ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিকে বলা যেতে পারে ঢাকা শহরের গুলশান। এখানে প্রযুক্তিবিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানির হেড অফিস, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন গজিয়ে উঠছে ছানাপোনা আরো অনেক নাম-না-জানা অফিস। যে-কোনো মুহূর্তে এই এলাকার কোনো একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপেস্নক্স ধরে ঝাঁকি দিলে শয়ে শয়ে প্রকৌশলী আর কম্পিউটার প্রোগ্রামার বের হয়ে আসবে – অনেকটা ভরা মৌসুমে বরই গাছ ঝাঁকি দিয়ে গাছতলা ভরে ফেলার মতো। এই প্রযুক্তিবিদদের অধিকাংশই ভারতীয় নয়তো চায়নিজ। আমাদের মতো কিছু খুচরা বাংলাদেশিও আছে, যাদের বাইরের লোকে ভারতীয় বলেই মনে করে – শুধু আমরা ছাড়া। পেছনে পেছনে আমরা ওদেরকে বলি অ্যান্ডু – ইন্ডিয়ানের সংক্ষিপ্ত আর চায়নিজদের ডাকনাম দিয়েছি চ্যাংক্কু। তবে সাদা বর্ণের মানুষদের কাছে আমরা শুধুই এশিয়ান। সাদারাও ভেতরে ভেতরে খুব রেগে থাকে আমাদের মানে এই এশিয়ানদের ওপরে। আমাদের উৎপাতে সাদারা এই এলাকায় এখন সংখ্যালঘু। দিন দিন ওদের দোকানপাট এশিয়ানদের দখলে চলে যাচ্ছে। আজকে অনেকদিন পর ফ্রিমন্ট হাবে এলাম। এলাকাটা চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সার সার ভারতীয় শাড়ি, গহনা, রেসেত্মারাঁ, ভোজ্যপণ্য আর কাঁচাবাজারের দোকান। এমনকি কোনার দিককার এক আমেরিকানের ল-ফার্মের জায়গাটা বদলে গিয়ে ভারতীয় নামের কেউ একজন তার ট্যাক্স অফিস বসিয়েছে।

তানভীর বলে উঠল, ‘আরে এটা তো দেখি এখন পুরোপুরিই গান্ধীনগর হয়ে গেছে।’

আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, বিজ্ঞান আর ধর্ম দিগন্তরেখার মতো অবশেষে কোনো এক জায়গায় গিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

‘আচ্ছা, তানভীর, তোমার কি কখনো মনে হয়েছে কারমা আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ? এসব হচ্ছে সব কারমা। সাদাদের অপকর্মের কর্মফল।’

‘কীভাবে?’

‘কে ভেবেছিল পলাশীতে যে-সূর্য ডুবেছিল, ২৫০ বছর পরে তাই আবার একদিন উদিত হবে সিলিকন ভ্যালিতে? কল্পনা করো তো স্বর্গ আর নরকের মাঝামাঝি নো ম্যান’স ল্যান্ডে এসে নবাব সিরাজউদ্দৌলা উত্তেজিত স্বরে লর্ড ক্লাইভকে বলে যাচ্ছেন, ‘তোমাদের ছিল কূটবুদ্ধি আর আমাদের হলো ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি।’

‘ব্রিটিশদের এতো ভিলেন বানিয়ে দিচ্ছ কেন? ওদের লেখাপড়ার সিস্টেম দিয়েই তো আমরা উঠলাম।’

‘একদম ভুল কথা। ওদের সিস্টেম আমাদের কেরানি বানিয়ে দিয়েছে। শশী নায়ারের বইটা পড়োনি?’

তানভীরের একটা ফোন এলো। ‘দিমি, তুমি ইন্ডিয়া বাজারের ভেতরে গিয়ে গ্রোসারিটা করে ফেল। এজেন্ট ফোন করেছে। আজকেই বোধহয় সাইন করতে যেতে হবে।’

আমার পেটের ভেতর প্রজাপতির পাখার ঝাপটানি! আমাদের আরেকটা বাড়ি হবে! হি হি হি। একেই বলে কারমা! প্রথমে আমরা সাদাদের চাকরিগুলো দখল করলাম, এখন করছি তাদের বাড়ি। এতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চায়নিজরা। ফিবছর চায়না থেকে বস্তায় বস্তায় ডলার এনে ঢালা হয় সিলিকন ভ্যালির রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগে। বাদামিরা সুন্দর করে না পিছিয়ে বরং এক পা এক পা এগিয়ে গিয়ে সুন্দর পিছাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে কোম্পানির বিগ বস আর জমির মালকিন জমিদার। ফলে সাদারা ক্রমশ পিছু হটতে থাকে আরো সস্তা কোনো জায়গার সন্ধানে।

 

দুই

অ্যান্টিয়ক শহরটি আগে কেমন ছিল তা বলতে পারবো না তবে বর্তমানে এশিয়ান আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের আধিক্য। এই শেষের সম্প্রদায়টির জন্য খুব কষ্ট হয়। আগে ছিল সাদাদের দাস, এখন তারা এশিয়ানদের ভাড়াটিয়া। এই শহরটি মূল সিলিকন ভ্যালি থেকে খানিকটা দূরে। তবে সিলিকন ভ্যালি দিন দিন উত্তপ্ত কড়াই হয়ে পড়ায় নতুন অভিবাসী এশিয়ানরা ধীরে ধীরে এ-অঞ্চলে বসতি গড়তে শুরু করছে। আর পুরনো খানদানি অভিবাসীরা তাদের হাইটেক রোজগারের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এই এলাকার বাড়িগুলো কিনছে। এই এলাকার সাদা রং খুব দ্রুত বদলে গিয়ে বাদামি আর কালো হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের প্রতিবেশীদের রং এতো দ্রুত বদলাতে দেখে ডোরা আর জ্যাক ঠিক করল, তারাও তাদের বাড়ি বিক্রি করে দেবে। এরপর তারা উঠবে পঞ্চাশ বা ষাটোর্ধ্ব বয়স্কদের জন্য গড়ে ওঠা কোনো কমিউনিটিতে, যেখানে রঙের ধূসরত্ব কম। আর ঠিক এ-কারণেই সে-সময়টায় ডোরা আর জ্যাক দম্পতির সঙ্গে আমাদের পরিচয়। বিনিয়োগকৃত সম্পত্তি হিসেবে আমরা তাদের বাড়িটা কিনছি। বাড়ি বিক্রির দালাল এই কেনাবেচার কাজটি প্রায় গুছিয়ে এনেছে। আজকে আমরা এসেছি তাদের বাড়ি দেখতে। তানভীর দালালের সঙ্গে বাড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমার আগ্রহ বাড়ির মালকিনের ব্যাপারে। আন্দাজ করতে পারি দুজনেই পঞ্চান্ন পার করেছেন। নিঃসন্তান। তবে জ্যাককে বয়সের তুলনায় অনেক বুড়ো লাগে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় জ্যাক কিছুটা অসুস্থ। পারকিনসন্সের প্রাথমিক অবস্থা। এখন সে আর কোনো চাকরি করে না। অনেকদিন ধরেই। সারাদিন বাসাতেই থাকেন। শোয় ছিলেন মিউজিশিয়ান। স্যাক্সোফোনের মতো ভারী একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। সে-তুলনায় ডোরা অনেক সুস্থ সবল এবং মেদহীন। একশ্রেণির আমেরিকান আছে যাদের কাছে নিজের শরীর আর ঘরবাড়ি টিপটপ রাখা হচ্ছে প্রতিদিনকার প্রার্থনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ডোরা সেই শ্রেণির। বাড়ির কাজ, চাকরি আবার অসুস্থ জ্যাককে দেখাশোনার সব কাজ সে একাই করছে। শুধু তাই-ই নয়, সংসারের সব হিসাবনিকাশ, খরচপাতির দায়িত্বও তার ঘাড়ে। প্রতিটি পুরুষই বোধহয় তাদের রূপকথার গল্পে এরকম একজন প্রেমময়ী, স্নেহময়ী মায়াবতী স্ত্রীর সন্ধান করে। ওদের একটানা পঁচিশ বছরের সংসার। খেয়াল করে দেখলাম বাড়িটা ডোরার নামে। হয়তো সে-ই কিনেছিল একসময়।

 

তিন

সেদিন বাসায় যেতে যেতে ভাবছিলাম একেই বলে প্রেম! হয়তো অল্প বয়সে স্যাক্সোফোনের সুরের জাদুতে সেই যে ডোরা ঘায়েল হলো তো হয়েই থাকলো। এখনো তাতে খাদ পড়েনি। স্বামী অসুস্থ, এমনকি নিজেদের কোনো সন্তান নেই, তারপরও ডোরা সংসারটাকে ধরে রেখেছে। পরম মমতায়। সমরেশ মজুমদারের কালবেলা উপন্যাসের মাধবীলতার পরে এই আরেক ডোরাকে দেখলাম; কিন্তু মাধবীলতা তো কাল্পনিক। আর ডোরা বড়ই বাস্তব। তাও আবার পশ্চিমা কন্যা। এই বিষয়টা নিয়ে একদিন একটি গল্প লিখতে হবে। পাশে ড্রাইভ করা তানভীরকে কথাটা বললাম।

‘গল্পের নামটা যদি দাও – বেকার ছেলে আর কর্মজীবী মেয়ে’ তাহলে জমবে ভালো। আমাদের দেশের বাংলা সিনেমা – বড়লোকের মেয়ে আর রিকশাওয়ালার ছেলে টাইপের।’ তানভীরের নির্বিকার মতামত।

‘বেকার শব্দটির ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। ছেলেদের প্রতি এ বড়ই অন্যায়। পয়সা উপার্জন করতে না পারে কিন্তু বস্ত্তত কেউ কখনো পুরোপুরি কর্মহীন থাকতে পারে না। মেয়েদের ব্যাপারে অনেক অবিচার হলেও বাংলা ভাষার দিক থেকে তাদের বরং কিছুটা আহ্লাদীপনা করে তোলা হয়। দেখবে বাংলায় কখনো বেকার মেয়ে কথাটি বলা হয় না। বড়জোর বলে আইবুড়ো মেয়ে। তাও একবার যদি বিয়ে হয়ে যায় তো মেয়েদের আইবুড়োত্ব পুরোপুরি ঘুচে গেল। জ্যাকের বেকারের বদলে আমি বরং বোহেমিয়ান বা ভ্যাগাবন্ড ব্যবহার করবো।’

 

চার

পরদিন জ্যাক আর ডোরার বাসায় আমাদের আবার যেতে হলো। ওদের ছবির মতো সাজানো লিভিংরুমে বসে অনেক কথা হলো। আমি ইন্টেল করপোরেশনে চাকরি করছি শুনে জ্যাক জানালো তার বাবাও ইন্টেলে কাজ করতেন। সেখানে তো কতজনই কাজ করে তাই আমি আর অতো উৎসাহ দেখালাম না।

জ্যাক নিজেই বললো, ‘আমার বাবা হচ্ছে ইন্টেলের চার নম্বর এমপস্নয়ি।’

এবার আমার হতবিহবল হওয়ার পালা। আমরা যারা সিলিকন ভ্যালি থাকি এবং সেইসঙ্গে প্রযুক্তি লাইনে কাজ করছি তারা জানি যে আইবিএম, এইচপি, ইন্টেল, সান, মাইক্রোসফট, অ্যাপেল, ইয়াহু, গুগল কিংবা হালের ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলোর গোড়াপত্তনের সঙ্গে জড়িত থাকার মানে কী! এদের একেকজন একেকটা বিস্ময়! প্রতিভা আর ব্যাংক ব্যালেন্স – দুটোর দিক থেকেই। তাঁরা খ্যাতিমান, কীর্তিমান এবং স্বভাবতই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁরা থাকেন সিলিকন ভ্যালির পালো আল্টো, লস আল্টোস কিংবা এথারটনের মতো এলাকাগুলোতে। এথারটনে একটা মাঝারি মাপের বাড়ি কিনতেই লাগে ছয় মিলিয়ন ডলার।

জ্যাক জানালো, কয়েক বছর আগে ২০১১ সালে তার বাবা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছেন। এই ধরনের পদক সাধারণত আমাদের দেশের স্বাধীনতা পদকের মতো। ভদ্রলোক তো তা পাবেনই। এতো বড় প্রকৌশলী! জ্যাক বড় হয়েছে লস আল্টোসে। তারা দুই ভাই। আরেক ভাই ম্যানহ্যাটনে থাকে। জ্যাক পড়াশোনা করেছিল মিউজিকের ওপরে। ডোরা ছিল জ্যাকের প্রতিবেশী। বোঝা গেল একটা সময় ডোরাকেই দুরু দুরু বক্ষে জ্যাকের মনোযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

পেছনের ঘটনা জানার পর হঠাৎ করেই দেখলাম জ্যাকের ব্যাপারে আমার প্যারাডাইম মানে দৃষ্টিভঙ্গি পালটে গেল। ভাবলাম, জ্যাকের তো আসলে এসব গানবাজনাবিষয়ক পড়াশোনা করারই
কথা। ধনকুবের ওয়ারেন বাফের ছেলে সানফ্রান্সিস্কোয় পিয়ানো বাজায়। তবে তার ব্যাংক ব্যালান্স দশ মিলিয়ন ডলার। বাবার থেকে নাকি শুধু অতোটুকুই পেয়েছে। ওয়ারেন বাফে মনে করেন, বিত্তশালীর ঘরে সন্তানরা আসলে মুখে সোনার চামচের বদলে জন্মগ্রহণ করে পিঠের পেছনে সোনার ছুরি নিয়ে। একটু অতৃপ্তির মধ্য দিয়ে বড় না হলে জীবনের চালিকাশক্তি মন্থর হয়ে যেতে পারে।

সাইড টেবিলের মধ্যে জ্যাক আর ডোরার বিয়ের অ্যালবাম ছিল। আমি এবার তা উৎসাহ নিয়ে দেখতে শুরু করলাম। রীতিমতো একটি রূপকথার বিয়ে। জ্যাক আর ডোরাকে একদম  আসলেই রূপকথার রাজকন্যা আর রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগছিল।

 

পাঁচ

সেদিন বাসায় ফেরার পথে তানভীর জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার গল্পটা কি এবার বদলে দিচ্ছ?’

আমি বললাম, ‘না। শুধু টাইটেলের ভ্যাগাবন্ড শব্দটা বদলে যাবে।’

‘বদলি শব্দটা কী হবে?’

‘জ্যাকপট।’