জুলফিকার মতিনের উপন্যাস : নানা পর্বের ব্যঞ্জনা

কবি জুলফিকার মতিন ষাটের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যে অন্যতম প্রতিনিধি। কবি হিসেবে তাঁর অধিক পরিচিতি হলেও একই সঙ্গে কথাসাহিত্য ও মননশীল প্রবন্ধসাহিত্যে তাঁর অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যে পদচারণা অব্যাহত রেখেছেন। প্রবন্ধের যুক্তি ও মননশীলতা তাঁর কথাসাহিত্যে বুদ্ধির ও দীপ্তির ছাপ রেখেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে আজ পর্যন্ত সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন সচেতন পর্যবেক্ষক হিসেবে তাঁর শিল্পমানসে যোগ হয়েছে বাঙালির শাশ্বত মৌলিক প্রগতি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। নিজে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িত থাকার কারণে তাঁর স্বদেশভাবনা স্বতন্ত্র এবং সেই নিজস্ব চিমত্মা-দর্শন ও যুক্তি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষক্ষত্রে আকাঙক্ষা করেন। এর ফলে তাঁর কথাসাহিত্য পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক দলিলে পরিণত হয়। সাহিত্যেও শিল্পের সংহত বা ধ্রম্নপদী বলয়ের একজন লেখক হিসেবে জনপ্রিয় ধারাকে তিনি পরিহার করেছেন। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সচেতনতা তাঁর শিল্পমানসে প্রভাব ফেললেও তিনি শিল্পের নন্দনকে অন্বিষ্ট করেছেন সবসময়। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, মানব-মানবীর চিরন্তন জীবন প্রত্যয় আশা মানবিক দিকের অনুপস্থিতি আমরা তাঁর কথাসাহিত্যে লক্ষ করি। বরং উপন্যাসের কাঠামোর মধ্যে তিনি মানব-মানবীর জীবনাকাঙক্ষাকে গভীর ও বাস্তবসম্মত করে তুলেছেন।

কবি জুলফিকার মতিন আমার খুব প্রিয় একজন লেখক এবং খুব পরিচিত ও কাছের মানুষ। তিনি আমার প্রিয়-শ্রদ্ধেয় বলেই তাঁর লেখা আমার
ভালো লাগে এমনটি নয়। তাঁর প্রায় সব কবিতাই আমার পড়া। ছাত্রজীবনে তাঁর বক্তৃতা শুনেছি নিমগ্নচিত্তে। ষাটের দশকের প্রতিভাবান এ-কবির শৈশব-কৈশোরে রচিত কবিতা ও শিশুতোষ রচনা এককথায় অসাধারণ। তিনি হয়তো খুব বেশি পরিচিত হয়ে উঠতে পারেননি বা বাংলাদেশে যেভাবে লেখকরা খ্যাতি পান সে-পথ অনুসরণ করতে পারেননি। তবু জাতীয় পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা সত্যিকারের পাঠকরা পড়েছেন। আমার মনে হয়, কবি জুলফিকার মতিনের কবিতার গভীরতা, সুষমা ও শিল্পঘন গঠন বিচার করলে তাঁকে বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী বলতে কারো দ্বিধা থাকবে না। সেই কবির কথাসাহিত্য আমি গভীরভাবে পাঠ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর প্রথম দিকে প্রকাশিত চারটি উপন্যাস পড়েছিলাম। মানব মানবী উপন্যাসটি নিয়ে একটি অধুনালুপ্ত পত্রিকায় বিসত্মারিত আলোচনাও করেছিলাম। সাধারণ পাঠকের যেমন কৌতূহল থাকে কবির উপন্যাস কেমন হবে, আমারও ছিল। আমি সে-সময় কী লিখেছিলাম আমার স্মৃতিতে তা নেই বা সংরক্ষিত নেই, তবু সেই উপন্যাসের সুবাস এখনো লেগে আছে আমার হৃদয়ে।

একজন কবি উপন্যাস লিখলে পাঠকের খানিকটা কৌতূহল থাকে, তার সঙ্গে দ্বিধা থাকে; দ্বিধা থাকে কবির পক্ষ থেকেও। কারণ কবিতা ও কথাসাহিত্য সাহিত্যের শাখা হলেও এর অবস্থান অনেকটা বিপরীত মেরুতে। কবিতা লিখতে গিয়ে কবিকে অনেক পরিমিতিবোধের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যেতে হয় অজস্র অনুভূতিক ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এবং এর নির্যাসকে বাঙ্ময় করে তুলতে হয় স্বল্পপরিসরে। উত্তীর্ণ চরণের জন্য তাঁকে অনেক অপেক্ষা করতে হয়; অপেক্ষা করতে থাকেন কীভাবে চিমত্মাসূত্র সংক্ষিপ্ত ও সংহত করা যায়। অন্যদিকে উপন্যাসে তাঁর অভিজ্ঞতাকে বিসত্মারিত করে দিতে হয়; অভিজ্ঞতার একটি পরিবেশনাপদ্ধতি ও ভাষার ডিকশন তৈরি করতে হয়। গদ্যের যে-ভঙ্গি দিয়ে উপন্যাস লেখা হয় তা ব্যবহারিক ভাষার মতো দেখতে হলেও সে-ভাষা আলাদা। সন্দেহ নেই তা খানিকটা কৃত্রিম এবং সেই কৃত্রিম ভাষাকে মর্যাদা দিতে হয়, বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হয়। তা স্বতন্ত্র বা আলাদা করতে না পারলে স্বতন্ত্র উপন্যাস হয়ে ওঠে না। আবার উপন্যাসের মধ্যে কবি উপস্থিত থাকলেও এই কবি আলাদা কবি। বঙ্কিম বা তারাশঙ্কর বা মানিকের উপন্যাসে যে কবিত্ব পাই সেই কবিত্ব দিয়ে কবিতা লেখা যাবে না, তবে সন্দেহ নেই সেটিও কবিত্ব। সাধারণ পাঠক হয়তো সেই পার্থক্য জানেন না, তাঁদের জানার দরকারও নেই। কারণ তিনি তো মোহিত হয়ে থাকেন গল্প বা চরিত্রের মোহন সব ব্যাপারে। তবে যিনি কবিত্ব চারিয়ে দেন উপন্যাসের শরীরে সেটা সজ্ঞানে এবং তিনি জানেন কী হতে যাচ্ছে। সত্যিকারের কবির বিপদ আরো বেশি, কারণ তিনি কাব্যশক্তি বা সুষমা ব্যবহারে দক্ষ হলেও কথাসাহিত্যে ব্যবহারের গুণপনাসম্ভব সময় অর্জন করতে পারেন না। তিনি প্রথমত সচেতন থেকে কবিতাকে আলাদা করতে গিয়ে খানিকটা কৃপণ হয়ে পড়েন। ফলে উপন্যাস কাব্যশূন্য হয়ে পড়ে আর সচেতনতার অভাবে কাব্যাক্রান্ত হয়ে পড়ে তাঁর উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আবার এটাও হয়েছে, কবি উপন্যাস লিখতে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন সত্তা আবিষ্কার করে ফেলেন এবং তখন তিনি স্রেফ ঔপন্যাসিক। এ-জাতীয় লেখকের সংখ্যা হাতেগোনা। আবার এটাও হয় যে, তিনি অভিজ্ঞতাহীন বিসত্মৃত বিশদ পটভূমি ব্যতিরেকে মানসিক বিষয় নিয়ে ক্যারিকেচার তৈরি করে ফেলেন। কাজেই কবির উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা সবসময় সহজ নয়। অনেকে ধারণা করেন, জীবনানন্দ দাশ উপন্যাসগুলো বাক্সবন্দি করে রেখেছিলেন এই ভেবে যে, ওগুলো কিছু হয়নি বলে। আমার মনে হয় এ-ধারণা ঠিক ছিল না। কারণ প্রথমত, তিনি বেশ গভীর উপন্যাস লিখেছেন, যদিও সেখানে বিষয়বস্ত্তর কিছু পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয়ত, লুকিয়ে রাখার কারণ বিষয়গুলো ছিল ব্যক্তিগত এবং তিনি এসব নিয়ে নতুন করে অশামিত্ম হোক সেটা চাননি। যা হোক, কবিতার সূক্ষ্ম নরিতসু জগতের সঙ্গে সাযুজ্য করে যদি ভিন্নমাত্রার উপন্যাস কবি লেখেন, সেটা পাঠকের বাড়তি পাওনা।

কবি জুলফিকার মতিনকে উপন্যাসজগতে স্বতন্ত্র মনে হয় আমার। যদিও ত্রম্নটি-বিচ্যুতি আবিষ্কার করা কষ্টসাধ্য নয়। তবু এখানে তাঁর গদ্য বা গল্প বলার ভঙ্গি এবং যুক্তিতর্ক-সংলাপ,
সমাজ-সংস্কৃতির সমবায়ে একটি পরিপূর্ণ শক্ত ও স্বতন্ত্র উপন্যাসের অবয়ব আমরা পেয়ে যাই। প্রচল ধারার জনপ্রিয় বা খুব সাধারণ ব্যাপার নিয়ে সাধারণ মানের বা ধারার উপন্যাস তিনি লিখতে চাননি। আমরা লক্ষ করব, তাঁর শিল্পসত্তা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চিমত্মাকাঠামো দিয়ে; তিনি প্রখর সমাজসচেতন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে তাঁর দেখা স্বদেশ তাঁর কাছে খুব চেনা এবং তিনি খুব গভীরভাবে দেখেছেন এই জনপদের মানুষ ও যাপিত জীবনের ধারাবাহিক পরিবর্তনসূত্রকে। রাজনীতির সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার কারণে তাঁর সৃজনশীল সত্তা খুব স্থিরভাবে তার লক্ষ্যকে ধারণ করে। বাংলাদেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত চরিত্রও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর অবস্থান থেকে। মূলত তিনি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চিমত্মাশীল ও রাজনৈতিক চেতনার জগৎকে তাঁর উপন্যাসের বিষয় করে তুলেছেন এবং রাজনীতি-সচেতনতা তাঁকে আরো বেশি করে রসদ জুগিয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে। এসব কথার অর্থ এই নয় যে, তিনি স্বাভাবিক মানব চরিত্রের অন্তর্জগৎ বা তার নানামুখী মানবপ্রবণতাকে এড়িয়ে  গেছেন। বরং তাঁর সময়ে মানব-এষণা বা প্রত্যয়কে তিনি তাঁর অবস্থান থেকে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। পাকিসত্মানি শাসক, বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসক বা সামরিক শাসকের সময়কালীন যে মানবিক-সামাজিক অসাম্য ও অনৈতিক কার্যকলাপ, যা এদেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করেছে, সেটাই তাঁর মূল জায়গা বলে ধারণা করা যায়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এটি তাঁর উপন্যাসের স্বাচ্ছন্দ্যের জগৎ।

সম্প্রতি তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসসমগ্রের দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে তিনি সত্যিকার অর্থে প্রচল ধারার বাইরের ঔপন্যাসিক। মোট সাতটি উপন্যাস নিয়ে তাঁর সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তাঁর এ-যাবৎ প্রকাশিত সব উপন্যাস গ্রন্থিত হয়েছে। কয়েকটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রয়েছে, যা আপাতত অসম্পূর্ণ মনে হবে। তবে প্রকৃতপক্ষে উপন্যাস দাঁড়িয়ে যায় তার তাৎপর্যগত গভীরতার জন্য। সে হিসেবে জুলফিকার মতিন সে-কাজটি করেছেন বেশ ভালোভাবে। সাদা কুয়াশার পাখি রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত উপন্যাস; পাকিসত্মান শাসকের প্রবল অত্যাচার-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি সোচ্চার হয়ে উঠছে; পাকিসত্মানপন্থী শাসক ও তাদের দোসরদের পরিকল্পনার কাছে পরাজয় মানবে না এদেশের যুবসমাজ। এরকম একটি চরিত্র আশফাক, যে তার কলেজের সবাইকে জাগিয়ে তুলতে চায়, পাকিসত্মানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এগিয়ে আসে অসীম সাহস নিয়ে। এই আন্দোলন বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন, মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন, বেঁচে থাকার আন্দোলন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সারাবাংলায় যে-দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার এক অন্যতম প্রতিনিধি আশফাক। আশফাককে তৈরি করার জন্য যা যা প্রয়োজন, যে পটভূমি ও আবহ সেটি তৈরি করেছেন ঔপন্যাসিক। একই সঙ্গে এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা এবং পাকিসত্মানপন্থী গু-াপা-া ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সবই তিনি তৈরি করেছেন। সোজা কথায় গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য উপন্যাসোচিত প্রকরণকৌশল ব্যবহার করেছেন লেখক। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আমরা লক্ষ করব সব বাধা অতিক্রম করে আশফাক তার দলবল নিয়ে মিটিং-মিছিল করছে। তীব্র ভাষায় আশফাক তার লক্ষক্ষ্যর কথা, দেশের মুক্তির কথা বলছে। কোনো পিছুটান তার নেই, কোনো ভয় নেই তার, এমনকি মরণেরও। গু-াদের হাতে আঘাতে মূর্ছা যাওয়া ও গ্রেফতার হওয়ার আগে সে যে-কথাগুলো বলতে পারে, সেটা মূলত স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করার মূলমন্ত্র। অর্থাৎ খুব সহজে ঔপন্যাসিক জুলফিকার মতিন মফস্বলের এক কলেজছাত্রকে দিয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বপ্নের কথা বলতে পেরেছেন। মাথায় প্রচ- আঘাতে নিসেত্মজ হওয়ার সময় সে চোখ বুজেই দেখতে পায়, তার চোখের সামনে ভিড় করছে
মা-বাবা, ভাইবোন-হাতেম আলী ম-ল-টোকা মিয়া, এসডিও সাহেব, আরিফুল, নবা, রতন, রশীদ, শুকুর আলী, দীনেশদা। শাহীন, হেনা, ফিরোজা, জোহরা তারাও রয়েছে সে-মিছিলে। তারা সবাই মিলনে-বিরোধে গড়ে তুলছে সংসার-সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা। এক বিনাশহীন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গড়িয়ে  চলেছে জীবনের রথ। এই আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব মিলে তৈরি হচ্ছে মহাপর্ব; সেই পর্ব ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

আগেই উলেস্নখ করেছিলাম যে, উপন্যাসোচিত অভিজ্ঞতার বিসত্মৃত উপস্থাপনা না করতে পারলে সত্যিকারের শিল্পমানসম্পন্ন উপন্যাস হতে পারে না। এর জন্য সংশিস্নষ্ট চরিত্রের মুখে উপযুক্ত ভাষা-ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। জুলফিকার মতিন সে-কাজটি করেছেন খুব ভালোভাবে। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র শাহীনের একটি বক্তব্য শুনলে বোঝা যাবে ঔপন্যাসিক তাঁর কাজটি করতে পেরেছেন গভীরভাবে। শাহীন বলে, সকালবেলার টেবিলে যে রুটি আসে, সে তো আর স্বেচ্ছায় গায়ে মাখন লাগিয়ে আহার্য হতে চায় না। তবে রুটি হলো জড়বস্ত্ত। সে কী চায় আর না চায় সেটা কে দেখছে। কিন্তু জনগণের বেলায় তো আর তা খাটে না। তাকে যদি পদার্থ বলেও বিবেচনা করেন, তবে সে-পদার্থ অত্যন্ত সচল, অত্যন্ত অনুভূতিশীল। আর এ-কথাটিই আপনারা ভুলে গিয়ে তাকে জড়বস্ত্ত মনে করে বারুদ লাগাতে চান। আর আমাদের রাজনীতি যেখানে মন্ত্রী হওয়ার রাজনীতি, সেখানে আর তারা কতবার গায়ে বারুদ মেখে আপনাদের আহার্য হবে।

এই শাহীন লেখাপড়া জানা বিদ্বান এবং সচেতন। দেশ-কাল-সমাজ নিয়ে সে-কারণে তার মুখের ভাষা এভাবে শাণিত করে তুলেছেন জুলফিকার মতিন। গোটা উপন্যাসে তিনি মূলত শিষ্টভাষা ব্যবহার করেছেন এবং আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করেছেন, যদিও গল্পটা মফস্বলের। তবে তিনি যেখানে ঘোর আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার প্রয়োজন সেখানে ঠিকই ব্যবহার করেছেন। আশফাক যেদিন হাতেম আলী ম-লের বাড়ি গিয়েছিল সেদিন তার স্ত্রী তাকে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করে এবং তার কোনো কন্যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে থাকে। আশফাককে দুপুরবেলায় বাড়ি আসতে দেখে উৎফুলস্ন ম-লগিন্নি স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে, ‘কী যে কও? এই রোদের মধ্যে, ছাওয়ালের আমার লেখাপড়া করতে করতে মাথাটা খারাপ হয়্যা গ্যাচে দেখত্যাচি… আর বলো না, গিরামের জমি-জিরাত থাক্যা ফসলাদি পাওয়া খুব দুষ্কর হয়্যা পড়চে। বর্গাদারেরা একেবারে নিমক হারাম। অনেকদিন বাড়ি যাই নাই – আম-কাঁঠাল এবার একটাও মুহে তুলতে পারলাম না। – কী আর বলমু, তোমার চাচা কয়, কয়দিন পরে তো রিটায়ার অমু। তখন গিরামে যায়্যা আবার বসত বানামু। হোন কতা, তাই আর অয় নাহি? আমরা না হয় যায়্যা থাকলাম, কিন্তু জোহরা-ফিরোজাদের লেহাপড়া? ফিরোজার আবার মাথাটা বেশ পরিষ্কার – পরীক্ষায় এবার…।’

বোঝা যায় তিনি চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ভাষা ব্যবহার করেছেন। যদিও তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। অর্থাৎ যে-পটভূমিকায় তিনি উপন্যাসটি রচনা করেছেন সেখানে আঞ্চলিক ভাষা-ব্যবহারের আরো সুযোগ ছিল।

মানব মানবী উপন্যাসের কাহিনি আপাতভাবে প্রেমের। আফজাল-শায়লার হারিয়ে যাওয়া প্রেমের নবরূপ দেখতে পাই আমরা এখানে। এক অর্থে এটি পরকীয়া-সংক্রান্ত উপন্যাস। আফজাল প্রায় একযুগ পরে শায়লার সঙ্গে দেখা করে বা দেখা হয়। ঔপন্যাসিককে ধন্যবাদ দিতে হবে এজন্য যে, তিনি পুরনো প্রেম নিয়ে অহেতুক আলাপচারিতায় উৎসাহিত করেননি আফজাল-শায়লাকে। তবে তাদের সম্পর্কের নিবিড়তা বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন নানাভাবে তাদের আচরণে ও কাজকর্মে। এখনো তারা পরস্পরকে অনুভব করে বা মিলিত হতে পারে বা নতুনভাবে সংসার করতে পারে – সেরকম নানা অনুপান তিনি সরবরাহ করেছেন বা সেরকম পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন উপন্যাসে। শায়লাকে দেখে আফজাল কখনো এমনও মনে করেছে যে, সে বুঝি তার সঙ্গে যে-কোনো সময় মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্ত্তত। বয়স্ক, বিবাহিত ও সমাজের শিক্ষিত ধনী শ্রেণি বলে তাদের পুরনো সম্পর্ককে কেউ বাঁকা চোখে দেখিনি, সহজভাবে নিয়েছে সবাই। এক পর্যায়ে শায়লাকে নিয়ে আফজাল পালাতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত পালায় না। শায়লার ছেলে (আগের পক্ষের, তবে তাকে মা বলে ডাকত) পুলিশের গুলিতে মারা গেলে শোক সামলাতে শায়লা যখন গৃহত্যাগ করে, তখনো আফজাল তার কাছে হাজির হয়। শায়লার ফুফু কুতুব সাহেবের (আপন নয়, তবে গভীর সম্পর্কের) বাড়িতে গিয়ে আফজাল শায়লাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। পরে স্বামী রহমান সাহেব এসে শায়লাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও আফজাল তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক ছিল। উপন্যাসে আফজালের পারিবারিক পরিচয় তেমন নেই। পাঠক কিছুটা আন্দাজ করতে পারে মাত্র। রহমান ও তার বন্ধুদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনোদন, পান, ভোজন এসবের সঙ্গে ওপরতলার মানুষের জীবনের শূন্যতা ধরা পড়েছে। একই সঙ্গে তারা অসুখী ও অসৎ। তবে রহমান সাহেব প্রতি সন্ধ্যায় বোতল খুলে (এমনকি ছেলের মৃত্যুর দিনেও) বসলেও তাকে ভালোমানুষ হিসেবে চিত্রিত করতে পেরেছেন ঔপন্যাসিক। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক জীবনাচরণের একটি সাধারণ চিত্র আমরা এখানে পাই প্রেমজ গল্পের আড়ালে। আর মানব-মানবীর জীবন যে নানা বিপর্যয়ের ও হতাশার মধ্য দিয়ে যায় বা অবিমিশ্র শামিত্ম বলে কিছু নেই, সে-বার্তা লেখক আমাদের দিতে পেরেছেন গল্পের মধ্য দিয়ে।

রৌদ্রছায়া ভালোবাসা উপন্যাসটি বাদ দিলে জুলফিকার মতিনের সব উপন্যাস রাজনৈতিক অথবা রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত। রৌদ্রছায়া ভালোবাসা উপন্যাসের মধ্যেও যে লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতা বা প্রজ্ঞার পরিচয় নেই তা বলা যাবে না। বরং এখানে তিনি সরাসরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ না বলে তাঁর সাম্যবাদী বা বামপন্থী চেতনার বীজ রোপণ করেছেন। গভীর অর্থে লেখক সেটি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন। সামন্তবাদী বা পুঁজিবাদী প্রথার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির মানুষ সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে পড়ে। এসব বড়লোকের আবার একধরনের সংস্কৃতিও তৈরি হয়, যা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয় হলেও সত্যিকার অর্থে তাকে ঈর্ষা করার কিছু নেই বা তাকে অবজ্ঞা করা যায়। এই উপন্যাসের নায়ক তাই দাদার বিশাল সম্পত্তিকে তুচ্ছজ্ঞান করে।

বিবরক্লান্ত শঙ্খের ফেনা উপন্যাসে জুলফিকার মতিনের নতুন শক্তি ও সম্ভাবনার নিদর্শন পাওয়া যায়। উপন্যাসটি আকারে ছোট হলেও এর বিষয়গত বৈচিত্র্য ও রচনাশৈলী বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। উপন্যাসের বর্ণনাকৌশল ও প্রেক্ষণবিন্দু তাঁর রচিত অন্য উপন্যাস থেকে আলাদা। একজন অবিবাহিত চাকরিজীবীর বয়ানে যাকে তিনি  উপস্থাপন করেছেন, ভিন্নভাবে তাকে ঘিরেই উপন্যাস বিসত্মার লাভ করেছে। তবে নারীজীবনের সীমাহীন দুর্গতি হয়তো এই উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য। হয়তো বলছি এ-কারণে যে, জৈবিক আকাঙক্ষা ও  জৈবিক ক্ষমতার অভাব বা এসবের কারণে যে মানসিক অসংগতি তাকে ঔপন্যাসিক কেন্দ্রে রেখেছেন। তিনজন নারীর ত্রিমাত্রিক সমস্যাকে একটি পুরুষ চরিত্র উপলব্ধি করছে। তার হয়তো কারো জন্য কিছু করার নেই এবং সে অন্যতম সহায়কচরিত্র হলেও কার্যত সে কারো কোনো উপকারে লাগে না।

যদিও উপন্যাসটি শুরু হয় নাটকীয়ভাবে তবে উপন্যাসের গল্পটি মোটেও নাটকীয় নয়, বরং তা আমাদের মৌলিক এক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করে। ভালোমানুষীর আড়ালে এক ভয়ংকর জগতের সঙ্গে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। সে-জগৎ উপলব্ধির জগৎ, বিবেচনার জগৎ, ভাবনার জগৎ। যদিও প্রথমদিকে কাঁচা পাঠক জৈবিক রসের সন্ধান পেতে পারেন, শস্নীল-অশস্নীল নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। তবে প্রকৃত পাঠক এর ভেতরের অন্তর্কাঠামোর সন্ধান পাবেন; মানবজীবনের এক গভীর জিজ্ঞাসার কাছাকাছি আসে পাঠক, যা তাঁকে ভাবায় এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে।

জুলফিকার মতিন শুরু করেছেন এভাবে : ‘ধরুন, টেলিভিশনে একটা সিনেমা চলছে। গভীর মনসত্মাত্ত্বিক ব্যাপার। স্বামী পুঙ্গম সন্ধ্যাকালে বাগানে বসে স্ত্রীর সঙ্গে যখন চা খায়, কিংবা দিনের বেলায় অন্য যে-কোনো সময় তার দিকে তাকায়, তখন মনে হয় ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়েলোক বুঝি পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আবার যখন রাত্রিদের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে যায়, তখন বোধ হতে থাকে, সমুখে শায়িতা এই দেহ কেবলই একতাল কদাকার মাংসপি-। ঘটনাটি যদি একবারের, দু-একবারের কিংবা তিনবারের হতো, তবে তা নিয়ে দুশ্চিমত্মার কিছু ছিল না। প্রথম প্রথম মনেও হয়েছিল, বুঝি সাময়িক কোনো ব্যাপার। কিন্তু এক সময় তার পৌনঃপুনিকতা দারুণ লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভাত-কাপড় দেওয়ার ক্ষমতা না থাকা এক জিনিস আর ও-জিনিস না থাকা আরেক জিনিস। বলা যেতে পারে, তা তো পুরুষত্বেরই সওয়াল। এর বেশি মানসিক যন্ত্রণা আর কোনো কিছুতেই হতে পারে না। রাতে যখন পারছে না, তখন দিনের বেলাতেও দেখা গেছে চেষ্টা-চরিত্র করে। কোনো লাভ হয়নি। বিছানায় স্ত্রীকে শোয়ালেই বোধ হতে থাকে, সেখানে পড়ে আছে এক আস্ত গাছের গুঁড়ি।’ এ-পর্যন্ত সিনেমা হওয়ার পর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে নায়ক সিনেমাটি দেখতে পারে না। কাকতালীয়ভাবে নায়কের সহকর্মী সাবিনা বেগমও (যাকে অফিসের তেমন কেউ পছন্দ করে না) একই সিনেমা দেখে এবং সে-ও সিনেমা শেষ করতে পারে না। কীভাবে যেন নায়কের সঙ্গে সাবিনা বেগমের খাতির হয়ে যায় খানিকটা এবং দুপুরের লাঞ্চ করে একসঙ্গে হাঁসের মাংস দিয়ে। অনেক কথার মাঝে নারীবাদী অনেক কথা বলে সাবিনা বেগম, তবে তার মোক্ষম কথা হলো সিনেমা। অনেকগুলো চ্যানেলের কারণে ওই ছবি আবার দেখার কথা। এবং শেষে কী হবে এ নিয়ে বাজি ধরতে চায় সাবিনা। নায়কের তখন এমন অবস্থহা যে, তার প্রসত্মাব অস্বীকার করতে পারে না। সাবিনা বেগম আরো খবর দেয় যে, অফিসপ্রধানের কাছে সবাই দাবি নিয়ে গেছে ম্যাটারনাল লিভের মতো পিতৃকালীন ছুটি দিতে হবে। অর্থাৎ মেয়েদের সুযোগ দেখলে পুরুষদের গা জ্বলে। যা হোক, সাবিনা বেগম কাগজে সিনেমার পরিণতি কী হতে পারে তা লিখে সিলগালা করে নিয়ে আসে। নায়ককে মতামত লিখে নিয়ে আসতে বললে সে আনেনি বললে সে তাকে জেরা করতে থাকে, আসলে সে ওই সময় কী করেছিল। সিনেমার পরিচালকের ভাবনা কার সঙ্গে মিলে যাবে সেটা দেখা তার লক্ষ্য। আর সিনেমা দেখার পর কেউ যেন তার মত পরিবর্তন না করতে পারে তার জন্য সিলগালা। তবে সাবিনা বেগম যে পুরুষের একচ্ছত্র দাপটের তীব্র বিরোধিতা করছে, সেটা নায়ক বুঝতে পারে এবং তার কথাবার্তায় তা প্রমাণিত হয়। সে যে-পুরুষের যৌন স্বেচ্ছাচার নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে তা তার কথায় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আর আমাদের ধারণা, ঔপন্যাসিকের বলার জায়গাটাও সেটি। সাবিনা একসময় তার মোক্ষম কথাটা বলে ফেলে : ‘শুনুন, যতক্ষণ পর্যন্ত সেক্সের অধিকার সমান না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি যা বুঝি সব অধিকারই ফক্কিকার। আপনারা পুরুষেরা মেয়েদের সঙ্গে রঙঢঙ করে বেড়াবেন আর নিজেদের চরিত্র রক্ষা করে চলতে হবে মেয়েদের। ব্যবস্থা বড় চমৎকার।’ সে শেষ পর্যন্ত নায়কের সঙ্গে লিভটুগেদার করার প্রসত্মাব দেয়। এবং কোনো যৌন সম্পর্ক ছাড়াই একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। যদি
বিপদ-আপদ ঘটে, তাহলে মামলা ঠুকে দেবে। পুরুষেরা আবার আইন করেছেন নারীর পক্ষে।

অন্যদিকে নায়কের বিল্ডিংয়ের এক মহিলা, যার স্বামী খুব পরহেজগার, সে সৌদি থেকে ফিরেও কাজের মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে। এই মহিলাকে একদিন নায়ক অন্ধকারে বিপদের সময় তার হাত ধরে ওপরে নিয়ে এসেছিলেন। ছেলের জন্মদিনে তাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন মহিলা। সেই মহিলা একদিন স্বামীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে নায়কের বাসায় এসে বলে যে, আমি এখন থেকে আপনার সঙ্গে শোব। অর্থাৎ তার স্বামী যা করতে পারে, সেও তা করতে পারে।

সমস্ত উপন্যাসে তেমন কোনো ঘটনা না থাকলেও নারী-পুরুষের অসম যৌন সম্পর্ক ও অধিকার নিয়ে নানা যুক্তিতর্ক ও আলোচনা রয়েছে। এটি আধুনিক বাংলাদেশের সমাজের বাস্তবচিত্র। তবে এ-বর্ণনা কখনো বিরক্তিকর হয়নি। বরং একটি চলমান বা গতিমান পরিবেশ তিনি তৈরি করেছেন আর বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে শনাক্ত করেছেন।

জুলফিকার মতিনের উপন্যাস তাঁর উপন্যাসসত্তার পরিচয় বহন করছে। যাঁরা তাঁর পাঠক তাঁরা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, তিনি প্রচল ধারার বা সহজ বিনোদনধর্মী লেখক নন। প্রচলিত সমাজের গভীর ক্ষত সম্পর্কে তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা মৌলিক প্রশ্ন তুলেছে। এ-প্রশ্নই পাঠককে আলোড়িত করে। একই সমাজে বাস করে তাঁর মাথায় যখন এ-ধরনের প্রশ্নের উদয় হয় না, তখন পাঠকের বিস্ময়বোধের জন্ম হয়। সমাজের সামূহিক পরিবর্তনধারার সঙ্গে নর-নারীর সম্পর্ক বা মানবসম্পর্কের সূত্রসমূহের মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা তা আমাদের ভাবাতে সাহায্য করে তাঁর উপন্যাস। যে-বিশ্বাস বা দর্শন তাঁর আরাধ্য, তাকে সবার সামনে মেলে ধরার লোভ নিশ্চয় তাঁর ছিল। তবে তা যে সরাসরি বলা চলে না বা এর পক্ষে তত্ত্বের বিসত্মার ঘটানো যায় না, সেটাও তিনি জানেন; সোজা কথায়, শিল্পের সীমানা তিনি মেনে চলেছেন আগাগোড়াই। প্রচলিত বিশ্বাস বা রীতিকে তিনি আঘাত করেছেন তবে তাও আরোপিত নয়, অর্থাৎ বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে উপযুক্ত কার্যকারণসূত্র ধরে। কবি হয়ে তিনি যে কবিতার পেলব কুসুমে দ্রবীভূত করে ফেলেননি উপন্যাসকে সেটা তাঁর বড় গুণ বলতে হবে। তবে তিনি প্রয়োজনে কবিতার সুষমাকে ব্যবহার করেছেন। ভাষা হিসেবে আলাদা কোনো প্রকরণ-কৌশল তিনি ব্যবহার করেননি। তবে তাঁর বাক্যবিন্যাস, শব্দপ্রয়োগ, গতিময়তা, রসবোধ ও
যুক্তি-দর্শন তাঁর উপন্যাসকে স্বতন্ত্র মহিমা দিয়েছে। বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়; অনেক ঋণাত্মক কথা বলেন সমালোচক। জনপ্রিয় সসত্মা ও ভাঁড়ামিপূর্ণ উপন্যাস দখল করেছে গড়পাঠকের মসিত্মষ্ক। সেখানে তিনি উপন্যাসের ধ্রম্নপদী ধারায় চলেছেন। তাঁর সমগ্র প্রকাশিত হলেও আমি তাঁর কাছে আরো উপন্যাস প্রত্যাশা করি এবং মনে করি যে, তাঁর শক্তির সবটা আমরা পাইনি। কখনো তিনি খুব দ্রম্নত উপন্যাস শেষ করেছেন বলে মনে হতে পারে। বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যের সার্বিক চরিত্র বিবেচনা করলে এবং তার সঙ্গে জুলফিকার মতিনের উপন্যাসের তুলনা করলে আমরা বলতে পারি, তিনি এদেশের উপন্যাস-সাহিত্যের একজন শক্তিমান প্রতিনিধি। তিনি খুব বেশি উপন্যাস লেখেননি, তবে যা লিখেছেন সেখানেই তাঁর শক্তি ও সম্ভাবনা সহজে শনাক্ত করা যায়।

জুলফিকার মতিনের সামনে পথচলার দিকে আমরা তাকিয়ে আছি তাঁর আরো কিছু উপন্যাস পড়ার আকাঙক্ষায়।