জয়নাল মাস্টার

দিলওয়ার হাসান

আজ থেকে বছর দুয়েক আগে নেতার সঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছিলেন মালঞ্চ গ্রামের যে-চার কৃষক, নেতার আগমন সংবাদ শুনে যারপরনাই খুশি হলেন। সাব্যস্ত করলেন কাল নেতার মিটিংয়ে যাবেন জেলা শহরে। নেতার কথা উঠতেই জয়নাল মাস্টারের কথাও মনে এলো তাদের। কারণ, জয়নাল তাদের এলাকার নেতা। তার বাড়িতেই নেতার সঙ্গে তারা পাত পেতে খেয়েছিলেন। জয়নালের স্ত্রীর রান্না করা মুড়িঘণ্ট, ইলিশ মাছের পাতুড়ি, কচুর শাক আর পুঁটি মাছের ঝোল দিয়ে নেতা ভাত খেয়েছিলেন পেটপুরে। পাইপ ধরিয়ে সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে বলেছিলেন, ‘জয়নাল, তর বউ দেখি খুব ভালো রান্না করে।’ বিদায় নেওয়ার সময় ওই চার কৃষকের সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন তিনি। এখন তারা সে-কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আহা, কত বড় একজন মান্সের লগে দেখা অইচিলো আমাগো। এই মানুষ অ্যাহন দ্যাশের ভাগ্যবিধাতা!’
নেতার মিটিংয়ে যাবেন বলে জয়নাল সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেজে আধাবাটি সর্ষের তেল গায়ে মেখে পুকুরে গিয়ে নামলেন তিনি। বেঁটেখাটো মানুষ। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, কুচকুচে কালো গায়ের রং। ঠোঁটজোড়া টকটকে লাল। পান-খাওয়া লাল নয়, সত্যিকারের লাল। মাঝেমধ্যে পান তিনিও খান। তবে তার নেশা করা বগলা সিগ্রেটে।
জয়নাল আবেদিন মালঞ্চ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তবে দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করে থাকেন কৃষিকাজে, ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি। নেতার দলের থানা পর্যায়ের নেতা তিনি। নিজেকে কৃষক ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন। ক্ষেতে হাল দেওয়ার সময় তার পরনে থাকে গেঞ্জি আর প্যান্ট। খুব নাকি সুবিধা হয়। দেখে গ্রামের লোকজন প্রথম প্রথম খুব হাসাহাসি করত। বলত, ‘জয়নাল হইতাছে আমাগো ভদ্দরলোক চাষা।’ তবে তার মতো একজন ব্যতিক্রমী মানুষ এ-তল্লাটে দুটি নেই। তার বাড়িতে বিরাট লাইব্রেরি। তাতে নানান ধরনের বই। একটা হারকিউলিস সাইকেলে চড়ে তিনি এলাকার সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। কাঁধে থাকে একটা ঝোলা। ঝোলার ভেতর বিশুদ্ধ পানির বোতল, তুলো-ব্যান্ডেজ-ডেটল, পেটের পীড়ার বড়ি, চিড়া-মুড়ি, সুই-সুতো মায় নানা জাতের ফল আর সবজির উন্নত বীজ। সাইকেলে করে তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যান। চাষিদের মধ্যে বিতরণ করেন উন্নত জাতের বীজ। মাসকয়েক পরে ওই গ্রাম দিয়ে যাওয়ার সময় চাষিরা তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। তার দেওয়া বীজে উৎপাদিত ফল কিংবা সবজি খেতে দেন। তার সঙ্গে নানা বিষয়ে পরামর্শ করেন। কেউ কেউ তাকে দিয়ে চিঠি কিংবা দরখাস্ত লিখিয়ে নেন। দুনিয়ার নানান বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ করেন।
বামপন্থী দলের কোনো নেতা এ-অঞ্চলে এলে জয়নালের সঙ্গে দেখা করেন। তার বাড়িতে একবেলা ডাল-ভাত খান। নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। একবার এক বাম নেতা তাকে বলেছিলেন, ‘আপনার স্বভাব চরিত্রের যে-পরিচয় আমরা পাই, তাতে মনে হয় ওসব মাল্টিক্লাস অরগানাইজেশনে আপনি কাজ করতে পারবেন না। আপনার ক্লাস ক্যারেকটারের সঙ্গে ঠিক মেলে না। আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।’ কিন্তু জয়নাল কিছুই বলেননি। নেতার দল ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি? সবকিছু হাসিল করতে হবে গণতান্ত্রিক পন্থায়, অন্য কোনোভাবে নয়। তার সব ভাবনা দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে। কথা উঠলে প্রায়ই বলেন, ‘একই দেশ; কিন্তু দুপ্রান্তের মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধানই না ছিল। ব্রিটিশ  যেতে-না-যেতেই আওয়াজ তুলতে হলো, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়।’ ছয় দফা, এগারা দফায় উঠে এলো এদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কথা। কিন্তু তাতেও কূল-কিনারা কিছুই হলো না।
‘আগরতলা মামলায় নেতা গেলেন জেলে। ধমক ছাড়া আইয়ুব-ইয়াহিয়ার মুখে কোনো কথাই ছিল না। তারপরও সত্তর সালে এদেশের মানুষকে ঠেকাতে পারেনি। ভোটের অধিকার ছিনতাই হলে গুলি-বন্দুক নিয়ে নামতে হলো একাত্তরে। অস্ত্র নিয়ে লড়ার কথা আমারও মনে হয়েছিল; কিন্তু নেতা কোনোদিন এসব চিন্তা মনে ঠাঁই দেননি। না, গণতান্ত্রিক পন্থায় সবকিছু হাসিল করতে হবে, অন্য কোনো উপায়ে নয়। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে যখন বলছেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, তখন মনে আর দ্বিধা ছিল না।’
এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে ভারতে চলে গিয়েছিলেন মাস্টার। মাসতিনেক পর ফিরে এসেছিলেন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। ছোটখাটো মানুষটা পুরো পাঁচটি মাস স্বর্ণকমলপুর এলাকাটি একেবারে গরম করে রেখেছিলেন পৌনঃপুনিক ও অতর্কিত গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে। ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখে জনাতিরিশেক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন। বড় বড় চুল, গোঁফ-দাড়ি আর জলপাই রঙের শার্ট-প্যান্ট পরনে ছিল তার। কেউ চিনতে পারেনি তাকে। মালঞ্চের লোকেরা বলাবলি করেছিল, ‘এডা আবর কেরা আইলো আমাগো গেরামে?’
নেতা তখন পাকিস্তানের জেলে। তার কথা ভেবে-ভেবে  নিদ্রাহীন কত রাত যে জয়নাল যাপন করেছেন চোখের পানিতে ভেসে, তার লেখাজোখা নেই। সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে নেতা একদিন ফিরেও এসেছিলেন। সেই ছবি খবরের কাগজে দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন জয়নাল। তার সহযোদ্ধা আর দলের লোকজন তখন লুটপাট আর বিহারিদের বাড়ি দখলে ব্যস্ত। কিছুই করতে পারেননি জয়নাল। আর তখন তো বাজার থেকে সব জিনিসপত্রই উধাও Ñ চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, কেরোসিন। বেশি টাকা দিলে সবই পাওয়া যায়। ন্যায্যমূল্যের দোকান খুলেছে সরকার। সেগুলোও পার্টির লোকেদের দখলে। রাতের অন্ধকারে কালোবাজারিদের হাতে মাল তুলে দিয়ে সকালে বলছে Ñ বেচাবিক্রি শেষ। আবার আসলে পাবেন…। কী করবেন জয়নাল?
কঠোর পরিশ্রমী মানুষ তিনি। হাঁটতে পারেন মাইলের পর মাইল। বক্তৃতা করার সময় মাইক লাগে না তার। খুব কম খান তিনি, ঘুমানও কম। ভাত-কাপড়ের জন্য কখনই দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না তাকে। তবে সব সময় দারিদ্র্যের ধার ঘেঁষে চলতে হয়। দুটো ভালো-মন্দ খাওয়া হয় না। নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়াও নেই তার। দুটো খদ্দরের পাঞ্জাবি, দুটো পাজামা কিংবা একটা-দুটো শার্ট-প্যান্টেই চালিয়ে নিতে পারেন। প্রচণ্ড তার ধৈর্য, সহনশক্তি বিস্ময়কর। যুদ্ধের সময় উপোস দিয়ে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। ঝড়-জল বা এরকম ছোট কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেননি। নেতা তাকে পছন্দ করেন খুব। তিনি সব সময়ই চেয়েছেন সৎ, সাহসী, কর্মিষ্ঠ এই স্কুলশিক্ষক তার দলের থানা কমিটির নেতৃত্ব দিক, আসুক জেলা কমিটিতে; কিন্তু এসবে কোনো মোহ ছিল না তার। একবার নেতা খুব চেপে ধরায় বলেছিলেন, ‘গরু-গাধা পিটিয়ে খাই। এসব করার জন্য বেশ কিছুটা সময় হাতে রাখতে হয়। দলের দায়িত্ব কাঁধে নিলে ওসব করব কখন? আমি তো আছিই আপনার সঙ্গে।’ নেতা একরকম বাধ্য হয়েই বলেছিলেন, ‘কর তোর যেভাবে খুশি…’

গোসল শেষ করে শীতে কাঁপতে-কাঁপতে বাড়ি ফেরেন জয়নাল। সাবানে কাচা সাদা একটা পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে তার ওপর হাতাবিহীন ক্ষুদ্রাকৃতির কালো কোট পরেন। নেতাও পরেন। কালো ফ্রেমের চশমা, পাইপ, ক্ষুদ্রাকৃতির কালো কোট, সফেদ পাঞ্জাবি, ঢোলা পাজামা আর গমগমে কণ্ঠস্বর তাকেই শুধু মানায়। তার কখনো কখনো মনে হয়, তিনি শুধু নেতাই নন, যেন এক মহান কবি। এক স্বপ্নের জাদুকর। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বুলিয়ে সুখের একটি সমাজ এনে হাজির করবেন মানুষের সামনে…।
জয়নাল সবসময় ভাবেন নেতা তো এলেন কেবল। এত বড় একটা যুদ্ধ গেল। এখন কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই। সব ভার নেতার ওপর। থানা কমিটির নেতাদের কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে একেকজন। জয়নাল ঠেকাতে পারছেন না তাদের। তিনি ভাবেন, দেখা যাক নেতা কী করেন? সাক্ষাতে সব বলবেন তাকে। যা করার তিনিই করবেন। এভাবে কি আর চলে?
পাটালি গুড় দিয়ে খানকয়েক আটার রুটি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন। অনেক বেলা হয়েছে। থানা কমিটির ভাড়া করা বাস যাবে জেলা শহর স্বর্ণকমলপুরে, কিন্তু ডামাডোল সইতে পারেন না তিনি। ভালো লাগে না হই-হল্লাও। একা-একাই যেতে চান তিনি। মাইল পাঁচেক সাইকেল চালিয়ে বাস স্টপেজে পৌঁছে যান। পরিচিত এক দোকানে সাইকেলটা রেখে বাসে ওঠেন। তিলধারণের জায়গা নেই। সবার লক্ষ্য নেতার সভাস্থল। স্বর্ণকমলপুর শহরটা যত এগিয়ে আসে, জয়নালের উত্তেজনাও তত বাড়তে থাকে Ñ এই তো আর কটা মুহূর্ত। তারপর দেখা হবে নেতার সঙ্গে। এসব ভাবনায় তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়। বাস থেকে নেমে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পানি খান। গলাটা কেন যেন শুকিয়ে আসছে। খুক-খুক করে কাশেন। চা খান। তারপর সিগ্রেট ধরিয়ে হন-হন করে হাঁটতে থাকেন।
নেতার মিটিংয়ের ভেন্যুটা জয়নালের পরিচিত। তিনি নিজেও বক্তৃতা দিয়েছেন এখানে অনেকবার। সেসব ছিটেফোঁটা স্মৃতি তার মনে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে এবং সেই স্মৃতিকাতরতার ভেতরেই তিনি মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। চারদিক লোকে লোকারণ্য। গমগম করছে সভাস্থল। শোনা গেল ইতোমধ্যেই নেতা এসে পৌঁছেছেন। যুদ্ধের পর এই প্রথম এলেন এ-শহরে।
ভিড় ঠেলে মঞ্চের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন। বুকের ভেতর ধক্ধক্ করছে। ওই তো স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তিনি বসে আছেন। মুখটি ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
নেতার চোখে-মুখে তখন অদ্ভুত এক অস্থিরতা। রুমালে মুখ মুছছিলেন বারবার। তাকাচ্ছিলেন এদিক-ওদিক। জয়নাল মঞ্চে উঠতে গেলে নিরাপত্তারক্ষীদের একজন বাধা দিলেন তাকে। অপ্রত্যাশিত ওই বাধার মুখে নিজের পরিচয় দিলেন সবিস্তারে। বললেন নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা। তারপরও নিরাপত্তারক্ষীদের একজন বললেন, ‘পরে আসুন। এখন তার কাছে যেতে পারবেন না।’
কী করবেন ভেবে পেলেন না। উসখুস করতে লাগলেন। মঞ্চের সিঁড়ির কাছ দিয়ে পায়চারি করতে লাগলেন অস্থির হয়ে। জয়নাল মাস্টারকে দেখে কিংবা তার কথাবার্তা শুনে কি বোঝার উপায় আছে রাসেলের হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি বাংলায় তর্জমা করেছেন তিনি। ডেমোক্র্যাসির ওপর তার লেখা ভার্নাকুলার ডেইলিতে ছাপা হয়। জাগরী উপন্যাসের ওপর তার ক্রিটিসিজম পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত মুগ্ধ হন।
জয়নাল স্যান্ডেল খুলে মাথা নিচু করে নিজের পায়ের পাতা অবলোকন করেন। অনেকক্ষণ ধরে কুটকুট করছে। শীত এলেই ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ভ্যাসেলিন-ট্যাসেলিন না-মাখলে একেবারে রক্তটক্ত বেরিয়ে পড়ে। খুব ছোটাছুটি করা পা তার।
জেলা কমিটির সেক্রেটারি মোশফেক উদ্দিন খান লাজু মিয়াকে নেতা বললেন, ‘জয়নালকে দেখছি না যে?’
‘আসেনি বোধ করি।’
‘আমার মিটিংয়ে সে আসবে না, এটা হয় কখনো? নিশ্চয়ই এসেছে। দেখো কোথায় গিয়ে বসে আছে। ওকে হাজির করো আমার সামনে।’
তিনি পাইপ ধরলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে লাজু মিয়া এসে বললেন, ‘না, লিডার জয়নালকে পাওয়া গেল না। আসলে তো আশপাশেই থাকত।’ নেতা খুবই বিরক্ত হলেন। প্রচার সম্পাদক গিরিজা প্রসাদ রন্টুকে ডেকে বললেন, ‘যেখান থেকে হোক জয়নালকে খুঁজে বের করো।’ মুহূর্তের মধ্যেই মাইকে ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ল, ‘মালঞ্চের জয়নাল ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, মঞ্চে এসে হাজির হোন। নেতা আপনাকে খুঁজছেন।’
একটু পরে সাদা পোশাকধারী পুলিশের এক লোক জয়নালকে মঞ্চে নিয়ে এলেন। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নেতা। জয়নালের চোখের পানি নেতার ক্ষুদ্রাকৃতি কালো কোট ভিজিয়ে দিলো। রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি? কখন থেকে খুঁজছি তোকে। কেমন আছিস, তোর বউ-ছেলেমেয়ে কেমন আছে?’ কান্নাভেজা স্বরে জয়নাল বললেন, ‘আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওরা…।’
‘ও বুঝেছি। আজকাল এই হয়েছে এক যন্ত্রণা। ওরা সিকিউরিটির জন্য এসব করে বুঝলি। আচ্ছা ঠিক আছে, তোর জন্য বিশেষ পাসের ব্যবস্থা করব।’
মনে কত কথা জমে আছে; কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলেন না জয়নাল। জনতা নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। জেলা কমিটির নেতারা বক্তৃতা করছিলেন। কেউ শুনছে বলে মনে হচ্ছে না।
একটু পরে বহু বিশেষণে ভূষিত হয়ে তাঁর নামটি উচ্চারিত হলে ডায়াসের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুহাত তুলে জনতাকে অভিবাদন জানালেন তার সেই চিরাচরিত ভঙ্গিমায়। মুহুর্মুহু করতালিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া জনতার কণ্ঠস্বর থেকে প্রশান্তিমূলক ধ্বনি উত্থিত হয়। তিনি বাঁ-হাত ডায়াসে স্থাপন করেন। ডান হাতের তর্জনী জনতার দিকে নির্দেশিত। তিনি বলতে থাকেন Ñ ‘ভাই ও বোনেরা আমার, যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে এখন, এ-সময়টাতে আমি আপনাদের কিছু দিতে পারব না। এই দেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব সবার। দেশের পুনর্গঠনে আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই। যেমন করে আপনারা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তেমনি করে আজ দেশ গড়ার কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করুন…।’ অতঃপর দুহাত তুলে দেশ গড়ার ব্যাপারে প্রতিশ্র“তি আদায় করলেন জনতার কাছ থেকে। ইদানীং সব মিটিংয়েই এ-কাজটি করছেন।
মিটিং শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। নেতার খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছিল মিটিংস্থল সংলগ্ন জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়। হরেকরকমের খাবারের আয়োজন হয়েছিল। নেতা জয়নালকে তার পাশে বসালেন। ডিশ থেকে আস্ত মুরগির রোস্ট তার প্লেটে তুলে দিয়ে বললেন, ‘খা জয়নাল, আমি দেখি।’ স্থানীয় নেতারা এতে জয়নালের ওপর যারপরনাই নাখোশ হলেন। রোস্টটা নেতার জন্য স্পেশালি বানানো হয়েছিল। সে-কথা তারা আকার-ইঙ্গিতে জয়নালকে বোঝাতেও চেষ্টা করেছেন। জয়নাল যে এসব বোঝেননি তা নয়। তিনি তো আর হাড়-হাভাতে নন। রোস্টটি তার পাতে পড়তেই প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘না লিডার, এটা আপনার জন্য, আমি…।’ নেতা এসব কানেই তুললেন না। একটা মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ‘খা তো দেখি। তুই ভোজনরসিক মানুষ। তোর বউ তো খুব ভালো রাঁধে। খেয়েছি না কতবার। একবার যাব তোর বাড়ি।’
‘এখন কি আর…?’
‘দেখি না…।’
তিনি খানিকটা পুঁইশাক আর কুঁচো চিংড়ির তরকারি নিলেন। ‘এখন আর আগের মতো খেতে পারি না রে…।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নেতা বললেন।
তার সঙ্গে কথা বলার জন্য লোকাল লিডাররা কখন থেকে উসখুস করছেন; কিন্তু তিনি জয়নালের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন ক্রমাগত। তার কথা ফুরাতেই চায় না। সবাই তখন জয়নালের ওপর প্রকাশ্যেই বিরক্ত। একজন লোকাল লিডার প্রকাশ্যেই বলে উঠলেন, ‘জয়নাল ভাই কি শুধু বকবক করবেন, না লিডারকে খেতে দেবেন।’ লজ্জায় মাথা নত হয়ে এলো তার। নেতার ভ্রুক্ষেপ নেই কোনো দিকে। বললেন, ‘সারাজীবন তো কষ্টই করে গেলি, তোর যখন যা দরকার বলবি আমাকে, লজ্জা করবি না।’
‘না, বলছিলাম কী আপনি তো জানেন গরু-গাধা পিটিয়ে মানুষ করার কাজ আমার। স্কুলটার জন্য…।’
‘সব করব রে জয়নাল। অনুমোদন, টিচার্স বেনিফিট, নতুন বিল্ডিং সব। কিন্তু তোর নিজের কী লাগবে, তাই বল!’
‘আমার? আমার আবার কী লাগবে। ধুর কিস্সু না… এলাকার কিছু সমস্যা আছে। জিনিসপত্রের দাম চড়া, অনেক কিছু আবার পাওয়াও যায় না। ন্যায্যমূল্যের দোকানের জিনিস সব কালোবাজারিদের হাতে চলে যাচ্ছে। খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, লুটপাট লেগেই আছে। জায়গাজমি দখল করছে পার্টির লোকজন। মানুষের খুব কষ্ট লিডার, আর ওই…।’
‘বাদ দে এসব। সব জানি তো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, প্রথম প্রথম হয় এসব। তুই নিজেও তো জানিস ইতিহাস। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটুখানি সময় তো দিবি আমাকে…।’ কত কথা ভেবে রেখেছিলেন জয়নাল। কিছুই বলা হলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। হাত ধুয়ে ফিরে এসে দেখলেন কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ঘিরে ধরেছেন তাকে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন। জার্মান টেলিভিশনের এক মহিলা সাংবাদিক সাকি এসেছেন, নেতার ইন্টারভিউ করবেন। সাংবাদিক-পরিবেষ্টিত নেতা ডাকবাংলোর কনফারেন্স রুমে গিয়ে ঢুকলেন। জয়নাল ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। এতো লোকজনের মধ্যেও নিঃসঙ্গ মনে হলো নিজেকে। এই বোধ নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডের পথ ধরলেন।
বাস থেকে নেমে আবার সাইকেলে চেপে বসলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দ্রুত প্যাডেল মারতে লাগলেন। নেতার সঙ্গে অনেক ভালো-ভালো খাবার খেয়েছেন আজ। অস্বস্তি লাগছে। অনেকদিন পর ভূরিভোজ হয়েছে। পেটটা কেমন ভারী হয়ে আছে। মনটাও ভারাক্রান্ত। কিছুই বলা হলো না। নেতা শুনতেও চাইলেন না। বলে কোনো লাভও হতো না Ñ এরকম একটা সান্ত্বনা মনকে তিনি দিতে পারলেন, তবে অতৃপ্তির একটা ভারী বোঝা মনের মধ্যে থেকেই গেল। কী হবে শেষ পর্যন্ত? এভাবে আর কতদিন চলবে?

নিরুপায় মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারা জয়নালের কাছে এসে হামলে পড়ে। অ্যাহন আমরা কী করুম মাস্টার, কী খামু? কী পিন্দুম?
দশ টাকা সেরের চাল কজন কিনতে পারে? টাকাই বা তাদের কোথায়? বছরখানেক আগেও এক টাকা পাঁচ সিকেয় বিকিয়েছে। গ্রামে আজকাল কাজকর্মও নেই।
প্রায় উপায়হীন জয়নাল তার স্কুলের মাঠে একটা লঙ্গরখানা খুলেছেন বাড়ি বাড়ি থেকে চাল-ডাল কুড়িয়ে এনে। ‘দেশ গড়ায় ছাত্র সমাজ’  নাম দিয়ে পতিত জায়গায় আলু, সবজি আর কাঁচামরিচের চাষ করিয়েছিলেন ছাত্রদের দিয়ে। ফলনও ভালো হয়েছিল। ভেবেছিলেন এগুলো বিক্রি করে একটা ফান্ড রেইজ করবেন নিরক্ষরদের অক্ষরজ্ঞান করার জন্য। সে আর হলো না। শিক্ষার চেয়ে খিদে বড়। আলু-সবজি বেচার টাকা লঙ্গরখানায় লাগাতে হলো।
ডিসি সাহেবের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। ঠাটবাটের আমলা হলেও গ্রাসরুট লেভেলের এই সৎ রাজনৈতিক কর্মীটিকে চিনতে পেরেছিলেন। চাল আর গমের কিছু বরাদ্দ জয়নাল পেয়েছিলেন। থানা কমিটির লিডাররা তখনো নিজেদের আখের গোছানোর কাজে  ব্যস্ত। জয়নালের দিকে ফিরেও তাকালেন না। বরং দূর থেকে সমালোচনার হুল ফোটাতে লাগলেন। জয়নাল নাকি এসব করছেন নেতা হওয়ার জন্য!
অভাবের এই দিনগুলোয় নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে গমের জাউ, তেলকা খিচুড়ি আর শাকপাতা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন জয়নাল। ফান্ডের অভাবে স্কুলটাও ঠিকমতো চলছে না। ড্রপ-আউটের সংখ্যা বাড়ছে দিনদিন। ক্ষুধার সামনে পৃথিবীর আর কিছুই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
ওদিকে অস্ত্রধারী কিছু যুবকের আবির্ভাব ঘটেছে ইদানীং। বুঝেসুজে ঠিক রাতের বেলা তারা গ্রামে আসে। ‘দুনিয়ার সর্বহারা এক হও’ বলে স্লোগান দেয়। সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে যায়, মাঝেমধ্যে দূর থেকে গুলির ফুটফাট আওয়াজ ভেসে আসে। ক্যাম্প থেকে রক্ষীরা ছুটে যায়; কিন্তু কারো নাগাল পাওয়া যায় না। নিরীহ কজন যুবক হয়তো অ্যারেস্ট হয়ে রাতারাতি জেলা সদরে চালান হয়ে যায়।
জয়নাল ঢাকা যান। নেতার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন, পারেন না। বোধকরি সেই সিকিউরিটির কারণেই সব ভেস্তে যায়। জয়নাল থামে না।
এলাকায় চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। ডায়রিয়া হচ্ছে খুব কচুঘেচু খেয়ে। জয়নাল জেলা সদরে যান। ডিসি সাহেবের কাছ থেকে ওষুধপত্র কিছু আদায় করে তবেই ঘরে ফেরেন। ডিসি সাহেব একদিন বললেন, ‘আর কতদিন এভাবে চালাবেন মাস্টার সাহেব?’
‘দেখি না স্যার। হাল ছেড়ে দিলে তো আর…।’
ডিসি শুকনো হাসলেন।
সাইকেল নিয়ে ঘুরে-বেড়ানো প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। স্কুলে যান। লঙ্গরখানার জন্য এদিক-ওদিক থেকে খাবার জোগাড় করে আনেন। দলের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। ওরা তাকে ডাকে না। জয়নালের মতো মানুষকে দিয়ে কী করবে ওরা?
স্কুলটা ঠিকমতো চলছে না বলে দুঃখ হয় জয়নালের। ছেলেমেয়েরা যা-ই হোক লেখাপড়া কিছু শিখছিল। ভবিষ্যতে কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে পারত হয়তো। সে-ও তো এখন বন্ধ হওয়ার পথে। একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হু-হু করা সর্বনেশে ঝড়, সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু কোথায়, কেউ জানে না। কখন কী হবে তা-ও কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
এই তো কদিন আগে সিসিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খুন হলেন। দুষ্কৃতকারীরা তার বাড়িতে ঢুকে গুলি করেছিল। থানা কমিটির মেম্বার ছিলেন। যাওয়ার সময় হত্যাকারীরা ‘শ্রেণী শত্র“ নিপাত যাক’, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’, ‘দুনিয়ার সর্বহারা এক হও’ Ñ এসব স্লোগান দিয়ে গেছে। ঘটনার পর রক্ষীরা গ্রামের বেশকজন যুবককে নিয়ে মারধর করেছে। থানা কমিটির সেক্রেটারি আবু লায়েস প্রাণভয়ে ঢাকা চলে গেছেন।
শ্রমিক নেতা নবু মিয়ার লাশ পাওয়া গেছে যমুনার চরে। কারা মেরেছিল, কেউ জানে না। ঢাকা থেকে মন্ত্রীরা এসেছিলেন জানাজায় অংশ নিতে। তারা বলে গেছেন, যে-কোনো মূল্যে নবু মিয়ার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা হবে। তাও মাসতিনেক হলো। পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি।
জয়নাল মাস্টারের লঙ্গরখানা বন্ধ হওয়ার পথে। চাল-তেল-নুন কিছুই জোগাড় করা যাচ্ছে না। আলু ছিল কয়েক বস্তা। খিচুড়িতে দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছিল। জয়নালের ছাত্ররা ওগুলো সেদ্ধ করে কাঁচামরিচ দিয়ে বুভুক্ষুদের পাতে তুলে দিচ্ছে।
অবস্থা যখন এরকম তখন এক সকালে রেডিওতে এক রাগী মেজরের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। নেতাকে মেরে ফেলার খবর প্রচার করছিলেন। জয়নালের রেডিওটা বিকল হয়ে আছে কমাস ধরে। তাছাড়া সকালবেলা রেডিও শোনার সময় পান না জয়নাল। ক্ষেত-খামারের কাজ করে স্কুলে ছোটেন। আজও সকালে সবজিবাগানে কাজ করে এসেছেন। হঠাৎ কোথা থেকে পাশের বাড়ির কোব্বাত এসে হামলে পড়ল তার সামনে Ñ ‘নেতারে তো মাইরা ফালাইচে…।’ অবিশ্বাস্যে ফেটে পড়ে জয়নাল বললেন, ‘কী আজগুবি কথা বলছ, কে মারবে তাকে?’
একজন-দুজন করে ততক্ষণে শখানেক লোক তার বাড়ির সামনে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘অ্যাহন আমরা কী করুম, কুথায় যামু? দ্যাশের অবস্থা কী হইবো? আবার যুদ্ধ লাগবো নাহি?’
হাত থেকে কাস্তেটা পড়ে গেল। কিছুই বলতে পারলেন না জয়নাল। বাক্যহীন দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন আর কোনোদিনও কথা বলবেন না।
সকাল থেকে পানিটুকুও মুখে দেননি। দুপুর ঘনিয়ে এলে তার ছেলেমেয়েরা তাকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা নিল; কিন্তু কিছু খেতে পারলেন না তিনি।
দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার আগেই থানা কমিটির সব নেতা ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন।
বিকেলের দিকে পুলিশের একটি দল জয়নাল মাস্টারের বাড়ি ঘেরাও দিয়ে ধরে নিয়ে গেল তাকে।
কাঁদতে কাঁদতে থানায় ছুটল তার ছেলেরা। ওখানে গিয়ে শুনল, ওদের বাবাকে জেলা সদরে চালান করে দেওয়া হয়েছে।