জোখা আল-হার্থি

একটি সাক্ষাৎকার ও একটি গল্প
ভূমিকা ও অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী
বহু বছর ধরে আধুনিক আরবি সাহিত্যের মোড়লগিরি মিসরের হাতে। লেবানন আরবি সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রধান কেন্দ্র। কখনো কখনো আলোকসম্পাত ঘটে সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিনের ওপর। কিন্তু ওমান কখনোই বিবেচনায় আসেনি।
এ-বছর ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পেলেন ওমানের জোখা আল-হার্থি। পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁর অনুবাদক ম্যারিলিন বুথও। পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাসটি হচ্ছে সেলেসচিয়াল বডিস। এই স্বীকৃতি তাঁকে এবং ওমানের সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যে তুলে আনল। এর আগে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন : ইসমাইল কাদারে (আলবেনিয়া ২০০৫), চিনুয়া আচেবে (নাইজেরিয়া ২০০৭), এলিস মুনরো (কানাডা ২০০৯), ফিলিপ রথ (যুক্তরাষ্ট্র ২০১১), লিডিয়া ডেভিস (যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩), লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (হাঙ্গেরি ২০১৫)।
২০১৬ থেকে প্রতিবছর পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে এবং এতে মূল লেখকের সঙ্গে অনুবাদককে পুরস্কারে সঙ্গী করা হচ্ছে। ২০১৬ : জ্যান ক্যাঙ্গ (দক্ষিণ কোরিয়া, অনুবাদক ডোরাহ স্মিথ), ২০১৭ : ডেভিড গ্রসম্যান (ইসরায়েল, অনুবাদক জেসিকা কোহেল), ২০১৮ : ওলগা তোরাক্রুজ (পোল্যান্ড, অনুবাদক জেনিফার ফ্রস্ট)।
জোখা আল-হার্থির জন্ম ১৯৭৮ সালে ওমানেই। পড়াশোনা ওমান ও যুক্তরাজ্যে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি, ধ্রম্নপদ আরবি সাহিত্যে। তাঁর অনুবাদক ম্যারিলিন বুথ তাঁর পিএইচ.ডি তত্ত্বাবধায়কদের একজন। তাঁর উপন্যাস তিনটি, ছোটগল্পের বই তিনটি।
জোখা আল-হার্থির একটি সাক্ষাৎকার ও একটি গল্প অনূদিত হলো :

এশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন : পশ্চিমের সমালোচক, প্রকাশনা সংস্থা এবং এমনকি আরবরাও কেন দশকের পর দশক ধরে ওমানি সাহিত্যকে তাচ্ছিল্য করছেন বা এড়িয়ে গেছেন?
উত্তর : ওমানি উপন্যাসের শুরুটা তুলনামূলকভাবে দেরিতে। সম্ভবত ষাটের দশকে ওমানি ঔপন্যাসিক আবদাল্লা আল তাকির (১৯২৪-৭৩) হাতে শুরু। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ওমানি লেখকরা তাঁদের বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। বলা যায় নতুন সহস্রাব্দে এসে ওমানি উপন্যাসের বিকাশ ঘটতে থাকে।
অল্পদিন আগে পর্যন্তও ওমানি সাহিত্য চক্রগুলো ছিল মূলত কবিতা প্রাধান্যের। আমার দাদাও ছিলেন সুপরিচিত কবি, তিনি তাঁর বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতেন, সেখানে তাঁরা আবু আল তায়ির আল মুতানাবিব (৯১৫-৯৬৫), আবু ইআলা আল মারির (৯৭৩-১০৫৭) ধ্রম্নপদ আরবি কবিতা আবৃত্তি করতেন। আমি তখন শিশু ছিলাম, কিন্তু আমি স্মরণ করতে পারি ধ্রম্নপদ কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি করতে না পারাটা একজন পুরুষের জন্য কতটা লজ্জার ব্যাপার ছিল। কাজেই কল্পনা করুন তরুণ ঔপন্যাসিক হিসেবে আমাকে আল মুতানাবিব এবং আল মারির মতো কবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দাঁড়াতে হবে। এখন এই প্রবণতা বদলে গেছে। ওমানিরা উপন্যাস পছন্দ করে। তবুও এটা দুর্ভাগ্যজনক, খুব কম ওমানি প্রতিষ্ঠানই সাহিত্যের এই শাখার বিস্তারে সহায়তা করে। আবার এটাও সত্য, অনেক আরব সমালোচক মিসর ও লেবাননকে মনে করেন আরবি সাহিত্যজগতের প্রকাশনার কেন্দ্রভূমি – তার মানে ওমানের ওপর খুব কমই নজর পড়ে। অনুবাদের ব্যাপারেও ঠিক তাই।
প্রশ্ন : আপনার উপন্যাস সেলেসচিয়াল বডিস আরবিতে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে কেবল গত বছর (২০১৮)। কেন?
উত্তর : ২০১০ সালে শ্রেষ্ঠ ওমানি উপন্যাস হিসেবে পুরস্কৃত হয়। ২০১৩ সালে ঠিক হয় ম্যারিলিন বুথ এ-উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন। আমার মনে হয়, তিনি ২০১৫ সালে অনুবাদ শেষ করেন। তারপর এটা প্রকাশ করতে কেটে গেছে আরো তিন বছর। আমার পিএইচ.ডি সুপারভাইজরদের একজনের বদলে আসেন ম্যারিলিন বুথ (হার্থি ধ্রম্নপদ আরবি ভাষায় পিএইচ.ডি, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে)। সে-সময় তিনি আমার উপন্যাসটি পড়েন এবং পছন্দ করেন। একটা উপন্যাস অনূদিত হয়ে বাজারে আসতে আট বছর কি বেশি সময় (হার্থি হাসেন) – বুকার শর্টলিস্টে আসা সুইডিশ ঔপন্যাসিক মারা স্ট্রিন্ডবার্গের উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে আরো আগে ২০০৬ সালে।
প্রশ্ন : আপনার উপন্যাস অনেক সংবেদনশীল বিষয়ে হাত দেয়, যেমন ওমানের ক্রীতদাস প্রথা। সাধারণভাবে আরব লেখকদের বেশি কেউ এ-বিষয়ে হাত দেননি। আপনার একটি প্রধান চরিত্র জারিফা একজন ক্রীতদাসী।
উত্তর : যেহেতু দাসপ্রথা বিষয়টির আলোচনাই অনেক নিষিদ্ধ, এ নিয়ে লিখতে ভীষণ সাহসী হতে হয়। কিন্তু এ-সমাজে বসবাসকারী অনেকের জীবনকেই দাসত্ব প্রভাবিত করেছে। দাসদের সন্তান-সন্ততি, তাদের সন্তান-সন্ততি রয়ে গেছে। আমাদের সমাজের সঞ্চরণ ও গতিশীলতা বুঝতে এটা ছিল আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমি এ-বিষয়ে অনেক গবেষণা করেছি, কিন্তু ওমানে তেমন কোনো দলিল পাইনি। আমাকে সাহায্য করেছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ। আমি সেখানেই আবিষ্কার করি কেমন করে দাস বিক্রি হতো এবং ওমানে পাঠানো হতো।
আমি অনেক বয়স্ক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, যাঁরা এখনো অনেক গল্প মনে রেখেছেন। অবশ্যই এটি বিবেচনার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট রয়েছে। যেমন আমার উপন্যাসে ক্রীতদাসী জারিফা তার মালিকের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রয়ে গেছে; কিন্তু তার ক্ষুব্ধ ছেলে দাসত্বের জোয়াল ঝেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
প্রশ্ন : সেলেসচিয়াল বডিসে নারীত্ব, অবিশ্বস্ততা ও দাম্পত্য জীবনের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওমানে ব্যাপারগুলোকে কীভাবে দেখা হয়?
উত্তর : কেবল ওমানে নয়, অন্যান্য আরব দেশেও যে ‘নৈতিক বিচারবোধ’ সে-দৃষ্টিতে আমার বই বড্ড বেশি উদারপন্থী। খোলাখুলিভাবে বলছি, আমি এসব সমালোচনায় কান দিইনি। যারা আমার বই নিয়ে আপত্তি জানায় তাদের নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। তাদের মতপ্রকাশের অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু যখনই আমরা সাহিত্যকে বাধাগ্রস্ত করি, সাহিত্য বিপন্ন হয়ে ওঠে। শিল্পবিকাশের পরিসর ছেড়ে দিতে হবে।
প্রশ্ন : আপনার উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্র পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক শাসনের কারণে পরোক্ষ ভোগাস্তির শিকার হয়, বিশেষ করে নারীরা পরাভূত রয়ে যায় – অবশ্য বিশেষ ব্যতিক্রম আপনার এক নায়িকা যার নাম লন্ডন, যে নজিরবিহীন স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করে।
উত্তর : ওমানে পুরনো পিতৃতান্ত্রিক শাসন ও ঐতিহ্য শত শত বছর ধরে সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। আমি অনেক ভাবি, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে মানুষ এখানে কেমন করে জীবন ধারণ করত। এমনকি বিংশ শতকের শুরুতেও একই ধারার জীবন ছিল। তেল আবিষ্কার হওয়ার আগে খুব শস্নথগতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। তেলের সঙ্গে প্রযুক্তি এসেছে। কাজেই যারা শত শত বছর ধরে অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করেছে, হঠাৎ তাদের বদলে যেতে হয়েছে। কিন্তু বদলে যাওয়া তো সহজ নয়। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে যখন আবদাল্লা ছোট ছিল, তখন যেসব বিষয় প্রশ্নাতীত বলে স্বীকৃত ছিল আশির দশকে এসে বদলাতে শুরু করে। নতুন সহস্রাব্দে এসে তাও বদলাল। এখনো বহু পরিবার পিতৃতান্ত্রিক শাসন এবং অনুরূপ বিধিবিধান রক্ষা করে চলেছে, তাদের আমত্মঃসম্পর্কের গতিশীলতাটি ভিন্ন।
আমি দেখছি একটি গাড়ি কিংবা একটি ফোন পাওয়া সহজ। কিন্তু আমার বাবার সঙ্গে কিংবা স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কটা বদলানো সহজ নয়। এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার নিজের একটি ছোট মেয়ে আছে। তার যা আছে আমি সেসবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, কারণ এগুলো সবই আমার জন্য নতুন। তাহলে ভাবুন আমাদের বাবারা কেমন বোধ করেছেন। আমি যেহেতু বিদেশে পড়াশোনা করেছি, আমার পক্ষে মানিয়ে নেওয়াটা সহজ হবে।
প্রশ্ন : আপনার উপন্যাসের আরবি ভার্সনের জন্য ‘চাঁদের নারী’ নামটি কেন নিয়েছেন, যদিও লন্ডনের বাবা আবদাল্লা এ-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র?
উত্তর : যদিও আবদাল্লার অধ্যায়গুলো প্রথম পুরুষে বর্ণনাকারী হিসেবে রাখা হয়েছে, তবুও উপন্যাসে নারীর ভূমিকাই অধিক কর্তৃত্বপ্রবণ। এতে একজন সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী নারীর পক্ষে কথা বলে। মূলত কন্যা লন্ডন, তার স্ত্রী এবং তাদের কাজের বুয়ার সঙ্গে আবদাল্লার সম্পর্ক ঘিরেই উপন্যাস বেড়ে উঠেছে। আপনি কি মনে করেন আমার উপন্যাসের নাম হওয়া উচিত ছিল ‘চাঁদের নারী এবং আবদাল্লা’ (তিনি হেসে ওঠেন)। বইয়ের একটি ভালো নাম বের করা খুব সহজ কাজ নয়। এমন কি ইংরেজিতেও – সেলেসচিয়াল বডিস। আমার কাছে অনেকগুলো নাম প্রস্তাবিত ছিল। বাদ দিতে দিতে এটাতে এসে ঠেকেছি।
প্রশ্ন : আপনার উপন্যাস পড়ার সময় অবাক হই আপনি কেমন করে উপন্যাসের প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে একই পৃষ্ঠায় সময়ের পেছনে যাচ্ছেন, আবার এগিয়ে যাচ্ছেন। ধ্রম্নপদ একরৈখিক বর্ণনার বিপরীতে আপনি পাঠকের সামনে তুলে ধরছেন কেমন করে চরিত্রের জীবন বদলাবে এবং কোন কারণে তাও বলছেন।
উত্তর : আমার ব্যাপারে সময়ের একটি আবর্তক প্রভাব রয়েছে। আপনি অতীত ও বর্তমানের তফাত করতে পারেন না। অতীত আমাদের স্মৃতির মাধ্যমে পরিস্রম্নত। ভবিষ্যতের মতোই এর সামনে অনেক সম্ভাবনা খোলা। সেজন্য চরিত্রকে তাদের অতীত থেকে উৎপাটন করা যায় না। অতীত তাদের বদলায়, তারা অতীতকে বদলায়। সময়ের কোনো প্রকৃত সীমান্ত নেই, যদিও মনে হয় অতীত আমাদের পেছনে।

জোখা আল-হার্থির Celestial Bodies যখন ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত হলো তখন লেখকের প্রতিক্রিয়া :
আমি আশা করছি আন্তর্জাতিক পাঠক সম্প্রদায় আবিষ্কার করবে যে, ওমানে একটি সক্রিয় ও মেধাবী লেখক সম্প্রদায় রয়েছে, যাঁরা শিল্পের জন্য কাজ করেন ও জীবনধারণ করেন। লেখালেখি বা শিল্পের আনন্দের জন্য পৃথিবীর অন্য যেকোনো স্থানের লেখক ও শিল্পীর মতো তাঁরা সংগ্রাম করেন, আত্মদান করেন। পৃথিবীর সর্বত্রই এটা ঘটে থাকে। লেখালেখির মধ্য দিয়ে ওমানিরা অন্যদের আমন্ত্রণ জানায় যেন, তারা খোলা মন ও অন্তর নিয়ে ওমানকে বিবেচনা করে। আপনি কোথায় বাস করছেন এটা বড় কথা নয়; ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, যন্ত্রণা, আশা এসবের অনুভূতি একই – এই সত্যটিকে বিশ্বাস করাতে মানুষকে আরো অনেক কাজ করে যেতে হবে।
সেলেসচিয়াল বডিস আরব ওমানি পরিবারের বর্ণিল জীবনের বিশেষ করে ওমানি ইতিহাসের একটি কেন্দ্রীয় সময়ে তিনটি বোনের বেড়ে ওঠার কাহিনি। আমি যে জীবনের বর্ণনা দিতে চেয়েছি তা ওমানি তরুণদের জীবনের প্রতিধ্বনি – পৃথিবীর এ অংশের সঙ্গে যাদের পরিচিতি নেই, তাদের কাছে উপস্থাপন করার মতো একবিংশ শতকের ওমানি সামাজিক একটি ছবি রয়েছে এই উপন্যাসে।

বিয়ে

জোখা আল-হার্থি

বিয়ের হলটা বিশাল আর কনের সিংহাসন অসংখ্য ফুল আর সাদা ও গোলাপি পর্দায় সাজানো।
নারীরা টেবিলের চারপাশে বৃত্তাকারে বসেছে। সালোমা তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসা, মাথা একেবারে উঁচিয়ে রাখাও না, আবার কাত করাও না। তার হাত দুটো নিজের কোলের ওপর, হাত দুটো স্বর্ণ ও অভ্রের আংটি, ব্রেসলেট এবং পুঁতিতে ঠাসা। গোড়ালি দিয়ে তার পা ভূমিতে প্রোথিত। আর ঠোঁটে অস্পষ্ট এক হাসি যেন তা তৃপ্তি ও আশীর্বাদের। তার জড়তাগ্রস্ত দৃষ্টি সোজা লম্বালম্বি বিয়ের কনের ওপর পড়েছে, কোনো রকম পিটপিট নেই।
বিয়ের দু-ঘণ্টারও বেশি সময় সালোমা তার আসন ছেড়ে ওঠেনি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়েনি, তৃপ্ত ও আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি এক মুহূর্তের জন্যও বদলায়নি – যেন এই চেয়ারে বসার জন্যই তার জন্ম হয়েছে, যেন এই বিয়ের হল ছাড়া অন্য কোথাও সে বসবাস করেনি; যেন অনন্তকাল ধরে সালোমা বিরাজ করছে, তার অস্তিত্ব মনে হচ্ছে অনন্তকাল এমনই থেকে যাবে।
এর আগে অন্তত দশজন পুরুষের সঙ্গে সালোমার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু এরকম জাঁকালো বিয়ে কখনো হয়নি। দোলায়মান পর্দা রয়েছে এমন কোনো কনের সিংহাসনে কখনো সে বসেনি। তার বরদের মধ্যে কেউই কখনো সবার সামনে হাত ধরে এভাবে তার পাশে বসেনি। যতবার তার বিয়ে হয়েছে মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ভারী স্কার্ফে ঢেকে রাখা হয়েছে তাকে। তার সেসব বিগত স্বামীর ক্ষমতার ওপর নির্ভর করত স্কার্ফ স্বর্ণখচিত, না কেবল সবুজ রঙের। গান গাইতে আসা নারীদের চাপে তার চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থা। তার নিজের বাড়ি থেকে তাকে সরাসরি বরের বাড়ি যেতে হতো। সেখানে ঘরের এক কোণে ছোট কার্পেট পাতা। তাকে সেখানে গিয়ে বসতে হতো, সবুজ স্কার্ফ এতোটাই ভারী যে, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। তাকে কেন্দ্রে রেখে অন্য মহিলারা বৃত্তাকারে মেঝেতে বসবে, সামনে থাকবে পেস্নটভর্তি হালুয়া আর কেটলিভরা তিতকুটে কফি। সারি বেঁধে পুরুষরা যখন এসে যায়, সারি বেঁধে নারীরাও বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নেয়। তারপর বর ও কনে রয়ে যায়। বর তার আবেগময় চেহারায় চোখের দিকে তাকায়, তার ব্রেসলেট, নেকলেস, কবচ, সোনা, রুপা ও রঙিন পস্নাস্টিকের ঝনঝন শব্দ শোনে, তবে এতকিছুর নিচে সালোমা কখনো হুমড়ি খেয়ে পড়েনি।
কিন্তু এ-রাতে যেন তার জন্যই তৈরি করা এই চেয়ারে সালোমা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হোক কি ইচ্ছাকৃতভাবে তার দৃষ্টি কনের ওপর নিবদ্ধ। তার চুলসজ্জার শৈলী বাইরে থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছে তার এমব্রয়ডারি করা স্কার্ফের ভেতর বেণির আকারটা কেমন। আর নাকে সোনার নথটি ফুলের মতোই, দেখে মনে হয় নাকের সঙ্গে এর অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক। আর তার আত্মবিশ্বাস – দারুণ। তার নয়টা মুরগি যে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্দেহ নেই। ভোরবেলাই সে মুরগির ঘর পরিষ্কার করেছে, ডিমগুলো বের করে নিয়ে এসেছে। তার দুপুরের খাবারের পর যেটুকু ছিল বিয়ের প্রস্ত্ততি নেওয়ার আগে সেগুলো মুরগিদের দিয়ে এসেছে। তারপর সে অতিথিদের বাসে চড়ে মাস্কাটের এই ওমানি নারী সমিতির বিয়ের হলের দিকে সরাসরি রওনা হয়।
মলিন একটু হাসি তার মুখে রয়েই যায়, তার মুখের চারপাশে কয়েকটা ভাঁজও তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। তার হাসিতে কোনো বক্রোক্তি নেই, সবটাই তৃপ্তির ও আশীর্বাদের। ডিম বিক্রি করে অনেকগুলো রিয়াল সে কামাই করেছে, তার পরনের ওমানি কুর্তাটি তার মেয়ের উপহার, প্রতি ঈদে সে মাকে দেখতে আসে। তার এই মেয়ের বাবা হচ্ছে তার চতুর্থ স্বামী। মাসের পর মাস ধরে সেই লোকটি তার হাঁটার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনুসরণ করেছে, উপশহর, পানির নালা, অপ্রশস্ত বস্তি পর্যন্ত তার পেছন পেছন হেঁটেছে – যতক্ষণ না সালোমার সম্মতি মেলে। তার সঙ্গে জীবনযাপন করার জন্য লোকটি তার শহর ও স্ত্রীকে ফেলে চলে এসেছে। খাবার সার্ভ করা হয়েছে, টেবিলে পেস্নট, কাঁটা চামচ, ছুরি রাখা আছে। গ্রিল করা মাংস, কেক এবং পেস্ট্রি টেবিলে টেবিলে বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু খাবারের দিকে সালোমার নজর নেই। পিঠ সোজা করে নিশ্চল অবস্থায় তার স্বাভাবিক দৃষ্টি পড়ে আছে বিয়ের কনের ওপর এবং কনের হাতের গোলাপগুচ্ছের ওপর। যখন তাকে খেতে বলা হয় সালোমা কেবল তখনই কাঁটা চামচ ও ছুরি নিয়ে খেতে শুরু করে – যেন সারাজীবনই সে কাঁটা চামচ আর ছুরিতে খেয়েছে। সানি নামে যে শরবতটা সে পছন্দ করল তার লালচে রং ঠোঁটে লেগে রইল। যখন সে তার হাত ওপরে তোলে বা নামায় চুড়ি এবং পোশাকের নিচে ঊর্ধ্ববাহুর বাজুবন্ধের টিংটিং শব্দ শোনা যায় – এই সাংগীতিক শব্দ বছরের পর বছর ধরে পুরুষদের যে মুগ্ধ করেছে সে-কথা ইতিহাস হয়ে আছে।
আমরা – আমি ও সালোমা পরস্পরকে চোখ টিপি, জিজ্ঞেস করি, ‘এই সালোমা, তোমার মেয়ের বাবার খবর কী? সেও কেন তোমাকে ছেড়ে চলে গেল?’
সে পিঠ সোজা করে দুহাতে কোমরের দুপাশ ধরে, চোখ তার জ্বলজ্বল করে, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আমরা বলি ‘বলতে হবে না’। সে খুশিমনে হাসে নিজের ঊরুতে চাপড় মেরে আমরা যা বলেছি তা নিশ্চিত সে-ইঙ্গিত করে মন্তব্য শোনায় : ‘হায় আল্লাহ – এটার জবাব দেওয়া যাবে না। আমি প্রতিদিনই আমার বাড়ির সামনে মাটিতে পোঁতা চুল, বিচ্ছিন্ন হাড় আর কালো সুতো পেয়েছি। মানুষ আমাকে এতো ঈর্ষা করে কেন? আমার তো কোনো ধারণাই নেই। আমি একজন অসুস্থ নিঃসঙ্গ নারী।’
আমরা সবাই সরাসরি তাকে ঠেকাই, ‘এটা ঠিক নয়। এখানে তোমার চেয়ে স্বাস্থ্যবান কেউ নেই। যদিও তোমার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, তোমার হাঁটার যে মনভোলানো ভঙ্গি তাতে এখানে-সেখানে যে-কেউ তোমাকে দেখলে মিউ মিউ করবে।’
আমাদের কথায় সে যে সন্তুষ্ট হয়েছে তার উজ্জ্বল রক্তাভ মুখম-লই সে সাক্ষ্য দেয়। সে আমাদের আশ্বস্ত করে এখনো তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু সালোমা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আসছে, কারণ মানুষগুলো বুড়ো আর বুড়োদের কেবল অভিযোগ করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
সালোমা রুমাল দিয়ে মুখ মোছে। ততক্ষণে তার পাশের মহিলারা সাজুগুজু শুরু করে দেয়। হাতব্যাগ থেকে পকেট-আয়না বের করে। ভুরু আবার ব্রাশ করে, ঠোঁটে আবার লিপস্টিক দেয়, মুখে পাউডার জড়ায়, চুলের গোছা পেছনে ঠেলে দেয়।
সালোমার কপালের সামনের দিকটাতে জাফরান পানির ছিটে লেগে আছে, তার কোনো হাতব্যাগ নেই, তার কখনো হাতব্যাগের প্রয়োজনও হয়নি। তার চারপাশের হাতব্যাগওয়ালা নারীদের দিকে তার নজরও নেই। ক্যামেরার সামনে কনের ওপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
একটি বৃত্ত তৈরি করে নাচার জন্য নারীরা এগিয়ে গেল। গানের বাণীর সঙ্গে বৃত্তটিও বড় হতে থাকে, সে-গানে কিছু সোয়াহিলি শব্দ থাকে। সালোমা সোয়াহিলি জানে না। অবশ্য তার স্বামীদের একজন খুব ভালো সোয়াহিলি বলত। তাদের বিয়েটা কয়েক মাসের বেশি টেকেনি। বিকেলে অন্যান্য নারীর সঙ্গে যখন তার সাক্ষাৎ হয়, সে হঠাৎ পিঠ ঠেস দিয়ে শুয়ে পড়ে, পা দুটি আড়াআড়ি করে, তার সেই স্বামীর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর নকল করে বলতে থাকে, ‘না না না, কসম আল্লাহর! সালোমা তোমার সঙ্গে আমার যেমন আরাম লাগে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে তা পাইনি। তুমি হচ্ছো আশীর্বাদ। তুমি হচ্ছো আল্লাহর দান। ৯৩ বছর তুমি কোথায় ছিলে? এই নাও মালপত্রের বাক্স, এই নাও গাধা, এই নাও খেজুর গাছ, সব তোমার, তুমি আমার সঙ্গে থাকো। এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?’
সালোমা উঠে বসে এবং হাসতে হাসতে বলে, ‘যখন আমার ছেলেটাকে জন্ম দিলাম, সে চলে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল তার মালপত্রের বাক্স। গাধা এবং খেজুর গাছ। ব্যস, এ নিয়ে কথা শেষ। যখন সে বাড়ি ফিরে আসত, আমি বাড়ি না থাকলে শয়তান-চোখা মহিলাটা বলত, ‘সে তো তার নাগরের কাছে গেছে’ – সব মিথ্যে। সবাই আমাকে ঈর্ষা করত। কিন্তু কেন? আমি জানি না। আমি তো নিঃসঙ্গ একজন অসুস্থ মানুষ।’ পিটপিট করে তাকিয়ে সে হাসত।
আমরা আপত্তি করতাম, ‘তোমার স্বাস্থ্য অনেক ভালো। আর তুমি এখন একা নও। তোমার ছেলে তো জেল থেকে বের হয়েছে, সে বিয়ে করবে, তুমি নাতি-নাতনি দেখার জন্য বেঁচে থাকবে।’ চোখ-ঝলসানো নাচের আলো আর উচ্চস্বর সংগীতের মধ্যে আগামী দিনের নাতি-নাতনির ছবি কি সে দেখতে পাচ্ছে? সে কি ভাবছে তারা দেখতে কেমন হবে? তার হ্যান্ডসাম ছেলের মতো, যে দেখতে অবিকল তার বাবার মতো, নাকি দেখতে মায়ের মতো হবে – বিয়ের খরচ কমাতে তার ছেলেকে তখন ভারতীয় কোনো মেয়ে বেছে নিতে হবে। এরকম বিয়ের আয়োজন তার পক্ষে কখনো করা সম্ভব নয়। এমনকি ওমানি সাধারণ যে বিয়ে, সে খরচই বা পাবে কোথায়? তার ছেলেকে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলতে হবে, তারপর তার নাতি-নাতনি দেখা হবে। তার অন্য ছেলের সঙ্গে তো দেখা হয় না বহু বছর। আল্লাহ তাকে নাও ছাড়তে পারেন। খরার বছর তার সপ্তম স্বামী তাকে বিয়ে করেছিল, সেদিন সে সালোমাকে ছেড়ে দেয়, একই দিনে ছেলেও মাকে ত্যাগ করে চলে যায়।
নাচের ফ্লোর থেকে ক্লান্ত নারীরা ফিরে এসে চেয়ারে বসে গা ছেড়ে দেয়। কনে অস্থির হয়ে ওঠে এবং দরজার দিকে তাকায়। গান ও শব্দ মিলিয়ে যেতে থাকে। অতিথিদের কেউ কেউ ফিরে যেতে শুরু করেন নিষ্কলুষ পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে, সালোমা গা এলিয়ে চেয়ারে বসে থাকে। যখন তার সঙ্গী ফিসফিস করে বলে বাস ছেড়ে দিচ্ছে, তখন সে এমনভাবে দ্রম্নত উঠে দাঁড়ায় যেন কখনো তার পিঠের ব্যথা ছিলই না। সে কনের সিংহাসনের দিকে এগোয়, কনের মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখে, কিন্তু কনে মাথা সরিয়ে নেয় পাছে তার বহু টাকা খরচ করে করা চুলের এই সাজ নষ্ট হয়ে যায়। সালোমা বিড়বিড় করে সুরা ফাতিহা পাঠ করে, তারপর হাঁটা দেয় – সেই একই ভঙ্গির হাঁটা, যা তাকে দশবার বিয়ের কনে বানিয়েছে। অতিথিদের মধ্য দিয়ে বিয়ের হলঘর পেরিয়ে বাসস্টপের দিকে চলে যায়।