জীবনের গল্প, সময়ের গল্প

কবির আহমেদ

সেরা দশ গল্প
নুরুল করিম নাসিম
অয়ন প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯
১৬০ টাকা

একজন মানুষের জীবন একটি মহাকাব্য, একটি বিশাল উপন্যাস কিংবা অসংখ্য ছোটগল্পের সমাহার। যেভাবেই বলি না কেন, জীবন এক রহস্যময় জটিল উপাখ্যান, তার বর্ণনা করা, চিত্রণ করা অসম্ভব না হলেও কঠিন শ্রমসাধ্য ও অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবু জীবন যাপিত হয় আপন নিয়মে। এক একটি জীবন, এক একটি জগৎ, বলা যায় মহাজগৎ। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। পাশাপাশি, তবু যেন দেখা হয় না। জানাজানি হয় না। কিন্তু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতেই থাকে। নানারকম চিন্তা, চেতনা ও বোধের জন্ম হয়। এভাবেই সৃষ্টি হয় শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত।
গল্পকে কখনো বলা হয় ছোটগল্প – সাহিত্যের একটি শাখা, বলা যায় গুরুত্বপূর্ণ শাখা, সাহিত্য ইতিহাসের অপেক্ষাকৃত আধুনিক শাখা; কিন্তু পাঠকের কাছে তা রহস্যজনক ও আকর্ষণীয়। পাঠকরা গল্প পছন্দ করেন, কিন্তু সব গল্প নয়, কোনো কোনো গল্প। কেন তাঁরা কিছু গল্প পছন্দ করেন আর কোন গল্প পছন্দ করেন না, তা জানার ও বোঝার বিষয় আছে। অনেক ক্ষেত্রে অপছন্দের বিষয়টি দুর্বল গল্প, আবার অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমানের গল্প অনগ্রসর পাঠকের কাছে গ্রহণীয় নাও হতে পারে। তাই সামগ্রিক বিচারের ভার শুধু পাঠকের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না, এমনকি সমালোচকদের ওপরেও নয়।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পূর্বকালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যাঁরা গল্প লিখেছেন তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনেকেই কিছুকাল লিখে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে। তবে আজ আমি যাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি তিনি নুরুল করিম নাসিম। তিনি ষাট দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত লিখে যাচ্ছেন। তাঁর লেখার বিষয় যদিও বিসত্মৃত (কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক, অনুবাদ) তবু তাঁর গল্প, বিশেষত তাঁর সর্বশেষ গল্পের বই সেরা দশ গল্প, নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তিনি গল্প লেখেন; কিন্তু কী ধরনের গল্প, কী মানের গল্প আমার সঙ্গে অন্যরা একমত হবেন, আমি তা মনে করি না; কিন্তু আমার আলোচনায় তারা যে একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশেষ বিচার-বিশেস্নষণের সন্ধান পাবেন তা আশা করতে পারি। অনেক বছর আগে (সম্ভবত সত্তরের দশকের শেষ দিকে) দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতায় নুরুল করিম নাসিমের ‘মধ্য রাতের স্বপ্নরা’ নামে একটি গল্প পাঠ করেছিলাম। লেখাটি আমার বিশেষ ভালো লাগে, কারণ সেখানে ছিল জীবনের গভীর উপলব্ধিমূলক স্মৃতিচারণ, দুঃখবোধ যাতনা এবং আত্মোপলব্ধি। তারপর লেখকের আরো বেশ কিছু গল্প পড়েছি। পত্র-পত্রিকায় এবং প্রকাশিত গ্রন্থে। তিনি জীবনকে দেখেন একজন অন্তরঙ্গ মানুষের দৃষ্টিতে, সহজ অনর্গল স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় তা বর্ণনা করেন। তাঁর নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন। আসলে আমরা অনেক কিছুই পড়ি, কিন্তু সব লেখা মনে সমান দাগ কাটে না। বিভিন্ন সময়ের কিছু লেখা আমার মনে বিস্ময় এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। অনেক বছর আগে সৈয়দ শামসুল হকের আনন্দের মৃত্যু গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কবি’ পড়ে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম। একজন গ্রাম্য কবি আবদুর রব মুন্সীকে নিয়ে লেখা গল্পটি নিয়ে আমি ভেবেছি অনেকদিন। তারপর একটি পত্রিকায় আহমদ ছফা-রচিত ‘হাত’ গল্পটিও আমাকে বিস্মিত ও চমকিত করেছিল। সেরকম আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ঝড় ও দরোজা’, সায্যাদ কাদিরের ‘ফুলের সাথে বনলতা’, ইমদাদুল হক মিলনের দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘বাণকুড়ালি’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘সিতাংশু তোর সমগ্র কথা’ মনে আছে, মনে থাকে। কারণ এগুলো জীবনের গল্প, জীবনের গভীর উপলব্ধির গল্প।
সেরা দশ গল্পে লেখক নুরুল করিম নাসিম জীবনের বিভিন্ন সময়ে লেখা গল্পের একটি নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেছেন। গল্পগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। প্রথমেই যেটি বলতে হয় তা হলো, গল্পের নির্বাচনটি যথাযথ হয়েছে। প্রধানত দুই ধরনের গল্প আছে – একটিতে আছে সমাজ পরিবেশ ও আশেপাশের মানুষ এবং আরেক ধরনের গল্প তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন এবং উপলব্ধি বিষয়ক। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশ তীক্ষন, সহজ ভাষায় গভীরতম উপলব্ধি তুলে আনেন কলমের ডগায় – এটা একজন তুখোড় লেখকেরই বৈশিষ্ট্য; পাঠকের মনকে যা সহজেই নাড়া দেয়।
প্রথম গল্প ‘যে যার ভূমিকায়’ বিংশ শতাব্দীর এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যুবসমাজের মানসিক অস্থিরতা, আচার-আচরণ, দ্বন্দ্ব মূর্ত হয়ে উঠেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনধারাও পরিবর্তিত হয়, তাই একসময় সমাজ পালটানোর অঙ্গীকারবদ্ধ যুবক-যুবতীরা পরবর্তীকালে জীবন প্রতিষ্ঠার মোহে পড়ে যায়। জীবন বদলে যায়, অনেকে খাপ খাওয়াতে পারলেও সবাই তা পারে না, গল্পের উপসংহারে সে-কথাই প্রতিধ্বনিত হয়।
‘আমি এখন একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার রিপোর্টার। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এদেশে যে আন্দোলন হয়েছিল, তখন রেজার সাথে আমারও জেল হয়। জেল থেকেই আমরা ইকোনমিক্সে পরীক্ষা দেই। রেজার রেজাল্ট অসম্ভব ভালো হয়েছিল। তারপর কেমন করে যেন তার সরকারি চাকরি হয় প্ল্যানিং কমিশনে। শুনেছি এখন ব্যাংককে ট্রেনিংয়ে আছে। …
কখনো কখনো রিপোর্টের আড়ালে আমার জীবনের একটি পুরনো রিপোর্টের কথা মনে পড়ে।
এক সাথে পার্টি করতাম।
রেজা, আলেয়া আর আমি।
আমরা এখনও আছি।
হায়! আজ আমরা কোথায়!’
দ্বিতীয় গল্প ‘তখন হঠাৎ যদি’ সাহিত্য ও জীবনের হারানো গলিপথে পরিভ্রমণের কথা। সেখানে ঘটনা আছে, নাটক আছে, দুঃখ আছে, আছে দুঃখময় এক ধরনের স্মৃতিচারণের সুখ, কিছুটা পরাবাস্তব আভাস আছে। তাই একরকম ভালোই লাগে। গল্পের একটি লাইন, ‘চলচ্চিত্রের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো স্মৃতিময় টুকরো টুকরো ছবি মনের ওপর দিয়ে চেতনার ভেতর দিয়ে ভেসে উঠে দ্রম্নত মিলিয়ে গেল।’
পথ চলতে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, তাতে কি আসে-যায়। তারপরও কোনো কোনো সহযাত্রীর সঙ্গে জীবন জড়িয়ে পড়ে। কথা হয়, জানাজানি, হয়তো চলে যায়, থেকে যায় রেশ অথবা আগামীর কোনো প্রত্যাশা। এমনি একটি গল্প ‘গভীর গভীরতর অসুখ’। ‘বইয়ের ঘর’ – জীবন সংগ্রামের গল্প। জীবনের সঙ্গে শিল্পের দ্বন্দ্ব। জীবনের কাছে অনেক সময়ই মানুষ হেরে যায়, তবু স্বপ্ন দেখে, অলৌকিক স্বপ্ন। ‘দুপুরের খাবার খেয়ে যে দৌড়ে যেত পাঠাগারে। একরকম নেশার মতো পেয়ে বসেছিল তাকে। সে স্বপ্ন দেখতো যে সে একদিন বড় লেখক হবে, তার নিজের একটা প্রকাশনা সংস্থা থাকবে। ভালো ভালো বই ছাপাবে। প্রকাশনা শিল্পের যে বন্ধ্যাত্ব সেটা ঘুচে যাবে। শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষেরা প্রকাশনার কাজে এগিয়ে এলে একটা বৈপস্নবিক পরিবর্তন হবে।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লেখা গল্প ‘সেদিন আকাশে পূর্ণিমা ছিল না’। ‘কাল সারারাত প্রচুর গোলাগুলির শব্দে আমাদের আজিমপুর এলাকাটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মধ্যরাত থেকে সৈনিকদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে তুমুলভাবে। … এ দেশের আকাশ শস্যশ্যামল সবুজ প্রান্ত আমার। এ দেশে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, এ দেশের সার্বভৌম স্বাধীন মাটিতে আমি মরতে চাই।’
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের এক খ-চিত্র ‘মস্নান বিকেলের মরা রোদ’। ‘তিনি যখন এদেশে এলেন, তখন খুব এলোমেলো সময়। পরাধীনতার গস্নানি থেকে মাত্র ক’বছর হয় মুক্ত হয়েছে দেশ। মানচিত্র বদলে গেছে। কিন্তু মানুষ পুরোপুরি বদলায়নি। পরিবর্তন আসেনি সমাজের ভেতর-কাঠামোতেও।’
গ্রন্থের সর্বশেষ এবং হৃদয়গ্রাহী গল্প ‘বাবার কালো ট্রাংক’। জীবনের খ- খ- ছবি। জীবন সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি, আত্মবিশেস্নষণ, উপলব্ধির পরিবর্তন, হারানোর দুঃখ, আবার অন্য ধরনের প্রাপ্তির দুঃখ। জীবন স্মৃতির বর্ণনা এ-গল্প জীবনেরই জলছবি। ‘একদিন এক বৃষ্টিঝরা রাতে মাকে খুব বিষাদময় মনে হলো। তিনি আমাকে ডাকলেন। বাবার কালো ট্রাংক খুলে তিনি বসে আছেন। … তিনি কালো ট্রাংকের ভেতর থেকে রেক্সিনের একটি কালো ডায়েরি আমার হাতে তুলে দিলেন। … নমিতার সাথে আর দেখা হবে না। দক্ষিণ মৈশন্ডির রাজনৈতিক শিক্ষগুরুকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল। পেছনে পড়ে থাকলো কার্ল মার্কস, নমিতার সর্বগ্রাসী চোখ, আর আমার শৈশব যৌবনের টুকরো টুকরো ছবি যা আমার জীবনে এর আগে কখনো আসেনি।’
মানুষ কি তার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হতে পারে? না, তা পারে না। সেটা তো ঈশ্বরের হাতে। কিন্তু মানুষ জীবনের ছবি আঁকতে পারে, নিপুণ কারিগরের মতো, অনেক সময় নিজেই সৃষ্টি করে নেয় সেই কাহিনি, লেখকের যোগ্যতা বা সার্থকতা সেখানেই।