জীবনের ক্ষুদ্র চিত্রাংশ

মামুন রশীদ

কীভাবে শরীর বৃক্ষ হয়ে যায়
ইকবাল আজিজ
অয়ন প্রকাশ
ঢাকা, ২০১০
১০০ টাকা
 

‘আমাকে কোথায় ঠেলে দেবে?

আমাকে কেন ঠেলে দেবে সীমান্তের ওই পারে?

আমার অপরাধ : আমার নাম ইকবাল আজিজ

আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি…

উপমহাদেশের বর্ণবৈচিত্র্যের মাঝে আমি

ঘুরে বেড়াবো বন্ধনহীন

শীতের শিশির ভেজা দিল্লির বস্তিতে

কিংবা অন্তহীন ডাকাতের দৃষ্টি এড়িয়ে

মধ্যপ্রদেশে কোনো নির্জন মফস্বল বাজারে।

আমি কি এভাবে ঘুরে বেড়াবো সারাজীবন?

এই উপমহাদেশে আমার স্বাধীন আত্মা ঘুরে বেড়াবে

স্বাধীনতার প্রদীপ জ্বেলে।’

                                       (‘পুশব্যাক পুশইন’)

কবি, যে-কোনো সমাজের ভেতরের মানুষ। সমাজের ভেতর থেকে জীবনকে দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা একজন সচেতন মানুষ। তিনি নিজের বেড়ে ওঠার ভেতরে সমাজ থেকে, নিজের চারপাশের পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করেন তথ্য-উপাত্ত। এই তথ্য, এই উপাত্তে ভরে থাকে চারপাশের মানুষ, জীবন, ধর্ম, দর্শন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কবিই কখনো নিজেকে সার্থক করে তুলতে পারেননি। বরং যাঁর অভিজ্ঞতা যত বেশি, জীবনকে যিনি যতভাবে নেড়ে-চেড়ে দেখেছেন, জটিল গলি-ঘুঁজি খুঁজে বেড়িয়েছেন – সেখান থেকে চেনা দৃশ্য – অভিজ্ঞতার বর্ণমালায় সাজিয়ে তুলেছেন, তিনি ততো বেশি আদৃত। আর এই দেখার অভিজ্ঞতাই কবিকে, কবির বর্ণনাভঙ্গিকে করে তোলে মনোরম, যা সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে আলাদা করে তোলে।

কবি হলেন সময়ের সন্তান। সময়কে ধারণ করেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে একজন কবি বর্ণমালার পর কর্ণমালা সাজিয়ে তৈরি করেন আপন ভুবন। যে-ভুবনে মানুষ খুঁজে পায় নিজেকে। একাত্ম করে তুলতে পারে কবির ভুবনের সঙ্গে নিজের তথা পাঠকের ভুবন। পাঠকের মনোজগতের সঙ্গে যে-কবি নিজেকে যতটা সম্পৃক্ত করে তুলতে পারেন তিনি ততো হয়ে ওঠেন পাঠকের হৃদয়ের কাছের মানুষ। তার পঙ্ক্তি ততো বেশি নাড়া দেয় পাঠককে। পাঠককে নাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্নতা। কারণ রুচি  ভেদে পাঠকহৃদয় পরিবর্তন হয়। আর এ রুচি গড়ে ওঠে পাঠকের পঠন-পাঠন, তার পরিবেশ-প্রতিবেশ ঘিরে। চর্যাপদের যে পাঠক-শ্রোতা ছিল তাদের রুচির সঙ্গে বর্তমানের পাঠকের রুচির বিস্তর ব্যবধান ঘটে গেছে। কারণ সময়। সময়ের হাত ধরে  সমাজ-সংসার-বিশ্বে যেমন বিপুল পরিবর্তন এসেছে, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রে – কবির ক্ষেত্রে – কবিতার পাঠকের ক্ষেত্রেও এসেছে বিপুল পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনকে ধারণ করেই কবিরা তাঁদের কবিতার ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন পাঠকের সামনে। হাজারো ঝাঁপি থেকে পাঠক তার রুচি দিয়ে গ্রহণ করেছে প্রিয়তম কবিতা।

ইকবাল আজিজ। আমাদের কবিতার ভুবনে এসেছেন সত্তরের দশকের হাত ধরে। সত্তরের দশক আমাদের জাতীয় জীবনে, আমাদের রাজনৈতিক জীবনে একটি জ্বলজ্বলে সময়। সত্তরের দশকের উপস্থিতি আমাদের সমাজে এবং রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য সময়। আবার একটু পেছনে ফিরে যদি তাকাই তাহলে দেখি ইকবাল আজিজের জন্ম ১৯৫৫ সালে। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন একটি ভূখন্ডের জন্ম, যার রক্তাক্ত ইতিহাস, স্বাধীনতার জ্বলজ্বলে স্মৃতির মাঝে ইকবাল আজিজের বেড়ে ওঠা। পাকিস্তান নামক নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই ভেঙে পড়ার যে-অস্থিরতা সময়ের পরতে পরতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক সে-সময়ে বেড়ে উঠেছেন ইকবাল আজিজ। নবগঠিত দেশের এক অংশে যখন শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা আর ঘৃণার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে, জ্বলে উঠতে শুরু করেছে, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক আবহাওয়া, সে-সময়ে ইকবাল আজিজ পার করছেন শৈশব এবং যৌবনের দুরন্ত সময়। চোখের সামনে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা দেখছেন ইকবাল আজিজ। টানাপড়েনের দিন পেরিয়ে দেখেছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনার মাঝে কবিতার জগতে প্রবেশ করেন ইকবাল আজিজ – সময়টা বাংলা কবিতার ইতিহাসে সত্তরের দশক।

ইকবাল আজিজকে যদি দশক ধরে বিচার করা হয়, তাহলে তিনি সত্তরের দশকের কবি। তবে তাঁর সময়ের অন্যদের থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করে ফেলেছেন নিজের প্রকাশভঙ্গি দিয়ে। তাঁর কবিতায় উচ্চস্বর অনুপস্থিত। তিনি নিচু লয়ে নিজেকে ব্যক্ত করেন পাঠকের কাছে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও সময় মাঝে মাঝে দিকভ্রান্ত করতে চাইলেও মূলত প্রেমেরই কবি ইকবাল আজিজ। কারণ মানুষের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধই ইকবাল আজিজকে প্রেমিক করে তুলেছে। আর তাই হয়তো তিনি বলতে পারেন –

তুমি বলেছিলে, ঝরে যাবে মরে যাবে একদিন

তুমি বলেছিলে, শোধ করে দেবে সব ঋণ

তুমি বলেছিলে, মৃত্যু নয় পুনর্জন্ম হবে

                    আবার তোমার –

চিনে নেবো জোছনায় নীলরং সেই কণ্ঠহার।

                  (‘বলেছিলে ঝরে যাবে’)

স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ইকবাল আজিজকে কবি করেছে। তাঁর কবিতায় প্রেম, দ্রোহ একাকার হয়ে আছে। যেখানে তিনি ব্যক্তিক প্রেমকে সর্বজনীন করে তোলেন। ইকবালের কবিতায় গল্প আছে, ছবি আছে, আছে ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’। কারণ ইকবাল আজিজ কবিতায় ছবি অাঁকেন শব্দে – ‘পাতা ঝরে যায় আর ফুল ঝরে পড়ে/ সারাদিন সারারাত শুধু শেফালিরা ঝরে -/ মনে হয় মৃত হয়ে গেলে/ কেমন শেফালি ফুল ঝরে রবে লাশের ওপর’। (‘পাতা ঝরে যায় আর ফুল ঝরে পড়ে’)

আঙ্গিক বিচারে বর্ণনাধর্মী ইকবাল আজিজের কবিতা। সেই বর্ণনা কখনো কখনো একাধিক দ্যোতনা তৈরি করে। আর সেই দ্যোতনার কারণেই জীবনের কাছে দাঁড়িয়ে জীবনকে খুব গভীরভাবে দেখার এবং সেই দেখা থেকে সচেতনভাবে বর্ণনার ক্ষমতা অর্জন করেছেন ইকবাল আজিজ। একটি কবিতা উদ্ধৃত করি – অবশেষে এ ছেলেটি ভক্ত হতে গিয়ে শত্রু হয়ে গেল;/ অথচ আমার মনে হয়েছিল, বহুদিন পর আমি পেয়ে গেছি/ অবিকল এক কবিভক্ত হাঁদারাম!/ কিন্তু পরে দেখি এ বিড়াল নয়,/ রীতিমতো মানুষখেকো বাঘের ছায়া/ অতঃপর আমিও অাঁকড়ে ধরি জল ছল ছল মায়া।/ ছেলেটি সাভার জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস থেকে/ প্রায়ই আসতো;/ রাত আটটার বাসে শাহবাগ থেকে ফিরে যেত।/ ছেলেটি আসলে আগুনের শিখা হয়ে/ আকাশ পোড়াতে চেয়েছিল;/ একদিন নিজেই সে পুড়ে ধূসর কয়লা হয়ে গেছে।/ মহাকাল তাকে ভুলে গেছে।/ এ ছেলেটি একদিন ভক্ত হতে গিয়ে সহসাই/ শত্রু হয়ে গিয়েছিল।/ আমি অনুক্ষণ তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত/ কামনা করি। (‘এ ছেলেটি শত্রু হয়ে গেল’)  সচেতন পাঠকের কাছে কবিতার ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। বিচ্ছিন্নতা নয়, বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায় ইকবাল আজিজের কবিতা এবং কবিতার পরিবেশ। সেখানে বিমূর্ততা নয়, বরং মূর্ততার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন ইকবাল আজিজ। কবিতায় ইকবাল আজিজ কোনো ঘোরানো-প্যাঁচানো পঙ্ক্তির মধ্যে পাঠককে আবদ্ধ রাখেন না। বরং তাঁর কবিতার পাঠক তাঁর কবিতার আপাত সরলতায় মোড়ানো পঙ্ক্তির মাঝেই উপলব্ধি করেন তাঁর কাব্যভাবনা।

ইকবাল আজিজের কবিতা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিই –

‘মনে হয় মরে গেছি মনে হয় জেগে আছি আমি/ গভীর বৃষ্টির জলে ভিজে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে/ ধীরে ধীরে বুড়িগঙ্গা নদীর শরীরে।/ ভেসে আছি ছিন্নভিন্ন দেহ সুগভীর ব্যথা নিয়ে -/…/ মহাবিশ্বে ছড়িয়েছে প্রাণ থরে থরে;/ মনে হয় ঘুমিয়েছি ঠিক গতকাল/  মনে হয় মরে গেছি মনে হয় জেগে আছি চিরকাল।’ (‘মৃত্যু আর জীবনের কাব্য’)

আরো একটি কবিতার অংশবিশেষ তুলে ধরছি –

‘তবু মাঝরাতে বুকে চেপেছিল মহাকালের অন্ধবোবা/ গঁ গঁ শব্দ তার শোনা যায়/ ট্রাম ছুটে যায়, চারপাশে দুঃখের আনন্দ -/ দাঁড়িয়ে আছেন মহাকালের কাঠগড়ায় রসিক আত্মভোলা/ জীবনানন্দ।’ (‘দুঃখের আনন্দ জীবনানন্দ’)।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-পরবর্তী কবিদের কবি হয়ে ওঠার পেছনে যতো চেষ্টা ছিল তার বেশিরভাগই ছিল রবীন্দ্রভাবনা যেন তাঁদের কাব্যভাবনাকে গ্রাস না করে। রবীন্দ্রবিরোধীতাকে উপজীব্য করেই সে-সময়ে কবিরা কাব্যচর্চায় মনোযোগ দিয়েছেন। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ঠিক একই অবস্থা উত্তররৈবিক কবিতার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। উত্তররৈবিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ জীবনানন্দ দাশ। ত্রিশের দশকের পর যেসব কবি কাব্যসাধনায় ব্রতী হয়েছেন তাঁদের জন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশকে অস্বীকার করে নয়, বরং তাঁকে আত্মস্থ করেই তাঁর কাব্যভাবনা ছাপিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র প্রকাশে ব্রতী হয়েছেন উত্তররৈবিক বাংলা কবিতার ভুবনে যাঁরা এসেছেন। ইকবাল আজিজের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ওপরে উদ্ধৃত দুটি কবিতার প্রথমটি পাঠের পর পাঠকের মনে ভেসে ওঠেন জীবনানন্দ দাশ, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতেও তাই। তবে, জীবনানন্দীয় কাব্যগন্ধ ইকবাল আজিজের কবিতায় থাকলেও তিনি ঠিক অনুসরণ নয়, বরং জীবনানন্দ দাশকে আত্মস্থ করেই নিজস্ব কাব্যভুবন নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। যা তাঁকে, ইকবাল আজিজকে, তাঁর স্বতন্ত্রতায় চিহ্নিত করেছে। আর এই স্বতন্ত্রতার ভুবনে ইকবাল আজিজের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাঁর কবিতার বর্ণনাভঙ্গিতে এবং শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে সেই বর্ণনার বিশ্লেষণে। যখন তিনি বলেন, – ‘আশা ছিল চাকরিটা পাবো, এইভাবে আশায় আশায় একটি বছর -/ পার হয়ে যায় কত বিপ্লবের মেলা স্বপ্নময় খেলা অগ্নিময় ঝড়;/ আশায় আশায় পার হয়ে যায় এই রুক্ষ শহরের বুকে কর্মহীন একটি বছর।/ গত বছর এই দিনে রমনায় ভার্সিটির গা ঘেঁষে অনেক/ বাগানবিলাস ফুটেছিল -/ আজো ফুটেছে আশ্চর্য লাল সেই বোগেনভেলিয়া/ দেয়ালের পরে পাশাপাশি;/ যেমন আমিও এই পথ দিয়ে রক্তিম ফুলার রোড থেকে একা ফিরে আসি।/ আশাকরি চাকরিটা হবে, এইভাবে অন্তহীন আশা ঝরে যায়;/ চাকরিটা কখনোই হয় না আমার; রাক্ষসেরা চাকরিটা গিলে খায়।’ (‘স্তব্ধতার ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন-১০’)

সহজ-সরল আটপৌরে শব্দে ইকবাল আজিজ বোধের যে-জানালা খুলে দেন পাঠকের সামনে তাই তাঁকে কবি-পরিচিতি এনে দেয়। সেখানে কবিতা আলোচনার প্রয়োজনে অকারণ কবিতার গদ্যাংশ নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে না। কোনো জটিল শব্দ নয়, বরং প্রতিদিনের চেনা শব্দের  যে-মালা দিয়ে কবি ইকবাল আজিজ জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ চিত্রিত করেন; সেই সাফল্যই তাঁকে সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে জাগিয়ে রাখে।