিন আটপৌরে ভাষা থেকে শব্দাবলি বেছে নিয়ে অনায়াসে লিখছেন :

হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;

অথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে।

এখন দুপুর রাতে নগরীতে দল বেঁধে নামে।

একটা মোটরকার গাড়লের মত গেল কেশে

অস্থির পেট্রল ঝেড়ে; – সতত সতর্ক থেকে তবু

কেউ যেন ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে জলে।

তিনটি রিক্শা ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাস ল্যাম্পে

মায়াবীর মতো জাদুবলে।…

খুব বিশদ করে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই যে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে অনেক দূরে ভিন্ন এক দিগন্তরেখায় অগ্রসর হয়েছিলেন জীবনানন্দ। কবিতার বিষয়বস্ত্ত, কাঠামো, শব্দচয়ন-সুধীন দত্তের সবকিছুতেই একটি আদিম গন্ধ লেগে থাকল। ‘চমৎকৃত চিলের চীৎকার’ অথবা ‘প্রত্ন প্রতিহিংসার প্রতুল’ ইত্যাদি প্রাচীন রীতির আদ্যানুপ্রাস সৃষ্টির মোহ যখন সুধীন দত্তকে আঁকড়ে আছে, তখন জীবনানন্দ যেন খানিকটা অন্যমনে শব্দের বিচিত্র বিন্যাসে গড়ে তুললেন, টাটকা অথচ, জহরসেন মজুমদারের ভাষায়, ‘অবিন্যস্ত বা ঢিলেঢালা’ সৌন্দর্য। সবচেয়ে দ্রষ্টব্য এই যে, জীবনানন্দ কবিতার মধ্যে একটি ধারাবাহিক সুস্পষ্ট বাণীক্রম তৈরির ঐতিহ্য উপেক্ষা করলেন; কবিতায় গল্পাকারে অর্থবোধকতা তৈরির দাবি অগ্রাহ্য করে তিনি নির্মাণ করলেন আঙ্গিক (organic) কাঠামোর  মানুষ বা উদ্ভিদের অঙ্গসংস্থানের মতো-প্রতিটি অঙ্গ নিজগুণে আর উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ যদিও সবমিলিয়ে পূর্ণাবয়ব মানুষই উজ্জ্বলতর। নিসর্গ, সমসাময়িক প্রতিবেশ, ইতিহাস আর পুরাণ থেকে গৃহীত চিত্রাবলি জীবনানন্দের সূক্ষ্ম উপলব্ধির ঐক্যসূত্রে গাঁথা পড়ল। মূলত জীবনানন্দের কবিসত্তা তাঁর অতলস্পর্শী বোধশক্তির কাছে ঋণী, কেননা এই বোধশক্তির জোরেই জীবনানন্দ সকল মেকি অনুভবের আবরণ ঠেলে মহাকাল ও ইতিহাসের নিরিখে বিংশ শতকী আধুনিক মানুষের মৃত্তিকালগ্ন, ইতিহাস-সমর্থিত মূল চেতনাটি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। ফলে আমরা দেখি অমিয় চক্রবর্তী যখন ‘বৃষ্টি’ কবিতায় লিখছেন-

কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।

ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।

শহরের দ্রম্নত অন্ধকার।

লুটায়ে পাথরে জল, হাওয়া তমখিনী;

আকাশে বিদ্যুৎ জ্বলা বর্ষা জানে

ইন্দ্রমেঘ;

কালো দিনগুলির রাস্তায়।

কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।

সেখানে, প্রায় একই সময়ে, জীবনানন্দ লিখছিলেন :

সে এক বিচ্ছিন্ন দিনে আমাদের জন্ম হয়েছিল

ততোধিক অসুস্থ সময়ে

আমাদের মৃত্যু হয়ে যায়।

দূরে কাছে শাদা উঁচু দেয়ালের ছায়া দেখে ভয়ে

মনে ক’রে গেছি তাকে-ভালোভাবে মনে করে নিলে-

এইখানে ভাল হতে বেদনার শুরু-

অথবা জ্ঞানের থেকে ছুটি নিয়ে সান্তবনার হিম হ্রদে একাকী লুকালে

নির্জন স্ফটিকস্তম্ভ খুলে ফেলে মানুষের অভিভূত ঊরু

ভেঙে যাবে কোনো এক রম্য যোদ্ধা এসে।…

বস্ত্তত জীবনানন্দের আধুনিকতা কেবল তাঁর প্রকরণ আর কাঠামোর আধুনিকতা নয়, জীবনানন্দের আধুনিকতা তাঁর আধুনিক দার্শনিক সত্তার অভিজ্ঞান। তিনি বিশ শতকের ফ্রয়েড-উন্মোচিত মানুষের সচেতনতায় সমৃদ্ধ; তাঁর সংবেদনশীলতা তীব্র-গভীর। ফলে জীবনানন্দ পৌঁছে গেছেন সেই বোধে যা সহজলভ্য নয়। এই বোধের সঙ্গে জীবনানন্দের কল্পনাপ্রতিভার সার্থক সম্মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন, ফলে তাঁর বাণী একই সঙ্গে চিত্রময়তায়, সংগীতে, অর্থগভীরতায়, ইঙ্গিতে ঋদ্ধ হয়ে উচ্চ কাব্যমূল্য অর্জন করেছে। জীবনানন্দের কবিতা অনুধাবনের আগেই মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে অনুধাবন দেয় এমন গভীর মানবীয় উপলব্ধি যা বিংশ শতাব্দীর আধুনিক, সচেতন মানুষের জন্য অনিবার্য। ফলে জীবনানন্দ সেই কবি হয়ে উঠেছেন – তাঁর নিজেরই ভাষায় – ‘যার হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে…’। তাঁর কবিতার ভুবন আশ্চর্য চিন্তা ও উপলব্ধিতে ঋদ্ধ :

আসিতেছে – আসিতেছে – আরও ঢের মানচিত্র – ঘড়ি – কম্পাস

সারা-রাত মিঠে ঘাসে – বারকোশে – কিংবা গণিকার সাথে

যারা করে সহবাস

তাহাদেরও হৃদয়ে গণিত

এক দিন জেগে উঠে তাহাদের আগাগোড়া জীবনের নেবে

পরিচয়

(তাহারা বলিছে কেঁদে) : দেয়ালের ঘড়িটারে এখুনি-যে

প্রতিভূত মত মনে হয়

কোনও কিছু হবে ব’লে সারা-রাত সহিতেছে কী ভীষণ শীত!

 

চার

বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলত কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। এ-প্রবন্ধের শুরু এইভাবে :

সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি – কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধ’রে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।

জটিল ভাষায় সুগভীর বক্তব্য নিয়ে প্রথম থেকেই প্রবন্ধলেখক জীবনানন্দ স্বতন্ত্র হয়ে গেছেন। এরপর পরম বিশ্বাসে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধে তিনি সৎ ও শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার শর্তাবলি নিরূপণ করেছেন; নির্ণয় করেছেন আধুনিকতার সঠিক পরিচয় এবং কখনো কখনো সমসাময়িক কবিতার মূল্যমান নির্ণয় করেছেন। কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে জীবনানন্দের কবিতাবিষয়ক ধ্যান-ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে নিরেট পরিসরে। সমসাময়িককালে ইউরোপীয় ধাঁচে বাংলা কবিতায় যে-আধুনিকতার প্রবর্তন হয়, সে-সম্পর্কে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ খুবই লক্ষ্যভেদী।

কবিতাবিষয়ক চিন্তায় জীবনানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি অভিনব বললে অত্যুক্তি হবে না। যুগ যুগ ধরে কবিতাবিষয়ক বিতর্কের কেন্দ্র হলো : কবিতা কী, কী গুণে একটি রচনা কবিতা হয়ে উঠতে পারে। তৎপরিবর্তে জীবনানন্দ সর্বাগ্রে কবির সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করাই শিরোধার্য করছিলেন, তিনি সর্বপ্রথমেই লিখলেন : ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি…।’

কে কবি?

জীবনানন্দ জানালেন, কবির হৃদয়ে থাকবে কল্পনা; সে-কল্পনার ভেতরে থাকবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা। অধিকন্তু, জীবনানন্দের মতে, একজন কবির পশ্চাৎপটে ক্রিয়াশীল থাকে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক কবিদের বিভিন্ন কাব্যপ্রয়াস। এ-কারণে, যার হৃদয়ে কল্পনার প্রতিভা নেই – আর কল্পনা যদিওবা থাকে, যদি না-থাকে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্রিক নির্যাস – তবে জীবনানন্দ তাঁকে, হতে পারেন তিনি বহুলপ্রজ এমনকি খ্যাতিমান কবিতালেখক, ‘কবি’ বলতে প্রস্ত্তত নন।

কল্পনার প্রতিভা কী তা স্পষ্ট করেননি জীবনানন্দ। ইমানুয়েল কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) সময় থেকেই শিল্পসৃষ্টিতে imagination বা কল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কান্ট যেমন ইঙ্গিত করেছেন, কল্পনার প্রতিভা হলো – যা দৃশ্যমান নয় তা প্রত্যক্ষ করবার – এবং একজন শিল্পীর জন্য – চিত্রায়নের ক্ষমতা; কবির জন্য ‘বোধ’ সৃষ্টির; তা হতে পারে স্মৃতিসঞ্জাত বা অভিজ্ঞতাপ্রসূত – এমনকি হতে পারে, আলেকজান্ডার বমগার্টেনের
(১৭১৪-১৭৬২) ভাষ্যে অভূতপূর্ব, অর্থাৎ অনদৃষ্ট, যা – এমনও হতে পারে – কেবল কবিতার মধ্য দিয়েই উপলব্ধ হবে। স্বীয় অভিজ্ঞতার গহন থেকেই উঠে আসে কল্পনালব্ধ বোধ; – কবি তাকে ধারণ করেন শব্দপুঞ্জের কাঠামোতে।

প্রতিভা কী তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমাদের অগ্রজ পল গাইয়ার (জন্ম ১৯৪৮) যা বলেছেন তার দোহাই দেওয়া যায় : the genius is praised for his or her capacity for invention and originality, as well as for the capacity for communication – এ-ব্যাখ্যায় জীবনানন্দের আপত্তি থাকবার কথা নয়। বরং জীবনানন্দের ভাষ্য ব্যাখ্যা করে বলা যেতে পারে, কবি তিনি যিনি অনুপলব্ধ অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে পারেন এবং পাঠককে নিয়ে যেতে পারেন এই অনুপলব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।  কাশেম-এর কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ যখন লেখেন :

কাশেম যেতেছে চ’লে দু’টো মহিষ’এর পিছে – কয়েকটা

গোরু ইতস্তত

তাহার গায়ের ঘ্রাণ – ঋতু-পরিবর্তনের দিনে পায়ের শিরার

নিচে মৃত্তিকার মত

সে-ও ঋতু – কয়েকটি গাভী ইতস্তত

ঋতু তারা; – তাহাদের রোমে নেমে কুয়াশার রমণীরা –  গাহিতেছে পায়রা’র মত কণ্ঠে গান

যদিও তারার দিকে বুনোহাঁস নিতে গেছে কুম্ভিলক-বৃত্তির

সম্মান

বাবলা’র লাঠি তবু – খই’এর মতন হিম ধূসর মুর্গি –

বালিহাঁস

কাশেম’এর সাথে-সাথে চলিতেছে – যদিও অনেক রাতে মাথার উপরে ভেঙে পড়িবে আকাশ

তখন পাঠক এক আশ্চর্য চলচ্চিত্রের মুখোমুখি হয়ে পড়ে : এক অভূতপূর্ব  চলচ্চিত্র যার কাহিনি অচিমত্ম্যসম্ভব অথচ মোহনীয়।

কবির কাজ কবিতা সৃষ্টি করা; কিন্তু একজন কবি ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখে উঠতে পারেন না কেননা কবিতা ‘চিন্তার ব্যায়াম’ মাত্র নয়। বস্ত্তত কবিতার জন্মরহস্য বর্ণনাতীত একটি ঘটনা। এমত সম্ভব নয় যে-কোনো কবি বলে উঠবেন, আজ আমি একটি কবিতা লিখব এবং তাঁর ইচ্ছে থেকে জন্ম হবে কবিতার। কবিতার জন্মের মৌলিক শর্ত তো এই যে, প্রথমত. কবির মনে বিশেষ একটি ভাবনা বা চিন্তার স্বয়ম্ভূ স্ফূরণ। অনেক কবিই অবহিত করেছেন : প্রথমত. একটি পঙ্ক্তি হঠাৎ করে জন্ম নেয়, তার থেকেই কবিতার বিস্তার। জীবনানন্দের ভাষ্যে : কবিতা কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে কবিমনের সততাপ্রসূত অভিজ্ঞতা ও কল্পনাপ্রতিভার দৈব সন্তান। কবিতার প্রক্রিয়াগত সংজ্ঞার্থে ‘দৈব সন্তান’ কথাটি অনিবার্য। দৃশ্যত কবিতা মানুষের অধিগম্য শব্দসমষ্টির বিন্যাস মাত্র, কার্যত বিস্ময় ও গভীর সৌন্দর্যের উৎস। কবিতা শব্দাবলির সমষ্টি হলেও মানুষের অনুভূতিতে সৃষ্টি করে বিশেষ একটা রস, সঞ্চারিত করে বিশেষ একটি আবেগ যা মানুষের উপলব্ধিতে জাগিয়ে তুলতে পারে বিশেষ তৃপ্তিবোধ, বিস্ময় এবং অনির্বচনীয় আনন্দোচ্ছলতা। কিন্তু কবিতা সকলের জন্যে নয়, অনেকের জন্যেও নয়। কবিতা কেবল কবিতাবোদ্ধাদের জন্য; জীবনানন্দ নিঃসংশয়ে মনে করেন শ্রেষ্ঠ কবিতা হলেই তা গণমানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে উঠবে তা নয়।

এরিস্টেফেনিসের নাটকে ইস্কিলাসের প্রশ্ন ছিল : What are the principal merits entitling a poet to praise and renown? ইউরিপিদিসের উত্তর ছিল : The improvement of morals, the progress of mind,/ When a poet, by skill and invention/ Can render his virtuous and wise – জীবনানন্দ কাব্যের এবম্বিধ উদ্দেশ্য সম্পর্কে কখনোই অভিন্নমত পোষণ করেননি। কবি শেলিও করেননি; তাঁর সুস্পষ্ট ঘোষণা :  didactic poetry is my abhorrence। জীবনানন্দের মতে, ‘কবিতা’ এবং ‘পদ্য’ অভিন্ন হতে পারে না; ‘পদ্য’ – যার ভেতর সমাজ-শিক্ষা, লোকশিক্ষা ও মতবাদের  অধিষ্ঠানই মুখ্য – কবিতা থেকে পৃথক; পদ্যের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী, পাঠককে দিতে পারে না সম্ভোগানন্দ; পাঠক বড়জোর নিম্নস্তরের তৃপ্তি বোধ করতে পারে। সাংবাদিকী ও প্রচারমর্মী রচনার সঙ্গে কবিতার পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত জিনিসগুলোর ভেতর অভিজ্ঞতাবিশোধিত ভাবনা-প্রতিভার মুক্তি, শুদ্ধি ও সংহতি কিছুই নেই; কবিতায় তা আছে।

কবির বৈশিষ্ট্য, কবিতা ও কবিতাসৃজন প্রক্রিয়া এই তিনটি বিষয় নিয়েই স্বীয় উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন জীবনানন্দ বিভিন্ন রচনায়। এক পর্যায়ে জীবনানন্দ সিদ্ধান্ত করেছেন, ‘কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুইরকম উৎসারণ।’  ১৯৫৪-তে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘…কবিতা অনেক রকম।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য।’ নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তা-ও প্রণিধানযোগ্য, ‘আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মনে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার, সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য – কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যেও কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।’

 

পাঁচ

কবিতার জন্মসূত্র সম্পর্কে জীবনানন্দের একটি অবিচল ধারণা ছিল। তিনি বারংবার উলেস্নখ করেছেন, কবিতা কবির সততাপ্রসূত অভিজ্ঞতা ও কল্পনাপ্রতিভার সন্তান।  ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত তাঁর প্রথম প্রবন্ধেই তিনি বলেছেন, কবির হৃদয়ে থাকবে কল্পনা এবং কল্পনার ভেতরে থাকবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র  সারবত্তা। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছিলেন এই শর্তপূরণের অভাবে সতীর্থদের কবিতা ভঙ্গুর ও নিরাবলম্ব হয়ে উঠেছে – চিন্তার ব্যায়ামের দৌরাত্ম্যে কবির অভিজ্ঞতা হয়ে পড়েছে রুগ্ণ, কংকালসার, পাঠকের হাতে পৌঁছুচ্ছে ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে পরিকল্পিত’ কবিতা। আবার নির্ভুল কাঠামো ও বিস্ময়োদ্রেককারী উক্তি সত্ত্বেও বিশুদ্ধ কাব্যরসে অরুচি তাঁদের কবিতাকে করে তুলেছে অস্ফুট ও অসার্থক, কখনো কেবল ‘সাংবাদিকী ও প্রচারধর্মী’।

জীবনানন্দ লক্ষ করেছিলেন তাঁর সতীর্থদের অনেকেই অডেনের কথা শিরোধার্য করে একের পর এক স্মরণীয় উক্তি (memorable speech) নির্মাণে মনোযোগী; কিন্তু শেষাবধি কারো কবিতা পর্যবসিত কেবল কতিপয় স্মরণযোগ্য উক্তির সমষ্টিতে, কারো কবিতার বাণী স্মরণীয়তর; কামিংসের মতো তাঁরা রচনা করে চলেছেন বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যসমুচ্চয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখি’ এবং সমর সেনের ‘নাগরিক’ পড়ে জীবনানন্দের মনে হয়েছিল : কবিদ্বয় নিরেট সাংবাদিকতার দেয়াল টপকে গেছেন মাত্র, ‘কিন্তু প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে ভাবপ্রতিভাকে শুদ্ধ করে নিয়ে তেমন কোনো জীবনদর্শন সৃষ্টি করতে পারেন নি, যাকে কবিতা বলা যায়।’ তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘কাব্য… যে ইতিহাস ধারার অনুগত, কবি সে ইতিহাস ও সমাজ পরিচ্ছন্নভাবে মর্মস্থ করতে পেরেছেন কি?’ আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় জীবনানন্দের কবিতার জগৎ একটি জীবনদর্শনের ব্যাপ্ত প্রকাশ।

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ হিসেবে অনুদার আমি হতে পারি, কিন্তু সময়-ও-সীমা-প্রসৃতির ভিতর সাহিত্যের পটভূমি বিমুক্ত দেখতে ভালোবাসি। তবু আমি এটা স্বীকার করব না যে ‘মেমোরেবল্  স্পীচ্’ মাত্রই কবিতা। কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ জীবনানন্দের এই যে দাবি – কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা এবং মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান – এ কেবল জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাষ্য নয়, এই দাবি সমসাময়িক আধুনিক কাব্যচেতনার দিকভ্রষ্টতার তিরস্কারও বটে; অন্যদিকে ত্রিশের আধুনিকতাবোধের এই সমালোচনা জীবনানন্দের কাব্যচেতনারও বিশ্বস্ত দিকনিরূপক।

তিরিশের দশকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার গোড়াপত্তন হয়েছিল একদিকে প্রতীচ্যের অগ্রজদের পদাঙ্কানুসরণে, অন্যদিকে রবীন্দ্রবিরোধিতায়। আধুনিকদের প্রতীচ্য-প্রীতি নিয়ে আপত্তি তোলেননি জীবনানন্দ; কিন্তু আধুনিকদের হাতে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যমোচন অনুমোদন করেননি তিনি। আধুনিকদের কাছে তিনি নিবেদন করেছেন : তাঁরা যেন অন্ধকারে দীর্ঘ শীত-রাত্রিটিরে ভালোবাসেন; তাঁরা যেন হৃদয়ঙ্গম করেন যে, শীতের রাত অপরূপ – মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে পূর্ণ; তারা যেন তাকিয়ে দেখেন শিকারির গুলির আঘাত এড়িয়ে কেমন করে বুনোহাঁস দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভেতরে উড়ে যায়; ভালোবেসে তারা যেন ধানের গুচ্ছের ওপর হাত রাখেন; গাছের সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হলুদ হয়ে যায় – এ যেন তাঁদের দৃষ্টি থেকে অপসারিত না হয়। এভাবেই আকাশচারী আধুনিকদের প্রতি মাটিতে অবতরণের আহবান জানিয়েছিলেন জীবনানন্দ। আবার এভাবেই তিরিশের সতীর্থদের থেকে তিনি আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘সকল দেশের সাহিত্যেই দেখা যায় একজন শ্রেষ্ঠতম কবির কাব্যে তাঁর যুগ এমন মানবীয় পূর্ণতায় প্রতিফলিত হয় যে, সেই যুগের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পথে যে-সব কবি নিজেদের ব্যক্ত করতে চান, ভাবে ভাষায়, কবিতার ইঙ্গিতে বা নিহিত অর্থে, সেই মহাকবিকে এড়িয়ে যাওয়া তাঁদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।’ দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় বটে কিন্তু জীবনানন্দের জন্য হয়নি সে-রকম। বরং সতীর্থদের জোট বেঁধে রবীন্দ্র-বিরোধিতার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। ‘লোকোত্তর রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘…রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ও ইঙ্গিত পেয়ে আজ যে আধুনিক কাব্যের ঈষৎ সূত্রপাত হয়েছে তার পরিণাম – বাংলা সাহিত্যও রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ভেঙ্গে ফেলে কোনো সম্পূর্ণ অভিনব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাহিত্যের ইতিহাস এরকম অজ্ঞাতকুলশীল জিনিষ নয়। ইংরেজ কবিরা যেমন যুগে যুগে ঘুরে ফিরে সেক্সপীয়র-এর কেন্দ্রিকতার থেকে সঞ্চারিত হয়ে বৃত্ত রচনা ক’রে ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, আমাদের কবিরাও রবীন্দ্রনাথকে পরিক্রমা ক’রে তাই করবে – এই ধারণা প্রত্যেক যুগসন্ধির মুখে নিতান্তই বিচারসাপেক্ষ বলে বোধ হলেও অনেককাল পর্যন্ত অমূলক বা অসঙ্গত বলে প্রমাণিত হবে না – এই আমার মনে হয়।’

জীবনানন্দ নিজেই ইংরেজি কবিতার এবং ইংরেজিতে অনূদিত ইয়োরোপীয় কবিতার, একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। ফলত আধুনিকতার নিক্তিতে তিনি পাশ্চাত্য ঘরানার অধিবাসী। তবে যদিও জীবনানন্দ গ্রহণ করেছেন প্রচুর, কিন্তু অনুসরণ করেননি কখনো। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য যে ‘…সহজেই প্রমাণ করে যে ইয়েটস্-এর ‘O Curlew’-র তুলনায় তাঁর ‘হায়, চিল’ অনেক বেশী তৃপ্তিকর কবিতা, আর ‘The Scholars’-এর সঙ্গে ‘সমারূঢ়ে’র সম্বন্ধ যেমন স্পষ্ট, তার স্বাতন্ত্র্যও তেমনি নির্ভুল। ‘Ode to Nightingale’-এর কোনো-কোনো পংক্তি ‘অবসরের গান’-এ কেমন নতুন শস্য হ’য়ে ফলে উঠেছে, তাও সহজেই বোধগম্য।’

 

ছয়

জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। তাতে জীবনানন্দীয় কবিসত্তার আভাসরেখা থাকলেও ঝরাপালকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার ও কাজী নজরুল ইসলামের স্পষ্ট প্রভাবই প্রথমত দৃষ্টিগোচর হয়। এ-রকম প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়; বরং রবীন্দ্রনাথের প্রভাব না-থাকার বিষয়টি বিবেচনার মতো। মনে রাখা দরকার, যে-সময়ে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার উন্মেষ, সে-সময়েই কবি হিসেবে জীবনানন্দের আবির্ভাব; কিন্তু এ পর্যায়ে প্রাক-আধুনিকতা কালের স্রোত অবসিত হয়ে যায়নি – তিরিশে আধুনিকতার শিলান্যাস হলেও যতীন্দ্রমোহন বাগচী বা জসীমউদ্দীনও লিখছেন, অব্যাহত রয়েছেন অবিশ্রান্ত রবীন্দ্রনাথ। এমন সময় ‘আধুনিক’ কবিদের চোখে ‘অনাধুনিক’দের কবিতা ‘পদ্য’ হিসেবে চিহ্নিত হতে লাগল।

রবীন্দ্র-ঐতিহের বিরোধীতা করেননি জীবনানন্দ, কিন্তু তাঁর কাব্য সৃষ্টির প্রণোদনা ছিল ভিন্ন, ফলে অচিরেই তিনি আধুনিকদের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। তারপর একসময় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন। তৈরি হয়েছে আজ যাকে আমরা ‘জীবনানন্দীয় ভুবন’ বলে আখ্যায়িত করি। ঝরাপালকের তৃতীয় কবিতা ‘নব নবীনের লাগি’র একটি স্তবক এরকম :

গাহি মানবের জয়!

– কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!

সবার প্রাণের অশ্রম্ন-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,

কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে, – কোটি কোটি শিখা

জাগে,

প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে,

আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!

জয় মানবের জয়!

ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ (বাংলা ১৩৪৪) সালে। এর কবিতাগুলো আগের কয়েক বছরে লেখা। জীবনানন্দ তরুণ, বয়স কুড়ির কোঠায়। বিষয়বস্ত্ত, শব্দচয়ন, ছন্দ বা কাব্যদর্শন তখনো স্বকীয় হয়ে ওঠেনি। কেবল কাঠামোতে একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় : প্রথাগত নিপাট অমত্ম্যমিলের পরিবর্তে আমত্মঃমিলের প্রতি স্বভাবী প্রশ্রয়।

দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করলে দেখা যায় চূড়ান্ত প্রকরণটি খুঁজে না-পেলেও ঝরাপালকেই জীবনানন্দ তাঁর মূল কাব্যচেতনার দেখা পেতে শুরু করেছেন। ‘অস্ত চাঁদে’ কবিতাটির প্রথম স্তবকটি দেখলে মনে হয় কেউ যেন কাঁচা হাতে জীবনানন্দকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে :

ভালোবাসিয়াছি আমি অস্ত চাঁদ, – ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!

– অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে কালো নদী, ঢেউয়ের কলসী,

নিঝ্ঝুম বিছানার ’পরে

মেঘ-বৌ’র খোঁপাখসা জ্যোৎস্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,-

সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে ফিরে ফিরে

মাঠে ঘাটে একা একা, – বুনোহাঁস – জোনাকির ভিড়ে!

দুশ্চর দেউলে কোন্ – কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে

দূর ঊর – ব্যাবিলোন – মিশরের মরুভূ’-সঙ্কটে,

দীর্ঘকাল আগে বুদ্ধদেব বসু দৃঢ় বিশ্বাসে আমাদের জানিয়েছিলেন যে, জীবনানন্দ একটি কাব্যভাষা নির্মাণ করেছিলেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। উপর্যুক্ত কবিতাটিতে ‘বুনোহাঁস’, ‘জোনাকির ভীড়’, ‘ব্যাবিলোন’, ‘মিশরের মরুভূমি’, ‘আসীরীয় সম্রাট’, পূর্ব-দক্ষিণ ফ্রান্সে অবস্থিত ‘প্রম্নভেন্স’ অঞ্চলের ‘ক্রুবাদুর’, ‘অলিভ পাতা’ ইত্যাদির ব্যবহারে এ-ভাষার সূত্রপাত লক্ষণীয়। ঝরাপালকেই জীবনানন্দের দিকদর্শন আভাসিত হয়েছিল : ‘চাঁদ আজো জেগে আছে অপলক যদিও ব্যাবিলোন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে’; ‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়’; ‘নিবিড় কাননে, তটিনীর কূলে ঘুঘু ঘরিয়াল ডাহুক শালিক গাঙচিল বুনোহাঁস ফিরে ফিরে ডেকে যায়।’ এভাবেই তাঁর কবিতা শুরু থেকেই হয়ে উঠেছে প্রবলভাবে ইন্দ্রিয়সংবেদী। কেবল বিশিষ্ট কাব্যভাষাই নয়, শব্দ দিয়ে ধ্বনিময়, দৃশ্যমান, স্পর্শনীয় চিত্রাবলিতে অলক্ষ্যে স্বীয় দার্শনিকতা গেঁথে তুলবার কৌশলটির অনন্য স্বকীয়কতা দৃষ্টি এড়াবার নয়।

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি জীবনানন্দের প্রথম পরিচায়ক কবিকৃতি। এই ক্ষীণতনু গ্রন্থে ছিল সেই সব অমর কবিতা – ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘মাঠের গল্প’, ‘সহজ’, ‘কয়েকটি লাইন’, ‘অনেক আকাশ’, ‘পরস্পর’, ‘বোধ’, ‘অবসরের গান’, ‘ক্যাম্পে’, ‘জীবন’, ‘শকুন’, ‘স্বপ্নের হাতে’ এবং ‘মৃত্যুর আগে’। ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬-এ ঝরাপালক প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর। এই দীর্ঘ পরিসরে জীবনানন্দীয় কবিতার জগৎ পরিব্যাপ্ত হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই অবসরে বাণী, শব্দচয়ন, উপমা নির্মাণ আর ভঙ্গিতে জীবনানন্দ সুস্থির হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এইসব বহিরাঙ্গিক চারিত্র্যলক্ষণ নিরূপিত হলেও জীবনানন্দ সহসা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেননি, বোধগম্য হয়ে ওঠেনি তাঁর কবিচেতনার দর্শন; এমনকি রবীন্দ্রনাথের কাছেও নয়। কেননা, কবিতা পত্রিকায় যখন ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি ছাপা হলো তখন রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ওই কবিতাটির কেবল চিত্ররূপময়তার কথাই উলেস্নখ করেছেন – জীবনানন্দের জীবনবোধের কোনো পরিচয়-ইঙ্গিত তাঁর মন্তব্যে আদৌ ছিল না। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত শনিবারের চিঠির বিশ্লেষণ স্মরণযোগ্য :

…তাঁর কাব্যের জগৎ ছিল তাঁর একান্তই নিজস্ব। যে কাব্যলোকে সাধারণ পাঠকের পরিচিত তার সঙ্গে মেলাতে গেলে জীবনানন্দের কবিতা অদ্ভুত, দুর্বোধ্য ও সঙ্গতিহীন মনে হওয়া কিছু আশ্চর্য নয়। তাঁর মন যেন চলেছিল প্রচলিত ভাব ভাবনার ও চিন্তার পথ এড়িয়ে অন্যপথে, তাঁর উপমাগুলো যেন, অন্যরকম, তাঁর ছবিগুলো যেন অন্যভাবে আঁকা। সেইজন্য কবিমন ভিন্ন অন্যধরনের মনে জীবনানন্দের কবিতার আবেদন যথাযথভাবে এবং জোরালোভাবে পৌঁছানো শক্ত। সেই হিসেবে তাঁকে কবিদের কবি বলা অন্যায় বলা হবে না। এমন কি কবিদের মধ্যেও সকলের পক্ষে জীবনানন্দের কবিতার রস সম্পূর্ণ উপভোগ করা হয়তো সম্ভব হয় নি।

 

সাত

ঝরাপালকধূসর পাণ্ডুলিপির পর জীবদ্দশায় প্রকাশিত জীবনানন্দের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো – বনলতা সেন (১৯৪২, বর্ধিত সংস্করণ ১৯৫২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪) এবং সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)। ১৯৫৪-এ জীবনানন্দের মৃত্যুর পর অপ্রকাশিত বা অগ্রন্থিত কবিতা সমবায়ে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে : রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১), গোপালচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে প্রকাশিত সুদর্শনা (১৯৭৩), ময়ূখ বসুর পরিকল্পনায় মনবিহঙ্গম (১৯৮০), অশোকানন্দ দাশের সম্পাদনায় আলোপৃথিবী (১৯৮৩), ভূমেন্দ্র গুহ ও প্রিয়ব্রত দেবের যৌথ উদ্যোগে হে প্রেম তোমাকে ভেবে ভেবে (১৯৯৮), ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর পরিকল্পনায় অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯), ভূমেন্দ্র গুহ ও গৌতম মিত্রের যৌথ সম্পাদনায় ছায়া আবছায়া (২০০৪) এবং ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সম্পাদনায় কৃষ্ণাদশমী (২০১৫), সূর্য-অসূর্যলোক (২০১৭) ও জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতা (২০১৭)। এছাড়া গৌতম মিত্র অপ্রকাশিত জীবনানন্দ শিরোনামে দুই খণ্ড ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে চলিস্নশটি এবং ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে তেইশটি অর্থাৎ মোট ৬৩টি অপ্রকাশিত কবিতা প্রকাশ করেছেন। প্রতীয়মান হয়, তিনি জীবনানন্দের হারিয়ে যাওয়া অনেক পাণ্ডুলিপির খাতার দুটি ২০১৪ সালে পুনরুদ্ধারে সমর্থ হয়েছেন।

জীবনানন্দের জীবৎকালে প্রকাশিত গ্রন্থর্ভূত কবিতাগুলো পর্যালোচনা করে কোনো ক্রমিক পরিবর্তনের পথরেখা সন্ধান করা সমীচীন হবে না। জীবনানন্দ লিখেছেন অনেক, কিন্তু প্রকাশ করেছেন সামান্য। একই কাব্যগ্রন্থের ভেতর সন্নিবিশষ্ট হয়েছে বিভিন্ন সময়ে লিখিত কবিতা। স্মরণীয় মহাপৃথিবীর কবিতাগুলো ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৪৫-৪৮ এই দীর্ঘ কালপরিসরে লিখিত; অন্যদিকে বেলা অবেলা কালবেলার জন্য নির্বাচিত কবিতাগুলো লিখিত হয়েছিল ১৯৩৪ থেকে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দব্যাপী কালপরিসরে। পাঠক শুদ্ধ রূপসী বাংলাতেই একটি অখ- কাব্যের আস্বাদ লাভ করতে পারেন; অন্য প্রায় সকল গ্রন্থই মিশ্রসংকলনের মতো বললে অন্যায্য হয় না। তবে এটা ঠিক বনলতা সেন এবং সাতটি তারার তিমিরের মধ্যে সুস্পষ্ট রয়েছে। যেমন বনলতা সেনে আমরা পাঠ করি :

সমস্ত  দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; …

(‘বনলতা সেন’)

অন্যদিকে সাতটি তারার তিমির আমরা পাঠ করি :

সান্টা ক্রুজ্ থেকে নেমে অপরাহ্ণে জুহুর সমুদ্রপারে গিয়ে

কিছুটা  স্তব্ধতা ভিক্ষা করেছিলো সূর্যের নিকট থেমে সোমেন

পালিত;

বাংলার থেকে এত দূরে এসে – সমাজ, দর্শন, তত্ত্ব, বিজ্ঞান

হারিয়ে,

প্রেমকেও যৌবনের কামাখ্যার দিকে ফেলে পশ্চিমের সমুদ্রের

তীরে

ভেবেছিলো বালির উপর দিয়ে সাগরের লঘুচোখ কাঁকড়ার

মতন শরীরে

ধবল বাতাস খাবে সারাদিন; …

(‘জুহু’, সাতটি তারার তিমির)

স্পষ্টত উপমার বর্ণচ্ছটা ইত্যবসরে অনেকখানি প্রশমিত হয়ে এসেছে; তীব্র – প্রায় জান্তব – ইন্দ্রিয়বোধ স্তিমিত হয়েছে; কোনো এক সুনির্দিষ্ট জীবনবোধের অন্বেষায় অন্তর্লিপ্ত জীবনানন্দ যেন দূরবগাহ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু জীবনানন্দের পরিবর্তনের ধারা অনুধাবন করতে হলে কলকাতার ভারতের জাতীয়  গ্রন্থাগারে রক্ষেত ৪৮টি পাণ্ডুলিপির খাতা ধারাবাহিকভাবে পড়বার প্রয়োজন রয়েছে, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থাদি থেকে তা অনুধাবনীয় নয়।

 

আট

পশ্চিমের প্রভাবে তিরিশের আধুনিকদের হাতে খানিকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যমোচন হয়েছিল। অথচ এই ঐতিহ্যমোচনের বিনিময়ে অর্জিত হয়নি প্রবল কোনো সাহিত্যকৃতি। শুধু রবীন্দ্রনাথের বৈভবকে অস্বীকার নয়, আধুনিকেরা তাঁদের সামাজিক অস্তিত্বের শেকড়কেও অস্বীকার করেছিলেন; নিজ অভিজ্ঞতার বাইরে আত্মোপলব্ধির একেকটি কষ্টকল্পিত ভূগোল তাঁরা রচনা করে চলেছিলেন নিবিষ্ট মনোযোগে।

অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশের কাব্যপ্রবাহে রবীন্দ্রনাথকে সচেতনভাবে ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ছিল না। রবীন্দ্রনাথেরই অনপনেয় ছায়ার পরিপ্রেক্ষেতে জীবনানন্দ দাশের কাব্য নিজ অভিজ্ঞতাপ্রসূত স্বাবলম্বনের ক্রমান্বয়ী বিবর্তন ধারা বয়ে চলেছিল। যে জীবন ও নিসর্গের ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, তার জন্যে সর্বজনবোধ্য সম্পূর্ণ নতুন এক কাব্যভাষা, নতুন একগুচ্ছ শব্দের প্রয়োজন হয়েছিল। কথ্য শব্দের ব্যবহারে সৃষ্টি হয়েছিল অনির্বচনীয় আবেদন। জীবনানন্দের কবিকৃতি এক অর্থে এই শব্দভা-ার সৃষ্টির, এই শব্দক্রীড়ার পরিণতি। কিন্তু এই শব্দক্রীড়া মালার্মে-কথিত কবিতার শব্দকেন্দ্রিকতা নয়; কেননা জীবনানন্দের হাতে শব্দপুঞ্জ চিরাচরিত অর্থনিছকতা থেকে অর্থসিদ্ধ চিত্ররূপময়তায় মুক্তি পেয়েছিল :-

বিস্মৃত নদীর প্রেত – বিবর্ণ – নির্জন

ভেসে আসে হাড়ে যেন সন্ধ্যার আঁধারে

হে দেবতা, সৌন্দর্যেরে তুলে তুমি দিলে কোন্ পারে

বলিলাম, এক গাল বাতাসের দুর্বল আহ্লাদে

যৌবনের সৌন্দর্যেরা চারি-দিকে হেমন্তের মত;-

অন্ধকারে ডুবে যেতে কত দেরি রয়েছে বল ত’

জামা প’রে আচ্ছন্ন ধূসর

বেড়াতেছ প্রান্তরের পর

আজ রাতে তোমারে কে চেনে

বিবর্ণ জামার মত তোমার দেহের আজ

পৃথিবীর বন্দরে কে কেনে

এক মুঠো খই আর কানাকড়ি দিয়ে

কোনও এক বুনো হাঁস ধবল উড্ডীন পাখা নিয়ে

ক্ষত নিয়ে যদিও ঝরিয়া পড়ে ব্যাপ্ত শরে – কাদার ভিতর

কাদা নয় – ধবল উড্ডীন প্রেম জ্যোৎস্নায়

আমাদের স্বপনের ঘর।

বস্ত্তত ‘মালার্মে-প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট; আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ’ বলেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পক্ষে যা সম্ভবপর ছিল না, জীবনানন্দের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছিল সহজাত অনায়াসে – কেননা, অভূতপূর্ব শব্দচাতুর্যের মধ্যস্থতায় জীবনানন্দের হাতে ভাষার সঙ্গে সর্বজনীন মানবীয় অভিব্যক্তির সফল সংশ্লেষ ঘটেছিল। বিংশ শতাব্দীর নিসর্গচ্যুত নিরাবলম্ব অথচ গাঢ়-সংবেদী নাগরিক মানুষের জীবনবোধ জীবনানন্দের কবিতায় শিল্পমণ্ডত প্রতিচ্ছায়া খুঁজে পেয়েছিল। অন্যদিকে শব্দকে ছন্দে ধারণ করতে গিয়ে  জীবনানন্দ দীর্ঘ কালের কঠোর প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি দিয়েছেন শব্দের বিন্যাস আর শাসন। এক জাদুঘরে হাতে তিনি – জীবনানন্দ দাশ – সৃষ্টি করেছেন এক অদ্ভুত ছন্দের সংগীত যা কানের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যায় গভীরে। শব্দবিন্যাসে তিনি অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন করেছিলেন, যা আজো অননুকরণীয় রয়ে গেছে :

আজকে রাতে তোমায় আমার কাছে পেলে কথা

বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার

প্রান্তর।

কিন্তু যেই নিট নিয়মে ভাবনা আবেগ ভাব

বিশুদ্ধ হয় বিষয় ও তার যুক্তির ভিতর;

আমিও সেই ফলাফলের ভিতরে থেকে গিয়ে

দেখেছি ভারত লন্ডন রোম নিউইয়র্ক চীন

আজকে রাতের ইতিহাস ও মৃত ম্যামথ সব

নিবিড় নিয়মাধীন।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমরা এক দূর আবহ প্রত্যক্ষ করি; দেখি এক গম্ভীর প্রসন্নতা সারাকাব্যে ছড়িয়ে দিয়েছে দুর্মর আকর্ষণ, সেখানে অলৌকিক মনোভুবনের ইঙ্গিত আমাদের স্পৃষ্ট করে। মানুষের ক্লান্তি-নিদ্রা-অবসাদ, জীবন-মৃত্যুর দোলাচল, দূরত্ব-নৈকট্যের জোয়ারভাটা, মানবসভ্যতার নিয়তিলাঞ্ছিত ইতিহাস, মানুষের নিরাবলম্ব অস্তিত্ব, নিসর্গের করুণ-বিষণ্ণ রূপ, জীবনানন্দের চেতনাকে দান করেছে প্রসন্ন গাম্ভীর্য। বর্তমানকে অতীতের সঙ্গে মিশিয়ে, নিকটের সঙ্গে সুদূরকে সংঘবদ্ধ করে, সচেতনতার সঙ্গে অবচেতনার সংশ্লেষ করে, সর্বোপরি অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনাকে জারিত করে  তিনি সৃষ্টি করেছেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মোহন এক ভুবন।

বস্ত্তত শিল্পসৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে, হিসেব-নিকেশ করে কবিতা নির্মাণ, কলাকৈবল্যবাদী কাব্যবোধ, নৈরাত্ম্যরীতি বা অন্য কোনো নির্মাণ কৌশল, বৃত্তাবদ্ধ দর্শন বা ছন্দের নির্দিষ্ট কাঠামো –  এ-ধরনের কোনো ছকধর্মিতাকেই গ্রহণযোগ্য আদর্শ বলে মেনে নেননি জীবনানন্দ। রীতিপ্রকরণের চর্চা নয়, তাঁর কবিতায় নিপুণ প্রয়োগে শব্দপুঞ্জ শিল্পে উত্তীর্ণ হয়েছে। সেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-কথিত সেন্স অব ফর্ম অগ্রাহ্য করে তিনি দেখিয়েছেন কী করে শব্দের প্রাকৃত প্রবহমানতা সৃষ্টি করতে সমর্থ অবিন্যস্ত সৌন্দর্য; কবিতা হয়ে ওঠে বাঙ্ময় ছবি আর অনিঃশেষ সংগীত যার কাছে অর্থদ্যোতনার দাবি অদম্য হয়ে ওঠে না।

দুঃখজনক যে, কেবল বনলতা সেন বা রূপসী বাংলা পাঠ করে করে আমাদের ঘড়ির কাঁটা সময়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়। বস্ত্তত জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতা পঠিত নয় আদৌ। তাঁর প্রায় আড়াই হাজার কবিতার মধ্যে রয়েছে বহু পরাক্রমশালী কবিতা যা বাংলা কবিতার সনাতন পাঠকের কাব্যবোধ এক ঝাঁকুনিতে পুনর্বিন্যস্ত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সহস্রাধিক কবিতায় এমন এক চেতনাপ্রবাহ ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবনানন্দ ছত্র থেকে ছত্রান্তরে যা বোধের অগম্য নয়, যদিও বোধের অধিগম্যতার মুখাপেক্ষী নয় আদৌ। মন্ত্রোচ্চারণের মতো পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি লিখে গেছেন জীবনানন্দ, যার চিন্তাসূত্রের আদি-অন্ত নিরূপণ করার আগেই আমাদের অনুভূতি স্পৃষ্ট হয় সংগীতে, চিন্তায়, প্রশ্নে ও বেদনায়। তখন আমাদের কবি নৈরাশ্যবাদী কি আশাবাদী, জীবনমুখী কি পলায়নবাদী, রোমান্টিক কি ক্ল্যাসিক্যাল – ইত্যাদি অনাদিপ্রচলিত তকমাগুলো অসহায় হয়ে পড়ে;  কবিতা সম্পর্কে আমাদের সকল আপ্ত ধারণা ব্যবহৃত ঠোঙার মতো দুমড়ে-মুচড়ে যায়; আমাদের মস্তিষ্ক-ধৃত দৈনন্দিন অভিধান গুটিয়ে নেয় সহযোগিতার হাত; আমাদের বোধ ও বোধি কুমারীর প্রথম রাগমোচনের নিবিড় ব্যথা ও গভীর সুখে যুগপৎ কাতর হয়ে পড়ে।

কার কবি জীবনানন্দ, কবেকার? কীসের কবিতা তাঁর? জীবনশিল্পী তিনি? ছদ্মবেশী ইতিহাসবিদ? নৃতত্ত্ববিদ কোনো? নিঃসঙ্গ পরিব্রাজক? এসব অনিবার্য প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের বনলতা সেন আর রূপসী বাংলার মায়াবীর জাদু ভেঙে যেতে হবে আরো উজানে, যেখানে শব্দের খেলা গাঢ়তর হয়ে স্পর্শ করেছে অলৌকিক অদৃষ্টপূর্ব দিগন্ত এক, সেখানে দৃশ্য ও কল্পনা, ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, চিন্তা-অনুচিন্তন, ছন্দ-ছন্দহীনতা আর বোধ-উপলব্ধি মিশ্রিত হয়েছে অতলান্ত মূর্ছনায় :

সময় ঘুরিতে আছে যেন কোনও মরুভূর উটপাখি

গৌরবের নীহারিকা শস্নাঘার মধ্যাহ্ন রৌদ্রে, লালসায়, –  ভাঁড়ামির বালির বিবরে

হে নাবিক দূর মধ্যসমুদ্রের আঁধারের

জাহাজের কম্পাস’এর কাঁটা তবু কোনও এক ঐকতান ছাড়া আর কিছু জানে না কি?

এরা সব নিয়োজিত প্রতিভার স্বেদ শুধু?

প্রেম? মৃত্যু? – শান্তি, আহা?

রাতের বাতাস আসে বৃষ্টির মেঘের ঘ্রাণ নিয়ে

চারি-দিকে নিস্তব্ধতা

এখন কি হয় নাই নিবিড় সময়

উটপাখি, কম্পাস’এর কাঁটা পুথিপত্র, মানচিত্র রেখে দিয়ে

দুই ইঞ্চি পাথরের তথাগত-মূর্তি হয়ে

নগরে বন্দরে যুদ্ধক্ষেত্রে গণিকার ঘরে

ভ্রাম্যমাণ লাঞ্ছনায় কেবলই ঘুরিব আমি অনন্ত বিষুবরেখা ধ’রে?-

অবিরল (নির্বাণের) শান্তি ছাড়া কিছু বুঝিব না তবু আর?

 

(‘সময় ঘুরিতে আছে’, সূর্য-অসূর্যলোক) r